অতলান্তিক

রুবিনার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে একান্ন বছর বয়সী শাফায়েত হোসেন অনেকটা জড়মূর্তির মতো বসে থাকেন। প্রায় দু-মিনিট সময় পেরিয়ে গেলেও তিনি চায়ের কাপে ঠোঁট স্পর্শ করাবার পরিবর্তে বারান্দার বাইরে শেষ বিকেলের এক চিলতে উজ্জ্বল বর্ণময় আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবেন। ব্যাপারটা গুরুতর কিছু নয় অথচ হঠাৎ এমন কেন হলো! সম্ভবত মাঝে মাঝে হয়, সব মানুষের। চায়ের কাপটা স্ত্রীর কাছ থেকে গ্রহণ করার সময় শাফায়েত হঠাৎ চমকে উঠেছিলেন। এতকাল পর তাঁর মনে হলো, ঈষৎ কুঞ্চনের রেশ ধরা বিবর্ণ এই আঙুলগুলি কার? তিনি কি ওই মুহূর্তে অবচেতনে ঘোরের মধ্যে ছিলেন – তাঁর চোখে কি ভাসছিল পঁচিশ বছর আগের এক তরুণীর মেহেদিরাঙা সেই পেলব হাতখানা? জ্যোৎস্নার মতো স্পর্শদেওয়া আঙুলগুলি? মনে আছে, ১৪ অক্টোবর সকাল সাড়ে দশটার দিকে এমনই স্বপ্নময় স্নিগ্ধ হাতে এক কাপ ঘন কফি এগিয়ে দিয়েছিল রুবিনা। অথচ আজ তাঁর সামনে কর্কশ বিবর্ণতা। সময় – হতচ্ছাড়া মহাকালই সবকিছু নষ্টের মূলে। সে-ই নীরবে বয়ে আনে অন্ধকার, বিনাশ ও ধ্বংসের বার্তা। তার সামনে নিতান্ত নিরুপায় আর অসহায় এই আদমসন্তানেরা। ঘন দুধের ধোঁয়া-ওঠা তপ্ত চা-ই চিরকাল পছন্দ শাফায়েতের, যদিও পাকস্থলীর ক্রনিক আলসারের কারণে স্নেহ-তরল বাতিল হয়েছে বহু আগেই। এই মুহূর্তে জুড়ানো লাল চায়ে মুখ দিয়ে কেমন একটা বিস্বাদের ভোঁতা রেশ ছড়িয়ে পড়ে পুরো শরীর-মনে। 

শাফায়েত নিস্পৃহ থাকতে চান, কিন্তু মনের ভেতর থেকে থেকে কত যে জিজ্ঞাসা খোঁচা মারতে থাকে তার ইয়ত্তা নেই। মানুষ নিজেকে সৃষ্টির এক কেন্দ্রবর্তী ও অনিবার্য বিষয় বলে মনে করলেও শাফায়াত হোসেনের এ-নিয়ে বরাবরই সংশয় হয়; সেই সন্দেহবোধটা ইদানীং আরো বাড়ছে। তাই যদি হবে, মানুষের এত দুঃখ-যন্ত্রণা কেন এই পৃথিবীতে? কেনই বা বিড়াল-পায়ে বার্ধক্যের নিষ্ঠুর গ্রাস? তিনি প্রায়ই অর্থ খুঁজে পান না এই ষাট-সত্তর বছরের মৃত্তিক-জীবনের। নিজেকে তবু নানাভাবে প্রবোধ দিতে চান, রক্তজমাট আঘাতে শীতল বরফ ঘষেন। বাঁচাটা সহজ নয় কোনোমতে – বেঁচে থাকতে হলে তো নিজেকে প্রতিনিয়ত প্রবোধ দিতে হয়। তাই বইয়ের পাতায়, ওয়েবসাইটে, কিংবা কখনো কোনো বন্ধুর মুখে খুঁজে বেড়ান কাক্সিক্ষত আলোর আভা। তাঁর জেনে ভালো লাগে স্টিফেন হকিংয়ের মতো চিন্তাবিদ মৃত্যুর আগে শেষবাণীতে প্রকারান্তরে আশাবাদের কথাই শুনিয়ে গিয়েছেন, অথবা এমনও হতে পারে বিজ্ঞানীর নিরপেক্ষ বাক্যে শাফায়েতই নিজের মতো করে বিশ^াস ও আস্থা খুঁজে নিয়েছেন। অন্য কারো কাছে এসব বক্তব্যের ভিন্ন অর্থও হতে পারে।  মোবাইলে ‘মিস্ট্রি অব লাইফ অ্যান্ড ডেথ’ সার্চ দিয়ে গুগল ঘাঁটতে-ঘাঁটতে এক অদ্ভুত ভিডিও আসে চোখের সামনে। শে^তাঙ্গিনী নারী বিরল এক অভিজ্ঞতা বিষয়ে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন, সঙ্গে নির্মিত দৃশ্যও দেখানো হচ্ছে। বৃত্তান্ত হলো – হার্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ডাক্তাররা সিসিইউতে ওই নারীকে মৃত ঘোষণা করেছিলেন। এর মধ্যে নিউজিল্যান্ডের ষাট বছর বয়সী নারী এলিনা কুপার নাকি খোদ স্বর্গেও ঘুরে এসেছেন। তিনি প্রথমে টের পান শরীর মেঘের মতো হালকা হয়ে ভেসে যাচ্ছে। এলিনা প্রথমে কিছু দেখতে না-পেলেও বাতাসে অভূতপূর্ব এক সৌরভ পাচ্ছিলেন। ধীরে ধীরে ঘোর কুয়াশা, মগজের আচ্ছন্নতা কেটে যায়। দৃষ্টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হাওয়ায় ওড়া ফিনফিনে শুভ্র পোশাক পরিহিত দেবদূতেরা তাঁকে স্বাগত জানায়। এলিনা তাদের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকেন, রূপের ছটায় মুগ্ধ না-হয়ে পারা যায় না, দেখে নারী না পুরুষ তা বোঝা মুশকিল। যেন গভীর ঘুম থেকে জেগে মায়ের কণ্ঠ শুনে চোখ মেলে তাকান তিনি। ‘এলিনা, কোনো ভয় নেই, তুমি এসে গিয়েছ আমাদের কাছে। এখানে আমরা খুব ভালো আছি, ভীষণ সুখে ও আনন্দে আছি; তুমি এসে গিয়েছ, আরো ভালো থাকব সবাই।’ মায়ের চেহারায় অপার প্রসন্নতা আর আনন্দের দ্যুতি দেখে এলিনারও ভীষণ ভালো লাগে। 

মা – সত্যি কি মা? মা তো মরেছিল সত্তর বছর বয়সে। সে অমন যুবতী হয়ে উঠল কী করে? একি কোনো ইন্দ্রজাল? চারপাশে তাকিয়ে দুবার চোখ কচলে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করেন এলিনা। না, স্বপ্ন তো এমন স্পষ্ট আর আলোকিত হয় না কখনো। তার ঘুম-স্বপ্ন চিরকালই বিবর্ণ কিছু চলমান ছবি মাত্র। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মিষ্টি রোদ, দুলতে  থাকা বিচিত্র-বর্ণিল গাছের পাতা, পাখির সুমিষ্ট কলরব, দৃষ্টিনন্দন রঙিন লঘু মেঘপুঞ্জ তাকে নিশ্চিত করে – আমরা মিথ্যে নই কেউ। তুমি বাস্তবে – না, বরং বাস্তবের চেয়ে অধিক বাস্তবতায়। তোমাদের পৃথিবীই বরং ছিল এক মরীচিকা মাত্র। আশ্চর্য – এখানে প্রকৃতিরও ভাষা আছে – সে-ভাষা মানুষ বুঝতে পারে। তাহলে তো ঝরনাধারা, মেঘপুঞ্জ, জ্যোৎস্না, পাখি কিংবা মাছ – সকলেই এখানে মানুষের বন্ধু হয়ে ওঠে। এলিনা অপলক দৃষ্টিতে দেখতে থাকেন চারপাশ।

যুগ-যুগ চেয়ে থাকলেও দেখার তৃষ্ণা মিটবে না যেন। এই অভূতপূর্ব পরিপাশর্^ দেখে আনন্দে তাঁর চোখে জল আসে। সামনে জীবন্ত, উষ্ণ-কোমল, দীপ্তিময়ী তরুণী মাকে পেয়ে আনন্দে প্রায় বাকরুদ্ধ অবস্থা হয় তাঁর। ‘এটা কোন জায়গা মা?’ তিনি প্রাণপণে মাকে স্পর্শ করতে হাত বাড়ান।

‘কেন এটাই তো স্বর্গ। তুমি এখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ।’ ঠিকই আছে এ তাঁর মায়েরই কণ্ঠ। কিন্তু কথায় কী এক আশ্চর্য মধু জড়ানো। এতকাল মায়ের কণ্ঠ তো এতটা মিষ্টি বোধ হয়নি! 

তারপর একে একে বাবা, অকালপ্রয়াত ছোটভাই, দাদু এসে হাসিমুখে তাঁকে বরণ করে নেয়। ওদের চিনতে অসুবিধে হয় না এলিনার – যদিও তারা কেউ নাবালক কিংবা বৃদ্ধ নয় – সকলেই তরুণ, সবার বয়স যেন একই। আশ্চর্য – এমনও হতে পারে, এখানে কি কোনো সময়ের বন্ধন কিংবা ক্ষয় নেই!

পরিজনের উষ্ণ স্পর্শ আর পরিপাশের্^র নয়নাভিরাম দৃশ্য এলিনাকে মোহাবিষ্ট করে তোলে। চারপাশের বৃক্ষরাজি, পাহাড়, ঝরনার সৌন্দর্য দেখে তৃপ্তি মেটে না। আর কর্ণকুহরে বর্ণিল পাখির কূজন চেতনাজুড়ে সুখানুভূতির আবেশ গড়ে দিচ্ছে। ছোট ভাই রবিন হাত ধরে নিয়ে চলল ঝরনার পাশে। ‘আপু, তুমি ফিরে এলে, আমার কী-যে ভালো লাগছে। আমি কেবল দিন গুনেছি তুমি কবে আসবে, কবে আসবে।’ এলিনা স্বচ্ছ জলে নেমে রবিনের সঙ্গে খেলছিল, ওদের পাশাপাশি সাঁতরে বেড়াচ্ছে অজস্র বর্ণিল মাছ। ঠিক তখনই আবার দৃষ্টিটা ঝাপসা হয়ে আসে। আবার কুয়াশা। শীতল নিস্তব্ধতা। আবারো অন্ধকার। ডাক্তার পরে জানান – এলিনার ক্ষেত্রে রীতিমতো এক মিরাকুলাস ব্যাপার ঘটে গিয়েছে। এগারো মিনিট তার হৃৎপিণ্ড বন্ধ ছিল। তাঁরা তাকে মৃতই ধরে নিয়েছিল। এখান থেকে কোনো মানুষের ফিরে আসার দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে।

এলিনা কুপারের কথাগুলি শুনতে মন্দ লাগে না শাফায়েতের, মনে আশাবাদও সঞ্চারিত হয়। যাক, তাহলে এখানেই সবকিছু শেষ নয়। আলোর পরে অন্ধকার, এই অন্ধকারই চূড়ান্ত নয় – তারপর আবারো জ্যোতির অনন্ত আহ্বান। আমরা অহেতুক দীর্ঘশ^াসে নিজেকে ভারাক্রান্ত করি – বিনাশ এলে নতুন সৃষ্টিরই বার্তা নিয়ে আসে চিরকাল। বাহ্, এই তো সবকিছু মিলে যাচ্ছে। এমনটা ভাবতেই তো পছন্দ করে আসছেন সেই কিশোর বয়স থেকে। কিন্তু আশ^াস স্থিত হতে-না-হতেই আবার দু-চার ঘণ্টা বাদে মনে নানাবিধ সংশয় উঁকি দিতে থাকে। এলিনা কুপারের ওই ঘটনাগুলি যে নিতান্তই তার স্বপ্নের ভেতর ঘটেনি তাই-ই বা কে বলবে? কিন্তু চিকিৎসকরা যে বলেছিলেন তার হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে গিয়েছিল!

শাফায়েত হোসেন রাত একটার দিকে ঘুমন্ত স্ত্রীর পাশে যখন শুতে গেলেন তখন বাইরে ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে। তিনি ভেবেছিলেন, শীতল আবহাওয়ায় দ্রুতই মসৃণ ঘুমে তলিয়ে যাবেন। একবার বোধহয় চোখজোড়া এঁটে এসেছিল, তখন প্রবল বজ্রপাতের শব্দে চমকে ওঠেন। পাশ ফিরে দেখেন রুবিনা দিব্যি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ও বেশ ভালোই আছে, শাফায়েতের মতো নয় – বেশিরভাগ বিষয় নিয়েই নির্বিকার, নিরুদ্বেগ, নিশ্চিন্ত। মিনিট-দশেকের চেষ্টায় আবারো ঘুমিয়ে পড়তে ব্যর্থ হয়ে শাফায়েত সাদা মশারির ভেতর থেকে বের হয়ে আসেন। ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালে ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে চোখেমুখে বৃষ্টির হালকা ছাঁট এসে লাগতে থাকে। অন্ধকারে দৃষ্টি রেখে আজ বিকেলে দেখা রুবিনার কুঞ্চিত আঙুলগুলির কথা আবারো মনে পড়ে। এভাবেই বোধহয় পৃথিবীর সবকিছু দিনে দিনে ক্ষয়ে আসে, যাবতীয় ঔজ্জ্বল্যকে গ্রাস করে হিংস্র অন্ধকার।

রুবিনার সঙ্গে তাঁর পরিচয় যখন, তখন ও মাত্র অনার্র্স ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। কী দুর্দান্ত আবেগ আর রোমান্টিকতার মধ্যে কেটেছে প্রথম পর্বের দিনগুলি! হঠাৎ চোখের সামনে বিদ্যুতের আলো আকাশটাকে খণ্ডিত করে দেয়। আবার বজ্রপাত, বৃষ্টির দাপট বাড়ছে। শাফায়েত হোসেন বিছানায় গিয়ে ঘুমন্ত রুবিনার একখানা হাত আলগোছে টেনে নিয়ে নিজের বুকের ওপর রাখেন। স্ত্রীর হাতে মেহেদির গন্ধ, আজ সন্ধ্যায়ই লাগিয়েছিল। এই গন্ধটা ডেকে আনে সেই প্রথম পুষ্পরাত্রি। তিনি আর ভাবতে চান না, প্রথম রাত – প্রথম স্পর্শ! ওই রাতের কথা ভাবলে চোখে জল আসার উপক্রম হয় তাঁর, নিজেকে তখন ভীষণ বোকা-বোকা লাগে। প্রতিটি দাম্পত্যরাত্রি যদি পুষ্পরাতের মতো হতো! শাফায়েত হোসেন নিজেকে সামলে আলো-আঁধারিতে স্ত্রীর সৌম্য মুখখানি একবার দেখে নেন। আজকাল দিবালোকের চেয়ে এই জ্যোৎস্নার মতো কোমল আলোতেই ওকে দেখে প্রশান্তি আসে। কোমল আলো – তুমি খুব ভালো – তুমি যত্ন করে ঢেকে রাখো চামড়ার সূক্ষ্ম খাঁজ, নিপুণ তুলিতে প্রলেপ মেখে দাও আঁখি-পল্লব আর চিবুকের অমোঘ মøানিমা। কিন্তু তুমি তো মৃত্যুকে রুখতে পারো না। বাইরে বাতাসের শনশন – বৃষ্টি বাড়ছে।

বাড়ুক। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। এবার বোধহয় ঘুম আসবে। বিছানার বালিশে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করার পূর্বমুহূর্তে ডিমলাইটের আলোতে ঘরটাকে সত্যিই জ্যোৎস্নালোকিত স্বপ্নময় মনে হতে থাকে তাঁর।

পরদিন সকালে তাঁর ঘুম ভাঙে মাইকে একটি মৃত্যুসংবাদ শুনে। ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না লিল্লাহি রাজিউন’ কথাটুকু কানে এলে মৃতের নাম-পরিচয় জানার জন্য রাস্তার দিককার, মানে উত্তরের বারান্দায় এসে দাঁড়ান। কাজী রফিকুল্লাহ – এ তো তাঁরই সহকর্মীর নাম। বয়সে তাঁর চেয়েও কিছু ছোট হবে, কীভাবে মারা গেল মানুষটা – রিকশাটা দ্রুত চলে যাওয়ায় মাইকে সেসব কথা তো স্পষ্ট শোনা গেল না। দেয়ালঘড়িতে সকাল আটটা দশ। কাকে ফোন দেওয়া যায়? না থাক, আগে দেখি ফেসবুকে কিছু আছে কি না। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে দু-তিন মিনিটের মধ্যেই বিস্তারিত পাওয়া গেল ওই ফেসবুকেই। গত রাতে দেড়টার দিকে হাসপাতালে এক অসুস্থ আত্মীয়কে দেখে মোটরসাইকেলে বাড়ি ফিরছিল রফিকুল্লাহ, মাঝপথে কারিগরি স্কুলের সামনে মাথায় বাজ পড়ে। স্পট ডেড। দুঃসংবাদটা শাফায়েতকে খুব বেশি বিচলিত করতে পারে না দেখে নিজেকে মনে মনে ধন্যবাদই দেন তিনি। তাই তো – অহেতুক আর হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে কী লাভ? ওই অন্ধকার তো ওঁৎ পেতে আছে যে-কাউকে যখন-তখন গ্রাস করার জন্য।

মাইকে শোনা ঘোষণা অনুযায়ী মাগরিবের পর শাফায়েত হাজির হয়ে যান মসজিদ চত্বরে। নতুন নির্মিত সুরম্য শুভ্র মসজিদের সামনে বিশাল বৈদ্যুতিক বাতিতে আলোকিত আঙিনার পশ্চিম দিকে স্টিলের রুপালি খাটিয়ায় রাখা লাশ। অনিচ্ছাসত্ত্বেও কৌতূহলী মানুষের সঙ্গে লাইন ধরে শাফায়েতও এগিয়ে যান কাজী রফিকুল্লাহকে দেখতে। মৃতের নাকের পাশ দিয়ে তখনো এক ফোঁটা রক্ত চোয়ানোর দাগ, সেখানে একটা কালো মাছি উড়ে বেড়াচ্ছে। জানাজার নামাজ শেষে সালাম ফেরানোর সময় বাঁ-পাশে দাঁড়ানো মানুষটাকে হঠাৎ চেনা মনে হয়। মানুষটাও তাঁর দিকে এক পলক তাকালে দৃষ্টিবিনিময় হয়। কয়েক মুহূর্ত পরে সে-ই বলে ওঠে, আপনি কি শাফায়েত?

হ্যাঁ, বলতে-বলতে লোকটার মুখের দিকে তাকান। না, চেনা লোক নয় তো। কখনোই দেখেননি এই চেহারা।

কেমন আছেন আপনি?

এই তো চলছে। 

চলুন ও-দিকটায় নিরিবিলি একটু কথা বলা যাক।

অচেনা লোকের আহ্বানে সামান্য সংকোচ হয় শাফায়েতের, চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। তবে যে এক ঝলক লোকটার মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন তাতে লোকটাকে অন্তত ভয়ের কিছু মনে হয়নি। তাই জানাজায় সমবেত মানুষগুলিকে রেখে নির্জন একটা পথ ধরে এগিয়ে যেতে থাকেন।

লোকটা বলেন, আচ্ছা সেদিনের কথা আপনার মনে আছে না? গলায় ওষুধের টুকরো আটকে গিয়েছিল? খুব কষ্ট পেয়েছিলেন, তাই না?

অচেনা লোকটার কথার সূত্র ধরে শাফায়েত হোসেন আট-নয় মাস পেছনে ফিরে যান।

তিনি টের পাচ্ছিলেন তাঁর নিশ^াস বন্ধ হয়ে আসছে। এর আগে অনেকবার বিষম খেয়েছেন, গলায় হয়তো মাছের কাঁটা বা কিছু আটকেওছে কিন্তু আজকের মতো ভয়ংকর অনুভূতি এ পঞ্চাশ বছরের জীবনে কখনো হয়নি। ইদানীং তিনি স্ত্রীর কাছে প্রায়ই মৃত্যুর কথা বলতেন। সেই মৃত্যু এভাবে তাহলে এসেই গেল – গলায় সামান্য এক টুকরো ওষুধ বেধে, এমন মরণ লেখা ছিল তাঁর কপালে। রুবিনা ডাইনিং টেবিলের অদূরে একটা সোফায় মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত ছিল। শাফায়েতের গলার ভেতর থেকে অস্বাভাবিক আওয়াজ আসায় সে ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে খানিক এগিয়ে এসে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, গলায় আটকে গিয়েছে – কী যেন করতে হয় এখন? আল্লাহ। সে বোধহয় দোয়া-দরুদ পড়তে শুরু করেছিল।

শাফায়েত হোসেন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। তিনি টের পাচ্ছেন তাঁর নিশ^াস বন্ধ হয়ে আসছে, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে বুক জুড়ে। মনে হলো, তিনি সোফায় গা এলিয়ে দেবেন, আর তার দু-এক মিনিটের মধ্যেই এই পৃথিবীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কচ্ছেদ হয়ে যাবে। কয়েক মিনিটের মধ্যে নিথর হয়ে যাবে তাঁর পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি শরীরটা। তিনি দেখছেন রুবিনা অস্থির হয়ে আছে। কী যেন বলছে সে কিন্তু তার কোনো কথা আর শাফায়েতের কানে পৌঁছায় না। সোফার দিকে তিনি এগিয়ে যাবেন এমন সময় মনে পড়ে বুকের খাঁচার মাঝে ফুসফুস বরাবর চাপ দিলে এ-অবস্থায়ও লোকে মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসে। কিন্তু তাঁর ও-সব স্পষ্ট মনে ছিল না। মৃত্যুতাড়িত শাফায়েতের ডান হাতখানা অনেকটা অবচেতনেই চলে যায় বুকের মাঝ বরাবর। তিনি খুব জোরে তিন-চারবার চাপড় দেন। কয়েক মুহূর্ত পর মনে হয় তিনি এবার যেন শ^াস নিতে পারছেন। যেন গ্রাস করতে থাকা গভীর জলের সঙ্গে লড়াই করে নিমজ্জমান শাফায়েত ওপর দিকে উঠে এলেন। কয়েকবার বুক ভরে বাতাস টেনে টের পান গলার ভেতর থেকে ওষুধের ছোট্ট টুকরোটা বের হয়ে এসেছে। উদ্বিগ্ন রুবিনাকে তিনি হাত ইশারা করে আশ^স্ত করেন। এর কয়েক সেকেন্ড পর বলতে পারেন, ঠিক আছি – ভয় নেই আর। ওটা বের হয়ে এসেছে। তিনি মেঝে থেকে হালকা বেগুনি রঙের ওষুধের টুকরোটা তুলে আনেন। সোফায় বসে রুবিনাকে বলেন, বোধ হয় আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমি মারা যেতাম।

হ্যাঁ, আমি টের পাচ্ছিলাম তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু কী করব বুঝে উঠতে পারিনি।

যাক এ-যাত্রা বেঁচে গেলাম।

থাক, ভুলে যাও আজকের দিন। মনে কষ্ট রেখো না। রুবিনার কণ্ঠে তখনো কাঁদো কাঁদো ভাব।

কিন্তু এই লোকটা কে? সে কীভাবে জানল ওই দিনের কথা। তাছাড়া তিনি তো কাউকে এ বিষয়ে কিছু বলেননি। এই লোকটা আবার মানুষের বেশে মৃত্যুদূত নয় তো! শাফায়েতের কেমন ভয় ভয় লাগে। তবু নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে তিনি লোকটার চেহারার দিকে গভীরভাবে দৃষ্টি রেখে বলেন, ‘কিছু মনে করবেন না, আপনাকে আগে কোথায় দেখেছি ঠিক মনে করতে পারছি না।’

‘আসলে মনে করতে পারার কথাও নয়। কিন্তু আমি আপনাকে দেখেছি। আচ্ছা সে-প্রসঙ্গ না-হয় পরে বলি। জানাজায় এসেছিলেন, রফিকুল্লাহ সাহেব কি আপনার আত্মীয়?’

‘না, ঠিক আত্মীয় নন। তবে গত রাতে যখন বজ্রপাতটা হয় আমি খুব কাছে ছিলাম। আমি দেখলাম একটা মানুষ কীভাবে মুহূর্তের ভেতর নিস্তব্ধ-নিথর হয়ে যায়।’

‘আপনি অত গভীর রাতে ওখানে কী করছিলেন?’

‘সত্যি কথা বলতে কী – আমার কাছে রাতদিনের বিশেষ পার্থক্য নেই। মানুষের বিচিত্র জীবন দেখে বেড়াতে আমার খুব ভালো লাগে। কত রকম মানুষ এই পৃথিবীতে, কী অদ্ভুত তাদের চাওয়া-পাওয়া! তবে চোখের সামনে এমন মৃত্যু কষ্টও দেয় ভীষণ। রফিকুল্লাহর নয় বছরের ছেলেটা লাশ ধরে যেভাবে কাঁদছিল – সহ্য করা কঠিন।’

লোকটার এই সহানুভূতির কথা শুনে ভালো লাগে শাফায়েতের। তাহলে এ হয়তো ছদ্মবেশী মৃত্যুদূত নয়। শাফায়েত বলেন, ‘আচ্ছা, কিছু মনে না  করলে আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। আমার মনে হয়েছে আপনি বেশ চিন্তাশীল মানুষ।’

‘চিন্তাশীল কি না জানি না। তবে জিজ্ঞেস করতে পারেন নির্দ্বিধায়।’

‘আমার ধারণা আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাসী।’

‘হ্যাঁ, তা বটে।’

‘তাহলে বলুন তো, পৃথিবীতে মানুষ পাঠিয়ে তাকে এই কষ্টকর জীবন দিয়ে তাঁর কী লাভ?’

‘কষ্ট – এখানে শুধুই কি কষ্ট?

সুখ-স্বস্তি-আনন্দ বলতে কিছুই কি নেই?’

‘আমার তো তাই মনে হয়। ছিটেফোঁটা সুখ হয়তো আছে, কিন্তু পনেরো আনাই কষ্ট আর যন্ত্রণায় মোড়া। অন্তত আমার জীবনের অভিজ্ঞতা তেমনই।’

‘সবার জীবন উপলব্ধি একরকম নয়। কেউ হয়তো পনেরো আনা সুখও অনুভব করতে পারেন। কিন্তু আপনার এত কষ্ট  কিসের?’

‘জীবনের বিস্তারিত বৃত্তান্ত হয়তো অন্য কোনোদিন বলা যাবে। তবে বলি – এই যে মানুষের বয়স বেড়ে যাওয়া, বার্ধক্যের কালো ছায়াপাত তা কি কোনো মানুষ পছন্দ করে? করার কোনো যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে? সে নিরুপায়, নিয়তির হাতে বাঁধা, তাই মেনে নিতে হয়। আচ্ছা আপনি আমার ওই গলায় ওষুধ আটকে যাওয়ার ব্যাপারটা কীভাবে জানলেন – সে-সময় তো আমার স্ত্রী ছাড়া আর কেউ পাশে ছিল না।’

‘আমিও কাছাকাছি, বলতে পারেন খুব কাছেই ছিলাম, আপনি হয়তো বুঝতে পারেননি।’

‘আচ্ছা, এতক্ষণ কথা বলছি আপনার পরিচয়টা তো জানা হলো না, আমার নাম তো আপনি জানেনই – আমি শাফায়েত হোসেন – সমবায় কর্মকর্তা, উপশহর পাড়ায় থাকি।’ বলতে বলতে শাফায়েত লোকটার দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দেন। লোকটা হাত বাড়িয়ে করমর্দন করতে করতে বলে, ‘আমাকে একেকজন একেক নামে ডাকে। আপনি আমাকে আলো, মেঘ কিংবা বাতাস এরকম কিছু-একটা বলে ডাকতে পারেন।’ লোকটার হাত স্পর্শ করে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি উষ্ণ মনে হয় – যেন গায়ে একশ পাঁচের ওপর জ¦র। কিন্তু তার চেহারা বা কথাবার্তায় কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। শাফায়েতের এতক্ষণে বুঝতে অসুবিধা হয় না – তার সঙ্গের এই মানুষটা অন্য জাতের। তিনি উত্তাপের প্রসঙ্গ না টেনে কেবল বলেন, ‘এ আবার কেমন নাম?’

‘নাম তো কোনো ব্যাপার না কাজ দিয়েই আমাদের আসল পরিচয়। মনে করুন আমি বাতাস কিংবা মেঘের মতো কিছু। কখনো আপনার খুব কাছে আবার খানিকটা দূরে থাকি।’

‘বাহ্, ভারী অদ্ভুত লোক তো আপনি! আচ্ছা আমি যদি আপনার মতো মেঘ কিংবা বাতাস হতে চাই?’

‘বলব, আরেকদিন বলব। মানুষ চাইলে কেবল মেঘ বা বাতাস কেন রোদ, জ্যোৎস্না সবই হতে পারবে একদিন।’

‘কীভাবে? আমি তো আলোর মতো গতি পেতে চাই। মুহূর্তে যেতে চাই এখান থেকে কোটি মাইল দূরে। আচ্ছা আলোরও কি মৃত্যু আছে আমাদের মতো?’

‘বলব, আজ চলি।’

শাফায়েত আশপাশে তাকিয়ে লোকটাকে আর দেখতে পান না। এত দ্রুত কোথায় গেল মানুষটা?  

যাক যেখানে খুশি। এই জগতে অদ্ভুত কত কিছু ঘটে। শাফায়েত অন্ধকার রাস্তা ধরে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকেন। তখন তাঁর মনে পড়ে রুবিনার সেই বিবর্ণ আর কুঞ্চনের রেশধরা আঙুলগুলি। মেহেদি রাঙালেও সেগুলি আগের মতো ঝলমল করে না। তাঁর মন চাইছে সাতাশ বছরের তরুণ হয়ে আবারো বাসরশয্যায় ফিরে যেতে। সেই পুষ্পসৌরভ, সেই পেলবতা, সেই উষ্ণতা, সেই নিশ্বাস!

‘উহ্’ বলে শাফায়েত থমকে দাঁড়ান। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটায় কিসে যেন লাগল ভীষণ। মোবাইল-টর্চের আলো জে¦লে দেখেন রক্ত ঝরছে। টকটকে লাল। উজ্জ্বল!