অমর একুশে বইমেলা ২০২৪

‘অমর একুশে বইমেলা ২০২৪’-এর পর্দা নেমেছে গত ২রা মার্চ। প্রতিবছর সাধারণত ফেব্রুয়ারির শেষদিন সমাপ্ত হয় বইমেলা। এ-বছর শেষ হলো দুদিন পর। তাছাড়া এ-বছরের ফেব্রুয়ারি মাস ২৯ দিন হওয়ায় অতিরিক্ত তিনদিন পাওয়া গেছে। করোনার কারণে ২০২১ সালের বইমেলা হয়েছিল ১৮ই মার্চ থেকে ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত। এবার ১লা ও ২রা মার্চ সাপ্তাহিক ছুটি থাকার কারণে প্রকাশকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বইমেলা দুদিন বাড়ানো হয়। 

ভাষা-আন্দোলনের চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করে আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষ এবং প্রসারের জন্য মাসব্যাপী বইমেলা বাংলাদেশের সংস্কৃতিচর্চার একটি অপরিহার্য অংশে পরিগণিত হয়েছে। ‘অমর একুশে বইমেলা’ শিরোনামটিই বলে দিচ্ছে এর গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ব্যাপ্তি। এই বইমেলা কেবল বই বিক্রির মেলা নয়, এর সঙ্গে সম্পর্কিত আমাদের অস্তিত্বের শিকড় ও জাতিগত প্রেরণা।

বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা অমর একুশে বইমেলা। এই মেলা লেখক, প্রকাশক, পাঠক ও সংস্কৃতিমনাদের মধ্যে একটা নিবিড় মেলবন্ধন তৈরি করে এবং এক মাসের জন্য ঢাকাসহ সারা দেশে উৎসাহের আমেজ বিরাজ করে। ঢাকা শহরে বসবাসরত মানুষের মূল আলোচনা যেন হয়ে ওঠে ‘বইমেলা’। অথচ এই বইমেলার ইতিহাস খুব পুরনো নয়। শুরুটা যখন ও যেভাবে হয়েছিল তখন কেউ হয়তো ভাবতেও পারেননি যে একদিন বইমেলার পরিসর, ব্যাপ্তি, কার্যক্রম, প্রত্যাশা এবং অঙ্গীকার এতটা বিস্তৃত হবে। বর্তমান মুক্তধারা (সূচনায় নাম ছিল স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ) প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা (প্রয়াত) এই অমর কীর্তির স্থপতি, যিনি ১৯৭২ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে চট বিছিয়ে মাত্র ৩২টি বই নিয়ে আজকের মহাসমারোহের বইমেলার খুঁটি স্থাপন করেন। সব মহৎ কাজের শুরুটা হয়তো এভাবেই হয়। এরপর ফেব্রুয়ারি মাস এলেই তিনি বইয়ের দোকান সাজিয়ে বসতেন এবং সে-প্রয়াস চালালেন ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত। চিত্তরঞ্জন সাহার কাজ দেখে অন্যরাও উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন। তৎকালীন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে এরপর ১৯৭৮ সালে বর্তমান বইমেলা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে এবং এর এক বছর পর বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি মেলার কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়। উল্লেখ্য যে, এই সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও চিত্তরঞ্জন সাহা। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বাংলা একাডেমি মেলার যাবতীয় কার্যক্রম প্রত্যক্ষভাবে পরিচালনা করে। আরো প্রায় এক ডজনের মতো মন্ত্রণালয় মেলার বিভিন্ন কার্যক্রমে যুক্ত হয়ে সহযোগিতা করে থাকে।

বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায় যে, অন্যান্য বছর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের একটি প্রতিষ্ঠান মেলার স্টল বিন্যাসের নকশা করে দিত। এ-বছরের মেলায় সেই প্রতিষ্ঠানটি কাজ করেনি বলে বাংলা একাডেমি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্টল বিন্যাসের নকশা ও স্টল নির্মাণ করেছে।

প্রতিবছরের মতো এবারও প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে ৩৭টি প্যাভিলিয়নসহ সর্বমোট ৬৩৫টি স্টলের ‘অমর একুশে বইমেলা’ শুরু হয় পহেলা ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টায়। প্যাভিলিয়ন ছাড়া স্টলগুলি এক-দুই-তিন বা চার ইউনিটে বিন্যস্ত। প্রতিটি ইউনিট আট ফুট বাই আট ফুট। প্রকাশকদের স্টল বণ্টন ছাড়াও উদ্যানের পশ্চিম পাশে ছিল ১৭০টি স্টলের লিটলম্যাগ চত্বর। লেখককের সাহিত্য আড্ডা ও সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এই চত্বরে প্রতিদিনই জমে উঠত আড্ডা।
এ-কারণেই হয়তো অনেকে এই চত্বরকে ‘লেখকের আঁতুড়ঘর’ বলে অভিহিত করেন।

শিশুদের জন্য ছিল শিশুচত্বর। এই চত্বরে কেবল শিশুদের পাঠোপযোগী বই থাকত। প্রতি শুক্রবার শিশুদের জন্য ছিল শিশুপ্রহর। সরকারি ছুটির দিন সকাল ১১টা থেকে মেলা শুরু হয়ে চলত রাত ৯টা পর্যন্ত। শিশুরা অভিভাবকদের সঙ্গে হেসেখেলে তাদের পছন্দের বই কিনে বাড়ি ফিরত। একুশে ফেব্রুয়ারিতে বইমেলার ফটক উন্মুক্ত হয়েছিল সকাল ৮টায়, শেষ হয়েছিল রাত ৯টায়।

বলা যায়, বইমেলার কারণে লেখকের সংখ্যা বেড়েছে এবং হয়তো বা লেখকের সংখ্যা বৃদ্ধি ও উৎসাহের কারণে প্রকাশকের সংখ্যাও বেড়েছে। ২০১৪ সালের আগে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলা অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু প্রকাশকের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এরপর এই প্রাঙ্গণে স্থান সংকুলান না হওয়ায় একাডেমির চৌহদ্দির রাস্তায় স্টল বরাদ্দ দেওয়া হতো। পরবর্তীকালে তাতেও  স্থান সংকুলান না হওয়ায় ২০১৪ সাল থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই উদ্যানে মেলা স্থানান্তিরত হওয়ার সময় নতুনভাবে যুক্ত হয় ‘প্যাভিলিয়ন’ ধারণাটি এবং পাশাপাশি অস্থায়ী রেস্তোরাঁ স্থাপনের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হলো বেশ অনেকটা স্থান।

‘অমর একুশে বইমেলা’ শুধু বই বিক্রির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই মেলাকে সার্থক করে তোলার জন্য আরো বিভিন্ন কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ‘আমি লেখক বলছি’ নামে একটি মঞ্চ সংযোজিত হয়েছে গত তিন বছর ধরে। এই মঞ্চের সঞ্চালনে থাকেন বাংলা একাডেমির কর্মকর্তারা। তাঁদের সঞ্চালনায় প্রতিদিন আটজনের মতো লেখক তাঁদের লেখালেখি নিয়ে কথা বলেন। এই মঞ্চে কথা বলার জন্য বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ লেখক নির্বাচন করেন, যেখানে পর্যায়ক্রমে দেশের সব লেখকের কথা বলার সুযোগ থাকবে বলে তাঁরা জানিয়েছেন। মঞ্চটি এবার ছিল উদ্যানের পশ্চিম প্রান্তে। উদ্যানের উত্তর প্রান্তে প্রতিবছরের মতো এবারও ছিল ‘মোড়ক উন্মোচন মঞ্চ’। বিপুল উৎসাহ নিয়ে এই মঞ্চে নতুন লেখকরা তাঁদের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন এবং নতুন বই ও লেখক সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচয় প্রদান করেন। বইমেলার এই সংস্কৃতি অনেক আগে থেকে চালু হয়েছে। এই মঞ্চের সামনেই রয়েছে স্থায়ীভাবে নির্মিত ‘নজরুল মঞ্চ’। নজরুল মঞ্চেও দু-একটি অনুষ্ঠান হতে দেখা যায়।

বইমেলাকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হয়ে ওঠে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোও। পত্র-পত্রিকাসহ টিভি চ্যানেলগুলির কুশীলবদের সরব উপস্থিতি ও কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে। এবার মেলার মাঠে বেশ কয়েকটি মিডিয়ার স্টলও দেখা গেছে। আরো ছিল প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার কয়েকটি স্টল। টিভি চ্যানেলগুলি মেলার মাঠের বিভিন্ন কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচার করে। বিটিভি এবার সরাসরি সম্প্রচারের জন্য ছোট পরিসরের একটি সেল স্থাপন করেছিল, যেটি আগের কোনো মেলায় দেখা যায়নি। এই সেলে প্রতিদিন তিনজন করে লেখককে ডাকা হতো এবং তাঁদের প্রকাশিত বই নিয়ে আলোচনা হতো।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশাপাশি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণও ছিল মুখরিত। এই প্রাঙ্গণকে সাজানো হয়েছিল ভিন্ন আঙ্গিকে। এখানে সাহিত্যবিষয়ক আলোচনা, প্রবন্ধ পাঠ, কবিতা আবৃত্তি, সংগীত পরিবেশন ইত্যাদির জন্য একটি মঞ্চ করা হয়েছিল প্রতিবছরের মতো। সাহিত্য-সংগীতপ্রেমীরা ওই প্রাঙ্গণে ভিড় জমান। শান্ত ও কোলাহলমুক্ত পরিবেশে এসব অনুষ্ঠান উপভোগ করার জন্য অনেক দর্শকশ্রোতা এই প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়েছিলেন প্রতিদিন। এই প্রাঙ্গণে অর্ধশতাধিক সংগঠন ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান স্টল বরাদ্দ পায়। এসব স্টলের মধ্যে ছিল ‘বাংলাদেশ শিশু একাডেমি’র। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত বইপত্র ছিল মূলত প্রদর্শনের জন্য উন্মুক্ত।

বইমেলাকে অনেকেই ‘প্রাণের মেলা’ বলে থাকেন। কারণ এই মেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ভাষা-আন্দোলন ও স্বাধীনতার উত্তাপ। অন্যদিকে বাঙালি জীবনের সঙ্গে মেলাসংস্কৃতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত – নাড়ির সঙ্গে যুক্ত। বাণিজ্যমেলা, বৈশাখীমেলা, চৈত্রসংক্রান্তির মেলা ছাড়াও এলাকাভিত্তিক নানা রকম মেলা মানুষের জীবনের অংশ হয়ে আছে। সারা দেশে বৈশাখিমেলায় যেমন সাজ-সাজ উৎসব ও আনন্দমুখর পরিবেশ পরিলক্ষিত হয়, বইমেলাতেও ঠিক তেমনই আমেজ সৃষ্টি হয়। বর্তমানে অমর একুশে বইমেলার আবহে ও অনুসরণে দেশের জেলা ও উপজেলাগুলিতেও বই মেলার আয়োজন করা।

বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বইমেলাকে আমরা প্রাণের মেলা বললেও দিন শেষে কিন্তু বিক্রিবাট্টার কথা চলে আসে। অর্থ লগ্নি ও স্থিতিকালের আলোকে বইমেলার সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা তুলনীয়। বাণিজ্যমেলায় পণ্য বিক্রির ব্যাপারে তেমন কোনো নীতিমালা আছে কি না আমাদের জানা নেই। কিন্তু বইমেলায় নির্ধারিত নীতিমালা রয়েছে; যেমন – ২৫ শতাংশ ছাড় দেওয়া। এ-বছর শিক্ষার্থীদের জন্য ৩০ শতাংশ ছাড় দেওয়ার নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দিনের শুরুতে লেখক-প্রকাশকদের হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখা গেলেও দিনশেষে অনেকের মুখে গোধূলির মালিন্য পরিলক্ষিত হয়। কেন এমন হতো?

মেলায় নানা ধরনের পণ্য থাকবে – এটাই স্বাভাবিক। ‘মাটির পুতুল’, ‘কাঠের পুতুল’, ‘প্লাস্টিকের পুতুল’ ইত্যাদির মতো বইমেলাতেও নানা ধরনের বই থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। বইমেলা উপলক্ষে প্রতিবছর অসংখ্য বইয়ের ভিড়ে দু-একটি বই পাঠকমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, বেস্টসেলারে পরিণত হয়। অনেক সময় এসব বইয়ের মান নিয়ে সাহিত্যবোদ্ধারা প্রশ্ন তোলেন। অভিজ্ঞতা থেকে দেখে যায় যে, এক মেলার আলোড়ন সৃষ্টিকারী বইয়ের অন্য মেলায় আর হদিস পাওয়া যায় না।

অন্যান্য বছরের মতো এবারের বইমেলাকে ঘিরে প্রকাশিত হয়েছে প্রায় চার হাজার বই এবং বিক্রি হয়েছে প্রায় ৬০ কোটি টাকা। গত তিন বছরের বিক্রির তুলনায় এবার বিক্রি বেশি হয়েছে বলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও বাংলা একাডেমির সূত্র থেকে জানা যায়। ২০২৩ সালে ৪৭ কোটি টাকা, ২০২২ সালে ৫২ কোটি, ২০২১ সালে তিন কোটি এবং ২০২০ সালে ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে মেলায়। যদি বিক্রির আলোকে বইমেলাকে বিচার করা হয় তাহলে স্বীকার করতে হবে যে, প্যাভিলিয়নই মেলার প্রাণশক্তি। কারণ প্যাভিলিয়নগুলি থেকেই বেশি বই বিক্রি হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। এদিকে প্যাভিলিয়নে বিনিয়োগ করা ছোট প্রকাশকদের জন্য একরকম দুরূহ ব্যাপার, কারণ খরচ কয়েকগুণ বেশি। ফলে মেলায় আসা ছোট প্রকাশকদের মুখে হতাশার ছাপ লক্ষ করা গেছে। অনেক প্রকাশক মনে করেন, শুধু মেলাতে তার  যা খরচ হয় বই বিক্রি করে সে-খরচও উঠবে না, মুনাফা তো দূরের কথা। কেননা, একটি এক ইউনিটের স্টলের এক মাসের মেলার খরচ ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকার মতো। 

মানসম্মত বই নিয়ে প্রতিবছরই সচেতন মহলে প্রশ্ন দেখা দেয়। বইমেলার সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে, আমি পূর্বে ইঙ্গিত দিয়েছি প্লাস্টিকের পুতুলের, আরো প্রশ্ন দেখা দেওয়াটা স্বাভাবিক যে, বইমেলায় কি সব মানসম্মত পাঠক আসেন? সব প্রকাশকের কি মানসম্মত বই প্রকাশের সক্ষমতা আছে? নাকি সব লেখকের মানসম্মত বই লেখার সক্ষমতা আছে? এ-বছর মেলায় ৬০ লাখ দর্শনার্থীর আগমন ঘটেছে – এটা অনুমাননির্ভর সংখ্যা, সঠিক পরিসংখ্যান নয়। লক্ষ করলে দেখা যাবে, শব্দটি বলা হচ্ছে ‘দর্শনার্থী’, ‘পাঠক’ বা ক্রেতা’ নয়। অনেকেই শ্লেষের সঙ্গে বইমেলাকে ‘সেলফিমেলা’ ও ‘খাদ্যমেলা’ বলেন। কারণ মেলায় শুধু বইক্রেতা আসেন না, অধিকাংশ মানুষই আসেন হয়তো ঘুরে বেড়ানোর জন্য। বর্তমান প্রজন্মের কাছে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ মানেই সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করা। এদের মধ্যে বই কেনা বা পড়ার কোনো আগ্রহ নেই। কেউ এসে ঘুরতে ঘুরতে শখের বশে কোনো পছন্দসই প্রচ্ছদ দেখলে বই কেনেন, কেউ কারো মুখে শুনে কেনেন অথবা ফেসবুকে কোনো পোস্ট দেখে দু-একটা বই কিনে ঘরে ফেরেন। তাদের কাছে ‘মানসম্মত’ শব্দটি কোনো ধর্তব্যের বিষয় নয়।

রুচিবান পাঠক কি বইমেলা থেকে বই কেনার জন্য অপেক্ষা করেন? আমার ধারণা, মানসম্মত পাঠকদের অধিকাংশই বিভিন্ন মাধ্যম থেকে মেলার আগে অথবা পরে বই সংগ্রহ করে থাকেন। তাই মেলায় অগ্রসর পাঠকের বই তেমন বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। তবে একটি কথা স্বীকার করা ও মেনে নেওয়া উচিত যে, মানসম্মত বই উৎপাদনের মাধ্যমেই কেবল মানসম্মত পাঠক তৈরি এবং মানুষের রুচির পরিবর্তন করা সম্ভব। বই যতটুকু রুচির পরিবর্তন করতে পারবে অন্য মাধ্যম ততটুকু পারবে বলে মনে হয় না। শুধু ব্যবসার জন্য বইমেলা – এই ধারণা প্রকাশকরা যদি পোষণ করেন, তাহলে বইমেলার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।  

প্রতিবছর বইমেলা উপলক্ষে প্রায় ৪ হাজার বই প্রকাশিত হয়, যেগুলির মধ্যে কবিতার বই-ই বেশি। কবিতার বইয়ের পাঠকসংখ্যা সবচেয়ে কম, যা সকলেই জানেন। কিন্তু বই বিক্রির প্রত্যাশায় কি কবিতার বই প্রকাশ করা হয়? তাহলে উদ্দেশ্য কী? বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন নেই কী?

বর্তমান সময়ে বইমেলাকে মাতিয়ে রাখেন ফেসবুক পেজে ও ইউটিউবের জনপ্রিয় সেলিব্রেটি লেখকরা। এবারের বইমেলাতেও এমন দু-একটি বই মেলাজুড়েই আলোচনায় ছিল। বইয়ের মান যা-ই হোক না কেন, ব্যবসায় সফলতার জন্য অনেক প্রকাশক এসব বই প্রকাশ করে থাকেন। তাঁদের কাছে সাহিত্য বড় কথা নয়, মুনাফাই বড়। 

বই বিক্রি হয় না বলে ছোট প্রকাশকদের হতাশা দেখা যায়। লোকসানের ভয়ে মানসম্মত বই প্রকাশ করে এমন কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মেলায় অংশগ্রহণও করেনি। কারণ, এক মাসের মেলায় খরচ তো আর কম নয়! আবার অনেকেই বিক্রিতে সন্তুষ্ট নন। বইমেলায় উচ্চমানের অর্থাৎ অগ্রসর পাঠকের পছন্দের বই কম বিক্রি হয় – এটি এখন প্রবাদতুল্য বাক্য। তবে উচ্চমানের বই কম বিক্রি হওয়ার আরেকটি কারণও আছে। সে-কারণটি নিয়েও ভাবা যেতে পারে। প্রকাশকরা বই প্রকাশ করার পূর্বে মার্কেট অ্যানালিসিস বাজার পর্যবেক্ষণ/বিশ্লেষণ কি কখনো করেছেন? বিনিয়োগ করবেন কিন্তু মার্কেট অ্যানালিসিস কেন করবেন না? একটি লাইসেন্স করে বই প্রকাশ করলেই বই বিক্রি হবে – এই ধারণা থাকা কতটা যৌক্তিক? একটি উদাহরণ দেওয়া যাক : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসটি চিরায়ত বই হিসেবে কপিরাইট ফ্রি হওয়াতে অনেক প্রকাশক এটি প্রকাশ করে থাকেন। এবার ভাবা যেতে পারে, এই উপন্যাসটি কত বছর ধরে বিক্রি হচ্ছে? এটি কত জন প্রকাশক প্রকাশ করেছেন? বাজারে এর প্রতুলতা ও প্রাপ্যতা অনুযায়ী পাঠক কি প্রতিবছর পাওয়া যাবে? এই উদাহরণ থেকে সম্পূর্ণ প্রকাশনা সেক্টরকে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। একজন লেখকের একই বই একাধিক প্রকাশক প্রকাশ করে যদি মুনাফা অর্জনের প্রত্যাশা করেন তাহলে তা কতটুকু যৌক্তিক হবে? বইমেলা ঘুরে এরকম একটি চিত্র দেখা যায় যে, একই লেখকের একই বই অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে পাওয়া যায়। তাহলে ক্রেতা কোথা থেকে আসবে? এরপরও বইয়ের প্রকাশনামান যদি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পারে তাহলে পাঠকের বই কেনার তো কথা নয়।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশনা সেক্টরটি পরিচালিত হচ্ছে। সারা বছর বই প্রকাশ করে এমন প্রতিষ্ঠান হাতেগোনা দু-একটি পাওয়া যেতে পারে। লেখকরাও বইমেলাকে টার্গেট করে বই লেখেন বলে তাঁদের মানসিক চাপের মধ্যে থাকতে হয়। কারণ, জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে পাণ্ডুলিপি জমা না দিলে বইমেলার পূর্বে বই প্রকাশ করার সম্ভাবনা থাকে না। অধিকাংশ প্রকাশকই বই প্রকাশের কাজ শুরু করেন সাধারণত সেপ্টেম্বর মাস থেকে এবং চলতে থাকে মেলার শেষ দিন পর্যন্ত। ফলে পাণ্ডুলিপির সম্পাদনাসহ মুদ্রণ কাজে তাড়াহুড়ো থাকে, প্রিন্টিং প্রেসে ও বাঁধাইখানায় অত্যধিক চাপ পড়ে। এত চাপের মধ্যে থেকে কীভাবে মানসম্মত বই লেখা ও প্রকাশিত হবে তা কি চিন্তা করার বিষয় নয়? এই সংস্কৃতি যদি চলতেই থাকে তাহলে বাংলাদেশে উন্নত মানের বই পাওয়ার সম্ভাবনাও কতটুকু, সেটা আমাদের ভাবা উচিত। একটি আশার কথা যে, জনপ্রিয়তা ও ব্যবসাসফল সাহিত্যের চিন্তা না করে যাঁরা সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন বা করেন, তাঁরা বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরই বই প্রকাশ করার প্রতিযোগিতায় থাকেন না – এমন নজিরও এদেশে অনেক রয়েছে। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক সংকটে যে তাঁরা ভোগেন না তার নিশ্চয়তা কে দেবে? আমাদের মনে রাখা দরকার যে, মানসিক চাপের মধ্যে থেকে অন্তত সৃজনশীল কাজ হয় না, অন্য কিছু হতে পারে।

একমাসব্যাপী মেলা সত্যিকার অর্থেই আমাদের প্রকাশনা সেক্টর ও সাহিত্যের জন্য সুফল বয়ে আনছে কি না – এ নিয়ে অনেক লেখক ও প্রকাশক প্রশ্ন তুলছেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক বইমেলা কোথাও কি এক মাসব্যাপী হয়? আমরা কেন তাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করছি না? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন প্রকাশক ও লেখক বড়জোর পনেরো দিনের বইমেলার পক্ষে মত দিয়েছেন। মেলার স্থিতিকালের বিষয়টি পর্যায়ক্রমে আলোচনার ভারকেন্দ্রে চলে আসছে বলে মনে হয়। তাঁরা মনে করেন, সারা বছরই বই প্রকাশের কাজ চালানো উচিত এবং বিপণনের জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতারও প্রয়োজন আছে।  

এত সুন্দর আয়োজন ও ব্যবস্থাপনার মেলায় কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে অনেকের ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। স্টল বিন্যাসের ক্ষেত্রে এবারও লিটলম্যাগ চত্বর থেকে লেখকদের মধ্যে ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। এ-বছর স্টল বিন্যাসের জায়গা ছিল অত্যন্ত কম এবং চলাচলের পথ সরু গলির মতো। অনেকের মতে, পরিকল্পনা সঠিকভাবে করা হলে এমন অবস্থা সৃষ্টি হতো না।  মাঝখানের পথে ইট বিছানো হয়নি, দুদিন বৃষ্টির জন্য স্টলের সামনে জলকাদা ছিল – এমন অভিযোগও উঠেছে। বাংলা একাডেমি জানিয়েছে, ইট বিছানো হলে এক কোটি টাকার মতো বাড়তি খরচ হতো, যে বাজেট তাদের ছিল না। এত টাকা হিসাব আসলে মুখের কথা নয়। এজন্য বিকল্প ব্যবস্থা কী? মেলার মাঠ যদি এবড়ো-খেবড়ো থাকে সেটিও আমাদের দেশের জন্য একটি অমর্যাদার বিষয়। আবার মূল মেলার মাঠের কোনাকানায় অনেক স্টল বিন্যস্ত হওয়াতে অনেক প্রকাশক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। মেলার জন্য ভালো জায়গা না হলে বিক্রি ভালো হয় না – এ-কথা সুবিদিত। এরকম ক্ষোভ কয়েক বছর ধরে প্রকাশ পেলেও এই সমস্যার সমাধান সম্ভব কি না তা ভাবা যেতে পারে। কোনাকানা থেকে মুক্তির উপায় হয়তো পাওয়া যাবে না, কিন্তু বিকল্প চিন্তা করা যেতে পারে। বইমেলায় এত বড় বড় বিলাসী খাবারের দোকানকে কোনো প্রকাশক বা লেখক ইতিবাচক বিবেচনা করেন বলে মনে হয় না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা হওয়ার আগে যখন খাবারের দোকান ছিল না তখন কি মেলা চলেনি? খাবারের দোকান মূল মেলার বাইরে রাখার বিষয়টি কর্তৃপক্ষ চিন্তা করতে পারেন। কেননা বইয়ের মেলাটি যদি খাবারের মেলায় পরিণত হয় তখন আমাদের আফসোসের আর সীমা থাকবে না।