কালি ও কলম সাহিত্য সম্মেলন ২০২৪ : সাহিত্য ও সমাজের পাঠ

কুড়ি বছর পেরিয়ে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে একুশে পা রেখেছে সাহিত্য শিল্প ও সংস্কৃতিবিষয়ক পত্রিকা কালি ও কলম। কোনো বাংলা সাহিত্যপত্রের এত দীর্ঘ সময় ধরে বিরতিহীনভাবে প্রকাশনা উল্লেখনীয় ঘটনা। কুড়ি বছর পূর্তি উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করেছিল কালি ও কলম

চলতি বছরের ৮, ৯ ও ১০ই ফেব্রুয়ারি বেঙ্গল শিল্পালয়ে অনুষ্ঠিত হয় এই সম্মেলন। এতে অংশগ্রহণ করেন এপার-ওপার বাংলার সাহিত্যিক, সংস্কৃতিজন, শিল্পী ও গবেষকরা। প্রথম দিন ছিল সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। পরবর্তী দুদিন মোট সাতটি অধিবেশনে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নানা বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা ছিল আয়োজকদের অন্যতম লক্ষ্য। এছাড়া এসব সাহিত্য-অধিবেশনের শিরোনাম থেকেই স্পষ্ট, এবং আয়োজকরা উল্লেখও করেছেন, তাঁদের লক্ষ্য প্রশ্ন উসকে দেওয়া। সব প্রশ্নের যে উত্তর মিলবে সে-প্রত্যাশা তাঁরা করেন না। প্রশ্ন উঠুক – এটাই তাঁদের মূল্য উদ্দেশ্য। 

সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে মূল বক্তা ছিলেন প্রাবন্ধিক, চিন্তক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইতিহাসবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন এবং প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক চিন্ময় গুহ। এই আয়োজনে সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুন নবী। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন কালি ও কলমের প্রকাশক আবুল খায়ের। স্বাগত বক্তব্য রাখেন কালি ও কলমের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন কালি ও কলমের সম্পাদক সুব্রত বড়ুয়া। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কালি ও কলমের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য লুভা নাহিদ চৌধুরী।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর ‘সাহিত্যের শত্রু ও মিত্র’ নামের প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, সাহিত্যের মিত্র হচ্ছে মানুষের মনুষ্যত্ব। আর শত্রু হচ্ছে পুঁজিবাদ। মনুষ্যত্ব মানুষকে যুক্ত করে আর পুঁজিবাদ মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে। তিনি বলেন, সাহিত্যের সঙ্গে দর্শন ও ইতিহাসের যোগ থাকে। তবে সাহিত্যের স্রষ্টারা দর্শনকে সরলীকরণ করেন না; বরং তাঁদের প্রয়াস থাকে সর্বজনীন করে তোলায়। অনেক সময় দর্শন যা পারে না, সাহিত্য তা-ও করার ক্ষমতা রাখে।

তিনি আরো বলেন, আজকের সংকট তৈরি হচ্ছে পুঁজিবাদের কারণে। এই সংকট নিরসন করতে হলে আমাদের বড় আশ্রয় সাহিত্য।

উপস্থিত অতিথিবৃন্দ কালি ও কলমের ফেব্রুয়ারি-মার্চ ২০২৪ সালের অর্থাৎ একবিংশ বর্ষ প্রথম-দ্বিতীয় যৌথ সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করেন।

দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ৯ই ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান শুরু হয় বিকেল ৪টা থেকে। এদিন মোট তিনটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম অধিবেশনের শিরোনাম ছিল ‘কবিতা ও সাহিত্য – এসেছি কতদূর’।  এই অধিবেশনের মূল বক্তা ছিলেন অধ্যাপক চিন্ময় গুহ। আলোচক ছিলেন কবি ও অধ্যাপক মাহবুব সাদিক এবং কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল। অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবুল মোমেন।

চিন্ময় গুহ তাঁর বক্তব্যে বলেন, দৃশ্যমাধ্যম ও ইন্টারনেটের প্রাবল্যের এ-যুগেও সাহিত্য তার আকর্ষণ অথবা প্রয়োজনীয়তা ধরে রেখেছে। পাঠকরা বই কিনছেন, পড়ছেন, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের সাহিত্য প্রতিভাবান কবি-সাহিত্যিকদের অংশগ্রহণে সমৃদ্ধ হচ্ছে।

দ্বিতীয় অধিবেশনের বিষয় ছিল মুক্তিযুদ্ধ। ‘স্মৃতি-বিস্মৃতির মুক্তিযুদ্ধ’ শিরোনামের এই অধিবেশনে প্রধান বক্তা ছিলেন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। আলোচনায় অংশ নেন লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ-গবেষক সালেক খোকন এবং কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান। সভাপতিত্ব করেন লেখক, গবেষক, প্রকাশক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক।

মূল বক্তা মুনতাসীর মামুন তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ শুধু স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেনি, বরং বাঙালি ও অন্যান্য জাতিসত্তাও পুনর্নির্মাণ করেছে। আমাদের সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা ও আদর্শের বিষয়াবলি আলোচিত ও প্রাসঙ্গিক। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও তাৎপর্য নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে দরকার দায়িত্ববোধ ও সঠিক পরিকল্পনা।

দ্বিতীয় দিনের তৃতীয় ও শেষ অধিবেশন শুরু হয় সন্ধ্যা ৭টায়। এই অধিবেশনের শিরোনাম ছিল ‘নাটক-চলচ্চিত্র : নতুন কতটুকু নতুন’। এতে মূল বক্তা ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও শিক্ষক মতিন রহমান। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্র-নির্মাতা, গীতিকার ও কবি মাসুদ পথিক এবং নাট্যকার ও কথাসাহিত্যিক রুমা মোদক। এ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষাবিদ, নাট্যকার ও অনুবাদক আব্দুস সেলিম।

মতিন রহমান তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন, নাটক-চলচ্চিত্রসহ সকল শিল্পকলা মাধ্যমে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটে চলেছে। যেটা মানুষ আগে দেখেনি বা শোনেনি, সেটা সে যখন দেখে বা শোনে তখন তার কাছে নতুন মনে হয়। কিন্তু যখনই সেটা দেখা বা শোনা হয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে তা আর নতুন থাকে না, অর্থাৎ পুরনো হয়ে যায়। এভাবে প্রতিনিয়তই নতুন-পুরাতনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে নাটক ও চলচ্চিত্র।

এদিন তিনটি অধিবেশনে সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন কালি ও কলমের সহযোগী সম্পাদক মুহাম্মদ আশফাক খান।

কালি ও কলম সাহিত্য সম্মেলনের তৃতীয় ও শেষ দিনে অনুষ্ঠিত হয় মোট চারটি অধিবেশন। প্রথম অধিবেশন শুরু হয় বেলা ১১টায়। এই অধিবেশনের শিরোনাম ছিল ‘নারী – সমাজ ও সময়ের দেয়াল কি ভাঙছে’। অধিবেশনে মূল বক্তা ছিলেন শিক্ষাবিদ এবং নারী ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ মাহবুবা নাসরীন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কথাশিল্পী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মানস চৌধুরী এবং লেখক ও সাংবাদিক সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম। অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন লেখক, সাংবাদিক ও নারী আন্দোলনের নেত্রী নাসিমুন আরা হক।

মাহবুবা নাসরীন তাঁর বক্তব্যে বলেন, নারীকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কাঠামোয় দাঁড় করিয়ে শক্তিহীন একটা প্রজাতি হিসেবে দেখানো হয়। বলা হয়, তাদের সব সময় সহযোগিতা করতে  হবে। তাদের ওই চোখেই দেখতে হবে। এভাবে ক্ষমতার জায়গা থেকে নারীকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে উন্নয়ন পরিকল্পনা ছিল, সেই পরিকল্পনায় শিক্ষা, সমতা – এ বিষয়গুলো ছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্রের যে আদর্শ যে মতবাদ ছিল, একটা সময়ের পর সেই বিষয়গুলো থেকে রাষ্ট্র সরে এসেছে। দেশ প্রবেশ করেছে ধর্মরাষ্ট্রের ভেতর এবং এটাকেই প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছে। সম-অধিকারের বিষয়টা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে গিয়ে তলানিতে ঠেকেছে।

এদিন দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয় বিকেল ৪টায়। এই অধিবেশনের আলোচ্য বিষয় ছিল ‘লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি : সমকালে শিকড়সন্ধান কতটা জরুরি’। এতে মূল বক্তা ছিলেন লোকসংস্কৃতি গবেষক ও নাট্যকার সাইমন জাকারিয়া। আলোচক ছিলেন গবেষক ও লেখক সঞ্জীব দ্রং এবং প্রাবন্ধিক ও গবেষক রঞ্জনা বিশ্বাস। অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন প্রবীণ গবেষক এবং কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী।

মূল বক্তব্যে সাইমন জাকারিয়া বলেন, এদেশের লোকায়ত সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতিটি উপাদানের গভীরের ঐতিহ্যগত চিন্তা-চেতনা ও দর্শনের এমন অনেক মৌলিক জ্ঞান নিহিত রয়েছে, যা অন্বেষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাস পুনর্নির্মাণ ও পুনর্গঠন সম্ভব হবে। এতে বাংলাদেশের সম্প্রদায়-সম্প্রীতির স্বরূপ নির্মাণের কাজও সহজতর হবে। তাই সমকালে লোকায়ত সাহিত্য ও সংস্কৃতির শিকড়সন্ধানের পথে অগ্রসর হওয়া জরুরি।

অধিবেশনের সভাপতি অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী বলেন, বর্তমান সময়ে একটা অন্তঃসারশূন্য ফাঁকা মূল্যবোধ নিয়ে আমরা পথ চলছি। তিনি আরো বলেন, লোকসংস্কৃতি ও সাহিত্যবিরোধী বাধা অপসারিত না হলে লোকসংগীত ও লোকসাহিত্য সম্পর্কে আমাদের

চিন্তা-চেতনা দানা বাঁধবে না। বাঙালি সংস্কৃতি লোকসাহিত্যের ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সেই ভিতকে যদি আমরা আরো শক্ত করতে চাই, তাহলে রবীন্দ্রনাথের চেতনায় অভিষিক্ত হয়ে লোকজীবনের কাছে, লোকসংস্কৃতির কাছে আমাদের নত হতে হবে। আমাদের আত্ম-আবিষ্কারের চেতনায় নিজেদের অভিষিক্ত করতে হবে।

তৃতীয় অধিবেশন শুরু হয় বিকেল সাড়ে ৫টায়। ‘সৃজনকলার ভিতর-বাহির’ শিরোনামীয় এই অধিবেশনে মূল বক্তা ছিলেন শিল্পী ও শিল্প-লেখক মুস্তাফা জামান। আলোচক ছিলেন স্থপতি ও শিক্ষাবিদ সাইফ উল হক এবং আলোকচিত্রী ও শিক্ষক জান্নাতুল মাওয়া। এই অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন নগরবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।

মুস্তাফা জামান তাঁর বক্তব্যে বলেন, যদি কোনো শিল্পী তাঁর রাজনৈতিকতা বা সামাজিক অঙ্গীকার তুলে ধরতে ক্ষমতার রাজনৈতিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ান, সেই একই শিল্পীর ভাষা গঠনে প্রচলিত ভাষার বা জ্ঞানকাণ্ডের সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্ম চর্চিত হয়েছে – এমনটা হলফ করে বলা যায় না। কারণ শিল্পী নির্গুণকে গুণে, কিংবা অসারকে সারে পরিণত করেন।

প্রসঙ্গত, তৃতীয় দিনের প্রথম তিনটি অধিবেশন সঞ্চালনা করেন বেঙ্গল আর্টস প্রোগ্রামের বিভাগ সহকারী জাফরিন গুলশান।

‘কালি ও কলম সাহিত্য সম্মেলন ২০২৪’-এর শেষ অধিবেশনের শিরোনাম ছিল ‘তারুণ্য কি সত্যি জাগছে’। মূলত এটি ছিল উন্মুক্ত আলোচনা পর্ব। এতে সভাপতিত্ব ও সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কবি শামীম রেজা। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন এভারেস্ট শৃঙ্গজয়ী প্রথম বাংলাদেশি নারী নিশাত মজুমদার, গায়ক ও গীতিকার শিবু কুমার শীল, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও পরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরী এবং কবি ও সাংবাদিক হানযালা হান।

প্রাণবন্ত এই আলোচনায় উঠে আসে, এদেশের তারুণ্য সব সময়ই জাগ্রত। বিভিন্ন সময়ে ও প্রয়োজনে তরুণরাই এগিয়ে এসে হাল ধরেছেন। তাঁদের সময়োচিত ও যথাযথ পদক্ষেপ জাতিকে পথ দেখিয়েছে বিপদকালে। তবে বর্তমান সময়ে তরুণ জনগোষ্ঠীর একটি অংশ এদেশটাকে আর নিজের বলে ভাবতে পারছে না। তারা নিজেদের ঠিকানা খুঁজছে পরবাসে। সেই মানসিকতা থেকে তারুণ্যকে ফিরিয়ে আনতে হলে রাষ্ট্র ও সমাজকে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে বলে উল্লেখ করেন বক্তারা।

সবশেষে এই আয়োজনে অংশগ্রহণকারী সব অতিথিকে ধন্যবাদ এবং সাহিত্য সম্মেলনের উদ্দেশ্য আবারও সবার সামনে তুলে ধরেন কালি ও কলমের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি এমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।