প্রতিচিন্তায় ‘নারীর ক্ষমতা’

Being a woman in a patriarchal society does not imply being powerless. (Fredrik Engelstad, qtd. in Kajal Bandyopadhyay’s Female Power and Some Ibsen Plays, p. 59)

‘…বেশিরভাগ উচ্চাভিলাষী দিবাস্বপ্নের কোথাও না

কোথাও আমরা কোনো এক নারীকে দেখতে পাবো। … পুরুষটি ওই নারীর জন্যই তাঁর সমস্ত নায়কোচিত কর্ম সম্পাদন করে থাকেন। ওই নারীর পায়েই নিবেদন করেন নিজের সকল সাফল্য, স্বীকৃতি।’ (উদ্ধৃতি, পৃ ১২)

‘নারীর ক্ষমতা’ বিষয়টি আমাদের এখানে নতুন মনে হলেও বিশ্বের নানা প্রান্তে এ-নিয়ে ঢের আলোচনা-সমালোচনা এবং তর্ক-বিতর্ক বহু আগে থেকেই চলছে। সেই উনিশশো  আশির দশকে নাইজেরিয়ার প্রখ্যাত সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও গবেষক শেন্ওয়েজু নারীবাদের প্রচলিত ধারণাসমূহের বিপক্ষে অবস্থান নেন, এবং নারীর ক্ষমতাকে দেখেন মনোজাগতিক ও জৈবিকতার আলোকে। তিনি তাঁর পিএইচ.ডি অভিসন্দর্ভে নারীর ক্ষমতার নানা দিক উদাহরণসহ তুলে ধরেন, যা ‘পুরুষমাত্রই নির্যাতনকারী’ আর ‘নারীমাত্রই নির্যাতিত’ এমন ঘুণেধরা বিশ্বাসকে তছনছ করে দেয়। পরবর্তী সময়ে তাঁর ওই গবেষণাই অ্যানাটমি অব ফিমেল পাওয়ার শিরোনামে বই আকারে প্রকাশিত হয়। এরই বাংলা অনুবাদ করেছেন যৌভাবে
কবি-প্রাবন্ধিক-গবেষক-অধ্যাপক কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী এবং শিক্ষক ঊর্মিলা চক্রবর্তী। বাংলায় অনুবাদের পর বইটির শিরোনাম দাঁড়িয়েছে নারীর ক্ষমতা : ব্যবচ্ছেদ, বিশ্লেষণ।

বাংলা ভাষান্তরে শেন্ওয়েজুর বইটি হাতে পাওয়ার পর আগ্রহ জাগে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানতে। সত্যিই নতুন, কারণ, এর আগে বাংলাদেশে এ-জাতীয় কোনো বই বাংলায় অনূদিত হয়েছে বলে অন্তত আমার জানা নেই। আবারো বলছি বিষয়টি নতুন, কারণ, এর পরতে-পরতে আমাদের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া নৈমিত্তিক বিষয়গুলোকে ভিন্ন মাত্রায় হাজির করা হয়েছে; বিষয়-আশয়গুলো চোখের সামনেই ঘটে চলছে বহুকাল ধরে, কিন্তু শেন্ওয়েজুর মতো করে এসবকে কখনো দেখা হয়নি। ফলে, অনেক নতুন অথচ প্রাত্যহিক বিষয়কে আবিষ্কারের পথে এগিয়েছি এ-বই পড়তে পড়তে। বুঝতে পেরেছি, নারীর ক্ষমতার বিষয়গুলো আমরা কীভাবে প্রতিনিয়ত এড়িয়ে যাচ্ছি; অপরদিকে, পিতৃতান্ত্রিকতাকেই সবসময় দোষারোপ করছি।

নারীর ক্ষমতা ব্যবচ্ছেদ, বিশ্লেষণ বইটির পাঁচটি অধ্যায় – ক. নারীর ক্ষমতার বৈশিষ্ট্য, খ. মায়ের ক্ষমতা : বাবার যিনি কর্ত্রী, ঘরের তিনি মালিক, গ. কনের ক্ষমতা : প্রণয়ের ককপিট, ঘ. স্ত্রীর ক্ষমতা : আমার কর্ত্রীর ঘরে, এবং ঙ. মাতৃতন্ত্র এবং এর অভিযোগসমূহ। প্রতিটি অধ্যায়ে নারীর ক্ষমতার আলাদা-আলাদা দিক উঠে এসেছে। মা-কনে-স্ত্রী – এই তিন পরিচয়ে নারী তার ক্ষমতার প্রয়োগ করে।

লেখক বলেন, ‘নারীর ক্ষমতা … সকল পুরুষের ঘাড়ের ওপর ছায়ার মত বিরাজ করে। পুরুষের জীবনকে দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। নারীর ক্ষমতার বিভিন্ন রূপ দ্বারা এ ভাগগুলো নির্ধারিত হয়। পুরুষের জীবনের ওপর প্রাধান্য বিস্তারকারী এ রূপগুলো হলো : মায়ের ক্ষমতা, প্রেমিকার বা কনের ক্ষমতা এবং স্ত্রীর ক্ষমতা।’

(পৃ ১৭)।

প্রথম অধ্যায়ে নারীর ক্ষমতার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করতে গিয়ে লেখক কয়েকটি স্তম্ভের কথা বলেন : ‘গর্ভাশয়, হেঁশেল ও দোলনা।’ পুরুষের ওপর নারীর ক্ষমতা বুঝতে এ-তিনটি বিষয় জরুরি। লেখক বলেন, এগুলো নারীর ক্ষমতার ‘নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র’। গর্ভাশয় তার ‘অসামান্য’ ক্ষমতার প্রয়োগে একজন মহাশক্তিশালী পুরুষকেও বশীভূত করতে পারে। সন্তান উৎপাদনের জন্য নারী-পুরুষ উভয়ের সমান অবদান প্রয়োজন হয়, কিন্তু ভ্রূণ যখন নারীর গর্ভাশয়ে বড় হতে থাকে, তখন সেটির একচ্ছত্র অধিকার থাকে নারীর। ওই বিশেষ সময়ে পুরুষ নারীর নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে। এ-বিষয়ে লেখক বলেন, ‘বংশধরের মাঝে বেঁচে থাকার স্বপ্নে বিভোর পুরুষ তখন ওই গর্ভাশয়ের মালিকের জন্য যে-কোনো কিছু করতে পারে …  মালিকের অনিচ্ছায় যদি সে কারখানা জব্দ করে, কোনরকম ছলচাতুরি বা জোরাজুরি করে, তাহলে তার সকল স্বপ্ন ভেস্তে যাবে। কারণ, কারখানার মালিক যে-কোনো সময় ভ্রূণটি ফেলে দিতে পারেন, অথবা জন্ম দেবার সঙ্গে-সঙ্গে শিশুটিকে গলা টিপে মেরে ফেলতে পারেন।’ (পৃ ২১) 

এমতাবস্থায়, পুরুষ নিরুপায় বোধ করে। ফলে, বিশ্ব জয় করে নারীর পায়ে এনে হাজির করতে পারে সে। লেখকের মতে, এমন দাসত্ব তৈরিতে নারীর গর্ভাশয়ের ভূমিকা অসামান্য। আর, পুরুষের এমন পরাধীনতার মূল কারণ তার বংশধর সৃষ্টি করার অদম্য ইচ্ছা। এ প্রসঙ্গে লেখক আরো বলেন, ‘হে গর্ভাশয়! তুমি মহান! তোমার ক্ষমতা অশেষ। … তুমিই নারীর ক্ষমতার মূল শেকড়। তুমি এমন এক লক্ষ্য, যাকে ভেদ না ক’রে পুরুষের পক্ষে বংশধর সৃষ্টি অসম্ভব। তাই তো তোমাকে পেতে পুরুষ যে-কোন রকম দাম চোকাতে রাজি থাকে।’ (পৃ ২৩)

দ্বিতীয় পর্যায়ে আসে হেঁশেলের ওপর নারীর একক কর্তৃত্বের বিষয়টি। হেঁশেল ক্ষুধার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। শেন্ওয়েজু বলেন, ক্ষুধা এমন এক বিষয় যার কাছে সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনীও পরাজয় স্বীকার করে। হেঁশেল দখল করে নারী সেই ক্ষুধার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। এই নিয়ন্ত্রণ পুরুষের ওপর আধিপত্য বিস্তারে নারীকে সহায়তা করে। লেখকের ভাষায় : ‘যে নারীটি এ কেন্দ্রের [হেঁশেল] নিয়ন্ত্রণে থাকেন, তিনি পছন্দমত খাইয়ে, কিংবা একেবারে কিছু না খাইয়ে পুরুষটিকে সম্পূর্ণভাবে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখেন। দুঃখ হয় সেই পুরুষের কথা ভেবে, যিনি নিজের খাবারের জন্য পুরোপুরিভাবে স্ত্রীর ওপর নির্ভরশীল। তার তুলনায় জাহাজের খালাসীর জীবনও স্বর্গীয়।’ (পৃ ২৩)

লেখকের মতে, হেঁশেলের ওপর নারীর একচ্ছত্র আধিপত্য পুরুষকে নারীর ক্রীতদাসে পরিণত করে।

তৃতীয়ত, নারীর ক্ষমতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে দোলনাকে অভিহিত করেছেন শেন্ওয়েজু। মা তার ছেলেশিশুকে কীভাবে কিছু নির্দিষ্ট বিষয় শিখিয়ে বড় করে তোলে, সেগুলোকে বোঝাতে তিনি ‘দোলনা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। যেমন – শিশুকাল থেকেই ছেলেদের ‘রান্নাবান্না করা’, ‘ঘরবাড়ি গোছগাছ’ করা ইত্যাদি কাজের প্রতি প্রবল অনীহা তৈরি করা হয়। বিশেষভাবে, রান্নাবান্নার প্রতি অনাগ্রহ তৈরি করার কারণে একজন ছেলেকে আজীবন ক্ষুধা মেটানোর জন্য মা অথবা স্ত্রীর ওপর নির্ভর করতে হয়।

তাছাড়া, ছেলেদের শেখানো হয় মাতৃভক্তি। ফলে ‘মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর’ চিরকালীন এক দায়িত্ব বর্তায় ছেলেদের কাঁধে। সেইসঙ্গে ‘মাতৃআজ্ঞা’ পালনের যে শিক্ষা একজন ছেলেকে দেওয়া হয়, তা পরবর্তী জীবনে স্ত্রীর আজ্ঞা পালনের জন্য তাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে। অর্থাৎ, কীভাবে একজন পুরুষ ধীরে-ধীরে নারীর ক্ষমতার শিকার হয় তা স্পষ্ট করে তোলে ‘দোলনা’ নামক ধারণাটি। এ প্রসঙ্গে লেখক বলেন, ‘… হে মহান দোলনা! তোমার ক্ষমতা অতুলনীয়। ছেলেশিশুর অহংবোধকে পোষ মানিয়ে তুমি এমন এক ভিত্তি রচনা করো, যার ওপর নারীর ক্ষমতা ইচ্ছেমতো কাঠামো গঠন করতে পারে। তাহলে মোদ্দা কথা দাঁড়ালো, গর্ভাশয়ের ক্ষমতাটি মৌলিক, এবং দোলনা ও হেঁশেলের ক্ষমতা কৌশলগত। এদের মধ্যে যে-কোন একটিও কারও নিয়ন্ত্রণে থাকলে, তিনি ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী হন। আর তিনটিই থাকলে তো বলারই অপেক্ষা রাখে না।’ (পৃ ২৪-২৫)

‘গর্ভাশয়-হেঁশেল-দোলনা’ – এ তিনটি বিষয় কীভাবে নারীর ক্ষমতার অন্যতম উৎস হয়ে উঠলো, তা নিয়েও শেন্ওয়েজু চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি মনে করেন, ‘ঈশ্বর বা বিবর্তন’ নারীকে গর্ভাশয় উপহার দিয়েছেন। এদিক বিবেচনায় নারী প্রকৃতিগতভাবেই সুবিধাপ্রাপ্ত। তাই, তার ‘গর্ভাশয়ের অধিকার প্রশ্নাতীত’। এক্ষেত্রে, লেখকের মন্তব্য, ‘যে পর্যন্ত ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে নতুন প্রাণ সৃষ্টি করে গর্ভাশয়ের প্রয়োজনীয়তা রহিত করা না হয়, সে পর্যন্ত এর কর্তৃত্ব বজায় থাকবে’ (পৃ ২৭)। দ্বিতীয়ত, হেঁশেলকে নারীর আগলমুক্ত করা প্রায় অসম্ভব, কারণ, শিশুকাল থেকেই ছেলেদের গড়ে তোলা হয় হেঁশেলবিরোধী মনোভাব নিয়ে। কীভাবে হেঁশেল-নিয়ন্ত্রণে নারীরা নানা কৌশল অবলম্বন করে তার একটা ধারণা পাওয়া যায় নাইজেরিয়ার নারী কলামিস্ট বান্মি ফ্যাডাসের মন্তব্য থেকে : ‘বেশিরভাগ নারীই স্বামীকে বোকা বানিয়ে যে রাজ্যটির দখল নিয়েছেন, পুরুষ কোন্ অধিকারে সে রাজ্যের সীমা লঙ্ঘন করে? … এই যে মেয়েরা! এরপর থেকে রান্না করার সময় খুব সতর্ক থাকবে। বর যদি জানতে চায় রান্নার পাতিলে কোনটার সাথে কী মেশাচ্ছো, সঙ্গে সঙ্গে পাতিলের মুখ বন্ধ করে দেবে। প্রয়োজনে মাঝরাতে উঠে রান্না করবে, তবু বরকে কিছু শিখতে দেবে না।’ (পৃ ২৫)

এক্ষেত্রে, শেন্ওয়েজু জানান, হেঁশেলের অধিকার থেকে নারীকে বঞ্চিত করার যে-কোনো আন্দোলন বা প্রচেষ্টা বাধাপ্রাপ্ত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাছাড়া, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, নারীদের দোলনার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কোনো সুযোগই পুরুষ পাবে না; কারণ, এটি একটি শিশুর বেড়ে ওঠার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, যেখানে একজন নারীর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে, এক্ষেত্রে পুরুষের ভূমিকা খুবই সীমিত। সেই সঙ্গে দোলনার অধিকারে পুরুষ ভাগ বসাক – এমন কথা কখনো একজন কট্টর নারীবাদীও বলবেন না।

আসলে, নারী-পুরুষের ক্ষমতার স্বরূপ কেমন, তা বুঝতে নিম্নোক্ত মন্তব্যে মনোনিবেশ করা একান্তই জরুরি :

পুরুষের ক্ষমতা কঠোর, আক্রমণাত্মক এবং দাম্ভিকতাপূর্ণ। নারীর ক্ষমতা কোমল, সহিষ্ণু এবং স্বনিয়ন্ত্রিত। পুরুষের ক্ষমতাকে যদি অপ্রতিরোধ্য বলা হয়, তবে নারীর ক্ষমতাকে বলতে হবে অপরাজেয়। … বাধা পেলে পুরুষের ক্ষমতা গর্জে ওঠে, হানাহানি করে … নারীর ক্ষমতা বাধা পেলে ফিসফিস করে … প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করে দিতে চায়। (পৃ ২৭)

উপর্যুক্ত পর্যবেক্ষণ এ-বিষয়টি স্পষ্ট করে যে, পুরুষ তার ক্ষমতা নিয়ে গর্ববোধ করে এবং ক্ষমতার প্রয়োগে কঠোর, কঠিন ও নিষ্ঠুর হয়ে থাকে। ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়ে পুরুষ সাময়িকভাবে দ্বন্দ্বেও লিপ্ত হয়। তবে, নারী ক্ষমতাকে কৌশলে ব্যবহার করে। সে ক্ষমতার বিস্তারে তাড়াহুড়ো না করে ধীরস্থির হয়; পুরুষের মতো গায়ের জোর ব্যবহার করে না। নারী দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতা ব্যবহারে আগ্রহী, তাই সে গতির চেয়ে চাতুর্যের ব্যবহারকে গুরুত্ব দেয়।

বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে মায়ের ক্ষমতার নানা দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তবে শুরুতেই বলা হয়েছে, পুরুষের ওপর নারীর ক্ষমতার যতগুলো রূপ রয়েছে, সেসবের মধ্যে মায়ের ক্ষমতা সবচেয়ে কম তীব্র। মা চেষ্টা করেন ছেলেসন্তানের মধ্যে এক ধরনের ‘অপরাধবোধ জাগিয়ে তুলে’ তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে। প্রথমত, মা তাঁর ছেলেসন্তানকে ‘নয় মাস’ গর্ভধারণের বিষয়টি সবসময় মনে করিয়ে দেন। ‘বুকের দুধ’ পান করিয়ে বড় করে তোলার বিষয়টিকে সামনে এনে মায়ের প্রতি ছেলের কৃতজ্ঞতাবোধ বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করেন। অন্যদিকে, মা তাঁর মেয়েশিশুকে তার মতো কোমলতায় বড় করেন। মায়ের প্রতি মেয়ের শতভাগ আনুগত্য বজায় রাখতে যা-যা করা দরকার, মা তার সবকিছুই করেন। এমনকি, মেয়ে যাতে বিয়ের পর তার বরের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখে, সে-ব্যাপারেও মায়ের ভূমিকা চোখে পড়ার মতো। অর্থাৎ, পুরুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করার সব কৌশলই মেয়েশিশুরা মায়ের কাছ থেকে রপ্ত করে। লেখক মায়ের ক্ষমতার প্রধান দিকগুলোর একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করেছেন এভাবে :

বাচ্চাদের মধ্যে যথাযথ ব্যক্তিত্বের বুনিয়াদ সৃষ্টি করা : মেয়েদের মধ্যে নার্সিসিজম, ছেলেদের মধ্যে হিরোইজম [নায়কোচিত ভাব], মেয়েদের জন্য হেঁশেল ও দোলনা-ক্ষমতা সংরক্ষণ করা।

মেয়েদের শালীনতা ও যৌনতা বিষয়ক সংযম শিক্ষা দেবার মাধ্যমে তাদের মধ্যে গর্ভাশয়-ক্ষমতাকে বড় করে তোলা। (পৃ ৩৪)

তৃতীয় অধ্যায়ে শেন্ওয়েজু সামনে নিয়ে এসেছেন কনের ক্ষমতার বিষয়টি। তাঁর মূল বক্তব্য হলো : নারী তার দৈহিক সৌন্দর্য ব্যবহার করে পুরুষকে বশীভূত করে। এটা এক ধরনের টোপ। এটি ব্যবহার করে নারী পুরুষের কামনাকে জাগিয়ে তোলে। লেখকের মতে, পুরুষ সে-ফাঁদে পা দিয়ে চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেয়। পুরুষ যেহেতু নারীদের দৈহিক সৌন্দর্য বা গ্ল্যামারের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়ে থাকে, নারী সেটিকে পুঁজি করে পুরুষের ওপর সীমাহীন কর্তৃত্ব বিস্তার করে। লেখক এই অধ্যায়ে আরো দেখিয়েছেন, প্রেম কীভাবে পুরুষকে ‘পঙ্গু’ ও ‘পোষমানা’ করে – ‘প্রেমকাতর’ পুরুষকে নারী কীভাবে প্রেমের ফাঁদে বন্দি করে এবং শেষতক, বিবাহের মাধ্যমে পুরুষ এমন এক চুক্তিতে প্রবেশ করে, যেখান থেকে তার ‘মুক্তি’ প্রায় অসম্ভব।

চতুর্থ অধ্যায়ে, লেখক স্ত্রীর ক্ষমতার আগ্রাসী রূপ নিয়ে কথা বলেছেন। অধ্যায়ের শুরুতেই প্রখ্যাত সমালোচক জিলি কুপারের একটি উদ্ধৃতি রয়েছে, যা এরূপ : ‘পুরুষ হচ্ছে এমন এক গৃহপালিত প্রাণী যাকে কঠোর হাতে, কোমলভাবে পোষ মানালে বেশির ভাগ কাজই করানো সম্ভব’ (পৃ ৭৪)। এ প্রসঙ্গে লেখক মনে করেন, একজন স্ত্রী সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব কাজে লাগিয়ে বর-ব্যবস্থাপনা করেন। এক্ষেত্রে, পেশাজীবী নারীরাও স্ত্রী-জীবনকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া নারীদের সঙ্গে পেরে উঠবেন না। লক্ষণীয় যে, এই অধ্যায়েই শেন্ওয়েজু ‘পিতৃতন্ত্রের মুখোশ’ বজায়ে পুরুষের দম্ভের নানা বিষয় সামনে নিয়ে আসেন। কেন পুরুষ এই মুখোশ ধরে রেখেছে এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘… প্রথমত, শাসনকর্ত্রীরা পুরুষকে সর্বোচ্চ এই মুখোশ পর্যন্তই অনুমোদন করে; দ্বিতীয়ত, মুখোশ হচ্ছে, সেই জিনিস যাতে পুরুষের অহংবোধটা বাঁচিয়ে রেখে তাকে সর্বনিম্ন ছাড় দেয়া যায়। ফলে, ঘাড়ে চাপানোর দায়িত্বের বোঝাটা পুরুষ খুশি মনেই মেনে নেয়। তবুও যদি কোনোদিন সে মাতৃতন্ত্রকে উৎখাত ক’রে সত্যিকার পিতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়, নারী তখন ঠিকই প্রতিহত করবে।’ (পৃ ৮৮)

শেন্ওয়েজু তাঁর বইয়ের একেবারে শেষে নারীবাদের কিছু বিষয় যেমন – ‘নারী ক্ষমতাহীন’, ‘নারী পুরুষের দ্বারা নির্যাতিত’ ইত্যাদিকে প্রশ্ন করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি যে কেস স্টাডি তুলে ধরেন তা নিম্নরূপ :

লন্ডনের এক নারী অভিযোগ করেন, ‘নারীবাদ নারীর প্রতি পুরুষের আবেগকে ধ্বংস করেছে। এখন আর ভীড়ে ঠাসাঠাসি হওয়া বাসে কোনো পুরুষ কোনো নারীকে জায়গা ছেড়ে দেয় না। এমনকি সেই নারীর হাতে ব্রিফকেস … বা অন্য কোনো ভারী জিনিস থাকলেও না।’ এমনকি উচ্ছৃঙ্খল নারীবাদীরা …, যাঁরা এখনকার নতুন সুযোগ-সুবিধেগুলো ব্যবহার ক’রে আগেকার দিনে পুরুষদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলোতে বসেছেন, তাঁরাও ‘প্রগতিবাদী নারীবাদী’দের ওপর বিরক্ত। তাঁদের মতে, প্রগতিবাদী নারীদের এই ক্রমাগত গোলমাল পুরুষদের প্রতিহিংসাপরায়ণ ক’রে তুলছে। … পত্রিকা সম্পাদক বেবি রেমন্ড সম্প্রতি বলেন, ‘নারীরা এখনকার মত ভালো অবস্থায় আর কখনোই থাকেনি। আমরা ঘরে থাকতে পারি, বর-বাচ্চার যত্ন নিতে পারি … বাইরে গিয়ে চাকরি করতে পারি। সমান সুযোগ রয়েছে … আমরা পোশাক পরি বা খুলি, পৃথিবীটা নারীর জন্য ঝিনুকের মতো। সমস্যাটা কোথায়?’ (উদ্ধৃতি, পৃ ১৩৭)।

এমন একটি বইয়ের আলোচনায় দ্রুত ইতি টানা মুশকিল, তার কারণ এর বিষয়ের বিস্তৃতি। হাজারো

যুক্তি-তর্ক-আলোচনা-চিন্তা-প্রতিচিন্তা হাজির করে এর মূল বিষয় নারীর ক্ষমতাকে বিচার-বিশ্লেষণ করা যায়। বিশ্বসাহিত্যের দিকে তাকালেও দেখব কীভাবে নারীর অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার শিকার হয়েছে পুরুষেরা। ব্যাখ্যায় না গিয়ে সংক্ষেপে বলছি : শেকসপিয়ারের ম্যাকবেথ নাটকে লেডি ম্যাকবেথ, যার প্ররোচনায় ম্যাকবেথ রাজা ডানকানকে হত্যা করে ক্ষমতায় আসীন হয়, অথচ এই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে লেডি ম্যাকবেথ। আবার, ডরিস লেসিংয়ের দ্য গ্রাস ইজ সিংগিং উপন্যাসে দেখি কীভাবে সাদা চামড়ার মেরি টার্নার অসুস্থতা ও অসহায়ত্ব সত্ত্বেও নিজের স্বামী এবং ভৃত্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সদা আগ্রহী। অন্যদিকে, রবি ঠাকুরের ছোটগল্প ‘ল্যাবরেটরি’তে দেখি নারী কীভাবে তার গ্ল্যামার ও যৌন-আবেদন ব্যবহার করে পুরুষের উপর সীমাহীন প্রভাব বিস্তার করে। সবমিলিয়ে, বলা যায়, শেন্ওয়েজুর গবেষণাটি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিথিসিস, যা পুরুষতন্ত্রে সব-দোষ-খোঁজা নারীবাদকে (থিসিস) সজোরে আঘাত করে এবং এর ভিত নড়িয়ে দেয়। এমন একটি বইয়ের অনুবাদ বাংলাভাষী পাঠকদের নিঃসন্দেহে অনেক ভিন্ন বা প্রতিচিন্তার খোরাক জোগাবে।