অলীক গোলাপ

তারপর তো একদিন গোলাপের গন্ধে চারদিক ভরে গেল। শীলা সকালবেলা বারান্দায় এসে পেল সেই সুগন্ধ। চারদিক একেবারে ম-ম করছে। শীলা বাগানের দিকে তাকাল। সেখানে একটা পেয়ারা গাছ আর একটা ক্রিসমাস ট্রি। ফুল বলতে কয়েকটা নাছোড়বান্দা নয়নতারা। এই ফুলগুলো শীলার দেয়ালের ব্র্যাকেটে রাখা গুটিকয়েক নিরীহ ঠাকুরের ফুলের জোগান মেটায়। ও হ্যাঁ, একটা জবাও আছে, সচরাচর দেখা যায় না এমন হলুদ ফুল ফোটায়। আর আছে একটা শিউলি, সেটা বারোমাসের। মানে সারাবছরই শিউলির একটা ক্ষীণ গন্ধ ঘুরে বেড়ায় বাড়িটায়। তবে শরতে গন্ধটা যত ধক্ করে নাকে আসে, অন্য ঋতুতে ততোটা নয়। হয়তো সদ্য বর্ষা কাটিয়ে ওঠা ভিজে মাটি এবং প্রকৃতির অন্যান্য যোগসাজশ শিউলির গন্ধ ছড়ানোর জন্যে শরতে যতটা সক্রিয় থাকে, অন্য সময় সেই যোগাযোগগুলো ঠিকঠাক হয় না। শীলা বিড়বিড় করে বলে, ‘স্বাতী নক্ষত্রের জল। স্বাতী নক্ষত্রের জল।’ সেই যে একটা লোকের কঠিন অসুখ, বিশেষ তিথিতে মড়ার খুলিতে সাপ বিষ ঢালবে আর তাতে

পড়তে হবে স্বাতী নক্ষত্রের জল, তবে লোকটার ওষুধ পাওয়া যাবে – এই হচ্ছে যোগাযোগ।

কিন্তু গোলাপ? তার শ্রীহীন বাগান, নষ্ট মাটি – গোলাপ ফোটাবে কোথা থেকে? আর  যে-ব্যাপক  গন্ধ  বেরোচ্ছে,  তা  এক-আধটা  গোলাপের  সাধ্য  নয়, এ যেন হাজার হাজার টাটকা গোলাপ তার চারপাশে ফুটে আছে। শ্বশুরমশাইকে চা দিয়ে দু-একটা কথা বলে রোজ। সতী রান্নায় ব্যস্ত থাকে বলে চা-টা সে-ই দেয়। আজ চা দিয়ে সে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সেই সুগন্ধের মধ্যে।

শীলার শরীর শিরশির করে উঠল। তার কেমন যেন ঘোর লেগে গেল। অনেকদিন অনীকের সঙ্গে দেখা হয়নি। ও এতো ব্যস্ত থাকে আজকাল। কে জানে শীলাকে এড়িয়ে যাচ্ছে কি না! কথাটা মনে হলেই শীলার খুব কান্না পায়। ওর সাজানো বাগান শুকিয়ে যায় যেন। সাজানো বাগান! আবার গোলাপের গন্ধে ডুবে যায় শীলা। তার মনে হয়, তাহলে কি অনীকের সঙ্গে দেখা হবে আজ? তাই চারদিকে ভুরভুর করছে গোলাপের গন্ধ?

দুই

চা খেতে খেতে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিলেন জয়াশিস। চায়ের গন্ধ এরকম? সাধারণত তিনিই চা-পাতা কিনে আনেন শিয়ালদা থেকে। কিন্তু সে-চায়ের গন্ধ তো এরকম নয়। এ তো ভুরভুর করছে গোলাপের গন্ধ। তার বউমাটি রান্নায় নানান এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালোবাসে, যদিও নিয়মিত রান্না করতে হয় না। একবার চায়ের কৌটোয় শুকনো কমলালেবুর খোসা রেখে দিয়েছিল। বলেছিল, কোথায় যেন পড়েছে, এতে চায়ের স্বাদ যেমন খোলে, গন্ধটাও তেমনি দারুণ হয়। সত্যি খুব ভালো স্বাদ-গন্ধ হয়েছিল সেই চায়ের। সেই সাফল্যের জের টেনে শীলা কি তবে চায়ের কৌটোয় গোলাপের পাপড়ি রেখেছে? গোলাপের পাপড়ি দিয়ে অনেক কিছুই করা যায়, গোলাপজল, আবার গোলাপ পাপড়ির জ্যাম – গুল কন্দ। সেইরকম কিছু করেছে বোধহয় শীলা। খুশি হয়ে উঠলেন জয়াশিস। তাঁর মনে হলো অশোকের ফোনটা আজই পাবেন। অশোক জানাবে সুখবরটা। বলেছিল, মিসৌরির কাছে ও একটা বাড়ি কিনবে অনলাইনে। শুনে লাফিয়ে উঠেছিলেন জয়াশিস। তাঁর অনেকদিনের স্বপ্ন একটা নির্জন পাহাড়ি জায়গায় গিয়ে থাকবেন। ভোরবেলায় হাঁটতে হাঁটতে চলে যাবেন পাইনের অরণ্যে। পাহাড়চুড়োর মন্দিরে ঘণ্টা বাজবে ঢং ঢং, সেই আওয়াজ ছড়িয়ে যাবে অনেক দূরে। গোলাপের সুগন্ধ প্রাণভরে নিতে নিতে ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলেন জয়াশিস।

তিন

খবরের কাগজটা বাবার হাত হয়ে আসতে আসতে অনেক দেরি হয়ে যায়। এ নিয়ে আগে প্রচুর অশান্তি হতো, এখন শিবাশিস নিজেই এর একটা সমাধান করে নিয়েছে। সে নেটে খবর দেখে নেয়। সবকটা লিডিং ডেইলিরই ইন্টারনেট এডিশন আছে, বাথরুমে ঢোকার আগে মোবাইলে দেখে নিলেই হলো। মেট্রোতে যেতে যেতেও দেখে নেওয়া যায়। আজো তাই করেছিল আর একটু সময় বাঁচিয়ে রেখেছিল বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্যে। বাবা কদিন ধরে বলছে, চোখ দেখাতে হবে। শিবাশিস জানতে এসেছিল অ্যাপয়েন্টমেন্টটা করে ফেলবে কি না। ব্যালকনিতে বসে মন দিয়ে কাগজ পড়ছিল বাবা, যেমন পড়ে। দেশ, রাজ্য, গোটা দুনিয়ার খবর পড়তে পড়তে বাবার মুখে ফুটে ওঠে বিরক্তি, হতাশা, রাগ। খুব স্বাভাবিক। লোককে খুন করার ছবি ভিডিও করে পোস্ট করছে মানুষ, চলন্ত বাসে ধর্ষণ, এছাড়া কোনো খবর নেই তো কোথাও। তাহলে আর কি-ই বা অভিব্যক্তি হবে মানুষের? আজ শিবাশিস অবাক হয়ে দেখল বাবার মুখে কি আশ্চর্য এক মায়াবী আলো খেলা করছে। অসম্ভব প্রশান্ত মুখ, সবুজ শান্তির সরোবরের সন্ধান পেয়ে গেছে যেন। তার কারণটা সে বুঝতে পারছিল না। বহুকাল বাবার এমন মুখ সে দেখেনি। তবে সে নিয়ে বেশি ভাবার বা খুঁটিয়ে জিগ্যেস করার সময় তার ছিল না। সে তাড়াতাড়ি জিগ্যেস করল –

‘এই শুক্রবার তোমার চোখের অ্যাপয়েন্টমেন্টটা করে ফেলি তাহলে?’

আর তখনি সে গন্ধটা পেল। টাটকা গোলাপের গন্ধ। এক-আধটা নয়, একরাশ গোলাপ।

বাবা বলল, ‘তুই যা ভালো মনে করিস কর।’ সে-কথাটা শুনতেই পেল না শিবাশিস। সে দাঁড়িয়ে রইল সেই সুগন্ধের বলয়ের মধ্যে।

তারপর বলে ফেলল, ‘তুমি কোনো গন্ধ পাচ্ছ বাবা?’

জয়াশিস চমকে উঠলেন। তার মানে শিবাশিসও পাচ্ছে গন্ধটা। একা তিনি নন। এতোক্ষণ তিনি ভাবছিলেন গন্ধটা শুধু তাঁর জন্যেই একটা সংকেত নিয়ে এসেছে। অশোক ফোন করবে আজই। মিসৌরি শহর ছাড়িয়ে রত্নপুরায় একটা ছবির মতো বাড়ি, ঢালু লাল টালির ছাদ। তিনি আর অশোক ওখানেই কাটিয়ে দেবেন বাকি জীবনটা। সেটা নয় তাহলে? গন্ধটা সবাই পাচ্ছে?

তিনি হতাশভাবে বললেন, ‘গন্ধ? কই, না তো?’

শিবাশিস বিশ্বাস-অবিশ্বাস কিছুই করল না। তার হাতে একদম সময় নেই। এখুনি বেরোতে হবে, সে বেরোলে শীলাও বেরোবে সব গুছিয়ে। এখন কোনো ভাবাভাবির সময় নয়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ল্যান্ডিংয়ে রাখা মায়ের ছবিটার দিকে তাকাল সে। মা খুব গোলাপ ভালোবাসত। তার মনে হলো, মা তার কাছে ফিরে আসছে। শীলা লাস্ট পিরিয়ড মিস করেছে। একটা ছোট্ট মিষ্টি মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়িটায়, তার গা দিয়ে গোলাপের গন্ধ বেরোচ্ছে, স্পষ্ট দেখতে পেল সে।

চার

দাদা আগে বেরোয়, তারপর বউদি। ওদের খাবার, টিফিন গুছিয়ে দেওয়া আর মেসোমশাইয়ের টিফিনের পাট চুকলে একটু দম নিতে পারে সতী। তখন সে আস্তে-ধীরে কাজ সারলেও কারো কিছু বলার নেই। সব রেডি। শুধু তার আর মেসোমশাইয়ের ভাতটা দুপুরে একটু গরম করে নেবে। কাজ অবশ্য টুকটাক অনেক আছে। রান্নার হাঁড়িকড়াই সব মেজে রাখতে হবে। নইলে, ঠিকেলোক চাঁপা মুখটা শুধু তোলো হাঁড়ির মতো করে রাখবে না, চাপা গলায় সারাক্ষণ শাপশাপান্ত করে যাবে। সে ভারি অশান্তির ব্যাপার। সারাজীবন এতো অশান্তি পুইয়েছে সতী যে জীবনটাই তার ধিকধিক করে পুড়ে গেছে। দাদাদের এখানে বছর তিনেক কাজ করা ইস্তক জীবনে একটু সুস্থির এসেছে। গতর বাঁচানোর ভয়ে সেই সুস্থিরটুকু সে নষ্ট করতে পারবে না। চাঁপা পাঁচ বাড়ি ঘুরে ঘুরে কাজ করে। বাড়িতে মাতাল বরের ঠ্যাঙানি, বিছানায় হাগা-মোতা শাশুড়ি তার। এসব দিন সতী পেরিয়ে এসেছে। তাই সে যতটা পারে চাঁপার কাজ কমিয়ে রাখে, ভালোমন্দ টিফিন খেতে দেয়। তারপর সে একচিলতে বাগানটায় গিয়ে দাঁড়ায়। এখানকার মাটি ভালো নয়। গাছ হতে চায় না। এক গাড়ি ভালো মাটি ফেললেই হয়। সে দাদার আর সময় হয় না, ইচ্ছেও নেই। মেসোমশাই মুখে বলে, দাদার ওপর রাগও করে, কিন্তু নিজে আদৌ গা পাতে না। আর বউদি তো চরকিপাক খাচ্ছে রাত-দিন।

বাগানে একটা শিউলি, খানকতক নয়নতারা আর একটা জবা – এই তো সাকল্যে। তবে জবাগাছটার বিশেষত্ব আছে, হলুদ জবা ফোটে, যেটা সচরাচর লোকের বাড়ি থাকে না। আর আছে একটা  পেয়ারা গাছ। কষটা পেয়ারা, ছোট্ট ছোট্ট, আর রাজ্যের কাঠপিঁপড়ের বাসা। তবু রান্নাঘরের কাজ মিটিয়ে সেখানে বসলে বুকটা ঠান্ডা হয় সতীর। মনের কোণে পড়ে থাকা একটা আবছা আবছা ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সে দেখতে পায় মৃত্যুঞ্জয় বাগানে কাজ করছে আর সে পা টিপে টিপে ঠিক তার পেছনটিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার কাজ দেখছে। দেখছে কত যত্নে মৃত্যুঞ্জয় নিড়ানি দিয়ে মাটি ঘেঁটে দিচ্ছে, শুকনো মরা ডাল, হলুদ পাতা সরিয়ে ফেলছে, কত ফুল বাগান জুড়ে – গাঁদা, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয়ের বেশি নজর এই গোলাপ বাগানে। তাই সতীর কাছে মৃত্যুঞ্জয়ের গায়ের গন্ধ আর গোলাপের গন্ধ একাকার হয়ে আছে। বরের অমানুষিক মারের হাত থেকে পালিয়ে পালিয়ে সে যেত মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে। তাদের মধ্যে কোনোদিন ওসব কিছু হয়নি, সবাই যা ভাবে – বউ মানুষের শরীরের খুব খিদে থাকলে তা মেটাতে পরপুরুষের কাছে যায়। মনের কথা কেউ ভাবে না। মৃত্যুঞ্জয় কোনোদিন তার কাছে কিচ্ছু চায়নি, সে একদিন থাকতে না পেরে পিঠের দাগগুলো দেখাতে গিয়েছিল তার কাছে। সেগুলো দেখে মৃত্যুঞ্জয় তাকে বুকে টেনে নিয়েছিল, ঠোঁটের ওপর ডুবিয়ে দিয়েছিল ঠোঁট। সেই প্রথম সতী জেনেছিল পুরুষের স্পর্শ কত কোমল কত সুখকর হয়। কিন্তু সে তো এক মুহূর্তের জন্যে। তার তপ্ত বালুকাময় মরুজীবনে সে তো এক বিন্দু জল। এক লহমায় সেই জলটুকু শুষে নিয়েছিল সতী। সেটুকু কোথায় আর আছে? শুধু তার স্মৃতি রয়ে গেছে গোলাপগন্ধের মতো। কত রকমের গোলাপ ফোটাত মৃত্যুঞ্জয়। কী তার খোশবাই! গোলাপের গন্ধ নাকে এলেই মৃত্যুঞ্জয়ের কথা মনে পড়ে সতীর। মনে পড়ে ঠোঁটের ওপর উষ্ণ কোমল স্পর্শের কথা। বাগানে বসে সতী ভাবল, এই তো শুকনো মরা বাগান, ফুল বলতে নয়নতারা আর জবা। এখানে তাহলে ভুরভুর করে গোলাপের গন্ধ আসছে কোথা থেকে? তাহলে কি সে আসছে?

পাঁচ

অফিসে গিয়েই মিটিং ছিল। রোজই থাকে। শীলা একটা রেডিও চ্যানেলে কাজ করে, প্রতিদিন অফিস গিয়েই আগের দিনের প্রোগ্রাম নিয়ে একটা রিভিউ মিটিং হয়, সেইসঙ্গে সেদিনের প্রোগ্রামেরও প্ল্যানিং চলে। আজ সকাল থেকেই কেমন এলোমেলো লাগছে, লেট হয়ে গেছে আসতে। এসেই নিজের জায়গায় ব্যাগ নামিয়ে মিটিংয়ে ঢুকেছে, ফোনটা ব্যাগেই রয়ে গেছিল। মিটিং শেষ হলে এসে দেখল একগাদা মিসড কল। কিন্তু যার কল ও চাইছিল, সে-ই নেই। অনীক ফোন করেনি তাকে। অথচ অফিস পৌঁছানোর পর প্রথম ফোনটা অনীকেরই আসে। ও জানে শীলার টাইমিংগুলো, পারতপক্ষে বাড়ি থাকার সময়টা ফোন করে না। শীলার খেয়াল হলো দুদিন ধরে অনীক তাকে নিজে থেকে ফোন করছে না, সে-ই করছে। আর তখনো কেমন ভাসা ভাসা কথা বলছে অনীক, দেখা করতে চাইলে বলছে ভীষণ ব্যস্ত। শীলার হঠাৎ চোখ ফেটে জল এলো। তার এই দমবন্ধ করা জীবনে অনীক ছিল একঝলক টাটকা হাওয়ার মতো। সে তাকে নিজেকে নতুন করে ভালোবাসতে শিখিয়েছে, নিজের মধ্যের চাপা পড়ে যাওয়া নারীকে আবার জাগিয়ে তুলেছে। অফিসে সে একজন কর্মী ছাড়া কিছু নয়, প্রতি মুহূর্তেই তাকে মাপা হচ্ছে, তাকে কেবলই পারফর্ম করে যেতে হবে। বাড়িতেও সে কারো স্ত্রী, কারো বউমা, আর প্রতিটি সম্পর্কই তার কাছে নির্দিষ্ট কিছু জিনিস চায়, না দিতে পারলেই চোখে চোখে অদৃশ্য তিরস্কার ফুটে ওঠে। কিন্তু শীলা কী চায়? কী ভালোবাসে? সে-খবর ওরা কেউ রাখে না। সে-খবর রাখত শুধু অনীক। রাখত! ভাবতেই কষ্ট হলো শীলার। অনীকের ভালোবাসাও পাস্ট টেন্স হয়ে গেল এতো তাড়াতাড়ি! তার ভাগ্যে ভালো কিছু টেকে না কেন?

কাজের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে শীলা ভেবে দেখল, সিলভার ওক রিসোর্ট থেকে ফেরার পর থেকেই এমন করছে অনীক। সেদিনের সেই পাগল করা দুপুরের কথা তারপর থেকে যতবার তোলার চেষ্টা করেছে, ততবারই কথাটায় ঢুকতে চায়নি অনীক। তাতে শীলার এমন সন্দেহও হয়েছে, যা তার কাছে একটা স্বর্গীয় অভিজ্ঞতা, অনীকের কাছে সেটা কি জলভাত? ও কি প্রায়ই অন্য মেয়েদের নিয়ে …? তারপর নিজেই লজ্জা পেয়েছে এমন বিশ্রী ভাবনার জন্যে। অনীক, সে তো তাকে ছাড়া কাউকে জানে না, স্ত্রী আছে;

কিন্তু তার সঙ্গে যোজন যোজন তফাৎ

চিন্তায়, মানসিকতায়, রুচিতে। রবীন্দ্রভারতীর অধ্যাপিকা সেই স্ত্রী ইমন চায় অনীক আরো বেশি প্রাইভেট প্র্যাকটিস করুক, যেখানে অনীক চায় অবসর সময়ে গানের চর্চায় ডুবে যেতে। শীলা ছাড়া কে বুঝবে অনীককে?

কিন্তু একটা কথা যে অনীককে জানানো খুব দরকার। এ মাসে … শীলা ভাবল অনীককে ফোনটা করে নেয়, এরপর আর একদম সময় পাবে না। কিন্তু তার আগেই একটা ফোন এলো। শিবাশিস।

‘হ্যাঁ বলো।’

‘শীলা।’

‘আরে তাড়াতাড়ি বলো, গাদা গাদা কাজ।’

‘শীলা সন্ধেয় অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরোবে? আজ চলো না কোথাও খেতে যাই? আজ কীরকম মনে হচ্ছে যেন, মা ফিরে আসছে। মেয়ে হবে দেখো। সকাল থেকে অপূর্ব গন্ধ পাচ্ছি। চারদিকে যেন অনেক গোলাপ ফুটেছে। তুমি পেয়েছ গন্ধটা?’

ছয়

‘বাগানটার কিছু করা যায় না সতী?’

‘মাটি ফেলতে হবে গো মেসো, কতবার বলেছি তোমাকে, দাদাকে। তোমরা গা-ই করো না।’

‘কোথায় পাব রে মাটি?’

জয়াশিস ব্যালকনি থেকে চোখ বাড়িয়ে দিলেন বাইরে। শান্ত নিঝুম দুপুর। খাবার পর আরেকবার এসে বসা ব্যালকনিতে – রিটায়ারমেন্টের পর থেকে এই অভ্যেস। ইজিচেয়ারে বসে বাকি থাকা না-পড়া খবরগুলো আরেকবার পড়েন। ততোক্ষণে সতী খেয়ে উঠে রান্নাঘর গুছিয়ে ছোট্ট একটা বাটিতে একটু মৌরি নিয়ে আসে ওপরে। এসে দেখে কাগজ পড়তে পড়তে মেসোমশাই ঘুমিয়ে পড়েছেন। সে তখন তাঁকে ডেকে তুলে বলে, ‘মেসো ঘরে গিয়ে ভালো করে শোও। ঘাড়ে ব্যথা হবে যে।’

আজ অবশ্য সতী এসে দেখল মেসো জেগেই আছেন। ইজিচেয়ারে গা এলানো, বুকের ওপর খবরের কাগজটা রাখা, যেন শীতের চাদর। মেসো কিন্তু কাগজ পড়ছেন না, বাইরে তাকিয়ে আছেন। সতীর মনে হলো, মেসো বাগান দেখছেন। আহা কি-ই বা বাগান! মেসো যে বাগানই দেখছেন তা বোঝা গেল পরের কথায়। ‘বাগানটার কিছু করা যায় না সতী?’

মেসোকে মৌরি এগোতে এগোতে সতী বলে, ‘কেন, একটা লোক হাঁকতে হাঁকতে যায় দেখবে সকালের দিকে, গোবর সার গোবর সার, ওকে বললেই মাটি এনে দেবে। এক লরি মাটি লাগবে গো।’

‘কখন যায়? খেয়াল করিনি তো। তুই দেখলে ডাকিস।’

‘সকালে আমি কী করে ডাকব গো? রান্নাঘর থেকে কিছু শোনা যায়? আর তখন যে তাল। দাদা-বউদির আপিসের ভাত, টিপিন। তোমার টিপিন দিতেই কত দেরি হয়ে যায়। তুমি দেখতে পেলে ডেকে

বোলো রোববার আসতে। আমি কথা বলে নেব।’

জয়াশিস এ-কথার কোনো উত্তর দিলেন না। আজ কোথা থেকে যে এই সুগন্ধ এসেছে, এখন এই ভরদুপুরেও তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন, মিসৌরি শহর ছাড়িয়ে রত্নপুরায় পাহাড়ের মাথায় একটা ছোট্ট বাড়ি, ঢালু লাল টালির ছাদ, সামনে অনেকটা বাগান। সেখানে থরে থরে গোলাপ ফুটে আছে। পাহাড়ে খুব ভালো গোলাপ হয়। হাওয়া এতো স্বচ্ছ, কোলেস্টেরল ফ্রি তেলের মতো, কোনো দূষণ নেই। অশোক আর তিনি বারান্দায় বসে দেখবেন। ভাইপোদের কাছে খুব একটা ভালো নেই বেচারী। তাঁর অবশ্য কোনো কষ্ট নেই। ছেলে-বউমা যথেষ্ট খেয়াল রাখে। আর এই সতী আসার পর থেকে তো সংসার তরতর করে চলছে। মেয়েটা তাঁর এতো যত্ন করে! কিন্তু রুমা চলে যাওয়ার পর থেকে কী একটা শূন্যতা কুরে কুরে খায় তাঁকে।

তিনি দেখলেন, সতী তখনো দাঁড়িয়ে আছে। ‘যা গিয়ে শো একটু। আমি আজ এখানেই থাকব।’ সতী ইতস্তত করে বলল, ‘আমাদের দেশে একজন আছে, খুব ভালো বাগান করে, তার হাতে জাদু আছে। গোলাপ যা ফোটায়, খবর দেব মেসো? তোমার বাগানের চেহারাই পালটে দেবে।’

জয়াশিস কিছু বলার আগেই ফোন বাজল, ল্যান্ডফোন তাঁর ঘরেই রাখা। ওদের আর লাগে না। প্রত্যেকের নিজস্ব মোবাইল। সতী গিয়ে ধরল তাড়াতাড়ি। তারপর ফোনের মুখটা চেপে বলল, ‘ও মেসো, তোমার অশোক বলে কোন বন্ধু আছে?’

জয়াশিস আরো বেশি করে গোলাপের সুগন্ধ নিতে নিতে বললেন, ‘অশোক ফোন করেছে? জানতাম। ধরতে বল। আসছি।’

‘না গো, তিনি নাকি হসপিটালে ভরতি। হার্ট অ্যাটাক। ওনার ভাইপো জানাল। কথা বলো।’

সাত

বারাসাত থেকে ট্রেন ধরে দমদম। সেখান থেকে মেট্রোতে এসপ্লানেড। মোটামুটি তিনটের মধ্যে অফিসে ঢুকে যায় প্রদীপ। রাতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সাড়ে এগারো-বারো বাজে। মাঝখানের সময়টুকু সে নিশ্বাস ফেলার ফুরসত পায় না। তাই অফিসে পৌঁছে প্রথমেই চা আনতে বলে পাঁচ-দশ মিনিট একটু গল্পগাছা করে নেয় প্রদীপ। সোনালি বেন্দ্রের ক্যান্সার, কাতারে পরের বিশ্বকাপ হওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত থেকে অভীক এখনো অ্যানিভার্সারির খাওয়া খাওয়ায়নি, কিংবা ছুটির পর গত তিনদিন অমলেন্দু নীতার সঙ্গে বেরোচ্ছে – এসব অতি জরুরি বিষয় নিয়ে পরে আর কথা বলার সময় পাওয়া যাবে না। আর এই সময় মেইলটাও চেক করে নেয়। তার ফোন এখনো স্মার্ট হয়নি। অফিসের কম্পিউটারেই মেইল দেখে সে। গুচ্ছ গুচ্ছ জাংক মেলের ভিড়ে যদি সেই ঈপ্সিত মেইলটি থাকে। মাসের পর মাস হয়তো থাকেই না। প্রদীপ ভাবে, জয়িতা ভুলেই গেছে তাকে। না ভুলে উপায় কী, টেক্সাসের মতো জায়গায় ডাক্তার স্বামী, নিজের চাকরি, দুটো ছেলেমেয়ের ঝক্কি সামলে কে আর পুরনো প্রেমিককে মনে রাখতে পারে? যেদিন এমন ভাবে, ঠিক সেদিনই মেইল আসে জয়িতার। দু-চারটে লাইন – কেমন আছ? সিগারেটটা কমিয়েছ? ছেড়ে দাও প্লিজ। তোমায় বড্ড মনে পড়ছে আজ।

এই চারটে বাক্যই যেন প্রচণ্ড গরমে এক গ্লাস প্যারামাউন্টের শরবতের মতো। প্যারামাউন্টের কথা মনে হলো কারণ প্রেসিডেন্সি থেকে ক্লাস কেটে প্রায়ই প্যারামাউন্টের শরবত খেতে যেত ওরা। জয়িতা খুব ভালোবাসত আমপোড়া শরবত। এখন কত দামি দামি জিনিস খায়। আমপোড়া শরবত নিশ্চয় আর ভালো লাগবে না। তবু প্রদীপ মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখে জয়িতা কলকাতায় এসেছে আর ওরা দুজনে সেই কলেজের দিনগুলোর মতো প্যারামাউন্টে বসে শরবত খাচ্ছে। আজ অফিসে ঢুকে ভাবল, তিন-চারদিন মেইল চেক করা হয়নি, হয়তো জয়িতা পাঠিয়েছে কিছু। কম্পিউটার খোলার আগেই অলকদা ইন্টারকমে ডাকলেন, ‘প্রদীপ একটু এসো তো।’

প্রদীপ বুঝে গেল পাঁচ-দশ মিনিটের ওই সময়টুকুও আজ তার ভাগ্যে নেই। অলকদার মাথায় সবসময় নতুন নতুন আইডিয়া ঘোরে। আর তার বেশিরভাগ ধাক্কাটাই প্রদীপকে খেতে হয়। আবার কী নিয়ে ফাঁসাবেন কে জানে, ভাবতে ভাবতে অলকদার ঘরে ঢুকে একজন অচেনা লোককে দেখতে পেল প্রদীপ। অলকদা বললেন, ‘এসো প্রদীপ। এঁকে চেনো? নীতেশ মিত্তল। রিয়া সোপস অ্যান্ড টয়লেট্রিজ এঁর। আজকের কাগজে দেখেছ তো এঁদের নতুন রোজ সোপের বিজ্ঞাপনটা? কাগজ থেকে ভুরভুর করে গোলাপের গন্ধ বেরোচ্ছে। কত যে ফোন এসেছে। আইডিয়া এঁর আর প্রোডাকশনের সমীর সেন্টেড কালি দিয়ে ছেপে কামাল করে দিয়েছে। এখন বর্ষায় ইনি এঁদের নতুন কদমফুলের গন্ধওলা সাবানের বিজ্ঞাপনটাও এইভাবেই করতে চাইছেন।’

প্রদীপ বুঝতে পারে না এর মধ্যে তার কী করণীয় আছে। সে নিউজের লোক। সুগন্ধি কালি, বিজ্ঞাপনে সে কীভাবে আসে?

অলকদা ওর থতমত মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘ভেরি ব্যাড। সকালে তো নিজেদের হাউজের কাগজ দেখতে হয় আদ্যোপান্ত। বিজ্ঞাপনটা দেখলে বুঝতে পারবে কেন তোমায় ডাকছি। টেকনিক্যাল টিম এতো খাটল কিন্তু কপিটা একদম জমেনি। বানান ভুল, ভাষা জঘন্য। মি. মিত্তল চাইছেন এবার কদমফুলের গন্ধওলা সাবানের কপিটা যেন জব্বর হয়। আর তাই তোমাকে ডেকেছি। তুমি তো একসময় কবিতা-টবিতা লিখতে। এখনো হাত বসে যায়নি। গত পুজোয় আমাদের শারদ সংখ্যায় যেটা লিখেছ, দারুণ।’

অলকদার মুখ দেখে বুঝতে পারছিল ওর কোনো লেখাই তিনি পড়েননি। এটাও বুঝতে পারছিল, এই কপিটা তাকে লিখতেই হবে। ইনবক্সে হয়তো জয়িতার মেইল পড়ে আছে। জয়িতাকে এক প্রবল বৃষ্টির দিনে ভেজা কদম দিয়েছিল প্রদীপ আর সেদিন পেয়েছিল প্রথম চুম্বনের স্বাদ। আজ ছাপাখানার কালিতে কি সেই কদমের গন্ধ ধরা যাবে? নাকি তার কপিতে উঠে আসা সম্ভব জয়িতার ঠোঁটের সেই ভেজা নরম স্বাদ? মি. মিত্তল চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ গেল অলকদার সঙ্গে কপি নিয়ে আলোচনায়। তারপর প্রদীপ ফিরে এসে নিজের কম্পিউটারে বসল। পাতা ছাড়তে হবে এখুনি। এখন আর মেইল চেকের সময় নেই। মৃদু একটা গন্ধ পাওয়ার চেষ্টা করতে করতে সে কাজ শুরু করল। তখন আবার একটা মায়াবী সন্ধে নেমেছে শহরে। ঠিক সেই মুহূর্তে দক্ষিণ কলকাতার এক নামী রেস্তোরাঁয় বসে নিঃশব্দে খাচ্ছিল শিবাশিস আর শীলা। সকালের গোলাপের গন্ধ এখন কেমন ফিকে লাগছে। শীলা কি অসম্ভব ঠান্ডা। দুপুরে অনীক জানাল, ইমন সব জেনে ফেলেছে। শীলার সঙ্গে রিলেশন রাখা বেশ চাপের হয়ে যাচ্ছে। শিবাশিস ভাবছিল, এতো ঠান্ডার মধ্যে কি মা আসতে পারবে? আর তখন সতীকে নিয়ে ই এম বাইপাসের ধারে এক নার্সিংহোমে বসেছিলেন জয়াশিস। অশোক আইসিইউতে। ৭২ ঘণ্টা না কাটলে কিছু বলা যাবে না। লাল ঢালু টালির ছাদ আর তার সামনে গোলাপ বাগান মিলিয়ে যাচ্ছিল জয়াশিসের চোখের সামনে থেকে। তাঁর পাশে বসে সতী দেখতে পাচ্ছিল, গোলাপের বেডে ঝুঁকে কাজ করছে মৃত্যুঞ্জয়। কিন্তু এতো দূর থেকে গোলাপের কোনো গন্ধই পাচ্ছিল না সতী।