অসীম সাহার কবিতা : অনুভব আর বীক্ষণে ঋদ্ধ

অসীম সাহার শ্রেষ্ঠ কবিতাগ্রন্থটি সেই সাতের দশক থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত কবির লেখালেখির বৃহদাংশ। এই দীর্ঘপথ অতিক্রমে সব ধরনের বাঁক, রূপবদল, উদয় ও ক্ষয়ের সার্বিকচিত্র নিরবচ্ছিন্নভাবে স্পষ্টতর হয়ে উঠে এসেছে কবিতার পঙ্ক্তিমালায়। কবিতার পরতে পরতে কবির নিজস্ব স্বর স্পষ্টতর হয়েছে। (অসীম সাহার কবিতায় পাশ্চাত্য ধারার প্রতিফলন থাকলেও তিনি কোনো বিশেষ ধারাকে অবলম্বন করেননি, বরং বাংলা কবিতার চিরায়ত ধারাকেই বেছে নিয়েছেন।)

শ্রেষ্ঠ কবিতাগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘বিরহ কাতর এক দগ্ধ বাউলিনী’। এই কবিতায় কবি অসীম সাহা এক বিশেষ আয়না তৈরি করেছেন, যেখানে প্রতিফলন আর প্রতিসরণের চূড়ান্ত দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এই কবিতায় যেমন – কিছুই ব্যাখ্যা না করেই ছুঁয়ে দিয়ে গেছেন পাঠকের হৃদয়, গল্পকে রূপান্তরিত করেছেন কবিতায়, এই রূপান্তরিত গল্প চিত্রকল্পের উপহারে আর উপমায় পূর্ণতা এনে দিয়েছে কবিতার শরীরে।

          ক্লান্তিহীন জাহাজগুলো এসে

                   নোঙর করেছে একের পর এক

          অদ্ভুত বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছে তাকে।

          তারপর ছিঁড়ে-খুঁড়ে নোংরা অসহায় সেই ভিখারিণীকে

          ইচ্ছেমতো ছিন্নভিন্ন করে, পরিত্যক্ত একটুকরো

ন্যাকড়ার মতো ফেলে যাচ্ছে কোনোদিকে না তাকিয়েই;

ফ্যাল্ফ্যাল্ করে তাকিয়ে সে অকস্মাৎ

                   উন্মাদ হাসিতে ফেটে পড়ছে

তবু প্রত্যাশার পাল ওড়ে, কিন্তু কোনোদিক থেকেই বাতাস বয় না। দূরে আরো দূরপানে চোখ মেলে দেয়, উড়ালপাখি ঘরে ফেরে না। সময়ও অপেক্ষা করে। শুধু সমুদ্রফেনায় চিৎকার ভেসে বেড়ায়, হাহাকারের ছলাৎ ছলাৎ জল আরো উঁচু উঁচু ঢেউ হয়, তবু ডিঙাতে পারে না শূন্যতার কারা-দেয়াল! অদ্ভুত স্বপ্নময় অন্ধকার আজো বহমান এই পূর্ব-উপকূলে। একটি ঘটনা বা বাস্তবতা, যা তার অর্থকে ধারণ করে রূপকের বাইরে অবস্থান করে অথচ যেখান থেকে এই বাস্তবতার উৎপত্তি, সেখান থেকে সরে এসে অসীম সাহা অন্যমাত্রা যুক্ত করেন কবিতার পঙ্ক্তিতে। এটা এক ধরনের উপবাস্তববাদ বা ম্যাটারিয়ালিজম। রাশিয়ান কবি মিখাইল এপ্স্টাইনের মতে, উপবাস্তবতা হলো Ôa reality that opens up beyond the metaphor transpors its meaning, and not on the empirical plane from where the meaning is taken’.

          শূন্যতাকে ওর তখন মনে হয় কারাপ্রাচীরের মতো।

          মনে হয়, ভেতরে কারা যেন চিৎকার করছে

মনে হয়, কোটিÑকোটি কয়েদি তীব্র আর্তনাদে

                              ফেটে পড়ছে

শিউরে উঠে সে তবু প্রত্যাশায় বন্দরের মানুষের দিকে

চোখ ফেরায়;

সমুদ্রের নোনাজল পার হয়ে তার চোখ

বহু দূর পর্যন্ত ভেসে চলে যায়

অন্ধকারে সে তেমনি বসে থাকে বিরহ-কাতর

                   এই পূর্ব-উপকূলে।

কবি বিক্ষিপ্ত জীবনের মেটাফর থেকে পৌঁছে যান দার্শনিকতার সার্বভৌমত্বে। তখন ইতিহাস কথা বলে ওঠে, যেন খুঁজে পাই চিরচেনা পরম্পরায় অপেক্ষা আর উপেক্ষার আর্তনাদ, যা প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে শুধু উপকূলে নয়, এই নগরকূলেও, প্রাত্যহিক চিত্রেও রয়েছে যে-নিদর্শন।

চর্যাপদ থেকে একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত অনেকদূর গড়িয়ে এসেছে বাংলা কবিতার জল – যা একবারে কম নয়। বাঁকে বাঁকে কবিতা ধরন পাল্টেছে, এসেছে গদ্য কবিতার নিরুদ্দেশযাত্রা। যদিও ছন্দের সংস্কার করেই তৈরি হয় গদ্যকবিতা, কিন্তু তারও আগে তাকে কবিতা হয়ে উঠতে হয়।

একবিংশ শতকের ভোগবাদ হাজার ফণা তুলে মানবজীবনে নানান অগভীর চটক আনলেও বাংলা কবিতাচর্চায় ভাটা পড়েনি। কবিতার নাও পাল তুলে দিয়ে কী ভাটি কী উজানে এগিয়ে চলেছে। আর এ-যাত্রায় এখনো তাঁরাই অগ্রগামী, যাঁরা আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে সে-নায়ের হাল ধরেছিলেন। অসীম সাহা সে-দলের সহযাত্রী।

          জলোচ্ছ্বাসে কেড়ে নেয়া পত্র-পল্লবহীন নিঃসঙ্গ বৃক্ষের মতো

          জেগে আছি একা;

          আমৃত্যু জেগে থাকি গন্ধহীন ব্যথিত গোলাপ।

                                 (স্মৃতি : ব্যথিত গোলাপ)

একান্ত ব্যক্তিগত যা, তাই-ই হয়ে ওঠে কবিতার উপজীব্য; কিন্তু সূক্ষ্ম একটি মন লাগে দৈনন্দিন বিষয়কে কবিতায় তুলে আনতে, যেখানে থাকে প্রেম, ভাঙন আর মধ্যবিত্ত জীবনের বিরহকাহন।

          একদিন পাথর ভেবে যাকে দূরে ঠেলে দিয়েছি,

          আজ তারই পায়ের নিচে অর্ঘ্য সাজিয়ে বসে আছি

                   আমি এক অন্ধ ভিখিরি,

          আর তুমি আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুলে

                   করুণা-কাতর চোখে চেয়ে আছো

                             যেন এক পাথর-প্রতিমা।

                                          (‘পাথর-প্রতিমা’)

আধুনিক মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গেই মিশে আছে এক ধরনের অতীতচারণা, যাকে আমরা বলে থাকি নস্টালজিয়া। মানুষ প্রতিনিয়ত ফিরতে চায় তার শেকড়ে, পারে কি মানুষ ফিরে যেতে? আমরা চারপাশে যা দেখি, তা যেমন কবিতা নয়, আবার তা কবির দ্বারা তাঁর শব্দশৈলী দিয়ে চারপাশের চিত্রই কবিতা হয়ে উঠতে পারে।

এইভাবে নদী ও বালির বুকে যে আগুন জ¦লে ওঠে রোজ

          তোমার সকল প্রেম একা-একা তারই সঙ্গে যায় –

          যেন অনুগামী মুকুরের অন্তর্লীন ঘুম।

ঘুমের ভেতরে এক হাওয়ার বল্লম তার তীক্ষèতা ফেলে রেখে

নতজানু কুকুরের লেজের ঝাপটার মতো

দোল খায় সাতসমুদ্রপাড়ে।

                                          (‘কংক্রীটের হাঁস’)

ভরাট আর আন্তরিক তাঁর ধরন, যে-কোনো পাঠককেই সেই ভঙ্গির সামনে নত না করলেও পাঠকের অস্বীকার করার জো নেই। এই নিরুদ্বেগ, নিপুণ পঙ্ক্তি প্রায় সব কবিতার মধ্যেই ছন্দ-মাত্রায় সাবলীলভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে গেছে, আর সেই শেকড় মেলে দিয়েছে অটুট বন্ধনে। কবি কখনো গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেননি। বদ্বীপের শান্ত ঢেউ অসীম সাহার কবিতা-ভাষার স্রোতকে চিরজাগ্রত রেখেছে।

          তখনো হয়নি অনেক কথাই বলা

          তখনো নামেনি দুই চোখে ধারাপাত

          তখনো আসেনি বিরহ-ব্যাকুল ভোর

          তখনো কাঁপেনি হাতের ভেতরে হাত।

          মেটেনি তৃষ্ণা, কেটে গেছে কতো যুগ

অঙ্গে-অঙ্গে লাগেনি স্পর্শ তার

          গোধূলিলগ্ন পা হয়ে গেছে কবে

এখনো রয়েছে অপার বিরহভার।

                                           (‘কালের তুলিতে’)

কবিরা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হন প্রকৃতিগতভাবেই। কবির স্বপ্নের স্থানজুড়ে থাকে ‘সুন্দরতম’। সুন্দর পৃথিবী, বসবাসযোগ্য সুন্দর সমাজ। যেখানে ন্যায়বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে না। তাই কবিতার ভাবনায় সত্যের জয় হয়, যদিও বাস্তবতা ভিন্ন। তাই কবিতায় শুদ্ধতার আকুতি আছে, যেখানে ন্যায়ের সম্মানটুকু শান্তস্বরে উচ্চারিত হয়।

          মুখগুলো থেকে মুখোশ পড়েছে খসে,

          সাহসী মেয়েটি ছিটিয়ে দিয়েছে থুতু;

          …          …          …

          কিন্তু সে-মেয়ে কিছুই মানেনি তার,

          দেখিয়েছে শুধু বুকের বাঁধন খুলে;

          গোপন অঙ্গে নাম লেখা যার-যার

          তাদের দিয়েছে সামাজিক নায়ে তুলে।

       …           …          …

       এই সব দেখে মেয়েটি একাকী কাঁদে,

       বন্যপ্রাণীরা ধরা পড়ে গেছে জালে;

       মেয়েটি দেখছে গ্রহণ লেগেছে চাঁদে,

       তাই সে হাঁটছে কাল থেকে মহাকালে।

(‘মুখোশ’)

শ্রেষ্ঠ কবিতাগ্রন্থে রয়েছে উদ্বাস্তু সিরিজের দশটি আত্মোপলব্ধির কবিতা। আর এই দশটি গুচ্ছ কবিতাকে ‘কনফেশনাল পোয়েট্রি’ বলতে পারি। আবার চীনদেশীয় ‘মিস্টিক’ পোয়েট্রিও বলতে পারি। আমরা এই ধরনের কবিতার ইঙ্গিত পাই বিশ শতকের পাঁচের দশকে আমেরিকান কবিদের মধ্যে, যা কবির নিজের জীবনেরই প্রতিফলন। এখানে শুধু আবেগের খেলা নয়, নির্মাণের নৈপুণ্য থাকতে হয়। কবি সতর্ক মনোযোগ দিয়ে উচ্চস্তরের কারুকার্যে অতীত ও দৈনন্দিন ঘটনাবলি তুলে ধরেন। অসীম সাহার এই উদ্বাস্তু সিরিজের কবিতায় সাবলীলতার পাশাপাশি বিমূর্ত ছবি জুড়ে রয়েছে অভিজ্ঞতার মিষ্টি দ্যোতনা।

সুররিয়ালিজমের ভাবনার সঠিক প্রয়োগ রয়েছে তাঁর বহু কবিতার মধ্যে, অথবা বলা যায় সুররিয়ালিজম ও ম্যাজিক রিয়ালিজমের মিশ্রণ নিয়ে এমনভাবে তৈরি করেছেন – যার কোথাও কোথাও বিশ্বাস করতে হয় যে, অবচেতনেই চেতনার উন্মেষ ঘটে। কবিতায় তাই বড় বেশি করেই ফুটে ওঠে বর্তমান প্রজন্মের ভাবনাচিন্তার বিন্যাস। সংগত কারণেই মানুষ সুন্দর পরিসমাপ্তির স্বপ্ন দেখে তাঁর কবিতায় এমন বিষণ্নতামিশ্রিত আহ্বান রয়েছে।

সমুদ্রপ্রেমী কবি অসীম সাহা বিশালতার পানে চেয়ে থাকেন, কখনো আকাশকে সমুদ্র করে তোলেন, কখনো সমুদ্রকে দুলিয়ে দেন, কখনো সমুদ্রের প্রান্তসীমায় পৌঁছে যান। আর এসব তিনি সমুদ্রের মতো গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখেন, উন্মোচন করেন প্রেমিকার সমুদ্রের মতো গভীর জগৎকে, সেখানে রয়েছে সমুদ্রের মতো বিশাল হৃদয়! ‘সমুদ্র’ শব্দ নিয়ে কবি সামুদ্রিক সৌরভ ছড়িয়ে দেন অনেক কবিতায়, কখনো রূপকার্থে, কখনো উপমা দিয়ে, আবার বলেলেন, ‘সমুদ্রও হতে পারে ধু-ধু মরুভূমি’, এর পুনঃপুনঃ ব্যবহারেও শব্দ ক্লান্ত হয়ে ওঠেনি।

একশ দুটি কবিতার ঠাসা-বুননে অসীম সাহার শ্রেষ্ঠ কবিতা শ্রেষ্ঠত্বেরই প্রমাণ রেখেছে। আসীম সাহার পোয়েটিক ডিকশন বা কাব্যিক শব্দসম্ভার আক্ষরিক অর্থে পরিশীলিত,  প্রতীকাশ্রয়ী।