নদী ও নারীর জীবনকথা

এ এমন এক নারীর জীবনকথা যাঁর জীবনে তিনটে নদীর প্রভাব ছিল প্রবল – রায়পুরার মেঘনা, ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র ও ঢাকার বুড়িগঙ্গা। আর ছিল তিনজন মানুষের প্রভাব – শিক্ষানুরাগী দাদু প্রফুল্ল পাল, মা সরোজনলিনী পাল ও স্বামী অজয় রায়। নারীটি হচ্ছেন জয়ন্তী রায়। এদেশের প্রখ্যাত বামপন্থী নেতা কমরেড অজয় রায়ের সুযোগ্য স্ত্রী। জয়ন্তী রায়ের জীবনস্মৃতি মেঘনা পাড়ের মেয়ে বইটি নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক।

জয়ন্তী রায়ের মেঘনা পাড়ের মেয়ে বইটির একটি বড় জায়গা জুড়ে রয়েছে কমরেড অজয় রায়ের কথা এবং সংগত কারণেই। কারণ অজয় রায় কেবল জয়ন্তী রায়ের স্বামীই ছিলেন না, ছিলেন বাংলাদেশের বাম আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম সম্পাদক, একজন অর্থনীতিবিদ ও সুলেখক। যথার্থই একজন সব্যসাচী মানুষ।

জয়ন্তী রায়ের জন্ম ১৯৪৮ সালে। ফলে পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু, ষাটের দশকের গণআন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম, বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলনের বিকাশ ও বিভক্তি – এসবই খুব কাছ থেকে দেখেছেন। ফলে লেখিকার বর্ণনা কেবল একজন ব্যক্তির স্মৃতিচারণ নয়, তা হয়ে ওঠে যেন একটা গোটা জাতির স্মৃতিচারণ। বিশেষ করে জাতির সেই অংশটা – যাঁরা বামপন্থী ও প্রগতিশীল, যাঁরা এ-সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের বহু ব্যক্তি ও পরিবার জয়ন্তী রায়ের এই স্মৃতিচারণের মাঝে যেন নিজেদের জীবনেরও পদচিহ্ন দেখতে পাবেন। আর এসব দেখার ক্ষেত্রে লেখিকার যে বিশেষ সুবিধাটা ছিল তা হচ্ছে, বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বামপন্থী নেতা কমরেড অজয় রায়ের সহধর্মিণী হিসেবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তিনি দেখেছেন খুব কাছ থেকে। অনেক সময় ঘটনার আবর্তের কেন্দ্রবিন্দু থেকে।

এদেশের বাম আন্দোলনের যাঁরা আজ প্রায় কিংবদন্তি এবং এদেশের গণমানুষের আন্দোলনের ইতিহাসে যাঁদের রয়েছে সুবিশাল অবদান, এমনসব কমিউনিস্ট নেতার, যেমন কমরেড মণি সিংহ, কমরেড অনিল মুখার্জী, কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী, কমরেড বারীন দত্ত, কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ – এঁদেরকে লেখিকা দেখেছেন খুবই কাছ থেকে। মিশেছেন পারিবারিকভাবে। এছাড়া এমন কিছু ব্যক্তি ও পরিবারের সঙ্গে লেখিকার ঘনিষ্ঠতা ছিল বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে যাঁদের অবদান অনন্য। যেমন বেগম সুফিয়া কামাল, বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য্য, রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য, অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সন্জীদা খাতুন বা ওয়াহিদুল হকের মতো মানুষেরা। ফলে এঁদের সঙ্গে লেখিকার স্মৃতিচারণের একটা

সমাজ-ঐতিহাসিক মূল্য তো রয়েছেই।

লেখিকার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে মেঘনা নদীর পাড়ে রায়পুরায়। মেঘনা নদীতে সাঁতার কেটে বড় হয়েছেন। তাঁর চেতন-অবচেতন মনের একটা বড় অংশ জুড়েই যেন তাই রয়ে গেছে বিশাল মেঘনা নদী। নিজের আত্মজীবনীটার নামও হয়তো তাই রেখেছেন মেঘনা পাড়ের মেয়ে।

বড় হয়ে রায়পুরা ছেড়ে লেখাপড়া শিখতে আসেন ময়মনসিংহ শহরে। পঞ্চাশ-ষাটের দশকের ব্রহ্মপুত্রপারের নিস্তরঙ্গ কিন্তু সংস্কৃতিমনস্ক ময়মনসিংহ তখন সুন্দর এক শহর। এ-শহরেই বেড়ে ওঠা, ছাত্র ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে একসময় কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ আর অজয় রায়ের সঙ্গে পরিচয় ও পরে বিয়ে।

কমরেড অজয় রায় ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী। ফলে আয়-উপার্জন তেমন ছিল না। অথচ ততদিনে তাঁদের গড়ে উঠেছে নিজস্ব পরিবার, একে একে তিনটে সন্তানও। পরিবার প্রতিপালনের দায়িত্বটা জয়ন্তী রায় তাই নিজের কাঁধে তুলে নেন। চাকরি নেন এক বীমা কোম্পানিতে। ময়মনসিংহ ছেড়ে এলেন আরেক নদী বুড়িগঙ্গাপারের শহর রাজধানী ঢাকায়। জীবনের দীর্ঘ চলার পথে চাকরি করে স্বামী ও সন্তানদের অন্নপূর্ণার মতোই যখন যা প্রয়োজন আজীবন জুগিয়ে গেছেন জয়ন্তী রায়। সে ছিল এক নিরন্তন জীবনসংগ্রাম।

অল্প বয়সে পিতার মৃত্যু হওয়ার ফলে মা আর দাদুই ছিলেন বালিকা জয়ন্তী রায়ের অভিভাবক। দুজনেরই গভীর আগ্রহ ছিল মেয়েটা লেখাপড়া শিখুক, মানুষ হোক। তার জন্য তাঁদের ত্যাগ ও চেষ্টার কোনো বিরাম ছিল না। অন্যথায় অত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ভালোভাবে লেখাপড়া শেষ করা সম্ভব হতো না জয়ন্তী রায়ের পক্ষে। পাকিস্তান আমলে একটি হিন্দু মেয়ের পক্ষে একা একা বাইরের কোনো শহরে গিয়ে পড়াশোনা করা তেমন সহজ ছিল না। তাই এ-দুজন মানুষের কথা বারবারই এসেছে জয়ন্তী রায়ের স্মৃতিকথায় – মা সরোজনলিনী পাল ও দাদু প্রফুল্ল পালের কথা। আর তৃতীয় যে-মানুষটার স্মৃতিচারণা এসেছে বারবার, এবং সেটা আসতেই হতো, তিনি হচ্ছেন যাঁর নিকট-সাহচর্য জয়ন্তী রায়ের জীবনকে অর্থবহ ও পরিপূর্ণ করেছে, এদেশের সেই সর্বজনশ্রদ্ধেয় বামপন্থী নেতা অজয় রায়, যাঁর স্মৃতিচারণ বইটিকে করেছে বিশেষভাবে গুরুত্ববহ।

বইটির একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। জয়ন্তী রায় কীভাবে পঁচিশে মার্চের পর এক বিপজ্জনক পথ পেরিয়ে দেশত্যাগ করলেন, উঠলেন ত্রিপুরার আগরতলায় কমিউনিস্ট পার্টির আস্তানা ক্রাফ্টস হোস্টেলে, এসব বর্ণনার একটা ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে বইকি! একটা রক্তাক্ত কিন্তু সফল মুক্তিযুদ্ধের পর যেভাবে প্রায় ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়ায় বাংলাদেশ, জয়ন্তী রায়ের দেখা সে-অভিজ্ঞতা তো ছিল গোটা বাংলাদেশের মানুষেরই অভিজ্ঞতা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা এসেছে কয়েকবারই। কারণ বঙ্গবন্ধু অজয় রায়কে চিনতেন। দেখা-সাক্ষাৎ হতো। বঙ্গবন্ধু-সম্পর্কিত কিছু কিছু ঘটনার বর্ণনার রয়ে গেছে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তাৎপর্য। যেমন জয়ন্তী রায়েরা পারিবারিকভাবেই ঘনিষ্ঠ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও বঙ্গবন্ধুর নিকট সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলামের পরিবারের। বিশেষভাবে ঘনিষ্ঠ ছিলেন সৈয়দ নজরুলের পুত্র সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে, যিনি পরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। সৈয়দ আশরাফ জয়ন্তী রায়কে বলেছিলেন যে, তিনি ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির মানুষদের পছন্দ করেন। কারণ ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে তিনি লন্ডনে একটি বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। তিনি তখন লন্ডনে থাকতেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অনুসারী বলে দাবিদারদের কাউকে তিনি পাননি। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের ধারার মানুষেরাই কেবল তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে মিছিলটাতে শামিল হয়েছিলেন। সৈয়দ আশরাফ তাঁকে এটাও বলেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে কিশোরগঞ্জ শহরে পনেরোই আগস্টের পরে প্রথম যে প্রতিবাদ মিছিলটা হয়েছিল সেটাও হয়েছিল

বাম-প্রগতিশীলদের উদ্যোগে।

জয়ন্তী রায় তাঁর বইটিতে কেবল যেসব মানুষকে দেখেছেন বা যেসব ঘটনার মধ্য দিয়ে গেছেন তার বর্ণনাই নয়, দেশের ভেতরে ও বাইরের যেসব জায়গায় গেছেন, সেসবেরও দিয়েছেন মনোজ্ঞ বর্ণনা। জয়ন্তী রায় বহুবার ভারতে ভ্রমণ করেছেন। বিশাল ভারতবর্ষের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান, শান্তিনিকেতন, বেনারস, নালন্দা, অজন্তা-ইলোরা – এসবের বর্ণনা রয়েছে বইটিতে। তিনি দুবার গিয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। কমিউনিস্ট পার্টির একজন নেতার স্ত্রী হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক কিছুই দেখেছেন কাছ থেকে। কমিউনিস্ট নেতারা সাধারণত সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে কোনো ভিন্নমত বলতেন না। কিন্তু জয়ন্তী রায় তো রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে যাননি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণ করেছেন একজন স্ত্রী হিসেবে, একজন সংবেদনশীল নারী হিসেবে। ফলে তাঁর দেখার চোখ ছিল ভিন্ন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়াও ছেলেমেয়েদের বিদেশে থাকার সুবাদে গেছেন পশ্চিম ইউরোপে। ঘুরেছেন জার্মানি, ফ্রান্স, হল্যান্ড, বেলজিয়াম। গেছেন আমেরিকা ও কানাডাতেও। বইটিতে সেসব ভ্রমণের বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা আছে।

কেবল যদি একজন মানুষের জীবন, বা একটা পরিবারের জীবনচিত্র জয়ন্তী রায় আঁকতেন, তাহলে এ-বই হয়তো ততটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু হতো না। কিন্তু লেখিকা বইটিতে নিজের জীবন ও নিজের পরিবারের সঙ্গে গোটা জাতির ইতিহাসটাই যেন তুলে ধরেছেন। ষাট দশকের আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর দেশ গড়ার চেষ্টা ও বাকশাল গঠন, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, আমাদের ইতিহাসের গোটা এই পর্বটাই যেন উঠে এসেছে জয়ন্তী রায়ের মেঘনা পাড়ের মেয়ে বইটিতে। আর এসেছে বেশ বিশদেই। এ-বই হয়তো ইতিহাসগ্রন্থ নয়, কিন্তু যাঁরা বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেন, জয়ন্তী রায়ের মেঘনা পাড়ের মেয়ে বইটি তাঁদের জন্য চমৎকার একটা আকরগ্রন্থ হতে পারে। এ-বইয়ের বড় এক গুণ, বইটির সহজ-সরল ভাষা ও ডিটেলসের বর্ণনায় সাবলীলতা। সৈয়দ ইকবাল হোসেনের রুচিশীল প্রচ্ছদ ও নির্ভুল ছাপার এ-বইটি একটানেই পড়ে ফেলার মতো একটি মনোগ্রাহী বই। বইটি লেখার জন্য আমি লেখিকা জয়ন্তী রায়কে সবিশেষ ধন্যবাদ জানাই এবং বইটা ব্যাপক পাঠকনন্দিত হবে বলে প্রত্যাশা করি।