জলের অক্ষরে লেখা   

পর্ব : ১৯

নাস্তার টেবিলে বসে ঋভু খেয়াল করলো, দুজনেই বেশ চুপচাপ। এর মধ্যে কী হলো আবার?

মা-মেয়েতে মনোমালিন্য? নাকি অন্য কিছু? কিছুক্ষণ পর সোফিয়া বললো, একটা কথা জিজ্ঞেস করি বাবা?

– করো।

– এই দেশে কাজের সুযোগ কেমন?

– কাজ মানে?

– মানে আমি যদি পড়াশোনা শেষ করে এখানে আসি তাহলে কাজ পাবো?

– নিশ্চয়ই পাবে। কী ধরনের কাজ চাও বলো।

– তা এখনো ভাবিনি। আমার তো কোনো ধারণা নেই।

– সব ধরনের কাজের সুযোগই আছে। যদি চাকরি চাও পাবে, ব্যবসা করতে চাইলে পারবে, আবার যদি সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ধরনের কোনো কাজ করতে চাও তাও পারবে।

– তাহলে যে শুনেছিলাম, বাংলাদেশে অনেক সমস্যা, ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে কাজ পায় না!

– ঠিকই শুনেছ মা। এটা ডিপেন্ড করে তুমি কোন শ্রেণিতে আছ।

– মানে?

– মানে, মধ্যবিত্ত হলেই যত সমস্যা। নিম্নবিত্তরা

কোনো-না-কোনো কায়িক শ্রমের কাজ জুটিয়ে নেয়, উচ্চবিত্তদের এসব নিয়ে ভাবতেই হয় না।

– আমি কোন শ্রেণিতে?

– তোমার কী মনে হয়?

– মধ্যবিত্তই তো হওয়ার কথা।

– না মা, তুমি উচ্চবিত্ত শ্রেণিতে থাকবে।

– কীভাবে?

– তুমি আমার মেয়ে যে!

– তোমার কি অনেক টাকা বাবা?

ঋভু হেসে ফেললো – অনেক না হলেও যেটুকু আছে তাতে তোমাকে আর টাকা নিয়ে ভাবতে হবে না। যে-কোনো ধরনের কাজই তুমি করতে পারবে।

– যদি ব্যবসা করতে চাই?

– ওই যে বললাম, টাকা কোনো সমস্যা হবে না। তবে ব্যবসা দাঁড় করানো বা পরিচালনা করার সক্ষমতা তোমার থাকতে হবে।

– হুম। আর যদি চাকরি করতে চাই?

– ওটা তো আরো সহজ।

– সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের কথা বলছিলে! ওটা করার উপায় কী?

– এদেশে এত সমস্যা যে, সারাজীবন কাজ করলেও তুমি শেষ করতে পারবে না।

– কিন্তু আমি সে-সুযোগ পাবো কীভাবে?

ঋভু খেয়াল করছিল, আরিয়ানা মাথা নিচু করে চুপচাপ খাচ্ছে, বাপ-মেয়ের আলাপচারিতায় ঢুকছে না, এমনকি তাকাচ্ছেও না। হঠাৎ করে কী হলো ওর? মুখটা অমন বিষণ্ন হয়ে আছে কেন? কিন্তু এখন এ-কথা জিজ্ঞেস করার  সময় নয়। রুমে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেই চলবে। সোফিয়া প্রশ্ন করে তাকিয়ে আছে, ঋভু বললো – সুযোগ তৈরি করে নেবে। যেমন ধরো, তোমার এক চাচা আছেন…

– চাচা? তোমার তো কোনো ভাই নেই। তাহলে আমার চাচা আসবে কোত্থেকে?

ঋভু হাসলো – ভাই নয়। আমার বন্ধু। বাবার বন্ধুরা চাচাই হয়।

– ও আচ্ছা।

– ও এই দেশের খুব বড় একজন আর্কিটেক্ট। নিজের ফার্ম আছে। ও এখন একটা নতুন প্রজেক্ট করছে…

ঋভু খুব গুছিয়ে পুরো ব্যাপারটা বললো। মনোযোগ দিয়ে শুনছিল সোফিয়া, আরিয়ানাও যে মনোযোগ দিচ্ছে তা খেয়াল করেনি। খেয়াল করলো যখন আরিয়ানা জিজ্ঞেস করলো – তোমার এই বন্ধুর কথা কি আমাকে আগে কখনো বলেছ পারভেজ?

– না বোধহয়।

– কী চমৎকার একজন মানুষ! শুনেই ভালো লাগছে।

– কথা বললে আরো ভালো লাগবে।

– কী নাম ওর?

– জহির আমিন। আমরা ডাকি অংশু বলে।

– আমাদের সঙ্গে দেখা হবে না?

– নিশ্চয়ই হবে। আমরা তো ঢাকা ছাড়বো কালকে, আজকে সন্ধ্যায় ওর বাসায় যাওয়া যেতে পারো।

– বেশ হয় তাহলে। জানো, আমার মনে হচ্ছে, এরকম

একটা কাজে যদি আমিও যুক্ত হতে পারতাম!

– হতে চাইলে নিশ্চয়ই পারবে। তখন তুমি আর আমি ওখানে গিয়েই থাকবো। আর সোফিয়া এই বাড়িঘর সামলাবে। পারবে না মামণি?

সোফিয়া মিষ্টি করে হাসলো, বললো – এত তাড়াতাড়ি সব ঠিক করে ফেলো না। দেখা যাক।

– ঠিক আছে। এখন তাহলে তোমরা রেডি হয়ে নাও। একটু ঢাকা শহর দেখিয়ে আনি তোমাদের।

নাস্তার টেবিল ছেড়ে তিনজন দোতলায় গেল, রুমে ঢোকার আগে আরিয়ানাকে ডাকলো ঋভু – আরিয়ানা শোনো।

– কী?

– কী হয়েছে তোমার?

– কই, কিছু না তো!

– মন খারাপ কেন?

– না তো! আমি ঠিক আছি।

– আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না। কী হয়েছে বলো।

– এত অস্থির হয়ো না। বলবো, সবই বলবো। বলার জন্যই তো এসেছি।

– শোনার জন্য কতদিন অপেক্ষা করতে হবে?

হাসলো আরিয়ানা – পাগল একটা। কেবল তো এলাম। একদিনে সব কথা বলা যায়? আমরা তো একসঙ্গেই থাকবো, সময়-সুযোগমতো বলবো। না বলে যাবো না।

– আচ্ছা ঠিক আছে। যাও গোসল করে রেডি হয়ে নাও।

আরিয়ানা নিজের রুমে যাওয়ার পর ঋভু ফোন করলো অংশুকে।

কী রে, আজকে এত সকাল সকাল ফোন? – অংশু বললো।

– বাসায় অতিথি। ভোরেই উঠতে হয়েছে।

– আহারে! আমার ঘুমকাতুরে বন্ধুটা…

– ফাজলামি রাখ। জরুরি কথা আছে।

– বল।

– সন্ধ্যায় তোদের বাসায় আসছি।

– আয়। এটা এমন কী জরুরি কথা?

– আরে গাধা এটা না। অন্য আলাপ।

– তাহলে সেটাই বল।

– আরিয়ানা মেয়েকে নিয়ে এসেছে।

– তো?

– ওটা আমারও মেয়ে।

– তোর মেয়ে মানে? – ওপাশে চেঁচিয়ে উঠলো অংশু।

– চিল্লাইস না গর্দভ।

– না মানে, হজম করতে একটু অসুবিধা হচ্ছে।

– হজম করে ফেল। ও আমারই মেয়ে। সেই যে নেপালে…

– বুঝেছি। কিন্তু এতদিন পর জানলি কেন? আরিয়ানা আগেই জানায়নি কেন?

– জানি না রে। বুঝতে পারছি না। এখনো খোলাখুলি কথা হয়নি।

– খুবই অদ্ভুত লাগছে। ও সত্যি বলছে তো, নাকি অন্য কোনো ধান্ধা আছে?

– এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে সত্যি বলেই মনে হচ্ছে। সন্ধ্যায় তো দেখা হচ্ছেই, তুই নিজেই দেখে বলিস।

– হুম, আচ্ছা।

– শোন, এখনই কাউকে বলিস না। খালাম্মাকে তো নয়ই। এই খবর উনার জন্য শকিং হবে। ওদের সঙ্গে দেখা হলেও এমন ভাব দেখাবি যেন কিছুই জানিস না। 

– আচ্ছা। অপলাকেও জানাবো না?

– ওকে আমিই বলবো। আজকে তো দেখা হচ্ছেই। এখন রাখি।

– আরেকটু শুনি।

– নারে। ওদেরকে নিয়ে একটু বেরুবো। কালকে তো ঢাকার বাইরে চলে যাবো, আজকে শহরটা একটু দেখিয়ে আনি। এখনো গোসল করিনি। রেডি হতে হবে।

– আচ্ছা ঠিক আছে।

– সন্ধ্যায় বাসায় থাকিস।

– হ্যাঁ, থাকবো। ডিনারের ব্যবস্থা কি বাসাতেই করবো?

– না, কোনো রেস্টুরেন্টে যাবো। তুই অপলাকে বলে রাখিস।

– আচ্ছা ঠিক আছে।  

কিছুক্ষণ পর সেজেগুজে তিনজন বেরোলো বেড়াতে। আজকে অবশ্য সঙ্গে ড্রাইভারও আছে। ঋভু প্রথমেই ওদের নিয়ে গেল পুরনো ঢাকায়, অলিগলি ঘুরিয়ে গেল লালবাগ কেল্লা আর হোসনি দালানে, বললো – এই আমাদের চারশো বছরের পুরনো শহর। তার আগেও জনবসতি ছিল, কিন্তু সে-ইতিহাস লেখা হয়নি কখনো।

তারপর দেখালো শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, চারুকলা ইনস্টিটিউট আর জাদুঘর। কেবল দেখালোই না, বর্ণনা করলো সবকিছু। তারপর রমনা পার্কে কিছুক্ষণ বেড়িয়ে ফিরে এলো বাসায়। একদিনের জন্য যথেষ্ট। এবার ওরা খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিক, সন্ধ্যার পর অংশুদের বাসায় যাওয়া যাবে।

আরিয়ানা এবং সোফিয়ার কাছে এর মধ্যেই অংশুদের গল্প করে ফেলেছে ঋভু। ফলে ওদেরকে নিয়ে যখন ও-বাসায় গেল সে, কারোরই চিনে নিতে অসুবিধা হলো না। তবে ঋভু সারপ্রাইজ দেবে বলে অপলাকে জানায়নি যে, সোফিয়া তারই কন্যা। অংশু অবশ্য জানে। তবু, পরিচয়পর্বের সময় যখন বললো তখন দুজনেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। অবশ্য সামলেও নিল দ্রুত, ওদের সামনে কোনো বিব্রতকর আচরণ করলো না।

আরিয়ানা আর সোফিয়াকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে বাসা দেখালো অপলা, পরিচয় করিয়ে দিলো সবার সঙ্গে। ঋভু আসলে ওদের যৌথ পরিবারের সৌন্দর্যটা দেখাতে চাইছিল। একজন বৃদ্ধ মানুষকে কেন্দ্র করে এতো মানুষ একসঙ্গে

থাকছে, দেখে অভিভূত হয়ে গেল ওরা। আরিয়ানা ফিসফিস করে বললো ঋভুকে – কী সুন্দর একটা পরিবার! আমার লোভ হচ্ছে।

– লোভ? কিসের লোভ?

– এরকম একটা পরিবারের।

– আমার তো মা-বাবা, ভাইবোন নেই, কিন্তু সোফিয়ার বাচ্চাকাচ্চা হলে নাতিপুতি নিয়ে আমাদের পরিবারটাও বড়ই হবে বোধহয়।

হঠাৎ করেই আরিয়ানার মুখে সেই বিষণ্নতা ফিরে এলো। ঋভুর চোখ এড়ালো না। কিন্তু ও না বলা পর্যন্ত জানার উপায় নেই, কেন ও মাঝে-মাঝেই বিষণ্ন হয়ে যায়।

গল্পসল্প শেষে ওরা বেরোলো ডিনার করবে বলে। রেস্টুরেন্টে বসে সোফিয়ার সঙ্গে গল্পে মেতে উঠলো অংশু আর অপলা। ও এত সুন্দর বাংলা জানে দেখে দুজনেই অভিভূত। একবার আরিয়ানার দিকে তাকিয়ে অংশু বললো – তুমি তো অসাধ্য সাধন করেছ!

– আমি আবার কী করলাম?

– আমাদের মেয়েকে এত সুন্দর বাংলা শিখিয়েছ!

‘আমাদের’ শব্দটি খুব ভালো লাগলো ঋভুর। অন্তর থেকে বলেছে অংশু, বোঝা যায়। কত সহজেই না ও আপন করে নিতে পারে মানুষকে! আমি কেন এমন পারি না? – ভাবলো ঋভু, কিন্তু কিছু বললো না।

– আমি শেখাইনি, ও নিজেই শিখেছে। – বললো আরিয়ানা।

– তাই নাকি?

– হ্যাঁ।

– তুমি নিজেও একটু শিখলে পারতে!

– খুব কঠিন লাগে।

– মেয়ে শিখে ফেললো আর তোমার কাছে কঠিন লাগে?

– হ্যাঁ। ভীষণ কঠিন। কারণ…

– কারণটা আমি বলি মা? – সোফিয়া বললো।

– বলো।

– ইতালিয়ান ভাষায় এক শব্দ দিয়েই অনেক কিছু বোঝানো হয়। যেমন ‘চাও’ শব্দটা কখনো হ্যালো, কখনো বিদায়, কখনো উচ্ছ্বাস, কখনো সহানুভূতি, কখনো ‘কী আশ্চর্য’, কখনো ‘সত্যি বলছো?’…

– এক শব্দ যদি এত অর্থে ব্যবহৃত হয় তাহলে বোঝো কীভাবে, কোনটার কী অর্থ?

– এক্সপ্রেশন দিয়ে।

সোফিয়া বিভিন্নভাবে উচ্চারণ করে বোঝালো, কোন এক্সপ্রেশনের কী অর্থ!

– দারুণ তো!

– হ্যাঁ। কিন্তু বাংলা ভাষায় একেক অনুভূতির জন্য একেক শব্দ, কখনো একাধিক শব্দ। প্রথম প্রথম বুঝতে একটু অসুবিধা হয়।

– তাহলে তুমি শিখলে কী করে মামণি?

– ইউনিভার্সিটিতে আমার বাঙালি বন্ধু আছে, সে খুব সাহায্য করেছে। আবার বাংলা স্কুলেও শিখেছি।

– খুব ভালো করেছ। এর জন্য তুমি উপহার পাবে। যা চাও তাই।

– সত্যি? যা চাইবো তাই দেবেন?

– হ্যাঁ, দেবো। চেয়েই দেখ।

– এখন চাইবো না, পরে ভেবেচিন্তে চাইবো।

– ঠিক আছে তাই হবে।

কথা হচ্ছিল অংশু আর সোফিয়ার মধ্যে। তাও বাংলায়। কিন্তু আরিয়ানা তো বাংলা বোঝে না। ঋভু তাই জিজ্ঞেস করলো, তুমি বোর ফিল করছো না তো আরিয়ানা?

– না তো! বোর ফিল করবো কেন?

– তোমার সঙ্গে কেউ গল্প করছে না যে!

– আমি তো মেয়ের গল্প শুনছি।

– শুনছো তো, বুঝতে পারছো?

– কিছু কিছু বুঝি।

খাওয়া-দাওয়া চললো, গল্পসল্পও। বুফে রেস্টুরেন্ট। যে যার পছন্দমতো খাবার নিয়ে এলো। এক ফাঁকে ঋভু জিজ্ঞেস করলো অংশুকে – কী মনে হয় তোর? সোফিয়া আমার মেয়ে? নাকি আরিয়ানা মিথ্যে বলছে? অন্য কোনো ধান্ধা আছে?

– আরে না। ওসব কিছু না। সোফিয়া তোরই মেয়ে।

– কীভাবে নিশ্চিত হলি?

– আরে, দেখতে তো হুবহু তোর মতো।

– কী বলিস! ও তো দেখতে ওর মায়ের মতো।

– ফিফটি পার্সেন্ট মায়ের মতো, ফিফটি পার্সেন্ট তোর। চোখ, চিবুক, চুলের রং, গায়ের রং, হাত-পায়ের আঙুল একেবারে অবিকল তোর মতো।

– এত খেয়াল করেছিস?

– করবো না? একেবারে রেডিমেড একটা কন্যা পেয়েছি আমরা, না দেখে পারা যায়?

– কিন্তু…

– কিন্তু কী?

– না, কিছু না।

– তোর মনে কি কোনো সন্দেহ আছে। থাকলে ডিএনএ টেস্ট করিয়ে নিতে পারিস।

– আরে ধুর। আমি তো শুরুতেই বিশ^াস করেছি। সন্দেহ থাকার প্রশ্নই আসে না।

এক ফাঁকে অপলা বললো ঋভুকে, আপনি তো ভয়ংকর লোক!

– কেন? আমি কী করলাম?

– কী করলাম মানে? রীতিমতো কন্যার বাপ, অথচ আমরা জানতামই না।

– আমিই জানতাম নাকি?

– সেটা তো আরো বড় অপরাধ। জন্ম দিয়েছেন অথচ জানেন না।

– কন্যার মা না জানালে জানবো কী করে?

– কোনোদিন খবরও তো নেননি। নাহ্, আপনাকে এত সহজে ছাড়া যাবে না।

– কী করবে শুনি!

– সবার সামনে তো বলবো না। দেখেন কী করি।

– আচ্ছা, দেখার অপেক্ষায় রইলাম।

রেস্টুরেন্ট বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত আড্ডা হলো। বেরোনোর সময় অংশু বললো আরিয়ানাকে, কালকে তো বাইরে যাচ্ছ। ফেরার পর একদিনের জন্য তোমাকে চুরি করবো।

– চুরি? তাও আমাকে?

– হ্যাঁ, তোমাকেই।

ঋভু বললো, তোর মতলবটা কী শুনি?

– তোকে তা বলবো কেন? বলবো আরিয়ানাকেই।

আরিয়ানা হেসে বললো, আমি রাজি। কখনো কেউ চুরি করেনি আমাকে, চুরি হতে কেমন লাগে দেখবো।

ঋভু তাড়া লাগালো – চলো চলো। তোমাদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ। আজকেই শেষ দেখা। এই বয়সে ঝুঁকি নিতে পারবো না।

হাসতে হাসতে বেরুলো তারা। বিদায় নেওয়ার সময় সোফিয়াকে জড়িয়ে ধরে আদর করলো অংশু আর অপলা। বললো, তুমি আমাদের সবার মামণি, আমাদের চোখের মণি। যখন ইচ্ছে হবে, আমাদের কাছে চলে আসবে। ঠিক আছে?

সোফিয়া মাথা নাড়লো, হ্যাঁ, ঠিক আছে।

গাড়িতে উঠে সোফিয়া বললো, তোমাদের সম্পর্কগুলো সত্যিই অদ্ভুত। বন্ধুও এত আপন হয়!

পরদিন বিকেলে তারা বেরোলো বরিশালের উদ্দেশে। সদরঘাট থেকে লঞ্চভ্রমণ। ঋভু ভেবে রেখেছিল, আরিয়ানাকে সে জীবনানন্দের বাংলাদেশ দেখাবে। দেখাবে, এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে – সবচেয়ে সুন্দর করুণ। সুন্দর অথচ করুণ, অথবা সুন্দর এবং করুণ। যে এই রূপ দেখেছে, সে যে আর

কোথাও গিয়ে থাকতে পারে না, আরিয়ানা তা নিশ্চয়ই বুঝবে। যদিও সে জানতো না, আরিয়ানা কতদিনের জন্য আসছে, সেজন্য পরিকল্পনা করতে একটু অসুবিধাই হচ্ছিল, তবু জিজ্ঞেস করতে পারেনি। তার সৌজন্যবোধে বাধছিল, মনে হচ্ছিল – আরিয়ানা যদি কিছু মনে করে! যদি ভাবে, আসার আগেই ফিরে যাওয়ার প্রসঙ্গ কেন! বাঙালি মন তার, সহজে এসব খুঁটিনাটি অস্বস্তি দূর হওয়ার মতো নয়। তবু, মোটামুটি একটা পরিকল্পনা ঠিক করে রেখেছিল, ওকে নিয়ে কোথায় কোথায় যাবে। ঋভু তখন এও জানতো না যে, তার একটা মেয়ে আছে, সেও আসছে মায়ের সঙ্গে। এখন জানে বলে কেবল আরিয়ানাকেই নয়, সোফিয়াকেও সে দেখাতে চায় আরো নিবিড়ভাবে, চেনাতে চায় ওর পিতৃভূমিটি আসলে কেমন। সত্যি বলতে কী, কেবল ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতে গিয়ে একটা দেশের কিছুই বোঝা যায় না। ওগুলো হলো মেকআপের মতো, আসল চেহারা নয়। বাংলাদেশে এসে যদি কেউ নদীই না দেখলো, অবারিত প্রান্তর জুড়ে ফসলের মাঠ না দেখলো, গাছপালা-ফুলফল-শাকসবজি-পশুপাখি-কীটপতঙ্গ না দেখলো, ঘাসের ওপর শিশিরবিন্দু বা অবিরাম বৃষ্টিপাত না দেখলো, জ্যোৎস্নারাতে নদীর রুপালি ঢেউয়ের মায়াবী রূপ না দেখলো, মানুষের আন্তরিকতা-আতিথেয়তা না দেখলো, তাহলে আসলে কিছুই দেখা হলো না। হ্যাঁ, ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতে যাবে সে – কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, সাজেক ভ্যালি, রাতারগুল; কিন্তু এর বাইরেও কিছু পরিকল্পনা আছে তার। সমস্যা হলো, একেকটা জায়গা দেশের একেক প্রান্তে। সড়ক বা রেলপথে ঘুরে আসতে অনেক সময় লেগে যাবে। তাছাড়া, একটানা ভ্রমণের একটা ক্লান্তিও আছে। মাঝে মাঝে বিরতি না নিলে অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। এই ঋতুতে আবহাওয়াও ততটা আরামদায়ক নয়, নামে শরৎকাল হলেও আসলে গ্রীষ্মকাল। যদি হেমন্ত বা শীতকালে আসতো ওরা, তাহলে অনেক বেশি আনন্দ পেতো। অবশ্য একেক ঋতুর একেক রূপ। এখন শরতের শেষ হলেও বর্ষার চিহ্ন মুছে যায়নি। নদীগুলো এখনো ভরভরন্ত, শীতকালে এরকম দেখা যেত না।

পদ্মাসেতু হওয়ার পর এখন সড়কপথে বরিশাল যাওয়া সহজ হয়ে গেছে, নিজের গাড়ি নিয়ে গেলে ওখানে ঘোরাঘুরি করতেও সুবিধা হতো, তবু ঋভু লঞ্চকেই বেছে নিয়েছে। আসল ব্যাপার তো তাড়াতাড়ি যাওয়া নয়, নদীপথের অপূর্ব ভ্রমণটা উপভোগ করার জন্যই এই পরিকল্পনা। সে তো কম ঘোরেনি, দেশে এবং বিদেশে, নদীপথে বরিশাল যাওয়ার মতো আরামদায়ক আর আনন্দময় ভ্রমণ সে কোথাও পায়নি। বিদেশে রিভার ক্রুজ বলে একটা ব্যাপার আছে। ছোট ছোট লঞ্চে দলবেঁধে পর্যটকরা ওঠে, যদিও ওরা ওটাকেই শিপ বা জাহাজ বলে, গানবাজনা হই-হল্লা করে ঘণ্টাদুয়েক নদীতে ঘুরে বেড়ায়। কোলাহল আর চেঁচামেচিতে কানে তালা লেগে যায়। হাস্যকর আর বিরক্তিকর লেগেছে ঋভুর। এটা সেরকম কিছু নয়। বিশাল বিশাল লঞ্চ আর স্টিমার এই পথে, জাহাজ বললে এগুলোকেই বলা উচিত, আর ভ্রমণটাও শান্ত, মৃদু, প্রেমময়। দীর্ঘ ভ্রমণে যে ক্লান্তি আসে, এই ভ্রমণে তা নেই। শুয়ে-বসে, ঘুমিয়ে বা জেগে, নদীর থেকে উঠে আসা শীতল হাওয়ায় গা-জুড়িয়ে, নদীর মাছের ঝোল আর নানারকম ভর্তাভাজি দিয়ে পেটপুরে খেয়ে দারুণ কাটে সময়টা।

আরিয়ানা বা সোফিয়া প্রথমে বোঝেনি, কোথায় যাচ্ছে। লঞ্চ দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো দুজনই।

– রিভার ক্রুজে যাচ্ছি? কী দারুণ ব্যাপার!

– হ্যাঁ। এটা অন্যান্য দেশের মতো রিভার ক্রুজ নয়। অন্যরকম। অপেক্ষা করো, দেখতে পাবে।

ভিআইপি কেবিন নিয়েছে ঋভু। এগুলো এতই বিলাসবহুল আর আরামদায়ক যে, ভ্রমণে আছি সে-কথা বোঝার উপায় থাকে না। কিন্তু ওরা কেবিনে বসে থাকতে রাজি হলো না। লঞ্চ বুড়িগঙ্গা ছেড়ে শীতলক্ষ্যায় পড়লো।  ওরা রেলিংয়ে ভর করে নদীর রূপ দেখতেই লাগলো। যেন দেখে দেখে সাধ মিটছে না। ঋভু ইচ্ছে করেই জোছনারাত বেছে নিয়েছিল নৌভ্রমণের জন্য, নইলে তো রাতের বেলা কিছু বোঝা যাবে না। আকাশও পরিষ্কার। চাঁদ তার অকৃপণ মায়াবী আলো ঢেলে দিয়েছে

পৃথিবীর বুকে, শহরে এই আলোর মহিমা বোঝা যায় না, এমনকি গতরাতেও কেউ খেয়াল করেনি। কিন্তু এখন, এই নদীর বুকে, ঢেউয়ের সঙ্গে জোছনার অপূর্ব খেলা দেখতে দেখতে চোখে ঘোর লেগে যাওয়ার জোগাড়। কোথাও কোলাহল নেই, আছে কেবল নদীর ঢেউ ভেঙে এগিয়ে চলার মৃদু শব্দ। কোলাহল যা আছে তা নিচতলায়, ইঞ্জিন রুমের আশেপাশেও অনেক মানুষ, জানে ঋভু। কিন্তু সেসব শব্দ তিনতলায় এসে পৌঁছে না। এই দেশটা আসলে ধনীদের জন্য খুব আরামদায়ক, প্রায় স্বর্গের মতো। আর গরিবদের জন্য বিভীষিকা, প্রায় নরকের মতো। ঋভু আপাতত ওদেরকে নরক দেখাতে চায় না। অল্পদিনের জন্য এসেছে, হয়তো কোনোদিনই আর আসবে না, কিংবা এলেও সোফিয়া আসবে, আরিয়ানা বোধহয় আর আসবে না, নরক দেখিয়ে কী লাভ? একটা সুন্দর অনুভূতি নিয়ে ফিরে যাক ওরা। সেটা বোঝাও যাচ্ছে। কতবার যে বলে ফেলেছে – কী সুন্দর, কী আশ্চর্য সুন্দর!

ঋভু একসময় বললো, চলো, ডিনারটা সেরে ফেলি। সামনে আরো বড় নদী। মেঘনা। তখন দেখবে নদী কাকে বলে।

লঞ্চের রান্না এমনিতেই সুস্বাদু। তবু ঋভু বলে রেখেছিল, স্পেশাল গেস্টদের জন্য যেন স্পেশাল রান্না হয়। বিদেশি রান্না নয়, দেশি রান্নাই। তবে পরিচ্ছন্ন হতে হবে, পরিবেশনাও হতে হবে সুন্দর। তাই হলো। একটু ঝাল লাগলেও সেই রান্না খেয়েও ওরা উচ্ছ্বসিত। বললো, বাংলা খাবার যে এত মজা, তা তো জানতাম না! তুমি আমাদের এ দুদিন কী খাইয়েছ? এখন থেকে বাংলা খাবারই চলবে।

ঋভু হাসলো। হ্যাঁ, এ দুদিন একটু সাবধানে খাবার নির্বাচন করেছে সে। যথাসম্ভব ওদের জন্য সহনীয় করে। পেটে সওয়ার একটা ব্যাপার তো আছে। ঋভু ঝুঁকি নিতে চায়নি।  

বরিশাল-ঝালকাঠি-পটুয়াখালি-কুয়াকাটা ঘুরে ঢাকায় ফিরলো তারা, কিন্তু বাসায় না গিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে উড়ে গেল চট্টগ্রাম। সেখান থেকে রাঙামাটি আর বান্দরবান। তারপর কক্সবাজার। একটু রয়েসয়ে ভ্রমণ করার জন্য দু-সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে এর মধ্যেই। এ ভ্রমণ তো কেবল দেখে যাওয়া নয়, বরং নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা, যেমনটি ঋভু সচরাচর করে থাকে। পর্যটকরা সবকিছু দেখে পাখির চোখে, ওপর থেকে। খুব তাড়া থাকে তাদের। যত বেশি দেখে নেওয়া যায় ততই লাভ – এই মনোভাব থেকেই দ্রুত কেবল এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে বেড়ায়, মুগ্ধ হওয়ার এক তীব্র আকুলতা থাকে তাদের মধ্যে, গভীর কোনো তাৎপর্য খোঁজার মতো মন থাকে না। ঋভু অন্য সব পর্যটকের মতো নয়, সে কোথাও কোথাও দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়। কিছু একটা বুঝতে চায়। দৃশ্যমান সবকিছুর বাইরের কোনো সত্য। সে জানে, জগতের সবকিছু মুগ্ধ হওয়ার জন্য নয়; এখানে দুঃখ আছে, বেদনা আাছে, গ্লানি আছে, অসুখ-বিসুখ আছে, সেসব দেখে কষ্টও পেতে হয়। একবার নরওয়ে গিয়েছিল সে, যেখানে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এতই সুচারু যে অপরাধের মাত্রা কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে, কারাগারগুলো শূন্য থাকতে থাকতে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কী অসাধারণ ব্যাপার! মানুষ কী অর্জন করতে পারে, কী ধরনের সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণ করতে পারে, তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ ওই দেশ। কিন্তু তারপরই তার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, কারাগার না-হয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, হাসপাতালের সংখ্যা কমছে না কেন? কেনই বা মানুষ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে? এখানে তো দুশ্চিন্তা কম, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও নেই বললেই চলে, অন্যায়-অবিচার নেই, খাবারে বিষ মেশানো নেই, মুনাফাখোরদের দৌরাত্ম্য নেই, বরং সবকিছুতে আছে রাষ্ট্রের কল্যাণকর ভূমিকা। তাহলে এত অসুখ-বিসুখ আসে কোত্থেকে? সে উপলব্ধি করেছিল, নিশ্চয়ই কোথাও কোনো সংকট আছে, কিন্তু বাইরে থেকে এখানকার মানুষের সংকটগুলো বোঝা যাবে না। স্বর্গের মতো দেশগুলোতেও নিরবচ্ছিন্ন সুখ বলে কিছু নেই। বেড়াতে বেড়াতে আরিয়ানা আর সোফিয়ার সঙ্গে সে এইসব নিয়ে আলাপ করে, নিসর্গের অপার সৌন্দর্য যেমন দেখায়, তেমনই দেখায় মানুষের বহুবর্ণিল জীবন।

অবশ্য ভ্রমণ মানে কেবল দেখে যাওয়াও নয়, ভ্রমণসঙ্গীদের চিনে নেওয়ারও একটা দারুণ সুযোগ। একমাত্র ভ্রমণের সময়ই মানুষ তার দৈনন্দিন জীবন থেকে বেরিয়ে আসে, অর্গল খুলে দেয়। তখন দেখা যায়, কারো ভেতরে সুরভিত ফুলের বাগান, কারো ভেতরে নোংরা ভাগাড়, ডাস্টবিন। ঋভুর সৌভাগ্য, সে ফুলের সৌরভই পাচ্ছে।

রাতে সোফিয়া এক রুমে একা ঘুমায়, আরিয়ানা আর ঋভু অন্য রুমে, একসঙ্গে, স্বামী-স্ত্রীর মতো। দুজনের কারো মধ্যেই কোনো দ্বিধা নেই। যেন এটাই স্বাভাবিক, চিরকাল তারা জোড় বেঁধেই ছিল। প্রথমদিকের মতো উত্তেজনাও আর নেই। মাঝেমধ্যে সঙ্গম হয়, বলাই বাহুল্য, কিন্তু সেটিই এখন তাদের সম্পর্কসূত্র নয়। বরং অনেকখানি প্রেম, মমতা আর নির্ভরতা যেন জন্ম নিয়েছে পরস্পরের ভেতরে। আরিয়ানা সবসময় ঋভুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। এটা বোধহয় ওর অভ্যাস। সকালে ঘুম ভেঙে ঋভু দেখে, আরিয়ানার একটা হাত পড়ে আছে তার বুকের ওপর। কী যে ভালো লাগে! এরকম একজন সঙ্গীই তো চেয়েছিল সে, না? 

কত বিষয় নিয়ে যে কথা হয়। দুজনেরই জীবনের গল্প বলা হয়ে গেছে দুজনকে। ঋভু কিছুই লুকায়নি। ছোটবেলার গল্প, নীলুর মৃত্যু, একা একা বড় হয়ে ওঠা, বিশ^বিদ্যালয়ের বন্ধুদের গল্প, অবন্তি আর অংশুর গল্প, পারুলের সঙ্গে তার প্রথম সঙ্গমের স্মৃতি, বাবার মৃত্যু, মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন, নেপাল যাওয়া, ফিরে এসে অবন্তির সঙ্গে কোনো মীমাংসায় পৌঁছতে না পারা, অবন্তির না বলে চলে যাওয়া, রিনির সঙ্গে বিয়ে কিন্তু সম্পর্কটি শীতল হয়ে থাকা, মায়ের মৃত্যু, রিনির চলে যাওয়া, তার একা হয়ে যাওয়া, অনেকদিন পর অবন্তির ফিরে আসা, ওর সঙ্গে সম্পর্কে নতুন মোড় – সব, সব বলেছে ঋভু। একইভাবে আরিয়ানাও বলেছে তার ফেলে আসা জীবনের খুঁঁটিনাটি। বলতে বলতে দুজন দুজনের আরো আপন হয়ে উঠেছে। সোফিয়ার জন্মের পর আারিয়ানার জীবন যে ওকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে, সেটাও বোঝা গেছে ভালোভাবে। যদিও সে অন্য পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিল, সেটিও ছিল নিছক শরীরেরই প্রয়োজনে। আরিয়ানার সব গল্পের মধ্যেই সোফিয়ার প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে আসে। একদিন বললো – সোফিকে নিয়ে কিছু ভেবেছ?

– কতকিছুই তো ভাবছি, তুমি কোন বিষয়ে জানতে চাইছ?

– ও তো এখন জেনে গেছে যে ওর বাবা আছে, খুবই ভালো একজন বাবা। কিন্তু বাবা আর মা দুই দেশে থাকে।

– তাতে কী হলো?

– যদি বাবার কাছে থাকতে চায়?

– থাকবে। এ নিয়ে ভাবার কী আছে?

– যদি মায়ের কাছে থাকতে চায়?

– তাও থাকতে পারে, আপত্তির কিছু নেই।

– তোমার খারাপ লাগবে না?

– খারাপ লাগবে কেন? আমি আমার মেয়ের মাকে দূরে রাখবো নাকি?

– মানে?

– মানে হলো, মেয়ের মা যেখানে থাকবে আমিও সেখানেই থাকবো। মেয়ে বাপের কাছেই থাকুক, আর মায়ের কাছেই থাকুক, একসঙ্গেই তো থাকা হলো।

– তুমি সত্যি বলছো?

– অবশ্যই।

– কিন্তু কোন দেশে?

– তুমি কী চাও?

– আমি যদি আমার দেশে ফিরে যেতে চাই?

– তাহলে আমিও যাবো।

আরিয়ানার খুশি হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু মুখটা কেমন বিষণ্ন হয়ে উঠলো, বললো – তা কি আর হবে?

– কেন হবে না? সমস্যা কোথায়?

– কেন যে হবে না, তা যদি বলতে পারতাম!

– বলো। আমি তো শুনতে চাই।

– পরে শুনো। এখন বলো, মেয়ে এ-বিষয়ে কিছু বলেছে তোমাকে?

– না বলেনি।

– তুমিও জানতে চাওনি?

– না চাইনি। সময় তো আর চলে যাচ্ছে না। এখন আমরা আনন্দ-ভ্রমণে আছি, মেয়েটা প্রথমবারের মতো বাবা আর মাকে একসঙ্গে পেয়েছে, এখন ওর সঙ্গে এত জটিল বিষয়ে আলাপ করার দরকার কী?

– সময় কিন্তু চলে যাচ্ছে পারভেজ। খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে।

– কিসের সময়ের কথা বলছো? তোমার টিকিটের তো? ওই চিন্তা বাদ দাও। যতদিন ভিসা আছে…

– না, ভিসা বা টিকিটের কথা বলছি না।

– তাহলে?

– বয়স হয়ে যাচ্ছে না আমাদের? সেই কথা বলছি।

ঋভু হেসে ফেললো, বললো – বিছানার পারফরম্যান্স দেখে তো মনে হয় না তোমার বয়স হয়েছে।

– সত্যিই মনে হয় না? – আরিয়ানা গম্ভীর।

– একটু ক্লান্ত লাগে। সেটা তো আমারও লাগে। কিন্তু ওটা এমন কোনো ব্যাপার নয়।

ঋভু যদিও হাসিঠাট্টা করে পরিবেশটাকে হালকা করার চেষ্টা করে সবসময়, কিন্তু বুঝতে পারে, কোথাও একটা লুকোছাপা চলছে। আরিয়ানা কী যেন লুকাচ্ছে তার কাছ থেকে, সোফিয়া কী যেন বলতে চেয়েও বারবার থেমে যাচ্ছে। কী হতে পারে সেটা? আন্দাজ করা মুশকিল। আরিয়ানার শরীর মাঝে-মাঝে বেশ গরম থাকে, মনে হয়ে জ¦র এসেছে। কিন্তু জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না, অথবা এড়িয়ে যায় – নতুন জায়গা তো, হয়তো সেজন্য মাঝেমধ্যে এরকম হচ্ছে – এই কথা বলে।

কখনো-বা খুব অন্যমনস্ক হয়ে যায় আরিয়ানা, বিষণ্ন হয়ে থাকে। একা থাকতে চায়। তখন ওকে ঠিক চেনা মনে হয় না। সোফিয়াও মাঝে-মাঝে লুকিয়ে কাঁদে, ঋভু দেখেছে, কিন্তু কিছু বলেনি। যে লুকিয়ে কাঁদতে চায়, তাকে তো কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করা যায় না। ঋভু অপেক্ষা করে ছিল, সময় দিচ্ছিল ওদের, নিশ্চয়ই কখনো-না-কখনো বলে ফেলবে। এই যে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা, পাহাড় থেকে সমুদ্র, নদী থেকে অরণ্য, এসবই তো আসলে মানুষের ভেতরের অর্গল খুলে দেয়। চাইলেও সব লুকিয়ে রাখা যায় না।

কিন্তু আজকে আরিয়ানার কথা শুনে ঋভুর মনে হলো, সত্যিই সোফিয়ার সঙ্গে এ-বিষয়ে কথা বলা দরকার। আরিয়ানা যা বলতে চেয়েও চেপে যাচ্ছে বারবার, তা হয়তো সোফিয়া বলবে। পাশের রুমেই সোফিয়া, সে গিয়ে দরজায় টোকা দিলো। কোনো সাড়াশব্দ নেই। ডাকলো কয়েকবার, তাও সাড়া মিললো না। আস্তে করে ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকলো ঋভু। সোফিয়া রুমে নেই। নিশ্চয়ই রুম খোলা রেখে বাইরে যায়নি! তাহলে?

ব্যালকনিতে পাওয়া গেল সোফিয়াকে। রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দূরে তাকিয়ে আছে। সামনে অনন্তবিস্তৃত জলরাশি, কী দেখছে ও? ঋভু পেছন থেকে গিয়ে কাঁধে হাত রাখলো। চমকে ফিরে তাকালো সোফিয়া। ঋভু দেখলো, অঝোরে কাঁদছে সোফিয়া, গাল ভেসে যাচ্ছে জলে। মেয়েটা কাঁদছে! কেন? কী এমন হলো হঠাৎ? ওকে নিজের দিকে ফেরালো ঋভু। বললো –  কাঁদছো কেন মামণি? কী হয়েছে?

সোফিয়া চোখ মুছলো। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো, মৃদু একটু হাসারও চেষ্টা করলো, কিন্তু হাসি ফুটলো না। না পেরে বাপের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো সে। ঋভু তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অবিরাম ডেকে চললো – মামণি, আমার মা, আমার আম্মু, আমার লক্ষ্মী সোনা চাঁদের কণা, কী হয়েছে তোমার? আমাকে বলো। বাবাকে সব কথা বলতে হয়।

একটু ধাতস্থ হয়ে সোফিয়া বললো, একটা কথা তোমাকে বলা দরকার। কিন্তু কীভাবে যে বলবো ভেবেই পাচ্ছি না। সেই আসার পর থেকে ভাবছি…

– এত ভাবতে হচ্ছে কেন মা? আমাকে তুমি যে-কোনো কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারো।

– ভাবতে হচ্ছে, কারণ কথাটা কঠিন।

– যত কঠিনই হোক, আমি জানতে চাই।

অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো সোফিয়া, দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো, কী যেন ভাবলো মগ্ন হয়ে, তারপর বললো – কিন্তু মা যে বলতে নিষেধ করেছে!

– কিন্তু তোমার বলতে ইচ্ছে করছে?

– হ্যাঁ।

– তাহলে বলো। তোমার মা জানতে পারবে না।

– পারবে। তুমি জানার পর এ নিয়ে কথা না বলে পারবে না। সেজন্যই দেশে আসার আগেই আমাকে বলে রেখেছে, তোমাকে যেন না বলি।

– আচ্ছা, আগে শুনি তো! তারপর দেখা যাবে, কী করা যায়!

– মা’র খুব অসুখ বাবা।

– অসুখ? কী অসুখ?

– ঠিক জানি না। মা বলতে চায় না। সম্ভবত লিউকোমিয়া। ব্লাড ক্যান্সার।

– সম্ভবত বলছো কেন? তুমি না বললে, মা বলতে চায় না।

– কয়েকবার ফোনে এটা নিয়ে কথা বলতে শুনেছি।

– ও! কবে ধরা পড়লো?

– এই তো জানুয়ারি মাসে।

– তারপর?

– জানার পর থেকেই মা হন্যে হয়ে তোমাকে খুঁজছিল। তার একটাই কথা, একবারের জন্য হলেও তোমার সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দিতে হবে।

– তুমি কি জানো, তোমার মায়ের অবস্থাটা ঠিক কী রকম? ক্যান্সার কোন স্টেজে?

– বললাম না, মা আমাকে পরিষ্কার করে কিছু বলেনি! তবে ডাক্তার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসা শুরু করতে বলেছেন।

– সেটা কবেকার কথা?

– মার্চ মাসেই শুরু করতে বলেছিলেন।

– শুরু করেনি?

– না।

– কেন?

– ওই যে তোমার সঙ্গে দেখা না করে কিছুই করতে চাইছিল না…

– ও!

এবার দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইলো ঋভু। তারপর বললো, আচ্ছা দেখা যাক, কী করা যায়। তুমি চিন্তা করো না।

– বাবা!

– বলো মা।

– এখানেই ট্রিটমেন্ট শুরু করা যায় না?

– ঢাকায় ফিরে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলবো। তবে, এদেশে ক্যান্সারের ট্রিটমেন্ট ততটা ভালো না। অধিকাংশ রোগী ইন্ডিয়ায় যায়, যাদের সামর্থ্য আছে তারা সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ডে যায়।

– ও! এখানে না হলে…

– কী মা? বলো।

– আমি ভেবেছিলাম, যদি ট্রিটমেন্টের সময় তুমি কাছে

থাকতে! আমার আসলে ভয় লাগছে বাবা। একা সামলাতে পারবো তো?

– তোমাকে একা সামলাতে হবে না মা। আমি তোমাদের সঙ্গেই থাকবো।

– কিন্তু এখানে যদি সম্ভব না হয়…

– যেখানেই হোক, আমি তোমাদের সঙ্গেই থাকবো।

– মা যদি নিজের দেশে ফিরে যেতে চায়…

– আমিও সেখানেই যাবো।

– যাবে! সত্যি তুমি যাবে বাবা?

– হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যাবো। তুমি একটা কথা বলো তো মামণি, তোমার মা কি শুধু আমার সঙ্গে তোমার দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্যই দেরি করছিল? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?

– অন্য কোনো কারণ থাকলেও আমি জানি না বাবা, আমাকে বলেনি কখনো।

– ও!

– তুমি কোন ধরনের কারণের কথা ভাবছো, বলবে আমাকে?

– ক্যান্সারের চিকিৎসা তো ব্যয়বহুল। আমি ভাবছিলাম, টাকা-পয়সার সমস্যা আছে কি না।

– তা থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের তো হেলথ ইন্স্যুরেন্স করা আছে। সেটা দিয়ে কতটুকু কাভার করবে আমি জানি না, তবে শুরু তো করাই যেত।

– ও হ্যাঁ। ও-দেশে তো হেলথ ইন্স্যুরেন্স বাধ্যতামূলক। এদেশে ওসবের বালাই নেই তো, সেজন্য মনে আসেনি।

– আমি কি এটা নিয়ে মা’র সঙ্গে কথা বলবো?

– তোমাকে কিছু বলতে হবে না। আমিই বলবো। আর হ্যাঁ, টাকা-পয়সা যতই লাগুক, চিন্তা করো না।

– চিন্তা করবো না?

– না, করবে না।

– চিন্তা না করে পারা যায়?

– আগে পারা যেত না। এখন তোমার বাবা আছে, সেই বাবার অন্তত এটুকু সামর্থ্য আছে।

– তোমার কি অনেক টাকা বাবা?

– কথাটা দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করলে মা।

– হ্যাঁ, কারণ তুমি সবসময়ই বলছো, টাকা কোনো সমস্যা না। কিন্তু তোমার আচার-আচরণ দেখে মনে হয় না যে তুমি অনেক ধনী।

– অনেক না হলেও যা আছে তা যথেষ্ট। এসব নিয়ে ভেবো না। আমরা আগে ঢাকায় ফিরি, তারপর ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেবো।

– আচ্ছা বাবা।

– তুমি কি এখনই ঢাকায় ফিরতে চাও, নাকি আরো কয়েকদিন বেড়াবে?

– আমার তো বেড়াতেই ভালো লাগছে। মাকে জিজ্ঞেস করো…

– তারও বেড়াতে ভালো লাগছে। ঠিক আছে আরো দু-তিনদিন থাকি, তারপর ফিরবো। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে অবস্থা বুঝে নিয়ে আবারো না হয় বেড়াতে বেরোবো। ঠিক আছে?

– থ্যাংক ইউ বাবা।

সোফিয়ার চোখে এখন চিকচিক করছে জল, কিন্তু ঠোঁটে মিষ্টি একটা হাসি।

ঋভু অবশ্য ডাক্তারের সঙ্গে কথা না বলেই প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে, আরিয়ানাকে বাঁচানো যাবে না। যে মৃত্যু তাকে তাড়া করে ফিরছে সেই ছোটবেলা থেকে, সেই মৃত্যুই আরিয়ানাকে তার কাছে নিয়ে এসেছে, যেন তাকে আবার একটা বিদায়ের সাক্ষী হতে হয়; কিন্তু কথাটা সোফিয়াকে বললো না সে।

– মা-র কাছে যাও। বুঝতে দিয়ো না যে আমাকে সব বলেছ। আমি একটু আসছি। – ঋভু বললো।

– কোথায় যাচ্ছো তুমি?

দূরে কোথাও না, নিচে যাবো। তুমি মা’র কাছে যাও। গল্পসল্প করো। আমি আসছি এখনই।

ঋভু আসলে একটু একা থাকতে চাইছিল। এই বিপর্যয় সে সামলাবে কী করে জানে না, কী করে পাড়ি দেবে সামনের দিনগুলো, তাও বুঝতে পারছে না।

সৈকতঘেঁষেই হোটেল। ঋভু নিচে নেমে সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালো। সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে অনেক আগে, তবু মানুষের ভিড় লেগে আছে। চারদিকে তাকিয়ে কেবল জীবনের উচ্ছ্বাস চোখে পড়ে, কানে আসে উল্লাসধ্বনি, হাসির শব্দ। সেসব ছাপিয়ে সমুদ্রের শব্দ, জোয়ার এসেছে, সে-কথা জানাতে ভুল করছে না সে। হাওয়া বইছে জোরেশোরে, একটা মিষ্টি গন্ধ জড়িয়ে আছে বাতাসে। হেমন্ত কি এসে গেল? এ কি ঋতু পরিবর্তনের মহার্ঘ মুহূর্ত? শরতের শেষে আর হেমন্তের শুরুতে এই ধরনের গন্ধ থাকে বাতাসে। সব ঋতুরই আলাদা গন্ধ, আলাদা রং, আলাদা শব্দ। কিছুই থেমে নেই, সব আছে আগের মতোই, কেবল তার জীবনেই হঠাৎ নেমে এসেছে অন্ধকার আর অনিশ্চয়তা। এই প্রথম ঋভু অনুভব করলো, এরকম দুঃসময়ে কাঁধে হাত রাখার মতো, পাশে দাঁড়ানোর মতো আপনজনের প্রয়োজন হয়। তারা সাহস দেয়, সান্ত্বনা দেয়, সেগুলো মিথ্যে হলেও মন শান্ত হয়। টাকা থাকলেই সব সমস্যার সমাধান হয় না, সব দুঃসময় সহনীয় হয় না। মা-বাবা চলে যাওয়ার পর দীর্ঘ একটা সময় সে কাটিয়ে এলো স্বজনহীন। এখন সে কী করবে? কাকে বলবে?

ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই সে ফোন করলো অংশুকে। রিসিভ হলো, ওপাশ থেকে অংশু ‘হ্যালো হ্যালো’ বললো কতক্ষণ, কিন্তু ঋভুর গলা ধরে আসছে। কী বলবে সে অংশুকে? কিন্তু ‘হ্যালো হ্যালো’ বলা থামছেই না, অবশেষে মুখ খুললো ঋভু, বললো – হ্যাঁ, অংশু।

হয়তো ওর কণ্ঠ শুনেই কিছু আন্দাজ করলো অংশু, বললো – কীরে ঋভু? কী হয়েছে?

– না কিছু হয়নি।

– কিছু একটা যে হয়েছে তা তো বুঝতেই পারছি। কী হয়েছে বল।

– কালকে তুই আসতে পারবি?

– কাল?

– হুম।

– আচ্ছা, আসবো।

– টিকিট পাবি আজকে?

– ম্যানেজ করে ফেলবো; কিন্তু কী হয়েছে বলবি তো।

– আয়, শুনবি। ফোনে বলতে ইচ্ছে করছে না। অপলাকেও নিয়ে আসিস। দু-একদিন থাকার মতো প্রস্তুতি নিয়ে আসিস।

– আচ্ছা। এখন ফোন রাখ। দেখি কোন ফ্লাইটের টিকিট পাওয়া যায়।

– কালকে দেখা হচ্ছে তাহলে।

– হ্যাঁ, দেখা হচ্ছে।

ফোন ছেড়ে কিছুক্ষণ ভাবলো অংশু। কী এমন ঘটলো যে, ঋভু এভাবে ডেকে পাঠাচ্ছে? কোনো ইঙ্গিতও দিলো না। যাকগে এত ভেবে লাভ নেই, অপলাকে ডেকে বললো – একটু গুছিয়ে নাও, কালকে সকালে কক্সবাজার যাচ্ছি।

– হঠাৎ?

– ঋভু যেতে বললো। কারণ জানি না। তুমি গুছিয়ে নাও। আমি টিকিটের ব্যবস্থা করছি।

পর্ব : ২০

ঘুরে ঘুরে বাংলাদেশ দেখার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে ঢাকায় ফিরে আসতে হয়েছিল ঋভুদের। অংশুই নিয়ে এসেছিল। পরদিন দুপুরেই পৌঁছে গিয়েছিল অংশু আর অপলা। হোটেলের লবিতে বসে অপেক্ষা করছিল ঋভু, রুম বুক করে রেখেছিল আগেই, দেখা হতেই অংশু উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলো – কী হয়েছে রে ঋভু?

– বলবো। আগে রুমে যা, ফ্রেশ হয়ে নে।

– এইটুকু পথ এলাম, ফ্রেশ হওয়ার কী আছে? তুই বল।

– চল, ক্যাফেতে বসি।

অংশু অপলাকে বললো – তুমি রুমে যাও, আমরা আসছি।

অপলার চোখে প্রশ্ন ছিল। কী এমন কথা যে, ওর সামনে বলা যাবে না? কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করলো না। জানা তো যাবেই, একটু অপেক্ষা করলে ক্ষতি নেই। দুই বন্ধু না-হয় কিছুক্ষণ নিজেদের মতো থাকুক।

দু-কাপ কফি নিয়ে মুখোমুখি বসলো দুজন। কিন্তু সহসা মুখ খুললো না ঋভু, চুপচাপ চুমুক দিতে লাগলো কফিতে। অংশুও কিছু জিজ্ঞেস করলো না, ঋভু খুব মগ্ন হয়ে কী যেন ভাবছে। ভাবুক। সময় হলেই বলবে। কফি শেষ করে অংশুর চোখের দিকে তাকিয়ে আচমকাই বললো ঋভু – আরিয়ানার ক্যান্সার। বোধহয় বাঁচবে না।

আকস্মিক এই খবরে চমকে উঠলো অংশু, তার কফি তখনো শেষ হয়নি, চমকানোর কারণে খানিকটা কফি চলকে উঠলো। কতক্ষণ চুপ থেকে কেবল বলতে পারলো, কবে জানলি?

– কালকে।

– কী ধরনের ক্যান্সার?

– জানি না।

– এ আবার কেমন কথা? ডিটেইল কিছু জিজ্ঞেস করিসনি?

– ওর সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়নি।

– তাহলে জানলি কীভাবে?

– সোফিয়ার কাছ থেকে।

– ও! আরিয়ানাকে কিছু জিজ্ঞেস করিসনি কেন?

– কী জিজ্ঞেস করবো, কী আলাপ করবো বুঝতে পারছি না। শোনার পর থেকে আমি সুস্থির হয়ে কিছু ভাবতেও পারছি না, কাউকে কিছু বলতেও পারছি না। তোকে খুব দরকার ছিল।

– হুম। বুঝলাম। শোন, তুই আরিয়ানার সঙ্গে কথা বল।

– কী বলবো?

– বিস্তারিত জানতে চাইবি। আগে তো জানতে হবে, ক্যান্সারটা কী ধরনের। কোন স্টেজে আছে।

– জেনে কী হবে?

– কী হবে মানে? চিকিৎসা হবে।

– লাভ হবে না রে। ও বাঁচবে না।

– বাজে কথা বলিস না।

– বাজে কথা না। আমি বুঝতে পারি।

– কী বুঝিস?

– ও আমাকে দেখতে আসেনি, এসেছে আমার কাছ থেকে বিদায় নিতে। আফটার অল, আমার সন্তান ও গর্ভে ধারণ করেছে…

– তোর কি মনে হয়, সোফিয়াকে তোর কাছে রেখে যাওয়ার জন্য…

– না, সেরকম কিছু নয়। ও জানে, সোফিয়া মায়ের সঙ্গেই ফিরে যাবে। তবে, ও ওর দায়িত্বটুকু পালন করে গেল।

বাপ-মেয়ের দেখা করিয়ে দিলো। এখন ও একটা শান্তি নিয়ে মরতে পারবে।

– আগেই এত কিছু ভাবিস না। আমরা একসঙ্গে দু-তিনদিন থাকি। তুই সময়-সুযোগমতো ওর কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে নিস।

তা জেনেছিল ঋভু। দুদিন রইলো তারা ওখানেই। অংশু একেবারে জমিয়ে রাখলো গল্পসল্প-হাসিঠাট্টা দিয়ে। এমন একটা ভাব করলো যেন সে কিছুই জানে না। আরিয়ানাও খুব আনন্দে মেতে রইলো। যেন তার কিছুই হয়নি। অপলা অতটা অভিনয়পটু নয়, তার ঠোঁটে খুব বেশি হাসি দেখা গেল না। ঋভু আর সোফিয়া, বাপ আর মেয়ে পরস্পরের চোখের দিকে তাকাতে পারলো না।

ঢাকায় ফেরার আগের রাতে ঋভু জানতে চাইলো আরিয়ানার কাছে।

– জেনে ফেলেছ! – আরিয়ানা অবাক গলায় জিজ্ঞেস কলো।

– হুঁ।

– মেয়েটাকে না করেছিলাম।

– কেন না করেছিলে? আমার কাছে লুকাতে চাও কেন?

– জানিয়েই বা কী হবে?

– কিছুই কি হওয়ার নেই?

– উহু।

– তুমি ট্রিটমেন্ট শুরু করোনি কেন?

– এবার গিয়ে শুরু করবো। কিন্তু লাভ হবে না।

– ডাক্তার বলেছে?

– হুঁ।

– ডাক্তাররা সব জানে?

– তাদের যতটুকু জানার কথা ততটুকু নিশ্চয়ই জানে।

– ক্রসচেক করেছ?

– কিসের ক্রসচেক?

– অন্য কোনো ডাক্তারের কাছে গিয়েছ?

– তার দরকার নেই। এত বড় ভুল কোনো ডাক্তার করে না।

– আমাদের দেশে অহরহ করে।

– অসম্ভব। একটু হেরফের হতে পারে, কিন্তু আকাশ-পাতাল পার্থক্য হবে না।

– আমি ওই একটু হেরফেরের ব্যাপারটাই বুঝতে চাই।

– মানে?

– তোমাকে অন্য কোনো দেশে নিয়ে যেতে চাই।

– অস্থির হয়ো না। আমি মেনে নিয়েছি।

– কিন্তু আমি মানছি না।

– এসব কথা রাখো তো। এসো, আমাকে একটু আদর করো।

ঋভু জড়িয়ে ধরলো তাকে, কিন্তু শরীর জাগলো না। বরং না বুঝে এতদিন যখন-তখন আরিয়ানাকে বিছানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য অপরাধবোধ হলো। নিশ্চয়ই তার উত্তেজনায় সাড়া দিতে আরিয়ানার কষ্ট হয়েছে! অথচ একটুও বুঝতে দেয়নি। শরীরে ক্যান্সারের মতো ঘাতক রোগ বয়ে বেড়াচ্ছে, তবু হাসি-আনন্দ-উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না। মেয়েটা সাহসী সন্দেহ নেই, এবং দৃঢ়চেতা। অথচ ঋভুর কাছে মোমের মতো গলে পড়ে বলে সে ভেবেছিল, ও কত কোমল, নরম, একখণ্ড মেঘের মতো। কত কম জেনেই না সম্পর্কে জড়িয়েছিল সে!

ঢাকায় ফিরে আরিয়ানা অংশুর প্রকল্প দেখতে যাওয়ার বায়না ধরলে অংশু তিনদিন সময় নিয়েছে। বলেছে, সামান্য একটু কাজ বাকি আছে। আমাকে তিনদিনের ছুটি দাও। ফিরে এসে তোমাদের নিয়ে যাবো।

এ তিনদিন অংশু আর আসেনি, এমনকি ফোনেও কথা বলেনি। ঋভু বুঝতেই পারছে না, ওর হঠাৎ কী এমন কাজ পড়লো। অবশ্য অপলা এসেছে প্রতিদিনই। গল্পসল্প করেছে, আড্ডা দিয়েছে, একদিন একসঙ্গে বেড়াতেও গেছে সবাইকে নিয়ে, যেন সবকিছু আগের মতোই স্বাভাবিক আছে।

ঋভু জানে, খেলাঘর দুদিনেই ভেঙে যাবে। সে তাই প্রস্তুতি নিচ্ছে। সোফিয়ার সঙ্গে আলাপ করে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলেছে। আপাতত সোফি তার মাকে নিয়ে ফিরে যাবে, চিকিৎসা শুরু করবে। ঋভু এদিকটায় একটু গুছিয়ে, ভিসা পাওয়ার পর রওনা হবে ওদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য। অবশ্য তেমন কিছু গোছানোরও নেই। বাড়িতে চাচা-চাচি থাকবে, করিমও থাকবে। ড্রাইভারকে সবেতন ছুটি দেবে। অংশুর প্রকল্প শেষ করার জন্য কিছু টাকা দেবে। এটুকুই তো।

তিনদিন পর অংশু সত্যিই ফিরে এলো। বললো, কালকে তোমাদের নিয়ে যাবো। একদিন ওখানে থাকার প্রস্তুতি নিয়ে যেয়ো।

পরদিন সকালেই রওনা হলো সবাই। অংশু-অপলা, ঋভু-আরিয়ানা-সোফিয়া। বিস্ময় অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য, বিশেষ করে ঋভুর জন্য। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে, একটা ভবন দাঁড়িয়ে গেছে, আরেকটার কাজ চলছে। মেইন রোড থেকে যে মাটির রাস্তাটা ছিল প্লটে যাওয়ার জন্য সেটা পাকা করা হয়েছে। রাস্তার মুখে একটা নজরকাড়া ফটক। সেখানে বড় করে ইংরেজিতে লেখা : আরিয়ানা’স হোম। তার নিচে একটু ছোট হরফে লেখা : এ হোম ফর হোমলেস চিলড্রেন অ্যান্ড সিনিয়র সিটিজেনস।

বিস্মিত না হয়ে উপায় আছে? এই প্রকল্পের নাম আরিয়ানার নামে হবে, সেটা ঋভু তো ভাবেইনি, এমনকি, সম্ভবত অংশুও ভাবেনি। গাড়ি থেমেছিল গেটের বাইরে। অংশু সবাইকে নামতে বলেছিল। লেখাটা দেখে আরিয়ানা হতভম্ব হয়ে গেল। বললো – মানে?

– কিসের মানে?

লেখাটার দিকে আঙুল তুললো আরিয়ানা। অংশু দুষ্টুমি করে বললো – বাংলা জানো না বুঝলাম, তাই বলে ইংরেজিও পড়তে পারো না?

– আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না।

– ভেতরে চলো, বুঝতে পারবে।

রাস্তা ধরে খানিক এগোলেই চারপাশে প্রাচীরঘেরা সেই প্রকল্প। এখানে আরেকটা ফটক। বাংলায় লেখা আরেকটা সাইনবোর্ড  চোখে পড়লো এবার : আরিয়ানার বাড়ি। নিচে ছোট করে লেখা : যাদের ঘর নেই, এটা তাদের বাড়ি।

আরিয়ানা পড়তে না পারলেও সোফিয়া নিখুঁত উচ্চারণে পড়লো, তারপর ইতালিয়ান ভাষায় মাকে কী যেন বললো।

আরিয়ানা ঋভুর হাত চেপে ধরে বললো – এসবের মানে কী পারভেজ?

– আমি জানি না আরিয়ানা। সত্যিই জানি না।

সত্যি বলতে কি, ঋভু নিজেও বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। সে কল্পনাও করেনি, অংশু এমন একটা কাজ করবে।

আরিয়ানা এবার অংশুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ওর হাত ধরে বললো – আমাকে বুঝিয়ে বলো, এসবের মানে কী?

– তুমি না নিজের দেশে ফিরে যেতে চাইছো! যাও। কিন্তু আমরা তোমাকে ছাড়বো না। তুমি থাকবে এইখানে, আমাদের সব কাজের সঙ্গে মিশে।

আরিয়ানা কতক্ষণ চুপ করে রইলো, বিহ্বল চোখে তাকালো এক এক করে সবার মুখের দিকে, তারপর দু-হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ঋভু এর আগে কখনো আরিয়ানাকে এভাবে কাঁদতে দেখেনি। গিয়ে আরিয়ানাকে জড়িয়ে ধরলো সে। দেখলো, সোফিয়ার চোখেও জল। হাত বাড়িয়ে ওকেও কাছে টেনে নিল সে। কাঁদছে অপলাও। কেবল অংশু ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে।

ঋভু ক্ষেপে গিয়ে বললো – উল্লুকটা ওরকম দাঁত বের করে হাসছে কেন, জিজ্ঞেস করো তো অপলা।

অপলার জিজ্ঞেস করতে হলো না, অংশুই বললো – সম্মিলিত কান্না প্রতিযোগিতা দেখতে মজা লাগছে দোস্ত। এরকম  কখনো দেখিনি কি না!

– এত বড় একটা বদমাশের সঙ্গে তুমি সংসার করো কী করে অপলা? – ঋভু ফের বললো।

– কী করবো বলেন! আমার তো কোনো বিকল্প পছন্দ নাই।

– নাই! এইটা তুমি বলতে পারলা? আমি কি মরে গেছি?

– একের পর এক নতুন বান্ধবী নিয়ে যেরকম ব্যস্ত আপনি!

– হলো তো চান্দু? মোক্ষম উত্তর পেলি তো! – অংশু ব্যঙ্গ করলো।

– এর প্রতিশোধ নেওয়া হবে।

– আচ্ছা নিস। এখন ভেতরে চল।

– এতক্ষণ কী নিয়ে কথা হলো? – জিজ্ঞেস করলো আরিয়ানা।

– তুমি বাংলা জানো না বলে ওরা সুযোগ নিলো। – অংশু বললো।

– মানে?

– মানে, বাংলা ভাষায় প্রেম করলো আর কি!

খিলখিল করে হেসে উঠলো সোফিয়া। বললো – তোমরা এত মজা করতে পারো! উফ!

– মজার দেখেছ কী মা! আজকে সারাদিন শুধু মজাই হবে। রাতেও নানান আয়োজন আছে।

– কী আয়োজন?

– সময় হলেই দেখবে। এবার ভেতরে চলো।

ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, নতুন ভবনের নিচতলাটা সুন্দর করে সাজিয়েছে অংশু। চারপাশে চারটা বেডরুম, মাঝখানে বড়সড় লিভিং স্পেস। আরিয়ানা-সোফিয়া আর অপলাকে ওখানে বসিয়ে রেখে ঋভু গেল অংশুর সঙ্গে অন্য ফ্লোরগুলো দেখতে। নিচতলার ডিজাইন আর অন্যগুলোর ডিজাইন এক নয়।

দোতলা-তিনতলা-চারতলা-পাঁচতলা একই ডিজাইজন। দুপাশে সারি সারি রুম, মাঝখানে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। তবে এখনো অনেক কাজ বাকি। দরজা-জানালা লাগানো হয়নি, বাথরুমে-কিচেনে ফিটিংস লাগানো হয়নি, রংও করা হয়নি। সম্ভবত তাড়াহুড়া করে কেবল নিচতলাটা গুছিয়েছে অংশু।

অংশু বললো, রুমগুলো থাকার জায়গা। আর মাঝখানের জায়গাটা লিভিংরুমের মতো। টেলিভিশন থাকবে, বুক-শেলফ থাকবে, বসার জন্য সোফা আর চেয়ার থাকবে, ডাইনিং টেবিল থাকবে একপাশে। এখনো কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে, তবে দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে। আর নিচতলাটা গেস্টহাউসের মতো। চারটা বেডরুম, বাকিটা তো দেখেছিসই।

ঋভু জিজ্ঞেস করলো, এত তাড়াতাড়ি শেষ হলো কীভাবে রে অংশু?

– তাড়াতাড়ি কোথায়! দু-মাস লেগে গেল।

– দু-মাস কি খুব বেশি সময়? একটা বিল্ডিং তুলতে তো দু-বছর সময় লাগে।

– আরে ধুর! কী যে বলিস! ফাউন্ডেশন করতেই যতটুকু সময় লাগে, তারপর তো তরতর করে উঠে যায়।

– তাহলে অন্যদের এত বেশি সময় লাগে কেন?

– রাজমিস্ত্রিরা বেশি সময় নেয়। ওরা এক জায়গায় কাজ ধরে অন্য জায়গায় আরেক কাজ নেয়। কিছুদিন এখানে কিছুদিন ওখানে। আমি তো ওদেরকে ছাড়িনি। মিস্ত্রি আর জোগালি লাগিয়েছি তিরিশ জন। দশ জন করে ভাগ করে তিন শিফটে কাজ করিয়েছি। এক মুহূর্তও নষ্ট করিনি।

– তিন শিফটে! সেজন্যই ছ-মাসের কাজ দু-মাসে হলো।

– কোনো কোনো কাজ এভাবেই করতে হয়।

– এত তাড়াহুড়া করছিস কেন?

– তাড়াহুড়া না। এমনিই তো দেরি হয়ে গেছে। এগুলো তৈরি হয়ে গেলে আমি প্রজেক্টটা শুরু করে দিতে চাই। তাছাড়া, আমার অন্য কাজ আছে না?

অংশু না বললেও ঋভু ঠিকই বুঝে নিল, কেন ওর মনে হচ্ছে যে, এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে! মানুষ আর বাঁচেই বা কদিন? সত্তর বা আশি বছর? চল্লিশের পর মানুষের জীবনে তাই বেলা পড়ে আসার অনুভূতি হয়। শরীর ও মন দুটোই জানান দেয় – সময় ফুরিয়ে আসছে, বেলা পড়ে আসছে। তখন আর নতুন করে কিছু শুরু করতে ইচ্ছে করে না। অথচ অংশু মধ্য-চল্লিশে এসে শুরু করলো সম্পূর্ণ নতুন আর অচেনা-অজানা এক কাজ। কী হবে এর ফলাফল তা আন্দাজও করা সম্ভব নয়, অথচ ওর হয়তো কিছু দেখে যাওয়ার সাধ হয়।

ঋভু অবশ্য এ বিষয়ে আর কিছু বললো না। প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, এখন একটু চা খাওয়ার ব্যবস্থা কর।

– ওসব রেডিই আছে। শুভ ভাই তো এখন এখানেই থাকে। সে-ই সব ব্যবস্থা করে রেখেছে।

– তাই নাকি?

– হ্যাঁ। কাজের নেশায় পড়ে গেছে। শুক্র-শনিবার জোর করে ঢাকায় পাঠিয়ে দিই।

– ভাবি-বচ্চারা কোথায়?

– অবন্তিদের বাসাতেই। মাঝে-মাঝে ওরাও আসে।

– যাক, শুভ ভাইয়ের তাহলে নতুন জীবন শুরু হয়েছে।

– তা বলতে পারিস। আচ্ছা, অবন্তির সঙ্গে তোর যোগাযোগ হয়?

– খুব বেশি না। দু-তিনবার কথা হয়েছে।

– কী বলে?

– দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

– তুই কিছু বলেছিস?

– কোন ব্যাপারে?

– আরিয়ানা আর সোফিয়ার ব্যাপারে?

– ওরা এসেছে তা তো জানে। বিস্তারিত কিছু বলিনি।

– বলিসনি কেন?

– বলবো। সবই বলবো।

– আরিয়ানা জানে অবন্তির কথা?

– হ্যাঁ জানে। ওকে কিছুই লুকাইনি।

– ভালো করেছিস। ওর প্রতিক্রিয়া কী?

– সহজভাবেই নিয়েছে।

– হুম। তুই কী করবি এখন?

– এখন তো একটাই কাজ। ওরা আগে চলে যাবে, আমি ভিসার জন্য অ্যাপ্লাই করবো দু-চারদিনের মধ্যেই। পেয়ে গেলে রওনা হবো।

– কতদিনের জন্য যাচ্ছিস?

– জানি না রে। পরিস্থিতি কোনদিকে গড়ায় তার ওপর নির্ভর করছে।

– আমাকে সবসময় আপডেট দিবি। ডুব দিয়ে থাকিস

না কিন্তু।

– আরে এখনই তো যাচ্ছি না। তোর সঙ্গে অনেক আলাপ বাকি আছে। আরিয়ানারা চলে গেলে সময় নিয়ে বলবো। এখন চল, নিচে যাই।

নিচে গিয়ে দেখা গেল, জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে ওরা তিনজন, কী নিয়ে যেন খুব হাসাহাসিও হচ্ছে। হালকা নাস্তা এসেছে, চা আসবে এখনই, শুভ ভাই জানালো। ঋভু কিছুক্ষণ তার সঙ্গে আলাপ করলো – কেমন আছেন, কেমন লাগছে নতুন এই কাজ, বাসার সবাই কেমন আছে, এইসব। ‘তোমরা আড্ডা দাও, আমি ওদিকে যাই। ধারেকাছে না থাকলে ওরা খুব কাজে ফাঁকি দেয়’ – বলে উঠে গেল শুভ।

– কী নিয়ে হাসাহাসি হচ্ছিল? – এবার আরিয়ানাকে জিজ্ঞেস করলো ঋভু।

– তা তোমাদের বলা যাবে না। – আরিয়ানা বললো।

– বুঝেছি।

– কী বুঝলে?

– আমাদের বদনাম হচ্ছিল।

আবার হাসিতে ভেঙে পড়লো ওরা।

– তুমি বুঝলে কী করে বাবা? – সোফিয়া হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলো।

– তা তোমাকে বলা যাবে না।

– আহা, আমি তো আর বদনাম করছিলাম না, আমাকে বলো।

– তুমিও তো ওই দলে।

– না না বাবা, আমি তোমাদের দলে।

– খুব হাসছিলে যে তাহলে!

– মা আর চাচির কথা শুনে হাসছিলাম।

– ও, তাই বলো। শোনো, মা-চাচিরা একসঙ্গে হলে বাপ-চাচাদের বদনাম করবেই। ইউনিভার্সাল ট্রুথ। এটা বোঝার জন্য বুদ্ধিজীবী হতে হয় না।

– আর বাপ-চাচারা যখন একসঙ্গে থাকে?

– তখন তারা কেবল বউদের ভালোবাসার গল্প করে।

– আহাহা … শুনিয়া পরান জুড়াইয়া গেল। – অপলা ফোড়ন কাটলো।

– বিশ্বাস করো না বলেই তোমার জীবনে প্রেম হইলো না, বুঝলা সুন্দরী? একটা উল্লুকরে নিয়া সংসার কইরা গেলা। যার যা কপাল!

অপলা উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঋভু উঠে গিয়ে নিজের ব্যাগটা এনে একটা সুদৃশ্য খাম বের করলো। বললো, তোর কলমটা দে তো অংশু।

– কী ওটা?

– তা দিয়ে তুই কী করবি, কলম চাইছি দে।

– এই নে। চাওয়া তো না, ডাকাতি। ফকিন্নির মতো চাইছিস, একটু নরম করে বল। একটু বিনয় তো শিখতে পারিস।

– বকবক করিস না গাধা।

তারপর একটু ঝুঁকে খামের ওপর লিখলো : ‘আরিয়ানার বাড়ির জন্য আমাদের সামান্য উপহার।’ নিচে ইংরেজিতে ‘আওয়ার লিটল গিফট ফর আরিয়ানা’স হোম।’ ওটা না লিখলেও চলতো। আরিয়ানার বোঝার জন্যই লেখা। তারপর খাম আর কলম সোফিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো – তোমার নাম লেখো তো মামণি। নিচে আমাদের লেখার জন্য জায়গা রেখো।

সোফিয়া লিখলো : সোফিয়া আরিয়ানা পারভেজ।

ঋভু এবার আরিয়ানাকে বললো নিজের নাম লিখতে। সে বললো – আমি তো বাংলা জানি না। ইংরেজিতে লিখবো?

– তোমার ইচ্ছা। নিজের ভাষায়ও লিখতে পারো।

আরিয়ানা ইংরেজিতে লিখলো :  লুসিয়া আরিয়ানা পারভেজ। তারপর ব্র্যাকেটে লিখলো, সোফিয়ার মা।

আরিয়ানার নামের শেষে জিওভান্নি। কিন্তু এখানে লিখেছে পারভেজ। ঋভু মৃদু হেসে আরিয়ানাকে বললো – থ্যাংক ইউ।

তারপর নিজের নাম লিখলো : পারভেজ মাহমুদ ঋভু। ব্র্যাকেটে লিখলো, সোফিয়ার বাবা।

তারপর সোফিয়ার হাতে খামটা দিয়ে বললো, এটা তোমার চাচাকে দাও।

সোফিয়া উঠে দাঁড়ালো, দাঁড়ালো অংশুও। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। সোফিয়া বললো, ছবি উঠবে না?

– হ্যাঁ, হ্যাঁ উঠবে, তুমি দাও।

সোফিয়া হাত বাড়িয়ে বললো, আমাদের সামান্য উপহার, চাচা।

একটু মাথা ঝুঁকিয়ে খামটা হাতে নিল অংশু। বললো, এত নাটক করার মানে কী? কী এটা?

– জিজ্ঞেস করার কী আছে? খুলে দ্যাখ।

অংশু খাম খুলে দেখলো একটা ব্যাংক চেক। অংকটা অনেকক্ষণ ভরে দেখলো। তারপর হতভম্ব গলায় বললো, এটা কী লিখেছিস?

– পড়ালেখা তো কিছু করিসনি। অংক তো জানিসই না, সামান্য ইংরেজিও পড়তে পারিস না।

অংশু গায়ে মাখলো না। বললো, অপলা, দেখ তো! এসবের মানে কী?

অপলা হাতে নিয়ে নিজেও হতভম্ব হয়ে গেল। ওদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছিল মা-মেয়ে দুজনেই। কী লেখা আছে চেকে তা ওরাও জানে না। অংশু বললো, তোমরা জানো, এখানে কত টাকার কথা লেখা আছে?

মাথা নাড়লো ওরা, জানে না।

– এক কোটি টাকা! এক কোটি! এক কোটি টাকার মানে বোঝো?

আবার মাথা নাড়লো ওরা, না জানে না।

– মানে প্রায় এক লাখ ইউরো। ইতালিয়ান লিরায় প্রায় একশ আশি মিলিয়ন। বুঝেছ?

সোফিয়া হাততালি দিয়ে উঠলো।

– ও গ্রেট! তারপর ঋভুকে জড়িয়ে ধরে বললো, তুমি গ্রেট বাবা। মায়ের নামে বাড়ি…

– তোমার মায়ের নামে না হলেও এটা আমি দিতাম মামণি। এখানে আসার আগে জানতামই না যে অংশু এটার নাম করেছে তোমার মায়ের নামে। আমি চেকটা ঢাকা থেকেই লিখে এনেছি।

– দারুণ বাবা। তুমি সত্যি গ্রেট।

– কিন্তু এত টাকা! ঋভু, তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? – অংশুর বিস্ময় কাটেনি।

– মাথা খারাপ হবে কেন? আমার টাকা তো অলসই পড়ে

 আছে।

– তাই বলে এত টাকা!

– এত টাকা এত টাকা করছিস কেন? তুই ফার্মের আয় থেকে প্রতি মাসে আমার অ্যাকাউন্টে কত জমা করিস খেয়াল আছে?

– সেটা তো তোর শেয়ার।

– তো? সেই টাকা তো খরচই হয় না।

– তাই বলে…

– শোন অংশু। তোকে বলেছিলাম না, এই প্রজেক্টের আশেপাশে আমার জন্য একটা জমি দেখিস। সেটা আর করতে হবে না। এই বাড়ির একপাশে আমাদের একটা টিনের ঘর করে দিস। বুড়ো বয়সে আমি আর আরিয়ানা এসে এখানে থাকবো। আর সোফিয়া ঢাকার সবকিছু দেখাশোনা করবে।

অংশু স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। এবার তার চোখে জল আর ঋভু মৃদু হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।

– হাসছিস কেন ইডিয়ট? – খেঁকিয়ে উঠলো অংশু।

– একক কান্না প্রদর্শনী দেখতে মজা লাগছে। কখনো দেখিনি কি না!

– শোধ নিলি, না? দেখে নেবো তোকে।

ওপাশ থেকে কান্না চাপার শব্দ শোনা গেল এবার। ঋভু তাকিয়ে দেখলো, আরিয়ানা মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

ঋভু গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখলো, বললো, কাঁদছো কেন আরিয়ানা?

– আমি অনেকদিন বাঁচতে চাই পারভেজ। অ-নে-ক দিন। বুড়ো বয়সে তোমার সঙ্গে এখানে এসে থাকতে চাই। শিশুদের বুকে জড়িয়ে ধরতে চাই। বয়স্কদের সেবা করতে চাই। তুমি আমাকে বাঁচাবে? – আরিয়ানা বললো।

ঋভু নিবিড় করে ওকে জড়িয়ে ধরলো, একবার সান্ত্বনা দিতে ইচ্ছে করলো। পরমুহূর্তেই মনে হলো, মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে কী লাভ? মানুষ যেকোনো সময় নিজের জীবন বা অন্যের জীবন কেড়ে নিতে পারে, কিন্তু নিজেকে বা অন্য কাউকে জীবন উপহার দিতে পারে না। আয়ু তার নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। মানুষ বড় পরাধীনভাবে বেঁচে আছে। এইসব সে অনেক আগেই উপলব্ধি করেছে। জীবনের কাছে তাই তার কিছু চাওয়ার নেই।

কিন্তু অংশু জীবনকে অন্যভাবে দেখে। তাই সে বলতে পারলো, তুমি অবশ্যই বাঁচবে আরিয়ানা। আমরা তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবো। তোমার স্নেহ-মমতা-যত্নেই এই বাড়ির সবকিছু পরিচালিত হবে। ক্যান্সার আর এখন অপরাজেয় রোগ না। আমরা অবশ্যই জয়ী হবো।

মিথ্যে সান্ত্বনা জেনেও আরিয়ানা মিষ্টি করে হাসলো, চোখ মুছে বললো – থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ ফর এভরিথিং ইউ ডিড। তোমার কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।

গল্পসল্প হলো, আড্ডা হলো, দুপুরে চমৎকার স্বাদের মাছ আর শাকসবজি দিয়ে ভাত খাওয়া হলো। আরিয়ানা-সোফিয়া দুজনেই ইতোমধ্যে বাংলা খাবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, পছন্দও করছে, অন্যদের মতো হাত দিয়ে মেখে খাচ্ছে, চামচের দরকার পড়ছে না।

পড়ন্ত দুপুরে এক পশলা বৃষ্টি হলো, যখন খাওয়া শেষে সবাই ভাতঘুম দিচ্ছিল। ঋভুর ঘুম আসেনি, যদিও শুয়ে আছে আরিয়ানার পাশে। বৃষ্টির শব্দে জানালা দিয়ে দূরে তাকালো সে, দেখলো নদীটা দেখা যায় এখান থেকে, সেখানে ধূসর বৃষ্টির অপূর্ব পতন। বেশিক্ষণ রইলো না বৃষ্টি, কিন্তু আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। বিকেলে তারা যখন নদীর পাড়ে বেড়াতে গেল, হেঁটে গেল অনেক দূর পর্যন্ত, জনমানবহীন নির্জন প্রান্তরে তখন শীতল বাতাস বইছে। সন্ধ্যার আগে আগে আকাশে ফুটলো মাখন রঙের কনে-দেখা-আলো। ঋভু আরিয়ানাকে বললো – জানো, বাংলায় এ আলোর নাম কনে-দেখা-আলো।

– এরকম নাম কেন বাবা? – জিজ্ঞেস করলো সোফিয়া।

– এ-অঞ্চলের অনেক মেয়ের গায়ের রং কালো হয়। তাদের সহজে বিয়ে হতে চায় না। দুনিয়ার সর্বত্র সাদা রঙের জয়। জানোই তো। তো, বরপক্ষ যখন কনে দেখতে আসে, মেয়ের বাবারা এই আলোর জন্য অপেক্ষা করে।

– কেন, কেন? সোফিয়ার কণ্ঠে দারুণ কৌতূহল।

– এই আলোতে সব কিছুর রং পাল্টে যায়, অন্যরকম দেখায়, সবাইকে সুন্দর দেখায়। দেখ, আমাদেরকে অন্যরকম লাগছে না?

– সত্যিই তো! কী অদ্ভুত ব্যাপার! এই আলো কি শুধু বাংলাদেশেই দেখা যায় বাবা?

– তা তো জানি না। বিশেষ আবহাওয়ায়, বিশেষ পরিবেশে দেখা যায়। নিশ্চয়ই অন্যান্য দেশেও দেখা যায়, কিন্তু বাঙালিরা এটাকে রোমান্টিসাইজ করেছে, অন্যরা হয়তো খেয়ালই করেনি।

– বাংলাদেশের প্রকৃতিটা এত সুন্দর, রোমান্টিসাইজ না করে উপায় থাকে না বাবা।

– তোমার ভালো লেগেছে?

– লাগেনি আবার! এদেশ ছেড়ে যেতেই ইচ্ছে করছে না।

– আবার আসবে মা। এদেশ তো তোমারই।

– নিশ্চয়ই আসবো। মা সুস্থ হলে আমরা সবাই মিলে ফিরে আসবো। ঠিক আছে বাবা?

মেয়েটা কথায় কথায় বাবা বলে ডাকে, বুক ভরে ওঠে ঋভুর। এই মেয়েকে ছাড়া সে থাকবে কীভাবে? নাহ, যেখানেই থাকুক সোফিয়া, সেও তার সঙ্গে থাকবে। দূরে থাকার মানেই হয় না।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। মনে হচ্ছে, হালকা কুয়াশা জমতে শুরু করেছে। ঋভু জিজ্ঞেস করলো – হেমন্ত কি এসে গেছেরে অংশু?

– ক্যালেন্ডারে তো কয়েকদিন আগেই এসেছে। ঢাকায় বসে বোঝা যায় না।

– সত্যিই রে। ঢাকা হলো ঋতুসংহারি শহর।

– ঋতুসংহারি! দারুণ বলেছিস। 

সন্ধ্যায় বসলো গানের আসর। মজনু মিয়া তার চেনা গায়কদের ডেকে এনেছে। এ-অঞ্চলের সব লোকশিল্পীই কমবেশি মরমি। তারা কীর্তন যেমন গায়, মুর্শিদীও গায়, লালন-মনমোহন-উকিল মুন্সির গানও গায়। ঘণ্টাদেড়েক মাতিয়ে রাখলো তারা গান দিয়ে, শহুরে ‘সাহেব’ আর ‘মেম’দের ব্যাখ্যা করেও শোনালো অনেক গানের গূঢ় অর্থ। ঋভু আবার সেসব অনুবাদ করে শোনালো আরিয়ানাকে। একের পর এক মরমি গানে পরিবেশটাও হয়ে উঠলো মোহনীয়।

ওদিকে শুভ ভাই উঠোনে বার-বি-কিউয়ের আয়োজন করছেন। শিল্পীদের খাইয়ে-দাইয়ে, যথেষ্ট পরিমাণ সম্মানী দিয়ে বিদায় করার পর গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা হলো তাদের, অনেকদিন পর একসঙ্গে পরিমিত পরিমাণে পানাহারও হলো। অপলা গুনগুন করে গানও গেয়ে শোনালো। সকালে কাজ নেই, ফেরার তাড়াও নেই, এইসব অলস আড্ডা তাই ভারি মধুর স্মৃতি হয়ে থাকে।

সকালে ঘুম ভাঙার কারণ ছিল না, তবু ঋভুর ঘুম ভেঙে গেল। পাশে আরিয়ানা ঘুমানো, সোনালি চুল এসে পড়েছে ওর অনিন্দ্যসুন্দর মুখের ওপর। মানুষ এত সুন্দর হয় কী করে? এত মায়া লাগে আজকাল ওর জন্য! এত সুন্দর একজন মানুষ, অথচ কত কম আয়ু নিয়ে এসেছে!

আলগোছে উঠলো ঋভু, বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলো, পাতলা কুয়াশার আবরণে ঢেকে আছে সব। হালকা শীতও পড়েছে যেন, যদিও গায়ে বিঁধছে না। সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে মায়াময় হেমন্ত তাহলে সত্যিই এলো। শুরুতেই জানান দিচ্ছে, দিন যত গড়াবে কুয়াশা তত ঘন হবে, শীত আরেকটু বাড়বে, রোদও হয়ে উঠবে কোমল আর আরামদায়ক। যেন খুব ধীরে প্রস্তুত করবে মানুষকে আসন্ন শীতের জন্য। হেমন্তের শেষের দিকে ঋভু গ্রামের দিকে চলে যায় প্রতিবছর। নিজের গ্রাম থেকেও নেই, তাই সে বেছে নেয় দেশের যেকোনো অঞ্চলের যেকোনো গ্রাম, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের দিকে গিয়ে থাকে কয়েকদিন যেখানে বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তরে কুয়াশা জমে থাকে দীর্ঘ সময় ধরে, একটু দূরের কিছুও ঠিকমতো দেখা যায় না। তখন সামনের দিকে তাকালে পরমের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুভূতি হয়। নিশ্চিত জানে সে – ওপাশে আছে ফসলের মাঠ, বৃক্ষরাজি, পশুপাখি, কীতপতঙ্গ, মানুষের ঘরবাড়ি আর তাদের জীবনযাপন, তবু অদৃশ্য সবকিছু। পরমও কি তেমনই কিছু – চির-অদৃশ্য, চির-অধরা, চির-অচেনা; কেবল প্রকাশিত হয় অনুভূতিতে, চিন্তায়, ইশারায়, ইঙ্গিতে?

হঠাৎ গানের সুর ভেসে এলো। কে গাইছে? ঋভু দেখলো, একটু দূরে, বাউন্ডারি-দেয়ালের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে মুখ করে অপলা গাইছে : ‘যদি প্রেম দিলে না প্রাণে, কেন ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে।’ গানটা গতরাতেও গেয়েছিল অপলা, তবে গুনগুন করে, এখন গলা একটু তুলেছে, যেন কাউকে প্রশ্ন করে উত্তর চাইছে এমনভাবে থেমে থেমে গাইছে, ‘কেন তারার মালা গাঁথা, কেন ফুলের শয়ন পাতা, কেন দখিন হাওয়া গোপন কথা জানায় কানে কানে?’ আহা, মৃদু কুয়াশামাখা এই নির্জন হেমন্তের ভোর, তার ভেতরে এক অপরূপা নারী জানতে চাইছে, ‘যদি প্রেম দিলে না প্রাণে, কেন আকাশ এমন চাওয়া চায় এ মুখের প্রাণে?’ মনে হচ্ছে যেন সে আকাশের দিকে তাকিয়ে নেই, আকাশই চেয়ে আছে তার মুখপানে। চিত্রকল্পটা এত অপূর্বভাবে এর আগে কখনো ধরা দেয়নি ঋভুর কাছে। হ্যাঁ, অপলার মুখশ্রী এত গভীর সুন্দর, আকাশও না তাকিয়ে পারে না।  কিন্তু এ-প্রশ্ন কাকে? – ‘তবে ক্ষণে ক্ষণে কেন, আমার হৃদয় পাগল হেন, তরী সে-সাগরে ভাসায় যাহার কূল সে নাহি জানে?’ যে চির-নীরব, চির-নিরুত্তর, তাকে এই প্রশ্ন করে লাভ কী? নাকি প্রশ্নের মধ্যেই নিহিত আছে উত্তর?

একবার এগিয়ে গিয়ে অপলার পাশে দাঁড়াতে ইচ্ছে হলো ঋভুর, পরমুহূর্তে সিদ্ধান্ত পাল্টালো। এত মগ্ন হয়ে, এত গভীর নিঃসঙ্গ হয়ে গাইছে অপলা, এই সময় ওর কাছে যাওয়া ঠিক হবে না। মানুষকে কখনো কখনো একা থাকতে দিতে হয়। কিন্তু এই দৃশ্যটা তার মন ভিজিয়ে দিলো। অপলাকে সে সবসময় দেখেছে ঘরোয়া পরিবেশে, এমনকি বেড়াতে গেলেও। তার একাকী মুহূর্ত ঋভুর কখনো দেখা হয়নি। আজকের এই দেখাটা চোখে লেগে রইলো, মনেও। অপলাকে যখন মনে পড়বে, দূর থেকে, তখন হয়তো ওর এই ছবিটাই ভেসে উঠবে চোখের ও মনের পর্দায়। হেমন্তের এই ভোরে এরকম এক অপূর্ব দৃশ্য উপহার পেয়ে সমগ্র প্রকৃতির কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে রইলো ঋভু।

ভেতরে ফেরত গেল সে। আরিয়ানা এখনো ঘুমাচ্ছে। কিন্তু আজকের দিনটি আর কখনো আসবে না, এরকম হেমন্তের ভোরে বাংলাদেশের কোনো এক নদীপাড়ের বাড়িতে হয়তো আর কখনোই আরিয়ানাকে পাওয়া যাবে না। ওকে এখন ঘুমাতে দেওয়া যাবে না,  ডেকে তুলতে হবে। কাছে গিয়ে আরিয়ানার কপালে হাত রাখলো ঋভু, না জ¦র আসেনি। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে দু-বার ডাকতেই চোখ মেললো আরিয়ানা।

ঋভু বললো, ওঠো। নদীর পাড়ে বেড়াতে যাবো।

আড়মোড়া ভেঙে উঠলো আরিয়ানা – সকাল হয়ে গেছে?

– বেলা ওঠেনি এখনো। চলো বাইরে যাই।

– হুম। একটু সময় দাও, ওয়াশরুম থেকে আসি।

– তার আগে সোফিয়াকে ডেকে তোলো। একসঙ্গে যাই।

– আচ্ছা।

পাশের রুমে গিয়ে সোফিয়াকে জাগালো আরিয়ানা।

পাঁচ-ছয় মিনিটের মধ্যে দুজনেই তৈরি। অবশ্য তৈরি হওয়ারও কিছু নেই। বেড়াতে তো যাচ্ছে না কোথাও। তিনজন বেরিয়ে দেখলো অপলা এদিকেই আসছে। ‘শুভ সকাল’ – সম্মিলিতভাবে শুভেচ্ছাবিনিময় হলো। ঋভু খেয়াল করলো, অপলার চোখ ভেজা ভেজা। হয়তো কেঁদেছে। ওরকম গান গাইতে গাইতে তো কাঁদাই যায়। এ তো কোনো সাধারণ দুঃখের কান্না নয়, জীবন ও জগতের গভীর কোনো তাৎপর্য খুঁজে বেড়ানোর গভীর বেদনা থেকে উৎসারিত কান্না। ঋভু যে একটু আগের দৃশ্য দেখে ফেলেছে তা বুঝতে দিলো না। বললো, এত ভোরে উঠেছ!

– আমি তো ভোরেই উঠি। আপনারা দলবেঁধে কোথায় যাচ্ছেন?

– নদীর দিকে যাই। তুমিও চলো।

– আপনারা যান। দেখি আমার কুম্ভকর্ণের ঘুম ভেঙেছে কি না। ওকে নিয়ে আসছি।

ঋভু বুঝে নিল, ও এখন একা থাকতে চাইছে। অথবা তাদেরকে নিজেদের মতো থাকতে দিচ্ছে।

বাইরে বেরিয়ে স্যান্ডেল খুলে ফেললো ঋভু, ওদেরকেও খুলতে বললো। তারপর শিশিরভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল অনেকদূর।

– কেমন লাগছে মামণি? – জিজ্ঞেস করে ঋভু।

– দারুণ বাবা। – উত্তর দিলো সোফিয়া।

– আর তোমার? – আরিয়ানার কাছে জানতে চাইলো ঋভু।

– এরকম অদ্ভুত অনুভূতি আর কখনো হয়নি জীবনে। মনে হচ্ছে শরীর আর মন থেকে সব যন্ত্রণা দূর হয়ে যাচ্ছে। থ্যাংক ইউ। আমি জানতাম না ঋভু, আমি এদেশ সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না।

ঋভু কিছু বললো না। জানলেই বা কী হতো? কিছুই না, কিছুই না। অল্প বয়সে মানুষ জীবনকে একভাবে দেখে, তাৎক্ষণিক লাভ-ক্ষতি, সুবিধা-অসুবিধার কথাই ভাবে। একসময় যখন আবিষ্কার করে ওসব ভেবে কোনো লাভই হয়নি, ততদিনে জীবন হাতছাড়া হয়ে গেছে। জীবন চলে জীবনের মতো, একে পরিচালনা করা যায় না, তবু মানুষ ভাবে সে নিজেই তার জীবনের পরিচালক। বিভ্রম, বিশুদ্ধ বিভ্রম, হয়তো মধুর বিভ্রমও। নইলে মানুষ বাঁচতো কী নিয়ে? এসব ঋভু বোঝে, যা ঘটার ঘটে গেছে, ঘটার কথা ছিল বলেই ঘটেছে। বদলানোর কোনো উপায়ই ছিল না।

চুপ করে এসব ভাবছিল ঋভু, দেখলো অপলা আর অংশু বেরিয়ে আসছে। ঋভু চিৎকার করে বললো, অপলা খালি পায়ে ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে এসো, ঋভু তুইও।

হাঁটতে হাঁটতে অপলার মুখে হাসি ফুটে উঠলো, কাছে এসে বললো, এসব আপনি পান কোথায় ঋভু ভাই?

– কোন সব?

– এই যে খালি পায়ে ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে আসা?

– এবং হেমন্তের শিশিরভেজা ঘাসে…

– হ্যাঁ। কোথায় পান এসব?

– আমি সংসারহীন বিবাগী মানুষ, এগুলোই খুঁজে বেড়াই। কেমন লাগলো বলো?

– অপূর্ব। এতবার গ্রামে গিয়েছি, কখনো এই অভিজ্ঞতা হয়নি।

– হবে কী করে? শীতের সকালে খালি পায়ে হাঁটা যায় নাকি? – অংশু বললো।

– কেন তোর ভালো লাগেনি?

– লেগেছে। কিন্তু ব্যাপারটা আমিও আগে আবিষ্কার করতে পারিনি। তুই তো লোভ ধরিয়ে দিলি।

– কাজটা তাহলে ভালো করেছি। তুই তো প্রায়ই এখানে আসিস। হেমন্ত আর শীতের সকালগুলো এখন তোর জন্য লোভনীয় হবে। অবশ্য সব ঋতুর ভোরই সুন্দর, কিন্তু এত মায়াজড়ানো না।

সূর্য উঠেছে, মিষ্টি-নরম রোদ এসে আছড়ে পড়েছে পৃথিবীর বুকে। ধীরে ধীরে কুয়াশা মিলিয়ে যাবে, ঘাসের শরীর থেকে শিশির ঝরে যাবে। কিন্তু হেমন্ত কখনোই গ্রীষ্মের মতো রুক্ষ হবে না। জীবনানন্দ বোধহয় সেজন্যই হেমন্তকে এত ভালোবাসতেন। এইসব ভাবছিল ঋভু। অপলা বললো, এবার ঘরে চলেন, নাস্তা তৈরি।

– এত সকালে নাস্তা!

– গ্রামে সকালেই নাস্তা হয়। শহুরে বাবুপনা এখানে চলবে না।

– খোঁচাও কেন? না হয় একটু বাবুপনা করিই, এ আর এমন কী দোষ?

– দোষের কথা বলেছি নাকি? চলেন চলেন।

সকালেই ঢাকায় ফেরার কথা, কিন্তু নাস্তার টেবিলে বসে আরিয়ানা বললো – আরেকটা দিন থাকা যায় না?

– থাকতে চাও? – অংশু জানতে চাইলো।

– আমার তো খুব ভালো লাগছে এখানে।

– কোনো সমস্যা নেই। আমি তাহলে একটু ঢাকা থেকে ঘুরে আসি। দুপুরের মধ্যেই ফিরবো। একসঙ্গে লাঞ্চ করবো। ঠিক আছে?

– থ্যাংক ইউ। হেসে বললো আরিয়ানা।

অংশু শুভকে ডেকে জানালো, আমরা আজকেও থাকছি। বাজারটাজার লাগবে?

– ওসব আমি দেখছি। চিন্তা করো না।

– আমি একটু ঢাকায় যাচ্ছি। দুপুরে ফিরবো। ততক্ষণ পর্যন্ত এরা আপনার জিম্মায় রইলো। একা একা যেন গ্রামের দিকে না যায়।

– ঠিক আছে। সমস্যা হবে না।

গ্রামের দিকে না যেতে দেওয়ার কারণ অবশ্য বোঝা গেল না, কিন্তু তা নিয়ে মাথাও ঘামালো না তারা। শুয়ে-বসে, আড্ডা দিয়ে সময়টা বেশ কেটে গেল। অংশু ফিরলো দুপুরের মধ্যেই, খেয়েদেয়ে একটু দিবানিদ্রাও হলো সবার। তারপর অংশু নিজেই সবাইকে নিয়ে গ্রাম দেখতে বেরুলো। ততক্ষণে বিকেল হয়ে এসেছে।

মেঠোপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে, অংশুর কাছে গ্রামের মানুষদের নিয়ে মজার সব গল্প শুনতে শুনতে, অচেনা মানুষদের সঙ্গে হাসিমুখে কুশলবিনিময় করতে করতে আর টং দোকানে চা খেয়ে, শখ করে একটা মিষ্টি পান মুখে দিয়ে রসে মুখ রাঙিয়ে, আরিয়ানার মুখ উজ্জ্বল আনন্দে ভরে উঠলো। সন্ধ্যার আগে তারা ফের গেল নদীর পাড়ে। এদিকটায় সন্ধ্যাবেলায় লোকজন আসে না বলে গভীর এক নির্জনতা নামে, তার ওপর হেমন্তের সন্ধ্যা, কুয়াশাও আজ নেমে এলো একটু আগেভাগেই, আগের দিনের চেয়ে একটু ঘন হয়ে, যেন সব আয়োজন আরিয়ানাকে খুশি করার জন্যই। সন্ধ্যার পর ফের এলো গায়করা, গভীর প্রেম নিয়ে কীর্তন-মুর্শিদী-মরমি গান গাইতে গাইতে আজ তাদের চোখে নামলো ঢল, আরিয়ানা ভাষা না বুঝলেও মোহাবিষ্ট হয়ে বসে রইলো। আজকে আর অনুবাদের প্রয়োজন হলো না। আরিয়ানা জানে, মিউজিক নিজেই এক ভাষা, লিরিক না বুঝলেও ঠিকই স্পর্শ করে। গায়করা চলে যাওয়ার পর পানাহার হলো, আড্ডা হলো, গল্পসল্প, হাসিঠাট্টা-দুষ্টুমি সবই হলো।

রাতে ঋভুর বুকে মাথা রেখে আরিয়ানা বললো – জানো, কালকে এই জায়গা থেকে চলে যেতে হবে ভাবতেই মন কেমন যেন করে উঠছে। যেতেই ইচ্ছে করছে না।

এর নাম মায়া, ঋভুর মনে হলো। মানুষ কারণে-অকারণে মায়ায় জড়ায়, শুধু মানুষের সঙ্গেই নয়, আরো অনেক কিছুর সঙ্গে। আরিয়ানাও এই জায়গার সঙ্গে অতি দ্রুত মায়ায় জড়িয়ে পড়েছে। ইতালিয়ান ভাষায় মায়া শব্দটির কোনো প্রতিশব্দ আছে কি না ঋভু জানে না, এমনকি অনেক হাতড়েও ইংরেজি প্রতিশব্দও খুঁজে পেল না। তাই বলা হলো না, আরিয়ানা, তুমি মায়ায় জড়িয়েছ। (চলবে)

Published :