একটি সৎ, পরিশ্রমী আর অনুগত ছেলে চেয়েছিলাম আমি। যে চলে গিয়েছিল, তার মধ্যে স্পষ্টতই এগুলির অভাব ছিল। ওদিকে আমার সামনে পোস্টিং অর্ডার নিয়ে দাঁড়িয়েছিল যে হ্যাংলা-পাতলা ছেলেটি, সেও কোনোভাবেই আস্থা কুড়োতে পারল না আমার। ও যে-কাজগুলি করবে, তা এমনিতে গুরুত্বহীন মনে হতে পারে; কিন্তু কোনো ভুলটুল হয়ে গেলে বড় খেসারত গুনতে হতে পারে কোম্পানিকে এবং একই সঙ্গে আমাকেও!

‘স্যার, আমারে দিতে পারেন … যেমনে যেমনে কইবেন, সেই মতোনই পৌঁছাইয়া দিমু।’ ওর বাচনভঙ্গিটাও পরিষ্কার ছিল না। সেখানে কেমন একটি খসখসে টান; শব্দ-বিরতিগুলি আকস্মিক আর অনুমান-অযোগ্য। পুরনো পিয়ন জামিল খবরটা দিতেই ডেকে পাঠিয়েছিলাম ওকে। একটা হাত ওর পুরোই অকেজো – ওদের জগতে মর্যাদাপূর্ণ বলে বিবেচিত ডকুমেন্ট আনা-নেওয়ার কাজটি করতে চাইছে!

ওর নাম ছিল সুখন। আর সে যে একজন পরহেজগার মুসলমান, কদিনেই তার পরিষ্কার ধারণা পেয়ে গিয়েছিলাম আমরা। আজান হওয়া মাত্র সে প্যান্টের নিচটা টাকনুর ওপর বটে ফেলত, আর মাথার ওপর গলিয়ে দিত একটা নিখুঁত রকমের গোলাকার ও জরিপেড়ে খয়েরি টুপি। তবে শুধু নামাজের সময় নয়, অন্য সব পর্বেও সে ছিল এক অক্লান্ত ঘোড়া, ছোটাতেই যার সুখ। যখন বিধিবদ্ধ কাজ ফুরিয়ে যেত, তখন সে চেয়েচিন্তে কাজ জুটিয়ে নিত অফিসের স্যার ও ম্যাডামদের ডেস্কে ডেস্কে ঘুরে। আবার তাদের অন্যায্য বকা খেয়েও সে হাসিটা ধরে রাখত ঠোঁটের কিনারে। পানকৌড়ির গলার মতো একখানি গলা ছিল ওর। আর মুখটা ছিল গড়পড়তা মাপের থেকেও কিছুটা লম্বা। দাঁতগুলিও সাধারণের থেকে বড় আর চকচকে।

অথচ এমন অসাধারণ সব বৈশিষ্ট্য ধারণ করেও সে সাধারণের কাছ থেকে ‘একটা নুলো’ ছাড়া আলাদা কোনো খেতাব জোটাতে পারেনি। এই সুখনের বিরুদ্ধে অচিরেই অভিযোগ আসতে শুরু করল। ওই নুলো হাত দিয়ে কাউকে মারধর করতে পারে, বিশ্বাস হতে না চাইলেও ডেকে পাঠাই তাকে। কিন্তু সে বরাবরের মতোই মাথাখানি মাটিতে স্থির রেখে, যেন কেউ শুনতে না পায় এমন একটা ভঙ্গিতে জানাল, ‘আপনি আমারে পছন্দ করেন, এইডা হেগো সহ্য না!’

আমি অফিসে কখনোই কাউকে পছন্দ করিনি – সে যদি সুখন বা তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা অমনটা বিশ্বাস করেও থাকে তাতে কিছু আসে-যায় না আমার। আমি শুধু কাজকে ভালোবাসি, আর যে কাজ করে, তার আচরণ কিছুটা এদিক-সেদিক হলেও মেনে নিই। আর তাই দু-চারটে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে ছেড়ে দিয়েছিলাম তাকে, পিয়নের মর্যাদাপূর্ণ কাজেও নিযুক্ত করেছিলাম। কিন্তু সে-ই একদিন পাক্কা তিনদিন ছুটি চেয়ে মেজাজটা বিগড়ে দিলো আমার।

‘এই না মাস দুয়েক আগে ছুটি কাটিয়ে এলে?’ প্রশ্নটা করার সময় আমার কুঁচকে-থাকা ভ্রুটা সোজা হওয়ার জন্য সংগ্রাম করতে লাগল।

‘আফনে না দিলে লমু না। তয় ছুটিডা না দিলে আমার বিরাট ক্ষেতি হইয়া যাইব, স্যার। বছরের এই টাইমডায় ক্ষেতিডা করলে বাড়তি কিছু ইনকাম হয়।’ বলেই সে আবার নতমুখ হয়।

‘নিজের ক্ষতি দেখলেই হবে? প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি দেখার কোনো দরকার নাই?’

‘আফনে না দিলে করনের কিছু নাই, স্যার! আমারে নানা টাইমে যে উপকারডা করছেন, সারা জীবনেও শুধতে পারমু না!’

‘এই শেষবারের মতো বলছি, আবার যদি পাম্প দেওয়ার চেষ্টা করো, তাইলে লগে লগে চাকরি শ্যাষ! আর ছুটি যদি নিতেই হয়, দুদিনের বেশি এক সেকেন্ড না!’ কথাগুলি বলার পর আমি হাঁপাতে থাকি আর উপসর্গটা বেছে বেছে শুধু এই সময়গুলিতেই হয়!

প্রার্থিত ছুটি কমানোই নিয়ম, এমনকি বিধাতাও তার বান্দাকে চাহিদামাফিক অবকাশ মঞ্জুর করেন না। তবে কর্তিত ছুটি কাটিয়ে যখন আগের থেকেও থলথলে হাসির মেদ নিয়ে ফিরে এলো সে, বোঝা যায়নি যে, মাসখানেকের মধ্যেই আবার ছুটির দরখাস্ত নিয়ে দাঁড়াতে যাচ্ছে।

‘আমার মনে হয়, বোধ-বুদ্ধি সব গুলে খেয়ে ফেলেছ তুমি!’ একটা বিস্ময় আমায় এমনভাবে আবিষ্ট করে যে রেগে উঠতেও ভুলে যাই।

‘স্যার, সব কিছু আপনার মর্জি! আপনি না দিলে লমু না! … তয় গত রাইতে একটা খবর আইল বাড়ির থনে …’ ওর কণ্ঠে সেই ‘নাকি’ সুরটা ফিরে আসে, আর একটি বেসুরো গানকে জোর করে শোনার মতো ওর কথা শোনাকেও অত্যাচার মনে হতে থাকে আমার!

‘ওইসব খবর অন্য কাউরে শোনাও। পরিষ্কার বুঝতে পারতেছি, চাকরির প্রতি আর কোনো মায়া নাই তোমার!’ যদি সত্যিই বাড়াবাড়ি করে, সেক্ষেত্রে ওকে ছাঁটাই করার পর সামনে কিভাবে চলবে, কয়দিন লাগবে নতুন লোক পেতে, তা নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিই আমি।

‘স্যার, যমজ পোলা দুইডারে এক নজর দেইখাই চইলা আমু। খালি একটা দিন, স্যার …’ কথাটা যখন বলছিল, ফ্যাসফেসে স্বরটা ওর ভেতরের আর্তিটাকে পুরো চেপে রাখছিল। কিন্তু সেদিকে কোনো খেয়াল ছিল না আমার; বিস্মিত নেত্রে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। ঠিক শুনলাম তো – যমজ! এই বেঢপ, নুলো আর ন্যাকাটার ঘরে দুই-দুইটা মানবশিশু!

সুখন সেবার ছুটি থেকে ফেরার সময় প্রায় আধমণ মিষ্টি আর দই নিয়ে এসেছিল। কিন্তু আমার তো মিষ্টির সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটেছে দুই বছর হলো। খবর শুনে ছুটে এলো সুখন।

‘স্যার, আমাদের রাজু ঘোষের নিজ হাতে তৈরি! যারাই একবার মুখে দিছে, সারা জীবনেও ভুলতে পারে নাই!’ নিজের মুসলমানিত্ব নিয়ে সর্বদা বড়াই করলেও হিন্দুর হাতের মিষ্টিতে সমস্যা নেই সুখনের! কিন্তু সে নিয়ে ভাবছিলাম না আমি। আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা। এই যে এত টাকা খরচ করে এলো, ভবিষ্যতে চলবে কেমন করে? যে রোজগার, তাতে একজনের চলাই কষ্ট! সামনে নিশ্চিত ধার-কর্জ করার অভিপ্রায় করবে সুখন!

বলতে কী, একটা নিশ্চিত ধ্বংসের প্রতীক্ষা করছিলাম যেন আমি! কিন্তু সুখনকে কোনো ঋণের দরখাস্ত জমা দিতে দেখা গেল না আমার টেবিলে। উল্টো অফিসে তার কাজের মনোযোগ ও গতি দুই-ই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে লাগল। আর এরই মাঝে একদিন বদলি আদেশ চলে এলো আমার।

‘স্যার, আমার বিষয়টা?’

আমার আর দিনতিনেক ছিল এই অফিসটাতে; শেষ পর্যন্ত গুছিয়ে উঠতে পারব কি না, তা নিয়ে টেনশনে ছিলাম; অথচ এই অপস্রিয়মাণ সময়ে তৃতীয়বারের মতো হাজির হয়েছে সে আমার সামনে! তারও একটা বদলি চাই, আর তা আমার সঙ্গেই, আমার নতুন কর্মস্থলে! আমি যাওয়ার সময় যতটা সম্ভব সদ্ভাব রাখতে চাইছিলাম সবার সঙ্গে, তাই তাকে জানিয়েছিলাম – ওপরে বলে দেখব কিছু করা যায় কি না। কিন্তু তা-ই অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করে নেবে সুখন, একদমই কে ভেবেছিল!

‘না, তুমি এখানেই থাক। পরে সময়-সুযোগ হলে দেখবোনে।’ বলে আমি ল্যাপটপের ফাইলগুলি ডিলিট করতে শুরু করে দিয়েছিলাম। এগুলি একান্তই আমার ব্যক্তিগত। এই অফিসটাতে রেখে যাওয়ার মানে হয় না।

‘স্যার, আফনে যা করছেন, ভুলতে পারমু না জীবনে! তয় যদি কোনো বেয়াদবি কইরা থাকি, মাফ কইরা দিয়েন।’ আবার সেই নাকিকণ্ঠে শব্দের মেঘ, এমন ধোঁয়াটে যে বোঝা যায় না কিছু!

এরপর প্রায় মাসতিনেক পার হয়ে গিয়েছিল। একটি করে ঘণ্টা, মিনিট আর সেকেন্ড এগোচ্ছিল, আর নতুন সব ছবি দখলে নিয়ে নিচ্ছিল আমার পৃথিবীটাকে, পুরনোদের হটিয়ে দিয়ে।

‘স্যার, আসতে পারি?’

নতুন বিজনেস প্ল্যানটাতে পুরো ডুবে গিয়েছিলাম, তাই ভূত দেখার মতোই চমকে উঠি আমি! সুখন আমার চেম্বারের কোনা আলো করে রাখা কাঁচের স্তম্ভটা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল; আর ওর সেই ‘নুলো’ হাতটাতে একটা কিছু শোভা পাচ্ছিল। দ্বিতীয়বার তাকিয়ে সেখানে একটা গ্যালন আবিষ্কার করতে সক্ষম হলাম; যতদূর দেখে মনে হচ্ছে, ভেতরে দুধ ভর্তি।

‘আরে! কিভাবে এলে? কেমন আছো?’ প্রাথমিক ধাক্কা কেটে যাওয়ার পর আমি নিরাসক্ত কণ্ঠে বলি। এদ্দিন বাদে এসেছে এত দূর থেকে, একটুখানি সময় সুখনের অবশ্যই প্রাপ্য হয়েছে। আর একটু ভালো ব্যবহার।

‘স্যার, অফিসের একটা কাজে আইছিলাম। তয় ভাবলাম, আপনের লগে দেখা কইরা যাই। আর আমার বাড়ির গাইয়ের দুধটাও দিয়া যাই।’

আমি অনেক কষ্টে নিশ্বাসটা চাপা দিই। এই ব্যাপারগুলি কি পৃথিবীতে শেষদিন পর্যন্ত চলতে থাকবে? ওর কেন খরচ করে আমার জন্য এতদূর থেকে দুধ বয়ে আনতে হবে? তাও তো আমি আর ওর বস‌ নই এখন।

‘বাহ, তোমার নিজের গাই বুঝি! খুব খুশি হলাম, সুখন।’ এই বলে যেই আমি মানিব্যাগে হাত দিয়েছি, সে প্রায় আর্তচিৎকার করে ওঠে।

‘স্যার, এইডা আমার বউবাচ্চার পক্ষ থাইকা আফনের লাইগা উপহার। কষ্ট পাইব হুনলে।’ মড়াকান্না ধরেছিল সে,তাই মানিব্যাগটা জায়গামতো রাখতেই হয় আমায় তাকে থামাতে।

উপহারটা বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম যতটুকু মনে পড়ছে। তবে দুধের কোয়ালিটি সেইরকমই কি না যার জন্য আমার মতো নাগরিক-মানুষের মনে আহলাদের ঢেউ ওঠে – তা নিয়ে ভাবার সত্যি সময় ছিল না। কারণ নতুন অফিসে আমায় সবকিছু নতুন করে চিনতে হচ্ছিল, আর মনেও রেখে দিতে হচ্ছিল। নতুন জায়গার সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, গ্রাহকেরা প্রতিনিয়ত পুরনোদের সঙ্গে তুলনা করতে থাকে। এমন নয় যে, পুরনো মানুষটিও সব সময় তাদের প্রত্যাশা শতভাগ পূরণ করতে পেরেছে। কিন্তু নতুনদের বেলায় প্রত্যাশার সামান্যতম হেরফের হলেও যেন রক্ষে নেই, নির্ঘাত বেধে যাবে কুরুক্ষেত্র।

এরই মাঝে একদিন যখন সুখনের নাম্বারটা রকেটের মতো ধেয়ে এসে ভেসে উঠল আমার স্মার্ট মনিটরে, অস্বীকার করব না যে, ভীষণ বিরক্তিতে ছেয়ে গিয়েছিল মনটা। ফোনটা রিসিভ না করায় আরো কয়েকবার ফোন টিউনের উপর্যুপরি আঘাত বরাদ্দ হলো আমার জন্য। একটা প্রবল হতাশা থেকে হাতের কাজ ফেলে রেখে দু-হাতের খোলে মুখটা ঢাকতে যাচ্ছিলাম; হঠাৎ বাসা থেকে ফোন এলো, একটি ছেলে নাকি বাসার সদর দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। পোশাক আর শরীরের যে বর্ণনা ফোনের ওপার থেকে ভেসে এলো, তাতে আমি নিশ্চিত হলাম ছেলেটি কে। তারপর যখন আমায় জানানো হলো, ছেলেটির হাতে রয়েছে দশ কেজি দুধ আর পাঁচ লিটার সরিষার তেল, চোখ-মুখ পুরোই শুকিয়ে গেল আমার।

‘একটা ফুল স্কেল স্টুপিড!’ আমার মনের মধ্যে এই গালিটার সঙ্গে ‘চলে যেতে বলো’ বা, ‘দরজা বন্ধ করে দাও মুখের ওপর’ ইত্যাকার সম্ভাব্য সংলাপ জুড়তে জুড়তে ভেঙে গেল, আর শেষমেশ ঠোঁটজোড়াকে ভীষণ গতিতে ধাক্কা মেরে বের হলো ‘দামটা দিয়ে জিনিসগুলো রেখে দাও।’ এরপর সেদিন রাতের ডাইনিং টেবিলে একটা পারিবারিক ঐকমত্যেও পৌঁছানো সম্ভব হলো – সুখনটাকে নিষেধ করে দিতে হবে কড়া করে, এমন যেন আর না করে।

কিন্তু কাগুজে সিদ্ধান্তের মতো এর কোনো আইনি তাৎপর্য ছিল না। মৌখিক এ নীতিগুলি মুখে মুখেই ভেঙে পড়ত আর পুনরায় গড়ত। ওই ঘটনার পরে আরো অনেকবারই সুখন এসেছে আমার বাসায় – দুধটা, সরিষার তেলটার সঙ্গে প্রতিবারই আরো কিছু যুক্ত করেছে সে। তারপর গাট্টি-বস্তা নামিয়ে দিয়ে টাকা নিয়ে চলে গেছে। পণ্যে ‘ভ্যারাইটিস’ নীতিকে অবলম্বন করলেও বিক্রয়-বিরতিতে সে একটা একতা ধরে রাখত। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, তিন মাসের বাঁধা সীমাটা পার হয়ে গেলে আমার মধ্যেও একটা অপেক্ষা জেগে উঠত; মনে হতো সুখনের পণ্যসম্ভারে স্নাত না হলে আমার চলবে না কিছুতেই।

একবার এমন হলো যে, অপেক্ষার প্রহর পাঁচ মাসে গিয়ে ঠেকল, তাও সুখনের দেখা নেই। এমন নয় যে, তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যেত না এই মুঠোফোনের দুনিয়ায়। কিন্তু কিছু পণ্যের জন্য ওকে ফোন দেব – ভাবতেই গা’টা শিরশির করে উঠত আমার।

বছরখানেক বাদে একদিন সুখনের ফোন অবশ্য বেজে উঠল। হুড়মুড় করে ধরা ফোনটা অচিরেই খুব ভারী বোধ হতে লাগল। ওর বউটা নাকি অনেকদিন ধরেই একটা জটিল সমস্যার কথা বলে যাচ্ছিল আপনজনদের – কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগে, আর মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে! অনেক ডাক্তার-বৈদ্য দেখানো হয়েছিল; কিন্তু চক্করটা শুধু আরো বেশি সময় নিয়ে আরো বেশি করে হামলে পড়ছিল। নিরুপায় হয়ে সুখন একসময় ইস্তফা দেয় চাকরিতে। তিন-তিনটে শিশুসন্তানের দিকে তাকিয়ে নিজের এক ফোঁটা জমিতে ক্ষেতি করতে লেগে গিয়েছিল সে, কিন্তু সেখানেও একের পর এক লস! তবে এত কিছুর মধ্যেও এক পশলা বাতাস বইয়ে দিয়েছে যে ঘটনাটা তার বাড়িতে সম্প্রতি, তা হলো, তার গাভীটা বিইয়েছে আর দুধ দিতেও শুরু করেছে!

‘কিন্তু সুখন, আমার তো আর দুধের দরকার নেই।’ বেরিয়ে আসতে চাওয়া দীর্ঘশ্বাসটাকে প্রাণপণে রুখতে চেষ্টা করি আমি।

‘মিছা কমু না, স্যার, যত্ন নিতে পারি নাই গাইডার। তয় কইতে পারি, আমার থিকা ভালো দুধ আর কোনোহানে পাইবেন না, স্যার।’ কেমন একটা বেপরোয়া সুর সুখনের কণ্ঠে।

‘আমায় দুধের জন্য কোথাও যেতে হয় না, সুখন। আমার নতুন যে অফিসটা তার সঙ্গেই রয়েছে একটি বেশ উন্নত মানের খামার …’

‘ও … স্যার … আবার বদলি হইছেন!’ কাঁপা কাঁপা কথাটা বলার সময় বিমর্ষ শোনায় তাকে। তারপর একটা কিছু যেন মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলে, ‘আচ্ছা স্যার … তাইলে … সরিষার তৈলডা … একদম খাঁটি …’

‘না, না, তারও আর দরকার নাই। এখানে সরিষার মিলও আছে একাধিক।’ এক নিশ্বাসে বলে যাই আমি।

এরপর আর কথা এগোয়নি সেদিন। দোয়া চেয়ে ফোনটা রেখে দেয় সে। কিন্তু তারপর থেকেই বুকের মধ্যে কিছু একটা দলা পাকাতে পাকাতে অসুস্থ করে দিতে থাকে আমাকে। রাতে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে করতে আবারো একটা পারিবারিক ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয় – এবার সুখনের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দেওয়া হবে, আর তা ওর দেওয়া পণ্যের মূল্য থেকে বেশি হবে অবশ্যই।

পরদিন সিদ্ধান্তটা জানানোর জন্য ফোন করতেই ওপাশ থেকে চকচক করে ওঠে সুখনের কণ্ঠ, ‘স্যার, ভালো আছেন? আমার মন কইতেছিল আফনের ফোন আইব।’ আমি নিশ্চিত, সে ধরে নিয়েছে যে, মতটা বদলেছি আমি আর অর্ডারটা শেষ পর্যন্ত করেই দেব।

‘শোনো, অন্য একটা বিষয়ে ফোন দিচ্ছিলাম আমি …’ তরতর করে বলে উঠি আমি।

সে চুপ থাকে। সেই নীরবতা এত গভীর যে, তার তীব্রতা ফোনের এ-প্রান্ত থেকেও আমায় ঘা মারতে থাকে।

‘দেখো, আমি তোমার জন্য একটা ব্যবস্থা করেছি। তোমার অ্যাকাউন্ট নাম্বারটা দাও … প্রতি মাসে …’

‘না, না, স্যার …’

‘না কেন?’ আমি হতবাক কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করি।

‘স্যার, এমনে টাকা নিলে নেক হইব না। তয় জানি, আফনে খুব মায়া করেন আমারে! কই কী, আমার কাছ থোন মাল লইয়া টাকা দেন, স্যার। খুব উপকার হইব … স্যার!’ আমি ধাক্কা খেলাম না তড়িতাহত হলাম, ঠিক বলতে পারব না। কিন্তু আর বিদায়টুকুও না নিয়ে ফোনটা রেখে দিয়েছিলাম।

এরপর বিষয়টা নিয়ে অনেক ভেবেছি আমি; কিন্তু ‘নেক’ শব্দটা অধরা থেকে গেছে বলে সুখনের কাছ থেকে মাল নেওয়া বা ওকে টাকা দেওয়া – কোনোটাই আর সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে।