হুমায়ূন আহমেদের ফেরা : ভাটির মানুষের জীবনকাব্য

ফে  রা উপন্যাসের ভূমিকায় নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, ‘‘ফেরা’র গল্প ভাটি অঞ্চল নিয়ে’ (হুমায়ূন আহমেদ, ফেরা, উপন্যাস সমগ্র, দ্বিতীয় খণ্ড, ঢাকা, প্রতীক প্রকাশনা, ২০১৮, ভূমিকা)। হুমায়ূন আহমেদের ভাটি অঞ্চল নিয়ে মুগ্ধতা ছিল। তিনি ভাটির দেশের লোক; হাওরের মায়াময় সৌন্দর্য, হাওরবাসীর উদাসী ও সংগ্রামী জীবনালেখ্য তাঁর ফেরা উপন্যাসের মুখ্য বিষয়। বাংলাপিডিয়ায় ভাটি অঞ্চলের টীকায় বলা আছে, ‘নদীবিধৌত ও জোয়ার-ভাটা দ্বারা প্লাবিত নিম্নাঞ্চল। বাংলা ভাটা বা ভাটি শব্দ থেকে ‘ভাটি অঞ্চল’ নামের উৎপত্তি (‘ভাটি অঞ্চল’, বাংলাপিডিয়া, ওয়েবসাইট http://bn.banglapedia.org)। বাংলাদেশ ভাটির দেশ, অনেক নদীর দেশ, পানির দেশ। কিন্তু পানির প্রাবল্য সব জেলায় সমান নয়, কিছু জেলা ও অঞ্চল আছে যেগুলিকে ভাটি অঞ্চল বলে। এর আরেক নাম হাওর অঞ্চলও। ‘হাওর’ নামটি এসেছে ‘সাগর’ থেকে। ‘সাগর’ শব্দটি ধ্বনি পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘সায়র’ হয়েছে, ‘সায়র’ থেকে ধ্বনি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে হয়েছে ‘হাওর’। বর্ষাকালে এসব অঞ্চলের পানির গভীরতা ও রূপবৈচিত্র্য এতই বৃদ্ধি পায় যে, তখন এসব অঞ্চলকে সাগর বা সমুদ্রের মতো মনে হয়। এশিয়ার সর্ববৃহৎ হাওর অঞ্চল বাংলাদেশে।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলা নিয়ে হাওর অঞ্চলের অবস্থান। এগুলি হলো – নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। হুমায়ূন আহমেদের জন্মস্থান নেত্রকোনায় হাওর আছে ৫২টি। উপন্যাসের প্রেক্ষাপট নেত্রকোনা হলেও যেসব স্থানের নাম উপন্যাসে এসেছে সেগুলি নেত্রকোনার বাইরে অপরাপর হাওর অঞ্চলে বিস্তৃত। লেখক হাওর অঞ্চলের সামগ্রিকতাকে ধারণ করেছেন, শুধু নেত্রকোনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। উপন্যাসে বর্ণিত নীলগঞ্জ কিশোরগঞ্জ জেলায়, সোহাগী ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। তবে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার বাইরে তিনি উপন্যাসের স্থান-কাল বিস্তৃত করেননি। উপন্যাসের মূল কাহিনি সোহাগী নামক গ্রামকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে।

ফেরা উপন্যাসের ছোট পরিসরে ভাটি অঞ্চলের মানুষের সুখ-দুঃখ, তাদের সংগ্রামী জীবনের সমান্তরালে বহমান বিষণ্নতার সুর, বেঁচে থাকার জন্য চারদিক পরিবেষ্টিত করে রাখা পানির সঙ্গে অবিরাম ও বাধ্যতামূলক যুদ্ধ, তাদের জয় পরাজয় – এসব কিছুর এক নিখুঁত ও প্রাণছোঁয়া বর্ণনা পাওয়া যায়। তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে আছে মালোপাড়া, পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসে আছে কুবেরদের জেলেজীবন, হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় আছে বনওয়ারী-করালীর কাহার সম্প্রদায়; ফেরা উপন্যাসে নির্দিষ্ট কোনো সম্প্রদায় মুখ্য হয়ে ওঠেনি, তাই সব পেশাজীবী সম্প্রদায়ই হয়ে উঠেছে সমানভাবে মুখ্য। উপন্যাসে আমিন ডাক্তার, মতি মিয়া, কানা নিবারণ, কৈবর্তদের প্রবীণ ব্যক্তি নরহরি দাস, ছোট চৌধুরী সাহেবসহ সবাই বিভিন্ন পেশার বিভিন্ন চরিত্রের মানুষ; বিচিত্র পেশার মানুষদের নিবিড় বসবাস সোহাগী গ্রামে। ‘ভাটিবাংলার রূপাঙ্কন এবং ওই স্থানিকতাকে বিচিত্র শৈল্পিক ফর্মে অনুবাদ করতে পারা হুমায়ূন আহমেদের শিল্পীজীবনের অন্যতম প্রধান অর্জন। বলা যাবে, সাহিত্যের মূলধারায় হুমায়ূনই বাংলাদেশের ওই বিশিষ্ট অঞ্চলের সাহিত্যিক প্রতিনিধি’ (মোহাম্মদ আজম, ‘হুমায়ূন আহমেদের গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস’, প্রথম আলো, ১৬ই জুলাই, ২০২১)।

হাওর অঞ্চলের মূল পেশা যদিও মাছ শিকার ও ধান চাষ, তবু হুমায়ূন আহমেদ নির্দিষ্ট কোনো পেশাজীবী সম্প্রদায়ের ছবি আঁকেননি, ভাটি অঞ্চলের সামগ্রিকতাকে ছোট পরিসরে ধারণ করেছেন। ফেরা আঞ্চলিক উপন্যাস কাঠামোয় পড়ে; এখানে নির্দিষ্ট অঞ্চল আছে, সে-অঞ্চলের ভাষা ও জীবন-সংগ্রাম আছে, তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও সমাজকাঠামো আছে। বিতর্কিত ‘আঞ্চলিক উপন্যাস’ ক্যাটাগরি দিয়ে ফেরা উপন্যাসকে বিচার না করে বরং হাওরবাসীর জীবনাখ্যানের এক অনবদ্য দলিল হিসেবেও একে বিবেচনা করা যায়। আঞ্চলিক উপন্যাস অভিধাটি বিতর্কিত এ-কারণে, প্রতিটি উপন্যাসই কোনো-না-কোনো অঞ্চল নিয়ে কথা বলে। ‘আসলে আঞ্চলিক উপন্যাস বলে কিছু নেই। আছে ভালো অথবা মন্দ উপন্যাস, সার্থক বা ব্যর্থ উপন্যাস। সে উপন্যাস লেখা হতে পারে ‘ভদ্রলোক’দের জীবন নিয়ে এবং ‘প্রান্তবাসী’ বা ‘অন্ত্যজ’ শ্রেণীর মানুষদের নিয়ে। ‘কবি’, ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ বা ‘নাগিনীকন্যার কাহিনী’ তাই আঞ্চলিক উপন্যাস নয়। বরং এ ধরনের উপন্যাসে পাঠক পেয়ে যান ‘অপরিচিত’ জীবন যাপনের বিন্যাস, বিবিধ আচার-আচরণ, অবলম্বিত মানুষজনের নানা রিচ্যুয়াল। তার মাধ্যমে পাঠক সন্নিহিত হতে পারেন সমাজের গরিষ্ঠ জনবিন্যাসের সঙ্গে।’ (বিষ্ণু বসু, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় : শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ১-এর ভূমিকা, ঢাকা, অবসর প্রকাশনা, ২০০৮)

নদীবেষ্টিত বাংলাদেশের নদীমাতৃকতা ফেরা উপন্যাসে প্রস্ফুটিত। উপন্যাসে আছে বর্ষা, আছে বৃষ্টি, বজ্রপাত, বান, অথই পানি, পানি সরে যাওয়ার পর ভয়াবহ পাঁক-কাদার নিটোল বর্ণনা। পানির দেশ হওয়ায় নৌকা জীবনাচারের অন্যতম অনুষঙ্গ, নৌকার সঙ্গে হাওরবাসীর সখ্য প্রবল। এছাড়া আছে পানি সংক্রান্ত নানা সংস্কার ও কুসংস্কার। ভাটির দেশের চারধারে অথই পানির মধ্যে জীবন কাটানো মানুষগুলি নানারকম ছড়া কাটে, গান তাদের জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ। ভাটি অঞ্চলের পললসমৃদ্ধ উর্বর মাটিতে প্রচুর ধান জন্মে আর জলাভূমিতে আছে মাছের প্রাচুর্য। ফসল ফলানোর সময়টি পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে কাটে তাদের, বাকি সময় কাটে অলস বিনোদনের মধ্য দিয়ে। আমোদ-ফুর্তির জন্য ভাটি অঞ্চলে হয় গান-বাজনা,  নৌকাবাইচ প্রভৃতি। জীবনকে নিরপদ্রূপ করার জন্য একসময় তারা শরণাপন্ন হতো সত্যপীর, সত্যনারায়ণ, ওলাবিবি, বনবিবি, শীতলাদেবীর কাছে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের সবসময়ের সঙ্গী; গান আর সুর তাদের অপার জীবনীশক্তির উৎস। হুমায়ূন আহমেদ ফেরা উপন্যাসে বেশকিছু লোকসংগীত ব্যবহার করেছেন। কিছু উদাহরণ –

আগে চলে দাসী বান্দি পিছে ছকিনা

তাহার মুখটি না দেখিলে প্রাণে বাঁচতাম না

ও মনা ও মনা …

(ফেরা, পৃ ১৮১)

এই গানটি হুমায়ূন আহমেদ তাঁর জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক অয়োময়-এ ব্যবহার করেছেন। অয়োময় নাটকও নির্মিত হয়েছিল ভাটি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। ফেরা থেকে আরো গান –

লোকে আমায় মন্দ বলে রে

মন্দ বলে মন্দ বলে মন্দ বলে রে

আমি কোথায় যাব কি করিব

দুঃখের কথা কাহারে কব রে।

মন্দ বলে মন্দ বলে মন্দ বলে রে।

(পৃ ১৮৫)

আছে মেয়েলি গীত। মেয়েলি গীতের নানা রকমফের থাকলেও মূলত অল্পবয়সে বিবাহিত মেয়েদের স্বামীগৃহের লাঞ্ছনা, মনের বেদনা, না-বলা কথা, বিরহ, অন্তর্জ্বালা প্রভৃতি কষ্টের অনুভূতি এই ধরনের গানের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। স্বামীর ঘরে আসা মেয়েদের মনে পড়ে তাদের ছেড়ে আসা বাবা-ভাইদের কথা, বাবা-মা ছেড়ে আসা নারীর গোপন দুঃখ উদ্ভাসিত হয় গানের মাধ্যমে –

শ্রাবণ মাস গেছে গেছে ভাদ্র মাসও যায়

জানি না কি ভাবেতে আছে আমার বাপ ও মায়।

(পৃ ২১৭)

বাইচ উৎসব হাওরবাসীর জীবনীশক্তির অন্যতম অনুষঙ্গ। বাইচের নৌকাগুলি বিশেষভাবে তৈরি, পানি কেটে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার জন্য গলুইয়ের বিশেষ ধরনের চৌকো নির্মাণশৈলী ব্যবহৃত হয়। ‘বাংলাদেশের নৌকা বাইচ সাধারণত ভাদ্র-আশ্বিন মাসে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এক সুরে নৌকার প্রতিযোগীরা গান গায় এবং এসব গানের কথায় থাকে প্রায়শ আল্লাহ বা ঈশ্বর ও প্রকৃতির কাছে সাহস সংগ্রহের আবেদন’ (নৌকা বাইচ, বাংলাপিডিয়া, ওয়েবসাইট : http://bn.bnglapedia.org)| ফেরা উপন্যাস থেকে বাইচের গান –

ওগো ভাবীজান, বাইচ বাইতে মর্দ লোকের কাম

ওগো ভাবীজান, বাইচ বাইতে মর্দ লোকের কাম।

(পৃ ২১৯)

উক্ত গানটি একটু ভিন্নভাবে গীত হয়েছে নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের শ্রাবণ মেঘের দিন চলচ্চিত্রে। বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে গীত গানে আছে, ‘ওগো ভাবীজান, নাও বাওয়া মর্দ লোকের কাম।’ বাইচ উৎসব নদীমাতৃক বাংলাদেশের লোকায়ত সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ফসল। 

ধান ও মাছ সোহাগীর সম্পদ। বেশি ধান উৎপন্ন হলে উৎসব হয়। এরকম এক উৎসবের নাম ‘বাঘাই সিন্নি’। বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হিসেবে অনেক আগে এরকম প্রথা চালু ছিল বলে এর নাম বাঘাই সিন্নি। বাঘাই সিন্নি উপলক্ষে অনেক লোক একত্রিত হতো, সমস্বরে গান গাইতো। এই গানগুলিতে একজন মূল ‘গাতক’ থাকত, তার সঙ্গে ধুয়া ধরত অন্যরা (আবদুস শহীদ, প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ওয়েবসাইট : northamerica.prothomalo.com)। ফেরা উপন্যাস থেকে –

(মূল গীত)

আইলাম গো

যাইলাম গো

বাঘাই সিন্নি চাইলাম।

(ধুয়া) চাইলাম গো। চাইলাম গো।

(পৃ ২১১)

গানের পাশাপাশি পুঁথিসাহিত্যেও সমৃদ্ধ ছিল সোহাগী। ধানের উৎসবে পুঁথি পড়ার জন্য পেশায় চোর কিন্তু ভাটি অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ কথক আলাউদ্দিনের কদর অনেক। ভাটি অঞ্চলের গানপাগল মানুষের কাছে গাতকের অন্যসব পরিচয়ের চেয়ে শিল্পী পরিচয়ই মুখ্য, পেশায় সেই শিল্পী চোর হলেও হাওরবাসীর কাছে তার শিল্পীসত্তারই কদর। ফেরা থেকে পুঁথিগান –

(গীত)

শুনেন শুনেন দশ জনাতে

শুনেন দিয়া মন।

লাল চাঁন বাদশার কথা হইয়াছে স্মরণ।

লাল চাঁন বাদশার মনে বড়ো দুঃখ ছিল,

লাল চাঁনের দুঃখ দেইখ্যা কান্দে গাছের পাতা

(পৃ ২১০)

ভাটির দেশে রয়েছে নানা ধরনের গান। যাত্রাগান, পালাগান, বাউলগান, কীর্তন, গাজির গান, ভাটিয়ালি, ধামাইল, মালসি গান, বারোমাসি, সূর্যব্রতের গান প্রভৃতি। গ্রামীণ যেসব চিরায়ত অনুষঙ্গ রয়েছে, যেমন নৌকাবাইচ, ফসল কাটা থেকে ঘরে তোলা, ধানের বীজরোপণ, হালচাষ প্রভৃতি কাজেও রয়েছে গানের স্পর্শ।

পানির দেশ হওয়ায় পানি নিয়ে ভাটির মানুষের আছে নানা লোকসংস্কার। ফেরা উপন্যাসে মতি মিয়ার ছেলে নুরুদ্দিন পানিতে জলকন্যা দেখে। আছে ওলাওঠার ভয়, তাই ওলাওঠার সময় সবাই ঘরে বসে থাকে। কারণ, ‘তখন বাইরে বেরোলে
রাত-বিরাতে বিকট কিছু চোখে পড়তে পারে। চোখে পড়লেই সর্বনাশ’ (পৃ ২২৫)। ‘ফিরাইল সাবের’ আগমন ঘটে প্রকৃতির আক্রমণ থেকে ধান বাঁচানোর জন্য। ধানের ওপর শিলাবৃষ্টি পড়লে ধান নষ্ট হয়ে যায়। শিলাবৃষ্টি থেকে ধান বাঁচাতে ‘ফিরাইল’ নামক মন্ত্রশক্তিসম্পন্ন ফকিরের দ্বারস্থ হতো সোহাগীর মানুষেরা। মন্ত্রশক্তিসম্পন্ন এ-ফকির ধানের ওপর আগত শিলাবৃষ্টিকে সরিয়ে মন্ত্রবলে অন্য কোথাও ফেলতো। ‘ফিরাইলে’র পাশাপাশি আছে আরো অলৌকিক প্রসঙ্গ। যেমন স্বর্ণমুদ্রাপূর্ণ কলসি ‘মাইট’। এসব ‘মাইট’ নিজেরা চলাচলে সক্ষম ও অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন। এছাড়া নীমতলি গ্রামের সীমানায় আছে দুটি তালগাছ এবং সেই “তালগাছ দু’টিতে দোষ আছে। গভীর রাত্রে মাছ মারতে এসে অনেকেই দেখেছে, একটা জাম্বুরার মতো বড়ো আগুনের গোলা গাছ দু’টির মাথায়। এ গাছ থেকে ও গাছে যাচ্ছে, আবার ক্ষণে ক্ষণে মিলিয়েও যাচ্ছে” (তদেব, পৃ ২০৮)। নানা বিদেহী জিনিসের সঙ্গে সোহাগীবাসীর নিত্যবসবাস। রাতে এদের নাম নেওয়া যায় না। তালগাছের মতোই এরা শেওড়া গাছেও বাস করে। ছোট গাঙ থেকে নৌকা যখন বড় গাঙে পড়ে তখন গা-ছমছম করা শব্দ হয়, সেই শব্দে গায়ে কাঁটা দেয়। সোহাগীবাসী এসব লোকসংস্কার ও ট্যাবুকে লালন করে বেঁচে থাকে। হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় বিরাটাকার চন্দ্রবোড়া সাপকে কাহারেরা ভক্তি করে, ফেরা উপন্যাসেও আছে এমনই নানারকম ভক্তির গল্প।

হুমায়ুন আহমেদের কথাসাহিত্য, টিভি নাটক কিংবা চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের লোকসাহিত্য উদ্ভাসিত হওয়ায় আমরা, পাঠকেরা-দর্শকেরা, এসব লোকছড়া-গান-শিলুক-লোকসংস্কার-ট্যাবুর আনন্দটুকু কেবল পেয়েছি; এই মূল্যবান সম্পদগুলির ইতিহাস, স্থান, সময় ও ঐতিহ্যকে পাইনি। হুমায়ূন আহমেদ লোকসাহিত্যের ভক্ত ছিলেন, কিন্তু লোকসাহিত্য গবেষণায় হয়তো তাঁর আগ্রহ ছিল না। একজন শুদ্ধ সাহিত্যিকের মতোই তিনি শুধু আনন্দের জন্য লিখতেন। তাঁর সংগৃহীত লোকসাহিত্যের ভাণ্ডার তাঁর সৃষ্টিকর্মের মতোই বিপুল।

বর্ষাকালে দীর্ঘ অলস সময়ই হাওরবাসীর সঙ্গে উজানবাসীর জীবনচর্যার পার্থক্য করে দেয়। অখণ্ড অবসরই সোহাগীবাসীকে ‘গাতক’ বানিয়েছে, লোকসংস্কৃতি চর্চায় বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে তাদের এগিয়ে নিয়ে গেছে। তবে অলস অবসর যে কেবল উৎকৃষ্ট সংগীত ও সাহিত্য সৃষ্টি করেছে এমন নয়। হাওরবাসীর জীবনে অন্ধকার দিকও ছিল। সেগুলিও প্রাসঙ্গিক। ফেরা উপন্যাস থেকে সোহাগীর বর্ষাযাপনের চিত্র – বর্ষা এসে গেছে। ক’দিন ধরেই ক্রমাগত বৃষ্টি হচ্ছে। পথঘাটে এক হাঁটু কাদা। আজরফ ঘরেই বসে থাকে। করার তেমন কিছু নেই। আগামী পাঁচ মাস ধরে জোয়ান মর্দ ছেলেরা ফড় খেলবে, ষোলকটি খেলবে। কেউ কেউ ফুর্তির খোঁজে চলে যাবে উজান দেশে। এই পাঁচ মাস বিশ্রামের মাস, ফুর্তির মাস। (পৃ ২১২)

ঔপন্যাসিক ‘ফুর্তির মাস’ বলে বিশেষ কিছুর ইঙ্গিত দিয়েছেন, ফুর্তির বিস্তারিত বিবরণ দেননি। হুমায়ূন আহমেদের সর্বশেষ চলচ্চিত্র ঘেটুপুত্র কমলায় হাওর অঞ্চলের জমিদার শ্রেণির কলুষিত ও বিকৃত আমোদ-ফুর্তির চিত্র দেখানো হয়েছে, অল্পবয়সী বালকদের বালিকা সাজিয়ে সেই বালিকাবেশী ঘেটুপুত্রদের সঙ্গে সমকামিতায় লিপ্ত হতো কলুষিত জমিদারেরা। এই বিকৃত ফুর্তির সময়ও ছিল বর্ষাকাল। বর্ষার দীর্ঘ অবসরে সমাজের উচ্চবিত্ত মানুষের বিনোদনের উৎস ছিল ঘেটুর গান বা ঘাটুর গান।

হুমায়ূন আহমেদের এইসব দিনরাত্রি উপন্যাসে বর্ণিত নীলগঞ্জ কিশোরগঞ্জ জেলার কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলায় অবস্থিত। উপন্যাসে ভাটির জীবনাচার সরাসরি না এলেও প্রবল বৃষ্টিপাত আর কাদামাটির রাস্তার বর্ণনার মধ্যে ভাটি অঞ্চলের গন্ধ মিশে আছে। উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র কবির মাস্টারের ছাত্র শওকত নীলগঞ্জে বর্ষা দেখে আগাম বুঝে ফেলে সে-বছর বন্যা হবে নাকি হবে না। বই থেকে –

‘খালের পানি বাড়তাছে।’

‘হুঁ।’

‘এই বছর কিন্তুক পানি অইত না।’

‘বুঝলি কীভাবে?’

‘পরপর দুই সন বান হয় না। তারপর পানিটা দেখেন, ভারি পানি, বানের পানি অয় পাতলা।’

‘তাই নাকি?’

‘জি।’

‘ভারি-পাতলা বোঝ কীভাবে?’

‘হাতে নিলেই বুঝন যায়।’

(হুমায়ূন আহমেদ, এইসব দিনরাত্রি, উপন্যাস সমগ্র

তৃতীয় খণ্ড, ঢাকা, প্রতীক প্রকাশনা, পঞ্চম মুদ্রণ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, পৃ ১৭৩)

হুমায়ূন আহমেদের লেখায় নীলগঞ্জ, নান্দাইল, গৌরীপুর প্রভৃতি নাম পাওয়া যায়। তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহের ছবি এঁকেছেন। এই ময়মনসিংহ তাঁর সাহিত্যিক জীবনে বর্তমানের ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ নিয়ে বিরাজিত ছিল। এইসব দিন রাত্রি উপন্যাসে আছে শিয়ালজানি খালের কথা, রাজারামপুর ঘাটের কথা। আমার আছে জল উপন্যাসেও আছে ভাটির কথা।

ভাটি অঞ্চলের বিস্তৃত জলরাশি সোহাগীবাসীকে জগৎ-জীবন তুচ্ছ করে নিরুদ্দেশ হওয়ার জন্য উৎসাহী করে, ঘরছাড়া হওয়ার ইচ্ছা গেঁথে দেয়। ফেরা উপন্যাসে মতি মিয়া ঘরবাড়ি ছেড়ে যায়, আবার ফিরে আসে, আবার ঘরছাড়া হয়। চারপাশে বিস্তৃত জলরাশি সোহাগীর মানুষগুলির মনেও প্রভাব ফেলে, তাদের মনে ভর করে বৈরাগ্য। কানায় কানায় যখন পুরো ভাটির দেশ ভেসে যায় তখন মতি মিয়ার অনুভূতি হয় এমন –

হাওরের দিগন্তবিস্তৃত কালো পানির দিকে তাকিয়ে মনটা উদাস হয়ে যায় তার। জগৎ-সংসার তুচ্ছ বোধ হয়। 

(ফেরা, উপন্যাস সমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ১৮৫) 

উজান হয়তো তখন মতি মিয়াকে ডাকে। ভাটি অঞ্চলের অবরুদ্ধ বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে মতি মিয়া নিরুদ্দেশ হয়, ভাটির আকর্ষণে আবার ফিরেও আসে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আমিন ডাক্তারও উদাসীন, ডাক্তারি বাদ দিয়ে সে স্কুলমাস্টার হয়। হাওরের বাইরের মানুষ আমিন ডাক্তার, কিন্তু হাওরের টানে হয়ে ওঠে হাওরবাসী। হুমায়ূন আহমেদের দারুচিনি দ্বীপ উপন্যাসের মনসুর আলি জাহাজে জাহাজে দেশ-বিদেশের নানা বন্দর থেকে বন্দরে ঘুরে বেড়ায় পেশাগত কারণে। এই সামুদ্রিক মানুষটিকে তার কন্যার বান্ধবী জরী প্রশ্ন করে, সমুদ্র সবসময় ভালো লাগে কি না। সে-প্রশ্নের জবাব মনসুর আলির মুখে ছিল এরকম – যখন সমুদ্রে থাকি তখন ভালো লাগে না। কিন্তু সমুদ্র ছেড়ে ডাঙ্গায় আসলেই খুব অস্থির লাগে। সমুদ্রের এক ধরনের নিজস্ব ভাষা আছে। সেই ভাষায় সে ডাকে। সেই ভাষা বোঝার জন্যে এক দিন দুদিন সমুদ্রে থাকলে হয় না। বছরের পর বছর থাকতে হয়।

(দারুচিনি দ্বীপ, উপন্যাস সমগ্র সপ্তম খণ্ড, ঢাকা, প্রতীক প্রকাশনা, ২০১৭, পৃ ১০৯)

হাওর অঞ্চলও আমিন ডাক্তারকে মায়ায় বেঁধে ফেলেছে। সে হাওরবাসী হয়ে গেছে। হাওরের ডাক সে উপেক্ষা করতে পারেনি। হাওর অঞ্চলের অবিরাম বৃষ্টি আর বানের ডাক ঘরবাড়ি নিয়ে সুখে নিদ্রা যাওয়ার মতো নিশ্চিন্ত জীবন উপভোগ করতে দেয়নি সোহাগীবাসীদের। প্রবল বানে তাদের বাড়িঘর প্রায়ই তলিয়ে যায়। তাই জীবনের স্থিরতার প্রতি একধরনের অনিশ্চয়তা নিয়ে তারা বাস করে, এই অনিশ্চয়তা তাদের নিয়ে গেছে বৈরাগ্যের দিকে। 

হুমায়ূন আহমেদের অপেক্ষা উপন্যাসেও নিরুদ্দেশ

হওয়ার চিত্র আছে, যেমনটা আছে ফেরা উপন্যাসে।

এ-ধরনের ঘরছাড়া হওয়ার মধ্যে একধরনের আধ্যাত্মিকতা আছে। হুমায়ূন আহমেদের লেখায় ঘরছাড়ার ঘটনা ঘটে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে, ঘরছাড়া মানুষটির পরিবার হারিয়ে যাওয়া মানুষটির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করে না। যেমন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসে নদীর কান্না গ্রামবাসীর কাছে অস্বাভাবিক বা ভৌতিক ঘটনা হয়ে ধরা দেয় না, তেমনি হুমায়ূন আহমেদের ফেরায় কিংবা অপেক্ষায় পরিবারের মুখ্য সদস্যের নিখোঁজ হওয়ার মতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা ঘটে খুব সহজে। তাদের হারিয়ে যাওয়া কেবল নস্টালজিক দুঃখ দেয়, মিস্টিকতার জন্ম দেয়, হারিয়ে যাওয়া মানুষটিকে খুঁজে বের করার তাগিদ দেয় না। প্রিয় মানুষেরা হারিয়ে যাবে হুট করেই, যার মৃত্যু হয় সে বলেকয়ে বিদায় নিয়ে মারা যায় না – এমন একটি বার্তা দেন লেখক। মৃত্যুর সঙ্গে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পার্থক্য হলো, মৃত ব্যক্তির জন্য কেউ অপেক্ষা করে না, জীবিতদের জন্য করে। ফেরা উপন্যাসের রহিমা অপেক্ষা করে তার হারিয়ে যাওয়ার স্বামীর জন্য। কারণ, ‘অসম্ভব তো কিছুই নয়। হারিয়ে যাওয়া মানুষ তো কতই ফিরে আসে’ (ফেরা, উপন্যাস সমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ১৯৪)। রহিমাও স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে।

হাওরের বিস্তৃত জলরাশি কিন্তু শুধু উদাসী-বৈরাগী মানুষই তৈরি করেনি, বৈষয়িক মানুষও তৈরি করেছে। কানা নিবারণের মতো, মতি মিয়ার মতো বড় ‘গাতক’ তৈরিতে যেমন হাওরের প্রভাব আছে, তেমনি মতি মিয়ার ছেলে আজরফের মতো বলশালী কাজের মানুষও হাওরের ভয়ংকর সুন্দর প্রতিবেশের কারণেই হতে পেরেছে। আজরফ তার বাবার স্বভাব পায়নি, পানির সঙ্গে বাস করলেও পানিকে সে বশে আনে, নৌকা বাইতে পারে খুব, ফসল ফলায়, জমি কিনে বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখে।

উপন্যাসটির সংলাপে ও শব্দে নেত্রকোনার কথ্যভাষার চমৎকার ব্যবহার আমাদের মৈমনসিংহ গীতিকার কথা মনে করিয়ে দেয়। একইভাবে আমাদের মনে পড়ে পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের নক্সী কাঁথার মাঠ কিংবা সোজন বাদিয়ার ঘাট – কালজয়ী দুটো সাহিত্যিক গাথাকাব্যের কথা। বাংলা গাথাকবিতায় নরনারীর প্রণয়ই মুখ্য, এ-প্রণয়ে থাকে নানা সামাজিক বাধা, প্রণয় ঘিরে চলে কূট ষড়যন্ত্র এবং সে-ষড়যন্ত্রের কারণে বিয়োগান্ত এক সমাপ্তি ঘটে নায়ক-নায়িকার প্রেমের। ফেরা উপন্যাসে বর্ণিত জীবনাখ্যান গাথাকবিতার মতো কেবল নর-নারীর ভালোবাসাকেন্দ্রিক নয়, এখানে আছে ভাটি অঞ্চলের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনও। প্রেম এখানে মুখ্য বিষয় নয়, যদিও নরনারীর প্রেম অন্যভাবে অন্য আঙ্গিকে এখানেও আছে। গাথাকবিতার গল্প সরলরৈখিক, নায়ক-নায়িকার প্রেমের শুরু ও পরিণতির কাহিনির মাঝে মাঝে সমাজের ও ভূগোলের নানা চিত্র পাওয়া যায়। উপন্যাসে বিস্তৃত পরিসরে কাহিনির মূলস্রোতের সঙ্গে আরো উপস্রোত মেশানো যায়, সরলরৈখিক বড় গল্পে আরো ছোট ছোট গল্প যোগ করার সুযোগ থাকে। ফেরা উপন্যাসটি গদ্যভাষায় রচিত না হয়ে পদ্যে লিখিত হলে চমৎকার এক গাথাকাব্য পাওয়া যেত। গাথাকবিতার মতোই এই উপন্যাসে গল্পরস আছে, রূপকথার আমেজ আছে, সমাজের নিটোল চিত্র আছে, রমণীর কান্নার শব্দ আছে। মৈমনসিংহ গীতিকার ‘মহুয়া’ পালা থেকে হাওর অঞ্চলের সুখছবি –

সানে বান্ধা পুষ্করিণী গলায় গলায় জল।

পাইক্যা আইছে সাইলের ধান সোনার ফসল॥

তা দিয়া কুটিয়া খাইয়াম সালি ধানের চিরা।

এই দেশ না ছাইরো ভাইরে আমার মাথার কিরা॥   

(দীনেশচন্দ্র সেন-সম্পাদিত মৈমনসিংহ গীতিকা, ঢাকা, ষ্টুডেন্ট ওয়েজ, মাঘ ১৪০৭ বঙ্গাব্দ, পৃ ৬১)

ভাটি অঞ্চলের সুখের এমন চিত্র ফেরা উপন্যাসেও আছে –

ভাত না খেয়ে বাঁচার রহস্য সোহাগীর লোকজনের জানা নেই। চৈত্র মাসের দারুণ অভাবের সময়ও এরা

ফেলে-ছড়িয়ে তিন বেলা ভাত খায়।

(ফেরা, উপন্যাস সমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ২২৪)

ভাটির পানির বর্ণনায় ‘মহুয়া’ পালায় আছে –

বিস্তার পাহাড়ীয়া নদী ঢেউয়ে মারে বাড়ি।

এমন তরঙ্গ নদী কেমনে দিবাম পারি॥

(দীনেশচন্দ্র সেন-সম্পাদিত মৈমনসিংহ গীতিকা, ঢাকা, ষ্টুডেন্ট ওয়েজ, মাঘ ১৪০৭ বঙ্গাব্দ, পৃ ৭৪)

ফেরা উপন্যাসে আছে বিস্তীর্ণ জলের সঙ্গে হাওরবাসীর বসবাসের নান্দনিক বর্ণনা –

তারপর এক দিন সকালে সোহাগীর লোকজন দেখল যেন মন্ত্রবলে চারদিক ডুবে গেছে। থৈথৈ করছে জল। হুমহুম শব্দ উঠছে হাওরের দিক থেকে। জংলা ভিটার বাঁশ আর বেত-বনে প্রবল হাওয়া এসে সারাক্ষণ বোঁ-বোঁ শোঁ-শোঁ আওয়াজ তুলছে। চিরদিনের চেনা জায়গা হঠাৎ করে যেন রহস্যময় হয়ে উঠেছে। আদিগন্তবিস্তৃত জলরাশির মধ্যে হঠাৎ যেন জেগে উঠেছে সবুজ রঙের ছোট্ট “সোহাগী”।

(ফেরা, উপন্যাস সমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ২০)

ফেরা উপন্যাসের নারীদের কণ্ঠস্বর মৈমনসিংহ গীতিকার নারীদের মতো সবল নয়। মতি মিয়ার স্ত্রী শরিফা অসুস্থ, অসুস্থ শরিফা মতি মিয়াকে প্রেমাস্পদের সুখ দেয় না। মতি মিয়া ঝুঁকে পড়ে অন্য দিকে; দূরসম্পর্কের আত্মীয়া রহিমাকে সে ঘরে আনে, আর শরিফা জীবন কাটায় সতীনের যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে। পাগল ছোট চৌধুরীর বউয়েরও সারাজীবন কেটেছে দুঃখে। মরার এক বছর আগে ছোট চৌধুরী ভালো হয়ে যায়, মাথার রোগ সেরে যায়। এই এক বছরের স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন পেয়েই ছোট চৌধুরীর বউ স্বামীর সব পাপ মাফ করে দেয়। পুরুষগুলির মতো সোহাগীর নারীদের বিচরণ সর্বব্যাপী নয়, চারিত্রিক দিক থেকে সোহাগীর লম্পট পুরুষদের মতো তারা স্বৈরিণীও নয়। 

সময়ের অবিরাম গতিকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় চিত্রিত করেছেন। নতুন আসবে, পুরনোকে নতুনের কাছে পরাজিত হতে হবে – প্রকৃতির এটাই নিয়ম। তারাশঙ্কর মমতা নিয়ে বনওয়ারীর পরাজয় এঁকেছেন, আবার করালীকেও তিনি ভিলেন হিসেবে দেখাননি। ‘কাহার’ সম্প্রদায়ের বিলুপ্তিতে নতুনের জয় ঘোষিত হয়েছে, পুরনোর কান্নাও জমে আছে। একটি সম্প্রদায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে, কাহার হয়ে গিয়েছে কুলি, নতুন একটি যুগের সূচনা হয়েছে হাঁসুলী বাঁকের উপকথার অন্তে। হুমায়ূন আহমেদ নতুনের জয় কিংবা পুরনোর মৃত্যু নিয়ে নিস্পৃহ। তিনিও সময়ের পরিবর্তনের কথা বলেন, হাওরবাসীর জীবনের বহতার বর্ণনা দেন; জয়-পরাজয়ের মীমাংসাও আছে, তবে মুখ্য নয়। সোহাগীতে স্কুল হয়, সুন্দর মিনারওয়ালা পাকা মসজিদ হয়, ডাক্তারখানায় নতুন ডাক্তার আসেন, চৌধুরীদের আমবাগান চলে যায় আজরফের জিম্মায়, বড় ‘গাতক’ হিসেবে কানা নিবারণের যে-খ্যাতি ছিল তা চলে যায় মতি মিয়ার দখলে, এগারো বছর জেল খাটার পর সোহাগীতে ফিরে আসা আমিন ডাক্তারকে দুয়েকজন ছাড়া কেউ চেনে না। লেখক জীবনের মোড় পরিবর্তনের চিত্র এঁকেছেন; কিন্তু হাওরবাসীর ঐতিহ্যিক জীবনের কোনো মৌলিক পরিবর্তন উপন্যাসে চিত্রিত হয়নি, কেবল তাদের বয়স বেড়েছে, তারা আগের মতোই বাঘাই সিন্নির গান গায়। উপন্যাসের এমন সমাপ্তি তৃপ্তিদায়ক।