মিলান কুন্ডেরা : উপন্যাসে অস্তিত্ব এবং চেতনার প্রভাব

সম্প্রতি প্রয়াত চেক লেখক মিলান কুন্ডেরার দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিইং উপন্যাসটির কথা স্মরণ করে লেখাটি শুরু করা যাক। এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র টমাসের চাকরিচ্যুতি, হাসপাতালের সার্জন থেকে উইন্ডো ক্লিনার হওয়া, কখনো নিজের স্ত্রীর ওপর বিরাগভাজন হয়ে অন্য মহিলাদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে জড়ানো – এরকম টুকরো টুকরো গল্পে উপন্যাসটি সাজানো, যেসব গল্পে জড়িয়ে থাকে অন্য চরিত্ররা – টেরেজা, সাবিনা, সিমন অথবা ফ্রান্ৎস, যাদের গল্পগুলিও উপন্যাসের কাঠামোতে শক্তি জোগায়। ১৯৮৪ সালের সেরা বইয়ের তালিকায় থাকা এ বইটি নিয়ে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস বুক রিভিউয়ে লেখা হয়, ‘এই লেখকের আসল কাজ হলো তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর দেশের বিপর্যয়কর ইতিহাসের চিত্রগুলি তুলে ধরা।’ ঔপন্যাসিক কুন্ডেরা ঠিকঠাকমতো কাজটি করতে পেরেছেন বলেই এই শতাব্দীতে সবার অগোচরে থেকেও পাঠকের পঠন-পাঠনে চিরজাগ্রত ছিলেন।

মিলান কুন্ডেরা অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে কাব্যে, নাটকে, প্রবন্ধে এবং উপন্যাসে বিশ্বাসের বিপর্যয়ের সন্ধান করেছেন। তাঁর দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিইং-এ এর তুখোড় পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন দেখা যায়। সালমান রুশদি দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, সব মহান লেখকের মতো মিলান কুন্ডেরা তাঁর পাঠকদের কল্পনার মাঝে রেখে গেছেন অমলিন চিহ্ন। কুন্ডেরার দ্য বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং বইয়ের একটি বাক্য রুশদিকে বিস্মিত করেছিল, সারা বিশে^র ঘটনা সম্পর্কে রুশদির উপলব্ধিকে আরো বেশি আলোকিত করেছিল। সে-বাক্যটি হলো – ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম। তিনি আরো বলেন যে, এই উপন্যাসের দুই চরিত্রের পেছনে থাকা দুই পূর্বসূরি লেখকের দুটি চরিত্র – স্যামুয়েল রিচার্ডসনের ক্লারিসা এবং লরেন্স স্টার্নের ট্রিস্ট্রাম শ্যান্ডি – রুশদির সাহিত্যজীবনের ভাবনায় নতুন এবং মূল্যবান রাস্তা খুলে দিয়েছে। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসটির মধ্যে কুন্ডেরার কিছু দর্শন রয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনের উপলব্ধি থেকে কুন্ডেরা যে অর্জন করেছেন তা তার পাঠকদের সতর্ক করে দেয় – জীবন কখনো রিভিশন অর্থাৎ সংশোধনের অনুমতি দেয় না, বা খসড়া করার সুযোগ দেয় না; এটা কখনো অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে, আবার কখনো মুক্তির স্বাদও দিতে পারে।

কুন্ডেরা বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রের ব্রনোতে ১লা এপ্রিল, ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে, যখন পুরো পৃথিবী একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাবার সংগীতবলয়ের মধ্যে বেড়ে উঠলেও রাজনৈতিক আর বৈরী সামাজিক প্রভাব তাঁর শৈশবের সরলরেখায় বেড়ে ওঠাকে প্রতিহত করেছে বারবার। নাৎসিরা চেকোস্লোভাকিয়া দখল করে নিলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালে তাঁকে জার্মান ভাষা শিখতে বাধ্য করা হয়েছিল; কিন্তু প্রতিবাদ হিসেবে তিনি গোপনে রুশ ভাষাও অধ্যয়ন করেছিলেন।

তাঁর পিতা ছিলেন একজন প্রখ্যাত পিয়ানোবাদক এবং সংগীতানুরাগী মানুষ। বাবার সান্নিধ্যেই পিয়ানোর রিডে সুর তুলেছিলেন সেই ছেলেবেলায়। পিয়ানোর সুরের সঙ্গে সঙ্গে কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে প্রথম সাহিত্যের পথে পা রাখা। তারপর কিছু বিরতি। লেখালেখির জীবনে পুনরায় ফিরে আসার আগে অর্থাৎ ১৯৫২ সালে প্রাগের ফিল্ম অ্যাকাডেমিতে বিশ্বসাহিত্যের প্রভাষক হিসেবে কাজ করেন।

১৯৫৫ সালে ‘দ্য লাস্ট মে’সহ একাধিক কবিতা এবং নাটক প্রকাশের মধ্য দিয়ে কুন্ডেরার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৫ সালে দেশত্যাগ করে তিনি ফ্রান্সে পাড়ি জমান। চেক নাগরিকত্ব হারিয়ে ১৯৮১ সালে ফ্রান্সের নাগরিকত্ব লাভ করেন। ১৯৮৪ সালে দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিইং প্রকাশিত হওয়ার পরপরই মিলান কুন্ডেরা আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। এই আখ্যানটি প্রেমের গল্পের পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং মানবীয় অস্তিত্বের প্যারাডক্সের ওপর নির্মিত একটি নান্দনিক অনুসন্ধানের সমন্বয়। আখ্যান বলার কারণ এই যে, এর মধ্যে রয়েছে টমাস, টেরেজা, ফ্রান্ৎস, সাবিনাদের একটা দীর্ঘ গল্প। ফ্রেডরিখ নিটশের ‘শাশ্বত প্রত্যাবর্তন’ থেকে পাওয়া ধারণা কুন্ডেরাকে এই উপন্যাস লিখতে উৎসাহ দিয়েছে। ১৯৮৮ সালে এই উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে ফিলিপ কাফম্যান একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।

এই উপন্যাসটি সম্পর্কে কুন্ডেরার নিজের ধারণা অন্যরকম। তিনি পাঠকের কাছে অনেক প্রশ্ন রেখে যান এবং পাঠকই এর উত্তর খুঁজে নেন। তিনি এরকম বলেন যে, একটি উপন্যাস আসলে কোনো কিছুকে প্রমাণ করে না। এ উপন্যাস পাঠককে অনুসন্ধানের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে; কিন্তু উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর শেষমেশ পাঠককেই খুঁজে বের করতে হয়। লেখক জানেন না তাঁর সৃষ্টি করা চরিত্ররা সঠিক কি না! একজন ঔপন্যাসিকের কাজ গল্প উদ্ভাবন করার পাশাপাশি পাঠককে গল্পের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া।

ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে উপন্যাসের ভূমিকা সম্পর্কে কুন্ডেরা বলেন, ‘কোনো কিছুর অস্তিত্বের ওপর যে গভীর চিন্তন দেখা যায় তা কাল্পনিক চরিত্রগুলির মাধ্যমে আসা।’ ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে উপন্যাসের গুরুত্ব অপরিমেয় এজন্য যে, এখানকার পাঠকরা উপন্যাস ছাড়া সাহিত্যের অন্য শাখায় খুব বেশি একটা আনন্দ পান না। উপন্যাসের আত্মপ্রকাশের পর থেকে তাঁরা উপন্যাসই পড়ে আসছেন। প্রেমের মধ্যে যে অ্যাডভেঞ্চার রয়েছে তাকে ইউরোপীয় প্রেমের অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। এখন হয়তো সময় বদলেছে, আবিষ্কারের পন্থা পরিবর্তিত হয়েছে। তবু কুন্ডেরা সেই অ্যাডভেঞ্চারের ভেতরে থেকেই লিখেছেন। তিনি বলেন, দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিইং সেই উপন্যাস যা আমাদের এই দুঃসাহসিক প্রেমকে প্রভাবিত করেছে।

কুন্ডেরাকে পড়তে গেলে ফ্রান্ৎস কাফকার কথা চলে আসে অনায়াসে। শুধু কাফকা নন আরো কিছু ঔপন্যাসিকের নাম কুন্ডেরা উল্লেখ করেছেন, যাঁদের মধ্যে ব্রোচ, মুসিল, গোমব্রোভিজ অন্যতম। তিনি তাঁদের ‘ইউরোপের মহান সাহিত্যিকের দল’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

কাফকা মারা যাওয়ার মাত্র পাঁচ বছর পর মিলান কুন্ডেরা জন্মগ্রহণ করেন। অর্থাৎ একজনের প্রস্থান, অন্যজনের আবির্ভাব। কাফকার আদর্শিক চিন্তা-চেতনার কাছে বারবার যেমন ধরা পড়েছে মানসিক আর শারীরিক ভাবে অত্যাচারকারী ক্ষমতাধর মানুষের কথা, ঠিক একইভাবে কুন্ডেরার লেখার মধ্যে রয়েছে কাল্পনিক চরিত্রকে দাঁড় করিয়ে সমাজকে চিনিয়ে দেওয়া, অত্যাচার আর অনাসৃষ্টি কীভাবে রাজনীতির নামে চেক-সংস্কৃতিকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে – সেসব বৃত্তান্ত। 

চল্লিশ বছর পর হারানো নাগরিকত্ব ফিরে পেয়ে কুন্ডেরা ফ্রান্সে নিযুক্ত চেক প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রদূতকে ধন্যবাদ জানান। নির্বাসনের দীর্ঘকাল কুন্ডেরা কাটিয়েছেন প্যারিসের মাটিতে আর এজন্যই হয়তো জীবনকে আলাদাভাবে চিনেছেন। তাই তিনি বলেছেন, Ôthe novel has no place|Õ সমস্ত লোকচক্ষুর আলোছায়াকে ফাঁকি দিয়ে অন্তরালে বসে লিখে গেছেন অসংখ্য মূল্যবান লেখা। বাস্তবতার নিরিখে তিনি দেখিয়েছেন, রাজনৈতিক স্রোতের বিপরীতে গিয়ে কোনো সমালোচনা করলে তা সুখকর হয় না। দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিইং-এ তার প্রমাণ মেলে। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সার্জন টমাস, কমিউনিস্ট লিডারশিপের সমালোচনা করে তোপের মুখে পড়ে যান এবং শেষমেশ জীবিকার জন্য জানালা পরিষ্কার করার কাজ নিতে হয় তাঁকে।

ব্যক্তিজীবনে কুন্ডেরা যে অপদস্থ ও অপমানিত হয়েছিলেন, সেসব কারো অজানা নয়। কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হওয়া, উপন্যাসে যৌনতার জন্য অভিযুক্ত হওয়া, নির্বাসিত হয়ে প্যারিসে আশ্রয় গ্রহণ – এই সবকিছু কুন্ডেরাকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। কুন্ডেরা তাঁর উপন্যাসের ক্ষেত্রে বলতে চেয়েছেন, ÔA novel does not assert anything; a novel searches and poses questions|Õ অর্থাৎ একটি উপন্যাস কোনো কিছু প্রমাণ করে না; অনুসন্ধান করে এবং প্রশ্ন তুলে ধরে। ঔপন্যাসিক হিসেবে কুন্ডেরার এই ভাবনা থেকেই দ্য জোক, ইম্মরটালিটি, স্লোনেস, আইডেনটিটি-এর মতো উপন্যাসের সৃষ্টি হয়েছে।

দ্য বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং তাঁর দ্বিতীয় বহুল আলোচিত বই। পাঠকের কাছে উপন্যাস হিসেবে আখ্যায়িত হলেও এটা আসলে সাতটা গল্পের একটা সিকোয়েন্স, অর্থাৎ ক্রম। কোলাহলভরা জীবনের গণ্ডি পার করে তিনি নির্লিপ্ততার মধ্য থেকে প্রতিবাদ করেছেন। উচ্চকণ্ঠ হয়েছেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে। প্রতিরোধ যখন সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায় তখন diversity of though-এর জানালা খুলে যায়। বাচনভঙ্গির তীক্ষ্ণতা এবং রসাত্মক ভাষাবোধ তাঁর সাহিত্যের ভাষাকে আরো সজীব করে।

নির্বাসনের পর প্রতিরোধ-প্রতিবাদের মুখোমুখি তিনি হননি, বরং লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন দার্শনিক অনেক অনুভব। তিনি বলেছেন, ‘স্টালিনবাদী সন্ত্রাসের সময় আমি হাস্যরসের মূল্য শিখেছি … হাস্যরসের অনুভূতিটা ছিল বিশ্বস্ত ইশারাকে নতুন করে চেনার। তখন থেকেই আমি এমন একটি বিশ্ব দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি, যা তার রসবোধ হারিয়ে ফেলছে।’ এই উপলব্ধি-বোধ-চেতনাকে কাজে লাগিয়েছেন, নিজেকে ভেঙেছেন এবং সাহসী করে তুলেছেন। কখনো হতাশাও তাঁর প্রাণে বাসা বেঁধেছে – তাকে হয়তো হতাশা বলা যায় না বরং দীর্ঘশ্বাস বলাই ভালো। তিনি দ্য ফেস্টিভাল অব ইনসিগনিফিকেন্স-এ লিখেছেন, ‘আমরা একটা দীর্ঘ সময় ধরে জানতে পারছি যে, পৃথিবীর এই চরম পরিস্থিতি থেকে না ওভারটার্ন করা সম্ভব, না নতুন করে রূপ দেওয়া সম্ভব।’

কুন্ডেরা নিজের কাজকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে নিষেধ করেছেন, যদিও তিনি উপলব্ধি করেছেন প্রাগ ও প্যারিস ইতিহাস এবং মতাদর্শ থেকে ভিন্ন। তিনি প্রভাবিত হয়েছেন নানা ভাবে – কখনো রাজনৈতিকভাবে, কখনো প্রগতিশীল লেখকদের দ্বারা।

মিলান কুন্ডেরা সমসাময়িকতার শুধু নন, তিনি ইতিহাসের পাতায় অবধারিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। ৎ

* দ্রষ্টব্য : কালি ও কলম আশ্বিন-কার্তিক ১৪৩০/ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত এই প্রবন্ধটিতে কিছু মুদ্রণবিভ্রাট ঘটার কারণে পাঠকের পক্ষে লেখাটি অনুসরণে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় আমরা দুঃখিত। সঠিক বিন্যাসে লেখাটি আবার পত্রস্থ করা হলো।