কবিতার বয়ানে ইতিহাসের চিত্র

মিনার মনসুরের কবিতার বই ব্রাসেলসের সন্ধ্যাটি ছিল মনোরম বেরিয়েছে ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এ। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের হতভাগ্য দুই নারীর নাম – যাঁরা ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টে হারিয়েছিলেন তাঁদের পিতামাতা, ভাইবোনসহ পুরো পরিবার, বাংলাদেশ ডুবে গিয়েছিল এক নারকীয় অন্ধকারের অতলে। সেদিন তাঁরা ছিলেন ব্রাসেলসের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাসভবনে। সেখানেই পেয়েছিলেন সেই ভয়াবহ ঘটনাটির  প্রথম খবর, তবে সুনিশ্চিত খবরটি সেদিনই তাঁরা জানতে পারেননি, তার জন্য পেরুতে হয়েছে অনেক দুঃসহ মুহূর্ত। ব্রাসেলসের সেই বাড়িতে, যেখানে তাঁরা আগের দিনই পেয়েছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কন্যার সম্মানে উষ্ণ স্বাগত সংবর্ধনা, সেদিনের সন্ধ্যাটিও কাটিয়েছিলেন তাঁরা রাষ্ট্রদূতের কন্যাদের সঙ্গে উচ্ছল হাসি-আনন্দে, পরদিন কীভাবে তাঁরা অনাহূত হয়ে যান, তারপর কী দুঃসহ উৎকণ্ঠায় চলে সময়যাপন, একটু নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে চলার পালা – এই ইতিহাসের সূত্র ধরে ‘ব্রাসেলসের সন্ধ্যা’ শব্দযুগল নিয়ে আসে পুরো একটি দেশের ক্রান্তিকালের ছবি, একটি স্বাধীন জাতির রূপকারের হত্যা এবং যাবতীয় শুভচেতনার বিনাশকালের আর্তনাদ।

এ-বইয়ের এক-একটি কবিতা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নামকরণের বাক্যটির ছবি ক্রমাগত রক্তের মতো প্রগাঢ় আর অগ্নিশিখার মতো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ‘ব্রাসেলসের মনোরম সন্ধ্যা’ তখন আর প্রকৃত অর্থে মনোরম, মৃদু হাস্যধ্বনির মতো কোমল উন্মুখ আর ছায়াঘন আলোর ভেতরে ফুটে-ওঠা কোনো সন্ধ্যার রূপকল্প জাগিয়ে তোলে না।

মিনার মনসুর আধুনিক বাংলা কবিতাভুবনে এক স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর।  দেশপ্রেম তাঁর কাব্যের মৌলিক প্রেরণা। সময় তাঁর কবিতার আত্মা। ইতিহাস-ঐতিহ্য, কাব্যসাহিত্য, মানুষ, জনপদ, ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, অতীত-বর্তমানের মধ্যে বলয়িত মানবজীবন, জীবনের গভীর অসুখ, সব কিছু নিয়ে তিনি তাঁর কবিতার শরীর গড়েন। 

ব্রাসেলেসের সন্ধ্যাটি ছিল মনোরম প্রকৃত অর্থে একটি ভিন্নধারার কাব্যগ্রন্থ। এই স্বাতন্ত্র্যের কারণ শুধু কবিতার বিষয় নয়, শৈলীও। দেশ, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, ১৫ই আগস্ট, বিনষ্ট চেতনা, অসুস্থ রাজনীতি, যুদ্ধ-সন্ত্রাস ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এ পর্যন্ত বহু কবিতা রচিত হয়েছে। মিনার মনসুরের কবিতাতেও এই বিষয়গুলি এসেছে। তিনি দেশকাল ও সময় সচেতন কবি। কিন্তু কবিতার নির্মাণশৈলী ও বক্তব্য উপস্থাপনে তিনি এক ভিন্ন ঘরানার কারিগর। তাই চেনা বিষয়ের ‘অন্তস্তলের খবর’ নিয়ে তিনি কবিতা নির্মাণ করেছেন ভিন্নভাবে।

বইটিতে রয়েছে গল্পের মতো গদ্যাকারে সাজানো কবিতা। আয়তাকার পৃষ্ঠায় কবিতাগুলি গদ্যের মতো অনুচ্ছেদে ভাগ হয়ে গল্প বয়ান করে গেছে। একে যদি কবি লাইন ভেঙে গতানুগতিক কবিতার অবয়ব দিতেন, তাহলে এ-বইয়ের আকার হতো এর তিনগুণ। কবি তা করেননি। কবিতাকে গদ্যের নদীতে বইয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সেখানে আছে আশ্চর্য পরিমিত ছন্দ। সহজ, খুব কাছের, ব্যবহৃত, চেনা শব্দের যোজনায় একের পর এক এঁকে গেছেন নানা ছবি। সেসব ছবি বলে গেছে এক-একটি অন্তর্গত দুঃখ-বেদনা, ক্ষোভ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, দ্রোহ, প্রেম-ভালোবাসা আর মর্মছেঁড়া অশ্রুমোড়া একটি দেশের কাহিনি। তবে

প্রথাগত কাব্য অবয়বেও আছে কিছু কবিতা। সেসব কবিতায় ছন্দ আর পর্ববিন্যাসে আছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ফলে সবকিছু মিলিয়ে এ-বই শিল্পস্বাতন্ত্র্যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ একটি কাব্যগ্রন্থ। 

মূলত ২০১৯ থেকে ২০২২-এর আগস্ট পর্যন্ত সময়সীমায় লেখা ৪৫টি কবিতা দিয়ে সাজানো হয়েছে বইটি। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বিশেষ সময় এবং সারাবিশে^র জন্য একটি ক্রান্তিকাল। ২০২০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত করোনা মহামারি সমগ্র বিশ^কে তোলপাড় করে দিয়েছে। জীবনকে করে দিয়েছিল স্থবির, নিশ্চল। প্রতি মুহূর্তে কোভিড-১৯ ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ভয়, মৃত্যু-আতঙ্ক, পাশাপাশি ব্যাধির চিকিৎসা, প্রতিষেধক ইত্যাদির সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কের ক্ষমতাধর দেশের কূটনীতি, মানুষের লোভ-দুর্নীতি ইত্যাদি নখদন্ত বের করে পৃথিবীকে আঁচড়ে-কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে এই দুটি বছর ছিল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর কারণে স্মরণীয় কাল। এ-সময়ে নানা কর্মসূচি আয়োজন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, ১৫ই আগস্ট আমাদের মনে নতুন দর্শনের অভ্যুদয় ঘটিয়েছে। একদিকে স্বাধীনতার সুউচ্চ পতাকা এবং তার চেয়ে উচ্চে মাথা তুলে হিমালয়কে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু। আরেকদিকে আছে জাতির পতাকা খামচে-ধরা শকুনের দল, জামায়াত, রাজাকার-আলবদরের বংশানুক্রমিক বর্ণচোরা ঘাতকের দল। দেশকে যারা দানবের মতো কুড়মুড় করে চিবিয়ে খায়, বন খায়, জমি খায়। নদী, পুকুর, প্রত্নস্থাপত্য, ব্যাংক, হাসপাতাল সব খেয়ে যারা নিজেদের আখের গুছিয়েছে – এতদিনে সেসব শক্তির উত্থান ঘটেছে পর্বতপ্রতিম। মিনার মনসুর তাঁর কবিতায় এসব প্রসঙ্গই এনেছেন। গল্পের অবয়বে কবিতা রচিত হওয়াতে একই কবিতায় দেশকাল, বিশ্ব-রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে অনেক বেশি শব্দসংকেত স্থান পেয়েছে। করোনা বা কোভিড শব্দ প্রায় উচ্চারণ না করে তিনি সেই সময়কে চিত্রিত করেছেন। আছে বাংলাদেশের অন্যতম অর্জন, আত্মনির্ভরতার প্রতীক পদ্মাসেতুর কথা। ‘সময়’ তাঁর কবিতার কলম। সমকাল তাঁর বিষয়। অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাণ কাব্যসাহিত্য, লোকপুরাণ, মরমি সাধক-গায়ক, বাংলা সংস্কৃতি, বাংলার মাঠঘাট, শস্যক্ষেত, আবহমান প্রকৃতি তাঁর কাব্যের অক্সিজেন। বিশ্ব-ইতিহাস, বর্তমান বিশ্বের যুদ্ধবিগ্রহ, ধর্ম-সন্ত্রাস, অতীতের ইতিহাস সব নিয়ে তিনি দিগন্তবিস্তৃত দৃষ্টি বিছিয়ে দিয়েছেন কবিতায়। যেখানে যা দরকার অবলীলায় তুলে এনেছেন, বসিয়ে দিয়েছেন যথাস্থানে। এক-একটা তুলনা, উপমা, রূপক মাঝে মাঝে তুমুল নাড়া দিয়ে যায়।

‘আমাজনের চিতাভস্ম এনে আমরা একদিন ঠিক ছিটিয়ে দেব বুড়িগঙ্গার অতৃপ্ত নাভিমূলে। কিন্তু কোথায় লুকাবে সেই স্বর্ণমৃগ – যখন শরতের সন্ত্রস্ত মেঘ আর বিপন্ন কাশবনের দিকে সগর্জনে ধাবমান শত-সহস্র লিঙ্গের বল্লম।’

(‘বৃথাই তুমি রোদন করছো, কবি’)

বাংলা কবিতায় বহু কবি

হিন্দু-মুসলমান ঐতিহ্য, পাশ্চাত্য পুরাণ, লোকজ ঐতিহ্যসহ নানা প্রকার ঐতিহ্য ব্যবহার করেছেন। মিনার মনসুর তাঁদেরই একজন সফল উত্তরসূরি।

কৈলাস দুর্গ, গাণ্ডীব, কুরুক্ষেত্র, কৃষ্ণ, বিশল্যকরণী, ইয়েমেন, ইথিওপিয়া, লালন, বাল্মীকি, রবীন্দ্রনাথ, সোনার তরী, ডন কিহিতো, ইকারুস, সূর্যের অগ্নিরথ, প্রমিথিউস, আমাজন, কারবালা, গোয়ের্নিকা, জালালাবাদ অসংখ্য ঐতিহ্য-ইতিহাস-চরিত্র যুগসাংকেতিক দ্যোতক শব্দ তিনি ব্যবহার করেছেন। নান্দনিক সব শব্দ চয়ন করেছেন। প্রচলিত ঐতিহ্যের সঙ্গে তিনি যোজনা করেছেন আধুনিক বিশ্ব-ঐতিহ্য। সৃষ্টি করেছেন নতুন চিত্রকল্প ও রূপক ঐতিহ্য, যা তাঁর কবিতাকে অভিনব ব্যঞ্জনা দিয়েছে। এক টানে তিনি কুরুক্ষেত্র বা কারবালাকে এনে বসিয়ে দেন মিরপুরের জল্লাদখানায়। একটি ঘোড়া হয়ে ওঠে শুদ্ধ বিবেক মনীষা জীবনের রূপক।

‘তার চোখের গহ্বর থেকে তীব্র বেগে ধেয়ে আসে লাইভ রক্তস্রোত – কুরুক্ষেত্রের, কারবালার, গোয়েরনিকার, মিরপুর জল্লাদখানার। এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পোষা হনুমানের লেজের আগুনে পুড়তে থাকে ক্রাইস্টচার্চ, লঙ্কা …।’ (‘আমি হন্যে হয়ে তার ঘোড়াটিকে খুঁজি’)

এই ঘোড়ার রূপক তাঁর কবিতায় বারবার এসেছে। বিরহে-বিপন্নতায়-সংকটে, প্রেমসম্পন্নতা আর শুশ্রƒষার বার্তা নিয়ে কবির চোখে স্বপ্নের অঞ্জন বুলিয়ে গেছে। তখন তিনি অঙ্গারের মতো দগদগে শব্দের পাশে ফুটিয়ে তোলেন শিউলির মতো করুণ কোমল শব্দস্বরূপতা।

‘মুশকিল হলো তোমার রহস্যময় সাদা শাড়ি। দশটি আঙুলের অলৌকিক সম্মোহন – যারা বাউণ্ডুলে মেঘের রুক্ষ চুলে শিশিরের আলপনা আঁকে আর ধামরাইয়ের ইটভাটায় পুড়তে থাকা ভাদ্রের দগ্ধ শরীরে ছিটিয়ে দেয় গঙ্গাজল। কোন কৈলাস থেকে তুমি আসো সে কেবল তুমিই জানো। তুমি ছুঁয়ে দাও বলে বিশল্যকরণীর মতো ঘোড়াটির বিক্ষত শরীর জুড়ে শিউলির শুশ্রƒষা ঝরে পড়ে।’ (‘মুশকিল হলো তোমার রহস্যময় সাদা শাড়ি’)

বিক্ষত সময় কবিকে ক্ষুব্ধ করে, আর্ত-পীড়িত করে। কখনো বিপুল বেদনা ও বিস্ময় নিয়ে অসহায় চোখে তাকিয়ে দেখতে হয় অজস্র ক্ষরণ আর পতন। দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি সব ক্ষেত্রে শিক্ষা-সংস্কৃতির অবক্ষয়, ধর্মব্যবসা, স্বার্থপর নেতৃত্ব, অর্থলোভী বেনিয়া শক্তির উত্থান – এসব যেন বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা-সংগ্রাম করে ৩০ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া দেশের ওপর দিয়ে একটি কাভার্ড ভ্যানের মতো সবকিছু দুমড়ে-মুচড়ে চলে যাচ্ছে। এই ভ্যানের মধ্যে লুক্কায়িত লোভের অস্ত্র, স্বার্থের গোলাবারুদ, ঘুষের টাকা, দুর্নীতির মালকড়ি।

‘সবুজ শাড়ি পরিহিতা যে-নারী খররৌদ্রে বটমূলে তাঁর আশ্চর্য আঁচলখানি বিছিয়ে তোমাকে আগলে রেখেছেন সব বালামুছিবত থেকে, তিনি এখন পাথরে মাথা ঠুকছেন। কেননা কাভার্ডভ্যানটি এখন তাঁর দিকেই ধেয়ে যাচ্ছে।’ (‘কেননা কাভার্ডভ্যানটি এখন তাঁর দিকেই ধেয়ে যাচ্ছে’)

মিনার মনসুরের কবিতায়ও রবীন্দ্রনাথ এসেছেন বারবার।

শুদ্ধতায়-সম্পন্নতায়, হতাশার আশার আভাস সৃষ্টিতেও রবীন্দ্রনাথ এসেছেন সোনার তরণি বেয়ে।

‘আমরা কে যে কার জন্য অপেক্ষমাণ দুজনের কেউই তা জানি না। ভারা ভারা সোনার ধান কূলে পড়ে আছে, অথচ যাদের এখন যাওয়ার কথা নয় তারাই দেখি একে একে লাফিয়ে পড়ছে সোনার তরীতে।’ (‘বাতাসে আকাশ ভেঙে পড়ার শব্দ’)

নামকবিতাটি তিনি রেখেছেন বইয়ের প্রায় মাঝামাঝি, ২৯ নম্বরে একে স্থান দিয়েছেন। ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টে বাংলাদেশের ইতিহাসে যে-কালো অধ্যায় রচিত হয়েছিল, তার অন্তরালের সব কথা, সব চক্রান্ত ও ঘটনা হয়তো এখনো রয়ে গেছে রহস্যের আড়ালে। তবে মহাবিভীষিকাময় সে-ঘটনার পটিয়ান হিসেবে যারা ইতিহাসের আলোর সামনে এসেছে তার আড়ালেও রয়েছে ছায়ানাট্যের আরো নটনটি। ব্রাসেলসের রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে সেই অভিশপ্ত দিনের সকালটিতে সর্বহারা নিঃস্ব দুই বোন দেখেছিলেন কী করে চেনা মানুষের চেহারা মুহূর্তেই পাল্টে যায়। রাষ্ট্রদূতের পদলোলুপ এক নাগরিক চাকরি বাঁচানোর জন্য কেমন করে দুই বোনকে দ্রুত নিজের বাসা থেকে বিদায় করে দেওয়ার জন্য অস্থির হয়েছিলেন। কেমন করে নিজেকে উচ্চাভিলাষী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির অনুগত করে তুলেছিলেন – এক অসাধারণ বিক্ষুব্ধ শ্লেষের মধ্য দিয়ে তিনি চিত্রিত করেছেন সে-দৃশ্য। কবিতাটির প্রথম স্তবক –

‘ব্রাসেলসের সন্ধ্যাটি ছিল মনোরম। নিখুঁত। মান্যবর রাষ্ট্রদূত মহোদয় কবিতার মতোই সযত্নে নির্মাণ করেছিলেন সেই সন্ধ্যাটিকে। কেননা কিঞ্চিৎ কবিখ্যাতিও ছিল তাঁর। দুর্লভ এক ফুলদানির মতোই নজর কাড়ছিল তাঁর ডিম্বাকৃতির কুসুমকোমল অবয়ব। সেখানে খেলা করছিল ভক্তি, আনুগত্য, পেশাদারিত্ব, আর পলাশীর প্রান্তরের বিচিত্র সব আলো-অন্ধকার।’ (‘ব্রাসেলেসের সন্ধ্যাটি ছিল মনোরম’)

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বা ১৫ই আগস্টের সেই ভয়াবহ ঘটনা নিয়ে এ-গ্রন্থে একাধিক কবিতা আছে। তবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এ-বইয়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা হলো – ‘তুমিই তো বয়ে যাও, পিতা’। বঙ্গবন্ধু কেবল একটি নাম নন, নন একটি ইতিহাস বা বিশে^র একজন মহান নেতা মাত্র, তিনি প্রবল একটি প্রাণপ্রবাহ। সে-প্রবাহ যেমন জাতির ধমনীতে রক্তের জোয়ার আনে, তেমনি চেতনায় আনে শক্তির তুরীয় গতি। বাংলার প্রকৃতিতে যা কিছু প্রবহমান, যত নদনদী-সমুদ্র-পাথার, দক্ষিণের অরণ্যের যত প্রবাহিত শাখা-প্রশাখা, ফসলের মাঠের যত বীজের প্রবাহ, সবকিছুতে তিনি বয়ে চলেছেন। তাঁর বিনাশ নেই। কী অপরূপ চিত্রকল্পে তিনি এঁকেছেন বঙ্গবন্ধুর এই অবিনাশী অস্তিত্বের ছবি।

এত জল কোথা থেকে আসে?

কোথা থেকে আসে এত জল?

গর্জে ওঠে বন্দুকের নল

গর্জে ওঠে বন্দুকের নল

বল ক্ষুদিরাম বল, কোথা থেকে আসে এত জল?

গর্জে ওঠে বন্দুকের নল

লক্ষ্য তার শাশ্বত বাংলার অশেষ ঝরনাতলা।

গর্জমান বন্দুকের মুখে বুক পেতে দেয় বঙ্গোপসাগর

বুক পেতে দেয় তেরোশত নদনদী

বুক পেতে দেয় বীর ব্যাঘ্রমাতা সুন্দরীর বন

বুক পেতে দেয় জালালাবাদের অজেয় পাহাড়

বুক পেতে দেয় পাহাড়পুরের ঐ বৌদ্ধ বিহার

বুক পেতে দেয় ষাট গম্বুজের মসজিদ

বুক পেতে দেয় আদিনাথের মন্দির।

(‘তুমিই তো বয়ে যাও, পিতা’)

আবার সমিল মুক্তক মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা কবিতা ‘তুমি জেগে আছো তাই’ এক চিন্ময় সংগীতধ্বনির মতো।

শিয়রে আমার তুমি জেগে আছো তাই

আমি হেঁটে যাই

পিছে পড়ে থাকে হাজার বছর – ধূলি, শুধু ধূলি

পিছে পড়ে থাকে কৃষ্ণবিবর – খুলি, শুধু খুলি!

পিছে পড়ে থাকে মৃত অজগর – গাঙুড়ের খল জল

পিছে পড়ে থাকে মনসার ক্রোধ – ভাঙা শৃঙ্খল!

শিয়রে আমার তুমি জেগে আছো তাই

আমি হেঁটে যাই

      পৃথিবীর পথে

         চড়ি স্বপ্নের রথে

উড়াই পতাকা জয় বাংলার …

গ্রন্থের শেষ পাঁচ-ছয়টি কবিতা প্রকৃতপক্ষে গল্পকাব্য। সেখানে আছে আখ্যান। চরিত্রেরা আসে। আসে ইতিহাস, দর্শন, জীবনের গভীরতম বোধ।