আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্পে চেতনাপ্রবাহরীতি

তত্ত্বগত দিক থেকে দেখলে বলা যায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্পের বুনটে নানা রীতি-পদ্ধতির এক অপূর্ব সংশ্লেষ ঘটেছে। গল্পের গঠনশৈলীতে কেবল নয়, এটা ঘটেছে বিষয়-ভাবনার নানা স্রোতের সম্মিলনীতেও। তাঁর উপন্যাসও এই বক্তব্যের ব্যতিক্রম নয়। ইলিয়াস প্রবলভাবে সমাজ-সচেতন লেখক। এমন কিছু গল্প তাঁর আছে যেখানে ব্যক্তিচৈতন্যের অন্তর্গূঢ় ভাবনা প্রাধান্য পেয়েছে, সমাজ তথা রাষ্ট্রের যেখানে প্রত্যক্ষতা নেই, সেখানেও ইলিয়াস সুকৌশলে ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র শাখা-কাহিনির মাধ্যমে সমাজের কোনো গুরুত্বপূর্ণ চালচিত্র ফুটিয়ে তোলেন। এসব গল্পে প্রাধান্য পায় ব্যক্তির স্বগত ভাষণ ও আত্মভাবনার বয়ান। সেই বয়ানে উঠে আসে পরাবাস্তব পরিমণ্ডল। বাস্তব ও স্বপ্নাচ্ছন্নতার সেখানে অনবরত স্থানান্তর ঘটে। মনঃবিশ্লেষণ পায় গভীরতা। ইলিয়াসের শিল্পবোধ আর শিল্পরীতির নৈপুণ্যে এই সবকিছু সংশ্লেষিত হয়। কিন্তু তা কোনো জটিলতা সৃষ্টি করে না। লেখকের স্বচ্ছন্দ ও অনন্য কথনভঙ্গি গল্পগুলিকে সহজে পাঠকের হৃদয়বেদ্য করে তোলে।

জাগ্রত অবস্থায় মানুষের চিন্তা-চেতনা সদা প্রবহমান। এমনকি ঘুমের মধ্যে যখন সে স্বপ্ন দেখে তখনো মনের একধরনের ক্রিয়াশীলতা ঘটে থাকে। তবে তার চরিত্র আলাদা। সেজন্য স্বপ্নে অলৌকিতা, উদ্ভটত্ব, অসামঞ্জস্য ইত্যাকার ব্যাপার মিলেমিশে জট পাকিয়ে যায়। কিন্তু জাগ্রত অবস্থায় সচেতনভাবে যখন সে চিন্তা করে তখনো কি তা সুসম্বন্ধভাবে এগোয়? সত্যিই মানুষের সমস্ত ভাবনা অখণ্ড একটি প্রবাহে আসেও না, অগ্রসরও হয় না। কবি বা লেখক সেই অসংলগ্ন ভাবনাকে পরিকল্পিতভাবে যুক্তিশৃঙ্খলা মেনে বিন্যস্ত করেন। কেননা পাঠক ও ভোক্তার সঙ্গে তাঁর রচনার সংযোগ ঘটানোর দায় তাঁকে পালন করতেই হয়।

নানা ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় চৈতন্যে উত্থিত ভাবপ্রবাহের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক তাঁর বিবেচনায় কার্যকর বিভিন্ন কৌশল বা টেকনিক অবলম্বন করে থাকেন। এই কৌশলকে বিশেষ কোনো অভিধায় চিহ্নিত করা চলে কি না সে-ভাবনা তাঁর নয়। কিন্তু সাহিত্যের যাঁরা বিচার করেন তাঁরা লেখকের রচনায় বিশেষ কোনো রীতি-কৌশলের পরিচয় পেলে তাকে একটি অভিধায় শনাক্ত করতে চান। এভাবে চেতনাপ্রবাহ রীতি (Stream of consciousness) নামে রচনার একটি কৌশল চিহ্নিত হয়েছে।

চেতনার প্রবাহ ধারণাটি দর্শন ও মনোবিজ্ঞানে নিয়ে আসেন উইলিয়াম জেমস তাঁর Principles of Psychology গ্রন্থের ÔStream of thoughtÕ অধ্যায়ে। সচেতন অবস্থায় মানুষের অন্তর্গত ভাবনা ও অনুভূতির ধারাবাহিক পরিবর্তন নির্দেশ করতে গিয়ে জেমস এই অভিধাটি ব্যবহার করেন। আর সাহিত্যালোচনায় এটির প্রথম প্রয়োগ করেন মেরি অ্যামেলিয়া সেন্ট ক্লেয়ার ১৯১৮ সালে প্রকাশিত ডরোথি রিচার্ডসনের Pilgrimage উপন্যাসের আলোচনা করতে গিয়ে। এজন্য অবশ্য তাঁকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। স্বয়ং ঔপন্যাসিক stream of consciousness অভিধা তেমন গ্রহণযোগ্য মনে করেননি। কিন্তু তখন থেকেই সাহিত্য, বিশেষত কথাসাহিত্য রচনার একটি বিশেষ কৌশল হিসেবে এটি মান্যতা পেতে থাকে।

বিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে কথাসাহিত্যে পশ্চিমের লেখকদের একটা বিশেষ প্রবণতা লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। সেটা হচ্ছে, চরিত্রের অন্তর্জীবনকে পাঠকের সামনে উন্মুক্তকরণ। বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ধ্বস্ত পারিপার্শ্বিকতায় ওই প্রবণতা আরো বিকশিত হয়।

চেতনামাত্রই যেহেতু ব্যক্তি-সংলগ্ন, সে-কারণে চেতনার প্রবাহধর্মী কথাসাহিত্যে এক বা একাধিক চরিত্রের সামগ্রিক অবস্থাকে তুলে ধরা হয়। খণ্ড খণ্ড ঢেউয়ের মিলিত প্রবাহের মতো চেতনাপ্রবাহও খণ্ড খণ্ড রূপে প্রবাহিত হয়ে থাকে। তা সংগঠিত হতে পারে, আবার অসংগঠিতও হতে পারে; হতে পারে বিচ্ছিন্ন কিংবা আপাত-বিচ্ছিন্ন। এই বিচিত্রধর্মী ভাবনা, অনুভূতি, স্মৃতি, স্বপ্ন, কল্পনার সম্মিলিত প্রবাহকে লেখক সুকৌশলে রূপায়িত করেন। সম্মিলিত এই প্রবাহ প্রায়শ শেকলের মতো পরস্পর যুক্ত থাকে না। ফলে অনভ্যস্ত পাঠকের কাছে সাহিত্যের এই প্রকরণ বিভ্রান্তিমূলক মনে হতে পারে।

শুরুতে বলেছি, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্পের গঠনশৈলীতে বিভিন্ন রীতিপদ্ধতির সংশ্লেষ ঘটেছে। আদ্যন্ত না হলেও তাঁর বেশ কিছু গল্পে চেতনাপ্রবাহ রীতির প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। আমরা বিশেষভাবে ‘দোজখের ওম’ ও ‘কান্না’ গল্প দুটি অবলম্বনে এই বিশেষ সাহিত্য-কৌশলের চরিত্র অনুধাবনের প্রয়াস পাব।

‘দোজখের ওম’ ইলিয়াসের বহু প্রশংসিত ও আলোচিত গল্প। গল্পের স্থানিক পটভূমি পুরনো ঢাকা। অতিবৃদ্ধ পক্ষঘাতগ্রস্ত কামালউদ্দিনকে ঘিরে স্ত্রী-সন্তানাদি ও পারিপার্শ্বিক কিছু ঘটনা নিয়ে গল্পের অবয়ব নির্মিত হয়েছে। কামালউদ্দিন পেশায় ছিল একজন অতি সাধারণ দর্জি। লুঙ্গি, বালিশের অড় ও মশারি সেলাই করে তার জীবন কেটেছে। নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ সে। পক্ষাঘাতে শরীরের ডানদিক অসাড় হয়ে পাঁচ বছরের ওপর সে শয্যাগত। স্ত্রী যদ্দিন বেঁচে ছিল সে-ই দেখাশোনা করত। সাড়ে তিন বছর হলো সে মারা গেছে। এখন দেখাশোনা করে বিধবা মেয়ে খোদেজা আর তার কিশোর ছেলে আবুবকর। আবুবকর নানার পাশের তক্তপোষে ঘুমায়। নানার প্রাকৃতিক কর্মাদি সে-ই সামলায়।

অচল অতিবৃদ্ধ কামালউদ্দিনের এই হচ্ছে বর্তমান। যেহেতু সে জীবিত এবং তার বোধশক্তি সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে যায়নি, সেহেতু বর্তমানের কিছু ঘটনায় তারও যোগ রয়েছে। কিন্তু গল্পে অতীতের ঘটনাবলিই প্রধান। সেই অতীত কামালউদ্দিনের কাছে আসে কখনো স্বপ্নে, কখনো চেতনার আচ্ছন্নতায়, কখনো-বা সচেতনভাবে। কিন্তু ধারাবাহিকতা মেনে সেই অতীতের আগমন ঘটে না। তা আসে বিচ্ছিন্নভাবে। সেইসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা জোড়া দিয়ে দিয়ে পাঠকের চেতনায় সামান্য অসামান্য হয়ে গল্পটি পূর্ণ অবয়ব পায়।

স্বপ্নে কিংবা চেতনার আচ্ছন্নতার মধ্যে, কিন্তু কামালউদ্দিনের কাছে বাস্তবত, রোজ রাতে এ-ঘরে আকবরের মায়ের অর্থাৎ তার স্ত্রীর আগমন ঘটে। আকবর তাদের বড় ছেলের নাম। তো সেই আকবরের মায়ের আজো আসার কথা। কিন্তু আজ যে এসেছে কামালউদ্দিন তাকে চিনতে পারে না। এর বয়স অনেক কম, হাবাগোবা চেহারা, কোলে কাঁথা-জড়ানো একটা বাচ্চা। চিনতে না পেরে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করে। মেয়েটি বলে, ‘পোলায় কান্দে দ্যাহো না? বুইড়া মরদটা খাতির জমাইয়া নিন্দ পাড়ো?’ তারপর মেয়েটা দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।

আকবরের মায়ের আসার সময় হলে কামালউদ্দিনের কেমন যেন ভয় করে। ভয় তার খোঁচা-মারা কথার জন্য।

৬০-৬৫ বছর ধরে সে তা শুনে এসেছে, মরার পরও তার আদল বদলায়নি। স্বামীর এভাবে বেঁচে থাকাতে সে বিদ্রূপ করে বলে, ‘যাইবা না? খালি দুইটা খাওন আর নিন্দের লাইগা তোমার এমুন লালচ ক্যালায়? বুইড়া জইফ মরদ একখান, হাগামোতা ভি ঠিকমতোন করবার পারো না, তয় কিসের টানে পইড়া থাকো, এ্যাঁ?’ কিন্তু কী করবে কামালউদ্দিন? ইচ্ছে করলেই কি সে বউয়ের ডাকে সাড়া দিতে পারে? আল্লাহর ইচ্ছার ওপর একটা ফোঁড় বসানোর ক্ষমতাও কি তার আছে? নিজের ইচ্ছামতো মরা তার মতো নালায়েক বান্দার থাকে না।

ইচ্ছামৃত্যু প্রসঙ্গে কামেল পিরের কথা কামালউদ্দিনের মনে উদিত হয়। অমন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন একজন পিরের মুরিদ ছিল তার বাপজান। বাপের কাছ থেকে সেই পিরের কত ক্ষমতার কথাই শুনেছিল সে। কোথায় যেন ছিল সেই হুজুরের খানকা শরিফ? মনে করতে পারে না কামালউদ্দিন। কিন্তু এটা বেশ স্পষ্ট মনে আছে, স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করার পর বাপজান হুজুরের কবরের পাশে দিনরাত বসে থাকত। বাপের ওপর একটু রাগ হয় তার। মৃত্যুর পর একদিনও কি ছেলেকে দেখতে আসতে পারে না? পিরসায়েব কি এখনো তাকে কব্জা করে রেখেছে? না, বাপজানের দোষ নেই। একদিন তাকে নিতেই এসেছিল, যেদিন সে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু ডাক্তার কী একটা ইনজেকশন দেওয়ায় তার যাওয়া হয়নি। সেও তো অনেকদিন হয়ে গেল। সেই থেকে সে এই দোজখের আগুনে পুড়ছে।

মরার পর প্রথম দিকে এসে আকবরের মা জানালার বাইরে আঙুল দিয়ে ইশারা করে স্বামীকে ডাকত। বাইরে চাপা গলি। রহিমুল্লা সর্দারের ছেলে পুরনো দালান ভেঙে নতুন করে বাড়ি করতে গিয়ে কামালউদ্দিনের অন্তত আড়াই হাত জমি গায়েব করে দিয়েছে। ওদিকে যাবে কী করে? এমনি করে কয়েকদিন চলার পর একদিন কামালউদ্দিন চোখ ঘষে দেখতে পায় রহিমুল্লা সর্দারের বাড়ি মুছে গিয়ে আকবরের মায়ের তর্জনীর মাথায় দুটো-তিনটে করতে করতে গড়ে ওঠে মোহাম্মদপুরের সাতগম্বুজ মসজিদ। তার পাশে নদী। নদীতে কত নৌকা। নৌকায় বুক-চিতানো পাল। কামালউদ্দিন মুগ্ধ : ‘কী সুন্দর সেলাই! একটা কাপড়ের সঙ্গে আরেকটার জোড়া এমনভাবে মিলে গেছে যে মনে হয় প্রত্যেকটি পাল নানা রঙ দিয়ে আঁকা।’ আকবরের মায়ের তাগাদায় কিংবা নিজের মুগ্ধতায় একটা নৌকায় সে সচল বাঁ পা তুলে দেয়। কিন্তু ডান পা তোলার আগেই নৌকা চলতে শুরু করে। সে ডাঙায় পড়ে যায়। তার রগে ও মাংসে টান পড়লে ব্যথায় গোঙাতে থাকে। ভয়ে আবুবকর নানাকে ডাকতে থাকে।  সাড়া না পেয়ে মাকে ডাকে। খোদেজা এসে দেখে, বাবা ঘেমে একেবারে নেয়ে উঠেছে।

পরদিন দুপুরবেলা বাপকে ভাত খাওয়ানোর সময় কথায় কথায় খোদেজা সব জেনে নেয় এবং বাপকে সাবধান করে দেয়, ‘আব্বা, খোয়াবের মইদ্যে মরা মানুষ ডাকলে পরে যাইবা না, কিছুতেই যাইবা না।’ অসুস্থ ও অচল হলে কী হবে, কামালউদ্দিন বোঝে যে, বাপকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে খোদেজারই লাভ। সে না থাকলে আমজাদ কি বোনকে এ-বাড়িতে থাকতে দেবে? যদি দেয়ও তার ম্যাট্রিকফেল বউটা কিছুতেই দেবে না। সাত বছর হলো খোদেজার স্বামী নেই। ভাশুর-দেবর-জায়ের মুখঝামটা সহ্য করতে না পেরে মায়ের কাছে এসে প্যানপ্যান করত। অতিষ্ঠ হয়ে কামালউদ্দিন পাকাপাকিভাবে মেয়েকে নিয়ে আসে। বাপকে দীর্ঘায়ু করার জন্যই যে এত যত্ন আর তদবির সে কি তা বোঝে না?

কামালউদ্দিন এও বোঝে যে, ছেলেমেয়ে বড় হলে কেউ কারো নয়। না হলে বড় ছেলে আকবর কি এমন কাণ্ড করতে পারত? বাপের পেশাটা সে নিয়েছিল। বশিরউদ্দিন মাস্টার টেইলারের সাক্ষাৎ সাগরেদ হাসান মিয়ার দোকানে অনেক চেষ্টায় ছেলেকে ঢোকাতে পেরেছিল। কিন্তু তাতে কী হলো? দুই-তিনটা ছেলের মা ওস্তাদের ধাড়ি বউয়ের পাল্লায় পড়ে বাপ-মা ছাড়ল। বছরখানেক তার কোনো পাত্তাই ছিল না। তারপর ওই বাড়িতে ঘেঁষার চেষ্টা করেছিল। তার মা সাফ জানিয়ে দিয়েছিল, ‘আইলে একলা আইব। খানকি উনকি লইয়া ঘর নাপাক করবার দিমু না!’ অথচ সেই কঠিনহৃদয় মা সাত-আটদিন জ্বরের ঘোরে কেবলই আকবরের কথা বলেছিল। সে-সময়ে শৈশবের আকবর তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। খবর পেয়ে আকবর এসেছিল। কিন্তু মা তাকে চিনতেও পারেনি।

হঠাৎ করে কামালউদ্দিনের মাথায় একটা সুই বিঁধে। এই একটা নতুন ব্যারামে ধরেছে আজকাল। একটু তন্দ্রার মধ্যে গেলেই মনে হয় সেলাই করতে করতে একটু ঝিমুনি এসেছে আর মেশিনের সুই বিঁধে গেছে তার তর্জনীতে। এখনকার সুইটা অবশ্য বিঁধল কপালের মাঝামাঝি। ত্বরিতগতিতে একটা কথা মনে পড়ল : কাঁথায় জড়ানো শিশুকোলে যে-তরুণীটি আজ এসেছিল, সেই শিশুটির মুখ কি অনেকটা আকবরের মতো? কামালউদ্দিন বুঝতে পারে না। ৫৫-৬০ বছর আগেকার শিশুর চেহারা মনে করা তার আধখানা মগজের কাজ নয়। তার এখনকার চেহারাই মাঝে মাঝে ভুলে যায়। সে কি বাপকে দেখতে আসে যে সবসময় তার মুখ-মনে থাকবে! মায়ের মৃত্যুর পর অবশ্য বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে বেশ ঘনঘন আসতে শুরু করেছিল। হয়তো
এ-বাড়িতে থেকে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু একদিন আমজাদের সঙ্গে কথাকাটাকাটি হলো, নাকি দুই বউয়ে মন কষাকষি, আবার সব যোগাযোগ বন্ধ। অবশ্য আকবর ও তার ছেলেমেয়ের কীর্তিকলাপ যে কানে আসেনি তা নয়, কিন্তু সেসব শুনতে খারাপ লাগে।

স্বপ্নে-জাগরণে-আধাজাগরণে কামালউদ্দিনের মনে তার দীর্ঘ জীবনের আরো অনেক স্মৃতি উঁকি দেয়। ছোট ছেলে সোবহান পড়ত জগন্নাথ কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে। কামালউদ্দিন যত্ন করে ছেলেটাকে লেখাপড়া করাতে চেয়েছিল। কিন্তু মিলিটারির জুলুম শুরু হলে মহল্লার কয়েকটি ছেলের সঙ্গে সেই যে বেরিয়ে গেল, আর ফিরল না। মহল্লার কোন ছেলে নাকি বলেছিল কোথায় কোন গ্রামে মিলিটারির গুলিতে সে মারা গেছে। আকবরের মায়ের স্বপ্নের মধ্যে সে নাকি প্রায়ই দেখা দিত। কিন্তু বাপের কাছে সে তো আসে না। অবশ্য একদিন, সেও অনেকদিন হয়ে গেল, আকবরের মায়ের পেছনে ঝাঁকড়া চুলওয়ালা একটা মাথা দেখা গিয়েছিল। চুল থেকে তার অঝোরে পানি ঝরছিল। পরে কামালউদ্দিনের মনে হয়েছিল, চুল থেকে ঝরা তরল জিনিসটা আসলে ছিল রক্ত। সোবহান ছাড়া আর কার মাথা থেকে রক্ত ঝরতে পারে?

নূরুন্নাহার ছিল কামালউদ্দিনের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। মেয়েটি জন্মানোর সময় ওর মা খুব কষ্ট পেয়েছিল, প্রায় যায়-যায় অবস্থা। হানিফের মা ভাবি আর রেণুবালা দাইয়ের চেষ্টায় সে-যাত্রা রক্ষা পায়। এই ভাবি ছিল তাদের দূরসম্পর্কের এক ভাইয়ের স্ত্রী। বিধবা এই নারী খুব সুন্দর করে কথা বলত। ভাবির প্রতি কামালউদ্দিনের কেমন একটা দুর্বলতা ছিল। এমনকি নুরুন্নাহারের জন্মের সময় তার মায়ের যখন কঠিন অবস্থা, তখন খুব অল্পক্ষণের জন্য তার মনে হয়েছিল, স্ত্রী মারা গেলে এই ভাবিকে নিয়ে সে ঘর বাঁধতে পারে। না, না, ঠিক এরকম ভাবে নাই। তা-ই কি হয়, না হওয়া উচিত?

নুরুন্নাহার দেখতে খুব সুন্দর হয়েছিল। হানিফের মা ভাবি বলত, ‘পয়দা হওনের টাইমে ছেমরি তুই বহুত জ্বালাইছস। তবে আমি বউ বানাইয়া খাটাইয়া লমু।’ ভাবি ওকে বউ বলেই ডাকত। একটু বড় হয়ে হানিফ তেজগাঁয় কোন কারখানায় কাজ নিয়ে চলে যায়। কিছুদিন পর মাকেও নিয়ে যায়। সেই থেকে আর যোগাযোগ নেই। হানিফের সঙ্গে বিয়ে হলে মেয়েটা অন্তত বেঁচে থাকতে পারত; কিন্তু কপাল মন্দ। চেহারা-সুরত দেখে এক দোকান কর্মচারীর সঙ্গে নুরুন্নাহারের বিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ছেলেটা যে একটা বদমাশ তা ভাবাও যায়নি। সাত-আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় একা ঘরে গর্ভপাত হয়ে মেয়েটা মারা গেল।

হঠাৎ একদিন আকবরের মৃত্যুর খবর শোনে কামালউদ্দিন। লাশ আনা হয় বাড়িতে। বেলা বারোটার দিকে তাকে বারান্দায় বসিয়ে দিলে ৫৫-৬০ বছরের ছেলের মৃতদেহের মুখে হাত বুলিয়ে সেখানে আট মাসের শিশুর আদল নিয়ে আসে। মুখ থেকে কীসব আওয়াজ বেরোয় বোঝা যায় না। বোঝার কেউ চেষ্টাও করে না। কিন্তু সে জানে, আকবরের মা আশেপাশেই আছে। এবার আকবরকেও হাত করে ফেলল। কিন্তু তার কী দোষ! কী এমন পাপ সে করেছে যে, এই হাবিয়া দোজখে তাকে পুড়তে হচ্ছে! পাপের খতিয়ান কষে সে। আবার পাল্টা যুক্তি উত্থাপন করে বুঝতে চায় সেগুলি সত্যিই পাপ কি না।

আমজাদ যদিও আকবরের স্ত্রীকে বলে দিয়েছে, এ-বাড়িতে তাদের কোনো হিস্যা নেই, তবু ভাইয়ের মৃত্যু-উত্তর ধর্মীয় ও সামাজিক কৃত্যাদি সে বেশ ঘটা করেই পালন করে। বাপকে রেডিমেড পাজামা-পাঞ্জাবি পরিয়ে বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানেই আকবরের মেয়ে পারভীন সম্পত্তির অধিকার সম্পর্কে চাচার মত দাদাকে জানিয়েছে। কামালউদ্দিন ধন্দে পড়ে যায়। আমজাদ যা বলেছে সে তো তারই কথা। আকবরকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার সংকল্প সে-ই তো বহুবার ঘোষণা করেছে। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে কিছু বলা তার সাধ্যে কুলায় না।

দাওয়াত পেয়ে হানিফ ও তার মাও এসেছে। হানিফের মা জানত না যে, কামালউদ্দিন এখনো বেঁচে আছে। তাকে দেখে সে বিস্মিত হয়। এই বিস্ময় ক্রমাগত বাড়ে এবং বিদায় নেওয়ার সময় বলে, ‘তুমি অহন তরি বাঁইচাই আছো?’ এর পরের অংশ গল্প থেকে তুলে দিচ্ছি :

পারভীনের একটি হাত তার সচল হাতের ভেতর নিয়ে কামালউদ্দিন বলে, ‘সিধা হইয়া খাড়া।’ নাতনীকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দেবার জন্য তার হাতে সে একটু ঠেলাও দিলো। যাবার জন্য পা বাড়িয়ে হানিফের মা বলে, ‘খবর দিও। বাঁইচা আছো একটা খবর ভি পাই না।’

‘বাচুম না ক্যালায়?’ কামালউদ্দিনের এই বিড়বিড় ধ্বনি ভালো করে শোনবার জন্য হানিফের মা ভাবী মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালো। দ্যাখে ডান হাতে ধরা লাঠিতে ভর দিয়ে কামালউদ্দিন উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। পারভীন চট করে এগিয়ে না ধরলে সে ঠিক পড়েই যেতো। লাঠি এবং নাতনীর ওপর ভাঙাচোরা শরীরের ভার রেখে ডান দিকের গতর ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে সে রওয়ানা হলো নিজের ঘরের দিকে। ঠোঁট, জিভ ও গলার সচল, অচল ও নিমচল টুকরাগুলো জোড়াতালি দিয়ে কামালউদ্দিন একটি লালা-বলকানো হুঙ্কার ছাড়ে, ‘তর চাচারে কইস, দাদায় অহন তরি বাঁইচা আছে।’

না বললেও চলে যে গল্পের এখানেই শেষ। দোজখের ওমের তাপ-উত্তাপ-জর্জরিত এই প্রাণময়তাই বার্ধক্য ও মৃত্যু উজিয়ে গল্পটিতে ইতিবাচকতা এনে দিয়েছে এবং তা এসেছে চেতনাপ্রবাহের কুশলী ব্যবহারের মধ্য দিয়ে।

জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল গ্রন্থভুক্ত ‘কান্না’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের আরেকটি বিখ্যাত গল্প। বিষয়ভাবনার দিক থেকে গল্পটি যেমন ভিন্ন মেজাজের, তেমনি অভিনব। অমন একটি বিষয় নিয়ে শিক্ষাগত দিক থেকে যে অসাধারণ ছোটগল্প লেখা সম্ভব, গল্প পাঠের আগে তা ভাবাই যায় না। গল্পের মূল চরিত্র মৌলবি আফাজ আলি ঢাকার এক অভিজাত গোরস্তানে বিভিন্ন উপলক্ষে কবর জিয়ারত করে, মুর্দার পক্ষে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করে যে-সামান্য উপার্জন করে, তা-ই দিয়ে নিজের ও সংসারের ব্যয় কায়ক্লেশে নির্বাহ করে। কাহিনিসূত্রে ইলিয়াস গল্পটিতে বাংলাদেশের সামাজিক-আর্থিক-ধর্মীয় পরিমণ্ডলের কিছু চালচিত্র রেখাঙ্কনের মতো অসামান্য দক্ষতায় তুলে ধরেছেন। কিন্তু সেসব আমাদের মূল আলোচ্য নয়। তবে আফাজ আলির চৈতন্যের অন্তর্লীন প্রবাহে সেসব চিত্রের অংশবিশেষ স্বপ্রকাশ হয়ে উঠতে পারে।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ লালসালু উপন্যাসের ‘এলেম-জানা’ লোকদের জীবিকার ধান্দায় বেরিয়ে-পড়ার মতো বরিশালের বাকেরগঞ্জের কোনো এক গ্রামের আফাজ আলি বেরিয়ে পড়ে ঢাকার এই সম্ভ্রান্ত গোরস্তানে থিতু হয়েছে। কবর জিয়ারতে তার পেশাদারি দক্ষতা ও নিষ্ঠার কমতি নেই। এ-ব্যাপারে সে খুবই সচেতন। কেননা, এখানেও রয়েছে প্রতিযোগিতা। হায়দর বখস ও কাল্লুমিঞা তার প্রতিযোগী। কাল্লুমিঞা হায়দর বখসের সহকারী। আফাজ আলির সহকারী শরিফ মৃধা। কাল্লু ও শরিফ দুজনেই গোরস্তানের গোরকোন-কাম-মালি। সহকারী না হলে এখানে চলে না। কেননা ‘পার্টি হাতাবার’ প্রশ্ন রয়েছে। এ-কাজে পিছিয়ে যাওয়া মানেই উপার্জন কম হওয়া।

গল্পের শুরুতে কবর জিয়ারতে ব্যস্ত আফাজ আলি সবুজ সোয়েটার ও সবুজ-হলুদ চেক-কাটা লুঙ্গিপরিহিত লোকটাকে দেখে বিরক্ত হয়। লোকটা কৃষ্ণকাঠির কুদ্দুস হাওলাদারের ছেলে মনু মিঞা। আফাজ আলির ছেলে হাবিবুল্লার ‘২০০০ সাল নাগাদ সবার জন্য শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নারীশিক্ষা বিস্তার’ প্রকল্পে চাকরির জন্য মনু মিঞার মাধ্যমে ঘুষের প্রথম কিস্তি ৫০০০ টাকা দেওয়া হয়েছে। টাকাটা ধার করা হয়েছে মনু মিঞার বাপের কাছ থেকে। এখন দ্বিতীয় কিস্তির টাকার জন্য মনু মিঞা ঢাকা পর্যন্ত ধাওয়া করেছে!

হাবিবুল্লা মাদ্রাসায় পড়ত। কিন্তু দাখিল পাশ করে বাকেরগঞ্জ কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য জিদ ধরে। তার নানা মওলানা আশরাফুদ্দিন উজিরপুরী, সারা অঞ্চলে যাঁর নামডাক, বাধা দিয়ে বলেন, ‘অন্তত আলেম পর্যন্ত পড়ো, আল্লার এলেম বরকত দেয়।’ হাবিবুল্লা রাজি হয়নি। মাদ্রাসা লাইনের ভবিষ্যৎ আছে? তাছাড়া তার মেজো মামা তো বরিশাল পলিটেকনিক কলেজে পড়ে। আফাজ আলি উশখুশ করলেও তার গোপন ইচ্ছা ছেলে কলেজেই পড়ুক। বিএ, এমএ না হোক, আইএ পাশ করেও ছেলের যদি ছোটখাটো চাকরি জোটে তো জীবিত অবস্থায় সে কবরবাস থেকে রেহাই পায়। কিন্তু হলোটা কী? চাকরি তো জোটে না। সেই চাকরির জন্য ঘুষের টাকা জোগাতেই আফাজ আলির কাহিল হাল। তিন বছর কলেজে পড়েই চাকরি করে জাতে উঠতে ছেলে পাগল হয়ে উঠেছে। তা সেই জাতে ওঠার জন্য টাকাটাও তার বাপকে জোগাড় করতে হয় মুর্দাদের জন্য দোয়া-দরুদ পড়ে। আল্লাহর কালামের বরকত না থাকলে তার সংসার চলে?

আফাজ আলির মোনাজাত চলতেই থাকে। প্রায় শেষের দিকে এসে হায়াৎ হোসেন খানের বদলে সে বলে বসে – ‘আল্লা পরওয়ার দিগার, মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহর জন্যে তোমার এতগুলো বান্দা আজ -’; একজন নাম সংশোধন করে দেয়। নাম ভুল করলেও আলিমুল গায়েব আল্লা – যিনি সব জানেন – ঠিকই সংশোধন করে নেবেন – এই বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও আফাজ আলি বিব্রত হয়। কয়েক মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে মোনাজাত অব্যাহত রাখে।

গোরস্তানে সংঘটিত কিছু ঘটনা, হাবিবুল্লার চাকরিকেন্দ্রিক স্মৃতি, মনু মিঞার আগমন – এগুলির যে-কোনো একটি কারণে অথবা সবগুলি কারণের জটপাকানো প্রতিক্রিয়ায় উত্তেজিত আফাজ আলি সারি-সারি কবরের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনু মিঞার সঙ্গে ধাক্কা খায়। রাগের টার্গেট পেয়ে সে প্রায় ধমকের সুরে তার আগমনের কারণ জানতে চায়। মনু মিঞা বলে :

‘চাচা আপনে ঐ গোরের দাফন করিয়া কৈ গেলেন আমি আর দেহি না।’

‘আরে, আমার কি মরণের টাইম আছে? লও, আগে নমাজ পড়িয়া আসি। আজান হইল, লও যাই।’

গোরস্তানের গেটে মসজিদে নামাজ পড়তে যায় আফাজ আলি। নামাজের মধ্যেও তার মনের অন্তঃস্তলে ঢেউয়ের মতো চিন্তার যে-ওঠাপড়া জাগে, অসামান্য দক্ষতায় ইলিয়াস তার বর্ণনা দিয়েছেন :

… ইমাম সায়েবের বুলন্দ গলার ‘আল্লাহ আকবর’ আওয়াজ ছাপিয়ে আফাজ আলির কানে বেজে ওঠে গোরস্তানের গেটে কয়েকটা গাড়ি থামার, গাড়ির দরজা খোলার ও বন্ধ করার মিঠে বোল। এই বোলেই গাড়ির খানদানের ইশারা স্পষ্ট। এইসব গাড়ির সঙ্গে মানানসই কোনো শরিফ ভদ্রলোক দুনিয়া থেকে চিরকালের জন্যে বিদায় নিয়েছে। এখন নিশ্চয় অ্যাডভান্স পার্টি এল, কবরের জায়গা বাছাই করবে, কবর কাটার গোরকোন নিয়োগ করবে। বাদ মগরেব বা বাদ এশা বায়তুল মুকাররমে জানাজার পর লাশ আসবে। এই লাশের দাফন, জিয়ারত, মোনাজাত ধরতে পারলে কিছু কামাই হয়, তাহলে মনু মিঞাকে দিয়ে বাড়িতে কয়েকটা টাকা পাঠানো যায়। হাবিবুল্লার চাকরির কদ্দূর কী হলো কে জানে? আবার কত টাকার ধাক্কা! এখন কাল্লুমিঞা আবার এই নতুন পার্টিকে হাত না করে ফেলে!

নামাজ অন্তে আবার দেখা হলে মনু মিঞা হাবিবুল্লার উদরাময়ের খবর জানায়। আফাজ আলি বিরক্ত হয় – ‘অর দাস্তের সোম্বাদ পৌঁছাইতে তুমি ঢাকা আইছো? বাকেরগঞ্জে সরকার হাসপাতাল বানাইলো কি তোমাগো বায়োস্কোপ দ্যাহাইতে?’ শরিফ মৃধা আফাজ আলিকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে তার ছেলের কঠিন অসুখের কথা জানিয়ে আজই বাড়ি রওনা দিতে অনুরোধ করে। মনু মিঞাও মরিয়া হয়ে বলে যে, গেলে আজই রওনা দিতে হয়। হাবিবুল্লার অবস্থা যা সে দেখে এসেছে -। এর পরের অংশ আমাদের এই আলোচনার স্বার্থে সরাসরি গল্প থেকে তুলে দিলেই ভালো হয়।

সে কী দেখে এসেছে? এই জন্যেই কি একটু আগে ১২৩৪৫ নম্বরে দাফনের পর মোনাজাতে তাকে দিয়ে হাবিবুল্লার নামে আগাম আরজি করে রাখল? – ৭৭৬৯ নম্বরের পাথরের চওড়া ও মসৃণ রেলিঙে আফাজ আলি ধপ করে বসে পড়লে তারই তদারকিতে ও শরিফ মৃধার হাতে লাগানো গোলাপের কাঁটা তার ঘাড়ে খোঁচা মারে। গর্দানটা তার একটু মোটাই, কিন্তু চামড়া সে তুলনায় পুরু নয় বলে ঘাড়টা চিনচিন করে উঠল। এই সঙ্গে অনেক আগেকার শিশু হাবিবুল্লা তার ঘাড়ের ওপর বসে দোল খেতে থাকলে সেখানটা শিরশির করে এবং আরেকটু ওপরে খচখচ করে বেঁধে এখনকার হাবিবুল্লার চাকরির ঘুষ বাবদ হাওলাত-করা ৫০০০ টাকার নোটের কোণাগুলো। গোলাপকাঁটার খোঁচা থেকেই যায়, টাকার চাপে মিলিয়ে যায় শিশু হাবিবুল্লার ছোট পায়ের দুলুনি। টুপির নিচে তার গোটা মুণ্ডু জ্বলে ওঠে দপ করে;

আফাজ আলির মুণ্ডু জ্বলে ওঠার কারণ শবেবরাতের মাত্র ছয়দিন বাকি। ওই পবিত্র রাত্রিতে গোরস্তানকে কেন্দ্র করে এলাহিকাণ্ড ঘটে। এ উপলক্ষে আফাজ আলির কত কাজ! এ সময় আয়টাও ভালোই হয়। এখন কি তার বাড়ি যাওয়ার সময়? তবু না গিয়ে উপায় থাকে না।

ভোরে বরিশাল ঘাটে নেমে প্রথম বাসে বাকেরগঞ্জ পৌঁছেই ইসহাক রিকশাওয়ালার মুখে খবর পাওয়া গেল, গতকাল বিকেলে হাবিবুল্লার দাফন হয়ে গেছে। আফাজ আলি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। দোয়া-দরুদ পড়া দূরের কথা, ‘ইন্নালিল্লা’ বলার কথাও মনে থাকে না। আড়াইবাঁকি ঘাটে খেয়া নৌকায় পায়রা নদী পাড়ি দিতে দিতে ঢেউয়ে-ঢেউয়ে নৌকা দোলে, আর …

আফাজ আলি শুধু পায়রার ঢেউ দেখে। ফাল্গুনের রোদে ঢেউগুলো রোদ পোহায়, এইসব ঢেউয়ের নিচে জলস্রোত ওঠানামা করে জলে-ডোবা মানুষের লাশের ওপর। নিচে কী হলো যে কবরগুলো এভাবে কাঁপে? ওখানে কি গোর-আজাব হচ্ছে? চমকে উঠে আফাজ আলি আস্তাগফেরুল্লা পড়ে এবং গ্রামের ঘাট পর্যন্ত আস্তাগফেরুল্লা পড়াই অব্যাহত রাখে।

মানুষের চেতনার যে-কাঠামো, প্রতিনিয়ত তাতে ভাঙাগড়া চলে। এই ভাঙা-গড়ার ফলে চেতনায় বিভিন্ন ভাবনা-অনুভূতির একত্র সমাবেশ লক্ষ করা যায়। চেতনার অন্তঃশীল প্রবাহকে সাহিত্যিক রূপ দিতে গিয়ে লেখকের বড় দায়বদ্ধতা থাকে চেতনার
গঠন-বৈশিষ্ট্যকে মূর্ত করে তোলা। উদ্ধৃত অংশটিতে নিশ্চেতন বস্তুকে আশ্রয় করে গল্পকার তার সফল প্রয়োগ করেছেন বলে ধারণা করি।

শোকের মাতমের মধ্যে হাবিবুল্লার মায়ের উদরাময়ে আক্রান্ত হওয়া আরো বিপত্তি ঘটায়। কিন্তু শবেবরাতের যে মাত্র আর চারদিন বাকি! এখন উপায়! আফাজ আলির সমস্যাটা তার শ্বশুর বোঝেন। নিজের কাছে রক্ষিত মাদ্রাসা ফান্ড থেকে ১০০০ টাকা জামাইয়ের হাতে দিয়ে পরামর্শ দেন টাকাটা সে বাড়িতে রেখে যাক। এ দিয়ে হাবিবুল্লার মায়ের চিকিৎসা হবে, কয়েক দিন সংসারও চলবে। তবে শবেবরাতের পরপরই টাকাটা যেন পাঠিয়ে দেয়। কেননা টাকাটা মাদ্রাসা ফান্ডের।

নিজের কর্মস্থলে পা দিয়ে আফাজ আলি গভীর তাজিমের সঙ্গে মুর্দাদের সালাম করে। কবরগুলি থেকে নীরব জবাব তার কানে আসে। শবেবরাত উপলক্ষে গোরস্তানের ভেতরে-বাইরে সাজ-সাজ রব পড়ে গেছে। ব্যস্ততা বেড়েছে আফাজ আলির। কিন্তু চৈতন্যের গভীরে হাবিবুল্লার মৃত্যুকেন্দ্রিক ভাবনা-দুর্ভাবনা চলতেই থাকে। আশা ছিল, ছেলে চাকরি পেলে জীবিত অবস্থায় এই কবরবাস থেকে রেহাই পাবে। সে আশা তো ভেঙে গেছেই, এখন ঘুষের জন্য ঋণের ৫০০০ টাকা কীভাবে শোধ হবে তার কোনো উপায় জানা নেই। বিধ্বস্ত ধর্মজীবী এই দরিদ্র পিতার আহাজারি অকালমৃত জনৈক শাহতাব কবিরের কবর জিয়ারতের মোনাজাতের সঙ্গে একাকার হয়ে যায় :

‘… আল্লা, আল্লা রাব্বুল আলামিন, শাহতাব কবিররে তুমি বেহেস্ত নসিব করো আল্লা। কিন্তু, পাক পরওয়ারদিগার, তার বাপটারে কি তোমার নজরে পড়লো না? বাপটা কি তামাম জীবন খালি গোরস্থানে গোরস্থানেই থাকবো?’ এবার শোকার্তদের বেশ কয়েকজনের শরীরের ভেতর লুকিয়ে রাখা শোক ধাক্কা দেয় তাদের গলায় এবং তাদের  অন্তত তিনজনের মোনাজাতে নিয়োজিত হাতের বিন্যাস ভেঙে পড়লে সেইসব হাত নিজেদের মুখে চেপে ধরে তারা ফোঁপায়। প্রায় একই সময়ে আফাজ আলির হাতও ঝুলে পড়ে নিচে এবং উপুড় হয়ে পড়ে যাওয়া ঠেকাতে ঐ হাতজোড়া দিয়ে সে আঁকড়ে ধরে কবরের বেড়ার দুটো খুঁটি। তাতে একটু বল পেয়ে সে বলে, ‘আল্লা, তার নাদান বাপটা কি খালি গোর জিয়ারত করার জন্যেই দুনিয়ায় বাঁচিয়া থাকবো। আল্লা!’ তার ফোঁপানি চড়ে গেছে কান্নায়, আল্লার প্রতি তার নিবেদন এবং আল্লার কাছে তার মোনাজাত চাপা পড়ে তার ভেউভেউ কান্নার নিচে। 

সদ্য পুত্রহারা এক অসহায় পিতার মর্মছেঁড়া এই আর্তকান্না পাঠকের মনকে দ্রবীভূত করে। আফাজ আলির জীবনে ঘটনাবহুলতা নেই, কিন্তু যেটুকু আছে তা প্রবল ঢেউয়ের আকার নিয়ে তার জীবন-নদীর পাড় ভাঙতেই থাকবে।

সাহিত্যিক কৌশল হিসেবে চেতনাপ্রবাহ রীতির ব্যবহার আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের আরো গল্পে পাওয়া যাবে। এখানে তাঁর এই রীতি-প্রকরণের কুশলী ব্যবহার দুটি প্রতিনিধি স্থানীয় গল্প অবলম্বনে খানিকটা বিস্তারিতভাবেই দেখানোর প্রয়াস পাওয়া হয়েছে। এ থেকে চেতনাপ্রবাহ রীতির স্বরূপ অনুধাবন করা যাবে আশা করি।