জল-বন্দনা

এসো এসো হে তৃষ্ণার জল, কলকল্ ছলছল্…

ভেদ করো কঠিনের ক্রূর বক্ষতল

কলকল্ ছলছল্ ॥

                                     – রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের এই গানের বাণীর ভাবার্থ – কঠিনের ক্রূর বক্ষতল ভেদ করার চেষ্টা-না করে বরং জল নিয়ে জলো কথা দিয়েই শুরু করা যাক। আমরা সবাই জানি, পৃথিবীর তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল। বিজ্ঞান বলে, দুটি হাইড্রোজেন ও একটি অক্সিজেনের পরমাণুর রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটলে একটি জলের অণু সৃষ্টি হয়। জল স্বাদ-বর্ণহীন তরল পদার্থ – যে-পাত্রে রাখা যায় সে-পাত্রের আকার ও রং ধারণ করে। জীবনধারণের জন্য জল অপরিহার্য। এজন্যই বলা হয়, জলের অপর নাম জীবন। তবে সেই জলকে অবশ্যই হতে হবে জীবাণু ও ক্ষতিকর রাসায়নিকমুক্ত এবং সুপেয়। এসব নিশ্চয়ই শিশুতোষ জ্ঞানের কথা। যেসব সবজিতে জলের আধিক্য তার মধ্যে চালকুমড়ো এবং লাউ প্রধান। মানুষ লাউ বা চালকুমড়ো নয়, তবু বিজ্ঞানীরা বলেন, মানবদেহে নাকি তিন ভাগই জল। সারবস্তু মাত্র এক-চতুর্থাংশ। পৃথিবীর ভৌগোলিক অবস্থার সঙ্গে মানবদেহের মেলবন্ধনটি বোধকরি এখানে! পৃথিবীর মানচিত্র এবং দেহের ভূগোল এখানে যেন একাকার। জলই জীবন।

শৈশবে প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় আকিকুল স্যারের কাছে প্রায়শই শুনতাম একটি আপ্তবাক্য : ‘জলবৎ তরলং’। ক্লাসে অংকের সমাধান করতে তাঁর কাছে গেলেই তিনি নাকের ডগায় চশমা এঁটে একথাটি বলতেন। তখন না-বুঝলেও এখন বুঝি, জলের তারল্যগুণকে সহজ অর্থে বুঝিয়েছেন। কৈশোরে সুকুমার রায়ের অবাক জলপান নাটকটি মঞ্চায়ন করতে গিয়ে জলের বিচিত্র প্রকাশ পাই একটি চরিত্রের জবানিতে :

কত জল খেলাম – কলের জল, নদীর জল, ঝরণার জল, পুকুরের জল – কিন্তু মামাবাড়ির কুয়োর যে জল -।’…

জলের কথা বলতেই কুয়োর জল, নদীর জল, পুকুরের জল, কলের জল, মামাবাড়ির জল বলে পাঁচরকম ফর্দ শুনিয়ে দিলে…।

বিষ্টির জল, ডাবের জল, নাকের জল, চোখের জল, জিবের জল, হুঁকোর জল, ফটিকজল, রোদে ঘেমে জল, আহ্লাদে গলে জল, গায়ের রক্ত জ-ল, বুঝিয়ে দিলো যেন জ-ল …। 

হাস্যরসের আধার হিসেবে বহুরূপী জলের কথা তো জানা গেল। এবার জলের স্বরূপ জেনে নিই। ‘জল’ শব্দটি তৎসম বা সংস্কৃত এবং পদে বিশেষ্য। সংস্কৃত-চর্চিত বাংলা এমন এক সমৃদ্ধ ভাষা, যে-ভাষায় সমার্থক শব্দ বিপুল। অশোক মুখোপাধ্যায়ের সংসদ সমার্থ শব্দকোষ থেকে জেনে নিই জলের প্রতিশব্দগুলি : বারি, সলিল, নীর, অপ, অম্বু, উদ, উদক, পয়্, অম্ভ, তোয়, পানি, উডু, সরঃ, ইরা, ইলা, পাথ, কর্বূর, সম্বর, তামর, শীতোত্তম, বরুণ, জীবন, প্রাণদ। এসব শব্দের গোটাসাতেক ছাড়া অন্যগুলি বাংলা ভাষায় অচল এবং অভিধানের পাতায় আশ্রিত।

এসব সমার্থক শব্দ ছাড়াও জলের আছে অনেক প্রকারভেদ। বিশেষণ প্রযুক্ত করে এর ভিন্নতা প্রকাশ করা হয়। যেমন – স্বচ্ছ জল, পরিষ্কার জল, নির্মল জল, টলটলে জল, ঘোলা জল, অপরিষ্কার জল, মৃদুজল, ক্ষরজল, গুরুজল, নোনাজল ইত্যাদি। এসব বিশেষায়িত জলে গুণাগুণই প্রকাশ পায়। তবে আটপৌরে বাংলায়, প্রতিদিনের কথোপকথনে সাধারণ পানি এবং জল শব্দই ব্যবহৃত হয়। তবে এই শব্দদুটি উৎসমূল ও ব্যুৎপত্তির বিচারে রক্তসম্পর্কহীন না-হলেও বাঙালির সমাজমনস্তত্ত্বে সাংঘর্ষিক। আমরা শব্দদুটিতে ধর্মীয় তকমা ও সাম্প্রদায়িকতার সিলমোহর এঁটে দিয়েছি। লক্ষণীয় যে, দৈনন্দিন জীবনে হিন্দু সম্প্রদায় ব্যবহার করে ‘জল’ আর মুসলমানরা করে ‘পানি’। যদিও ধর্মভিত্তিক শব্দ আছে কিন্তু ভাষার কোনো ধর্ম নেই। তবু এ-নিয়ে ঔপনিবেশিক পাকিস্তান আমলে বাদানুবাদ কম হয়নি। পাকিস্তানপন্থি সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিসম্পন্ন তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা জলকে সংস্কৃত ও হিন্দুয়ানি শব্দ এবং পানিকে আরবি ও মুসলমানি শব্দ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। যদিও আমরা জানি, দুটোই তৎসম বা সংস্কৃত শব্দ। কবি শামসুর রাহমান তাঁর কবিতায় এক বাক্যে দুটো শব্দকে মোহন মিলনে ব্যবহারের চমৎকারিত্ব দেখিয়েছেন : ‘শহুরে পানির ফোয়ারা শোনাতো তাকে জলকিন্নরীর কতো গান।’ এবার জল ও পানি শব্দের ব্যুৎপত্তির দিকে একটুটু চোখ ফেরাই।

সংস্কৃত √পা ধাতু থেকে পানি শব্দের উৎপত্তি। এই তরল পদার্থটি পেয় বা গলাধঃকরণযোগ্য। এই √পা ধাতুর সঙ্গে বিভিন্ন প্রত্যয় যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ তৈরি হয়। যেমন : √পা + অন = পান, পান + ই = পানি, √পা + অনট = পানীয় (সংস্কৃত), পান + ঈয় = পানীয় (বাংলা)। এর প্রাকৃত রূপ ‘পাণিঅ’ থেকে পাণি, পাণী, পানী, পানি। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে শব্দটি উল্লিখিতভাবে লেখা হয়েছে। তাই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে আছে : ‘যৌবন বাধে পাণির ফোঁটা’ (১৪৫০)। চৈতন্যভাগবতে আছে : ‘আহার পাণি নিদ্রারহিত’ (১৬০০)। ‘সেই ঝারখণ্ডের পানী তুমি খাওয়াইলা’ (কৃষ্ণদাস, ১৫৮০)। ‘জোয়ারের পানী নারীর যৌবন গেলে না ফিরিবে আর’ (চণ্ডীমঙ্গল, ১৭০০)। এসব উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, সেকালে পাণি, পাণী, পানী, পানি ইত্যাদি বানান জল অর্থেই ব্যবহৃত হতো। মূলত সংস্কৃত ‘পানীয়’ শব্দ থেকেই ‘পানি’ শব্দের উদ্ভব। তাই ওপার বাংলার গঙ্গাতীরের মানুষ পানিকে ‘জল’ আর এপার বাংলায় জলকে ‘পানি’ বললেও ‘পানীয়’ শব্দে কারো আপত্তি নেই। জল আমাদের জীবন আর পানি আমাদের প্রাণ।

আর ‘পাণি’ যখন হাত অর্থে ব্যবহৃত হয় তখন এর ব্যুৎপত্তি ভিন্ন : √পণ্ + ই (ইণ্) = পাণি। যেমন বীণাপাণি, শূলপাণি, শস্ত্রপাণি, পাণিগ্রাহী ইত্যাদি। কিন্তু ‘পান’ চিবিয়ে খাবার বস্তু তাম্বুল বোঝালে তার ব্যুৎপত্তি ভিন্ন। সংস্কৃত শব্দ ‘পর্ণ’ থেকে পান। এই ‘পর্ণ’ কিন্তু অশ্লীলতার সঙ্গে যুক্ত পর্নো (porno) নয়। সংস্কৃতে পর্ণ মানে পত্র বা পাতা – পর্ণ> পন্ন> পান। যেমন পর্ণকুটির, পর্ণপুট, পর্ণবীথি, পর্ণমোচী। সেজন্যই শীতকালে পাতাঝরা গাছকে আমরা ‘পর্ণমোচী বৃক্ষ’ বলি। সুতরাং তরল বস্তু গলাধঃকরণ করা পানের সঙ্গে চর্ব্য বস্তু পানকে যেন আমরা গুলিয়ে না ফেলি। তবে আমরা পানও খাই, পানিও খাই। চা খাই, চকোলেটও। অর্থাৎ চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয় আমরা একাকার করে ফেলি! এসব বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতির অব্যাখ্যাত আচরণ। তবে প্রশ্ন হতে পারে, ডাল কী ধরনের খাবার? তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। তবে খাদ্য হিসেবে ডালের চরিত্র নির্ভর করবে রান্নার পদ্ধতির ওপর। পাতলা ডাল পেয়, ঘন ডাল লেহ্য আর ভাজা ডাল চর্ব্য। খাদ্যবস্তুর রূপরূপান্তরের ওপরই নির্ভর করে খাবারের গ্রহণযোগ্যতা।

বাংলা সাহিত্যে প্রাচীনকাল থেকেই জল শব্দটি প্রচলিত। এর কয়েকটি নিদর্শন :

ষ জলে মাছ কূলে গাছ মৈল তার বিষে।

(বড়ু চণ্ডীদাস, ১৪৫০)।

ষ জলে পসি তপ করে নীল উতপল। (ওই)

ষ না ভিজয় জলেত অগ্নিত না পোড়ায়।

(আলাওল, ১৬৮০)।

ষ জল ভর সুন্দরী কন্যা জলে দিয়া ঢেউ।

   হাসি মুখে কও না কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ।

(মৈমনসিং গীতিকা, ১৬৫০)।

ষ আমি তাপিত পিপাসিত,

   আমায় জল দাও।

(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চণ্ডালিকা, ১৯৩৮)।

জলসহযোগে বাংলাভাষায় সন্ধি ও সমাসযুক্ত শত শত শব্দ আছে। সেগুলির মধ্যে সমার্থক শব্দ যেমন আছে তেমনই সাধারণের অজানা বিচিত্র অর্থযুক্ত শব্দও আছে। উল্লেখযোগ্য তেমন কয়েকটি শব্দের বিচয়ন :

সমার্থক শব্দ –

ষ জলে নেমে সাঁতার বা খেলা বিশেষ অর্থে –

   জলকৃড়া, জলক্রীড়া, জলকেলি, জল ছোড়া।

ষ কল্পলোকের জলবাসী যৌবনবতী সুন্দরী অর্থে –

   জলকুমারী, জলকিন্নরী, জলকন্যা, জলপরি।

ষ জলের ঢেউ অর্থে –

   জলকল্লোল, জলতরঙ্গ, জললহরী।

ষ টিফিন বা নাস্তা অর্থে –

   জল খাবার, জলপান, জলযোগ, জলপানি, জলটল।

ষ ভারতীয় পুরাণমতে জলের দেবতা বরুণ অর্থে –

 জলপতি, জলনাথ, জলদেবতা, জলেশ্বর, জলেশ,

   জলাধিপ।

ষ মেঘ অর্থে –

   জলদ, জলধর, জলপতি।

ষ পদ্মফুল অর্থে –

 জলপদ্ম, জলপুষ্প, জলফুল, জলজ লিলি, জলকুমুদী,

   জলমৃণাল।

ষ আবহাওয়া অর্থে –

   জলবায়ু, জলবাতাস, জলহাওয়া।

ষ গতিময় জলের ধারা অর্থে –

   জলপ্রপাত, জলধারা, জলপ্রবাহ, জলধার, জলরেখা।

ষ মেঘের শব্দ অর্থে –

   জলদগর্জন, জলদধ্বনি, জলদমন্দ্র।

ষ সমুদ্র অর্থে –

   জলধি, জলরাজ, জলদলপতি।

ষ নির্বিষ সাপ-বিশেষ –

   জলডোড়া, জলঢোঁড়া, জলবোড়া।

ষ জলভরা হাত অর্থে –

   জল-অঞ্জলি, জলগণ্ডূষ, জলপাণি।

ষ জলজ প্রাণী অর্থে –

   জলহস্তী, জলমার্জার, জলবিড়াল, জলখাসি।

ষ সহজ অর্থে –

   জলবৎ, জলভাত, জাউভাত।

এবার ‘জল’ শব্দযুক্ত কয়েকটি অজানা ও অল্পজানা পদের অর্থ ও উদাহরণ :

ষ জলকে চলা (জল আনতে যাওয়া)। ‘জলকে চলে লো কার

 ঝিয়ারি…।’ (কাজী নজরুল ইসলাম)

ষ জলকিন্নরী (জলে বাসকারী দেবলোকের গায়িকা)। ‘শহুরে পানির ফোয়ারা শোনাতো তাকে জলকিন্নরীর কতো গান।’ (শামসুর রাহমান, ১৯৭২)

ষ জলখ্যাংরা (জলে ভিজানো ঝাঁটা)। ‘তোমার বাড়ী ওরে এক দিন আনি, এনে জলখ্যাংরা খাইয়ে বিদেয় করি।’ (দীনবন্ধু মিত্র, ১৮৬৩)।

ষ জলগোজা (ফল-বিশেষ)। ‘সে জলগোজা খাইয়া টপ্পা মারিতে আরম্ভ করিলেন।’ (প্যারীচাঁদ মিত্র, ১৮৫৮)।

ষ জলচল (সামাজিকভাবে খাদ্যগ্রহণ)। ‘তাদের সঙ্গে জলচল বন্ধ।’ (রবীন্দ্রনাথ, ১৯৪১)।

ষ জলচুড়ি (জলতরঙ্গ বাদ্য)। ‘বাজায়ে জলচুড়ি কিঙ্কিণী -।’ (কাজী নজরুল ইসলাম)

ষ জলজান (হাইড্রোজেন গ্যাস)। ‘তিনি জলজান বায়ুর সাহায্য অবলম্বন করেন নাই।’ (বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ১৮৭৫)

ষ ‘জলটুঙি (জলাশয়ের মাঝে তৈরি ঘর)। ‘এবার আমি নিচ্ছি ছুটি, ছুটছি এবার জলটুঙিতে।’ (সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, ১৯১৫)

ষ জলদোষ (পেটে জল জমা রোগ)। ‘দেখিতেছি কিছু কিছু আছে জলদোষ।’ (রামনারায়ণ তর্করত্ন, ১৮৫৪)

ষ জল-নটিনী (নৃত্যময়ী বর্ষা)। ‘তরঙ্গেরই নূপুর পরে জলনটিনী আয় নেমে।’ (নজরুল, ১৯৩৩)

ষ জলমণ্ডুক (জলের ব্যাঙ)। ‘জলমণ্ডুক বাদ্য বাজায় সবে করতলে।’ (কৃষ্ণদাস, ১৫৮০)

ষ জলমরু (মরুতুল্য নিষ্প্রাণ জলরাশি)। ‘সেই শৈবালবিকীর্ণ জলমরুর মাঝখান হইতে সমস্ত গ্রামগুলি যেন কথা কহিয়া উঠিল।’ (রবীন্দ্রনাথ, ১৯০৭)

ষ জলমেয়ে (স্নানরত মেয়ে)। ‘সেই জলমেয়েদের স্তন ঠাণ্ডা, শাদা, বরফের কুচির মতন।’ (জীবনানন্দ দাশ, ১৯৩৬)

ষ জলবাশ (আরবি জলূ + ফারসি বশ >

জলবাশ। অশ^ারোহী সৈন্য)। ‘উজবক জলবাশে ঘিরিয়াছে চারপাশে।’ (ভারতচন্দ্র, ১৭৬০)

ষ জলাঙ্গী (নদীবিশেষ)। ‘জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়।’ (জীবনানন্দ, ১৯৩২)

এই জল শব্দটি নিয়ে বাংলা ভাষায় প্রবাদপ্রবচনও কম নেই। অর্থসহ এমন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রবাদপ্রবচন :

ষ জল হওয়া (রাগ প্রশমিত হওয়া), ষ জলে কুমির ডাঙায় বাঘ (উভয় সংকট), ষ জলে পড়া (বিপদে বা অপাত্রে পড়া),  ষ জলে ফেলা (অপাত্রে দান বা অপচয়),  ষ জলে যাওয়া (বৃথা ব্যয়), ষ জলের দাম (খুব সস্তা)।

নদীমাতৃক দেশ বলেই আবহমান কালের বাংলা গানে এসেছে জলের প্রসঙ্গ। এই জল কখনো জোয়ার-ভাটার, কখনো

জীবন-যৌবনের প্রতীক, কখনো বিলয়-বিধ্বংসের হাহাকারে ভরা। ভারতীয় পুরাণ ও সাহিত্য-ঐতিহ্যে গঙ্গাজল পুণ্যের,

যমুনার জল প্রেমের এবং পদ্মার জল সমৃদ্ধির পতাকা। প্রাচীন বাংলা সাহিত্য, বৈষ্ণব গীতিকবিতা, পুরনো দিনের বাংলা গান, মরমি লোকসংগীত, পঞ্চকবির গীতসম্ভার ইত্যাদিতে জলের প্রসঙ্গ বিপুল ধারায় জলছলছল। তাই জলের প্রসঙ্গ আছে, এমন গানের উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করা যাবে না! প্রভাতে ও প্রদোষকালে যমুনায় বা জলাশয়ে কুলবধূদের জল আনার দৃশ্য এখন হারিয়ে গেলেও তা বাংলা গানে ও বাঙালির প্রাণে আছে চিরন্তন হয়ে। জলকে চলা রমণী এখন চোখে পড়ে না! কিন্তু আমাদের দুই মহান কবিবর তাঁদের কবিতা ও গানে তা মনে করিয়ে দেন –

‘বেলা যে পড়ে এল, জলকে চল্!’

পুরানো সেই সুরে কে যেন ডাকে দূরে,

কোথা সে ছায়া সখী, কোথা সে জল!

                             – রবীন্দ্রনাথ

জলকে চলে লো কার ঝিয়ারি

রূপ ছাপে না তার নীল শাড়ি।

                             – কাজী নজরুল ইসলাম

বাঙালির জীবনে কত প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গে যে-জল জড়িয়ে আছে তা বর্ণনাতীত। মানবদেহের প্রতিটি শিরা-উপশিরার সঙ্গে যেমন বাঁচামরার সম্পর্ক তেমনই জলের সঙ্গে বাঙালি-জীবনের। বাঙালির জীবনে জলের আবাহন যেমন তৃষ্ণা মেটানোর জন্য তেমনই ফুলে-ফলে-ফসলে জীবনকে পল্লবিত করার জন্যও। রবীন্দ্রবাণীতেই পাই : ‘এসো করো স্নান নবধারাজলে’ এবং ‘তুমি অন্ন মুখে তুলে দিলে, তুমি শীতল জলে জুড়াইলে’ – এমন অসংখ্য-অগণন শুচিস্নিগ্ধ পঙ্ক্তিমালা। জলের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক মেঘের ও বৃষ্টিপাতের। সংগীতের সেই মেঘমল্লার তো শ্রাবণের অঝোর বর্ষণেরই জয়গান। বাঙালির দুই বাতিঘর রবীন্দ্র-নজরুলের বর্ষার গানও তা-ই। আষাঢ়ের মেঘ আর শ্রাবণের বারিধারাপাতে বঙ্গভূমি হয় রজঃস্বলা – বাংলার মাটি হয় ঋতুবতী। সবই বারির গুণ – জলের মহিমা। প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে পঞ্চভূতের অন্যতম তাই অপ। এই জলের সঙ্গে মিতালি করে এবং জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে যুদ্ধ বাঙালির জীবনপথে যাত্রা।

জল আমাদের কাছে মাতৃরূপিণী, প্রাণসঞ্চারিণী ও জীবনদায়িনী। পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে তো জলের মধ্যেই। তাছাড়া একথাও সত্য যে, মাতৃগর্ভে মানবশিশু ন’মাস জলের মধ্যেই বাস করে। আমাদের খাদ্যের জোগান ও শস্যের সরবরাহের মূলে তো নিহিত আছে জলের অবদান। এ-কারণেই মাইকেল মধুসূদন বলেছেন : ‘দুগ্ধস্রোতা রূপী তূমি জন্মভূমি স্তনে।’ সেই জলেশ্বরী উৎসমুখ হিমালয়-তনয় গঙ্গোত্রী হিমবাহ, মানস সরোবর আর আকাশের কথা বললে জলধরের কথা যেমন মনে পড়ে তেমন জলধির কথাও স্মরণ হয়। জলময় জীবন আমাদের। কথাশিল্পী হরিশংকর জলদাসের মতো আমরা যারা ‘নোনাজলে ডুব সাঁতার’ দিতে জানি না তাদের জন্য আছে রবীন্দ্রনাথের ‘আমাদের ছোট নদী’, সৈয়দ হকের জলেশ্বরী, আল মাহমুদের তিতাস, নির্মলেন্দু গুণের কংস, জীবনানন্দ দাশের ধানসিড়ি, মহাদেব সাহার ফুলজোড়সহ আরো কতশত নাম-না-জানা নদীর জলধারা। হরিশংকর জলদাস তাঁর প্রথম উপন্যাসের  নাম রেখেছেন জলপুত্র – বাড়ির নামও তা-ই। কিন্তু তিনি একাই জলপুত্র নন। মানবজাতির সৃষ্টি ও স্থিতির প্রশ্নে আমরা সকলেই জলপুত্র নই কি? মানবজীবনে জলের মহিমার কথা ভাবলে এই সত্য অস্বীকার করার জো নেই!

২. জলবিষয়ক এই পর্বটি এমন উদ্ধৃতি-কণ্টকিত হয়ে গেল যে, পড়তে-পড়তে পাঠক জলাতঙ্কে আক্রান্ত না-হলেই রক্ষা! প্রাণসত্তার উৎস যে-জল তা যদি প্রাণঘাতী হয় তবে বিড়ম্বনার অন্ত নেই! তাই একটু হাসির খোরাক –

এক কৃপণ শখ করে একটি আলখাল্লা বানিয়েছে। দীর্ঘদিন ব্যবহারের পর সেটি ছিঁড়ে গেলে এর ভালো অংশ দিয়ে একটি স্কার্ফ তৈরি করল। সেটিও ছিঁড়ে গেলে তার ভালো অংশটুকু দিয়ে তৈরি করল একটি রুমাল। রুমালটিও ছিঁড়ে গেলে সেটি পুড়িয়ে তার ছাই দিয়ে দাঁত মেজে কুলি করছে আর বলছে – আমার আলখাল্লা তৈরির হাজার টাকা আসলে জলেই গেল।