আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে ভাষা ও বাস্তবতা

অনুবাদ : সুব্রত বড়ুয়া

বিজ্ঞানের ইতিহাস জুড়ে নতুন আবিষ্কার ও নতুন ভাবনাসমূহ সবসময় বৈজ্ঞানিক বিবাদের সৃষ্টি করেছে, নতুন ধারণাগুলিকে সমালোচনা করে তর্কবিতর্কমূলক প্রকাশনার পথ খুলে দিয়েছে এবং এসব সমালোচনা প্রায়শ সেগুলির উন্নয়নের সহায়ক হয়েছে। কিন্তু এসব মতবিরোধ পূর্বে কখনো এমন সহিংসতার মাত্রায় পৌঁছায়নি যেমনটা ঘটেছে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আবিষ্কারের পর এবং কিছুটা কম মাত্রায় কোয়ান্টাম তত্ত্বের পর। উভয় ক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিক সমস্যাগুলি শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক সমস্যাগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে পড়ে এবং কয়েকজন বিজ্ঞানী তাঁদের মতামত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক পদ্ধতিগুলির সাহায্য গ্রহণ করেন। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক উন্নয়ন সম্পর্কে উগ্র প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি অনুধাবন করা যাবে শুধু যখন কেউ বুঝতে পারবেন যে, এখানে পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তিসমূহ নড়তে শুরু করেছে; এবং এই গতি এমন অনুভূতির সৃষ্টি করেছে যে, বিজ্ঞান থেকে এর ভিত্তিভূমিটিই আলাদা হয়ে যাবে। একই সঙ্গে সম্ভবত এর অর্থ হতে পারে, নতুন পরিস্থিতি সম্পর্কে কথা বলার মতো যথার্থ ভাষা এখনো কেউ খুঁজে পায়নি এবং নতুন আবিষ্কারগুলি সম্পর্কে উৎসাহের প্রাবল্যে এখানে-সেখানে প্রকাশিত অযথার্থ বিবৃতিগুলি সবধরনের ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করেছে। এটি প্রকৃতপক্ষে একটি মৌলিক সমস্যা। আমাদের সময়কার উন্নয়নকৃত পরীক্ষণ-কৌশল বিজ্ঞানের আওতার মধ্যে প্রকৃতির নতুন নতুন বিষয় নিয়ে এসেছে, যা সাধারণ ধারণাসমূহের ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তাহলে কোন ভাষায় সেগুলি বর্ণনা করা উচিত? বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার প্রক্রিয়া থেকে প্রথম যে-ভাষাটির উদ্ভব ঘটে তা তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে সচরাচরভাবেই একটি গাণিতিক ভাষা অর্থাৎ গাণিতিক পরিকল্প, যেটি কাউকে পরীক্ষণসমূহের ফলাফল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার সুযোগ প্রদান করে। পদার্থবিজ্ঞানী সন্তুষ্ট হতে পারেন   যখন তাঁর কাছে গাণিতিক পরিকল্প (scheme) থাকে এবং তিনি জানেন, পরীক্ষণসমূহের অধিব্যাখ্যার জন্য কীভাবে সেটি ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু তাঁর প্রাপ্ত ফলাফল সম্পর্কে তাঁকে অধিবিদ্যাবিদদের (metaphysicists) সঙ্গেও কথা বলতে হয়, যাঁরা সুবোধ্য সাধারণ ভাষায়, যেটি সকলেই বুঝতে পারে, কিছু ব্যাখ্যা প্রদান করা না হলে সন্তুষ্ট হবেন না। এমনকি পদার্থবিজ্ঞানীর জন্য সুবোধ্য ভাষায় প্রদত্ত বর্ণনাও অনুধাবনের একটি নির্ণায়ক-মাত্রা, যেখানে পৌঁছা সম্ভব হয়েছে। অনুরূপ বর্ণনা আদৌ সম্ভব হবে কোন মাত্রা পর্যন্ত? কেউ কি পরমাণুর নিজস্ব সত্তা সম্পর্কে কিছু বলতে পারে? এটি যেমন ভাষার সমস্যা, তেমনি সেরূপ পদার্থবিজ্ঞানেরও সমস্যা এবং সেজন্যই ভাষা সম্পর্কে সাধারণভাবে যেমন কিছু মন্তব্য প্রয়োজন, তেমনি বিশেষভাবে বৈজ্ঞানিক ভাষা সম্পর্কেও।

ভাষা গঠিত হয়েছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানবজাতির মধ্যে যোগাযোগের একটি উপায় হিসেবে এবং চিন্তার একটি ভিত্তি হিসেবে। ভাষা গঠনের বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কে আমরা সামান্যই জানি, কিন্তু ভাষা এখন ধারণ করছে বিপুলসংখ্যক ধারণা, যেগুলি দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাবলি সম্পর্কে কমবেশি দ্ব্যর্থহীন যোগাযোগের জন্য উপযোগী হাতিয়ার। এসব ধারণা অর্জিত হয় ক্রমশ ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে বিচারমূলক বিশ্লেষণ ব্যতিরেকেই এবং একটি শব্দ যথেষ্টভাবে ব্যবহৃত হওয়ার পর প্রায়শ আমরা মনে করি যে, এর দ্বারা কী অর্থ বোঝায় সেটি আমরা কমবেশি জানি। এটি অবশ্য একটি সুপরিচিত বিষয় যে, প্রথমদৃষ্টিতে যেমন মনে হয় ঠিক সেভাবে শব্দগুলি সংজ্ঞায়িত নয় এবং সেগুলির প্রয়োগযোগ্যতার পরিসর সীমিত মাত্র। দৃষ্টান্তস্বরূপ, আমরা একখণ্ড লোহা অথবা একটুকরা কাঠ সম্পর্কে বলতে পারি, কিন্তু একখণ্ড বা একটুকরা পানি সম্পর্কে বলতে পারি না। ‘খণ্ড’ বা ‘টুকরা’ শব্দগুলি কোনো তরল দ্রব্য সম্পর্কে প্রযোজ্য হয় না। অথবা, আরেকটি দৃষ্টান্তের কথা বলতে গেলে, ধারণাসমূহের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আলোচনাগুলিতে বোর (Bohr) নিচের গল্পটি বলতে বেশ পছন্দ করেন : “একটি বাচ্চা ছেলে হাতে একটি পেনি নিয়ে মুদির দোকানে গিয়ে বলে : ‘আমাকে কি এক পেনি দামের মেশানো মিষ্টি দেওয়া যাবে?’ মুদি দুটি মিষ্টি বের করে নিয়ে ছেলেটির হাতে দিয়ে বলেন : ‘এখানে দুটি মিষ্টি আছে। তুমি নিজেই সেগুলি মিশিয়ে নাও।’” শব্দ ও ধারণাসমূহের মধ্যেকার সমস্যামূলক সম্পর্কের আরো গুরুতর একটি উদাহরণ হচ্ছে, লাল ও সবুজ শব্দ দুটি ব্যবহার করেন এমন মানুষেরাও যাঁরা বর্ণান্ধ, যদিও এই দুটি ভাষিক শব্দের প্রয়োগসাধ্যতার পরিসর অন্যদের কাছে যেমন, তার চেয়ে অবশ্যই অনেক ভিন্ন তাঁদের কাছে।

শব্দাবলির অর্থের স্বকীয় অনিশ্চয়তা অবশ্য একেবারে প্রথমদিক থেকেই চিহ্নিত হয়েছিল এবং সেটিই সংজ্ঞাসমূহের প্রয়োজনের বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছিল, অথবা ‘সংজ্ঞা’ শব্দটি যেমন বলে – সীমানাগুলির অধিষ্ঠান (settings) নির্ধারণ করা অর্থাৎ কোথায় শব্দটি ব্যবহার করা প্রয়োজন এবং কোথায় নয়। কিন্তু সংজ্ঞাগুলি দেওয়া যেতে পারে শুধু অন্যান্য ধারণার সাহায্য নিয়ে এবং চূড়ান্তভাবে নির্ভর করতে হয় কিছু ধারণার ওপর যেগুলি গ্রহণ করা হয় তা যেমন রয়েছে সেভাবেই – অবিশ্লেষিত এবং অসংজ্ঞায়িত।

গ্রিক দর্শনে ভাষায় ধারণাগুলির সমস্যা সক্রেটিসের সময় থেকেই ছিল একটি প্রধান বিষয়বস্তু। তাঁর জীবন ছিল – যদি আমরা প্লেটোর সংলাপে শিল্পিত উপস্থাপনে তা অনুধাবন করতে পারি – ভাষায় ধারণাসমূহের বিষয় এবং প্রকাশের ধরনসমূহে সীমাবদ্ধতাগুলি সম্পর্কে ক্রমাগত আলোচনা। বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার একটি দৃঢ় ভিত্তি অর্জনের উদ্দেশ্য নিয়ে অ্যারিস্টটল তাঁর যুক্তিশাস্ত্রে ভাষার গঠনরূপসমূহ, সিদ্ধান্তে পৌঁছার নিয়মানুগ কাঠামো (formal structure) এবং
বিষয়-নিরপেক্ষ ব্যবকলন নিয়ে বিশ্লেষণ শুরু করেন। এভাবে তিনি বিমূর্ততা ও যথাযথতার এমন একটি মাত্রায় পৌঁছান যা গ্রিক দর্শনে সেই সময়কাল পর্যন্ত অজানা ছিল এবং এর দ্বারা তিনি আমাদের চিন্তার পদ্ধতিগুলিতে স্পষ্টীকরণ ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিপুল অবদান রাখেন। তিনি প্রকৃতপক্ষে বৈজ্ঞানিক ভাষার জন্য ভিত্তি নির্মাণ করেন।

অন্যদিকে ভাষার এই যৌক্তিক বিশ্লেষণের মধ্যে আবার সংশ্লিষ্ট থাকে অতিসরলীকরণের বিপদ। যুক্তিশাস্ত্রে মনোযোগ আকর্ষণ করা হয় অত্যন্ত বিশেষ কাঠামো, প্রতিজ্ঞা ও ব্যবকলনের মধ্যেকার দ্ব্যর্থহীন সংযোগ এবং যুক্তিবিন্যাসের সরল ধরনসমূহের প্রতি; আর ভাষার অন্য সকল কাঠামোকে অবহেলা করা হয়। এইসব অন্যান্য কাঠামোর উদ্ভব ঘটতে পারে শব্দগুলির কিছু অপরাপর অর্থের মধ্যে অনুষঙ্গসমূহ থেকে; দৃষ্টান্তস্বরূপ, একটি শব্দের গৌণ অর্থ যা অস্পষ্টভাবে মনের ভেতর যাওয়া-আসা করে যখন শব্দটি শোনা হয়, আবশ্যিকভাবে একটি বাক্যের বিষয়ের সঙ্গে কিছু যোগ করতে পারে। বাস্তব অবস্থা এই যে, প্রতিটি শব্দই আমাদের মনে শুধু অর্ধসচেতন আন্দোলন সৃষ্টি করতে পারে যাকে ভাষায় বাস্তবতার কিছু অংশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ব্যবহার করা যায় যৌক্তিক ধাঁচগুলির চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্টভাবে। অতএব, কবিরা প্রায়শ ভাষায় এরূপ জোর প্রদানের ও যৌক্তিক বিন্যাসের ভিত্তিতে চিন্তার বিষয়গুলিতে আপত্তি উত্থাপন করেছেন, যা – যদি আমি তাঁদের মতামতগুলি সঠিকভাবে অধিব্যাখ্যাত করি – ভাষাকে এর উদ্দেশ্যপূরণের ক্ষেত্রে কম উপযোগী করবে। এখানে আমরা দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্যেটের (Goethe) ফাউস্ট (Faust)-এর সেই শব্দগুলির কথা স্মরণ করতে পারি যা মেফিস্টোফেলিস তরুণ ছাত্রটিকে বলছেন (আনা সোয়ানউইক [Anna Swanwick]-এর অনুবাদ থেকে উদ্ধৃত) :

Waste not your time, so fast it flies;

Method will teach you time to win;

Hence, my young friend, I would advise,

With college logic to begin.

Then will your mind be so well brac’d,

In Spanish boots so tightly lac’d,

That on’t will circumspectly creep,

Thought’s beaten track securely keep,

Nor will it, ignis-fatuus like

Into the path of error strike

Then many a day they’ll teach you how

The mind’s spontaneous acts, till now

As eating and as drinking free,

Require a process; ― one, two, three!

In truth the subtle web of thought

In like the weaver’s fabric wrought,

One treadle moves a thousand lines,

Swift dart the shuttles to and fro,

Unseen the threads unnumber’d flow,

A thousand knots one stroke combines.

Then forward steps your sage to show,

And prove to you it must be so;

The first being so, and so the second.

The third and fourth deduc’d we see;

And if there were no first and second,

Nor third nor fourth would ever be.

This, scholars of all countries prize,

Yet ’mong themselves no weavers rise.

Who would describe and study aught alive,

Seeks first the living spirit thence to drive :

Then are the lifeless fragments in his hand,

There only fails, alas! ― the spirit-band.

এই রচনাংশটিতে রয়েছে ভাষার কাঠামো এবং সরল যৌক্তিক ধরনগুলির সংকীর্ণতার একটি প্রশংসনীয় বর্ণনা।

পক্ষান্তরে বিজ্ঞানের ভিত্তি হতে হবে অবশ্যই যোগাযোগের একমাত্র উপায় হিসেবে ভাষা এবং সেখানে, দ্ব্যর্থহীনতার সমস্যা যেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যৌক্তিক ধরনগুলিকে অবশ্যই তাদের ভূমিকা পালন করতে হবে। এই বিষয়ের ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্যমূলক দুঃসাধ্যতা নিম্নোক্তরূপে বর্ণনা করা যেতে পারে। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে আমরা সার্বিকতা থেকে যথাযথতা নির্ণয় করার চেষ্টা করি, অনুধাবন করার চেষ্টা করি সরল সাধারণ নিয়মসূত্রগুলি (laws) দ্বারা সৃষ্ট বিশেষ প্রতিভাস। সাধারণ নিয়মসূত্রগুলি যখন ভাষায় সূত্রবদ্ধ করা হয় তখন সেগুলিতে শুধু অল্প কয়েকটি সরল ধারণা অন্তর্ভুক্ত থাকে – অন্যথায় নিয়মসূত্রগুলি সরল ও সার্বিক হবে না। এসব ধারণা থেকে আহরিত হয় অসংখ্যপ্রকার সম্ভাব্য প্রতিভাস, শুধু গুণগতভাবে পূর্ণ যথাযথতাসহ। স্পষ্টত, সাধারণ ভাষার ধারণাগুলি, যেমনটা সেগুলি অযথাযথ ও শুধু অস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত, কখনো এরূপ আহরণ অনুমোদন করতে পারত না। যখন কোনো সিদ্ধান্ত-শৃঙ্খল আসে প্রদত্ত প্রতিজ্ঞাসমূহ থেকে, তখন সম্ভাব্য সংযোগসমূহের সংখ্যা নির্ভর করে প্রতিজ্ঞাসমূহের যথাযথতার ওপর। অতএব প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে সাধারণ নিয়মসূত্রগুলির ধারণাসমূহ অবশ্যই পূর্ণ যথাযথতার সঙ্গে সংজ্ঞায়িত হতে হবে এবং এটি অর্জন করা যাবে কেবল গাণিতিক বিমূর্তনের মাধ্যমে।

অন্যান্য বিজ্ঞানে এই পরিস্থিতি কিছুটা অনুরূপ হতে পারে যে-পর্যন্ত বরং যথার্থ সংজ্ঞাগুলির প্রয়োজন হয়; যেমন আইনের ক্ষেত্রে। কিন্তু এখানে সিদ্ধান্তসমূহের শৃঙ্খলে সংজ্ঞাগুলির সংখ্যা খুব বিরাট হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, সম্পূর্ণ যথাযথতারও প্রয়োজন হয় না এবং সাধারণ ভাষার ভাষিক অর্থে যথাযথ সংজ্ঞাসমূহই বরং যথেষ্ট।

তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে আমরা গাণিতিক প্রতীকসমূহ উপস্থিত করার মাধ্যমে, যেগুলিকে তথ্যাবলির সঙ্গে যেমন পরিমাপসমূহের ফলাফলসহ সম্পর্কিত করা যায়, প্রতিভাসের গ্রুপগুলিকে বুঝতে চেষ্টা করি। প্রতীকগুলির জন্য আমরা নামসমূহ ব্যবহার করি যেগুলি পরিমাপগুলির সঙ্গে তাদের সহসম্পর্ককে রূপকল্পিত করে (visualize)। এভাবেই প্রতীকগুলি ভাষার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায়। অতঃপর প্রতীকগুলি পরস্পর আন্তঃসংযুক্ত হয় সংজ্ঞা ও স্বতঃসিদ্ধসমূহের একটি কঠিন পদ্ধতির মাধ্যমে এবং চূড়ান্তভাবে প্রাকৃতিক নিয়মসূত্রগুলি প্রকাশ করা হয় প্রতীকগুলির মধ্যেকার সমীকরণ হিসেবে। এসব সমীকরণের অসংখ্য বৈচিত্র্য অতঃপর প্রতিসঙ্গী হয় বিশেষ প্রতিভাসসমূহের অসংখ্য বৈচিত্র্যের যেসব প্রতিভাস প্রকৃতির এই অংশে সম্ভব। এভাবেই, প্রতীকসমূহ ও পরিমাপসমূহের মধ্যেকার সহসম্পর্ক যতদূর বজায় থাকে ততদূর গাণিতিক পরিকল্প প্রতিভাসের গ্রুপগুলিকে তুলে ধরে। এই সহসম্পর্কই প্রাকৃতিক নিয়মসূত্রগুলিকে অভিন্ন ভাষার ভাষিক শব্দে প্রকাশের সুযোগ প্রদান করে, যেহেতু ক্রিয়াসমূহ ও পর্যবেক্ষণসমূহ-সমন্বিত আমাদের পরীক্ষণগুলি সবসময় সাধারণ ভাষায় বর্ণনা করা যায়।

তবুও, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে ভাষারও সম্প্রসারণ চলতে থাকে; নতুন ভাষিক শব্দগুলির প্রবর্তন ঘটে এবং পুরোনো শব্দগুলিরও ব্যাপকতর ক্ষেত্রে অথবা সাধারণ ভাষা থেকে ভিন্নভাবে প্রয়োগ হতে থাকে। শক্তি (energy), বিদ্যুৎ (electricity), এনট্রপির (entropy) মতো ভাষিক শব্দগুলি এর সুস্পষ্ট উদাহরণ। এভাবে আমরা একটি বৈজ্ঞানিক ভাষা গড়ে তুলি যাকে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের নতুনতর ক্ষেত্রগুলিতে সহযোজিত সাধারণ ভাষার স্বাভাবিক সম্প্রসারণ বলা যেতে পারে।

বিগত উনিশ শতকে বেশ কিছু নতুন ধারণা সূচিত হয়েছে পদার্থবিজ্ঞানে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা সেসব শব্দের ব্যবহারের সঙ্গে যথার্থভাবে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার আগে উল্লেখযোগ্য সময়ের প্রয়োজন হয়েছে। যেমন ‘তড়িৎ-চৌম্বক ক্ষেত্র’ (electromagnetic field) ভাষিক পদটি, যা ফ্যারাডের কাজে ইতোমধ্যেই কিছুটা পরিমাণে উপস্থিত ছিল এবং পরে ম্যাক্সওয়েল (Maxwell)-এর তত্ত্বের ভিত্তি তৈরি করে, পদার্থবিজ্ঞানীদের দ্বারা সহজে গৃহীত হয়নি যাঁরা প্রাথমিকভাবে তাঁদের মনোযোগ নিবদ্ধ করেছিলেন জড়বস্তুর যান্ত্রিক গতির প্রতি। এই ধারণাটির প্রবর্তন বস্তুত বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলির একটি পরিবর্তনকে ধারণ করেছিল এবং এ-ধরনের পরিবর্তনগুলি সহজে সম্পন্ন হয় না।

তবুও, বিগত শতকের শেষদিক পর্যন্ত প্রবর্তিত সব ধারণা গঠন করেছিল অভিজ্ঞতার ব্যাপক ক্ষেত্রে প্রযোজ্য একটি নিখুঁত সংগতিপূর্ণ সেট এবং, পূর্বেকার ধারণাগুলির সঙ্গে একযোগে, গঠন করে একটি ভাষা যা শুধু বিজ্ঞানীরাই নন, বরং কারিগর ও প্রকৌশলীরাও সাফল্যের সঙ্গে তাঁদের কাজে প্রয়োগ করতে পারতেন। এই ভাষায় নিহিত মৌলিক ধারণাগুলির মধ্যে ছিল এই অনুমান যে, সময়ের মধ্যে ঘটনাবলির ক্রমশৃঙ্খলা পুরোপুরিভাবে স্থান-পরিসরে (in space) তাদের ক্রমশৃঙ্খলা-নিরপেক্ষ, ইউক্লিডীয় (Euclidean) জ্যামিতি বৈধ বাস্তব স্থান-পরিসরে এবং দেশ-কালে (in space and time) ‘ঘটনাবলি’ সংঘটিত হয় সেগুলি পর্যবেক্ষিত হোক বা না হোক তার সঙ্গে সম্পর্করহিত বা নিরপেক্ষভাবে। এটা অস্বীকার করা হয়নি যে, প্রতিটি পর্যবেক্ষণেরই পর্যবেক্ষণীয় প্রতিভাসের ওপর কিছুটা প্রভাব ছিল, কিন্তু সাধারণভাবে এমন পূর্বধারণা করা হয়েছিল যে, সাবধানতার সঙ্গে পরীক্ষণগুলি করা গেলে এই প্রভাবকে যদৃচ্ছভাবে ক্ষুদ্র রাখা যেতে পারে। এটি বস্তুত বস্তুনিষ্ঠতার আদর্শের জন্য একটি প্রয়োজনীয় শর্ত বলে মনে হয়েছিল, যে শর্তটিকে বিবেচনা করা হয়েছিল সকল প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ভিত্তি রূপে।

পদার্থবিজ্ঞানের এই শান্তিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে সে আবহকে ভেঙে আবির্ভূত হয়েছিল কোয়ান্টাম তত্ত্ব এবং বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব, প্রথমে ধীর ও অতঃপর ক্রমাগত বৃদ্ধিশীল এক আকস্মিক সচলতা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ভিত্তিসমূহে। প্রথম প্রচণ্ড আলোড়নমূলক আলোচনা শুরু হয়েছিল আপেক্ষিকতা তত্ত্ব দ্বারা সূচিত দেশ ও কালের সমস্যাগুলিকে কেন্দ্র করে। নতুন পরিস্থিতি নিয়ে কীভাবে কথা বলা উচিত? চলমান বস্তুকায়াসমূহের লরেনৎস সংকোচনকে (Lorentz contraction) কি বাস্তব সংকোচন অথবা শুধুই প্রতীয়মান সংকোচন রূপে বিবেচনা করা উচিত? এমনকি বলা উচিত যে, দেশ ও কালের কাঠামো ঠিক যেমন হওয়া উচিত বলে ধারণা করা হয়েছিল বাস্তবে তা থেকে ভিন্ন অথবা শুধু কি এমন বলা উচিত যে, পরীক্ষণগত ফলাফলকে গাণিতিকভাবে কি এই নতুন কাঠামো অনুযায়ী সংযুক্ত করা যাবে, যখন দেশ ও কাল, আমাদের কাছে যেভাবে আবির্ভূত হয় সেরূপ সর্বজনীন ও আবশ্যক ধরন হওয়ার ফলে, সবসময় যেমন ছিল সেরূপই থেকে যাবে? এরূপ বহু মতবিরোধের পেছনে যে প্রকৃত সমস্যা ছিল তা হলো – এমন কোনো ভাষার অস্তিত্ব তখন ছিল না যে-ভাষায় নতুন পরিস্থিতি সম্পর্কে সংগতিপূর্ণভাবে কথা বলতে পারা যাবে। সাধারণ ভাষার ভিত্তি ছিল দেশ ও কাল সম্পর্কে পুরনো ধারণা এবং এই ভাষা শুধু বিন্যাস ও পরিমাপসমূহের ফলাফল সম্পর্কে যোগাযোগের দ্ব্যর্থহীন উপায়গুলির সুযোগ দিয়েছিল। তবুও পরীক্ষণগুলি দেখায় যে, পুরনো ধারণাগুলি সর্বত্র প্রয়োগ করা যাবে না।

স্পষ্টত আপেক্ষিকতা তত্ত্বের অধিব্যাখ্যার (interpretation) জন্য অতএব সূচনাবিন্দু ছিল এই ঘটনা যে, ক্ষুদ্র বেগসমূহের সীমানির্দেশক ক্ষেত্রে (ক্ষুদ্র, আলোর বেগের সঙ্গে তুলনায়) নতুন তত্ত্বটি প্রায়োগিকভাবে পুরনো তত্ত্বের সঙ্গে অভিন্ন। অতএব তত্ত্বের এই অংশে এটি স্পষ্ট ছিল গাণিতিক প্রতীকগুলিকে কিভাবে পরিমাপসমূহ ও সাধারণ ভাষার ভাষিক শব্দগুলির সঙ্গে সহসম্পর্কিত করতে হবে; প্রকৃতপক্ষে কেবল এই সহসম্পর্কের মাধ্যমেই লরেনৎস রূপান্তরণ পাওয়া গিয়েছিল। সেখানে এই অঞ্চলের শব্দাবলি ও প্রতীকসমূহের বিষয়ে কোনো দ্ব্যর্থতা ছিল না। বস্তুত এই সহসম্পর্ক আপেক্ষিকতার সমস্যার সঙ্গে সংযুক্ত পরীক্ষণমূলক গবেষণার পুরো ক্ষেত্রেই তত্ত্বটির প্রয়োগের জন্য ইতোমধ্যেই যথেষ্ট ছিল। অতএব ‘প্রকৃত’ বা ‘প্রতীয়মান’ লরেনৎস সংকোচন বিষয়ে অথবা ‘যুগপৎ’ (simultaneous) শব্দটির সংজ্ঞা ইত্যাদি বিষয়ে মতবিরোধমূলক প্রশ্ন ঘটনাবলির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল না, কেবল ভাষা ব্যতীত।

পক্ষান্তরে, ভাষা বিষয়ে ক্রমশ স্বীকার করে নিতে হয়েছে যে, কিছু কিছু নীতির ব্যাপারে সম্ভবত অত্যধিক জোর দেওয়া উচিত হবে না। ভাষায় কোন ভাষিক শব্দগুলির জন্য সাধারণ প্রত্যয়গ্রাহ্য নির্ণায়কসমূহ ব্যবহৃত হওয়া উচিত এবং কীভাবে সেগুলি ব্যবহার করা বিধেয় তা খুঁজে পাওয়া সবসময় কঠিন। শুধু অপেক্ষা করা উচিত ভাষার উন্নয়নের জন্য, যা নিজেই কিছু সময় পর নিজেকে নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে সমন্বিত করে নেয়। প্রকৃতপক্ষে বিগত পঞ্চাশ বছরে বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে এই সমন্বয় ইতোমধ্যে বেশ বড় পরিমাণে সংঘটিত হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ‘প্রকৃত’ ও ‘প্রতীয়মান’ সংকোচনের মধ্যে এই স্বাতন্ত্র্য সহজেই অদৃশ্য হয়েছে। ‘যুগপৎ’ (simultaneous) শব্দটি আইনস্টাইন প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুসরণেই ব্যবহৃত হয়, যেখানে পূর্বের একটি অধ্যায়ে ব্যাপকতর সংজ্ঞার জন্য সেটি আলোচিত হয়েছে ‘স্থান-পরিসরসদৃশ দূরত্বে’ (at a space-like distance) সাধারণভাবে ব্যবহৃত ইত্যাদি অর্থে।

সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে বাস্তব স্থান-পরিসরে অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির ধারণা (the idea of a
non-Euclidean geometry) কয়েকজন দার্শনিক দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। তাঁরা এই বিষয়টি নির্দেশ করে বলেন যে, পরীক্ষণসমূহ বিন্যাসের ক্ষেত্রে আমাদের সম্পূর্ণ পদ্ধতিতে ইতোমধ্যেই ইউক্লিডীয় জ্যামিতি পূর্বধারণাকৃত হয়ে আছে।

বস্তুত কোনো মেকানিক/ যন্ত্রবিদ যদি একটি নিখুঁত সমতলপৃষ্ঠ প্রস্তুত করার চেষ্টা করেন, তাহলে তিনি নিম্নবর্ণিত উপায়ে তা করতে পারেন। তিনি প্রথমে মোটামুটি একই আকারের ও প্রায়-সমতল তিনটি পৃষ্ঠতল তৈরি করেন। অতঃপর তিনি চেষ্টা করেন তিনটি পৃষ্ঠতলের যে-কোনো দুটিকে বিভিন্ন আপেক্ষিক অবস্থানে একটিকে অপরটির সঙ্গে বসিয়ে সংসর্গে নিয়ে আসার জন্য। যে ডিগ্রিতে এই সংসর্গসাধন পুরো পৃষ্ঠতলজুড়ে সম্ভব হয় সেটিই হচ্ছে যথাযথতার ডিগ্রি – যে যথাযথতায় পৃষ্ঠতলগুলিকে ‘সমতল’ (plane) বলতে পারা যাবে। তিনি তাঁর তিনটি পৃষ্ঠতল নিয়ে সন্তুষ্ট হবেন যদি তাদের যে-কোনো দুটির মধ্যেকার সংসর্গ (contact) সর্বত্র সম্পূর্ণভাবে ঘটে। যদি তা ঘটে তাহলে গাণিতিকভাবে প্রমাণ করা যাবে যে, ইউক্লিডীয় জ্যামিতি তিনটি পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। এভাবে যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছিল যে, ইউক্লিডীয় জ্যামিতি নির্ভুল করা হয় আমাদের নিজেদের পরিমাপগুলির দ্বারা।

অবশ্য সাধারণ আপেক্ষিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে জবাব দেওয়া চলে যে, এই যুক্তিতর্ক শুধু ক্ষুদ্র মাত্রাসমূহের ক্ষেত্রেই ইউক্লিডীয় জ্যামিতির বৈধতা প্রমাণ করে অর্থাৎ আমাদের পরীক্ষণ-সরঞ্জামের মাত্রাগুলির মধ্যেই। এই অঞ্চলে যে যথাযথতার সঙ্গে তা খাটে সেটি এতই উচ্চ যে, সমতল পৃষ্ঠতলসমূহ পাওয়ার জন্য ওপরে বর্ণিত প্রক্রিয়া সবসময় চালিয়ে যাওয়া যায়। এরপরও এই এলাকায় ইউক্লিডীয় জ্যামিতির যে অতি সামান্য বিচ্যুতিসমূহ বর্তমান থাকে তা বুঝতে পারা যাবে না যেহেতু পৃষ্ঠতলগুলি এমন উপরকণ দিয়ে তৈরি যা কঠোরভাবে দৃঢ় নয় কিন্তু রূপবিকৃতি (deformation) ঘটতে দেয় অত্যন্ত সামান্য এবং যেহেতু সংসর্গের ধারণা সম্পূর্ণ যথাযথতার সঙ্গে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, মহাজাগতিক মানদণ্ডে বর্ণিত প্রক্রিয়াটি অবশ্যই কাজ করবে না; কিন্তু তা পরীক্ষণমূলক পদার্থবিজ্ঞানের কোনো সমস্যা নয়।

আবার, সাধারণ আপেক্ষিকতায় গাণিতিক পরিকল্পের ভৌত অধিব্যাখ্যার জন্য স্পষ্টত সূচনাবিন্দু হচ্ছে এ তথ্য যে, ক্ষুদ্র মাত্রাসমূহের ক্ষেত্রে জ্যামিতি হলো অত্যন্ত কাছাকাছিভাবে ইউক্লিডীয়; এই এলাকায় তত্ত্ব এগিয়ে যায় চিরায়ত (classical) তত্ত্বের দিকে। অতএব, এখানে গাণিতিক প্রতীকসমূহ ও পরিমাপসমূহ এবং সাধারণ ভাষায় ধারণাসমূহ দ্ব্যর্থহীন। তবুও কেউ কেউ বৃহৎ মাত্রাগুলিতে অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির কথা বলতে পারেন। বস্তুত এমনকি সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের বিকাশসাধনের অনেক আগেই গণিতজ্ঞরা বাস্তব স্থান-পরিসরের ক্ষেত্রে অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির সম্ভাব্যতার কথা বিবেচনা করেছিলেন বলে মনে হয়, বিশেষভাবে গটিংগেনে (Göttingen) গাউস (Gauss)। যখন তিনি তিনটি পর্বত তথা হার্জ পর্বতমালায় ব্রোকেন (the Broken in the Harz Mountains), থুরিংগিয়ায় ইনসেলবার্গ (the Inselberg in Thuringia) এবং গটিংগেনের নিকটবর্তী হোয়েনহেগেন (the Hohenhagen) দ্বারা গঠিত একটি ত্রিভুজ নিয়ে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ধরাকৃতি (geodetic) পরিমাপসমূহ সম্পন্ন করেন – কথিত আছে তিনি তখন অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে যাচাই করে দেখেছিলেন যে, তিনটি কোণের সমষ্টি প্রকৃতপক্ষে ১৮০ ডিগ্রির সমান ছিল; এবং তিনি একটি পার্থক্যও বিবেচনায় নিয়েছিলেন যা ইউক্লিডীয় জ্যামিতি থেকে বিচ্যুতি প্রমাণ করার জন্য সম্ভব ছিল। প্রকৃতপক্ষে তিনি তাঁর পরিমাপসমূহের যথাযথতার মধ্যে কোনোরূপ বিচ্যুতি দেখতে পাননি।

সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে যে ভাষায় আমরা এখন প্রকৃতপক্ষে সাধারণ নিয়মসূত্রগুলি বর্ণনা করি তা গণিতজ্ঞদের বৈজ্ঞানিক ভাষাকে অনুসরণ করে এবং পরীক্ষণগুলির নিজেদের বর্ণনার জন্য আমরা সাধারণ ধারণাসমূহ বর্ণনা করতে পারি, যেহেতু ইউক্লিডীয় জ্যামিতি ক্ষুদ্র মাত্রাসমূহে যথেষ্ট যথাযথতার সঙ্গে বৈধ।

অবশ্য ভাষা ব্যবহার নিয়ে সবচেয়ে কঠিন সমস্যার উদ্ভব ঘটে কোয়ান্টাম তত্ত্বের ক্ষেত্রে। এখানে প্রথমে আমাদের কাছে সাধারণ ভাষার ধারণাগুলির সঙ্গে গাণিতিক প্রতীকগুলিকে সহসম্পর্কিত করার জন্য কোনো সরল নির্দেশিকা নেই; এবং শুরু থেকে যে একমাত্র বিষয় আমরা জানি তা হলো, আমাদের সাধারণ ধারণাগুলি পরমাণুসমূহের কাঠামোর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে না। আবার রীতিনীতির ভৌত অধিব্যাখ্যার জন্য সুস্পষ্ট সূচনাবিন্দু মনে হয় এই ঘটনা যে, কোয়ান্টাম বলবিদ্যার গাণিতিক পরিকল্প চিরায়ত বলবিদ্যার গাণিতিক পরিকল্পের দিকে অগ্রসর হয় সেইসব মাত্রার ক্ষেত্রে যেগুলি পরমাণুসমূহের আকারের তুলনায় বৃহৎ। কিন্তু এই বিবৃতিও অবশ্যই প্রকাশ করতে হবে এমনকি কিছুটা সংবরণসহ। এমনকি বৃহৎ মাত্রাসমূহের ক্ষেত্রেও কোয়ান্টামতাত্ত্বিক সমীকরণগুলির বহু সমাধান রয়েছে যেগুলির অনুরূপ সমাধান চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানে পাওয়া যায় না। এসব সমাধানে, প্রথমদিককার অধ্যায়গুলিতে যেমন আলোচনা করা হয়েছে তদ্রূপ, ‘সম্ভাবনাসমূহের ব্যতিচার’ (interference of probabilities) সুপ্রত্যক্ষ হবে (show up); চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানে এর অস্তিত্ব নেই। অতএব, এমনকি বৃহৎ মাত্রাগুলির সীমার মধ্যেও গাণিতিক প্রতীকসমূহ, পরিমাপসমূহ এবং সাধারণ ধারণাসমূহের সহসম্পর্ক কোনোভাবেই নগণ্য নয়। অনুরূপ একটি দ্ব্যর্থহীন সহসম্পর্ক পাওয়ার জন্য অবশ্যই সমস্যাটির অপর একটি বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নিতে হয়। এটি নিশ্চয়ই লক্ষ করা উচিত যে, যে সুব্যবস্থাটি (system) ক্রিয়ান্বিত করা হয় (treated) কোয়ান্টাম বলবিদ্যার পদ্ধতিসমূহ দ্বারা সেটি বস্তুত একটি অনেক বেশি বৃহৎ পদ্ধতির একটি অংশ (অবশেষে সমগ্র বিশ্ব); এটি এই বৃহত্তর সুব্যবস্থার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ারত; এবং এর সঙ্গে আরও যোগ করা উচিত যে, বৃহত্তর সুব্যবস্থাটির আণুবীক্ষণিক ধর্মাবলি (অন্তত একটি বৃহৎ পরিধিতে) অজানা। এই বক্তব্যটি নিঃসন্দেহে প্রকৃত পরিস্থিতির একটি নিখুঁত বর্ণনা। যেহেতু সুব্যবস্থাটির পরিমাপসমূহ ও তাত্ত্বিক অনুসন্ধানসমূহের লক্ষ্য হয়ে উঠতে পারেনি, সেহেতু এটি বস্তুত প্রতিভাসসমূহের জগতের অন্তর্গত হতে পারত না যদি এমন কোনো বৃহত্তর সুব্যবস্থার সঙ্গে এর মিথস্ক্রিয়া না থাকত যে সুব্যবস্থার অংশ নিজে পর্যবেক্ষণকারীও।

বৃহত্তর কোনো সুব্যবস্থার সঙ্গে, এর অসংজ্ঞায়িত ধর্মাবলি-সহ, মিথস্ক্রিয়া অতঃপর বিবেচনাধীন সুব্যবস্থার বর্ণনার মধ্যে একটি নতুন সংখ্যায়নিক উপাদান নিয়ে আসে – কোয়ান্টাম-তাত্ত্বিক ও চিরায়ত উভয়ই। বৃহত্তর মাত্রাসমূহের সীমায়নমূলক ক্ষেত্রে এই সংখ্যায়নিক উপাদান ‘সম্ভাবনাসমূহের ব্যতিচার’-এর প্রভাবগুলি ধ্বংস করে এমনভাবে যে, এখন কোয়ান্টাম-বলবিদ্যাগত পরিকল্প (quantum-mechanical scheme) প্রকৃতভাবেই সীমার মধ্যে চিরায়ত পরিকল্পের পথে অগ্রসর হয়। অতএব, এই বিবেচনার ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম তত্ত্বের গাণিতিক প্রতীকসমূহ এবং সাধারণ ভাষার ধারণাসমূহের মধ্যেকার সহসম্পর্ক দ্ব্যর্থহীন এবং এই সহসম্পর্ক পরীক্ষণগুলির অধিব্যাখ্যার জন্য যথেষ্ট। অবশিষ্ট সমস্যাগুলি আবার তথ্যাবলির চাইতে বরং ভাষার সঙ্গেই সম্পৃক্ত, যেহেতু এটি এই ‘তথ্য’ ধারণার অন্তর্ভুক্ত যে, একে সাধারণ ভাষায় বর্ণনা করা যেতে পারে।

কিন্তু ভাষার সমস্যাগুলি এখানে সত্যিই গুরুতর। আমরা কথা বলতে চাই পরমাণুসমূহের কাঠামো সম্পর্কে, শুধু তথ্যাদি সম্পর্কে নয় – যেমন শেষোক্তটি হচ্ছে একটি আলোকচিত্র-প্লেটের ওপর কালো দাগসমূহ অথবা একটি ক্লাউড চেম্বারে জলবিন্দুসমূহ। কিন্তু সাধারণ ভাষায় আমরা পরমাণুগুলি সম্পর্কে কিছু বলতে পারি না।

বিশ্লেষণটি এখন অব্যাহত রাখা যাবে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন উপায়ে। আমরা হয় জিজ্ঞেস করতে পারি, কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূত্রগঠনের পর থেকে বিগত ত্রিশ বছরে পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে পরমাণুগুলি সম্পর্কে প্রকৃতপক্ষে কোন ভাষাটি গড়ে উঠেছে। অথবা আমরা গাণিতিক পরিকল্পের প্রতিসঙ্গী হিসেবে একটি যথাযথ বৈজ্ঞানিক ভাষার সংজ্ঞা প্রদানের জন্য গৃহীত প্রয়াসগুলি বর্ণনা করতে পারি।

প্রথম প্রশ্নটির উত্তরে বলা যেতে পারে যে, কোয়ান্টাম তত্ত্বের অধিব্যাখ্যার মধ্যে বোর কর্তৃক প্রবর্তিত পরিপূরকতার ধারণা পদার্থবিজ্ঞানীদেরকে উৎসাহিত করেছে একটি দ্ব্যর্থহীন ভাষার পরিবর্তে বরং একটি দ্ব্যর্থবোধক ভাষা ব্যবহার করতে, অনিশ্চয়তা নীতির সঙ্গে কিছুটা অস্পষ্টভাবে অনুবর্তনসম্পন্ন চিরায়ত ধারণাসমূহ ব্যবহারে, একান্তরভাবে ভিন্ন ভিন্ন চিরায়ত ধারণা প্রয়োগ করতে যেগুলি যুগপৎ ব্যবহৃত হলে অসংগতিসমূহের দিকে চালিত করবে। এভাবে বলা হয় ইলেকট্রনের কক্ষপথসমূহ সম্পর্কে, শক্তি ও ভরবেগ ইত্যাদি সম্পর্কে, সবসময় ও এ বিষয়ে সচেতন থেকে যে, এসব ধারণার রয়েছে অত্যন্ত সীমিত পরিসরের প্রযোজ্যতা। যখন ভাষার এই অস্পষ্ট ও নিয়মশৃঙ্খলাহীন ব্যবহার দুঃসাধ্যতাসমূহের দিকে নিয়ে যায়, তখন পদার্থবিজ্ঞানীর নিজেকে গাণিতিক পরিকল্পের মধ্যে এবং পরীক্ষণগত তথ্যসমূহের সঙ্গে এর দ্ব্যর্থহীন সহসম্পর্কের মধ্যে প্রত্যাহার করে নিতে হয়।

ভাষার এই ব্যবহার বিভিন্নভাবে বেশ সন্তোষজনক, যেহেতু এটি আমাদেরকে দৈনন্দিন জীবনে অথবা কবিতায় ভাষার অনুরূপ ব্যবহারের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমরা বুঝতে পারি যে, পরিপূরকতার পরিস্থিতি শুধু একা পারমাণবিক জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; আমরা এর সাক্ষাৎ পাই যখন আমরা একটি সিদ্ধান্ত এবং আমাদের সিদ্ধান্তের প্রণোদনাগুলি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করি অথবা যখন আমাদের কাছে সংগীত উপভোগ ও এর কাঠামো বিশ্লেষণের মধ্যে বাছাই করে নেবার কোনো সুযোগ থাকে। পক্ষান্তরে, চিরায়ত ধারণাগুলি যখন এভাবে ব্যবহৃত হয়, সেগুলি সবসময় একটাকিছু অস্পষ্টতা নিজেদের মধ্যে ধরে রাখে, সেগুলি ‘বাস্তবতা’র সঙ্গে তাদের সম্পর্কের মধ্যে অর্জন করে শুধু একই সংখ্যায়নিক গুরুত্ব যেমনটা করে চিরায়ত তাপগতিবলবিদ্যার ধারণাগুলি এর সংখ্যায়নিক অধিব্যখ্যায়। অতএব, তাপগতিবলবিদ্যার এসব সংখ্যায়নিক ধারণার সংক্ষিপ্ত আলোচনা হয়তো কাজে আসতে পারে।

‘উষ্ণতা’ ধারণাটি চিরায়ত তাপগতিবলবিদ্যায় বাস্তবতার একটি বস্তুনিষ্ঠ বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলে প্রতীয়মান হয় যা জড়বস্তুর একটি বস্তুনিষ্ঠ ধর্ম। দৈনন্দিন জীবনে একটি থার্মোমিটারের সাহায্যে এটি সংজ্ঞায়িত করা বেশ সহজ কোনো জড়বস্তুর একটি খণ্ড একটি নির্দিষ্ট উষ্নতায় রয়েছে বলতে আমরা কি বুঝাতে চাই। কিন্তু যখন আমরা একটি পরমাণুর উষ্ণতা বলতে কি বুঝায় তার সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করি, এমনকি চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানেও, তখন আমরা অনেক বেশি কঠিন অবস্থানে পৌঁছে যাই। প্রকৃতপক্ষে এই ‘পরমাণুর উষ্ণতা’ ধারণাটিকে আমরা পরমাণুর একটি সুসংজ্ঞায়িত ধারণার সঙ্গে সহসম্পর্কিত করতে পারি না, কিন্তু একে সংযুক্ত করতে হয়, অন্তত আংশিকভাবে হলেও, সেটি সম্পর্কে আমাদের অপর্যাপ্ত জ্ঞানের সঙ্গে। আমরা উষ্ণতার মানকে পরমাণুর ধর্মাবলি সম্পর্কিত নির্দিষ্ট সংখ্যায়নিক প্রত্যাশাসমূহের সঙ্গে সহসম্পর্কিত করতে পারি, কিন্তু এ বিষয়ে সন্দেহ থেকে যায় যে, একটি প্রত্যাশাকে বস্তুনিষ্ঠ বলা উচিত কি না। ‘পরমাণুর উষ্ণতা’ ধারণাটি গল্পের যে বালক নানা ধরনের মিশ্রিত মিষ্টদ্রব্য কিনেছিল সে গল্পটির ‘মিশ্রিতকরণ’ ধারণাটির চেয়ে অনেক বেশি ভালোভাবে সংজ্ঞায়িত নয়।

একইভাবে কোয়ান্টাম তত্ত্বে সকল চিরায়ত ধারণা, যখন পরমাণুর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, ‘পরমাণুর উষ্ণতা’র মতোই ভালো ও সামান্যভাবে সংজ্ঞায়িত মাত্র; সেগুলি সংখ্যায়নিক প্রত্যাশাসমূহের সঙ্গে সহসম্পর্কিত; শুধু বিরল ক্ষেত্রসমূহেই প্রত্যাশা হয়তো নিশ্চয়তার সমতুল্য হয়ে উঠতে পারে। আবার, চিরায়ত তাপগতিবলবিদ্যায় যেমনটা, প্রত্যাশাকে বস্তুনিষ্ঠ বলাও কঠিন। একে হয়তো একটি বস্তুনিষ্ঠ প্রবণতা বা সম্ভাব্যতা বলা যেতে পারে, অ্যারিস্টটলীয় দর্শনের ভাবার্থে একটি ‘পটেনশিয়া’ (‘Potentia’)। বস্তুত আমি বিশ্বাস করি যে, পদার্থবিজ্ঞানীরা যখন পারমাণবিক ঘটনাবলির কথা বলেন তখন তাঁরা প্রকৃতপক্ষে যে ভাষা ব্যবহার করেন সেটি তাঁদের মনে ‘পটেনশিয়া’ ধারণাটির অনুরূপ ভাবনাসমূহ সৃষ্টি করে। অতএব পদার্থবিজ্ঞানীরা ক্রমশ ইলেকট্রনসমূহের কক্ষপথগুলি ইত্যাদিকে বাস্তবতা হিসেবে নয় বরং একধরনের ‘পটেনশিয়া’ রূপে বিবেচনায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ভাষা ইতোমধ্যে নিজেকে, অন্তত কিছুটা হলেও, এই প্রকৃত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে। এটি এমন একটি যথাযথ ভাষা নয় যে ভাষায় স্বাভাবিক যৌক্তিক বিন্যাসগুলি ব্যবহার করতে পারা যাবে; এটি এমন এক ভাষা যা আমাদের মনে ছবি তৈরি করে, কিন্তু সেগুলির সঙ্গে একত্রে এমন ভাবনাও তৈরি করে যে, বাস্তবতার সঙ্গে ছবিগুলির শুধু একটি অস্পষ্ট সংযোগ রয়েছে, এবং সেগুলি বাস্তবতার প্রতি শুধু একটি প্রবণতারই প্রতিনিধিত্ব করে।

পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই ভাষার অস্পষ্টতা অতএব চালিত করেছে একটি ভিন্ন যথাযথ ভাষার সংজ্ঞা প্রদানের প্রচেষ্টাসমূহের দিকে যা কোয়ান্টাম তত্ত্বের গাণিতিক পরিকল্পের সঙ্গে পূর্ণমাত্রায় সংগতি (conformity) বজায় রেখে সুনির্দিষ্ট যৌক্তিক বিন্যাসসমূহ অনুসরণ করে। বার্কহফ (Birkhoff) ও নয়মান (Neumann) এবং অধিকতর সম্প্রতি ওয়েয়িৎসাকের (Weizsäcker) কর্তৃক গৃহীত প্রয়াসসমূহের ফলাফল বিবৃত করা যায় এভাবে যে, কোয়ান্টাম তত্ত্বের গাণিতিক পরিকল্পকে চিরায়ত যুক্তিবিদ্যার সম্প্রসারণ অথবা সংশোধন রূপে অধিব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এটি বিশেষভাবে চিরায়ত যুক্তিবিদ্যার একটি মৌলিক নীতি যার সংশোধন প্রয়োজন বলে মনে হয়। চিরায়ত যুক্তিবিদ্যায় এমনটা ধরে নেওয়া হয় যে, যদি একটি বক্তব্যের আদৌ কোনো অর্থ থেকে থাকে তাহলে হয় বক্তব্য অথবা বক্তব্যের অপলাপ (negation) অবশ্যই নির্ভুল হবে। ‘এখানে একটি টেবিল আছে’ অথবা ‘এখানে একটি টেবিল নেই’-এর মধ্যে হয় প্রথম অথবা দ্বিতীয় বক্তব্যটি সঠিক অবশ্যই। ÔTertium non daturÕ অর্থাৎ সম্ভাব্যতার অস্তিত্ব এখানে নেই। এমন হতে পারে যে, আমরা জানি না, বক্তব্যটি অথবা এর অস্বীকৃতি এই দুয়ের মধ্যে কোনটি সঠিক; কিন্তু বাস্তবে এদের দুটির মধ্যে একটি সঠিক।

কোয়ান্টাম তত্ত্বে এই সূত্রটি অর্থাৎ ÔTertium non daturÕ (সম্ভাব্যতার অস্তিত্ব এখানে নেই) সংশোধন করতে হবে। এই মৌলিক মূলসূত্রের যে-কোনো সংশোধনের বিরুদ্ধে অবশ্য তৎক্ষণাৎ যুক্তি দেওয়া যায় যে, মূলসূত্রটির পূর্বধারণা করা হয় সাধারণ ভাষায় এবং আমাদেরকে আমাদের যুক্তির পরিণামস্বরূপ সংশোধনের বিষয়ে অন্তত স্বাভাবিক ভাষায় কথা বলতে হবে। অতএব স্বাভাবিক ভাষায় প্রযোজ্য নয় এমন একটি যৌক্তিক পরিকল্প স্বাভাবিক ভাষায় বর্ণনা করা হবে স্ববিরোধিতা। সেখানে অবশ্য ওয়েৎসেকার (Weizsäcker) মনোযোগ আকর্ষণ করেন এই বলে যে, ভাষার বিভিন্ন স্তরের পার্থক্যনির্দেশ
যে-কেউ করতে পারেন।

একটি স্তর নির্দেশ করে বস্তুসমূহের প্রতি – যেমন পরমাণসমূহ অথবা ইলেকট্রনসমূহ। দ্বিতীয় একটি স্তর নির্দেশ করে বস্তুসমূহ সম্পর্কিত বিবৃতি বা বক্তব্যসমূহের প্রতি। তৃতীয় স্তরটি নির্দেশ করতে পারে বক্তব্যসমূহ, বস্তুসমূহ, ইত্যাদির বিবৃতিগুলির প্রতি। তখন বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন যৌক্তিক বিন্যাস পাওয়া সম্ভব হবে। এ কথা সত্য যে, শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে স্বাভাবিক ভাষার কাছেই ফিরে যেতে হবে এবং তদনুযায়ী চিরায়ত যৌক্তিক বিন্যাসের কাছে। কিন্তু ওয়েৎসেকার (Weizsäcker) পরামর্শ দেন যে, চিরায়ত যুক্তিবিদ্যা অনুরূপ উপায়ে কোয়ান্টাম যুক্তিবিদ্যার একটি পূর্বিতা (priori) হতে পারে, যেমনটা চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান পূর্বিতা হচ্ছে কোয়ান্টাম তত্ত্বের। চিরায়ত যুক্তিবিদ্যাকে তখন কোয়ান্টাম যুক্তিবিদ্যার একধরনের সীমান্তিক ঘটনা হিসেবে ধারণ করা যেতে পারে, কিন্তু দ্বিতীয়োক্তটি অধিকতর সার্বিক যৌক্তিক বিন্যাস গঠন করবে।

চিরায়ত যৌক্তিক বিন্যাসের সম্ভাব্য সংশোধন তখন বস্তুসমূহ সম্পর্কিত স্তরটিকে প্রথমে নির্দেশিত করবে। চলুন আমরা একটি দেয়াল দ্বারা দুটি সমান অংশে বিভক্ত একটি আবদ্ধ বাক্সের মধ্যে পরমাণুর চলাচল বিবেচনা করে দেখি। দেয়ালটিতে একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র ছিদ্র থাকতে পারে যাতে পরমাণুটি তার ভেতর দিয়ে যেতে পারে। অতঃপর পরমাণুটি, চিরায়ত যুক্তিবিদ্যা অনুসারে, হয় বাক্সটির বামদিকের অর্ধাংশে অথবা ডানদিকের অর্ধাংশে থাকতে পারে। এখানে কোনো তৃতীয় সম্ভাবনার অস্তিত্ব নেই : ÔTertium non daturÕ। কোয়ান্টাম তত্ত্বে, অবশ্য, আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে যে – যদি আমরা আদৌ ‘পরমাণু’ এবং ‘বাক্স’ শব্দদুটি ব্যবহার করি, তাহলে সেখানে অন্যান্য সম্ভাবনাও রয়েছে পূর্ববর্তী দুটি সম্ভাবনার সঙ্গে অদ্ভুত উপায়ে মিশ্রণ হিসেবে। এটি আমাদের পরীক্ষণগুলির ফলাফল ব্যাখ্যার জন্য প্রয়োজন। দৃষ্টান্তস্বরূপ, আমরা পরমাণু কর্তৃক বিচ্ছুরিত আলো পর্যবেক্ষণ করতে পারতাম। আমরা সম্পাদন করতে পারতাম তিনটি পরীক্ষণ : প্রথমটি হলো, পরমাণুটি (যেমন, দেয়ালের ছিদ্রটি বন্ধ করে দিয়ে) রাখা হয়েছে বাক্সের বামদিকের অর্ধাংশে, বিচ্ছুরিত আলোর তীব্রতার বণ্টন পরিমাপ করা হলো; অতঃপর সেটি আবদ্ধ করে রাখা হলো ডানদিকের অর্ধাংশে এবং আবার বিচ্ছুরিত আলো পরিমাপ করা হলো এবং চূড়ান্তভাবে, পরমাণুটি সম্পূর্ণ বাক্সের মধ্যে অবাধে চলাচল করতে পারে ও আবার বিচ্ছুরিত আলোর তীব্রতার বণ্টন পরিমাপ করা হলো। যদি পরমাণুটি সবসময় হয় বাক্সের বাম অর্ধে অথবা ডান অর্ধে থাকত, তাহলে চূড়ান্ত তীব্রতা-বণ্টন হওয়া উচিত পূর্ববর্তী দুই তীব্রতা-বণ্টনের একটি মিশ্রণ (পরমাণুটির বাক্সের দুই অংশের প্রত্যেকটিতে ব্যয়িত সময়ের ভগ্নাংশ অনুযায়ী)। কিন্তু এটি সাধারণত পরীক্ষণগতভাবে সম্ভব নয়। প্রকৃত তীব্রতা-বণ্টন সংশোধিত হয় ‘সম্ভাবনাসমূহের ব্যতিচার’ দ্বারা; বিষয়টি নিয়ে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।

এই পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ওয়েৎসেকার (Weizsäcker) ‘সত্যের মাত্রা’ (degree of truth) নামে একটি ধারণার প্রবর্তন করেন। ‘পরমাণুটি রয়েছে বাক্সের বাম (অথবা ডান) অর্ধাংশে’-এর মতো বিকল্পমূলক যে-কোনো বিবৃতির জন্য একটি জটিল সংখ্যাকে সংজ্ঞায়িত করা হয় এর ‘সত্যের মাত্রা’র পরিমাপ হিসেবে। সংখ্যাটি যদি ১ হয়, তাহলে এর দ্বারা বুঝায় যে, বিবৃতিটি সত্য; আর সংখ্যাটি যদি ০ হয় তাহলে এর অর্থ হলো সেটি মিথ্যা। তবে অন্যান্য মানও সম্ভব। জটিল সংখ্যাটির পরম বিবৃতি সত্য হওয়ার সম্ভাবনা নির্দেশ করে; বিকল্পের দুটি অংশ নির্দেশকারী (আমাদের ক্ষেত্রে হয় ‘বাম’ অথবা ‘ডান’) সম্ভাবনাদ্বয়ের সমষ্টি অবশ্যই এক হবে। কিন্তু বিকল্পের দুটি অংশ নির্দেশকারী জটিল সংখ্যাগুলির প্রতিটি জোড়া, ওয়েৎসেকার-এর সংজ্ঞাসমূহ অনুসারে একটি বিবৃতির প্রতিনিধিত্ব করে যা অবশ্যই সত্য, যদি সংখ্যাগুলির ঠিক এসব মান থাকে; দৃষ্টান্তস্বরূপ, দুটি সংখ্যাই আমাদের পরীক্ষণে বিচ্ছুরিত আলোর তীব্রতা-বণ্টন নির্ধারণের জন্য যথেষ্ট। যদি ‘বিবৃতি (statement) ভাষিক শব্দটি এভাবে ব্যবহার করতে দেওয়া হয়, তাহলে নিম্নোক্ত সংজ্ঞা দ্বারা ‘পরিপূরকতা’ ভাষিক শব্দটি প্রবর্তিত করা যায় : প্রতিটি বিবৃতিকে যা দুটি বিকল্প বিবৃতির কোনোটির সঙ্গেই অভিন্ন নয় – আমাদের ক্ষেত্রে এই বিবৃতিসমূহ : ‘পরমাণুটি বাম অর্ধে রয়েছে’ অথবা পরমাণুটি বাক্সের ডান অর্ধে রয়েছে – এসব বিবৃতির পরিপূরক বলা হয়। প্রতিটি বিবৃতির জন্য পরমাণুটি বাঁ অথবা ডান এ-প্রশ্নটির সিদ্ধান্ত হয়নি। কিন্তু ‘সিদ্ধান্ত হয়নি’ ভাষিক শব্দটি কোনোভাবেই ভাষিক শব্দ ‘জানা যায়নি’-এর সমতুল্য নয়। ‘জানা যায়নি’-এর অর্থ হবে, পরমাণুটি বাস্তবে ডানে অথবা বাঁয়ে, শুধু আমরা জানি না সেটি কোথায় আছে। কিন্তু ‘সিদ্ধান্ত হয়নি’ নির্দেশ করে একটি ভিন্ন পরিস্থিতি, যা প্রকাশযোগ্য কেবল একটি পরিপূরক বিবৃতি দ্বারা।

এই সাধারণ যৌক্তিক বিন্যাসটি, যার বিস্তারিত বিবরণ এখানে বর্ণনা করা যাবে না, যথাযথভাবে প্রাতিসঙ্গিক কোয়ান্টাম তত্ত্বের গাণিতিক রীতিনীতির সঙ্গে। এটি একটি যথাযথ ভাষার ভিত্তি গঠন করে যা ব্যবহার করতে পারা যায় পরমাণুর কাঠামো বর্ণনার জন্য। কিন্তু তেমন একটি ভাষার প্রয়োগ কিছু কঠিন সমস্যা সৃষ্টি করে যেগুলির মধ্যে মাত্র দুটি আমরা এখানে আলোচনা করব : ভাষার বিভিন্ন ‘স্তরে’র মধ্যে সম্পর্ক এবং অন্তর্নিহিত অধিবিদ্যার (ontology) জন্য পরিণামসমূহ।

চিরায়ত যুক্তিবিদ্যায় ভাষার বিভিন্ন স্তরের মধ্যেকার সম্পর্ক হলো একের সঙ্গে অন্যটির একটি যোগাযোগ। ‘পরমাণুটি রয়েছে বামদিকের অর্ধাংশে’ এবং ‘এ-কথা সত্য যে পরমাণুটি রয়েছে বামদিকের অর্ধাংশে’ বিবৃতিদ্বয় যৌক্তিকভাবে দুটি ভিন্ন স্তরের অন্তর্ভুক্ত। চিরায়ত যুক্তিবিদ্যায় এসব বিবৃতি সম্পূর্ণভাবে সমতুল্য, অর্থাৎ সেগুলি উভয়ই হয় সত্য অথবা উভয়ই মিথ্যা। এটি সম্ভব নয় যে, একটি সত্য এবং অপরটি মিথ্যা। কিন্তু পরিপূরকতার যৌক্তিক বিন্যাসে এই সম্পর্ক অধিকতর জটিল। প্রথম বিবৃতিটির নির্ভুলতা অথবা অনির্ভুলতা তবুও দ্বিতীয় বিবৃতির নির্ভুলতা বা অনির্ভুলতা ইঙ্গিত করে। কিন্তু দ্বিতীয় বিবৃতির অনির্ভুলতা প্রথম বিবৃতির অনির্ভুলতার ইঙ্গিত করে না। যদি দ্বিতীয় বিবৃতিটি ভুল হয়, তাহলে সিদ্ধান্তহীন থাকতে পারে যে – পরমাণুটি বাঁ অর্ধে আছে কি না; পরমাণুটিকে অবশ্যই ডান অর্ধে থাকতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সেখানে তখনো একটি বিবৃতির নির্ভুলতা প্রসঙ্গে ভাষার দুই স্তরের মধ্যে পূর্ণ সমতুলতা থাকবে, কিন্তু অনির্ভুলতা প্রসঙ্গে নয়। এই প্রসঙ্গ-সূত্র থেকে কোয়ান্টাম তত্ত্বে চিরায়ত নিয়মসূত্রগুলির (laws) অটলতা বুঝতে পারা যায় : যেখানেই একটি প্রদত্ত পরীক্ষণ থেকে চিরায়ত নিয়মসূত্রসমুহ প্রয়োগের মাধ্যমে একটি সুনির্দিষ্ট ফল আহরণ করা যায়, সেখানেই কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকেও এই ফলাফল আসবে এবং পরীক্ষণগতভাবেও তা বজায় থাকবে।

ওয়েৎসেকার-এর প্রয়াসের প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে ভাষার উচ্চতর স্তরগুলিতেও সংশোধিত যৌক্তিক বিন্যাসগুলি প্রয়োগ করা; কিন্তু এসব প্রশ্ন এখানে আলোচনা করা যাবে না।

অপর সমস্যাটি সংশোধিত যৌক্তিক বিন্যাসগুলিতে নিহিত অধিবিদ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত। যদি জটিল সংখ্যাগুলির একটি জোড়া এইমাত্র বর্ণিত অর্থে একটি ‘বিবৃতি’র প্রতিনিধিত্ব করে, তাহলে প্রকৃতিতে এমন একটি ‘অবস্থা’ অথবা ‘পরিস্থিতি’র অস্তিত্ব থাকা উচিত যেটিতে বিবৃতিটি নির্ভুল। এই প্রসঙ্গের ক্ষেত্রে আমরা ‘অবস্থা’ শব্দটি ব্যবহার করব। পরিপূরক বিবৃতিসমূহের সঙ্গে প্রাতিসঙ্গিক ‘অবস্থাগুলি’কে তখন ওয়েৎসেকার ‘সহাবস্থিত অবস্থানসমূহ’ নামে অভিহিত করেন। এই ভাষিক শব্দ ‘সহাবস্থিত’ নির্ভুলভাবে পরিস্থিতি বর্ণনা করে; বস্তুত সেগুলিকে ‘ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা’ বলাও কঠিন হবে, যেহেতু প্রতিটি কিছুটা পরিমাণে অপর ‘সহাবস্থিত অবস্থানসমূহ’ও ধারণ করে। ‘অবস্থা’র এই ধারণা অতঃপর কোয়ান্টাম তত্ত্বের অধিবিদ্যা বিষয়ে একটি প্রথম সংজ্ঞা গঠন করবে। তাৎক্ষণিকভাবে দেখা যায় যে, ‘অবস্থা’ শব্দটির এই ব্যবহার, বিশেষত ভাষিক শব্দ ‘সহাবস্থিত অবস্থা’, প্রচলিত জড়বাদী অধিবিদ্যা থেকে এতই ভিন্ন যে, সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে একটি সুবিধাজনক পরিভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে কি না। পক্ষান্তরে, ‘অবস্থা’ শব্দটি যদি বাস্তবতার পরিবর্তে কোনো সম্ভাবনা তথা সুপ্তশক্তি বর্ণনা করছে বলে বিবেচনা করা হয় – তাহলে ‘সহাবস্থিত সম্ভাবনাসমূহ’-এর ধারণা বেশ সত্যাভাসরূপ (plausible), যেহেতু একটি সম্ভাবনা অন্যান্য সম্ভাবনাকে সংশ্লিষ্ট অথবা অধিক্রম (involve or overlap) করতে পারে।

এসব কঠিন সংজ্ঞা ও স্বাতন্ত্র্য পরিহার করতে পারা যায়, যদি ভাষাকে ঘটনা বা তথ্যাবলি বর্ণনার মধ্যে সীমিত রাখা হয়, অর্থাৎ পরীক্ষণগত ফলাফল। অবশ্য কেউ যদি পারমাণবিক কণাসমূহ সম্পর্কে কথা বলতে চান তাহলে তাঁকে হয় অবশ্যই স্বাভাবিক ভাষার একমাত্র পরিপূরক হিসেবে গাণিতিক পরিকল্প ব্যবহার করতে হবে অথবা অবশ্যই এমন এক ভাষার সঙ্গে সন্নিবিষ্ট করতে হবে যে ভাষা সংশোধিত যুক্তিবিদ্যার ব্যবহার করে না। পারমাণবিক ঘটনাবলি-সংশ্লিষ্ট পরীক্ষণগুলিতে আমাদেরকে বস্তুসমূহ ও তথ্যাদি এবং দৈনন্দিন জীবনের যে-কোনো প্রতিভাসের মতো প্রতিভাসগুলি নিয়ে কাজ করতে হয়। কিন্তু পরমাণুসমূহ অথবা প্রাথমিক কণাসমূহ নিজেরা তত বাস্তব নয়; তারা বস্তু বা ঘটনাসমূহের চেয়ে বরং সম্ভাবনাসমূহ বা সম্ভাব্যতাসমূহের একটি জগৎ গঠন করে।

*এই রচনাটি বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের ফিজিক্স অ্যান্ড ফিলোসফি বইয়ের দশম অধ্যায়ের বাংলা রূপান্তর।