আবুল হাসনাতের কথাসাহিত্য পর্যালোচনা : সতীনাথ ও মানিক

আবুল হাসনাতের মৃত্যুর পরপরই তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছিলেন যে, আবুল হাসনাত ‘সংস্কৃতির শক্তিতে বিশ্বাস করতেন এবং সেটা সেই সংস্কৃতি, যেটা আমাদের ভূমি থেকে উৎসারিত। যাকে আমরা বাঙালিয়ানা বলি – সেই গ্রামবাংলা থেকে উঠে আসা সংস্কৃতির তিনি একজন বড়মাপের বিশ্বাসী ছিলেন। (দৈনিক সমকাল, ৬ নভেম্বর, ২০২০)। সেই বিশ^াসের জোর থেকেই একজন সাহিত্য-সম্পাদক হিসেবে তিনি নিজেকে যেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে পৌঁছানো এখন যে-কারো পক্ষেই দুঃসাহসিক একটা ব্যাপার। কখনো-কখনো সেটা অসম্ভব বলেই মনে হয়। পাশাপাশি এটাও সত্যি যে, তিনি শুধুই একজন সাহিত্য-সম্পাদক ছিলেন না, তারচেয়েও আরো বেশি কিছু ছিলেন। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর গ্রন্থে ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে ‘স্পৃহণীয় অকৃত্রিমতা’ নামক দুর্লভ সদ্গুণের পরিচয় পেয়ে তাঁকে একজন ‘তাজা মানুষ’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। আবুল হাসনাত অবশ্যই বিদ্যসাগর নন, তিনি সেটা হতেও চাননি। তিনি সত্যিকার অর্থেই আবুল হাসনাতই হতে চেয়েছিলেন। তারপরও, আমরা যদি তাঁকে একজন তাজা মানুষ হিসেবে বর্ণনা করি, তাতে বিন্দুমাত্র সত্যের বরখেলাপ হয় না।

সম্পাদনার পাশাপাশি তিনি ‘মাহমুদ আল জামান’ নামে কবিতা লিখেছেন। নিজের নির্বাচিত কবিতার ভূমিকায় একেবারে অকপটে তিনি বলেছিলেন, ‘এতদিন ধরে কবিতা লিখছি। কিছু হচ্ছে কিনা কিছুই জানি না। কবিতা অধরা, সূক্ষ্ম, বহুমাত্রিক। একই কবিতা কতভাবে তো ব্যাখ্যা করা যায়। সেজন্য খুবই দ্বিধা নিয়ে এ বই বেরুল।’ তাঁর সেই দ্বিধার পাশাপাশি একজন আত্মসচেতন কবিসুলভ এই প্রত্যয়টিও বজায় রেখেছিলেন যে, ‘আমি জানি, কালের প্রবাহে বাংলাদেশের কবিতা-চর্চার ধারায় এতটুকুও দাঁড়াবার জায়গা নেই। সামান্য অভিঘাত সৃষ্টি করে চিৎকার আর উচ্চকণ্ঠে প্রতিষ্ঠার জমিতে অনেকের সরব উপস্থিতি ছিল প্রবল কিন্তু মহাকাল তাকে আর স্মরণ করে না। আমি বিশ^াস করি, কেউ কেউ কবি। সকলে কবি নয়।’ যার যা-ই হোক, আবুল হাসনাতের মধ্যে এমন আত্মবিশ^াসের কোনো অভাব ছিল না।

দুই

আবুল হাসনাতের কিশোর উপন্যাস ইস্টিমার সিটি দিয়ে যায়-এর শেষাংশ যদি পাঠ করি, আমরা দেখব সেখানে টুটুলের কথা এভাবে বলা হয়েছে – ‘টুটল খাট ধরে দাঁড়িয়েছে, টুটুলের পায়ের নিচে পদ্মার মতো তল নেই। প্রবল স্রোতের মতো গর্জন শোনা যাচ্ছে পদ্মায়, এই খাট, বীণা আপা, বন্ধু আহসান সব দূরে চলে যাচ্ছে।

‘বীণা আপার সেই কণ্ঠ, সেই স্বর, ‘জানো টুটুল … আমি বোধ হয় বাঁচবো না।’ অনেকক্ষণ পাড়ভাঙা পদ্মার স্রোতের মতন ছলছল গর্জন করে গেল, সে পদ্মার স্রোতের আছড়ে যাওয়া ঝুপঝুপ শব্দ শুনেছিল আর ভিটেমাটি-ছাড়া হয়েছিল। টুটুলের মনে হলো এ-গর্জনও তেমনি, ঝুপঝুপ শব্দ আর স্রোত যেন নদীর পাড় ভেঙে ভেঙে দিয়ে মহাসমুদ্রে চলে যাচ্ছে।

‘বীণা আপা সে স্রোতে ভেসে যাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে। সে স্রোতে টুটুলের ভেতরটা ধসে ধসে পড়ছে তাদের হালিশপুরের গ্রামের মতো।’

নিজের জীবনের বিভিন্ন পর্বে নানারকম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে আবুল হাসনাতকেও যেতে হয়েছে। নানা কারণে নানাভাবে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে, রাজনৈতিক জীবনে ঝড়ঝঞ্ঝা নেমে এসেছিল, কিন্তু তাই বলে জীবনের কাছে কখনো হার স্বীকার করেননি। বরং ভেতরের সামর্থ্য আর দীপ্তি নিয়ে তিনি জীবনের মুখোমুখি হয়েছেন, ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর ‘স্মৃতিমথিত’ আত্মকথা হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজের ভূমিকায় আন্তরিকতার সঙ্গেই পাঠকদের জানিয়েছিলেন, ‘আমার জীবন কোনো অর্থেই বর্ণময় নয়। সাধারণ ও আটপৌরে। তবে প্রত্যক্ষ করেছি এদেশের মানুষের সংগ্রাম ও বিজয়। এই বিজয় আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে বাঙালি সমাজকে স্বাজাত্যবোধে উদ্দীপিত করেছে। জাতীয় বিকাশ ও শিল্প ও সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রকে করে তুলেছে দীপিত। এ যে কত বড় অভিজ্ঞতা তা বলে শেষ করা যায় না।’ ঠিক সেই সূত্রেই তিনি আরো বলেছিলেন, ‘পুরনো আর্টস বিল্ডিংয়ের আমতলা, নতুন আর্টস বিল্ডিংয়ের বটতলা আর মধুর ক্যান্টিন এক সময়ে প্রাণভোমরা হয়ে উঠেছিল। এখানেই অনন্যসাধারণ কিছু ছাত্রনেতাকে দেখেছিলাম, প্রত্যয়ে দীপ্ত; ধমনিতে ধারণ করেছিলেন তাঁরা সমাজ বদলানোর অনিঃশেষ শক্তি, যে-কোনো ত্যাগের জন্য প্রস্তুত ছিলেন তাঁরা। জীবন ছিল সরল ও নিরাভরণ।’ নিজের রাজনৈতিক-সামাজিক চেতনা ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে বিশ্লেষণ করে এই ছাত্রনেতাদের সম্পর্কে এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছিলেন যে, ‘এঁদের অধিকাংশ এসেছিলেন গ্রামীণ কৌম সমাজ থেকে। গড়ে তুলেছিলেন প্রমত্ত ছাত্র আন্দোলন এবং দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সংযোগ রেখে দেশের রাজনৈতিক কর্মপ্রবাহে প্রবল ও তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি করেছিলেন। পৃথিবীর যে-কোনো যুবা ও ছাত্র আন্দোলনের মতো এর গুরুত্ব কম তাৎপর্যবাহী ছিল না। ষাটের দশক হয়ে উঠেছিল মুক্তির দশক।’

তাঁর এই পর্যালোচনা ষাটের দশক নিয়ে যাঁরা ভবিষ্যতে লিখবেন, গবেষণা করবেন, তাঁদের নানাভাবে নানান নতুন নতুন পথের সন্ধান দেবে বলে আমরা বিশ^াস করি। নিজের সম্পর্কে বেশ খোলামেলাভাবেই জানিয়েছিলেন, ‘যৌবনকালে সুধীন দত্তের মতো আমার মনে হয়েছিল, এ বিরূপ বিশে^ মানুষ নিয়ত একাকী; এ মত ও নিঃসঙ্গতা ঘুচিয়ে দিয়েছিল ছাত্র ও যুব বিদ্রোহ। বাম ছাত্রসংগঠনের কর্মী হয়ে-ওঠা ও একই সঙ্গে রাতে ‘সংবাদে’ চাকরি জীবনকে বহুভাবে অভিজ্ঞ ও সমৃদ্ধ করেছিল। মনন ও প্রজ্ঞায় উজ্জ্বল কত মানুষের যে সান্নিধ্য পেয়েছি চাকুরি ক্ষেত্রে তার তালিকা দীর্ঘ।’ এতকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে থাকার পরও আবুল হাসনাত তাঁর নিজের লেখালেখিতে আমৃত্যু সক্রিয় ছিলেন। এ-প্রসঙ্গে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছিলেন, ‘সম্পাদনার বাইরে হাসনাত যে গদ্য লিখতে শুরু করেন, সেখানেও তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর মেলে।’ আবুল হাসনাতের কৃতিত্বের কথা জানাতে গিয়ে তিনি আরো বলেন যে, সেইসব লেখা ‘নিয়ে পরবর্তী সময়ে বই প্রকাশিত হতে শুরু করে। তাঁর এই লেখাগুলিতে তিনি তাঁর সময়কে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন।’ এসবের পাশাপাশি আবুল হাসনাতের আরেকটি কৃতিত্বের কথা তুলে ধরতে তিনি কোনো ধরনের দ্বিধা করেননি। তাঁর মতে, আবুল হাসনাত ‘অত্যন্ত আবেগ নিয়ে লেখা শুরু করলেও তাকে নিয়ন্ত্রণও করেছেন’ (দৈনিক সংবাদ, ৫ নভেম্বর, ২০২০)। এই কথাগুলি মনে রেখে আমরা যদি আবুল হাসনাতের গদ্য কিংবা কবিতা, যা-ই বলি না কেন, পাঠ করতে শুরু করি, তাহলে পাঠকের দিক থেকে প্রতিহত হওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকে না। কেননা, একজন লেখকের জন্যে এটি কোনো দিক থেকেই কম দক্ষতার ব্যাপার নয়।

তিন

তাঁর প্রত্যয়ী স্মৃতি ও অন্যান্য গ্রন্থের ‘ভূমিকা’য় আবুল হাসনাত বলেছিলেন, ‘দীর্ঘদিন থেকে সম্পাদনা কাজে যুক্ত থাকবার ফলে নিজের লেখালেখি অব্যাহত রাখা ছিল কষ্টকর। যদিও বিভিন্ন সময়ে লিখেছি কোনো না কোনো জিজ্ঞাসা নিয়ে – প্রবন্ধ, স্মৃতি বা কখনো চিত্রকলা বিষয়ে প্রত্যক্ষণের সমীক্ষা ও কবিতা। সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে কত বিষয়ে যে জিজ্ঞাসা জাগে এ-বলে শেষ করা যায় না।’ সেইসঙ্গে এই বিষয়ে তাঁর প্রতি অন্যদের অনুরাগের কথাও তিনি স্নিগ্ধমনে জানিয়েছিলেন। আর সেই কারণেই তিনি বলেছেন, ‘অভিভাবকতুল্য কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান আপিসে এলেই বলতেন, সাংবাদিকতা ও নিত্যদিন অন্যের লেখা পাঠ করা মানেই হচ্ছে সৃজনশীল গদ্য নষ্ট করা ও লেখার উদ্যম হারিয়ে ফেলা। দেখা হলেই তিনি অনুপ্রাণিত করতেন লিখতে। সাংবাদিকতা সৃজনশীল উদ্যোগের ঘাতক – এমন মন্তব্য করতেন বুদ্ধদেব বসুও। তাঁদের উপরিউক্ত মন্তব্য যে কত যথাযথ সে-কথা অভিজ্ঞতা দিয়ে মান্য জ্ঞান করি।’ স্নেহভাজন নরেশ গুহকে লেখা এক চিঠিতে বুদ্ধদেব বসু সাংবাদিকতাকে সাহিত্যের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। সেই বিষয়টিও সাহিত্যের একজন বিনয়ী ছাত্র হিসেবে আবুল হাসনাত কখনো ভোলেননি।

চার

কবিতার প্রতি নানাভাবে সমর্পিত হয়েও আবুল হাসনাত কথাসাহিত্য নিয়ে তাঁর অনুরাগের কথা নানা জায়গায় ব্যক্ত করেছিলেন। উপন্যাস, বিশেষ করে মানিক-সতীনাথকে নিয়ে তাঁর একটি আলাদা ধরনের আগ্রহ ছিল। তাঁর লেখালেখিতেও এর নমুনা ছড়িয়ে আছে। রবিশঙ্কর মানিক সতীনাথ ও অন্যান্য (অয়ন প্রকাশন, একুশে বইমেলা, ২০১৬) গ্রন্থটি প্রধানত আমাদের কথাসাহিত্যসহ নানা বিষয়ে লেখকের ভাবনা নিয়ে লেখা প্রবন্ধের সংকলন। এটি ‘মাহমুদ আল জামান’ নামেই প্রকাশিত হয়। আবার, অন্যদিকে তাঁর আরেকটি প্রবন্ধের সংকলন প্রত্যয়ী স্মৃতি ও অন্যান্য (জার্নিম্যান, মে, ২০১৯) প্রকাশিত হয়েছিল Ñ ‘আবুল হাসনাত’ নামেই। ‘আবুল হাসনাত-মাহমুদ আল জামান’ নামদুটি পাঠকমহলে অনেক সময় লেখকের পরিচয় নিয়ে একধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করেছে – সে-কারণেই প্রসঙ্গটি এখানে তুলতে হলো আমাদের।

রবিশঙ্কর মানিক সতীনাথ ও অন্যান্য গ্রন্থের ‘ভূমিকার বদলে’তে তিনি বলেছিলেন, ‘এই প্রবন্ধগুলো নিয়ে বই বেরোবে তা কোনোদিন ভাবিনি এবং বইয়ের প্রস্তুতি নিয়ে এসব লেখা হয়নি।’ এইসব প্রবন্ধ রচনার নেপথ্যের কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘কারুর ব্যক্তিস্বরূপ আমার কাছে হয়ে উঠেছিল আকর্ষণীয়, কারুর সঙ্গ পেয়ে সাহিত্য ও শিল্পের অর্কেষ্ট্রার ধ্বনি বেজে উঠেছে আমার হৃদয়ে। এতে সাহিত্যের রুচি, ধারণা ও রূপকল্পের এক প্রতিমা গড়ে উঠেছে।’ আর সেইসঙ্গে তিনি তাঁর মনের কথাটিও গোপন রাখতে পারেননি, সরাসরি যেন পাঠকের কাছে এসে বলে গিয়েছিলেন, ‘সাহিত্য ছাড়া আমার কোনো দ্বিতীয় প্রেম নেই।’ সতীনাথ ভাদুড়ী ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে তিনি যে বিশ্লেষণ আর পর্যালোচনা করেছেন, সেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা তাঁর সেই প্রেমের চিহ্ন ছড়িয়ে যেতে দেখি।

পাঁচ

বিপ্লবী লেখক র‌্যালফ ফক্স (Ralph  Fox : 30 March 1900-28 December 1936) উপন্যাসকে আজকের আধুনিক, বর্ধিষ্ণু, বিকাশমান বুর্জোয়া সমাজের একটা মহাকাব্যিক শিল্পরূপ হিসেবে বিবেচনা করতেন। তাঁর মতে, ÔThe novel is the epic art form of our modern, bourgeois societyÕ-র পাশাপাশি তিনি সেই বুর্জোয়া সমাজের অবধারিত অবক্ষয়ের কথাও বলতে দ্বিধা করেননি। তিনি বলেছেন, ÔIt reached its full stature in the youth of that society, and it appears to be affected with bourgeois society’s decay in owr own time.’ অবক্ষয়ের এই বিষময় প্রতিক্রিয়া তিনি বলতে পেরেছিলেন এই কারণেই যে, ফক্স মার্কসবাদে আস্থা স্থাপন করেছিলেন। আর সমাজের ভেতরকার চেহারাটা মার্কসবাদীরা যতটা দেখতে পান, অন্য কারো পক্ষে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এরই সূত্র ধরে তাঁর এটি বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, ‘The novel deals with the individual.’

মোটের ওপর উপন্যাসের কারবার ব্যক্তি-মানুষ নিয়ে। ফক্সের কথাগুলি আমাদের কাছে আজ মোটেও নতুন বা অভিনব বলে মনে হবে না। কেননা, বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক প্রয়াত দেবেশ রায় সেই কথাগুলিকেই অনেকটা নিজস্ব ধরনে আর অভিজ্ঞতার আলোকে এইভাবে বলেছিলেন, ‘উপন্যাসের অন্বিষ্ট সমাজ নয়, সময় নয়, ইতিহাসও নয়।’ তাহলে উপন্যাসের অন্বিষ্ট কী? এর উত্তরে দেবেশ রায় বহু আগে বলে-যাওয়া ফক্সের কথার প্রতিধ্বনি তুলেই উত্তর দিয়েছিলেন, ‘উপন্যাসের অন্বিষ্ট ব্যক্তিমানুষ।’ ফক্সের মতো তিনিও বিশ^াস করতেন, আজ মানুষ ও তার সমাজের মধ্যে ভারসাম্যের বোধটাই নষ্ট (the balance between man and society was lost) হয়ে গেছে। আর তাই তো দেবেশ রায় বলেছিলেন, ‘মানুষের সংজ্ঞা বারবারই নতুন করে খুঁজতে হয়। … মানুষকে খুঁজতে গিয়ে এই সমাজ, সময় আর ইতিহাসকেও খুঁজতে হয়। সমাজ, সময় আর ইতিহাসধৃত ব্যক্তিমানুষ হচ্ছে উপন্যাসের বিষয়’ (উপন্যাস নিয়ে, জানুয়ারি, ১৯৯১)। এই কথাগুলি নানাভাবেই সত্যি হয়ে ওঠে সতীনাথ ভাদুড়ী আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে। সত্যের সেই প্রোজ্জ্বল অংশটুকু, আজকের দিনে পাঠকের সঙ্গে, আরেকবার নতুন করে দেখতে চেয়েছেন আবুল হাসনাত। আর সেইসঙ্গে করেছেন কিছু সাহিত্যিক-পর্যালোচনা আর পাঠ-বিশ্লেষণ; যা সীমিত আকারে হলেও, পাঠককে প্রাণিত করে।

ছয়

জাগরী উপন্যাসটি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বাংলা উপন্যাসের আরেক ব্যক্তিত্ব তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় অনেকটা সমীহ নিয়ে সতীনাথ ভাদুড়ীর কৃতিত্ব বিষয়ে বলেছিলেন, ‘কালের হিসাবে স্বল্পকালেরই সাধনা তাঁর। কিন্তু তা একান্ত উজ্জ্বল, আপন স্বকীয়তায় একান্ত বিশিষ্ট।’ সতীনাথ বিষয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গিয়ে তিনি দৃষ্টান্ত দিয়ে উল্লেখ করেছিলেন, ‘সতীনাথের প্রথম রচনাই তাঁর সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য রচনা। হয়তো শ্রেষ্ঠতম রচনাও।’ এই ভূমিকাটুকু শেষ করেই তারাশঙ্কর আরো বলেন, ‘বইখানি [জাগরী] পড়ে চমকে গেলাম। একেবারে নূতন কথা, নূতন সুর, নূতন সব মানুষের ভীড়, একেবারে সম্পূর্ণ নূতন মনোভাব। লেখকের অপরিচিত নাম, কিন্তু রচনার অভাবিত উৎকর্ষ। চমক লাগলো। সম্পূর্ণ নূতন কাল, প্রায় সমসাময়িক কাল নিয়ে রচনা। অথচ রচনাটির সর্বাঙ্গে অভ্রান্তভাবে কালাতীত সাহিত্যকর্মের ছাপ। এ যে লেখকের নিজের চোখ দিয়ে, মন দিয়ে দেখা জীবন তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই’ (সতীনাথ স্মরণে, পরিমার্জিত সংস্করণ, জানুয়ারি, ২০১৩)। অন্যদিকে, গোপাল হালদারের মতো সাহিত্য-সমালোচক সে-কারণেই হয়তোবা সতীনাথের উপন্যাসে ‘আধুনিক মানুষের পরম যন্ত্রণাময় সংকটের মধ্য দিয়ে’ ঔপন্যাসিকের সাহিত্য-সাধনার স্বরূপখানা বুঝে নিতে চেয়েছিলেন। আর সে-কারণেই তাঁর মনে হয়েছিল যে, এই উপন্যাসে সতীনাথ জেলের ভেতরে-বাইরের নানান ধরনের মানুষকে ‘বিভিন্ন আদর্শ, বিভিন্ন উদ্দেশ্য, প্রত্যেকের নিজ নিজ আশা-আকাক্সক্ষা, সুখ-দুঃখ – ‘এইসব সূত্রে আন্দোলনের [১৯৪২-এর আগস্ট আন্দোলন] ব্যাপ্তিকেও অনুভবগম্য করে তোলে’ (সতীনাথ ভাদুড়ী : সাহিত্য ও সাধনা, জানুয়ারি, ১৯৭৮)। আর সেই উৎসারণ থেকেই ‘বাইরের ও অন্তরের দুই বস্তুতে মিলে কথাবস্তু ও ভাববস্তুর দুই মিলিতরূপ – সেই চারটি চরিত্রের [মা-বাবা-বিলু-নীলু] এক রাত্রির কথা মহাকাব্যের ইঙ্গিতবহ অখণ্ড এক কথাকাব্য’ হিসেবে সার্থক চেহারা পেয়ে যায়। আর এঁদের বক্তব্যকে মান্যতা দিয়ে আবুল হাসনাতের মনে হয়েছে যে, রাজনৈতিক সংঘাত, আগস্ট আন্দোলন ‘একটি পরিবারকে কীভাবে আলোড়িত করেছিল তারই বিস্তৃত চিত্র অঙ্কিত হয়েছিল ‘জাগরী’ উপন্যাসে।’ ব্যক্তিকে অবলম্বন করে রচিত হলেও এই উপন্যাসটিকে তাঁর মনে হয়েছে ‘আগস্ট আন্দোলন ও গান্ধীবাদের … উল্লেখযোগ্য রেখালেখ্য।’

ছয় (দুই)

সতীনাথের ঢোঁড়াই চরিত মানস উপন্যাসটিকে সমালোচক নারায়ণ চৌধুরীর কাছে মনে হয়েছিল, ‘সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের, ভিন্ন স্বাদের বই। এক কথায় এটিকে বলা যেতে পারে বিহারের লোকজীবনের কথাকাহিনী।’ সেইসঙ্গে তিনি এটিও বলেছিলেন, ‘‘জাগরী’র সঙ্গে এ বইয়ের প্রায় কোনো মিল নেই, একমাত্র মিল আছে ‘জাগরী’তে যেখানে-যেখানে দেহাতিদের কথা এসেছে, সেখানটার সঙ্গে এ বইয়ের গোটা চরিত্রের। ফলত এটিকে উপন্যাস বললে কমই বলা হয় অথবা ঠিক-ঠিক বলা হয় না; বলা উচিত ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ হল উত্তর-পূর্ব বিহারের লৌকিক জীবনের একটি নাতিবৃহৎ ‘সাগা’।’ তারপরও কিন্তু নারায়ণ চৌধুরী এই উপন্যাসটির সার্থকতা নিয়ে বেশ খানিকটা সন্দিগ্ধ ছিলেন; সে-কারণেই তিনি বলেছিলেন, ‘উপন্যাস হিসেবে ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ কতটা সার্থক হয়েছে বলা কঠিন, তবে এটি যে চারিত্র্যলক্ষণে একটি অসাধারণ গ্রন্থ সে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই। বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে এ বই বাংলা সাহিত্যে তুলনাহীন’ (সতীনাথ স্মরণে : পূর্বোক্ত)। সমালোচকের এই কথাগুলিকে আজ আর অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

ছয় (তিন)

র‌্যালফ ফক্স যেমন বলেছিলেন, ‘বাস্তবকে বুঝতে গেলে, জানতে গেলে সত্যানুসারী জ্ঞানের এক তত্ত্ব প্রয়োজন, তাঁর মতে, ‘Truth is not abstract and notionless … Truth can only be reached through practical activity.’ আমরা জানি যে, বাস্তবে সতীনাথ ভাদুড়ী কিন্তু মোটেও মার্কসের অনুসারী ছিলেন না, এমনকি মানিকের মতো কমিউনিস্টও তিনি ছিলেন না। বরং তাঁদের কাছ থেকে নিজেকে একটু আড়ালই করে রাখতেন; কেননা তিনি মনে করতেন, ‘ওদের তো সবই ভাল কিন্তু regimentation মেনে নিতে মন সায় দেয় না।’ আর তাই বাস্তবের এবং ‘সময়ান্বিত মানুষের অন্বেষণ’-এর মধ্যে দিয়েই তিনি সত্যের কাছাকাছি হাজির হতে চেয়েছিলেন।

‘ঢোঁড়াই’ সম্পর্কে সতীনাথ আমাদের জানিয়েছিলেন, ‘তাতমাটুলিতে ঢোঁড়াই নামে একজন লোক সত্যিই ছিল।’ আর সে-প্রসঙ্গ ধরেই আরো অগ্রসর হয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘বহু মূর্তিতে আমি ঢোঁড়াইকে দেখেছি। তাকে ভিক্ষা করতে দেখেছি, ঘর ছাইতে দেখেছি, গরুর গাড়ি চালাতে দেখেছি। ইদানীং সে হয়েছিল রাজমিস্ত্রি-ঠিকাদার।’ এসবের পাশাপাশি সতীনাথ ভাদুড়ীর মনে হয়েছিল, ‘এ যুগে শ্রীরামচন্দ্র নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের মধ্যে। এখানেই হল ঢোঁড়াই-রামের আবির্ভাব আমার মনে। এ যুগে মহাকাব্য অচল কি না, সে প্রশ্ন আমার কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছিল। কেননা আমার কাজ ছিল শুধু পুরনো মহাকাব্যের ফ্রেমে ঢোঁড়াই-রামকে বাঁধানো।’ শুধু এইটুকুই নয়, তিনি আরো চেয়েছিলেন, ‘চেনা ঢোঁড়াইকে এমনভাবে বদলানো যাতে সে সারা দেশের সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। তাদের প্রতিবেশের পূর্ণতম সম্ভাবনাটুকু, তার চরিত্রের মধ্যে দিতে হবে।’ (সতীনাথ রচনাবলী, চতুর্থ খণ্ড, মাঘ ১৪২০)। এখানেও দেখতে পাই, সতীনাথের এসব মন্তব্যকে মান্যতা দিয়েই আবুল হাসনাত বলেছিলেন, এই উপন্যাসের প্রথম খণ্ডে ‘তাৎমাদের জীবন নিখুঁত ও বাস্তবভাবে রূপায়িত হয়েছে।’ সেইসঙ্গে উপন্যাসের চরিত্রগুলো যে নানান মাত্রায় ও গভীরতা নিয়ে ‘উন্মোচিত ও পরিবর্তিত হয়েছে’ সেইদিকেও আবুল হাসনাতের দৃষ্টি একেবারে এড়িয়ে যায়নি।

ছয় (চার)

সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর একটি লেখায় সতীনাথ ভাদুড়ীকে ‘লেখকদের লেখক’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এইটা মেনে নিয়েও, আবুল হাসনাত, তাঁর প্রবন্ধের শেষাংশে এসে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘সতীনাথ ভাদুড়ী ব্যাপকার্থে বাঙালির মননচর্চায় কি বড় ধরনের অভিঘাত সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন?’ তিনি নিজেই এর উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বোধকরি না।’ কেন এমনটি মনে হয়েছিল তাঁর? এ-প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘এক সময়ে বলা হতো, সতীনাথের রচনাবলি দুর্লভ; পাওয়াই যায় না। সেজন্যে বিস্মৃতপ্রায় সতীনাথ ভাদুড়ীর সমগ্র রচনাকে চারখণ্ডে গ্রথিত করে শঙ্খ ঘোষ ও নির্মাল্য আচার্য বৃহৎ দায়িত্ব পালন করেছিলেন।’ তিনি অনেকটা ব্যথিত মনে নিজের উপলব্ধিকে এইভাবে প্রকাশ করেছেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম, এই চারখণ্ডের মধ্যে দিয়ে বাঙালি নবীন-পাঠক সতীনাথ ভাদুড়ীকে পুনরাবিষ্কারে প্রভূত আনন্দিত হবেন ও সতীনাথ-চর্চা নতুন মাত্রা লাভ করবে। বাংলা সাহিত্যে সতীনাথ ভাদুড়ীর আসনটি হয়ে উঠবে মর্যাদার’, কিন্তু বাস্তবে তা আদৌ হয়নি। এর পাশাপাশি তিনি পর্যালোচনার চেষ্টা করেছেন সতীনাথ ভাদুড়ীর সামগ্রিক সাহিত্যকীর্তিকে। তাঁর ভাষ্যমতে, ‘সতীনাথ ভাদুড়ী বাংলা উপন্যাসে সৃষ্টির ধ্যানে, বোধে, শিল্পিত সাধনায় এবং নিজেকে সাহিত্যসাধনায় প্রস্তুত করবার জন্য যেভাবে পঠন-পাঠনে নিমগ্ন হয়েছিলেন, তার কোনো তুলনা নেই। উপন্যাসের নতুন প্রকরণ নির্মাণ করেছেন তিনি। প্রচলিত ধারা থেকে সরে এসে অসাধারণ দুটি উপন্যাসে যে-জীবনকে উপজীব্য করেছেন, বাংলা সাহিত্যে তা বিশিষ্ট হয়ে আছে।’ কিন্তু সেইসঙ্গে তাঁর দুঃখবোধটুকুও তিনি অপ্রকাশিত রাখতে পারেননি, সে-কারণেই বলেছিলেন, ‘তাঁকে [সতীনাথ ভাদুড়ী] নিয়ে উপন্যাসের ইতিহাসে বড় রকমের কোনো উল্লেখ নেই। জ্ঞানী আলোচকরা তাঁর সৃষ্টি নিয়ে খুবই কুণ্ঠিত আলোচনা করেন। তাঁর জন্মের শতবর্ষও চলে গেল প্রায় নীরবে এবং নিঃশব্দে।’ নিজেই নিজেকে যেন প্রশ্ন করেছেন, ‘এ কি এজন্য যে, বাংলা সাহিত্যের বুধমণ্ডলীর মঞ্চ থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন তিনি। কিংবা এও তো বলা যায়, তাঁর জীবনসাধনা ও সাহিত্যচর্চার প্রবণতার মধ্যেই নিহিত ছিল এই নিঃসঙ্গ থাকার অঙ্গীকার।’ ঔপন্যাসিক সতীনাথের সামগ্রিক মূল্যায়ন যেভাবে তিনি পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করেছেন, তা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তথাকথিত পণ্ডিতি কায়দায় নয়, বরং একজন উত্তরসূরি হিসেবেই সতীনাথের বিশিষ্টতাগুলিকে আবুল হাসনাত পর্যালোচনার চেষ্টা করেছেন।

সাত

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবুল হাসনাত তাঁর প্রবন্ধের শুরুতেই বলেছেন, ‘বাংলা সাহিত্যে বাস্তববাদী ধারা এবং সত্যিকার অর্থেই সংগ্রামী ও নীতিনিষ্ঠ শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিকের নাম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। মানুষের মনের গহন অন্ধকার রূপায়ণের আশ্চর্য রূপকারও বটে।’ আর এরই সূত্র ধরে তিনি আরো খানিকটা স্পষ্টভাবেই জানিয়েছেন, এই ‘কালজয়ী ঔপন্যাসিক … সূক্ষ্ম ও তীক্ষè অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা দরিদ্র নিরন্ন মানুষের অন্তরের ছবি এঁকেছিলেন তাঁর সৃষ্ট গল্প আর উপন্যাসে। মধ্যবিত্তের ভাঙন, দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্তের জীবনচিত্রণ তাঁর কলমে বিশ^স্তভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে এই রূপায়ণ চিত্রণ বিরল বিষয় হয়ে উঠেছিল’ (পৃ ৪৬)। এখানে প্রশ্ন উঠবে, তাহলে লেখক হিসেবে মানিকের স্বকীয়তা ঠিক কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তরে তাৎক্ষণিকভাবেই বলতে পারি, একজন সাহিত্যিকের কাছ থেকে আমরা শৈল্পিক নির্বিকারত্ব ও নিরপেক্ষতা আশা করি, আর সেইসঙ্গে এই প্রত্যাশাও আমাদের থাকে যে, তিনি যেন সেই নিরপেক্ষতায় ভর দিয়ে বাস্তবতার সমগ্রতাকে ধরার চেষ্টা করেন। মানিক তাঁর পাঠকের সেই শিল্পিত চাহিদাকে অনেকটা ‘নিরাসক্তভাবে’ পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

মানিকের এই সক্ষমতার কার্যকারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবুল হাসনাতের মনে হয়েছিল যে, মানিকের মধ্যে ‘জীবনকে নিরাসক্তভাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল। সেজন্য বাস্তবের রূপায়ণে তিনি শুধু তুষ্ট হননি, বাস্তবের অন্তরালবর্তী সত্যেরও সন্ধানী হয়ে উঠেছিলেন। একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ক্ষুধা, জীবনসংগ্রাম ও আকাক্সক্ষা প্রতিফলনের এক সিদ্ধহস্ত কথাসাহিত্যিক।’ আবার এ-ও তো সত্যি যে, আবুল হাসনাতের ভাষায়, ‘জীবদ্দশায় নানা বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছিলেন তিনি।’ সেই বিতর্কের কারণ খানিকটা সাহিত্যিক আবার তার মধ্যে খানিকটা রাজনীতিও প্রচ্ছন্নভাবে রয়েছে। প্রাবন্ধিকের ভাষ্যমতে, মানিক তাঁর ‘সাহিত্যজীবনের প্রথম পর্বে ফ্রয়েডীয় বিশ্লেষণে আচ্ছন্ন ও তাড়িত হয়েছেন। অথচ কোনোভাবেই মনস্তাত্ত্বিক বিষয় বিশ্লেষণ তাঁর প্রধান বিষয় ছিলো না। মানুষের মন নিয়ে কারবার করেছেন বলেই এক অন্তর্দৃষ্টি তাঁর গড়ে উঠেছিল।’ এটি যেমন সত্যি, তেমনি আবার এ-ও তো ঠিক যে, আবুল হাসনাতের মতে, ‘১৯৪২ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার পর মার্কসবাদী বাস্তববাদকে অবলম্বন করে তাঁর সৃষ্টি আবর্তিত হয়েছে।’ যে-কারণে মানিকের ‘প্রাক-কমিউনিস্ট পর্বের সৃষ্টিতে কেউ কেউ খাপছাড়া, উৎকেন্দ্রিক, এলোমেলো, ইঙ্গিতময় জীবন দর্শনকে প্রত্যক্ষ করেছেন আর দ্বিতীয় পর্বে অনেকে দেখেছেন বাস্তবতার প্রতিবিম্বনে নগ্ন উদ্দেশ্যবাদ।’ আর শুধুমাত্র এইসব কারণেই ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা কথাসাহিত্যে এক বিস্ফোরক, প্রচল ছেঁড়া প্রতিভা হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে নিয়ে নানা সময়ে বিতর্কের জন্ম হয়েছে। তাঁর প্রতিভার অবমূল্যায়নও কম হয়নি।’

এইখানে এসে আমাদের দেবেশ রায়কে মনে পড়ে যায়। তিনি এ-বিষয়ে বলেছিলেন, ‘একজন সৃষ্টিকর্মীর সারা জীবনের কাজ একটা সমগ্রতায় আমাদের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার পরও সেই সমগ্রতাকে আমরা নানা ছোট-ছোট ভাগে আবার টুকরো-টুকরো করে নিতে যে চাই, সে তো ঐ সমগ্রতার ধারণাটা আছে বলেই।’ আর সেই ‘সমগ্রতার ধারণা না থাকলে ঐ ছোট-ছোট টুকরোগুলো হয়ে ওঠে ঐ সৃষ্টিকর্মীর সমগ্রতার বিরোধী। আর তার ফলে সেই টুকরোগুলো একটা স্বাতন্ত্র্যও পেয়ে যেতে পারে – যেন ঐ টুকরোটা সমগ্রের চাইতে বড়।’ মানিকের মতো একজন বড়ো মাপের লেখকের রচনায় ওই সমগ্রতার সন্ধান করতে এসে দেবেশ রায়ের মনে হয়েছিল, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বোঝার জন্যে এই পর্বচিহ্নের জটিলতা যে-সবচেয়ে বেশি ঠেকে তার একটি কারণ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ নেওয়ার মত বাস্তব একটি রাজনৈতিক ঘটনা দিয়ে তাঁর নিজের জীবনের পর্বান্তরকে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন ও আমরা সেই পর্বান্তরচিহ্ন তাঁর সাহিত্যে খুঁজে নিতে চেয়েছি। যদি সেই পর্বান্তর তাঁর গল্প-উপন্যাসেও নাটকীয়ভাবে উচ্চকিত থাকত … তাহলে হয়তো তাঁর জীবনের পর্বান্তরকে সাহিত্যের পর্বান্তরে বুঝে নিতে আমাদের কোনো অসুবিধে হত না।’ আর তাঁর যুক্তির পক্ষে প্রমাণ রাখতে গিয়ে দেবেশ রায় আরো বলেছিলেন, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কমিউনিস্ট হওয়ার আগেই এমন অনেক গল্প-উপন্যাস লিখেছেন যা তিনি কমিউনিস্ট হওয়ার পরে লিখতে পারতেন বা কমিউনিস্ট হওয়ার পরেও তিনি এমন গল্প-উপন্যাস লিখেছেন যা তিনি কমিউনিস্ট হওয়ার আগে লিখতে পারতেন, এইরকম একটা ধারণা আমাদের বিব্রত করে আসছে’ (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় : নিরন্তর মানুষ, পৌষ, ১৪১৬)। কমিউনিস্ট পার্টিতে মানিকের যোগ দেওয়াকে, আমাদের সাহিত্যের অনেক ‘দিকপাল’ সমালোচকও যে ভালোভাবে মেনে নিতে পারেননি, দেবেশ রায় সেটি ঠিকই ঠারে-ঠোরে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।

সাত (দুই)

কমিউনিস্টদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণে, শুধুই যে মানিকের বেলায় যে এমনটি ঘটেছে তা নয়। বরং, দেশ-বিদেশের আরো অনেকের বেলায় সেটি আমরা নানা সময়ে আর নানাভাবে দেখতে পাই। ম্যাক্সিম গোর্কির মৃত্যুর পরে লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক স্মরণসভায়, এই প্রসঙ্গের উল্লেখ করে র‌্যালফ ফক্স গোর্কিকে ‘one of the greatest of the imaginative writers of our time’ (আমাদের সময়ের মহান চিন্তাশীল লেখকদের অন্যতম) হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। ফক্সও খেয়াল করেছিলেন যে, পশ্চিমের অনেক সাহিত্য-সমালোচকই গোর্কির বলশেভিকদের সঙ্গে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারটি ঠিক স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। ফক্সের ভাষায় – ÔThe critics say that politics destroyed Gorki.Õ পশ্চিমা সমালোচকদের এই সমালোচনা মানতে একেবারেই নারাজ ছিলেন ফক্স, সে-কারণে তিনি বেশ জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, ÔGorki’s creative work since 1917, both in quality and quantity, would compare favourable with any other european writer’s.

গোর্কির মতো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেবার পরে একই অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। সেই অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে দেবেশ রায় পরবর্তী সময়ে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গল্পকার ও ঔপন্যাসিকদের অন্যতম এই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কখনোই ব্যক্তির বিকাশের সংকট ছাড়া কোনো আখ্যান লেখেন না।’ সেইসঙ্গে এটিও তিনি বিস্তারে গিয়ে জানিয়েছিলেন যে, ‘ঐ মাপের লেখকরা যেমন অপ্রমেয় শক্তিতে অভ্রান্ত মাপতে পারেন, তাঁদের তৈরি ব্যক্তিদের সময়বাধ্য বিকাশগতি, মানিকও সেই শক্তিতেই জেনেছিলেন, কলোনির কোনো ব্যক্তি থাকে না, কলোনি কেবলই এক সত্তাহীন অস্তিত্ব, জড়পিণ্ডেরই মত, অন্য কোনো শাসকশক্তির প্রয়োজন ও ইচ্ছায় সেই জড়পিণ্ডেরই ভিতর কিছু ভঙ্গি কখনো-কখনো তৈরি হয়, যাকে জীবনের চিহ্ন মনে হতেও পারে, বা ইচ্ছে করে তেমন ভুল দেখাও যেতে পারে’ (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় : নিরন্তর মানুষ, পূর্বোক্ত)। মানিকের যে-সামর্থ্যকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন দেবেশ রায়, সেটি থেকে এ-প্রত্যয় আমাদের আরো দৃঢ় হয় যে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর সময়ের তুলনাহীন একজন কথাসাহিত্যিক।

সাত (তিন)

মানিকের অকালমৃত্যু আবুল হাসনাতের কাছে ‘এক ট্র্যাজেডি’ বলেই মনে হয়েছিল। তাঁর মতে, এই ট্র্যাজিক মৃত্যুর কারণ মানিক নিজেই। সেইসঙ্গে তাঁর এটিও মনে হয়েছে, এইরকম মৃত্যুর জন্যে মানিকের ‘পরিপাশের্^র উদাসীনতা ও অবহেলা কম দায়ী নন।’

শেষ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে মানিকের অবদানটা ঠিক কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তরে আবুল হাসনাত জানিয়েছিলেন, ‘ষাটটি অসাধারণ গ্রন্থের রচয়িতা জীবনের অবক্ষয়ী ব্যাধির বীজাণু খুঁজেছেন নৈষ্ঠিক বিজ্ঞানীর মতো।’ আর সেইসঙ্গে মানিক ‘সকল রকম ভাবালুতাকে পরিহার করে সাধারণ মানুষকে নিয়ে যে-ভুবন সৃষ্টি করে গেছেন কিংবা ভদ্রতর সমাজের মূল্যবোধকে যেভাবে ব্যঙ্গ ও প্রশ্নে জর্জরিত করেছেন, বাংলা সাহিত্যে এর মূল্য অপরিসীম এবং তিনি স্বয়ংসিদ্ধও বটে।’ এই বক্তব্যের পাশে আমরা দেবেশ রায়কে রাখতে পারি। দেবেশ রায়ের মতে, ‘‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ যদি শশীর দ্বিধাদীর্ণতারই কাহিনীমাত্র হত, যদি সেই দ্বিধাদীর্ণতা আমাদের দেশ ও সমাজের প্রায়-রূপকও হত, তাহলেও, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ মহৎ সৃষ্টি হত।’ কিন্তু তারপরও, দেবেশ রায়ের মতে, ‘‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ যে সেই মহতের চাইতেও মহত্তর, তার একমাত্র কারণ, উপন্যাস-রচনার প্রথাগত শৃঙ্খলাতেই মানিক তৈরি করেছেন একটি গ্রাম, গাওদিয়া, যা ব্রিটিশ ভারতের যে-কোনো গ্রামই হতে পারে বটে কিন্তু নির্ভুল স্থানাঙ্কে গাওদিয়াই। শশী-কুসুমের সম্পর্কের অমীমাংসকে এ-উপন্যাসের প্রধান গল্প ভাবা, আমাদের কলোনিমানসের অমীমাংসা-বিলাস’ (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় : নিরন্তর মানুষ, পূর্বোক্ত)। তাৎক্ষণিকভাবে বিবেচনায় আনলেও এই সিদ্ধান্ত থেকে আজকের পাঠকের পক্ষে সরে আসা কঠিন।

সাত (চার)

মানিকের জীবনের অন্তিম পর্বের ট্র্যাজিক পরিণতির দিকে খেয়াল রেখেই তাঁর অপ্রকাশিত ডায়েরির সম্পাদক যুগান্তর চক্রবর্তী বলেছিলেন, ‘জীবন এবং আদর্শের ভারসাম্য তখনই নষ্ট হয়ে যায় … কল্পনার সঙ্গে [যখন] বাস্তবের সামঞ্জস্য থাকে না, স্বাভাবিকতার সঙ্গে ঔচিত্যের বিচ্ছেদ ঘটে; জীবনের এই সর্বাত্মক সংকট থেকে জীবনের সংজ্ঞা নির্ণয় করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।’ (অপ্রকাশিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ফাল্গুন, ১৩৯৬)। আর কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সে-কারণেই সম্ভবত, ‘তাঁর অস্তিত্বের এই সামগ্রিক সংকট থেকেই জীবনের দিকে তাকিয়ে আবিষ্কার করেন রোগাক্রান্ত, মরণাপন্ন, চিকিৎসার-অতীত এমন এক সমাজ ও সময়, বিজ্ঞানের আশীর্বাদ পর্যন্ত যেখানে ব্যর্থ; নিজেকে আঘাত করাই যখন চৈতন্যের একমাত্র ধর্ম; আত্মহনন যেখানে আত্মদর্শনের নামান্তর।’ বলা যায়, সেই দিকটিতে লক্ষ করেই যুগান্তর চক্রবর্তীর আরো মনে হয়েছিল, ‘ঔচিত্যের সঙ্গে স্বাভাবিকতার বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে বাস্তবতার এক সর্বাত্মক সংকট তাই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যে অনিবার্য হয়ে ওঠে।

১৯৩৬-এর শেষভাগ থেকে ১৯৪৪-৪৫, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যের এই ন-দশ বছরের সময়কালকে আমরা বাস্তবতার সংকটকাল নামে চিহ্নিত করতে পারি।’ তাঁর বক্তব্যকে আরো খানিকটা স্পষ্ট করতে গিয়ে যুগান্তর চক্রবর্তীকে সংগতভাবেই বলতে হয়েছিল, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডায়েরি পড়ে যদি কারো মনে হয়, শেষ জীবনের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ঘোষিত বিশ^াস বা প্রকাশ্য আদর্শের বিপক্ষে, তবে এ-ও মনে রাখা দরকার, একই সময়কালের গল্প ও উপন্যাসে, তাঁর শেষতম রচনায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কখনোই তাঁর সমগ্র লেখক-চরিত্র ও জীবনচর্যার বিপক্ষতা করেন না।’ আর তাঁর বক্তব্যের একেবারে শেষে এসে যুগান্তর চক্রবর্তী এ-ধরনের ‘চরম কথা’ বলতে বাধ্য হন যে,  ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকে ভুলে থেকে বা উপেক্ষা করে, একমাত্র তাঁর ডায়েরির লেখাকেই যাঁরা কোনোভাবে ব্যবহার করতে চান, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্টতই তাঁদের লেখক নন।’ আমাদের মনে পড়ে যে মানিক নিজেও বিশ^াস করতেন যে, ‘বুদ্ধি আর সমগ্র চেতনার মিলেমিশে কাজ করার এই প্রক্রিয়া যিনি ঘটাতে পারেন না তার পক্ষে খাঁটি শিল্পী বা সাহিত্যিক হওয়া সম্ভব নয়।’ আবুল হাসনাতকেও তাই বলতে হয়েছে, মানিকের ‘ব্যক্তিত্ব, মনীষা আর সাম্যবাদে অঙ্গীকার যেভাবে গড়ে উঠেছিল তাতে এই বিধ্বংসী হয়ে ওঠা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না কিংবা বলা যায় এই স্বেচ্ছামৃত্যুর হিসেব মেলে না।’

এতোটা বলার পরেও, আবুল হাসনাত এটি মেনে নিয়েছিলেন যে, মানিকের অন্তত আর যাই হোক, ‘নিজের সৃজনী শক্তিমত্তা নিয়ে … এতটুকু সংশয় ছিলো না।’ আর ছিল না বলেই নিজেকেও তিনি জীবনের শেষ মুহূর্তেও অতিক্রমণের চেষ্টা করেছেন। বলতে পারি যে, এইরকম দৃষ্টান্ত আমাদের সাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি নেই।

আট

আবুল হাসনাত যেভাবে দুইজন শক্তিমান কথাসাহিত্যিকের কৃতিত্বকে বিশ্লেষেণ করেছেন, পর্যালোচনা করেছেন – সেই দৃষ্টান্ত থেকে তাঁর সমালোচনা-কর্মের সামর্থ্যরে বিষয়টি আমরা নতুন করে আবারো বুঝে নিতে পারি। হয়তো নিজেদের অবহেলায়, এই বিষয়টির দিকে আমাদের নজর, বেশিরভাগ সময়ই, এড়িয়ে গেছে। আর সেইসঙ্গে এটিও তো অস্বীকার করার উপায় নেই, আবুল হাসনাত সবসময়ই খ্যাতি-ক্ষমতা – এইসব বিষয়কে সাধ্যমতো এড়িয়ে চলেছেন। কেননা, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মতো তিনিও আত্যন্তিকতায় বিশ^াস করতেন যে, ‘খ্যাতি, ক্ষমতার মতোই [মানুষের] বাস্তববুদ্ধিকেও নড়বড়ে করে দেয়। তার সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনের ওপর তৈরি করে ভয়ংকর চাপ।’ নিজের ধরনে নিজের একান্ত নিঃসঙ্গতা বয়ে চলার সক্ষমতা দিয়ে, সেইসব চাপকে, আবুল হাসনাত দারুণভাবে সামলে নিতে পেরেছিলেন।

নয়

তাঁর সেই সামাল দেওয়ার চলনটাকে যথাযথভাবেই সম্মান জানিয়ে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘হাসনাত ভাইয়ের কাছে কোনো-না-কোনোভাবে ঋণী নন, এমন মানুষের সংখ্যা কম। এই ঋণ তাঁদের চিত্তবান করেছে।’ আর সেই বক্তব্যের রেশটুকু টেনে নিয়ে গিয়ে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পেরেছিলেন, ‘হাসনাত ভাইয়ের তুলনা চলে বাতাসের সঙ্গে। যত দিন তিনি ছিলেন, তাঁর অভাবের প্রশ্ন আসেনি, যেন তাঁর থাকাটাই স্বাভাবিক। এখন তিনি নেই, তাঁর অভাবটা প্রতিদিন আমরা অনুভব করব।’ (দৈনিক প্রথম আলো, ৭ই নভেম্বর, ২০২০)। একজন প্রজ্ঞাবান সাহিত্যকর্মীর এমন কথার পরে আর বিশেষ কিছু বলার থাকে না।

দশ

সবশেষে এসে এটুকুই শুধু বলার, সেটি হচ্ছে – আবুল হাসনাত আমাদের সময়ের একজন অনন্য সাহিত্য-সম্পাদকই কেবল ছিলেন না কিংবা কবি-প্রাবন্ধিক, শিশু-সাহিত্যিকই শুধু নন; মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন বেশ খানিকটা অন্যরকম। যাকে কিনা শঙ্খ ঘোষের ভাষায় বলতে পারি, ‘এই একজন মানুষের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল গোটা-মানুষের খানিকটা আদল।’ সেই ‘আদলে’র মধ্যে দেখা গেছে বিষাদের পাশাপাশি একটি সংবেদনশীল মনের উজ্জ্বলতা, যা মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে অনেকখানি ‘স্রোতোময় করে তোলে’। আমাদের সাহিত্যে একজন মর্মসন্ধানী সমালোচককে আবুল হাসনাতের মধ্যে আবিষ্কার করতে পেরে পাঠকের তো খুশি হওয়ারই কথা। তাঁর স্মৃতির প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জানাই!

সহায়ক গ্রন্থ

১.        মাহমুদ আল জামান, রবিশঙ্কর মানিক সতীনাথ ও অন্যান্য, অয়ন প্রকাশন, ২০১৬।

২.       আবুল হাসনাত, প্রত্যয়ী স্মৃতি ও অন্যান্য, জার্নিম্যান, মে, ২০১৯।

৩.       স্মৃতিতে অনুভবে আবুল হাসনাত, সংকলন ও সম্পাদনা : মতিউর রহমান, প্রথমা, ২০২০।

৪.       যুগান্তর চক্রবর্তী, সমগ্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় : দ্বন্দ্বের দুই মুখ, এবং মুশায়েরা, ২০০৮।

৫.       দেবেশ রায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় : নিরন্তর মানুষ, এবং মুশায়েরা, ২০১০।