কবিতার রূপশ্রেণি

কবিতা অনেক রকম। এর রয়েছে রূপশ্রেণিগত নানা বৈচিত্র্য। তা নির্ভর করে কীভাবে কবিতাকে শ্রেণিবদ্ধ করা হয় তার ওপর। সে-শ্রেণিকরণ হতে পারে বিষয়বস্তু বা রীতিনির্ভর, আকার কিংবা আয়তননির্ভর, উদ্দেশ্য কিংবা ছন্দবৈশিষ্ট্যনির্ভর। কবির মনোভঙ্গির বিভিন্নতার আলোকেও কবিতাকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা চলে।

কবিতার বিষয়বস্তুর মৌলিক প্রকৃতি বিচার করে কখনো কখনো কবিতার শ্রেণিবিভাগ করা হয়ে থাকে। কবিতায় আত্মগত ভাবানুভূতি প্রধান না নৈর্ব্যক্তিক বিষয়বস্তু প্রধান – সে-বিচারে কবিতাকে কেউ কেউ দুটো প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন। ক. মন্ময় কবিতা (subjective) খ. তন্ময় কবিতা (objective/impersonal)।

মন্ময় কবিতা মূলত আত্মমুখী ও আত্মভাবনামূলক। কবি    ব্যক্তিগত    অভিজ্ঞতা,    ভাব-ভাবনা    ও   আবেগ-অনুভূতির   প্রকাশ   ঘটান   এ-ধরনের কবিতায়। অন্যদিকে তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ কবিতায় কবি অন্তর্মুখীনতাকে পরিহার করেন, বহির্জগতের নানা ঘটনা, অভিজ্ঞতা, বিষয় ও অভিঘাত হয় তাঁর কবিতার বিষয়। মন্ময় কবিতায় নিবিড়তা পায় কবিমনের একান্ত আবেগ ও অনুভূতি। পক্ষান্তরে তন্ময় কবিতায় অভিব্যক্তি পায় বস্তুজগতের নৈর্ব্যক্তিক উপলব্ধি। মন্ময় কবিতার উদাহরণ হচ্ছে গীতিকবিতা, তন্ময় কবিতার উদাহরণ হচ্ছে মহাকাব্য, গীতিকা ইত্যাদি। তবে কবিতার এ-ধরনের বিভাজন অনেকটা অস্পষ্ট ও শিথিল ধরনের। কারণ নির্ভেজাল মন্ময় কবিতা ও পুরোপুরি তন্ময় কবিতার উদাহরণ পাওয়া খুবই মুশকিল। বস্তুজগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন মন্ময় কবিতার অস্তিত্ব  প্রায় অসম্ভব। অন্যদিকে আত্মভাবনার প্রভাবমুক্ত বস্তুনিষ্ঠ কবিতা যথার্থ কবিতা হয়ে ওঠে কি না সন্দেহ। আবার একই কবিতা বা কাব্যে যুগপৎ তন্ময় ও মন্ময় বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্বও থাকতে পারে।

এ জন্যে আধুনিককালে সমালোচক ও সাহিত্যবোদ্ধারা কবিতার রূপশ্রেণি বিচারে প্রধানত রীতির ওপর গুরুত্ব দেন এবং সেদিক থেকে কবিতাকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করে থাকেন। এগুলো হলো : ১. কাহিনি-কবিতা বা আখ্যানধর্মী কবিতা (narrative) ২. গীতিধর্মী (lyrical) কবিতা এবং ৩.  নাট্যধর্মী (dramatic) কবিতা।

১. অ্যাখ্যানধর্মী কবিতা বা কাহিনি-কবিতা

(Narrative poetry)

কাহিনি-কবিতায় বর্ণনার মাধ্যমে কিংবা সংলাপ ও বর্ণনার মাধ্যমে কোনো আখ্যান ব্যক্ত হয়। একে আখ্যানধর্মী কবিতাও বলা চলে। আখ্যানধর্মী কবিতার কাজ হচ্ছে মূলত কবিতার মাধ্যমে কাহিনি বা গল্প বর্ণনা। অবশ্য কখনো কখনো গীতিকবিতা কিংবা রাখালি কবিতায় আখ্যানবস্তুর অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। কাব্যনাট্যে তো আখ্যানের অস্তিত্ব অপরিহার্য। কিন্তু এগুলি কাহিনি-কবিতার পর্যায়ভুক্ত নয়। কাহিনি-কবিতার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মহাকাব্য ও গীতিকা।

কাহিনি-কবিতার কিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। এগুলির মধ্যে রয়েছে : আনুপূর্বিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে কাহিনি বর্ণিত হয়। কাহিনিতে সূচনা, মধ্যভাগ ও পরিণতি থাকে; কাহিনিতে বিভিন্ন চরিত্রের সমাবেশ ঘটে। কেন্দ্রীয় চরিত্রটি কোনো বীর নায়ক কিংবা লোকনায়ক হতে পারে। তবে কাহিনি-কবিতায় কাহিনি বা ঘটনাই মুখ্য হয়, চরিত্র অনেকটা গৌণ ভূমিকায় থাকে; কাহিনি সরলভাবে দ্রুত অগ্রসরমাণ হয়ে থাকে। ফলে কাহিনিতে পারিপাশির্^ক বর্ণনা, উপকাহিনির বিস্তার, বিশ্লেষণ বা ভাষ্য ইত্যাদি গুরুত্ব পায় না; কোনো কোনো কাহিনি-কবিতায় নাটকীয় গঠন (দৃশ্য বিভাগ ও সংলাপের মাধ্যমে কাহিনি বর্ণনা) লক্ষ করা যায়; ভাষার ক্ষেত্রে লৌকিক বা মৌখিক বাগ্ধারার প্রয়োগ চোখে পড়ে। ছন্দে ও অন্ত্যমিলে বিশেষ বৈচিত্র্য থাকে না। অলংকারের প্রয়োগ হয় কম; কাহিনি-কবিতায় ধুয়ার ব্যবহার থাকতে পারে। কাহিনির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ধুয়া নতুন অর্থ বহন করে।

মধ্যযুগের কাহিনি-কবিতায় এসব বৈশিষ্ট্যের প্রায় সবই চোখে পড়ে। আধুনিককালের কাহিনি-কবিতায় এসব বৈশিষ্ট্যের কোনো কোনোটি নাও থাকতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে কাহিনি-কবিতা গীতিকবিতার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যকেও ধারণ করতে পারে।

প্রেম, ঐতিহাসিক বা কিংবদন্তিমূলক ঘটনা, দেশ বিজয়, বীরকাহিনি ইত্যাদি যে-কোনো বিষয় নিয়ে কাহিনি-কবিতা রচনা হয়ে থাকে। তবে একাধিক বিষয় সাধারণত একসঙ্গে গ্রথিত হয় না।

জিওফ্রি চসারের Canterbury Tales গ্রন্থাকারে রোমান্সমূলক কাহিনি-কবিতা। আলোকজান্ডার পোপ-এর ‘The Rape of the Lock’ ও বায়রনের ‘Don Juan’ উল্লেখযোগ্য কাহিনি-কবিতা। কবি কোলরিজের ÔThe Rime of the Ancient MarinerÕ বহুখ্যাত কাহিনি-কবিতা। ইংরেজি সাহিত্যে কাহিনি-কবিতার আরো উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে : রবার্ট ফ্রস্টের ‘The Death of the Hired Man’সহ বেশ কিছু কবিতা, হেনরি লংফেলোর ‘Evangeline’, আলফ্রেড টেনিসনের ‘The Charge of the light Brigade’, এমি লোয়েলের গ্রন্থ Patterns ইত্যাদি।

জনসমাজে প্রচলিত অনেক লোককাহিনি বা কিংবদন্তি পরিমার্জিত করে মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে অনেক  কাহিনি-কবিতা রচিত হয়েছে। কাশীরাম দাশসহ অনেক বাঙালি কবির  রচিত মহাভারতে উপকাহিনি হিসেবে অনেক কাহিনি-কবিতা   সংকলিত হয়েছে। মধ্যযুগের কাহিনি-কবিতাগুলিতে মহাকীর্তি, বীরত্বগাধা, আত্মত্যাগ, উদারতা ইত্যাদি মর্মবস্তুর প্রকাশ ঘটে। এগুলির রচনাশৈলী ও বর্ণনারীতিতে  অনাড়ম্বর  সরলতা  লক্ষ  করা  যায়।  তবে কোথাও কোথাও অপরিমার্জিত আতিশয্য ও স্থূলতাও লক্ষণীয়। মধ্যযুগের অনেক কাহিনি-কবিতা নাটকীয় গুণসম্পন্ন।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে রাম-সীতা, রাধা-কৃষ্ণ ইত্যাদি সম্পর্কিত পৌরাণিক কাহিনির সঙ্গে লৌকিক কাহিনির মিশ্রণে নানা আখ্যানগীতি প্রচলিত ছিল। নাথ সিদ্ধাদের আখ্যানগীতি থেকে গোরক্ষ বিজয় কাহিনি-কবিতার জন্ম। মনসার গান, চণ্ডীর গান, ধর্মঠাকুরের গান ইত্যাদি লৌকিক গীতি থেকে একসময় মঙ্গলকাব্যের সৃষ্টি হয়। মঙ্গলকাব্যগুলি কাহিনি-কবিতার বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এগুলির গঠনবৈশিষ্ট্য ও রূপরীতি  বিচার   করে  মঙ্গলকাব্য নামে বিশেষ ধরনের কাহিনি-কবিতার পর্যায়ভুক্ত করা হয়। কৃত্তিবাসের শ্রীরাম পাঁচালী, কাশীরাম দাশের মহাভারতের মতো মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণ বিজয় কাব্যেও কাহিনি-কবিতার উপাদান রয়েছে। মধ্যযুগে মুসলিম কবিদের রচিত রোমান্টিক প্রণয় উপাখ্যানগুলি (যেমন শাহ মুহম্মদ সগিরের ইউসুফ জোলেখা, দৌলত উজির বাহরাম খানের লায়লী মজনু) কাহিনি-কবিতার একটি শাখা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্যে প্রথম আধুনিক কবিতার সংযোজন করেন কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর পদ্মিনী উপাখ্যান রাজপুত-ইতিহাস টডের Annals and Antiquities of Rajasthan থেকে নেওয়া। ইতিহাসের পটভূমিতে রোমান্টিক দেশপ্রেমের কাহিনি এর উপজীব্য। মধুসূদনের তিলোত্তমা সম্ভব কাব্যকে মহাকাব্যিক (epic link) বলা হলেও এটি কাহিনি-কবিতার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বীরবাহু ও ছায়াময়ী আখ্যানকাব্যধর্মী। নবীনচন্দ্র সেনের রঙ্গমতী ইংরেজি কবি স্কটের আদর্শে রচিত কাহিনি-কবিতা। অক্ষয়কুমার চৌধুরীর উদাসিনী ও সাগর সঙ্গমে, ঈশানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের যোগেশ ও দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বপ্নপ্রয়াণ সমকালে কাহিনি-কবিতা হিসেবে পাঠকনন্দিত হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ অনেক কাহিনি-কবিতা লিখেছেন। প্রথম দিকে রচিত তাঁর কাহিনি-কবিতার মধ্যে রয়েছে : ‘বনফুল’, ‘কবিকাহিনি’, ‘ভগ্নতরী’, ‘ভগ্নহৃদয়’, ‘রুদ্রচণ্ড’। রবীন্দ্রনাথ অক্ষরবৃত্ত ছন্দের প্রবহমান পয়ারে পুরাণ ও ইতিহাস-আশ্রিত কিছু কাহিনি-কবিতা রচনা করে গেছেন। সেগুলি সংকলিত হয়েছে তাঁর কথা ও কাহিনি, কাহিনি ও নাট্যকাহিনি প্রভৃতি গ্রন্থে। এগুলির কোনোটি বর্ণনাপ্রধান, কোনোটি নাট্যধর্মী। এসব কাহিনি-কবিতায় বিশেষ তত্ত্ব বা আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চোখে পড়ে।

রবীন্দ্রনাথ সামাজিক ঘটনা নিয়েও কিছু কাহিনি-কবিতা লিখেছেন। এগুলিতে রয়েছে স্বরবৃত্ত ছন্দের পরীক্ষা। কাহিনি-কবিতাগুলি সংকলিত হয়েছে তাঁর পলাতকা কাব্যগ্রন্থে। গদ্য ছন্দেও রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছু কাহিনি-কবিতা রচনা করেছেন। যেমন, পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থের ‘অপরাধী’, ‘ছেলেটা’, ‘বালক’, ‘ছেঁড়া কাগজের ঝুড়ি’, ‘ক্যামেলিয়া’, ‘উন্নতি’, ‘শাপমোচন’, শেষ সপ্তক কাব্যগ্রন্থের ‘পিলসুজের উপর পিতলের প্রদীপ’, ‘বাদশাহের হুকুম’, শ্যামলী কাব্যগ্রন্থের ‘কবি’, ‘হঠাৎ দেখা’, ‘অমৃত’, ‘দুর্বোধ’ ইত্যাদি। এসব কাহিনি-কবিতায় ছোটগল্পের আমেজ পাওয়া যায়।

কথাসাহিত্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে কাহিনি-কবিতার প্রতি পাঠকের আকর্ষণ ক্রমেই কমতে থাকে। কবিও কাহিনি-কবিতা রচনায় উৎসাহ হারাতে থাকেন। সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যে কাহিনি-কবিতার ধারা বিলুপ্তপ্রায়।

আখ্যানধর্মী বা কাহিনি-কবিতার বিশেষ কিছু রূপশ্রেণি রয়েছে। যেমন : ১. মহাকাব্য, ২. ব্যঙ্গ মহাকাব্য, ৩. গীতিকা, ৪. মঙ্গলকাব্য, ৫. চরিতকাব্য, ৬. রূপক কবিতা। এখানে ক্রমান্বয়ে এসব রূপশ্রেণি সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো।

১.১ মহাকাব্য (epic)

মহাকাব্য আখ্যানধর্মী কবিতার বিশেষ একটি শ্রেণি। তবে ভাবগাম্ভীর্য, বিশালত্ব ও চরিত্র-মহিমায় মহাকাব্য এক ধরনের সমুন্নত তন্ময় কাব্য। এর আখ্যানবস্তু গড়ে ওঠে জাতীয়, ঐতিহাসিক, পৌরাণিক, কিংবদন্তিমূলক কিংবা বীরত্বব্যঞ্জক কোনো ঘটনা বা কাহিনিকে কেন্দ্র করে। এর নায়ক চরিত্র শৌর্য, বীর্য, মনন ও মহত্ত্বে মহীয়ান, কাব্যরীতিতে মহাকাব্য বর্ণনামূলক উপাখ্যান এবং গ্রহণযোগ্যতার বিচারে এটি সর্বজনীন।

সাহিত্যের যে-রূপশ্রেণিকে প্রাচ্যের আলংকারিক বা কাব্যতাত্ত্বিকরা ‘মহাকাব্য’ নামে অভিহিত করেছেন পাশ্চাত্য আলংকারিকরা  তার  নাম  দিয়েছেন  ‘এপিক’।  ‘এপিক’ কথাটি এসেছে গ্রিক ‘ইপস’ শব্দ থেকে, যার প্রাচীন অর্থ শব্দ। একসময় এর আরোপিত অর্থ দাঁড়িয়েছে বীরত্বব্যঞ্জক কবিতা। এদিক থেকে বিস্তৃত পরিসরে ভাবগাম্ভীর্যময় পরিবেশে কোনো বিশাল গল্প-কাহিনির কাব্যিক রূপায়ণকে বলা হয় ‘এপিক’ বা মহাকাব্য।

মহাকাব্যের কাহিনি গড়ে ওঠে কোনো মহৎ চরিত্রকে কেন্দ্র করে। সেই কাহিনিতে থাকে নানা শাখা-প্রশাখার বিস্তার। এভাবে সুবিশাল কাহিনির মধ্য দিয়ে দেশ-কাল, সমাজ-সংস্কৃতির স্বতঃস্ফূর্ত রূপায়ণ ঘটে, ফুটে ওঠে মানব সমাজের ছবি। সব মিলিয়ে মহাকাব্যকে মনে হয় যেন জীবনসমুদ্রের কল্লোলিত বিস্তার। দেশের সঙ্গে, জাতির সঙ্গে, কালের সঙ্গে মহাকাব্যের সামগ্রিক ও অচ্ছেদ্য যোগসূত্রই সাধারণ কবিতার সঙ্গে মহাকাব্যের মৌলিক পার্থক্য সূচিত করে। সাধারণ কবিতায় আমরা শুনতে পাই ব্যক্তি কবির একান্ত কণ্ঠ-ধ্বনি, আর মহাকাব্যকে যেন ব্যক্তিবিশেষের রচনা বলে মনে হয় না। মনে হয় যেন তা বিশাল দেশ-কালে ব্যাপ্ত এবং তাকেই বহুমাত্রিকতায় তুলে ধরেছে।

কেউ কেউ মনে করেন, প্রাচীন মহাকাব্যগুলি মূলত অজ্ঞাতনামা একাধিক কবির রচনা। একসময় সেগুলিকে একত্র করে একটা প্রাথমিক রূপ দেওয়া হয়। তারপর ক্রমে কাহিনিগুলি সামঞ্জস্যপূর্ণ সংহত রূপ নেয়। তবে পরবর্তীকালের গবেষকরা মনে করেন, মহাকাব্যের উপাদান এভাবে বিকশিত হলেও তা আসলে কোনো না কোনো মহান প্রতিভারই সৃষ্টি।

যেসব মহাকাব্যের রচয়িতা একেবারে অজ্ঞাত সেগুলিকে বলা হয় লোক-মহাকাব্য। এ-ধরনের মহাকাব্য কোনো একক স্রষ্টার হাতে হতে পারে, এগুলি লোকসমাজের হাতেও সৃষ্টি হতে পারে।

মহাকাব্যের বৈশিষ্ট্য

মহাকাব্যের স্বরূপবৈশিষ্ট্য নিয়ে সুপ্রাচীনকাল থেকেই নানা আলোচনা হয়ে আসছে। এসব আলোচনাকে দুটো মোটা দাগে ভাগ করা চলে : প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য।

প্রাচ্যে সংস্কৃত আলংকারিকরা মহাকাব্যের স্বরূপবৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করতে গিয়ে প্রধানত বহিরঙ্গ অবয়ব ও উপাদানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। সংস্কৃত আলংকারিক আচার্য দণ্ডী ষষ্ঠ শতকে রচিত তাঁর কাব্যাদর্শ গ্রন্থে মহাকাব্যের বৈশিষ্ট্যসমূহ বিশদ করেন। পরবর্তীকালে মহাকাব্যের গঠন ও রসনিষ্পত্তি সম্পর্কে মননশীল আলোচনা করেছেন চোদ্দো শতকের সংস্কৃত আলংকারিক বিশ^নাথ কবিরাজ। দণ্ডী মহাকাব্যের যেসব লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করেছিলেন বিশ^নাথ কবিরাজ তাতে কিছু সংযোজন করেন।

সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্র অনুসারে মহাকাব্যের বিশেষ লক্ষণগুলো হচ্ছে :

মহাকাব্য হবে বিভিন্ন সর্গে বিন্যস্ত রচনা; সর্গ সংখ্যা আট-এর কম হবে না; মহাকাব্যের কাহিনি নীতিদীর্ঘ, নাতিহ্রস্ব  সর্গে  গ্রথিত  হবে।  প্রতিটি  সর্গের  নামকরণ থাকবে; আশীর্বচন, নমস্কার ও বস্তু নির্দেশের মাধ্যমে মহাকাব্যের সূচনা হবে; মহাকাব্যের কাহিনি রচিত হবে ঐতিহাসিক বা লোকপ্রসিদ্ধ ঘটনা কিংবা কোনো মহৎ জীবন অবলম্বনে; মহাকাব্যের কাহিনি রচিত ও পঠিত হবে চতুর্বর্গ ফলপ্রাপ্তি অর্থাৎ ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ লাভের প্রত্যাশায়; মহাকাব্যের নায়ক হবেন কোনো মহৎপ্রাণ, উদাত্ত চরিত্রের ব্যক্তি; মহাকাব্যে নিসর্গ প্রকৃতি (সমুদ্র, পর্বত, সূর্যোদয়, চন্দ্রোদয়) ও নগর, উৎসব ও ক্রীড়া (বনক্রীড়া, জলক্রীড়া), প্রেম ও পরিণয়, রাজ্য ও রাজকর্ম, যুদ্ধ ও মৃত্যুর আলংকারিক বর্ণনা থাকবে; মহাকাব্য অলংকারযুক্ত ও রসভাব সংবলিত হবে। তাতে শৃঙ্গার, বীর কিংবা শান্ত রস প্রধান হবে; প্রতি সর্গে বৈচিত্র্যময় ছন্দমাধুর্য সৃষ্টি করে রসের সঞ্চার করা হবে; মহাকাব্য হবে লোকরঞ্জক এবং কালান্তরব্যাপী স্থায়ী;

উপরিউক্ত লক্ষণগুলির কোনো কোনোটির অভাব ঘটতে পারে – তবে সেক্ষেত্রে মহাকাব্যকে হতে হবে কাব্যপাঠক ও সামাজিকের কাছে আকর্ষণীয় ও রসগ্রাহী।

এছাড়া একটি স্বতন্ত্র লক্ষণের কথা নির্দেশ করেছেন আলংকারিক বিশ^নাথ কবিরাজ। মহাকাব্যের গঠন কৌশলের ক্ষেত্রে তিনি নাটকের পঞ্চসন্ধিরীতি (মুখ, প্রতিমুখ, গর্ভ, বিমর্ষ ও উপসংহৃতি) অনুসরণের কথা বলেছেন। যেন মহাকাব্যের ঘটনা ও কাহিনিধারা সরল ও তীব্র গতিতে পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়।

পাশ্চাত্যে ‘এপিক’ বা মহাকাব্যের স্বরূপ লক্ষণ বিচারের সূচনা প্রাচীন গ্রিসে। অ্যারিস্টটল তাঁর কাব্যতত্ত্বে মূলত ট্র্যাজেডি সম্পর্কে আলোচনা করলেও প্রসঙ্গত তিনি মহাকাব্য সম্পর্কেও আলোকপাত করেছেন। মহাকাব্যবিষয়ক যে-ধারণায় তিনি উপনীত হয়েছিলেন তার ভিত্তি ছিল হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসি।

অ্যারিস্টটলের  মতে,  মহাকাব্যের  উপজীব্য  হচ্ছে, আদি-মধ্য-অন্ত সমন্বিত, শাখাকাহিনিযুক্ত, নাট্যরীতিতে গঠিত আখ্যানবস্তুসমৃদ্ধ, একই ছন্দে রচিত একমুখীন কাহিনি। তাঁর মতে, মহাকাব্য ট্র্যাজেডির মতোই জীবনেরই অনুকৃতি। তবে মহাকাব্য উন্নততর মহান চরিত্র, মহৎ কার্যকলাপ ও মর্যাদামণ্ডিত বিষয়বস্তুকে প্রতিফলিত করে। ট্র্যাজেডির মতোই মহাকাব্য সাধারণ বাস্তবতাকে ও সম্ভাব্যতাকে অতিক্রম করে জীবনের বিস্ময় উদ্রেককারী মহিমাময় রূপ রচনা করে। তিনি মহাকাব্যকে আখ্যানমূলক শ্রবণকাব্য হিসেবে গণ্য করেছেন, তাঁর মতে, মহাকাব্যের বৃত্ত গঠিত হবে নাট্যরীতিতে। তা গঠনের দিক থেকে হবে একক ও পূর্ণাঙ্গ, বিভিন্ন শাখা কাহিনি তাকে বৈচিত্র্যময় করবে, তবে সেগুলি সংযোগবিচ্ছিন্ন হবে না।

মহাকাব্যের উপযুক্ত ছন্দ হবে heroic metre, তা হবে সম্প্রসারিত, ঐশ^র্যদীপ্ত, ভাবরসাত্মক ও মহাকাব্যোচিত। তাঁর মতে, মহাকাব্যের আবেদন মননশীল ও সূক্ষ্মগ্রাহী। তাই তাতে সরল কাহিনির জটিল বিস্তার ঘটা সম্ভব।

মহাকবি টাসো মহাকাব্যের লক্ষণ নিয়ে যে-আলোচনা করেছেন, তাতে গভীর বিচারবোধ ও সূক্ষ্ম দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায় না। তিনি ঐতিহাসিক ঘটনা ও ধর্মীয় উপকরণনির্ভর, ভাবগাম্ভীর্যময় ও মহৎ ভাবসমন্বিত রচনাকে মহাকাব্য পদবাচ্য করেছেন। মহাকাব্যের লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে পরবর্তীকালে আরো অনেক আলোচনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তবে তাঁরা সকলেই মূলত ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করেছেন অ্যারিস্টটলের পোয়েটিকস গ্রন্থটিকে। এসব আলোচনাকে বিবেচনায় নিয়ে পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্বের আলোকে বিভিন্ন কালে রচিত মহাকাব্যগুলির কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করা যেতে পারে। এগুলির মধ্যে রয়েছে :

মহাকাব্যের চরিত্র হবে মর্যাদাসম্পন্ন ও মহিমাব্যঞ্জক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কিংবা ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক তাৎপর্যমণ্ডিত; এর পটভূমি হবে সুবিশাল; তা বিভিন্ন দেশ, জাতি, বিশ^ (স্বর্গ, মর্ত, পাতাল), এমনকি মহাবিশ^ পরিব্যাপ্ত হতে পারে; এর কাহিনিবৃত্ত গড়ে উঠবে ঐতিহাসিক কিংবা কিংবদন্তিমূলক কোনো কেন্দ্রীয় ঘটনাকে ঘিরে এবং তার সঙ্গে পল্লবিত হবে নানা শাখা ঘটনা, বা শাখা কাহিনি; মহাকাব্যে বর্ণিত ক্রিয়াকলাপ হবে মহাপরাক্রমের; এমনকি তা হতে পারে অতিমানবিক সাহসিকতার; দেবতা, দেবদূত ও দানব ইত্যাদি অতিপ্রাকৃতিক শক্তি ঘটনাধারায় সংশ্লিষ্ট ও সক্রিয় হবে; মহাকাব্যের বর্ণনারীতি হবে ভাবসমুন্নত; কবি বস্তুনিষ্ঠতা ও নৈর্ব্যক্তিকতার মাত্রা বজায় রাখবেন।

কোনো কোনো মহাকাব্যে এসব সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কোনো কোনোটি পরিলক্ষিত নাও হতে পারে। আবার কোনো কোনো মহাকাব্যে এসবের বাইরে আরো কিছু ভিন্নতর বৈশিষ্ট্য যুক্ত হতে পারে। উভয় ক্ষেত্রেই মহাকাব্যের রচয়িতারা এসব বৈশিষ্ট্যের অতিরিক্ত কিছু রীতিপদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন। এগুলির মধ্যে রয়েছে : কাব্যসূচনায় বিষয়বস্তুর বর্ণনা; কাব্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর সাহায্য প্রার্থনা, মাঝামাঝি জায়গা থেকে কাহিনি বর্ণনা শুরু করে ক্রমে প্রয়োজনীয় ঘটনাবলি বর্ণনা; যোদ্ধা, জাহাজ, সেনাদল ইত্যাদির তালিকা প্রদান, প্রধান প্রধান চরিত্রের আনুষ্ঠানিক ভাষণ উপস্থাপন, ঘন ঘন মহাকাব্যিক উপমার ব্যবহার ইত্যাদি।

মহাকাব্যের প্রকারভেদ

মহাকাব্যের স্বরূপ লক্ষণকে বিবেচনায় নিয়ে একে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয় : (ক) লোক মহাকাব্য (folk epic) বা স্বতঃস্ফূর্ত মহাকাব্য (authentic epic), (খ) সাহিত্যিক মহাকাব্য (literary epic)।

(ক) লোক মহাকাব্য (folk epic)

এ-ধরনের মহাকাব্যের রচয়িতা থাকেন অজ্ঞাত কিংবা অনির্দিষ্ট। সাধারণত কোনো বিশেষ কবির সযত্ন প্রয়াসে এগুলি রচিত হয় না। কোনো বিশেষ কবির নামে প্রচলিত হলেও এ-ধরনের মহাকাব্য সৃষ্টির পেছনে থাকে অনেক অজ্ঞাত-অখ্যাত কবির প্রয়াস, প্রেরণা ও অবদান। নানা কবির হাতে এগুলির কাহিনি পরিবর্তিত ও সমৃদ্ধ হয়। এদিক থেকে এগুলি সাধারণত লোকসমাজের সৃষ্টি এবং মৌখিক সাহিত্যের নিদর্শন। যুগ-যুগান্তর ধরে জনমানসে প্রচলিত উপকথা, লোককাহিনি, কিংবদন্তি, গীতিকা ইত্যাদি একত্রে গ্রথিত করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মহাকাব্যের রূপ দেওয়া হয় বলে একে স্বতঃস্ফূর্ত মহাকাব্য (authentic epic) নামে অভিহিত করা হয়। লোক মহাকাব্যে দেশ ও জাতির পরিপূর্ণ মানসরূপের ছায়াপাত ঘটে থাকে। ব্যক্তি ও সমষ্টির ভাবনা ও  ধারণা,  চিন্তা  ও  চেতনা,  বিশ^াস  ও  কল্পনা, ধর্ম ও সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটে তাতে। ফলে এর আবেদন হয় সর্বব্যাপক ও বিশ^জনীন, তা সর্বকালে দেশ-দেশান্তরের মানুষের কাছে গ্রহণীয় হয়ে ওঠে। লৌকিক মহাকাব্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এ-ধরনের মহাকাব্যের ‘ভিতর দিয়া একটি সমগ্র দেশ, একটি সমগ্র যুগ, আপনার হৃদয়কে, আপনার অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত করিয়া তাহাকে মানবের চিরন্তন সামগ্রী করিয়া তোলে।’ সুপ্রাচীন কালে এবং প্রাচীন যুগ-পরিবেশে এগুলি জন্মলাভ করেছে বলে এবং প্রাচীন যুগের পরিচয়-সমৃদ্ধ বলে এ-ধরনের মহাকাব্য প্রাথমিক মহাকাব্য (primary epic) বা আদিম মহাকাব্য (primitive epic) নামেও পরিচিত। যুগ-যুগান্তরে লোকমুখে সম্প্রচলিত হতে গিয়ে এ-ধরনের মৌখিক মহাকাব্যের আঙ্গিকে ও বিন্যাসে নানা পরিবর্তন হয়ে থাকে, শিথিল ও বিচ্ছিন্ন শাখা কাহিনি ক্রমে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সংহত রূপ নেয়। এ-ধরনের মহাকাব্য কাল-কালান্তর ধরে বিকশিত হয় বলে একে কালজাত মহাকাব্যও (epic of growth) বলা হয়ে থাকে। এ-ধরনের মহাকাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য সরলতা ও প্রাঞ্জলতা – প্রায়শ সেই সরলতায় থাকে আদিম ভাব। এ-ধরনের মহাকাব্যের চরিত্রের আবরণের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয় শিশুসুলভ সারল্য, প্রেমের ক্ষেত্রে দেখা যায় আবেগের উদ্দামতা, ক্রোধের ক্ষেত্রে বিচারবিবেচনাহীন নির্মমতা।

লোক মহাকাব্যের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে : হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসি, প্রাচীন ইংরেজি সাহিত্যের বিউলফ, পূর্ব ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারত, স্পেনীয় মহাকাব্য সিড, ফিনল্যান্ডীয় মহাকাব্য কালেভালা, ফরাসি মহাকাব্য song of Roland, জার্মান মহাকাব্য Nibelungenlied

(খ) সাহিত্যিক মহাকাব্য (literary epic)

সাহিত্যিক মহাকাব্য শিক্ষিত মার্জিত সাহিত্যরসপিপাসু পাঠকদের জন্য রচিত লিখিত মহাকাব্য। শিল্পসচেতন কোনো নির্দিষ্ট কবি এর স্রষ্টা। তিনি মহাকাব্য রচনা পদ্ধতি অনুসারে সযত্নে এ-কাব্য রচনা করেন এবং পঠনের উদ্দেশে তা রচিত হয়। এ-ধরনের মহাকাব্য লোক মহাকাব্যের চেয়ে অনেক বেশি সুগ্রথিত ও পরিশীলিত হয় এবং উদ্দেশ্যের দিক থেকে অনেক বেশি নান্দনিক গুণসম্পন্ন হয়ে থাকে। এ-ধরনের মহাকাব্য রচনাকালে কবি জনপ্রিয় উপাদান ব্যবহারে অনেক বেশি স্বাধীনতা নেওয়ার সুযোগ পান এবং সেগুলির বিশ^াসযোগ্যতাও কম প্রত্যাশিত হয়। এতে সাধারণত অতীতের ঘটনাই বর্র্ণিত হয়। তবে তাতে রচয়িতার নিজের সমকালের যুগচেতনা ও যুগাকাক্সক্ষাই বাণীরূপ লাভ করে। এ-ধরনের মহাকাব্যে প্রাচীন মহাকাব্যের নবরূপায়ণ, নবমূল্যায়ন কিংবা পুনর্নির্মাণ হয়ে থাকে। এরকম ক্ষেত্রে কবি তাঁর যুগমানসের প্রেক্ষাপটে পরিশীলিত জ্ঞান ও সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে পূর্বকালের কোনো কাব্য বা মহাকাব্যের ঘটনাকে নতুন রূপ দেন। এ-ধরনের মহাকাব্যে শিল্প-সংস্কৃতি যুগের রচয়িতার পরিশীলিত শিল্পকুশলতার পরিচয় থাকে বলে এগুলিকে শৈল্পিক মহাকাব্য ও (art epic) বলা হয়ে থাকে।

শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মহাকাব্যগুলির কয়েকটি হচ্ছে : লাতিন ভাষায় লেখা কবি ভার্জিলের ঈনিড, ইতালীয় ভাষায় লেখা কবি দান্তের ডিভাইন কমেডি ও কবি তাসসোর জেরুজালেম লিবারেতা, ইংরেজি ভাষায় লেখা কবি মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট, আধুনিক জার্মান ভাষায় লেখা গ্যেটের ফাউস্ট ইত্যাদি। ভারতীয় দুই লোকায়ত মহাকাব্য সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনি অবলম্বনে সংস্কৃত ভাষায় বেশ কিছু সাহিত্যিক মহাকাব্য রচিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কালিদাসের রঘুবংশ, ভারবির কিরাতার্জুনীয়, শ্রী হর্ষের নৈষধ চরিত্র ও মাঘের শিশুপাল বধ।

বাংলা সাহিত্যে সাহিত্যিক মহাকাব্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন রামায়ণের কাহিনি অবলম্বনে রচিত মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য।

সাধারণত লোক মহাকাব্যের কাহিনি অবলম্বনে রচিত হয় বলে সাহিত্যিক মহাকাব্যগুলিতে গঠন, চরিত্রায়ণ ও রসপরিবেশনের দিক থেকে প্রাচীন মহাকাব্যের সঙ্গে যথেষ্ট সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। লোকমহাকাব্যের মতোই সাহিত্যিক মহাকাব্যের আখ্যানভাগ গঠিত হয় বীরত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক, পৌরাণিক কিংবা কিংবদন্তিমূলক কাহিনি নিয়ে। কাহিনিতে অতিপ্রাকৃতিক শক্তির ভূমিকা থাকে। কাহিনি বর্ণনার সূত্রে নিসর্গ সৌন্দর্য, যুদ্ধবিগ্রহ, প্রেম-বিরহ, আনন্দ ও শোক ইত্যাদি বর্ণনা এবং বীরত্বের উপস্থাপনা অনেকটা প্রথাবদ্ধ পথে অগ্রসর হয়, তবে রচনাশৈলীগত বিশিষ্টতায় সাহিত্যিক মহাকাব্য অনেক বেশি সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। লোকমহাকাব্যের সঙ্গে কয়েকটি ক্ষেত্রে সাহিত্যিক মহাকাব্যের সুস্পষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন :

লোকমহাকাব্যের নায়কেরা লৌকিক বীর। তারা লোকজীবনের প্রচলিত বীর সম্পর্কিত সাধারণ ধারণা ও লোকবিশ^াসেরই প্রতিভূ। পক্ষান্তরে সাহিত্যিক মহাকাব্যের বীর নায়কেরা কবিমনের সৃষ্টি, তারা সমকালীন সমাজের কোনো বীর চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে না, অতীতের কোনো বীর চরিত্রের মধ্যে সমকালীন, দেশপ্রেম, জীবনাদর্শ ও স্বাধীনতাস্পৃহা আরোপিত হয় এবং এভাবে কবির মনের উপযোগী ব্যক্তি নায়ক তার ব্যক্তিত্ব, স্বাতন্ত্র্য, গৌরব ও মহিমায় ভাস্বর হয়ে ওঠে।

সাহিত্যিক মহাকাব্যে কাহিনি ও ঘটনাকে ছাপিয়ে চরিত্রই প্রধান হয়ে ওঠে। এবং বহু চরিত্রের মধ্যে নায়ক চরিত্রই সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে প্রতিভাত হয়। তার প্রখর ব্যক্তিত্ব, প্রগাঢ় দেশপ্রেম, সমুন্নত আদর্শ, দুর্জয় পৌরুষ, প্রবল আত্মবিশ^াস ও অপরিসীম আত্মত্যাগ তাকে পরিণত করে সবচেয়ে মহিমান্বিত ব্যক্তিত্বে। সেইসঙ্গে তার দেশব্রতী ও সমাজহিতৈষী ভূমিকা তাকে পরিণত করে জাতীয় বীর চরিত্রে। এভাবে সাহিত্যিক মহাকাব্য হয়ে ওঠে জাতীয় বীরের বীরত্বগাথা। এ জন্যে এ-ধরনের কাব্যকে ‘জাতীয় মহাকাব্য’ (National epic) বলা হয়ে  থাকে। জাতীয় জীবনের মহত্ত্ব ও আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করায় প্রয়াসী হয় বলে এ-ধরনের মহাকাব্য যথেষ্ট নীতিগর্ভ হয়ে থাকে। জাতির সামনে তুলে ধরা হয় মনুষ্যত্বের আদর্শ, সত্যের অন্বেষা, ত্যাগের মহিমা ইত্যাদি।

সাহিত্যিক মহাকাব্য লোক মহাকাব্যের তুলনায় অনেক বেশি নাট্যগুণসম্পন্ন হয়ে থাকে। নাটকোচিত আখ্যানবস্তু ও চরিত্রপুঞ্জের সমবায়ে মহাকাব্যের কাহিনি সরল ও তীব্রগতিতে পরিণতি অভিমুখী হয়ে থাকে। সূচনা, মধ্যবর্তী ঘটনা ও পরিণতি – এই নাট্যাঙ্গিকে কাহিনি বর্ণিত হয় এবং তাতে থাকে নাট্যক্রিয়া ও নাটকীয় দ্বন্দ্বের প্রাধান্য।

সাহিত্যিক মহাকাব্য লোক মহাকাব্যের তুলনায় অনেক বেশি শিল্পকুশলতার পরিচয়বহ। শব্দচয়ন, শব্দবিন্যাস, উপমা ও অলংকার ব্যবহারের দিকে থেকে এ-ধরনের মহাকাব্যের স্রষ্টার অনেক বেশি শিল্প-সচেতনতা, প্রয়োগকুশলতা লক্ষ করা যায়। সুবিখ্যাত প্রাচীন মহাকাব্য অবলম্বনে পরবর্তীকালে অনেক কবি মহাকাব্য রচনা করেছেন। যেমন বাল্মীকির রামায়ণ অবলম্বনে কালিদাস রচনা করেছেন রঘুবংশ। কৃত্তিবাস বাল্মীকির রামায়ণ বাংলায় অনুবাদ করেছেন আর কাশীরাম দাশ বাংলায় অনুবাদ করেছেন বেদব্যাসের মহাভারত। কিন্তু বাংলায় অনূদিত এ দুটি মহাকাব্যকে সাহিত্যিক মহাকাব্য বলা যাবে না। এর কারণ এ-দুটির কোনোটিই নতুন যুগের আদর্শকে ধারণ করেনি। এগুলি মূলত অনুবাদই। তবে এই সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে, তাঁদের কারো অনুবাদ একেবারে আক্ষরিক অনুবাদ নয়, অনেক ক্ষেত্রে নতুন সৃষ্টি। সেই কারণে কৃত্তিবাস ও কাশীরাম দাশ বাংলায় মহাকাব্য রচয়িতার মর্যাদা পেয়ে থাকেন।

বাংলায় প্রাচীন মহাকাব্যের অনুসরণে সাহিত্যিক মহাকাব্য রচনার প্রথম সচেতন ও সার্থক শিল্পপ্রয়াস মাইকেল মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য। রামায়ণ-আশ্রিত কাহিনি হলেও এ-কাব্য শিল্পসচেতন কবিমনেরই সৃষ্টি।

মহাকাব্য রচনায় মধুসূদন ভারতীয় কাব্যাদর্র্শ কিংবা ইউরোপীয় কাব্যাদর্শ কোনোটিকেই সর্বাংশে মান্য করেননি। তিনি প্রাচ্যের ব্যাস, বাল্মীকি, কালিদাস থেকে শুরু করে পাশ্চাত্যের হোমার, ভার্জিল, দান্তে, চসার, মিল্টন প্রমুখের কাব্যাদর্শ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মহৎ কাব্যের ভাবকল্পনা, বিষয়বস্তু, রচনাকৌশল ইত্যাদি থেকে গ্রহণ-বর্জন করে মেঘনাদবধ কাব্যের সৌন্দর্য সাধন করেছেন। মেঘনাদবধ কাব্য গ্রিক আদর্শে রচিত মহাকাব্য। সংস্কৃত সাহিত্যের কাছে মধুসূদনের ঋণ উপাখ্যান বা কাহিনিগত। অন্যদিকে বাচনভঙ্গি ও শৈলী ইত্যাদির ক্ষেত্রে তাঁর ঋণ গ্রিক ও ইউরোপীয় সাহিত্যের কাছে। এ-ঋণ সত্ত্বেও কবির মৌলিকতা এখানে যে, তাঁর অনন্যসাধারণ প্রতিভা ও সৃজনীশক্তির স্পর্শে বিদেশি উপকরণ, আদর্শ ও অলংকার এ-কাব্যে নতুনভাবে সজীব ও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বড় কথা, মহাকাব্যের বাণীরূপ দিতে গিয়ে যে ছন্দ ও কবিভাষার প্রয়োজন হলো, অমিত্রাক্ষর ছন্দে সেই কবিভাষা নির্মাণের কৃতিত্ব মধুসূদনের সম্পূর্ণ নিজস্ব।

আঙ্গিক ও প্রাণধর্ম উভয় দিক থেকেই মেঘনাদবধ কাব্য পূর্ণাঙ্গ মহাকাব্য। রামায়ণের কাহিনি অবলম্বনে রচিত হলেও এ-কাব্য রাম-রাবণের প্রচলিত কাহিনির প্রথানুসরণ নয়।

রাম-রাবণের কাহিনির মধ্যে এখানে সন্নিবেশিত হয়েছে নতুন যুগ-সচেতনতা। বাল্মীকি ও কৃত্তিবাস – দুজনের কাছেই রাম-রাবণের যুদ্ধ ছিল ধর্ম ও অধর্মের যুদ্ধ। এই সংগ্রামে রাবণের প্রতি সহানুভূতির কথা তাঁদের কল্পনাতীত ছিল। এই যুদ্ধ যে আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা ও ভাবাদর্শ পেতে পারে তা তাঁরা ভাবতেও পারেননি। কিন্তু মধুসূদন তাঁর মহাকাব্যে যুগের এই বিশেষ আকাক্সক্ষাকে রূপায়িত করে এ-কাব্যকে প্রকৃত সাহিত্যিক মহাকাব্যের গৌরব দিয়েছেন।

উনিশ শতকে বাঙালি জীবনে আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, মানবমহিমা ও স্বাজাত্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত যে জীবনাদর্শ গড়ে উঠেছিল নবযুগের সেই চিন্তাচেতনার গৌরবময় প্রকাশ আমরা মেঘনাদবধ কাব্যে  লক্ষ করি। সমগ্র কাব্য জুড়ে রাম-রাবণের যুদ্ধের অন্তরালে উনিশ শতকের নবজাগ্রত বাঙালির জীবনবোধের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। কাব্যের নায়ক রাবণ মহান সম্রাট, স্নেহশীল পিতা ও দেশপ্রেমিক বীর হিসেবে মহৎ মানবিক গুণের অধিকারী। রামায়ণে সে অধর্মের প্রতীক হলেও মেঘনাদবধ কাব্যে সে মানবিক গুণে গুণান্বিত। রাবণ চরিত্রে দেশনায়কের শৌর্য, চরম বিপর্যয়ের মধ্যেও অসামান্য দৃঢ়তা, আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের অটুট সংকল্প, দুর্জয় সাহস, আত্মমর্যাদাবোধ ও স্বাজাত্যচেতনার সমুজ্জ্বল প্রকাশ দেখা যায়। দেশ রক্ষায় মেঘনাদের অসাধারণ বীরত্বে আমরা অভিভূত হই। তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত স্বজাতিপ্রাণতার দৃপ্ত বাণী শুনে সহানুভূতিতে আমাদের মন ভরে ওঠে। এভাবে উনিশ শতকের নবজাগ্রত জাতীয়তাবোধ ও স্বাদেশিকতার চেতনার ইঙ্গিতময় প্রকাশ ঘটে এই মহাকাব্যে। যুগচেতনাকে ধারণ করায় এ-মহাকাব্যের আবেদন হয়েছে আরো তাৎপর্যময়।

মহাকাব্যের ঘটনাবিন্যাস করতে হয় বিশাল পটভূমিকায়। মেঘনাদবধ কাব্যে সে-বিশালত্ব আভাসিত হয়েছে কাহিনি নির্মাণকৌশলে। এ-কাব্যের বর্ণিত ঘটনার সময় পরিধি মাত্র তিনদিনের। কিন্তু মাইকেল কালিক ও স্থানিক বিশালত্বকে সফলভাবে আভাসিত করতে পেরেছেন। দ্বিতীয় সর্গ থেকে পঞ্চম সর্গ – এই চারটি সর্গে ঘটনা ধারাবাহিকভাবে সংঘটিত হলেও তা ঘটেছে যুগপৎভাবে চারটি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে – স্বর্গে, যুদ্ধক্ষেত্রে, অশোককাননে যেখানে সীতাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে এবং রাবণের রাজপ্রাসাদে। মহাকাব্যের ঘটনাবিন্যাসে পূর্বতন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিবেশ, আখ্যান-কিংবদন্তির পটভূমি, ধর্মীয় ও পৌরাণিক ধ্যান-ধারণা ইত্যাদির জৈবিক মেলবন্ধন ঘটাতে হয়। সেইসঙ্গে কল্পনা ও সৃজন-নৈপুণ্যের সাহায্যে তাতে ভাবসমুন্নতি ঘটাতে হয়। মেঘনাদবধ কাব্যে এসব বৈশিষ্ট্যের আশ্চর্য সমাবেশ লক্ষ করা যায়। মহাকাব্যের কাহিনির ভাবসমুন্নত প্রকাশের জন্য যে চমকপ্রদ কুশলতা, শব্দচয়ন ও শব্দগ্রন্থনায় যে আভিজাত্যময় মননশীলতা দরকার মেঘনাদবধ কাব্যে মাইকেল এসব ক্ষেত্রেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য যথাযথ ও প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন : ‘বীররস করুণরসের সাধারণীকৃত রূপ, ঐশ^র্য সমারোহ, বর্ণাঢ্য চিত্রসৌন্দর্য, রণসজ্জা ও যুদ্ধবিগ্রহের ধ্বনিগাম্ভীর্য ও কোলাহলমুখরতা – এই সমস্ত কাব্য বর্ণনার মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলাতে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী।’

মধুসূদন বীররসের ক্লাসিক কাব্য লিখতে বসেছিলেন। কিন্তু ক্লাসিকতার অন্তরে রোমান্টিক গীতিময়তাকে অবাধ প্রশ্রয় দিয়েছেন তিনি। কিন্তু তাতে মহাকাব্যোচিত ভাবসমুন্নতি আদৌ ক্ষুণ্ন হয়নি। বরং এর মধ্য দিয়ে বাংলা কবিতার মুক্তির দিগন্ত প্রসারিত হয়েছে।

মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্যের ভাষাভঙ্গির প্রধান বৈশিষ্ট্য এর ক্লাসিক গুণ ও ভাস্কর্যধর্মিতা। তা সর্বত্রই সুস্পষ্ট, স্বচ্ছ ও ব্যঞ্জনাধর্মী। কোথাও তা রহস্যময়তা বা অস্পষ্টতায় আচ্ছন্ন হয়নি।

পরবর্তীকালে মধুসূদনের অনুসরণে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় দুই খণ্ডে মোট পঁচিশটি সর্গে লিখেছেন সাহিত্যিক মহাকাব্য বৃত্রসংহার। বৃত্রাসুর-বধের পৌরাণিক কাহিনিই এর মূল উপজীব্য। হেমচন্দ্র একে বাঙালির নবজাগ্রত দেশাত্মবোধের উপযোগী করে নবরূপ দিতে প্রয়াসী হয়েছেন। কিন্তু মহাকাব্যের ক্লাসিক প্রেরণা তাঁর কবিপ্রতিভায় ছিল না। ফলে আঙ্গিকের দিক থেকে মহাকাব্য হলেও এটি রসোত্তীর্ণ মহাকাব্যের পর্যায়ভুক্ত হয়নি।

এরপর নবীন চন্দ্র সেন ভাগবত কাহিনি অবলম্বনে শ্রীকৃষ্ণের জীবনকে নবযুগের চেতনার আলোকে নবরূপ দিয়ে বিশাল সাহিত্যিক মহাকাব্য রচনা করতে চেয়েছিলেন। তাঁর ওই পরিকল্পনার ফসল ত্রয়ীমহাকাব্য – রৈবতক, কুরুক্ষেত্র ও প্রভাস। কিন্তু সাহিত্যিক মহাকাব্যে যে সংহতি, ভাবগাম্ভীর্য ও ভাবসমুন্নতি প্রত্যাশিত তা নবীন সেনের কাব্যে দেখা যায় না। এই ধরনের সীমাবদ্ধতার কারণে নবীন সেনের মহাকাব্য প্রকৃত মহাকাব্যের পর্যায়ভুক্ত হতে পারেনি।

১.২ ব্যঙ্গ মহাকাব্য (satirical epic)

মহাকাব্যের উদাত্ত ও মহিমাব্যঞ্জক শিল্পরীতি ব্যবহার করে তুচ্ছ বা লঘু বিষয় নিয়ে লেখা সাহিত্যের ব্যঙ্গব্যঞ্জনাময় রূপশ্রেণিকে বলা হয় ব্যঙ্গ মহাকাব্য। এটি বিশেষ ধরনের পদ্যছন্দবন্ধ রচনা। তবে কখনো কখনো তা গদ্যপদ রচনাও হয়ে থাকে। এ-ধরনের রচনায় সচেতনভাবেই ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপের উদ্দেশ্যে ধ্রুপদী মহাকাব্যের চরিত্রাবলি, রচনাশৈলী ও মহাকাব্যিক কাঠামোকে কাজে লাগানো হয়ে থাকে এবং তুচ্ছ ও নগণ্য বিষয়কে অতিরঞ্জিত করে ব্যঙ্গাত্মক করে তোলা হয়। ধ্রুপদী মহাকাব্যের মতোই এতে কাব্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর বন্দনা, মর্মবস্তু সম্পর্কিত উক্তি, অতিপ্রাকৃতিক শক্তির সংশ্লিষ্টতা, মহাকাব্যিক উপমা প্রয়োগ ইত্যাদি প্রকরণ অনুসৃত হয়।

সত্যিকারের মহাকাব্যের তুলনায় ব্যঙ্গ মহাকাব্য লক্ষণীয়ভাবে ছোট হলে একে mock heroic বলা হয়ে থাকে। এমন রচনাকে ব্যঙ্গ রোমান্সও (mock romance) বলা চলে। চসারের Nun’s priest’s tale অংশত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ব্যঙ্গ মহাকাব্য। ইংরেজি সাহিত্যে এ-ধরনের রচনার সুপরিচিত উদাহরণ স্যামুয়েল বাটলার ইয়েট্সের Hudibras। জনপ্রিয় ক্রীড়া ও বিনোদনের ক্ষেত্রে পিউরিটানদের দমননীতিকে ব্যঙ্গ করে লেখা এটি একটি দীর্ঘ কবিতা। আলেকজান্ডার পোপের Dunciad-ও এ-ধরনের রচনা। ব্যক্তিগত দুই শত্রুকে এই কাব্যে তিনি আহম্মকের বাদশাহ হিসেবে চিত্রিত করেছেন। অনেকের মতে পোপের The Rape of the Lock সম্ভবত ইংরেজি সাহিত্যের সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যঙ্গ মহাকাব্য। তিনি মার্জিত কাব্যের মাধ্যমে সুশীল সমাজের তুচ্ছ বিরোধকে ব্যঙ্গ করেছেন। লর্ড পিটার অ্যারা বেলা ফারমের নামে এক সুন্দরী মহিলার একগুচ্ছ চুল কেটে নেওয়ায় যে পারিবারিক বিবাদ শুরু হয় তা নিষ্পত্তির জন্যে পোপ এ ব্যঙ্গাত্মক কাব্য লেখেন। এক্ষেত্রে তিনি হেলেনকে কেন্দ্র করে গ্রিক ও ট্রোজানদের বিরোধকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে অনুকরণ করেছেন।

তীক্ষèধার ব্যঙ্গ মহাকাব্য বহুমুখী ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন : নির্বোধ আচরণকে উপহাস করা; যথার্থ মহাকাব্যের অসম্ভাব্যতা বা ভড়ংকে বিদ্রƒপ করা, নিচু ও নির্বোধ চরিত্রকে মহিমা দান; সমুন্নত চরিত্রের মানবীয়করণ, অহংকার চূর্ণ করে, কিংবা স্বরূপ উদ্ঘাটন করে ওই চরিত্রের অবনমন। ব্যঙ্গ মহাকাব্যের সমান্তরাল রচনা বাংলা সাহিত্যে না থাকলেও মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্যকে ব্যঙ্গ করে জগদ্বন্ধু ভদ্রের লেখা ছুছুন্দরীবধ কাব্য অনেকটা ব্যঙ্গ মহাকাব্য জাতীয়। এই কাব্যে ছন্দ অলংকার ইত্যাদির ক্ষেত্রেও মহাকাব্যের শিল্পরীতিকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে অনুকরণ করা হয়েছিল। যেমন,

হায়রে যেমতি

সুশ্যামল বঙ্গগৃহে কন্যায় শরদে

বিশ^প্রসূ বিশ^ম্ভরা দশভুজা কাছে, –

(ক্ষ্মাভ্রীশ-আত্মদা যিনি গজেন্দ্রাস্য মাতা)

ব্যজেন চামর লয়ে ঋত্বিক্ মণ্ডলী

কিম্বা যথা ঘটিকাযন্ত্রের দোলদণ্ড

ঘন মুহুর্মুহুঃ দোলে।

ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভারত উদ্ধারও অনেকটা ব্যঙ্গ মহাকাব্য ধরনের। উনিশ শতকে বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে বিদ্রƒপ করে এর অন্তঃসারশূন্যতাকে তুলে ধরা হয়েছে এ-কাব্যে। ভারতসভার সদস্য বিপিনকৃষ্ণ ও তাঁর বন্ধু কামিনীকুমারের ইংরেজ বিতাড়নের প্রয়াসকে মহাকাব্যের প্যারোডি হিসেবে এ-কাব্যে বিদ্রƒপবিদ্ধ করা হয়েছে। কাব্যটির প্রথম সর্গে রয়েছে প্রস্তাবনা ও সরস্বতী-বন্দনা, দ্বিতীয় সর্গে ভারত উদ্ধার। কাহিনি অংশে দেখা যায়, ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পদক্ষেপ হিসেবে প্রথমে সুয়েজ খালে ছাতুর বস্তা ফেলে পানি শুকিয়ে ইংরেজদের পালানোর পথ বন্ধ করা হয়। তারপর বঙ্গবীরেরা কেউ বঁটি হাতে কেউ পিচকারিতে বালিগোলা পানি নিয়ে যুদ্ধে লেগে যায়। ইংরেজদের চোখে বালিগোলা পানি ছোড়া হলে তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এদিকে লড়াইয়ের অংশ হিসেবে পূর্বপরিকল্পনা মতো চিৎপুরের খাল-পাড় থেকে কেল্লা পর্যন্ত সুড়ঙ্গ কেটে তার মধ্যে লঙ্কার বস্তা ও বাজারের সব পটকা ভরে মজুদ করা হয়েছিল। এবার তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। এর ফল হলো এরকম :

প্রবল লঙ্কার ধূম প্রবেশি অরাতি –

নাসারন্ধ্রে – গালে, খক্ খক্ খকে

কাসাইল শত্রুদলে, ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ, ফ্যাঁচে,

হাঁটাইল ভয়ংকর, কাতরিল সবে।

এভাবে কবি ভারত উদ্ধার কাব্যে মহাকাব্য ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যঙ্গাত্মক অনুকরণ করে হাস্যরস সৃষ্টি করেছেন।

১.৩ গীতিকা (ballad)

বর্ণনামূলক বা আখ্যানমূলক কবিতার একটি বিশেষ রূপশ্রেণি হচ্ছে গীতিকা। এটি গাথা নামেও পরিচিত। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘ব্যালাড’ (ballad)। আবৃত্তি বা গীত হওয়ার উদ্দেশ্যে মধ্যযুগে এর উদ্ভব। এর প্রকাশভঙ্গি লৌকিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। গীতিকার মূল ভিত্তি জনশ্রুতিমূলক কোনো বিষয়। এর কাহিনিতে থাকে নাটকীয়তা এবং প্রায়শ এর পরিণতি হয় বেদনাবহ। গীতিকায় প্রধানত বর্ণিত হয় অসুখী প্রেমের কাহিনি, পারিবারিক ট্র্যাজেডি। কখনো কখনো গীতিকায় ব্যক্ত হয় ঐতিহাসিক বা কিংবদন্তিমূলক জনপ্রিয় লোকায়ত কাহিনি।

লোকসাহিত্যের অন্যান্য আখ্যানমূলক রচনার (যেমন : লোককাহিনি) সঙ্গে এর প্রধান পার্থক্য হলো, এতে কাহিনি পল্লবিত হয় না, কাহিনির অপরিহার্য ঘটনাধারা দ্রুত সংকটময় পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। এর কাহিনি উপস্থাপনরীতি অনেকটা নাট্যধর্মী।

গীতিকা প্রধানত দু-ধরনের : লোকগীতিকা ও সাহিত্য-গীতিকা।

লোকগীতিকা (folk ballad) : এটি লোকসাহিত্যের অন্যতম প্রাচীন রূপ। এ-ধরনের গীতিকার রচয়িতা প্রায়শ অজ্ঞাত। তাঁদের নাম কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। রচয়িতারা হয়তো সুশিক্ষিত ছিলেন না, কিন্তু তাঁদের রচনায় স্বাভাবিক ও সহজাত পটুত্ব ছিল। তাই এসব গাথা মুখে মুখে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সম্প্রচলিত হয়ে এসেছে। এগুলি প্রথমে রচিত হয়েছে গেয়ে কিংবা আবৃত্তি করে শোনানোর জন্যে। পরবর্তীকালে মৌখিক রূপ লিপিবদ্ধ করে এগুলিকে লিখিত ও মুদ্রিত রূপ দেওয়া হয়েছে। লোকগীতিকার বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : এগুলি মূলত অভিজাত সমাজের কাহিনি নয়, সাধারণ লোকের কাহিনি; ঘটনাধারায় কখনো কখনো অতিপ্রাকৃতিক শক্তির ভূমিকা থাকলেও এগুলি সাধারণভাবে পার্থিব মানুষেরই কাহিনি, পারলৌকিক আশ^াস সাধারণত কাহিনি নিয়ন্ত্রণ করে না; কাহিনি মূূলত ক্রিয়া, চরিত্র, পরিবেশ ও ঘটনার মধ্যে সংহত থাকে। তবে কাহিনি উপস্থাপনায় চরিত্রায়ণ ও চিত্রল বর্ণনার চেয়ে ক্রিয়া এবং ঘটনাই মুখ্য হয় এবং কাহিনিতে নাটকীয়তা সৃষ্টি ও গতিসঞ্চার করে; কাহিনিতে অবাস্তব ঘটনা ও অপ্রাসঙ্গিক বিষয় সযত্নে পরিহার করা হয়; শাখা বা উপকাহিনি দিয়ে ঘটনাধারাকে ভারাক্রান্ত করা হয় না বরং অনেক ক্ষেত্রে আভাস ইঙ্গিত বা সংকেতের মাধ্যমে কাহিনিকে সংক্ষিপ্ত ও দ্রুত গতিময় করা হয়ে থাকে; লোকগীতিকার চরিত্রগুলি সাধারণত টাইপ চরিত্র হয়ে থাকে। তবে কখনো কখনো কোনো কোনো চরিত্র স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত নাটকীয় চরিত্রের মতো হয়ে থাকে; দেশীয় বাদ্যযন্ত্র সহযোগে এগুলি গীত হয় এবং শ্রোতাদের মনে রাখার সুবিধার জন্য কোনো কোনো অংশ ধুয়া আকারে পুনরাবৃত্তি করা হয়; সাধারণের বোধগম্য করে রচিত হয় বলে এর ভাষা হয় অত্যন্ত সহজ; গাওয়ার উপযোগী করে রচিত হয় বলে এগুলি হয় ছন্দিত এবং এতে মূলত লৌকিক ছন্দ ব্যবহৃত হয়; এগুলি সাধারণত নাতিদীর্ঘ হয়ে থাকে।

লোকগীতিকার পাশ্চাত্য ও এদেশীয় সংজ্ঞায় কিছু পার্থক্য রয়েছে। পাশ্চাত্যে লোকগীতিকাকে দেখা হয় ‘নাতিদীর্ঘ অ্যাখায়িকা’ হিসেবে। কিন্তু বাংলাদেশের লোকগীতিকাগুলিকে নীতিদীর্ঘ বলা যায় না। পাশ্চাত্যে গীতিকাগুলি স্তবকে বিভক্ত; কিন্তু বাংলা গীতিকাগুলি স্তবক-বিভক্ত নয়। পাশ্চাত্যে গীতিকার মূল আবেগ হচ্ছে বীরত্ব, কিন্তু বাংলা গীতিকাগুলিতে বিষয় হিসেবে বীরত্বগাথা ছাড়াও রয়েছে প্রেম, আত্মত্যাগ, আত্মিক উৎকর্ষ ইত্যাদি। বস্তুত বাংলা লোকগীতিকাগুলির ঐতিহ্য ব্যাপক ও সমৃদ্ধময়।

গীতিকার সৃষ্টি নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। একদল পণ্ডিত মনে করেন, গীতিকা ও লোকসংগীত সমগোত্রীয় এবং সংহত সমাজের যৌথ সৃষ্টি। তাঁদের ধারণা, লোকসাহিত্যের বৈশিষ্ট্যের নিরিখে দেখলে ব্যক্তিবিশেষ লোকগীতিকার স্রষ্টা হতে পারে না। কিন্তু আধুনিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গীতিকা ব্যক্তি-প্রতিভারই একক সৃষ্টি। গীতিকা সচেতন কবিমনের সৃজনী-ফসল। স্রষ্টা কবি হয়তো নিরক্ষর হতে পারেন তবে জীবন-অভিজ্ঞতায় তাঁর কবিমন সমৃদ্ধ। দ্বিতীয়ত, তাঁরা মনে করেন, একটি ঐতিহ্যবাহী সমাজে ঐতিহ্য-সচেতনতার পরিমণ্ডলেই কেবল গীতিকা রচিত হতে পারে। সমাজজীবনে সুদৃঢ় সংহতি ও জীবন সম্পর্কে নাটকীয় কৌতূহলের অস্তিত্ব না থাকলে গীতিকা রচিত হতে পারে না। তাই তাঁদের অভিমত, গীতিকা আদিম সমাজের নয়, উন্নত সমাজের  ফসল।  আদিম  সমাজে  লোকসংগীতের  অস্তিত্ব থাকলেও লোকগীতিকায় অস্তিত্ব ছিল না।

লোকগীতি ও লোকসাহিত্যের সঙ্গে লোকগীতিকার সংযোগ ও সাদৃশ্য বিশেষ নেই। লোককাহিনিমূলক রচনা পাঁচালির সঙ্গেও রয়েছে লোকগীতিকার রসগত ভিন্নতা। কোনো কোনো লোকগীতিকায় জীবনবোধের যে উঁচু আদর্শ দেখা যায় তা সাধারণ নিরক্ষর সমাজ থেকে উদ্ভূত বলে ধারণা করা মুশকিল।

পাশ্চাত্যে অনেক বিশেষজ্ঞ গীতিকার মধ্যে মহাকাব্যিক গুণ লক্ষ করে ধারণা করেছেন, মহাকাব্য বা এপিকের সঙ্গে গীতিকার নিকট-সম্পর্ক রয়েছে। কারো কারো মতে, গীতিকা মহাকাব্য রচনার পূর্ববর্তী রচনা; কারো কারো মতে, তা মহাকাব্য রচনার পরবর্তী রচনা।

গীতিকার সঙ্গে মহাকাব্যের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে, গীতিকা আকারে মহাকাব্যের চেয়ে অনেক ছোট। মহাকাব্যের বিশাল ক্যানভাসে থাকে ঘটনার জটাজাল, পক্ষান্তরে গীতিকা মূলত গড়ে ওঠে একটিমাত্র ঘটনাকে ঘিরে।

সাধারণত গীতিকার দ্রুত সঞ্চারমান কাহিনি সংকটপূর্ণ পরিণতির দিকে অগ্রসরমান হয়ে থাকে। ঘটনার বর্ণনা ও প্রত্যক্ষ সংলাপের মধ্য দিয়ে নাটকীয়ভাবে কাহিনি অগ্রসর হয়। বর্ণনাকারী কাহিনি বর্ণনা করেন নৈর্ব্যক্তিকভাবে।

বাংলাদেশ থেকে সংগৃহীত বাংলা সাহিত্যের লোকগীতিকার উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হচ্ছে :  মৈমনসিং গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকা ও নাথ গীতিকা।

মৈমনসিং গীতিকা

মৈমনসিংহ গীতিকা বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার পূর্বাঞ্চল থেকে সংগৃহীত দশটি লোকগীতিকা বা লোকগাথার সংকলন। এটি কলকাতা বিশ^বিদ্যালয় থেকে সর্বপ্রথম মৈমনসিং গীতিকা নামে ড. দীনেশচন্দ্র সেন কর্তৃক সম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হয় (সংকলিত ১৯২৩, প্রকাশিত ১৯৫৩)। লোকসাহিত্য সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে এসব লোকগীতিকা সংগ্রহে দীনেশচন্দ্র সেনকে সহায়তা করেন। এ পর্যায়ে সংগৃহীত লোকগীতিকাগুলি হচ্ছে : মহুয়া (রচয়িতা : দ্বিজ কানাই, সতেরো শতক), মলুয়া (রচয়িতা : অজ্ঞাত), চন্দ্রাবতী (রচয়িতা : নয়নচাঁদ ঘোষ), কমলা (রচয়িতা : দ্বিজ ঈশান), দেওয়ান ভাবনা (রচয়িতা : অজ্ঞাত), দস্যু কেনারামের পালা (রচয়িতা : চন্দ্রাবতী), রূপবতী (রচয়িতা : অজ্ঞাত), কংক ও লীলা (রঘুসুত, দামোদর, শ্রীনাথ ও নয়নচাঁদ ঘোষের ভনিতাযুক্ত), কাজল রেখা (রচয়িতা : অজ্ঞাত) এবং দেওয়ান মদিনা (রচিয়তা : মনসুর বয়াতি)।

প্রতিটি গীতিকাই মনোগ্রাহী এবং সহজ-সাবলীল কবিত্বশক্তির পরিচয়বহ। গীতিকাগুলির মধ্যে মহুয়া ও দেওয়ান মদিনা অনেক বেশি সমাদৃত।

পূর্ববঙ্গ গীতিকা

ময়মনসিংহ জেলার পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ পূর্ববঙ্গ থেকে যেসব লোকগীতিকা চন্দ্রকুমার দে, আশুতোষ চৌধুরী প্রমুখের দ্বারা সংগৃহীত হয় সেগুলি কলকাতা বিশ^বিদ্যালয় থেকে দীনেশচন্দ্র সেনের সম্পাদনায় পূর্ববঙ্গ গীতিকা নামে চার খণ্ডে প্রকাশিত হয়। এর প্রথম খণ্ড মৈমনসিং গীতিকা নামে পরিচিত। এসব গীতিকা ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিকের সম্পাদনায় প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা নামে সাত খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। পূর্ববঙ্গ গীতিকায় সংকলিত গীতিকার সংখ্যা ৫৪টি। এর মধ্যে ৩৯টি বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের। বাকিগুলি সিলেট, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালি অঞ্চল থেকে সংগৃহীত (পরবর্তীকালে আরো কিছু গীতিকা সংগৃহীত হয়েছে)। এসব লোকগীতিকার অধিকাংশই চতুর্দশ শতকে রচিত বলে ধারণা করা হয়।

গীতিকাগুলির মধ্যে মহুয়া, মঞ্জুর মা, ধোপার পাট, কাঞ্চনমালা, শ্যামরায়, আঁধা বধূ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের প্রকৃতি, গ্রামবাংলার নরনারীর হৃদয়ানুভূতি ও চরিত্র-বৈশিষ্ট্য, তাদের পার্থিব প্রেমের স্বরূপ ইত্যাদি এসব গীতিকায় ফুটে উঠেছে। এসব কাহিনি আকর্ষণীয়, কবিত্বময় এবং নাটকীয়। গীতিকাগুলির ভাষা অমার্জিত, কিন্তু সরল।

লোকগীতিকার শ্রেণিকরণ : বৈশিষ্ট্য ও বিষয়বস্তু অনুসারে লোকগীতিকাগুলিকে নানা শ্রেণিতে বিভক্ত করা চলে –

প্রেমমূলক : মহুয়া, মলুয়া, কমলা, চন্দ্রাবতী, কঙ্ক ও লীলা;

ঐতিহাসিক : ঈশা খাঁ দেওয়ানের পালা;

দস্যুতামূলক বা লোকন্যায়মূলক : দস্যু কেনারামের পালা;

স্থানভিত্তিক : বারতীর্থের গান;

বারোমাসি : বগুলার বারমাসী;

রূপকধর্মী : কাজল রেখা।

নাথগীতিকা

নাথগীতিকার মধ্যে সর্বপ্রথমে উল্লেখযোগ্য মানিক চাঁদের গীতি। ড. জর্জ এ গ্রিয়ারসন নাথগীতিকার এই পাঠটি উত্তরবঙ্গ থেকে উদ্ধার করে The Story of Manik Chand নামে ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম প্রকাশ করেন। এতে রাজা মানিকচন্দ্র তাঁর পত্নী ময়নামতী ও পুত্র গোপীচন্দ্রের জীবনকথা বর্ণনার মাধ্যমে লৌকিক-অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ ও নাথ ধর্মের মহিমা কীর্তন করা হয়েছে। গ্রিয়ারসন-সম্পাদিত পুথি প্রকাশের পর উত্তর ও পূর্ববঙ্গের নানা অঞ্চল থেকে ময়নামতীর গান, গোপীচন্দ্রের গীত, মানিকচাঁদের গীত ইত্যাদি নামে একই কাহিনির বিভিন্ন পুথি পাওয়া গেছে। গোপীচন্দ্রের গান কলকাতা বিশ^বিদ্যালয় থেকে ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়।

সাহিত্য-গীতিকা (literary ballad)

লোকগীতিকার ছন্দ ও স্তবক-বৈশিষ্ট্যের অনুকরণে ও অনুসরণে বিশিষ্ট ও পরিচিত রচয়িতা-সৃষ্ট গীতিকা সাহিত্য-গীতিকার পর্যায়ে পড়ে। এ-ধরনের গীতিকা লোকগীতিকার মতো গীত হওয়ার জন্য রচিত হয় না, এগুলি পাঠ ও আবৃত্তি করা হয়। এ-ধরনের গীতিকায় লোকগীতিকার ছন্দ, স্তবক-বৈশিষ্ট্য কিংবা বিষয়বস্তু অনুসৃত হলেও এগুলি লোকগীতিকার চেয়ে অধিকতর পরিশীলিত এবং সচেতনভাবে শৈল্পিক কারুকার্যমণ্ডিত হয়ে থাকে।  লোকগীতিকায়  থাকে  বর্ণনার  সারল্য  কিন্তু  সাহিত্য-গীতিকায় থাকে ঘনীভূত ও প্রখর নাটকীয়তা। এগুলির ভাষা প্রায়শই সমুন্নত হয়ে থাকে এবং তাতে প্রতিভাবান কবির বাগ্রীতির উৎকর্ষের পরিচয় পাওয়া যায়। ফলে তা হয়ে ওঠে রচয়িতার  স্বকীয়  শিল্প-নিদর্শন।  জসীম উদ্দীনের  নকশী কাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট বাংলা সাহিত্যে সাহিত্যিক গীতিকা হিসেবে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী।

সাহিত্য-গীতিকা বাংলায় গাথা-কবিতা নামেও পরিচিত। বাংলা সাহিত্যে এ-ধরনের কবিতার উল্লেখযোগ্য নিদর্শন কালিদাস রায়ের গাথাঞ্জলি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা ও কাহিনির অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন কাহিনি-কবিতা, কাজী নজরুল ইসলামের ‘শাত-ইল-আরব’, কুমুদরঞ্জন মল্লিকের ‘শ্রীধর’ ইত্যাদি।

ইংরেজি সাহিত্যে বেশ কিছু সুবিখ্যাত সাহিত্য-গীতিকা রয়েছে। এদের মধ্যে জন কীটসের ‘La Belle’ কবিতাটি লোকগীতিকাকে ব্যবহার করে পুরোপুরি স্বতন্ত্র শিল্প নিদর্শন হয়ে উঠেছে। স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের ‘The Rime of The Ancient Mariner’ কবিতাটিকে বিবেচনা করা চলে আধুনিক সাহিত্য-গীতিকার অন্যতম সেরা নিদর্শন বলে। লোকগীতিকার সরল সুরের অনুরণন ধ্বনিত হয় ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘Lucy gray’ কবিতায়। এছাড়া উইলিয়ম মরিস, জর্জ মেরেডিথ, লুইস ক্যারল প্রমুখ ইংরেজ কবি সাহিত্য-গীতিকা রচনায় পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। মার্কিন সাহিত্য-গীতিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : হেনরি ওয়ার্ডসওয়ার্থ লংফেলোর ‘The Skeleton in Armor’, স্টিফেন ভিনসেন্ট বেনেটের গান ‘The Ballad of William Sycamore’ এবং আর্নেস্ট থেয়ারের কবিতা ‘Casey at the Bat’।

১.৪. মঙ্গলকাব্য

বাংলার লৌকিক দেবতার মাহাত্ম্য প্রচারমূলক আখ্যানকাব্য মঙ্গলকাব্য নামে পরিচিত। বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান ও পতন, তুর্কি আক্রমণের ফলে অবিভক্ত বাংলার রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে বিপুল পরিবর্তন দেখা দেয়। বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য সমাজ এবং ধর্মব্যবস্থার দুর্বলতার শিকার সাধারণ মানুষ আস্থা ও আত্মবিশ্বাস হারিয়ে লৌকিক শক্তির ওপর নির্ভরতা স্থাপন করতে শুরু করে। সাপের ভয় থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় মনসার, বাঘের ভয় থেকে রক্ষা পাওয়ার আশায় দক্ষিণরায়ের, বসন্ত রোগের হাত থেকে বাঁচতে শীতলার এবং কৃষিজীবী ও শিকারি সমাজে সফলতার আশায় শিব ও শিবপত্নী চণ্ডীর পুজো অন্ত্যজ সমাজে প্রচলিত হতে শুরু করে। এই প্রেক্ষাপটেই চোদ্দো শতকে বাংলায় দেবমহিমা প্রচারের উদ্দেশ্যে আখ্যানকাব্য রচনা শুরু হয়। ওইসব আখ্যান কাব্য সমবেত শ্রোতাদের আসরে গান গেয়ে পরিবেশন করা হতো। এতে মঙ্গল হবে – এই বিবেচনা থেকে একে বলা হতো মঙ্গল গান আর আখ্যান-কাব্যগুলি পরে পরিচিত হয় মঙ্গলকাব্য নামে। যেসব দেবদেবীর বন্দনায় মঙ্গলকাব্য রচিত হতো তাঁদের নামেই সেগুলি পরিচিত হতো। এভাবে বাংলায় মধ্যযুগে বিভিন্ন দেবদেবীর মাহাত্ম্যসূচক বিশাল কাব্যসাহিত্য গড়ে ওঠে। মাহাত্ম্য প্রচারসূচক যে-কোনো আখ্যান কাব্যই ক্রমে মঙ্গলকাব্য নামে অভিহিত হতে থাকে। এরই প্রভাবে চৈতন্যদেবের জীবনীকাব্যও চৈতন্যমঙ্গল নামে চিহ্নিত হয়।

মঙ্গলকাব্যগুলি  কোন  ধরনের  দেবতার  মহিমাজ্ঞাপক সে-বিচারে এগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করা চলে :

(ক) লৌকিক মঙ্গলকাব্য : চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল, ষষ্ঠীমঙ্গল, শীতলামঙ্গল, রায়মঙ্গল প্রভৃতি।

(খ) পৌরাণিক   মঙ্গলকাব্য  :  দুর্গামঙ্গল,  ভবানীমঙ্গল,  কৃষ্ণমঙ্গল, গঙ্গামঙ্গল প্রভৃতি।

মঙ্গলকাব্য বন্দনা বা স্তুতিমূলক বলে এতে ওড বা স্তোত্রকাব্যের লক্ষণ রয়েছে। কিন্তু দেবতার স্তুতি থাকলেও এগুলি আখ্যায়িকা-প্রধান। তাই এগুলিকে স্তোত্রকাব্য বা ‘ওড’ পর্যায়ভুক্ত করা যায় না। আখ্যায়িকা কাহিনি হিসেবে গীতিকা বা ব্যালাডের সঙ্গে এর সাদৃশ্য আছে। কিন্তু মঙ্গলকাব্যের কাহিনি মূলত ধর্মীয় মাহাত্ম্যসূচক বলে একে গীতিকা শ্রেণিভুক্ত না করে ‘মঙ্গলকাব্য’ হিসেবে আলাদা শ্রেণিভুক্ত করাই সংগত।

মঙ্গলকাব্যগুলি রচিত হয়েছে চোদ্দো শতক থেকে আঠারো শতকের মধ্যে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কবি বিভিন্ন দেবতাকে নিয়ে এগুলি রচনা করলেও বিষয়ে ও উদ্দেশ্য অভিন্ন হওয়ায় মঙ্গলকাব্যগুলি মোটামুটিভাবে একই গঠনপ্রকৃতির অনুসারী। এগুলির গঠনগত সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে :

(ক) সাধারণভাবে এগুলো চারটি খণ্ডে বিভক্ত –

বন্দনা খণ্ড : এই খণ্ডে থাকে দেবদেবীর বন্দনা। যে দেবীর প্রশস্তিমূলক কাব্য রচিত হচ্ছে তাঁর বন্দনা তো থাকেই, সেইসঙ্গে থাকে আরো দেবদেবীর বন্দনা;

গ্রন্থোৎপত্তির কারণ : এই খণ্ডে গ্রন্থ রচনার কারণ হিসেবে দেবদেবীর আশীর্বাদ কিংবা স্বপ্নাদেশকে নির্দেশ করা হয়। তাছাড়া  গ্রন্থ  রচনার  কাল,  কবির  আত্মপরিচয়  ইত্যাদিও এ-অংশে বর্ণিত হয়;

দেবখণ্ড : এই খণ্ডে সেই অভিশাপের কথা বর্ণিত হয় যে কারণে দেবতা বা দেবীকে মর্ত্যে জন্মগ্রহণ করতে হয়;

মানব খণ্ড : মানব খণ্ডে থাকে পৃথিবীতে সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে দেব বা দেবীর জীবনচিত্র।

(খ) কতকগুলো সাধারণ বিষয় সাধারণত মঙ্গলকাব্যে থাকে। যেমন : বারোমাস্যা বা বারোমাসের দুঃখের কাহিনি, চৌতিশা, স্তুতি, নারীর পতিনিন্দা, রান্না ও খাওয়ার বিস্তারিত বিবরণ, ফুল-ফল-পশুপাখির বর্ণনা।

(গ) দেবদেবীর মহিমাসূচক হলেও মঙ্গলকাব্যে সাধারণ মানুষের জীবনচিত্রও সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়ে থাকে।

মঙ্গলকাব্য ধারার কাহিনিগুলিতে অতিপ্রাকৃত ও অলৌকিক ঘটনার প্রাধান্য থাকলেও পাশাপাশি রয়েছে বাঙালির সামাজিক, রাজনৈতিক  জীবনের  ছবি।  মধ্যযুগের  বাঙালি  সমাজের  সুখ-দুঃখ আশা-আকাক্সক্ষার নানা অভিব্যক্তি সেগুলিতে পরিলক্ষিত হয়। এদিক থেকে মঙ্গলকাব্যগুলিকে মধ্যযুগের বাঙালি জীবনের সাহিত্যিক জীবনালেখ্য বলা চলে। মঙ্গলকাব্যের দেবদেবীরাও অনেকাংশে সাধারণ মানুষের সগোত্রীয়। শাপভ্রষ্ট বলে তাঁদের দুঃখ-লাঞ্ছনা সইতে হয়, সংগ্রাম করতে হয়।

মঙ্গলকাব্যগুলিতে সমাজের নিম্নবর্গের মানুষই নায়ক-নায়িকার মর্যাদায় অভিষিক্ত। চণ্ডীমঙ্গলের নায়ক-নায়িকা কালকেতু ও ফুল্লরা ব্যাধ সমাজের প্রতিনিধি, মনসামঙ্গলের নায়ক চাঁদ সদাগর ও তার পুত্রবধূ নায়িকা বেহুলা বণিক সমাজের প্রতিনিধি। ফুল্লরা সহনশীল বাঙালি নারীর মহিমায় অভিষিক্ত। চাঁদ সদাগর দৃপ্ত ও অবনমিত পৌরুষের প্রতীক। বেহুলা আত্মবিশ্বাসে ভরপুর পুণ্য-পবিত্র নারীর মহিমায় উজ্জ্বল।

মনসামঙ্গল

মঙ্গলকাব্যের মধ্যে মনসামঙ্গল সবচেয়ে প্রাচীন, জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত। এটি সাপের দেবী মনসার লীলাসূচক আখ্যায়িকা কাব্য। মনসার মহিমা স্বীকারে চাঁদ সওদাগরের অনীহা ও মনসার বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিণামে তাঁদের অশেষ দুঃখভোগ, পুত্র লখিন্দরের মৃত্যু, শেষে পুত্রবধূ বেহুলার একান্ত সাধনায় লখিন্দিরের পুনর্জীবন লাভ এ-কাব্যের মূল বিষয়বস্তু। এই বিষয়বস্তু নিয়ে শতাধিক কবি মনসামঙ্গল কাব্য রচনা করেছেন। মনসামঙ্গল কাব্যের আদি কবি হিসেবে গণ্য হরি দত্ত। প্রাচীন কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন বিপ্রদাস পিপলাই। তাঁর কাব্যে চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যযাত্রা অংশে প্রাচীন সপ্তগ্রামের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়।

মনসামঙ্গল কাব্যের অন্যান্য রচয়িতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন : বিজয় গুপ্ত, নারায়ণ দেব, কেতকাদাস, ক্ষেমানন্দ, দ্বিজ বংশীদাস প্রমুখ।

চণ্ডীমঙ্গল

মনসামঙ্গলের পরে বিশেষ উল্লেখযোগ্য আখ্যায়িকা কাব্য হচ্ছে চণ্ডীমঙ্গল কাব্য। এতে রয়েছে দুটি কাহিনি : প্রথম অংশে কালকেতু-ফুল্লরা কাহিনি, দ্বিতীয় অংশে ধনপতি সওদাগর ও খুল্লনার কাহিনি। দুটি কাহিনি পরস্পর সম্পর্কহীন। দুটি কাহিনিতে চণ্ডীর মাহাত্ম্য কীর্তন করা হলেও তারা স্বতন্ত্র। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে ফুল্লরার বারোমাসী ও ভাঁড়ু দত্তের শঠতা ব্যাপকভাবে সমাদৃত। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আদি কবি হিসেবে গণ্য মানিক দত্ত। এই কাব্যের শ্রেষ্ঠ রচয়িতা মুকুন্দরাম চক্রবর্তী।

অন্নদামঙ্গল

অন্নদামঙ্গল কাব্যের কাহিনি রচিত হয়েছে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের গৃহদেবতা দেবী অন্নপূর্ণার মহিমা নিয়ে। এতে তিনটি কাহিনি সংগ্রথিত হয়েছে। পৌরাণিক শিব প্রসঙ্গের পর একে একে কাহিনিগুলি এসেছে। প্রথমে হরিহোড়ের কাহিনি, তারপর বিদ্যাসুন্দরের কাহিনি এবং শেষে মানসিংহের কাহিনি। ধর্মীয় উপাখ্যানের মধ্যে এ-কাব্যে ইতিহাস ও জনশ্রুতি স্থান পেয়েছে। অন্নদামঙ্গল দীর্ঘকাল ধরে জনপ্রিয় কাব্যের মর্যাদায় আসীন ছিল। এর রচয়িতা ভারতচন্দ্র। তিনি আঠারো শতকের শ্রেষ্ঠ কবি। মধ্যযুগের শেষ কবি হিসেবেও তিনি গণ্য।

ধর্মমঙ্গল

মঙ্গলকাব্যের আর একটি প্রধান শাখা ধর্মমঙ্গল। ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্য অবলম্বনে এটি রচিত। এই ধারার আদি কবি ময়ূরভট্ট পনেরো শতকের লোক। ধর্মমঙ্গল কাব্যে বৌদ্ধ, জৈন ও হিন্দু ধর্মের মিলিত প্রভাব লক্ষ করা যায়।

অন্যান্য মঙ্গলকাব্য

মঙ্গলকাব্যের প্রধান শাখাগুলির অনুসরণে আরো বহু দেবদেবীর কাহিনি নিয়ে মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে মধ্যযুগে। এদের মধ্যে রয়েছে : কালিকামঙ্গল, বিদ্যাসুন্দর কাব্য, শীতলামঙ্গল, ষষ্ঠীমঙ্গল, সারদামঙ্গল, রায়মঙ্গল, সূর্যমঙ্গল, গঙ্গামঙ্গল, কপিলামঙ্গল ইত্যাদি। এই ধারায় ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর কাব্য বিখ্যাত রচনা। রায়মঙ্গল রচিত হয়েছে সুন্দরবনের ব্যাঘ্রদেবতা হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ রায়ের মাহাত্ম্য নিয়ে। রায়মঙ্গল কাব্যে কুম্ভীর দেবতা ও পীর বড় খাঁ গাজীর মহিমাও বর্ণিত হয়েছে।

মঙ্গলকাব্যের প্রভাব আধুনিককালেও এসে পৌঁছেছে। নব্য বাংলা কাব্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিহারীলাল চক্রবর্তী লিখেছেন সারদামঙ্গল কাব্য (১৮৭৯)। এটি বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে কোনোভাবেই মঙ্গলকাব্যের সগোত্র নয়, কাব্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর উদ্দেশে নিবেদিত গীতিময় আখ্যায়িকা মধ্যযুগের মঙ্গল গানের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। (চলবে)