ওমর আলী : তাঁর স্বনির্ধারিত নিয়তি

বিভাগপূর্ব আমলেই কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়া আর যে দুজন মুসলমান কবি তাঁদের কবি প্রতিভার বৈশিষ্ট্যে কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি সাহিত্যিক সমাজের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, বন্দে আলী মিয়া তাঁদের একজন। অপরজন বলা বাহুল্য জসীমউদ্দীন। পূর্ব বাংলার পল্লিপ্রকৃতির সৌন্দর্য এবং গ্রামীণ মানুষের জীবনকথা এই দুজন কবির লেখনীতে যেভাবে রূপায়িত হয়েছে, তা ছিল এককথায় অদৃষ্টপূর্ব। দেশভাগের পর জসীমউদ্দীন ও বন্দে আলী মিয়া উভয়েই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। ফরিদপুরের জসীমউদ্দীন কলকাতা থেকে এসে আবাস গাড়েন ঢাকায়, যোগ দেন সরকারি প্রচার দফতরের চাকরিতে। অন্যদিকে বন্দে আলী মিয়া পাবনায় থিতু হন। মধ্যে কিছুদিন ঢাকা বেতারে চাকরি করলেও, রাজশাহী-পাবনা মিলিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত মফস্বলবাসীই রয়ে যান। সাহিত্যের নানা শাখায় অনায়াস বিচরণ ও সক্ষমতার পরিচয় দিলেও এবং পত্রিকা সম্পাদনা ও চিত্রাঙ্কনসহ নানা বিষয়ে পারদর্শী হয়েও দুশোর মতো গ্রন্থের রচয়িতা বন্দে আলী মিয়া যে শেষজীবনে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন, সে হয়তো তাঁর এই রাজধানী থেকে দূরে অবস্থানের কারণেই। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আল মাহমুদও যদি সময়মতো ঢাকায় পাড়ি না জমাতেন, ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে যদি সে সময় বইঘর-এর মতো একটি অভিজাত গ্রন্থ প্রকাশনালয় না থাকতো, মাঝে কর্মসূত্রে (ইত্তেফাক বন্ধ হওয়ার পর) যদি ওই প্রতিষ্ঠাটির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ না ঘটতো, এবং সেখান থেকে স্বাধীনতা-পূর্বকালেই যদি তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ কালের কলস প্রকাশিত না হতো, তিনিও হয়তো, ঢাকা ও কলকাতার নামী সব সাহিত্য-পত্রিকায় লেখা ছাপা হওয়ার পরও, আমাদের সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে যোগ্য সমাদর থেকে বঞ্চিত হতেন। অথচ পৃথিবীর অন্যত্র দেখা যায়, কবি-লেখক-শিল্পীরা অনেকে তাঁদের সাধনার উপযুক্ত পরিবেশ হিসেবে রাজধানী বা বড় শহরের বাইরে কোলাহলহীন কোনো স্থানকেই বেছে নেন।

কিন্তু এ-লেখাটি জসীমউদ্দীন, বন্দে আলী মিয়া কিংবা আল মাহমুদ – এঁদের কাউকে নিয়ে নয়। বন্দে আলী মিয়ার মতোই দেশের প্রান্তবাসী আরেক কবিপ্রতিভা ওমর আলীকে নিয়ে। তাঁর সাহিত্যিক নিয়তি বিষয়ে। তাঁর ব্যাপারে ঢাকাকেন্দ্রিক আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি বৃত্তের – উপেক্ষা যদি নাও বলি – একরকম ঔদাস্যের মনোভাব কীভাবে তাঁকে সুদীর্ঘকাল আমাদের পাঠক সমাজের মনোযোগের বাইরে রেখেছে, ভাবতে গেলে অবাকই লাগে। আবার পরমুহূর্তেই মনে হয়, না, এটাই তো স্বাভাবিক। এর অন্যথা তো হওয়ার কথা নয়। তিনি নিজেই তো এই কৃত্রিম ও ভোগসর্বস্ব নাগরিক জীবন – তার যাবতীয় কুশ্রিতা ও নিষ্ঠুরতার প্রতি তীব্র বিরাগ নিয়ে আমরণ প্রকৃতির কোলে বসবাস এবং এভাবে তাঁর কোমল, সংবেদনশীল ও সৌন্দর্যপিপাসু মনটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছেন। সেদিক থেকে এই স্বেচ্ছানির্বাসিত জীবন তিনি শ্রেয়োজ্ঞানে বেছে নিয়েছিলেন বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। তাঁর কবিতায় বারবার তথাকথিত নাগরিক জীবন ও সভ্যতার প্রতি তাঁর এই বিরূপতা কখনো নম্র আবার কখনো শ্লেষকায়িত ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে।

দুই

কবি ওমর আলীর জন্ম ১৯৩৯ সালে পাবনা জেলার চর শিবরামপুরে, মামার বাড়িতে। নবম শ্রেণি অবধি তিনি পাবনাতেই পড়াশোনা করেন। এরপর ঢাকায় এসে আরমানিটোলার হাম্মাদিয়া হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং তৎকালীন কায়েদে আজম কলেজ (বর্তমানে যার নাম সোহরাওয়ার্দী কলেজ) থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। পরে গিয়ে ভর্তি হন পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে। সেখান থেকে স্নাতক পাশ করার পর তিনি ১৯৭০ সালে প্রথমে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে ও পরে ১৯৭৮ সালে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকায় দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও তা ছিল খুবই স্বল্পস্থায়ী। পরে তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। শুরু করেছিলেন স্কুলশিক্ষক হিসেবে, পরে কিছুকাল কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় এবং পরে দীর্ঘ সময় নিজ জেলা পাবনায় কলেজ পর্যায়ে শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৯৭ সালে পাবনার শহীদ বুলবুল সরকারি কলেজ থেকে অবসরে যান। ২০১৫ সালের ৩রা ডিসেম্বর ৭৬ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন। যাঁরা কবিকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, জানতেন, কিংবা কখনো তাঁর কাছাকাছি এসেছেন, তাঁদের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, মানুষ হিসেবে ওমর আলী ছিলেন সরল প্রকৃতির। অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। কলেজে পড়ানোর পাশাপাশি সংসার চালানোর জন্য পাবনা শহরেই টিউশনি করতেন। কিন্তু সুযোগ পেলেই তিনি ছুটে যেতেন গ্রামে।

ওমর আলীর কবিতা রচনার সূত্রপাত তাঁর নয় বছর বয়সে, যখন তিনি চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। স্কুলজীবনেই তাঁর লেখা কবিতা ঢাকা ও কলকাতার পত্রপত্রিকায় ছাপা হতে শুরু করে। নিজের কাব্যযাত্রা সম্পর্কে শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় তিনি জানিয়েছেন, দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই বেতারে কবিতা পড়ার সুযোগ হয়েছিল তাঁর, আর সে অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছিলেন মুনীর চৌধুরী। লিখেছেন, ‘দৈনিক সংবাদ-এর ঈদ সংখ্যায় আমার কবিতা ‘বৃষ্টির বিপদে এক চড়ুই’ প্রকাশিত হলো ১৯৫৫ সালে এবং ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী ও কলকাতার দুরন্ত দুপুর-এর কবি নরেশ গুহ এর ভূয়সী প্রশংসা করলেন। আত্মবিশ^াস জন্মালো, হ্যাঁ, আমি পেরেছি এবং পারবো। আহসান হাবীব মোহাম্মদী ও সওগাত পত্রিকায় আমার কবিতা ছাপলেন। কলকাতার নতুন নতুন কবিতার বই এবং তিরিশের কবিদের শ্রেষ্ঠ কবিতা পড়ে ফেললাম। জীবনানন্দ দাশকেই বেশি ভালো লাগলো। আমার মননশীলতার সহায়ক হয়ে উঠলো এসব পঠন।’

ছাত্রজীবনেই ১৯৬০ সালে ওমর আলীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি প্রকাশিত হয়, যা পাঠক সমাজের মুগ্ধতা অর্জনের পাশাপাশি তাঁকে বিপুল কবিখ্যাতি এনে দেয়। তাঁর সমসময়ে প্রথম ও একটিমাত্র কবিতাগ্রন্থের মাধ্যমে এতটা খ্যাতি এদেশে আর কোনো কবির ভাগ্যে জুটেছে কি না সন্দেহ। এরপর ১৯৬০-এর দশকেই পরপর তাঁর আরো কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, যা তাঁকে আমাদের সাহিত্যের একজন অগ্রগণ্য কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত করে। এরপরও বছরে বছরে তাঁর আরো কবিতার বই বেরিয়েছে। যদিও এই পর্যায়ে তাঁর কবিখ্যাতি কিছুটা যেন আড়ালে পড়ে যায়। কবিতা ছাড়াও খান ম্যানসনের মেয়ে (১৯৬২) ও কুতুবপুরের হাসনা হেনা (১৯৮২) নামে তাঁর দুটো উপন্যাস এবং একটি ছড়াপুস্তক প্রকাশের কথা জানা যায়। সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতি হিসেবে ওমর আলী, কিছুটা দেরিতে হলেও, কয়েকটি পুরস্কার ও পদক পেয়েছেন। জীবদ্দশায়ই ১৯৮১ সালে তিনি কবিতার জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৭ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক দেওয়া হয়। এছাড়াও তিনি বন্দে আলী মিয়া সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮) এবং আলাওল সাহিত্য পুরস্কারেও (১৯৯১) ভূষিত হয়েছেন।     

তিন

কবি ওমর আলীর নাম আমি প্রথম শুনি বন্ধু কবি আবু করিমের কাছে। ১৯৬০ দশকের শেষদিকে, যখন আমরা দুজনেই স্কুলের নবম কি দশম শ্রেণির ছাত্র। কিন্তু তাঁর সুবিখ্যাত প্রথম কাব্যগ্রন্থটি কিংবা তার নাম-কবিতার সঙ্গে পরিচয় হতে আমার আরো কিছুদিন লেগে যায়। কারণ তখনো সে-বইটি সহজলভ্য ছিল না। তারপর পত্রপত্রিকায় ছড়ানো-ছিটানো তাঁর আরো কিছু কবিতা পড়ার সুযোগ হলেও (সিকান্দার আবু জাফর-সম্পাদিত মাসিক সমকাল-এর বিশেষ কবিতা সংখ্যায় কি তাঁর কবিতা ছাপা হয়েছিল? মনে করতে পারছি না), একটা গোটা কাব্যগ্রন্থ কখনো হাতে পাইনি। কজন পেয়েছেন জানি না। ফলে, তাঁর  শ্রেষ্ঠ কবিতা হাতে নিয়ে যখন সাতাশটি কবিতাগ্রন্থের হিসাব পাই, তখন চমক বা বিস্ময়ানুভূতির সঙ্গে সে তথ্যটি আমাকে একরকম অপরাধবোধেও আচ্ছন্ন করে।

প্রচুর লিখেছেন তিনি, যাকে বলে অবিরল ধারায়। পুনরাবৃত্তিময় তাঁর সে কাব্যচর্চায় ক্রমউত্তরণ বা বাঁক বদলের পরিচয় বিশেষ পাওয়া যায় না। আমাদের কজন কবি বা লেখকের বেলায়ই বা তা দেখা যায়? কবিতার ভাষা বা আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগ্রহ ও প্রচেষ্টার কথা শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় বলেছেন বটে, কিন্তু তাও তেমন করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। প্রথম কাব্যগ্রন্থের ‘একদিন একটি লোক’-এর মতো সংলাপধর্মী কিংবা ‘আমি কিন্তু যামুগা’র মতো আঞ্চলিক ভাষা মিশ্রিত কবিতা তিনি পরে বেশি লেখেননি। শেষদিকে তো অনেকটা স¦ভাবকবির মতো সহজ-স্বতঃস্ফূর্ততায় লিখে গেছেন। ফলে প্রথমদিকের সনেটধর্মী কবিতাগুলিতে যে শৈল্পিক নৈপুণ্যের ছাপ আমরা দেখতে পাই, পরে বিশেষ করে বর্ণনা বা বিবৃতিধর্মী রচনাগুলিতে তা ক্রমে দুর্লক্ষ্য হয়ে ওঠে। যদিও শুধু বাংলা সাহিত্যই নয়, ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের ও অন্যান্য ভাষার সাহিত্যের সঙ্গেও পরিচয় ছিল (পেশাগত জীবনে ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক), আধুনিক কবিতার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা রাখতেন। তবে নাগরিক জীবনের সকল রকম কৃত্রিমতার সঙ্গে দূরন্বয় সৃষ্টির আকাক্সক্ষা বা সংকল্পই হয়তো তাঁকে বারবার পুরনো বৃত্তে ফিরিয়ে এনেছে।

চার

তাঁর সময়ের আমাদের অন্য প্রায় সব আধুনিক কবির মতো জীবনানন্দ দাশ তাঁকেও প্রভাবিত করেছেন। কখনো কখনো হয়তো একটু বেশিমাত্রায়ই। যেমন প্রথম কাব্যগ্রন্থের ‘সেই নারী তুমি’ কবিতাটির উদাহরণ দেওয়া যায়, যেখানে তিনি লিখেছেন :

সেই নারী তুমি, যার হৃদয়ের সব অনুভূতি

লুপ্ত হ’য়ে গেছে, স্তব্ধ হয়ে গেছে, তোমার হৃদয়

এখন পাথর হ’য়ে শুয়ে আছে পৃথিবীর ঘাসে;

তোমার স্মৃতিকে তবু একটি পুরুষ বুকে বয়।

তবে ওমর আলীর বেলায় এই প্রভাবটা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। একেবারে শেষদিকের কোনো কোনো কবিতা এমনকি কাব্যগ্রন্থের নামকরণেও এই প্রভাবটা আমরা লক্ষ করি, যেমন :

বনানীতে দেখা হলো একদিন পাবনার লুবনার সাথে…

সমুদ্র কড়ির মতো মৃদু হেসে বললো সে, “কেমন

                                                   আছেন?…

দিন শেষে রাত হয় বাতি নেভে জাগে চাঁদ নক্ষত্র আকাশে

স্বপ্নে তখন দেখি জোনাকি ও লুবনা বেগম উড়ে আসে…

(‘লুবনা বেগম’, লুবনা বেগম) 

অবশ্য এই প্রভাব অঙ্গীকরণ করে এবং কোথাও কোথাও ছাড়িয়ে ওমর আলীর কবিপ্রতিভা নিজস্ব দ্যুতি নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর বেশ কিছু কবিতায়। এখানে তাঁর প্রথম এবং শেষদিকের দুটি কবিতাগ্রন্থের উদাহরণ দেওয়া যায় :

… শিমুল-শাখে যে নীল পাখিটা ডেকে যায়,

সে তো আমাদের পাখি। যে নদীটি বহমানতায়,

সে তো আমাদের নদী। আমাদের রৌদ্র, অন্ধকার।

হাসিনা তুমি ও আমি কিছুদিন এই পৃথিবীতে

বেঁচে রবো উজ্জ্বল বসন্তে আর অনুজ্জ্বল শীতে।

(‘হাসিনা’, এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি)

কিংবা

…জুতোর দোকান দেখলে মুখস্থ পদ্য মনে পড়ে

থাক, আমার এখন নতুন জুতো না হলেও চলবে…

জামার পকেট না থাকলে চলে না? কিন্তু অনেকেরই

                               জামা নেই তা-ও তো দেখি চলে

পায়রার মতো শ্রবণ ললিত দাম্পত্য নেই তা বলে কি

                                       সংসার থেমে আছে?

(‘এসব পছন্দ অপছন্দ’, ছবি)

তাঁর কবিতার বিষয় প্রেম, নারীর সৌন্দর্য এবং প্রকৃতি। অনেক কবিতায়ই অবশ্য এ তিনটি বিষয় মিলেমিশে আছে। নারীর প্রেমের তুলনায় তাঁর কাছে অন্য সবকিছু তুচ্ছ মনে হয়, স্বণর্, রৌপ্য, মণি-মুক্তা, এমনকি বইও (‘তুমি সুন্দরী’)। তবে কবির কাছে প্রেয়সী নয় অন্য বা পরনারী। নানা রূপে যেন প্রধানত সে তাঁর নিজেরই ঘরণী। যাঁর উদ্দেশে তিনি বলেন :

তুমি ছাড়া পৃথিবীতে আমার দুচোখে অন্ধকার

সব ফুল অর্থহীন, সব সুর আনন্দবিহীন

তুমি ছাড়া যন্ত্রণার নীল রাত্রি, দুঃখভরা দিন

প্রেয়সী, তুমি ও আমি। আমাদের এই সংসার।

পাঁচ

দেশ বা সমাজচেতনার উপস্থিতি তাঁর কবিতায় নেই বলা যাবে না। তবে তা কোথাও প্রবল হয়ে প্রকাশ পায়নি। বিশেষ করে ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে আমাদের দেশ কিংবা পৃথিবী যে অগ্নিক্ষরা সময়ের ভেতর দিয়ে পার হয়েছে, সে সময়ের আঁচ তাঁর কবিতায় সেভাবে পাওয়া যায় না। সমকালীন ইতিহাসের সঙ্গে এই আপাতবিচ্ছেদ, এটাও পরবর্তীকালে ওমর আলীর কবিতার পাঠকপ্রিয়তার পথে বিঘ্ন ঘটিয়েছে বলে ধারণা করি। দেশপ্রেম তাঁর বেশকিছু কবিতার বিষয় হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ বা একাত্তরের স্মৃতি নিয়েও তিনি লিখেছেন। যেমন লিখেছেন বাংলা ভাষা ও একুশে ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ও শিলাইদহ নিয়েও। সামাজিক শোষণ-বঞ্চনা, দারিদ্র্য, নারীনিগ্রহ এসব বিষয় ঘুরেফিরেই তাঁর কবিতার বিষয় হয়েছে। কিন্তু তাঁর স্বভাবগত মৃদু উচ্চারণ ও সাধারণ বর্ণনায় তা সীমাবদ্ধ থেকেছে। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ের স্বপ্নভঙ্গের হতাশা ও ক্ষোভও প্রকাশ পেয়েছে কবির ‘এখন আমাকে আমি ভুলে গেছি’র মতো কবিতায় :

… একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করেছিলাম…

সেই একটি ফুলের স্পন্দন চোরাপথে

নির্মম বিক্রি করে দিই

মরুভূমির পৈশাচিক উটের দৌড় প্রতিযোগিতার কাছে…

ওমর আলীর দীর্ঘ বর্ণনামূলক বা বিৃবতিধর্মী কবিতাগুলিতেও মর্মদ্রাবী বা পাঠককে চমকে দেওয়ার মতো পঙ্ক্তি অনেকই পাওয়া যাবে, যা সময়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবে তাঁকে চিনিয়ে দেয়। আর এ-কথাও তো ঠিক যে, কোনো কবিরই একটি সেরা কবিতারও সবগুলি বা অধিকাংশ পঙ্ক্তি তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় ধারণ করে না। ওমর আলী যখন লেখেন –

যুগল হাঁটুতে ধরা মাটির দোনায় সাদা চন্দ্রকিরণ টেনে

                                        নামাচ্ছে যে জন

কালো এক গাভীর ওলান থেকে কলিমের বউ সোনাভান…

মালেকা বেগম যেন গীটারে আঙুল রেখে নামাচ্ছে

                                        দুধের মতো সুর…

(‘সবুজ সুনীল মাছরাঙার দেশে’, ডাকছে সংসার)

কিংবা

আঁধার যেমন ঢুকে যায় বাতির ভেতরে

বাতিও যেমন ঢোকে তরল আঁধারে

শিকড় যেমন ঢোকে উর্বরতার গোপন মাটিতে

হে অফিস হে পৃথিবী রমণীকে ছুটি দিয়ে দাও

ভোর যেমন ছুটি দিয়ে দেয় কৃষ্ণপক্ষের

ক্ষয়িষ্ণু পূর্ণিমাকে সংসারের ধ্রুবতারাকে

(‘ডাকছে সংসার’, ডাকছে সংসার)

তখন কবির এই কাব্যভাষাই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন শক্তিমান কবিকে আমাদের চিনিয়ে দেয়।

ছয়

কবি হিসেবে ওমর আলী ছিলেন আত্মসচেতন। শ্রেষ্ঠ কবিতার (এপ্রিল ২০০২) ভূমিকায় আপন কাব্যচর্চার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানিয়েছেন, ‘জীবনানন্দ দাশ এবং জসীম উদ্দীনের গ্রাম বাংলা ও প্রকৃতিকে আরও প্রাণবন্ত ও বাস্তবচিত্রধর্মী করা’ই ছিল তাঁর কাব্যসাধনার লক্ষ্য। লিখেছেন, ‘এক হাতে আঁতুড়ে শিশু অন্য হাতে রান্নার উনুন নজরুলের সাথে এভাবেই আমার পার্থক্য এবং আমি তাঁর পরবর্তীকালের স্বতন্ত্র আধুনিক কবি। বলা যায় জীবনানন্দ এবং জসীম উদ্দীনের ধারাকে প্রশস্ত করেছি।’ আমরাও বলতে পারি, এই আত্মসচেতনতাই কবি হিসেবে তাঁর নিয়তি নির্ধারণ করেছে।