বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার ‘শব্দতন্তুজাল’

বিশ শতকের রিমার্কেবল স্প্যানিশ কবি আন্তোনিও মাচাদো (১৮৭৫-১৯৩৯) বলেছেন : ‘কবিদের হাতে রয়েছে সূক্ষ্ম তন্তু, এই তন্তু দিয়ে আমাদের স্বপ্ন, শুধুই স্বপ্ন, বুনে যেতে হবে।’ আমাদের কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে (১৯২০-৮৫) নিয়ে শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন : ‘চেতনা থেকে অবচেতনের, রূপারতি থেকে লীনরূপতার, একাকী থেকে মহাসৃষ্টির মুখোমুখি হবার মতো এমন ঘনতাময় কবিতার অভিজ্ঞতা বড়ো সহজে মেলে না।’ পরপর এই দুটো মন্তব্য কিন্তু এক প্রবণতার নয়। একই কণ্ঠও নয়। কিন্তু কবি-নির্ণয়ে বা কবিতা-যাচাইয়ে কোনো কবির ক্ষেত্রেই এ-ধরনের মতের ধারণা বাতিল করার ব্যাপার যেমন নয়, তেমনি অগ্রহণীয় মনে করারও কারণ নেই। কেননা, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রচুরত্বের যে প্রবক্তা-কাঠামো সেই চুয়াল্লিশ থেকে সারা কবিজীবনে পাঠক-সমাজে যা মিলেছিল, তা শুধু মহৎ নয়, দায় ও দায়িত্ব নিয়ে ‘প্রবহমান মনুষ্যত্বে’রই প্রতিষ্ঠা বলা যায়। এ নিয়ে তিনি নিরাপস। অননুকরণীয়ও বটে। এখন প্রশ্ন – কীসে অননুকরণীয়? একদম এক বিরাট এবং চাপ-চাপ ঘন বুর্জোয়া স্বার্থের বিপরীতে দুর্দাম কঠোর-কুঠারাঘাত প্রয়োগের নির্ভার সরল নির্মেদ উজ্জ্বল কাব্যভাষা তো তাঁরই – যেটি হানা দেয় চিত্তে ও মননে, চিহ্নিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিস্তরে – রাগীচোখে, ক্রুদ্ধ বয়ানের তীব্রতায় – সবকিছু যেন ফাঁস করে দেয়, জনচিত্তের করে নেয়। বেলেল্লাপনা, স্ববিরোধিতা, প্রবঞ্চনা, স্বার্থলোভ, লুকোচুরি, কিল খেয়ে কিল চুরিসর্বস্ব ব্যক্তি ইত্যাকার সবকিছুর বিপরীতে বীরেন্দ্রর কবিতা এক জল্লাদ-ত্রাস। প্রখর কমিটমেন্টে বোনা তাঁর ওই তন্তুজাল। অবশ্যই সাম্যে গড়া তাঁর সামাজিক সদ্ভাব। সেই লক্ষ্যেই কীসব ‘পাগলের প্রলাপ’।

‘অ-সামাজিক’, ‘সোজা’, ‘সাধারণ’, ‘অচল’ বীরেন্দ্র ধিক্কারে স্কন্ধে ধারণ করেন তাঁর চিরসত্যকে – সমস্ত পরাস্ত শৈথিল্য সমাজ-আততিতে বুনে দেন। আর তখনই তার ভেতরেই গোলাপ ফোটে। মানুষের মনুষ্যত্ব স্ক্রিনিং হয়, স্ক্রুটিনি চলে পরিশুদ্ধ মানুষের আকর উদ্ধারের। সেই মেসেজ – দীর্ঘ সময়ে জমে ওঠে। বস্তুত, এরূপ তাঁর আধার ও আধেয়।

দুই

বীরেন্দ্রর কবিতার ইতিহাসটা কী? চল্লিশে তো শক্তির শক্তি, সুভাষের শক্তি, সমরের তেজসমেত আরো অনেকেই দৃঢ়। তার ভেতর থেকে বীরেন্দ্র কী করে অন্য বলয় বানালেন! শুধু বানানো নয়, নিয়ে চললেন, প্রামাণ্য করলেন, পথ দেখালেন – এও যে কবিতার ভরকেন্দ্র, এই যে জীবন ও রাজনীতি, ভাষ্যটা ঠিক এই উচ্চতায় পর্যবসিত হতে সক্ষম – সেটি সকলের মাঝে সত্য করে তুললেন। সততা কারে কয়! কবিতার মহত্ত্ব কী – কী স্তরের অনুভবে এই সততা পরিশ্রুত, ফলে শঙ্খ ঘোষকে ‘আগুন হতে প্রেমের গান’টি তুলে আনতেই হয়। বীরেন্দ্রর প্রিয় কবিতাগুলিকে শঙ্খ আরো প্রিয় করে তোলেন, বুঝি একেবারে নিজের পথটা অগ্রজের নিকট পরখ করে নিতেই।

এখানে শুরুতেই আন্তোনিওকে রেফার করার কারণ, স্বপ্ন ও স্বাপ্নিক বীরেন্দ্রর তন্তুজালটি পরখ করার বিশ্বাস থেকে। কী তাঁর স্বপ্ন? যে স্বপ্নে গড়ে ওঠে এই হালরকমের শব্দ? ‘অন্ধকারে দেখা যায় না/ তবু/ অনুভব করা যায় চোখের জলের নদী প্রবাহিত/ এইখানে’। শব্দের মুকুর তো ধ্বনির স্বর – তাতে ছন্দ গড়ে উঠলে, বিভাময় হয় বিষয়ের ছায়া, গড়ে ওঠে তা চেতনে বা অবচেতনে – মনই তো বলে দেয়, কত কথা কত রূপ ওই তন্তুজালে আভাময় হয়ে প্রকাশ পায়। অন্ধকার আর ‘চোখের জল’ নিস্পৃহ; কিন্তু নদী তো গতিমান, সেখানে মানুষ সর্বদা সমুপস্থিত। কারণ, পরোক্ষে ‘আমি’-সত্তায় মানব অবশ্যই কেন্দ্র। কীভাবে কষ্ট-বেদনা-হাহাকারের আনন্দ, সুনির্দিষ্ট সময়-শিখরে অবমুক্ত হবে! এই সত্যটি কী সত্য নয়? আরো ব্যক্তকথন সৃজিত হতে পারে, পঙ্ক্তি-পঠনে নির্ণীত হয় শ্লেষ বা প্যারাডক্সিক্যাল কমপ্লেক্স। ‘অন্ধকার’ যখন বাস্তবত অদৃশ্য আসলে সে দৃশ্যকেই ইমেজবন্দি করে – যেখানে সে দেখে চলেছে চোখের জলের নদী, দুঃখের নহর। কাজটি কুশলে বর্তায় ‘এইখানে’তের উচ্চারণ। তখন অনুভব তীব্র হয়। সেটি পেয়ে যায় স্থানিক ও সময়ের ধ্রুপদ-কাঠামো। সেটি খুবই কাল পেরোয় আর সমকালের মহৎ মানুষের কণ্ঠ মেলায়, এক করে। সমস্ত কু-ব্যবস্থাকে চালান করে দেয়। বলছিলাম, স্বপ্ন নিয়ে তথা কবির স্বপ্নের কথা – যা আকরিত হয় তন্তুজালে! তবে এই উদ্ধৃতিটি কম কী!

কবির লেখা কিছু কাব্য : ‘রানুর জন্য’, ‘উলুখড়ের কবিতা’, ‘মৃত্যুত্তীর্ণ’, ‘লখিন্দর’, ‘জাতক’, ‘সভা ভেঙে গেল’, ‘মুখে দিয়ে রক্ত ওঠে’, ‘ভিসা অফিসের সামনে’, ‘মহাদেবের দুয়ার’। এই কাব্যগুলি ১৯৫১ থেকে ১৯৬৭-র মধ্যে রচিত। প্রচুর লিখেছেন, এ সময় Ñ আর লেখার ভেতর দিয়ে তৈরি হয়েছে জীবনের লাভাস্রোতের অন্ধিসন্ধি। কথাগুলি কেমন? নিশ্চয়ই গঁৎবাঁধা নয়। এ পর্যায়ের কবিতায় আছে ইন্দ্রিয়ের ভেতরে হৃৎকমলের আভা। আত্মভাবনার কথাগুলি বলেন প্রচুর আশাবাদের আগুন হাতে নিয়ে। এগুলি প্রথমদিকের লেখা। বয়স তখন তাঁর চল্লিশের কোটায়। বিশ্বযুদ্ধ তো মানুষকে চেনাল। মানুষ মানুষে নানা কষ্ট, বেদনা, বৈষম্য, ভেতরের হাহাকার, শূন্যতা – সব চিত্তের চিলেকোঠায় স্থান পায়। ভিত্তিটা আঘাতের অনুষঙ্গের চেয়ে সংবেদনায়। পচন ও লাঞ্ছনায়; ভর্ৎসনায়। অমসৃণ ক্লান্ত আলোর রেখা যেন একপ্রকার চিনে ফেলা। কবি নিজেই দাঁড়িয়ে রইলেন, অভাবিত অনিশ্চয়তার দেখা পেয়ে। লিখলেন :

মেঘে মেঘে রক্ত ঝরে, রক্ত ঝরে আকাশ মাটিতে

হাওয়ায়, হাওয়ার মতো হৃদয়ের ভাবনাগুলিতে   

রক্ত ঝরে, নীল মেঘ, কালো মেঘ, শাদা বলাকার

মতো সারি সারি মেঘ রক্তে রঙে হয় একাকার

ঋতুর দহনে; পোড়ে মেঘের অরণ্য, মেঘগ্রাম;

মনের সহস্র গলি রক্তস্নাত জানায় প্রণাম

ক্রান্তিলগ্ন আবির্ভাব।

অ্যান্টি-রোমান্টিক না বলে নিও-রোমান্টিক চালে প্রকৃতির ভেতরে নিজের বক্তব্য ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করার আভাস, অনুমান করি এখানে। ‘বেহুলা’ যদি ঐতিহ্যের কথা হয়, সেখানে রিচুয়ালগুলি কীভাবে কালে কালে ফিরে আসে! বেদনার কথাই শুধু সেখানে থাকে না। ট্র্যাডিশনাল কথামৃত প্রচুর শক্তি হয়ে স্বভঙ্গিমাকে প্রকাশ করে : ‘গান দেব, জ্বলব, কিন্তু হব না অঙ্গার;’ – উপর্যুক্ত পঙ্ক্তিমালায়ও ‘ক্রান্তিলগ্ন’কে চেনার অবকাশটি পুনর্গঠিত হয়। প্রাচুর্যময়, অন্তহীন প্রয়াস আনন্দের কিন্তু প্রাত্যহিকে দৃশ্যমান সবটুকু দগ্ধ, বিষম আর সর্বনাশা মোহে আচ্ছন্ন। তাহলে প্রশ্ন, এই ক্লান্তি কেন? ক্লান্তির রূপ প্রচ্ছন্ন – অনেকটা নির্জনও; কিন্তু তাতে গড়ে ওঠে তো বিষাক্ত ধিক্কার। বীরেন্দ্র এক নতুন সংজ্ঞার্থ যেন হাজির করেন। সেটি মানুষের জীবনে হয়তো নতুন কিছু নয়। কিন্তু ক্রোধ-ঘৃণার এই স্বাদ গভীর বিবিক্ত ও রক্তাক্ত। গভীর চেতনা থেকে তা উঠে আসে। মর্মের ভেতরের ঘুম ভাঙায়। তিনি ক্রমশ আলাদা হন। এই সহজাত ও চেনা বিষয়কে নিয়েই কিন্তু নতুন হয়ে পড়েন কবি – বিস্তর ও অন্তরঙ্গ গভীরতার অতল অনুষঙ্গ প্রস্তুতকরণ প্রয়াসে। যখন মেঘের হাওয়ার রং পাল্টায়, রক্তরং ধরে ওঠে – তখন বিশ্বযুদ্ধোত্তর সমাজে-ব্যক্তিতে সততা, সাম্য, পৌরুষেয় ব্যষ্টিক স্বার্থবিরোধী প্রবণতার অন্তঃস্রোত গড়ে তোলে – বিপরীতে হাঙরের গ্রাস কিংবা অক্টোপাসের আক্রোশ ধারণ করা সমাজ ও ব্যক্তি পরশের প্লাবনে প্রবহমান মনুষ্যত্বের ভিত্তিতে স্থাণু হয়ে পড়ে। সহজ ও প্রচ্ছন্নতার ভেতরেই গভীর স্বতঃশ্চল ধারাবিবরণী তৈরি করে। ‘In a defence of poetry, [Shelley] attempts to prove that poets are philosophers; that they are the creators and protectors of moral and civil laws … Poets introduce and maintain morality. The mores so created are codified into laws. The social function or utility of poets is that they create and maintain the norms and mores of a society.’ – এটি বহুল প্রচারিত কথা। সেটি বীরেন্দ্র যে কোনো মুখাপেক্ষিতায় আমলে নিয়েছেন, তা মনে হয় না। কিন্তু প্রকৃত কবির এই পথ চিনে নিতে দেরি হয় না। বস্তুত, ‘নিজের মধ্যে নিহিত থেকে অর্কেস্ট্রা বাজানো’টা তিনি বাজাতেন। তাই ভণ্ড পৃথিবীটা চিনে নিতে তেমন সময় লাগে না। কাব্যগ্রন্থের নামেই তার প্রমাণ।

আর পঙ্ক্তিতে গড়া যে টেক্সচার তা নিজস্ব স্বপ্নে ঘেরা। স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন দ্বান্দ্বিক, কিন্তু হাতে হাতে ধরে প্রবাহটি তৈরি করে। ফলে প্রকৃতির ভেতরেই ‘প্রাকৃত সারস’ যেন উড়ে যায়। বয়স যখন কবির বাড়ে তখন তপ্ততার স্বেদ বাড়ে। আরো ক্রুদ্ধ হয় মন। তবে কবিতাচেতনায় ‘চীন’, ‘ক্ষুদিরাম’ অবশ্যই ‘ডিফেন্স অব পোয়েট্রি’ – সন্দেহ নেই।

অভিজ্ঞতাটা ইন্দ্রিয়ের আঘাতে যেন অনভিপ্রেত (যেটি আগে দেখা যায়নি – ‘বিশেষ প্রকাশক’) শব্দবন্ধে উদ্ভাসিত হয়, তাতে কবি-স্বায়ত্ত কায়েম হয়, দেখা-না-দেখা, পাওয়া-না-পাওয়া, চেনা-অচেনা প্রজ্ঞা নিয়ে। উন্মাতাল সময়, এলোমেলো ছন্নছাড়া লোভ, বিচ্ছিন্নতা, বিকটত্ব, উৎকটত্ব, মানবতার উৎখাতপ্রবণ শক্তির লোলুপ অট্টহাসি, শিল্পপুঁজির কেন্দ্রে হনন করা যাবতীয় সুন্দর – তখন বীরেন্দ্রর কবি-ত্রিকালদর্শিতা ওই শব্দের খুঁটে গ্রথিত হয়। কোনো ছাড় নেই তাতে। জীবনবাজির অঙ্গীকার – ‘মানুষ’কেন্দ্র চরম কমিটমেন্টে গুরুত্বপূর্ণ। শুধু অধিকার বা দায় না, বীরেন্দ্রর কবিতার কেন্দ্র ওই বিষয়ের নিমিত্ত ব্যক্তির মন ও মানস। ব্যক্তির আকাশ। দুর্মর সে ব্যক্তিত্ব। মানুষই তার উত্তমর্ণ। সেখানে কবিত্বশক্তির উদ্যাপন চলতে থাকে। স্বীয় ভাষা ও প্রতিজ্ঞা অকপটে অবগাহিত হতে থাকে। নিশ্চয়ই তুল্যমূল্য ধরনের এসব কিছু নয় – যখন অন্তত, চেতন-অচেতন সত্তাজাত আঘাত-প্রতিঘাতের প্লাবন আমরা দেখতে পাই। সেখানে ইন্দ্রিয়-সংবেদ তীব্রতর রূপে, পরতে পরতে, প্রতি মুহূর্তে সক্রিয় থাকে। সে সক্রিয়তায় শব্দের অর্থ বিশেষ ভার তথা মিনিং তৈরি করে। সে মিনিং মিছিলের, সাম্যের, শ্রমস্বার্থসঞ্জাত। বাতিল করা বিন্দুমাত্র মানববিরোধী কোনো স্বার্থ। সেখানে ফরমাল বা আনুষ্ঠানিকতারও কোনো প্রগল্ভতা থাকে না। থাকে উলুখড়ের কবিতা বা বস্তির রচনা। কার্যত, সমাজের খাদ, ব্যক্তির বিচ্যুতি একপ্রকার উৎপাদন-সম্পর্কের ভেতর থেকে গড়ে ওঠে। বুর্জোয়াবৃত্তির কালোয়াতি, মেশিনারিজ বাণিজ্য, করপোরেট শোষণ বিশ্বজুড়ে বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরেই হামলে পড়ে, নানা ফায়দায় নানা মেজাজে। সেটি ক্রমশ বাণিজ্যদ্বন্দ্বে পরিণত। ফলে, সেখানে কে কার? বীরেন্দ্র এসব কবিত্ব করেন মতবাদদুষ্ট হয়ে নয় বা কোনো মত প্রতিষ্ঠিত করতে নয়। প্রকৃতি ও মানুষের চিরায়ত সংশ্রবকেই তিনি ষাটোত্তর কাব্যপ্রকরণ করে তোলেন; অনেকের থেকে স্বতন্ত্র করে। প্রকাশের ভিন্ন তাণ্ডবে। সেজন্যই মুণ্ডুহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে। কী তবে প্রকরণ? ‘মুণ্ডুহীন’ কোন্ সংকেতের আততি? পুরো শিরোনামটিই বা কি বীভৎসতার আলাপে দৃঢ়তর? কোনো অস্পষ্টতা আছে কি?

অসীম করুণা তাঁর, ঐ বধ্যভূমি, যাকে বলি মাতৃভূমি

জল্লাদেরা প্রেম বিলায় কোলের শিশুকে, তাঁর লীলা

কবিরা কবিতা লেখে, দেশপ্রেম, ক্রমে গাঢ় হয় গর্তের

                                       ভিতর রক্তপাত –

মুণ্ডুহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চীৎকার করে,

বীরেন্দ্রর এই শব্দখেলাই মুক্ত-পরিসরের তৎপরতা। যেটি ক্রমশ সম্পূর্ণতর হয়ে চূড়ান্ত অবমুক্ত হয়েছে। হাওয়া দেয়, মানুষের মুখ, মুণ্ডুহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে, আমার রাজা হওয়ার স্পর্ধা, রাস্তায় যে হেঁটে যায়, জ্বলুক সহস্র চিতা অহোরাত্র এ পাড়ায় ও পাড়ায়, মানুষখেকো বাঘেরা বড় লাফায়, এই জন্ম, জন্মভূমি, সেই মানুষটি, যে ফসল ফলিয়েছিল, ভিয়েতনাম ভারতবর্ষ, বাহবা সময়, তোর সার্কাসের খেলা, পৃথিবী ঘুরছে, মহাপৃথিবীর কবিতা, শীত বসন্তের গল্প, বেঁচে থাকার কবিতা, দিবস রজনীর কবিতা, আরেক আরম্ভের জন্য, ভাতে পড়লো মাছি, উচ্চারণ, এই হাওয়া, সত্তর আশির কবিতা Ñ এসব কাব্যগ্রন্থে কবিতাগুলির নামই সংকেতায়িত করে; সহজ ও গভীরতম অনুভবের স্বল্প প্রয়াসে :

এই জন্মে কে তুমি? কোথায় যাও? পথ

যতোদূর দেখা যায় নদী, শীর্ণ, লোহিত …

নরক কোথায় ছিল এতোকাল? কেমন ঘুমন্ত

এই শহরে! এখনো কবিতা লেখ?

তুমি কেন লেখ?

এ তো গান নয়, ছবি নয়

শুধু শ্মশান! এ জন্মভূমি কবে ছিল তোমার? 

এবং,

এভাবেই বুঝি দিন যাবে –

মাঝেমধ্যে সভা হবে,

পুলিশ পাহারা দেবে মন্ত্রীদের

মাঝেমধ্যে আলো নিভবে, আলো জ্বলবে;

শিশুরা হাততালি দেবে, মন্ত্রীরা বিদেশ যাবে;

বর্গী এসে খাজনা চাইবে, বুলবুলি ধান খাবে;

খোকারা ঘুমুবে, পাড়া জুড়ুবে …

বুঝি এভাবেই সাঙ্গ হবে দিন-বদলের পালা   

যার জন্য এতো কান ঝালাপালা, এতে

কথার ফুলঝুরি, এত সব …

এইসব কবিতার ভেতরে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নির্ভার আবিষ্কার করা সম্ভব। কবিতাশিল্পে ‘সিনট্যাকটিক ট্রায়াঙ্গল’  ধারণার প্রবক্তা আই. এ. রিচার্ডস যেমনটা বলেন অভিজ্ঞতা, স্বজ্ঞা ও তৎসৃষ্ট প্রকরণের কথা – যেখানে কবিধর্ম ও কবিতাকে বিস্তর অনুধ্যানে পাঠ করা ও মর্মের সামূহিক উদ্যাপন করা যায়। শব্দকেই সর্ব-সামর্থ্য করে তুললে বা সহজবোধ্য হয়ে উঠলে তা কীভাবে কাব্য-সমীপে পর্যবসিত হয়? বিশ্বযুদ্ধের পরে পাঁচ ও ছয়ের দশকে এই রীতি কীভাবে রাজনীতির আজ্ঞাকে আমলে নিয়ে কবির অভ্যন্তরীণ শক্তি বাড়িয়ে তুললো – সে দক্ষতায় এই উদাহরণগুলি পড়ে নিলে প্রবণতার দায় চিহ্নিত হয়, তখন স্পষ্ট হয় বাংলা কবিতা কোন সময়খণ্ডে কেন এমন রীতিকে গ্রহণ করল। ঐতিহ্যকে অস্বীকার না করে, দেশ-কালকে অপ্রত্যক্ষ না রেখে, স্বার্থজীবীকে দুমড়ে-মুচড়ে নিপাট সৌন্দর্যের স্বরকে অনিবার্যতায় আনলে এই বিশ শতকে পাশ্চাত্য কবি এজরা পাউন্ড কিংবা অনতিপূর্বে ম্যাথু আর্নল্ড কবিতাকে যে অর্থে ‘প্র্যাক্সিস’সারার্থ দেন, তেমনই কী বীরেন্দ্র নয়! বীরেন্দ্রর টোন, শব্দার্থ, সিনট্যাক্স, ছদ্মবেশের ছিন্নতা – সেই পুরনো ধারণাকে বাদ দিয়ে বলতে পারে জন্মভূমির শ্মশান হওয়ার খবর আর সেখানে দিনবদলের প্যারাডক্স রাজনীতির দিনকাল তো কবিকেই দিতে হয়! কীভাবে যেন তা আর বাইরেরও থাকে না। সমস্ত উত্তাপ আছড়ে পড়ে অন্তরের ইন্দ্রিয়ে। প্রতিটি পরতে তা কড়া নাড়ে। অবসাদের গোড়া ধরে টান দেয়। শব্দের মধ্যে আনে নৈঃশব্দ্য। চিৎকারের মধ্যে আনে নিস্তব্ধতার কোলাহল। ব্যক্তি প্রখর শ্বেদ আর ক্লান্তিতে ফিরে দেখে তার চারপাশ শূন্য, অহোরাত্রির অনিবার্য সত্য ছিনতাই হয়ে অসত্য দাঁড়িয়ে আছে রাষ্ট্রের নল তাক করে। যেহেতু কবির কেন্দ্র নির্বিবাদে ‘মানুষ’ – যেখানে তিনি সৃষ্টি করতে চান মনুষ্যত্বের প্রবাহ – সেখানে সাঙ্গ করা দিনযাপনে, রাষ্ট্র যে প্রতিপক্ষ, মানুষের হন্তারক, মনুষ্যত্বের সংকোচক আর জন্মভূমিটুকু নাই করে দিয়ে সেখানে গড়ে তোলে বন্দুকধারীরা শ্মশানের ছায়া; তাতে নির্মম সত্যটি নির্ভারত্বের দায়ে এই প্রকরণ হাতে নেয়। প্রব্রজ্যা নেয় সেই গূঢ়ত্ব, রোমান্টিক বিভূতি আর প্রচ্ছন্ন বিবাগী কণ্ঠস্বর। বীরেন্দ্র সেখানে প্রতিবাদ। অনেকের মধ্যে অন্যতম হয়েও, স্বতন্ত্র। আগে সুভাষ, সমর – পরে প্রণবেন্দু-শঙ্খ, কিন্তু তিনি ‘একক’; সমস্ত আয়োজন নিয়েই উন্মাতাল ও উন্মেষ-পরিণতিসাপেক্ষে একক। ফলত, সেই নামেই তা চিহ্নিত হয় মুণ্ডুহীন ধড়ের আহ্লাদী চিৎকার কিংবা মানুষখেকো বাঘের লাফারি বা দেশভাগের দায়ে দাঁড়ানো দুই ভাই ভিসা অফিসের সামনে Ñ মারাত্মক নমিত অনুভব, যাতে ‘আধুনিক’ অন্তর্বাচনের সংস্রব প্রতিষ্ঠা পায়।

তিন

আবার আন্তোনিও মাচাদোর স্বপ্নের ‘ধারণা’টি আমলে আনা চলে। রাষ্ট্রের ‘শ্মশান’ গড়ার আয়োজন কিংবা জনতার বিপরীতে পুলিশের হাততালিতে কবির কীসের স্বপ্নবুনুনি থাকতে পারে! সেখানে কীভাবে তা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? কবির এই স্কন্ধবাহিত সরল শক্তিচেতনা যা ধসে গেছে সমাজ-রাষ্ট্রের আগ্রাসী অভিঘাতে সেখানে লেনিন, মাও, লুমুম্বা, ভিয়েতনাম, চীন প্রেরণার স্বরূপে একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত তৈরি করে। কিন্তু নিশ্চয়ই সেসব নজরুল-সুকান্ত ধাঁচের নয়। কবি-উক্তি তীব্রভাবে ব্যক্তির নম্র, অবিনাশী, উত্তমর্ণের আকরণ পায়। সেখানে ব্যক্তির চ্যুতি-বিচ্ছিন্নতা কেন কীভাবে সংবিধান-রাষ্ট্রে ধৃত হচ্ছে, জটিল রূপ নিচ্ছে তার ইঙ্গিতটি প্রকরণে জমাট বাঁধে। এতে সচেতন ও আধুনিক দৃষ্টিকোণটি কবি পেয়ে যান – সময়ের দ্বন্দ্বদীর্ণ সচল সচেতন সক্রিয়তা থেকে। ষাটে-সত্তরে কবির কাব্যসৃজনের প্রকাশশীলতার চরম সময়।

নকশালবাড়ি-চীন-সোভিয়েত-ভিয়েতনাম রাজনীতির চরম সময়। বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী দুই মেরুর স্নায়ুযুদ্ধ, চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব, পেরু-কিউবা চে চেতনা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্বপ্নবুনুনিতে যতটা রোমান্টিক স্বর তৈরি করে ততটাই মানুষ-ভাবনার চিরায়ত পরিসর রচনা করে। এ মানুষ কেমন? মনুষ্যত্বপ্রবণ। মনুষ্যত্ব ও মননশীলতা যে মানবের কেন্দ্র, সেভাবেই সমাজ তৈরির স্বপ্ন প্রভূত ইঙ্গিতে পরিস্রুত হয়েছে কবিতায়। সহজ কথায় বলেন গভীরতর অসুখের কথা। এক্ষেত্রে শঙ্খ ঘোষের উপলব্ধি :

কী অর্থে নতুন এই ভাষা, সেটা লক্ষ করবার জন্য কিছুটা ইতিহাসের কথা তুলতে হবে। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে আমাদের কবিতায় যখন আধুনিকতার আন্দোলন চলছিল, রবীন্দ্রনাথের সর্বগ্রাস থেকে বেরিয়ে আসবার জন্য কবিতা কোনো কোনো নতুন পথ খুঁজছিল তখন। বিচিত্র সেই পথগুলোর দুটো সাধারণ লক্ষণ ছিল শিল্পিতা আর মনীষীতার আতিশয্য। বোধ নয়, কবিতার প্রধান ভর মেধা – এই সূত্রটির ঘোষণায় রবীন্দ্রনাথও কিছু-বা আপ্লুত ছিলেন মনে হয় … ‘শিল্পের উত্তরীয়’ই হোক আর এই ওলটপালট করে দেওয়া ‘আঙ্গিকের বিস্ফোরণ’ই হোক, দুইয়েরই কেন্দ্রে আছে কোনো-এক প্রসাধনের, শিল্পিতার ঝোঁক। এই ঝোঁক থেকে যে স্মরণীয় কিছু সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। [‘কবিতার মুহূর্ত’]

এমনটাই জীবনানন্দ-পরবর্তী বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা। শঙ্খ ঘোষ বীরেন্দ্রকে পরিষ্কার স্বীকরণে নিয়ে স্পষ্ট করে বলেন, সেই প্রথম থেকে একেবারে আমার যজ্ঞের ঘোড়ার (১৯৮৫/ কবির মৃত্যুর বছর) শেষ কবিতা ‘একটি অসমাপ্ত কবিতা’ পর্যন্ত কবি এক শিথিল বহিরাবয়বে পৌঁছে গিয়েছেন অভ্রান্ত লক্ষ্যে। সে-লক্ষ্য ওই ষাট-সত্তর পর্বের রাজনৈতিক সমাজের বাস্তবতা। আর সেটি গড়ে উঠেছে সময়ের সিঁড়ি বেয়েই। এই অভ্রান্ততা কী? শব্দ আর প্রতিমাগত স্বরূপচিহ্ন। পূর্বোক্ত উদাহরণের ধারা বেয়ে আরো বলার অবকাশ তৈরি হয় :

আদিম অন্ধকারের মুখোশদেবতা

তোমার একটিই আনন্দ

আমাদের মুখ ম্লান করে দেওয়া। 

এই ভিত্তি সহজ বোধের, সরল উচ্চারণের। পূর্ণতায় যা স্নিগ্ধ ও ক্রুদ্ধ ধনুকের ছিলার মতো টান টান। এমনটা কেন? প্রচলিত সাজানো রসনা-বিলাস আর নয় কবিতার, বাতিল সব বহ্বারম্ভ, হইচই বা অস্পষ্ট তুলতুলে কথার বাহারি ধ্রুবপদ – ফলে দৈনন্দিনতায় গড়ে ওঠে বীরেন্দ্র-ভাষান্তর। সেটি স্টান্ট নয়। উৎপলকুমার বসু আর এই কালীকৃষ্ণ গুহ পর্যন্ত তো আমাদের এই রূপটাই দেখতে হবে। অর্থাৎ আধুনিকতার একপ্রকার সংজ্ঞার্থই তো তাতে দানা বাঁধে। 

বীরেন্দ্রর শেষদিকের কবিতায় কাব্যপ্রসিদ্ধির একটি অধিকতর রূপ পরিলক্ষিত হয়। সেটি পূর্বের লেখনীকে অস্বীকার করে নয়, বরং সেই ধারাটিই আরো পরিণত ও নতুন আস্থার অভিমুখ তৈরি করেছে। তিনি লেখেন ‘যোদ্ধার হৃদয় বলে কিছু নেই।/ নেই পিছুটান?/ যেখানে সন্ধ্যাবাতি জ্বলে, শিশুকালে/ মানবী ছায়ার মতো –  শীর্ণ, প্রতীক্ষায় …/ বন্দুকের নল ছাড়া তার চোখে আর কোনো স্বপ্ন নেই’ – এই চরণমালা আমাদের কী সাক্ষ্য দেয়? সেটি কী শুধু কোনো নির্দিষ্ট সময়ের নাকি চিরকালের? এই এখনকার ব্যবস্থায় আমরা কী একে অস্বীকার করতে পারবো? শুধু ব্যক্তিপর্যায়েই বা কেন নৈর্ব্যক্তিকভাবে কিংবা বৃহত্তর পরিসরে এসব উক্তি কী অনর্থ তৈরি করে। কবি তো ভেতর থেকেই স্বপ্ন তৈরি করেন, বৃক্ষ-জীবন প্রত্যাশা করেন। উদার আকাশী স্বপ্নে সকল মানুষের কন্দর জুড়ে ভরিয়ে দিতে চান জীবনের আলো, সুস্থ সম্বন্ধের সৎকার আর মনুষ্যত্ব নিয়ে চলার অহংকার। তাতে এইসব পঙ্ক্তি কী বলে? ‘যোদ্ধা’ই তো সবটুকু তৈরি করে দেন সবার জন্য, নির্ভার হয়ে, কোনো বাতাবরণ তৈরি না করে, অবগুণ্ঠনে না থেকে স্বচ্ছতোয়া খোলা হাওয়ায় তিনি পরিয়ে দেন মুক্ত জীবনের সংবেদ। এই প্রযুক্তিপ্রবাহিত করপোরেট জীবনে সেটা সহজ নয়! আগ্রাসী অসততা, মানুষকে বিষাক্ত নীলকণ্ঠে কণ্টকিত করেছে। রাষ্ট্রীয় বিধিব্যবস্থা প্রচণ্ড স্ববিরোধীতাযুক্ত। পরস্পরের কাছাকাছি কেউ নেই। থাকলেও তা অসুস্থ, দূষিত, কর্দমাক্ত। ভেজালের নিঃসরণ। ফাঁকি, হিপোক্রেসি আর লোলুপ বিকারে তারা পরাক্রান্ত। সে সমরে প্রকৃত ও সৎ যোদ্ধার হৃদয় বলে কেন কিছু থাকবে? আর পিছুটান থাকলে কী চলে? যাদের পিছুটান আছে তারা স্বার্থের বৃত্তে, নিজেদের গুটিয়ে রাখে। বীরেন্দ্র শব্দগুচ্ছের ভেতর ডিলেমা তৈরি করেন, দ্বৈরথে আঁটান। বুঝিয়ে দেন সদর্থক-নঞর্থক পরিক্রমার কথা। সেজন্যেই প্রয়োজনীয় প্রকরণের (নেই আঙ্গিকের বৃথা আস্ফালন কিংবা শৈলীর উত্তরীয়) অবমুক্তিতে সমস্ত সরল-নিপাট তথ্যকথাকেই কাব্য করে তোলেন, তাই-ই শৈলী হয়ে দাঁড়ায়। পর্যবসিত হয় তাবৎ বক্তব্যের ও অনিবার্য রূপকল্পের দোসর। বোধকরি সময়ই সেটি কবিকে ওই প্রকরণে প্রস্তুত করে। ঠিক টেক্সটে সমালোচক যখন সেটি উদ্ধার করেন, তখন দেখা যায় নতুন একটি ধারা – পর্যবসিত হয়েছে সংহত প্রকরণ সমীরণে। তাতে একই সঙ্গে, এরূপ যাত্রারথে আরো অন্যদেরও পাওয়া যায়। মিলে যায় অবারিত চিন্তাস্রোতের বাস্তবতর ধারায় কবির অবস্থান। সামূহিক বাস্তবতা তো কবির শুধু নির্ধারিত হয় বা প্রত্যক্ষতার সমীকরণে নির্মিত হয় না – সেটি ত্রিকালদর্শিতা এবং নিজের-অন্যের সামূহিক প্রবণতায় কবির জানা-অজানার ভেতরে তৈরি হতে থাকে। ফলে, সহজ ও সিদ্ধিজাত কবি সেটি তুলে নেন তাঁর নির্ধারিত শব্দবন্ধে। সেজন্যই জরুরি সত্তরের সেই অবস্থা জারির আগেই কবি বুঝে নেন – তার কর্মপরিখা। কিংবা নকশাল দ্রোহের সময়টা গেঁথে যায় শরীরে। চীন, ভিয়েতনাম, লেনিন, লুমুম্বা চিরায়ত হয়ে ওঠে। মানুষের ও মনুষ্যত্বের অনুকূলে দাঁড়ান। কবি দৃঢ়তররূপে অবারিত করে তোলেন এসব অর্থ ওই কবিতায়। কবি পেয়ে যান তার ভেতরেই সত্যিকার মানুষ ও মনুষ্যত্বের চিন্তাধারা, যা হয়ে দাঁড়ায় কালোত্তরের প্রতিশ্রুতি। অন্ধকার পেরুনোর নির্ধারিত শপথ। আলোর জন্য যাবতীয় যোদ্ধাবৃত মন। বস্তুত, এই-ই নির্ভার প্রকরণে ধৃত বীরেন্দ্রর কবিমেধা Ñ যেটি এক অর্থে আঙ্গিকের বিস্ফোরণের ভেতর নির্মেদ বিষয়ের সূক্ষ্ম তন্তুজাল। আর এই বিষয়ই নির্ধারিত বিষয়ীর ধারাবিবরণী। সেটিই কবি-স্বপ্নের আকরিত শব্দতন্তুজাল।