যুদ্ধ ও মধুবালা

যুদ্ধের দিনে বাড়িতে ফিরে এসে খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মোহাম্মদ হাসিবউদ্দিন দেখলেন, ঘরের দেয়ালে মধুবালার ছবি নেই।

দরজা বন্ধ থাকলে সেগুন কাঠের দুটো পাল্লার ওপর খোদাই করা দুটো ময়ূরের দুটো চঞ্চু বন্ধ পাল্লার দাগের সামনে বাধা পায়।

ময়ূরের পাখায়, গলায়, নেচে-ওঠা পেখমে ধুলো জমেছে। অনেকদিন হলো হাসিবউদ্দিনের বউ কানিজ দরজা মোছেন না।

এপ্রিল মাসের ১৪-১৫ তারিখের আগেই বোমারু বিমান? পাক সেনা মারা পড়ল পাবনায়? শহরের এবং গ্রামের কোনো কোনো বাড়ির বন্ধ ঘরের মাঝখানে, সন্ধ্যায়, হারিকেনের আলো কমিয়ে, শ্রোতারা প্রায় শ^াস বন্ধ করে, কেউ কথা বলছে না, সতর্ক কানে, সব শব্দ শোনাও যায়নি, রেডিওতে শোনার চেষ্টা করছে কোথায় কী ঘটছে সেই খবর। স্বাধীন বাংলা বেতার শুরু হয় মে মাসে।

দুটি বোমারু বিমান, পাকহানাদারদের, তখন বেলা দুটোর কাছাকাছি, চৈত্রের শেষ, রৌদ্রে মাটি পুড়ছে, আকাশে মেঘ নেই, দোহারপাড়া গ্রামের কোনো কোনো বাড়িতে আখায় ভাত বা ডাল ফুটছে, কজন তরুণ পুকুরে কাটছে সাঁতার, দুজন বয়সী মানুষ বুকপানিতে নেমে মুখ ধোয়া, কুলি করা ও কথা বলায় ব্যস্ত, কী কথা? হতে পারে ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বা ‘শেখ মুজিবরে কি মাইরে ফেলছে?’ অন্য ঘাটে তিনজন মেয়ের মধ্যে একজন ধলা মুখে সাবান দিচ্ছে, অন্য দুজনের একজন কথা বলছে, হাসছে; অন্যজন চুলে নারকেল তেল দিতে দিতে শুনছে কথা, তিনজনেরই ছয় পা পানিতে ডোবা, তার মধ্যে একজন দুটো পা দোলাচ্ছে, ছোট ছোট ঢেউ দেখছে অন্যজন, পাবনার আকাশের অনেক নিচ দিয়ে তিন চক্করে ভয় ও আতঙ্কের তীব্র আওয়াজে দুটি বিমান বলে গেল : ‘হম র্মানে কে লিয়ে আয়ে হ্যাঁয়, জিনা ভি যাবর ক্যারনে আয়ে হ্যাঁয়, জ¦ালানে কে লিয়ে আয়া।’

যুদ্ধ কী, দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ; মন্বন্তর কী, চুয়ান্নর মন্বন্তর; হিন্দু মহাসভার অধিবেশনে সাভারকরের ‘হিন্দুত্ব’ তৈরি, জিন্নাহর ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ – সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কী, ক্যালকাটা কিলিং; দেশভাগ কী, মানুষ আর বাংলার মাটি, আকাশ, বাতাস ভাগ হয়ে যাওয়া, – এসবের ভয়াবহ চেহারা দেখা ও বোঝা, কলকাতার রাস্তায় ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ বলা সাতচল্লিশ বছর বয়সী, শক্তপোক্ত স্বাস্থ্যের, গায়ের রং ঘন শ্যামলা, মাথার চুল পাতলা, দু-একটায় পাক ধরেছে, উচ্চতা আর কত হবে? পাঁচ ফুট আট-নয় ইঞ্চি, হাসিবউদ্দিনের চোখেমুখে বিরক্তি ও রাগ একাকার।

মিনিটখানেক পরে যুদ্ধের বিমান আসলে কী ক্ষতি হতো? হাসিবউদ্দিনের চারো পাতা ছিল পাবনার সদর গোরস্তানের পুবপাশের খালে। পরিষ্কার পানিতে পোনামাছের চলাচল এক দৃষ্টিতে দেখছিলেন হাসিবউদ্দিন। চক্কর দেওয়া বোমারু বিমানের দিকে তাকিয়ে তিনি খুবই বিরক্ত হন। রাগে এক-দুবার শালাও বলেন। চোখেমুখে হাসি দেখা দেয়। মাছ চারোর মুখের দিকে আসছে। আর তখনই উত্তরের দিকে পানির মধ্যে, পাতা চারো থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ হাত দূরে, পড়ে একটা শেল। শেলটা পানিতে পড়ার আগে হাসিবউদ্দিনের কানে একটা শাঁ শব্দ এসেছিল।

গোরস্তানের পাশে খ্রিষ্টানদের কবরে বা হিন্দুদের পঞ্চাননতলায় শেলটা পড়লেও চারোতে মাছগুলি ঢুকতো বলে মনে করেন হাসিবউদ্দিন। চারোর মুখের কাছে আসা একঝাঁক পোনা মাছ চারোতে না ঢুকে ক্ষিপ্র বাঁক নিয়ে ফিরে যায়। দু-একটা মাছ লাফও দেয়। খালের কিনারে বসে থাকা কয়টা বক ডানা ঝাপটে এদিক-ওদিক উড়ে গেল। প্রাণমাত্রেই নিরাপত্তা খোঁজে।

পরে হাসিবউদ্দিন বলবেন, ‘দুডে পেলেনের আওয়াজে কান ফাইটে যাওয়ার জুগার, ভাগ্যি কানে আঙুল দিছিলেম, খালের পানিত মানে যেখেনে শেলডা প্যড়লে, বুজলু, পানি চাইর-পাঁচ হাত উপেরে লাফ দিয়ে উঠলে। ঢেউ আইসে আমার পাও ভিইজে দিলে। হারামিরা।’

আগের বছর বাণী সিনেমা হলে জীবন থেকে নেয়া ছবি দেখে বের হওয়ার সময় কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে হাসিবউদ্দিনও ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’, গলায় সুর নেই, কোরাসের সঙ্গী, ‘শেখ মুজিবের সাথে দ্যাশের মানুষের এই আন্দোলনের সুময় ছবিটা কী ক্যবের চায়?’ শেখ মুজিব জেলে, চলছে আগরতলা মামলা, আইয়ুবের ক্ষমতা প্রায় শেষ, ভাবতে ভাবতে গেয়েছিলেন।

দুই

১৯৬০ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে হাসিবউদ্দিনের দুই বন্ধু দীপক সান্যাল ও খসরু মুনসী কলকাতা থেকে আসার পর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলেই দু-এক কথার পরেই বলতে শুরু করতেন মোগল-ই আজমের গল্প।

দীপক-খসরুর মুখ থেকে, খসরু-দীপকের মুখ থেকে বারবার কথা কেড়ে নিয়েও দুজনের বলা ছবির কথা শেষ হতো না। মধুবালা ও বিভিন্ন দৃশ্যের বর্ণনায় দুজনই আংশিক কবি হয়ে ওঠেন। সৌন্দর্যের মধ্যে পড়লে কোনো কোনো মানুষ অপার্থিবের ঘূর্ণিতে পড়ে যায়।

মধুবালার হালকা গোলাপি রঙের রেশমের নেকাব তোলা। আর তুলতেই কী

সেই মুখ, মৃদু হাসি, ভাঙা হাসি। ‘কেমনি ক্যরে তাকালে, ক?’ ‘কী যে ঝলক।’

জীবনের আনন্দ ও রহস্যকে ঠোঁটের তরঙ্গে ভাসানো। অনেক উচ্ছল ফোয়ারার পাশে একদল তরুণী বাজাতে থাকে সেতার। জলের আর মধুবালার নাচের সঙ্গে সেতারের সংগীত আসরের আবহে অনুভবগত। দিলীপকুমারের চোখ ও ঠোঁটে স্নিগ্ধ হাসি কেঁপে ওঠে। পৃথ্বীরাজকাপুর মুগ্ধ। চোখে পলক নেই।

‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া’ গানের সময় পৃথ্বীরাজকাপুরের চোখ লাল হয়ে যাচ্ছিল। খসখসে গলায় বনমালী ইনস্টিটিউটের মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে খসরু গেয়ে ওঠেন ওই কলি।

লাইট হাউস সিনেমা হলের দর্শকরা আনারকলির কষ্টে, যন্ত্রণায় চুপ। শিকলে বাঁধা মধুবালা। কী কষ্ট! দীপকের দীর্ঘশ^াস পড়ে। খসরুর চোখ ভিজে যায়।

গানটাই শুধু কালার আর সারা ছবি কিন্তু সাদাকালা। আকবরকে কেন মহামতি বলে? আনারকলিকে তিনি জ্যান্ত কব্বর দ্যান। কী নিষ্ঠুর লোক। সম্রাট তাঁর ছেলেকে ওই কানিজ থেকে বাঁচাবে না? হিন্দুস্তানের সম্রাট হবে কে? সেলিম তো আনারকলির জন্যে বাপের সঙ্গে যুদ্ধও করে। ‘প্রেমিকার জন্যি তো যুদ্ধ করবিই।’ কামালের কথার সঙ্গে একমত পল্টু।

হাসিব, কামাল ও পল্টু কদিনের মধ্যেই কলকাতায় যাবেন মোগল-ই আজম দেখতে।

তিন

পাবনার মেয়ে সুচিত্রা সেনের অভিনয় হাসিবউদ্দিনের কখনো ভালো লাগেনি।  বোম্বের মধুবালার সৌন্দর্য, অভিনয় ও নাচের তুলনা কোথায় আছে? কলকাতায় হগ মার্কেটের পাশে, তিনি হগ মার্কেটকে নতুনদের মতো নিউমার্কেট বলেন না, লাইট হাউস সিনেমা হলে ১৯৬১-র জানুয়ারিতেই, তখন কলকাতায় যেতে-আসতে, বর্ডারে হেসে, কুশল বিনিময়েই অনেকে সীমান্ত পার হতেন, মোগল-ই আজম দেখে আসার পর বন্ধুদের সামনে, মাছ ধরার সময়, রাতে একা বাড়ি ফেরার পথে ছবির অন্য কোনো গান নয়, হাসিবউদ্দিন, যতদিন রেকর্ড বের হয়নি, রেকর্ড বের হলেই কিনতে হবে, বাড়িতে কলের গান তো আছেই, কতবার ভাঙা ভাঙা গলায় একটা গানই গেয়েছেন এবং গাইবার সময়, বড়ো দুটো চোখ তাকাতো দূরের আকাশে, যেন দেখছেন ওই আকাশের নিচে রাজকীয় প্রাসাদে সম্রাট আকবর ও প্রেমিক সেলিমের সামনে ঘুরে ঘুরে নাচছেন আনারকলি, দৃষ্টি কখনো তীক্ষè, হার-না-মানা কটাক্ষ, কখনো পরিশীলিত অবহেলা, অভিমান এবং মৃদু হাসিজাত ঠোঁটের কোণা হালকাভাবে কামড়ানো, হাতের নরম আঙুলে শিল্পের মুদ্রা নৈপুণ্যে গড়ে নিয়ে, শরীরের লাবণ্যে ছন্দ ও মাত্রা সংগীতের তালে যথারূপ রেখে গাইছেন : ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া।’

কলকাতায় ঘনঘন যাওয়ার কারণে, কারণ কী? ইস্ট বেঙ্গল আর মোহামেডানের ফুটবল খেলা ও ছবি দেখা, ওয়াসেক মোল্লার কাপড়ের দোকানে বসে আড্ডা মারা এবং কজন হিন্দিভাষী মানুষের সঙ্গে মিশতে মিশতে হিন্দি ভালোই বুঝতেন হাসিবউদ্দিন।

গানটার কয়েকটি কথা এবং সেলিমের কোমর থেকে ছুরি নেওয়া, ছুরির ধারালো তীক্ষè আগা আনারকলি বুকের ওপর ধরে, এবং নামিয়ে নাচতে নাচতেই, সবধর্মের মানুষের অধিকার রক্ষায় কর্মপ্রতিজ্ঞ, মহামতী আকবরের জুতোর সামনে নত হয়ে ছুরিটা রেখে আসা, সেলিমের মৃদু হাসি, দৃশ্যগুলির জাদুকরী ইশারা-কথার বহুমাত্রিক রূপ ও ব্যঞ্জনা হাসিবউদ্দিনের চিন্তার কোষে কোষে এবং চোখের সামনে বারবার ঘুরতে থাকে।

আর ওই ঘূর্ণন, নাচ শেষ হতেই, সম্রাটের চণ্ডমুখী নিঃশব্দ আক্রোশের তোপে বাতাস দিতে থাকা সুন্দরী চামরনীর হাত থেকে মখমলের ঝালর লাগানো বড়ো চামরটা পড়ার আগে, ছাদের সিলিংয়ে লাগানো বৃত্তাকার অনেক আরশির মধ্যে নৃত্যরত আনারকলির ঘূর্ণমান প্রতিবিম্ব, বৃত্তের মধ্যে ঘুরছে সৌন্দর্যের বৃত্ত – এই দৃশ্য বাস্তব না নিশিপাওয়া, নাকি স্বপ্নজাত ভ্রম, যা হাসিবউদ্দিনের চিন্তা, যতবার মনে পড়েছে আনারকলির মুখ, চোখের মধ্যে জ¦লে ওঠা দীপ্তি, কূল ও কিনারা না পেয়ে চলে গেছে লৌকিকতার বাইরে।

চার

আনার : ডালিম, কলি : কুঁড়ি। রমণীর সৌন্দর্যের ফলজরূপ। আনারকলির গায়ের রং কি পেকে ওঠা ডালিমের মতো ছিল? নাকি ওই রক্তিম কুঁড়ির মতো? ওই রমণী কি ভারতের? ইতিহাস কি সত্যি? হাসিবউদ্দিনের কৌতূহল সীমাহীন।

ইরানের পনেরো বছর বয়সের তরুণী, নাম ছিল দিলারা বেগম, আকবর তাঁর সৌন্দর্যের অব্যয়ে মুগ্ধ হয়ে নাম রাখলেন আনারকলি।

পিতার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার পথে দস্যুরা দিলারার পিতাকে খুন করে তাঁর দখল নেয়। পুরুষের স্বেচ্ছাচারী দখল। অপমানের ক্ষত-বিক্ষত জীবন শুরু।

দস্যুরা দিলারাকে তুরস্কের এক ধনীর কাছে বিক্রি করে। ধনীপুরুষটা ওই পণ্যকে তার প্রয়োজনমাফিক ব্যবহার করে উপহার হিসেবে দিলেন তুরস্কের অধিপতিকে। তাঁর হেরেম থেকে তিনি দিলারাকে উপহার হিসেবে পাঠালেন ‘দীন-ই ইলাহী’র প্রতিভূ সম্রাট আকবরের কাছে।

আনারকলি শব্দের অর্থ এবং তাঁর দুঃসহ পূর্বজীবনের কথা জানার আগেই, হলে বসে ছবি দেখতে দেখতে গানটির কথাগুলির সঙ্গে নিরুপায় হয়ে ভেসে যেতে যেতে, রমণীর কষ্টের সঙ্গে, হাসিবউদ্দিনের বিহ্বলতা বা মগ্নতা তাঁকে ভুলিয়ে দিয়েছিল যে, তিনি ছবির দর্শকমাত্র। একজন দর্শক কতক্ষণ শুধু দর্শক? রূপান্তরে কী হয়?

গানের প্রথম চার কলিতে ‘ইনসান’, ‘দুনিয়া’, ‘মহব্বত’, ‘র্দদ’, ‘জিতা’ এবং ‘মরতা’ শব্দগুলির মধ্যে ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া’য় নিহিত যুদ্ধরত প্রশ্ন হাসিবউদ্দিনকে করেছিল এবং করে দিকহারা। দশদিকের স্থিতি কোথায়? সব দিকই শূন্যতার সঙ্গী।

বউ কানিজ ফাতিমা হিসাব মেলাতে পারেন না, কেন তার স্বামী দিন দিন সংসারে থেকেও একা হয়ে যাচ্ছেন। ‘আপনের কী হ্যয়ছে?’ প্রশ্নে ‘না, কিছু না’, উত্তর সংক্ষিপ্ত।

গানের আরো কিছু কথা, নিজের তর্জমাতেই হাসিবউদ্দিন খুশি : ‘প্রেম করেছি, চুরি তো করিনি’, ‘লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা,’ ‘পৃথিবী মৃত্যু দেখবে’, ‘ধুঁকে ধুঁকে মরা’,‘ ‘হৃদয়ের আকাক্সক্ষা’, ‘এছাড়া আমরা কি করতে পারি?’, ‘আমাদের প্রেম লুকানো নয়’, ‘খুদার পর্দা নেই, অন্যের পর্দা দিয়ে কী হবে?’ এবং বারবার ঘুরে ঘুরে আসা ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া’ সম্পূর্ণ গানটাকে, প্রেম, বিরহ ও মিলনের আশাব্রত শেকলে যত্নে বেঁধে রেখেছে।

হাসিবউদ্দিন প্রথম যেদিন বউকে ছবির গল্পটি বলেন এবং ভাঙা ভাঙা গলায় ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া’ গানটি শোনান, এবং গানের তর্জমা করতে থাকেন, কানিজ বলেছিলেন, ‘মিয়েডার, নাম জিনি কি ক্যলেন? আনারকলি না কি জিনি, খুব কষ্ট। ছাওয়ালের সাথে আকবর বাদশা যদি মিয়েডার বিয়ে দ্যিতে হা হলি কি হ্যতে? শ্যাষে মিয়েডাক মারে‌্যই ফেইল্লে। আকবর লোকটা ভাল্ না।’

‘ইনসান’-এর বাংলা মানুষ বা মানবজাতি এবং ওই গানে বলা সব কথার মধ্যে মানুষ বা মানবজাতি বেঁচে থাকে, যুদ্ধ করে, মরে যায় এবং প্রেম খোঁজে – স্বামীর কথা শুনে কানিজের সন্দেহ বাড়ে, পাঁচ ছাওয়ালপালের বাপ কি আবার বিয়ে করবি?

‘আনারকলি কিডা? মধুবালা কিডা?’ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে হাসিবউদ্দিন হেসেছেন।

‘সে তো টকির নায়িকা। আপনের কী? আপনে কি একটা বিয়ে ক্যরবেন?’

‘দূর পাগলি।’ হাসিবউদ্দিনের জবাবে কানিজ খুশি হননি।

‘ওই মধুবালার কথা শুনতি আমার ভালো লাগে না। ক্যলেন, আকবর বাদশা মিয়েডাক কয় কানিজ, খুব রাগ মিয়েডার পর। আমার নামের নাম, কানিজ মানে কী?’

কানিজ মানে দাসী – হাসিবউদ্দিন ভাব দেখান, অর্থ জানেন না, ভুলে গেছেন।

পাঁচ

বাড়িতে ফিরতে না ফিরতেই মাথার ওপর আবার যুদ্ধবিমানের চক্কর। কানিজ, স্বামীর মুখ দেখেই বুঝে যান, মেজাজ চড়া। খালোইতে মাছ নেই।

‘মাছ পাননি?’ কম কথা বলা হাসিবউদ্দিন মাছের খবর না দিয়ে, ‘যুদ্ধ লাগেছে, বুমা তো ফেলবিই, ভাত বাড়ো, হারামিরা আবার কতজনরে যে মারবি’, বলে কাঁধের গামছায় মুখ মুছে পুকুরে গেলেন গোসল করতে।

পানিতে ডান পা। বাঁ পা ঘাটের ওপর। অন্য ঘাটে কসিম ভাই পানিতে নামতে যাওয়ার আগে বললেন, ‘হাসিব মনে হচ্ছে আবার বুমা ফেলবি। গোঁ-গোঁ ক্যইরে ঘোরতেছে।’

‘আমারও তাই মনে হচ্ছে। কয়দিন আগে আমারে ছাওয়ালপল কতজন পাকসেনাক মাইরলে।’

‘আমারেও কয়জন ম্যইরলে।’ দুজনের কথার মধ্যে ঘাটে এলেন দিনমজুর দবির মিয়া। ‘ঠিক কইছেন হাসিবভাই। শালারা আবার বুমা ফেলবি। মানুষ মারবি।’

দক্ষিণ দিকে তাকাতেই হাসিবউদ্দিনের চোখে পড়ে, রাজাপুরের মাথার ওপর কালো ধোঁয়া। ধোঁয়ার মধ্যে দুটো চিল ডুবে গেল। পুকুরের পূর্বদিক থেকে উজ্জ্বল পাগল, গায়ের রং ছিল প্রায় সোনারঙের, এক সুপুরুষ, দৌড়াতে দৌড়াতে, না-কাটা লম্বা চুল, ময়লা চুল উড়ছিল, যেন গ্রামের সবাইকে জানাতে হবে, চিৎকার করে বলছেন, ‘মিলিটারি আসতেছে, মিলিটারি, পলাও, পলাও।’

কয়টা কুকুর বিভিন্ন বাড়ির উঠোনে, বাইরে, চোখে রাগ, আতঙ্ক, গলার রগ ফুলিয়ে তারস্বরে ডাকছে, মাটি খচে গ্রামের পথে দৌড়াচ্ছে।

‘কসিমভাই রাজাপুরের দিক তাকান। আগুন দেছে। উজ্জ্বল কী কচ্ছে শোনেন।’ বলেই হাসিবউদ্দিন দ্রুত তিন ডুব দিয়ে উঠে দৌড়ে লাল গামছায় চুল মুছতে মুছতে চলে যান বাড়ির দিকে।

ছয়

হাসিবউদ্দিন টাকা ও সময় খরচের হিসাব কখনো করেননি। পাখি শিকার করা, ছবি ও ফুটবল দেখা এবং মাছ ধরা – যৌবন শুরুর প্রথম থেকেই এই চারটি শখের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে একসময় সখগুলি তার নেশা হয়ে যায়।

মায়ের অতি আদরের ছেলে ধান, পাট ও হলুদ বিক্রির টাকা নিয়ে চলে যেতেন কলকাতায়। মোহামেডানের সঙ্গে মোহনবাগান, ইস্ট বেঙ্গল বা ব্রিটিশদের খেলা কোনোদিন বাদ পড়েনি। এবং লাইট হাউস সিনেমা হলে বই দেখে মাঝরাতে ট্রেন থেকে নামতেন ঈশ^রদী জংশনে। স্বামীর জন্যে ভাত নিয়ে অপেক্ষা করতেন কানিজ। যত রাতই হোক ঠান্ডা ভাত ও তরিতরকারি ফিরোজের বাপের জন্যে তাকে গরম করতে হতো। একরাতে নিভানো আখা আগুন দিয়ে খড়ি নাড়তেই কীভাবে যেন ছাইয়ের গরম একটা কণা উড়ে এসে কানিজের চোখে পড়ে। চোখ মুছতে মুছতে খাবার নিয়ে ঘরে আসতেই হাসিবউদ্দিন বলে, ‘চোখ লাল। কাঁদো ক্যা? কী হয়ছে?’

কানিজ বললেন, ‘কিছু না।’

‘ঘরে ঢ্যুকে দ্যেখলেম তুমি মধুবালাক দেখতিছ্যাও।’

‘আপনেক একটা কথা কই, সেদিন ওয়াজে হুজুর ক্যলে ঘরে ছবি থাকলি নামাজ হয় না, আমি তো এই ঘরে নামাজ পড়ি, বাঁদিক সালাম ফিরানির সুময় ওই ছবির দিক তো দুই-একবার চোখ পড়ে।’

‘নতুন ঘরে নামাজ প্যড়বে।’

কোনো কোনো রাতে বা পরের দিনও কলকাতা থেকে হাসিবউদ্দিন ফিরতেন না। কারণ কী? দুদিন পরেই খেলা পড়তো মোহামেডানের। ‘পরশু আইসলেন না ক্যা?’ কানিজের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলতেন, ‘কাম ছিলে।’ বলতেন না : ‘মহামেডানের সাথে বিটিশের খেলা তো শুধু খেলা না, বিটিশের শাসনরে বুজায়ে দেওয়া তুমরা হারতিছেও। ভারত আমারে। ওই খেলাও ছিলে রাজনীতি।’

সাদাটে দেয়ালে টানানো মোহামেডানের খেলোয়াড়দের ছবি দেখিয়ে হাসিবউদ্দিন বউকে বলতেন : ‘কী যে খেলা। আমারে দল। একটানা পাঁচবার চাম্পিয়ান। বিটিশের ক্লাবরে কত হারাইছে। তুমাক একবার লিয়ে যাবো। লাইট হাউসে দুইজন বই দ্যাখ্পো। আরো একটা মজার কথা কই, তা হচ্ছে ইস্ট বেঙ্গল আর মোহনবাগানের খেলার দিন, মনে করো মোহনবাগান জিত্লে তালি কইলকাতায় রুই মাছের দাম বাইড়ে যাবি কারণ ঘটিরা রুই ভালোবাসে আর যদি ইস্ট বেঙ্গল জেতে তালি বাড়বি ইলশের দাম, আমরা তো বাঙাল, আমারে মাছ ইলিশ। হা হা হা। ব্যুঝলে।’ কানিজের চোখ ও মুখে স্বামীর কথা আনন্দভাব লেপ্টে দেয়।

ওই ছবির পাশে নয়, অন্য দেয়ালে বাষট্টি সালের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহের এক সকালে টাঙানো হবে কলকাতা থেকে বাঁধানো মধুবালার সাদাকালো ছবি। দরজা খুলে সামনে তাকালেই প্রথমে চোখ পড়বে ছবির ওপর।

আর ছবিটা দেয়ালে টাঙানোর পর গ্রামে এ-কান সে-কান ঘুরে ঘুরে সবাই জেনে যায়, হাসিবউদ্দিন কলকাতা থেকে ‘এক মিয়েলোকে’র ছবি এনে ঘরে টাঙিয়েছে। হাসিবের মা ছেলের কাজ পছন্দ করেননি। অনেক মহিলা, যুবতী এবং বেশ কজন পুরুষ ছবিটা দেখতে এসেছিল, পুরুষদের মধ্যে ছিলেন মসজিদের হুজুর, রিকশঅলা খোশন এবং উজ্জ্বল পাগলও।

কানিজের কাছে কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মিয়েডা কোন্ দ্যাশের?’ ‘মনে হয় কলকাতার। টকি করে। নায়িকা।’ ‘হাসিব চাচা কোন্তেন ছবি আইনলে?’ ‘ক্যা কলকাতা তেন।’ কানিজের উত্তরের মধ্যে ছিল দাঁত কামড়ানোর শব্দ। ‘মিয়েডার নাম কী?’ ‘ফিরোজের বাপ একবার কয় মধুবালা, একবার কয় আনারকলি। জানিনে কোনডে ঠিক।’

গ্রাম-বেড়ানো নাফিজা বেওয়া হাসেন, ‘যাই কও ফিরুজের মা, মিয়েডা খুব সুন্দর।’ কানিজ সেদিন বিকালে হাফিজাকে পান খেতে দেননি।

উজ্জ্বল যতবারই এই বাড়িতে এসেছেন, ছবিটা না দেখে যাননি। একদিন অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে দেখে কানিজ রেগে যান। ‘উজ্জ্বল এখন যা।’ চলে যাওয়ার সময়, ‘কী সুন্দর’, বলেছিলেন উজ্জ্বল। পাগলের সৌন্দর্যবোধ অন্যরকম।

কানিজ ফাতিমা অনেকবার খেয়াল করেছেন ফিরোজের বাপ ঘরে ঢুকেই তাকান মধুবালার ছবির দিকে। কখনো কখনো বাইরে যাওয়ার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে দ্যাখেন। আর ছবিটাতে চোখের দৃষ্টি এমন, পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রির কোণ থেকে দেখলেও, দেখা যায় মধুবালা তাকিয়ে আছেন দর্শকের দিকে।

হিংসা, ঈর্ষা ও কষ্টে কোনো কোনো রাতে কানিজের ঘুমও হতো না। ‘পুকুরে, পগারে যদি ওই ছবিডাক ফেলব্যের পাইরতেম।’

বড়ো ছেলে ফিরোজকে একদিন বলেছিলেন, ‘ওই ছবি সরালি তোর বাপ কি রাগ করবিনি?’ বাপের খুব রাগ হবে। অনেক কথা শুনতে হবে। ছবিটা টানানোর সময় হাসিবউদ্দিন বলেছিলেন, ‘এই ছবিত কেউ যিনি হাত না দেয়।’

দোহারপাড়া গ্রামের মানুষরা হাসিবউদ্দিনের আরো দু-তিনটি শখ বা পছন্দের কথাও তার সামনে ও আড়ালে বলত। সুগন্ধি সাবান দিয়ে গোসল করা, দামি ধুতি ও পাঞ্জাবি পরা, পায়ে থাকত পালিশ করা কালো পামশু এবং সন্ধ্যায় যখন শহরে যেতেন উন্নতমানের সুগন্ধি কাপড়ে, শরীরে না দিয়ে বেরই হতেন না। কখনো মদ খাননি। হুঁকায় সুগন্ধি তামাক দিয়ে বড়ো হেলান চেয়ারে শুয়ে বেশ শব্দ করে সকালে এবং সন্ধ্যায় শহরে যাওয়ার আগে টানতেন পাথরের কলকির হুঁকা।

এক বিকালের শেষে, দোহারপাড়াতেই, উড়ন্ত একটা সরখেল পাখিকে, গুলি করেন হাসিবউদ্দিন। গুলি করার সময় পাশে যারা ছিল, দ্যাখে : পাখিটা আরো ওপরে উঠে যাচ্ছে। একজন বলে, ‘গুলি তো লাইগনে না।’ হাসিবউদ্দিন বলেন, ‘বুকে লাগছে। তাই একটু উপেরে উঠে গেল। এখনি পড়বি।’ দর্শকরা অবাক, সরখেল পড়ছে।

হাসিবউদ্দিন পরদিন সকালে বউকে বলেছিলেন, সাথিহারা পাখিটারে গুলি করা ঠিক হয়নি।

অনেকদিন পরে, বয়স পঁচাশির ওপরে, সাল দু-হাজার পাঁচ হবে, চোখে অনেক পাওয়ারঅলা কাচের চশমা, ঢাকায় ছেলের বাড়িতে এসেছিলেন ডাক্তার দেখাতে। কেউ তাকে বলেছিল, ‘মোগল-ই আজম এখন কালার।’ হাসিবউদ্দিনের চোখে সন্দেহ। বিশ^াস হয়নি। খবরটা ঠিক কি না জানার জন্য ফিরোজকে বলেন, ‘মোগল-ই আজম দেখবো।’ শুনে কানিজের হাসি পায়। ‘আবার মধুবালাক দেখপেন?’

কথাটা বলেননি।

আগে, মানে সেই একষট্টি-বাষট্টিতে কলকাতায় গিয়ে সাতবার দেখেছিলেন। প্রথম চারবার দেখেছেন শেষ পর্যন্ত। প্রথমবার শেকলে বাঁধা মধুবালাকে দেখে তার চোখ ভিজে যায়। দ্বিতীয়বারও। পাঁচ, ছয় ও সাত-এ কখন আসবে ওই রঙিন নাচ এবং গান হিসাব করে ঢুকতেন হলে।

সিডি প্লেয়ারে রঙিন মোগল-ই আজম দেখে হাসিবউদ্দিনের ভালো লাগেনি। সাদাকালো ছবির মধ্যে এক বিশেষ অর্থে প্রায় সাড়ে ছয় মিনিটের নাচ ও গানে রঙের, আলোর বহুমাত্রিক বিভাজন ও সংযোজনের মধ্যে দিলীপকুমার, পৃথ্বীরাজকাপুর এবং মধুবালার নাচের প্রাণপূর্ণ গতি দর্শককে নিয়ে যেত প্রেম ও হাহাকারের জগতে, এবং তার পরেই আবার ছবি সাদাকালো। হাসিবউদ্দিন সাদা ও রঙিন অংশের অংক করেছেন : পৃথিবী সাদাকালো, জীবনের কোন অংশ রঙিন? আবার সাদাকালো।

সাত

উজ্জ্বল পাগল চিৎকার করছেই, ‘মিলিটারি আসতেছে। মিলিটারি। পলাও, পলাও।’ এর-ওর বাড়ির আনাচে-কানাচে দৌড়ে এসে হাসিবউদ্দিনের উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সতর্ক কথাগুলি বলেই দৌড় দিলেন।

ট্রা রা ট্রা রা ট্রা রা ট্রা রা শব্দ : মেশিনগানের গুলি। শাঁ-শাঁ শব্দ : রাইফেলের গুলি বাতাসকে চৌচির করে চলে যাচ্ছে।

কার মাথা ও বুক ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে, কার কার বাড়িতে পাকসেনারা আগুন দিলো, দোহারপাড়া গ্রামের কে কোথায় পালাচ্ছে, তা দেখার বা বোঝার সময় নেই হাসিবউদ্দিন ও কানিজ ফাতিমার।

আখার ফুটন্ত ভাত ফেলে কানিজ দৌড়ে ঘরে আসেন। ‘পলা, পলা, তুরা পলা, আপনে কোনে, গোসুল হয়ছে?’

হাসিবউদ্দিন ছেলেমেয়ে ও বউকে বলেন, ‘তুরা পলা, পলা, বাঁশঝাড়ের ওই দিক দিয়ে পলা, আমি আসতিছি। মিলিটারি আসতেছে।’

শাঁ-শাঁ শব্দ। রাইফেলের গুলি বাতাসকে চৌচির করে চলে যাচ্ছে।

হাসিবউদ্দিনের গা খালি, পরনে লুঙ্গি, কাঁধে গামছা। হাতের কাছে পেলেন পাঞ্জাবি ও পায়জামা, একটা লুঙ্গি, দুটো শাড়ি, একটা ছায়া, তাকের ওপরে ছিল লাল ও নীল রঙে গোলাপ আঁকা টিনের বাক্স, বাক্সে ছিল কিছু টাকা, এইসব দ্রুত নিয়ে যাওয়ার সময় মধুবালার ছবি এবং খাটের পাশে লোহার সিন্দুকের দিকে, সিন্দুক খোলার সময় নেই, কানিজের সোনার মালা, হাতের বালা, কানের দুল আর বাড়ির দলিল আছে সিন্দুকে, তাকালেন। ছবির দিকে এক পা এগিয়ে, টিনের বাক্সটা মেঝের ওপর রাখতে যাবেন, তখনই গুলির শব্দ শোনা গেল বাড়ির খুব কাছেই। একটা গুলি লাগলো ঘরের পাকা দেয়ালে। ছবি নিতে পারেননি।

সিঁড়ির গোড়ায় ঘেউ ঘেউ করছিল বাড়ির কুকুর টম। দৌড়ে যাওয়ার সময় হাসিবউদ্দিন ডাকলেন, ‘টম আয়, আয়।’ দেখা হলো উজ্জ্বল পাগলের সঙ্গে। ‘উজ্জ্বল চল, পলা।’ উজ্জ্বল কোনো কথা না বলে, কোনো তাড়াহুড়া নেই, ময়লা চুলে ভরা মাথা চুলকাতে চুলকাতে চলে গেলেন কাছারি ঘরের দিকে। চিন্তিত মুখ।

আট

কানিজ ফাতিমা ছেলেপেলেদের নিয়ে বাঁশঝাড়ে যাননি। হাসিবউদ্দিন বাঁশঝাড় থেকে দেখেছেন পাকিস্তানিরা গুলি করতে করতে বাড়ির সামনে এসে গেছে। পাশের বাড়ি মোগলদের। একজন সৈনিক আগুন দিলো। পুড়ছে।

পাকসেনাদের সঙ্গে টুপি পরা, খালি গা, হাসিবউদ্দিনের সমবয়সী তাহের গাছি কেন? রিকশঅলা খোশন কেন? খোশনের মাথায় টুপি নেই। গা খালি। হাসিবউদ্দিনের হিসাব মেলে না। তাহের আর খোশনরে কেন গুলি করেনি?

নয়

দোহারপাড়া গ্রাম থেকে ছেলেপেলেদের সঙ্গে কানিজ পাশের গ্রাম আরিপপুরে চলে গেছেন। সন্ধ্যার আগেই হাসিবউদ্দিনের সঙ্গে তাদের দেখা হলো।

এখন বাড়ি ফেরা যাবে না। ইছামতীর পাড় ধরে হেঁটে হেঁটে, দোহারপাড়ার আরো অনেকের সঙ্গে হাসিবউদ্দিন বউ আর ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে গেলেন দোগাছিতে। দুই-চারদিন কারো বাড়িতে থেকে, অবস্থা বুঝে ফেরা যাবে দোহারপাড়ায়।

‘কয়জনরে যে গুলি ক্যইরলে।’

‘কয়ডা বাড়িত যে হারামিরা আগুন দিলে।’

‘কতদিন যে যুদ্ধ চলে?’

‘গরুডারে লিবের পাইরলেম না। ভয়ে ডাকতিছিলে।’

‘আমার ছাগলের দ্যুডে বাচ্চা হয়ছে। তখন দুধ খাচ্ছিলে।’

কথাগুলি বলতে বলতে চরের বালিতে হাঁটতে হাঁটতে ছোট-বড়ো মানুষ আশ্রয়ের খোঁজে যাচ্ছিল।

দশ

ঘর থেকে বের হওয়ার আগে, পাকসেনারা বাড়িতে ঢোকার আগে, হাসিবউদ্দিন কী কী নিতে পেরেছিলেন দোগাছির মাদবরবাড়ির মাটির বারান্দায় বসে সবই দেখেছেন কানিজ ফাতিমা। মধুবালার ছবিটা

নেওয়ার সময়ই পাননি, নিতে চেষ্টা করেছিলেন, এ-কথা হাসিবউদ্দিন বউকে বলেননি। ‘টম পাছ পাছ আইছিলে তারপর যে কোনে গেল?’ বউকে হাসিবউদ্দিন জানান।

দোগাছিতে খবর গেছে, শহরে মাইকিং হচ্ছে। যারা বাড়িঘর ছেড়ে চলে গেছে, তারা সবাই ফিরে আসুক। কোনো অসুবিধা নেই। পাকিস্তানে এখন শান্তি।

সব খবরই পাচ্ছেন হাসিবউদ্দিন। উজ্জ¦লের লাশ পড়েছিল কাছারিঘরের বারান্দায়। জলিল ও দিদার মোল্লার বাড়ির সামনে দুটো কুকুরের মাথায় গুলি করেছিল। দোহারপাড়ার আর কাউকে মারেনি। আসার পথে, পথের পাশে লিয়াকত আর সবুরদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে। পাকসেনার মেজর ও ক্যাপ্টেনকে ডাব পেড়ে দিয়েছেন তাহের গাছি। ডাবের কাঁদির দিকে গুলি করেছিল এক পাকসেনা। গুলি ডাবে লাগতেই   পানি   পড়ে   ক্যাপ্টেনের  মাথায়। ‘মনে হ্যলে কেউ ম্যুতে দিলে’  বলবেন খোশন। শ্রোতারা খোশনের সঙ্গে হাসবে। ‘আমার মনে হচ্ছিলে এক শালাক যদি মাইরবের পাইরতেম।’ খোশনের কথা শুনে কেউ বলবেন, ‘পারতু না।’

পাকসেনারা ওদের ধরলো কিন্তু কেন গুলি করেনি? তাহের গাছি ও খোশন গ্রামের মসজিদের মধ্যে লুকান। দুজনকে দেখেছিল পাকসেনারা। ক্যাপ্টেন নিজে মসজিদে ঢুকে ওদের ধরে আনে। দুজন ভয়ে কাঁপছিলেন। মেজর হাসতে থাকে। ‘শালে বানচোত্’ বলে ধমক মারে। ‘চল্।’ পাকসেনাদের সঙ্গে দুটো বাড়িতে দুজন আগুন লাগানো দ্যাখেন। উজ্জ্বলকে ক্যাপ্টেন ডেকেছিল। শুনেও তাকাননি। তাহের গাছি উজ্জ্বলকে হাতের ইশারায় কাছে আসতে বলেছিলেন। তার কথাও উজ্জ্বল শোনেননি। ‘পাগল কলি কি শালারা বিশে^স ক্যরবিনি?’ ভাবনা বলতে তাহের গাছির সাহস হয়নি। উজ্জ্বল নাকি পাকসেনাদের দেখে হাসি হাসি ভাব দেখান। পায়ের ওপর পা তুলে পা দোলাচ্ছিলেন।

মেজর ঢুকেছিল হাসিবউদ্দিনের ঘরে। চোখ পড়ে মধুবালা ও মোহামেডানের খেলোয়াড়দের ছবির ওপর। সে মধুবালার সামনে দাঁড়িয়ে একটু হাসে। তার ঠোঁট নড়ে। গানের বিখ্যাত কলি ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া’ কি গেয়েছিল? ক্যাপ্টেনের বলা, ‘মধুবালা’, এবং একজন বয়স্ক সৈনিকের রাইফেলের বেয়নেট ছবিটার দিকে তুলে বলা, ‘আনারকলি,’ শোনার পর মেজর হাতের ইশারায় বোঝায়, ঘরে আগুন দিতে হবে না।

তাহের গাছি ও খোশনের বলা কথাগুলি অনেকবার, অনেকদিন শুনবে দোহারপাড়ার মানুষ। কেউ কেউ প্রশ্ন করবে, ‘তুরা জানলু ক্যেমনি ক্যরে একজন মেজর, একজন ক্যাপ্টেন?’ তাহের গাছি ও খোশন একজন আর একজনের মুখের দিকে তাকালে শ্রোতারা হাসবে।

এগারো

চারদিন পর শেষ বিকালের দিকে হাসিবউদ্দিন পরিবারের সবাইকে নিয়ে দোহারপাড়ার বাড়িতে এলেন। উঠোনে কয়েকটা কার্তুজের খোল। ঘরের দরজা-জানালা খোলা। চৌকাঠে পা দিয়েই দেয়ালের দিকে তাকান। মধুবালার ছবি নেই। জায়গাটা ধূসর এবং কাঠের ফ্রেমের চারকোনা দাগ পড়েছে দেয়ালে। বর্গক্ষেত্রের ওপর দিয়ে, হতে পারে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে, নিঃশব্দে যাচ্ছে পিঁপড়ের সারি, মুখে সাদা ডিম। ডান দিকের দেয়ালে মোহামেডানের খেলোয়াড়দের সাদাকালো ছবি। সামনে বড়ো কাপ। ওরা হাসছে।

কানিজ দেয়ালের দিকে তাকিয়েই দ্রুত চোখ ঘোরান ঘরের চারপাশে। মানুষ আসার শব্দে কয়েকটা তেলাপোকা দৌড়ে গেল এদিক-ওদিক। সিন্দুকের তালার ওখানে গুলির দাগ। পাল্লা খোলা। সোনাদানা নেই। বাড়ির দলিলটা খাটের নিচে।

পালানোর সময় ঘর, ঘরের অন্যসব জিনিসপত্র যেমন ছিল, সেই অবস্থাতেই আছে। খোলা জানালা দিয়ে আসা শেষ বিকালের রোদ পড়ে কানিজের শ্যামলা রঙের মুখের ওপর।

হাসিবউদ্দিন ঘরের বাইরে আসার সময় চৌকাঠে দাঁড়িয়ে মাথা একবার পেছনের দেয়ালের দিকে ঘোরান। চোখমুখ গম্ভীর। পিঁপড়ের সারির কাছে একটা বড়ো টিকটিকি। লেজের শেষ প্রান্ত দুলছে।

বারো

দোহারপাড়া থমথমে। সন্ধ্যা হলো। গ্রামের মসজিদে কেউ আজান দিলেন না। অনেক বাড়িতে বউরা, মেয়েরা কুপি, হারিকেন ও আখা জ¦ালাতে ব্যস্ত। বাঁশবাগানে কয়টা শেয়াল ডাকছে। বাড়ির ওপর দিয়ে একটা লক্ষ্মীপেঁচা উড়ে গেল।

কানিজ কুপি জ¦ালিয়ে গেলেন রান্নাঘরে। পালানোর সময় আখায় ছিল দুপুরবেলার ভাত। পাতিলটা উল্টো হয়ে পড়ে আছে, কিছু পোড়া ভাত কালো কাঁকর, আখার আশপাশে ও ভেতরে ছাইয়ের মধ্যে। পাশে বাড়ির কুকুর টম শোয়া, সামনের দুই পা, মুখ ও কানের নিচে পোড়া ভাত। পেটে বাড়ির খাবার কদিন পড়েনি। শরীর দুর্বল। কানিজের দিকে তাকায়। দৃষ্টিতে মায়া। দৃষ্টি করুণ। জ¦লছে কুপির আলোতে। ডাকে : ‘কুই, কুই।’ উঠে দাঁড়ালো। গায়ের পশমে আটকে থাকা কয়টা পোড়া ভাত পড়লো। আগে কোনোদিন টমের মাথায় কানিজ কখনো হাত দিয়ে আদর করেননি, হাত বোলালেন। টম লেজ দোলায়।

শহরের মধ্যে চলা মেশিনগানের গুলির শব্দ গ্রামের আপাত নিস্তব্ধতাকে ঝাঁঝড়া করে দিলো : ট্রা রা ট্রা রা ট্রা র ট্রা রা ট্রা রা…।