বাড়ি দেখে বেরিয়ে আসতেই কালিদাস দালাল জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী পছন্দ হয়েছে তো?’ বলেই গড়গড় করে বলে চললেন, ‘বলেছিলাম না তৈরি জিনিস, থাকার লোক নেই। মালিক কলকাতায় ফ্ল্যাটে থাকেন। বাড়িটি স্রেফ ফেলে রাখা হয়েছে।’

অয়ন দালালের কথায় পুরো মনোযোগ দেয়নি। ফলে, কাজের কথাটুকু শুধু বলল, ‘পছন্দ-অপছন্দের কথা নয়, মাত্র দুমাস থাকব, তার কম দিনও থাকতে পারি। স্রেফ পরিবার নিয়ে একটা সাময়িক আস্তানা চাই।’

কালিদাস দালাল মনে মনে একটা হিসাব কষছিলেন। অয়নের কথায় হিসাবটা মাঝপথে বন্ধ করে চোখ কুঁচকে বললেন, ‘মাত্র দুমাস!’

– ভিসার কাগজপত্র আসতে যা সময় লাগবে ততদিনই থাকব, থোক কত দিতে হবে বলুন?

কিছুটা সংশোধন করে আবার বলল, ‘দুমাস ধরেই থোক বলুন, পরে দিন বাড়লে সেই রেটেই বাড়াবেন।’

– ভিসার কাগজপত্র মানে?

অয়ন বলল, ‘আমি বাংলাদেশে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করি। চাকরিটা চুক্তিভিত্তিক। প্রথম পাঁচ বছরের চুক্তি শেষ হয়ে গেছে। দ্বিতীয় পাঁচ বছরের জন্য আবার চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। সেই আবার বাংলাদেশ সরকার থেকে সার্ভিস ভিসা নিতে হবে। সেটা এক মাসেও হতে পারে, দুই মাসও লাগতে পারে।’

কালিদাস দালাল বুঝে ফেললেন টেম্পারিং মাল, ঝোপ বুঝে ঘাই মারতে হবে ধীরেসুস্থে। মিষ্টি হাসিতে অয়নের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করে এগিয়ে ধরতেই অয়ন বলল, ‘এসবের পাঠ চুকিয়ে দিয়েছি। কত দিতে হবে বলুন?’

সিগারেটে একটা টান দিয়েই কালিদাস দালাল বললেন, ‘দুমাসের জন্য থোক বিশ হাজার টাকা দেবেন, পুরো বাড়িটা ব্যবহার করবেন।’

অয়ন বিশ হাজার শুনে একটা ধাক্কা খেল। সেটা কালিদাস দালালকে বুঝতে দিলো না। মুখে দরাজ হাসি ছড়িয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, পরে আপনার সঙ্গে কথা বলছি। মোবাইল নাম্বার তো আমার কাছে আছেই।’ বলে পা বাড়াতেই কালিদাস দালাল বুঝতে পারলেন পার্টি হাতছাড়া হয়ে যাবে। এতটা বাড়িয়ে চাওয়া ঠিক হয়নি। মালদার হলেও হিসেবি। বুঝেই কণ্ঠস্বরে কিছুটা আবেগ মিশিয়ে অয়নকে ডাকলেন, ‘একটা কথা প্লিজ শুনে যান।’

– বলুন।

– বাড়ি তো আপনি দেখে গেলেন। বাজারের পাশে একেবারে তৈরি বাড়ি। পাম্পের জল পাবেন। খাবার জলের অ্যাকোয়া, লাইট, পাখা ছাড়াও একটি ঘরে এসি বসানো আছে। ইচ্ছেমতন চালাতে পারবেন। ঘরের ফার্নিচারগুলি ব্যবহার করতে পারবেন। কিচেন সাজানো। আপনি পরিবার নিয়ে ঘরে ঢুকলেই গ্যাসের সিলিন্ডারটা দিয়ে দেব। অশোকনগরের মতো জায়গায় বাড়ি। তার জন্য দুমাসের ভাড়া চেয়েছি বিশ হাজার। খুব কিন্তু বেশি চাইনি। ঠিক আছে, আপনি না হয় কিছুটা কম দেবেন। কোন দিন বাড়িতে আসবেন বলুন?’

অয়ন কথার উত্তর না দিয়ে পারল না। বাধ্য হয়েই বলল, ‘দাদা, এই যে কচুয়া মোড় বাজারটা দেখছেন, বাজারের দক্ষিণ দিকে রাজবেড়িয়া রোড ধরে গুনে গুনে চারটা বাড়ির পর আমার বাড়ি। এইখানে আমার জন্ম, স্কুল, কলেজ, আড্ডা। আপনি দুমাসের জন্য বিশ হাজার টাকা চাইছেন, কী বলি বলুন তো! মাত্র পাঁচ বছর এখানে নেই, তাতেই এত পরিবর্তন?’

অয়নের কথায় এতটুকু হাল না ছেড়ে গলাটাকে খাদে নামিয়ে খুব মোলায়েম করে বললেন, ‘কখন ঘি দিয়ে ভাত খেয়েছেন তার ফিরিস্তি দিলে চলবে! বাড়ি থেকেও আপনি বাসা খুঁজছেন, প্রয়োজন আছে বলেই না? বাজারটা একবার দেখুন, কেমন চড়চড় করে বাড়ছে। মালিককে দিয়ে আমাকেও তো বউ-বাচ্চার জন্য দুটো পয়সা রাখতে হবে। আসুন না, কিছু না-হয় কম করে নেব। আপনি যখন একেবারেই স্থানীয়, খুব একটা অসুবিধা হবে না। আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।’

কালিদাস ঘোষ বনেদি দালাল। অয়ন লোকটাকে আগেও চিনত। কোনো দিন মেলামেশা বা কথা বলার প্রয়োজন হয়নি। আজ অয়নকে মেয়ে আর স্ত্রীর জন্য একটা মাথা গোঁজার জায়গা নিতে হবে বলেই কালিদাস দালালকে খুঁজে নিতে হয়েছে। এইসব দালাল কখনো কখনো জীবনের কোনো না কোনো অপ্রিয় প্রসঙ্গকে চাগাড় দিয়ে জাগিয়ে তোলে। যেমন ঘি দিয়ে ভাত খাবার উদাহরণটা কিংবা বাড়ি থেকেও আপনি বাসা খুঁজছেন; প্রয়োজন হয়েছে বলেই না!

গতকালই বাংলাদেশ থেকে দুপুরের পরপর মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে নিজেদের বাড়িতে এসেছে। একের পর এক তিক্ত অভিজ্ঞতা অয়নকে নাজেহাল করে ফেলেছে। অয়ন তাৎক্ষণিকতায় ঘর ভাড়া খুঁজতে বাধ্য হয়েছে। দুপুরে বাড়িতে ঢোকার পর বিকেলে অবিবাহিত দিদি অঞ্জনা জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই, তোরা কি রাতে এখানে থাকবি?’

দিদির প্রশ্ন শুনে অয়ন এই পরিবারে লালিত হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝে নিল, বাবা কিংবা মা যে অপ্রিয় কথাটা মুখের ওপর বলতে পারছে না, সেটাই অঞ্জনার মুখ দিয়ে বলিয়ে দিচ্ছে। অঞ্জনা অবিবাহিত। বাড়ির বড়ো মেয়ে। পরিবারের একজন অভিভাবকও বটে। অয়নের চুপ করে থাকা দেখে উত্তর দিলো অয়নের স্ত্রী মালা, ‘বড়দাকে বলো আমাদের ঘরটা পরিষ্কার করে দিতে, অল্প কয়েকদিন থাকব। তোমার ভাইয়ের  ভিসার কাগজপত্র এলেই চলে যাব বাংলাদেশ।’

অদ্ভুত! অঞ্জনা কোনো প্রত্যুত্তর না দিয়ে সামনে থেকে সরে গেল। অয়ন বাবা-মায়ের ভাবগতিক দেখেও বোঝার চেষ্টা করছে, পরিবারের বিরক্তি সত্ত্বেও জোর করে এখানে থাকবে, না বিয়ের পরপর যেভাবে এ-বাড়ি থেকে বউ নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, এত বছর পরও সেই একইভাবে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। মালা এখন বউ হিসেবে পুরনো। মেয়ে তনিমার বয়স এখন চার বছর। মালা তার অধিকার ছাড়বে কেন? কিছুটা গম্ভীর হয়ে বড় জা মাধুরীকে বলল, ‘দিদি, দাদা বাড়িতে এলো না। ফোন করে দাদাকে বলো আমরা এসেছি, দোকান থেকে একবার এসে যেন দেখা করে যায়।’

মাধুরীও নির্বাক। উত্তর দিলো বড়ো ননদ অঞ্জনা, ‘চয়নের শরীরটা খুব খারাপ, দোকান বন্ধ করে ও শ্বশুরবাড়ি গেছে। কিছুক্ষণ আগে ফোন করে আমাকে বলেছে, ও রাতে ফিরবে না।’

অয়ন এবং মালা দুজনেই বুঝল বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে একটা চিত্রনাট্য তৈরি করে ফেলেছে ওরা। সবাই সেই চিত্রনাট্য অনুসারে কথা বলছে। মেয়ে তনিমা ঠাকুরদাদা আর ঠাকুমার ঘরে বসে পাকা-পাকা কথা বলছে। মাধুরী আর চয়নের ছেলে সেবকও সেখানে বোনের সঙ্গে মিশে গেছে। অয়ন এবং মালা দুজনেই বুঝল, প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের একটা নীরব কথোপকথন চলছে কীভাবে অয়নকে বাড়ি থেকে আপাতত বিদায় করা যায়। একে অন্যকে গার্ড দিচ্ছে। তনিমা ঠাকুরদাদা আর ঠাকুমার সঙ্গে ঝাঁপাঝাঁপি করতে করতে ঘুমে কাহিল হয়ে পড়েছে। মালা মেয়েটাকে যে শোয়াবে কোনো খাট খালি পাচ্ছে না। শাশুড়ি মালাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘কী রে মালা, তোর মেয়ে তো ঘুমিয়ে পড়ছে। আমাদের খাটে শুইয়ে দে আপাতত।’

নিজে উদ্যোগ নিয়ে নাতনিকে শোয়ালো না। এইরকম দড়ি টানাটানির মধ্যে অয়নকে কাকতালীয়ভাবে উদ্ধার করলো গদাই কুণ্ডুু। অয়নের ভায়রা, মালার জামাইবাবু। এই রাস্তার প্রায় এক কিলোমিটার দূরে গদাই কুণ্ডুুর বাড়ি। শ্যালিকা বাংলাদেশ থেকে এসেছে শুনে দেখা করতে এসেছিল। এসে পরিস্থিতি বুঝে শ্যালিকাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। গদাই নিজেই প্যাডেল ভ্যান ডেকে আনল। নিজের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য অয়নের লাগেজ ব্যাগগুলিও নিজেই ভ্যানে ওঠাতে লাগলো। ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে নিয়ে ভ্যানে বসতে বসতে নতুন বউ হয়ে এই বাড়িতে আসার দিনটির মিল খুঁজে পেল মালা। ছবির মতো ভেসে উঠল।

বিয়ের পরের দিন মালা নতুন বউ হয়ে এসেছে। শাশুড়ি বড় ছেলের বউ মাধুরী আর বড় মেয়ে অঞ্জনাকে দুপাশে ঢাল হিসেবে রেখে কোনোমতে বরণডালাটা মালার কপালে ছুঁইয়ে ছিল। মালা প্রথমে ব্যাপারটা ধরতে পারেনি। ঘরে ঢুকে খানিকক্ষণ বসে রইল।

পাড়া-প্রতিবেশীরা চলে যেতেই বেনারসিটা পাল্টে হাতে-মুখে জল দেওয়ার জন্য উঠোনে নেমে এলো। অয়নদের কল বাথরুম ঘরের লাগোয়া নয়। উঠোনে নেমে দক্ষিণ দিক বরাবর দশ-বারো পা হেঁটে যেতে হয়। অয়ন সবে বাড়িটা বানিয়েছে। সংস্কার অনুসারে সেদিন মালার কালরাত্রি। মালা বাথরুমের দিকে যেতেই, পেছন পেছন শাশুড়িও উঠোনে নেমে পায়চারী করছিল। ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই শাশুড়ি মালার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ডান হাতের তর্জনী তুলে বলল, ‘আমিও দেখবো তুই আমার ছেলের সঙ্গে কীভাবে সংসার করিস। তোকে আমি এ-বাড়ি থেকে তাড়াবই!’

কালরাত্রিতেই শাশুড়ির বিষাক্ত নিশ্বাস নিয়ে নতুন জীবন শুরু করেছিল মালা। তারপর শুরু হলো এক নীরব সংঘাত। অয়ন শুধু মালাকে সাহস জুগিয়ে বলে গেছে, ‘সবসময় মনে রাখবে, সংসারে যে সয় সে-ই রয়।’ মালা অক্ষরে অক্ষরে সেটা পালন করার চেষ্টা করে গেছে। ত্রিমুখী আক্রমণে বারবার আহত হয়েছে মালা। অয়নের সামনে সবাই একরকম। অয়ন  বাড়ি থেকে অফিস বেরোতেই, বাড়িসুদ্ধ সবার ভূমিকা পাল্টে যায়। বাইরের থেকে কেউ বুঝত না। বউভাতের তিনদিন পর দ্বিরাগমন থেকে ফিরে আসার পরদিন, অয়ন স্নান, খাওয়া-দাওয়া করে অফিসে বেরোতেই মালা ঠাকুরের আসন থেকে ফুলের সাঁজিটা নিতে যেতেই বড়ো ননদ অঞ্জনা কোত্থেকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘বাসি কাপড়ে আসন ধরছ কেন? কী করবে?’

– বাসি কাপড় কখন ছাড়া হয়ে গেছে। বলেই বলল, ‘সাঁজিটা নিচ্ছিলাম ফুল তুলব বলে!’

– আমাকে বলবে তো? ওখানে দাঁড়াও আমি সাঁজি দিচ্ছি! বলে লক্ষ্মীর আসনের ওপর থেকে ফুলের সাঁজিটা মেঝেতে নামিয়ে দিয়ে বলল, ‘ফুল তুলে এইখানে সাঁজিটা রাখবে, আসন ছোঁবে না!’

বলে আসনের পাশে একটা নির্দিষ্ট জায়গা দেখিয়ে দিলো। সবটা বোঝার পর মালার মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো, ‘তোমারও তো বাসি কাপড় দিদি!’

বলতেই অঞ্জনার শরীরটা ফুঁসে উঠল। মালার দিকে তাকিয়ে মৃদু ধমক দিয়ে বলল, ‘আমি কী করলাম না দেখে নিজের চরকায় তেল দাও!’ বলেই স্বগত বাচন ‘অজাত-কুজাত কোথাকার’ বলতে বলতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

মালা বধূ হয়ে আসার প্রথম দিন থেকেই দেখতে পাচ্ছে,ওর বড় জা, বড় ননদ, শাশুড়ি কেউই ওকে কোনো কাজের কথা বলে না। সংসারের কোনো কিছু ছুঁতে গেলেই উপযাচক হয়ে সেই কাজটা করে দিচ্ছে। জটিলতাটা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারল জলখাবার সময়। কিছুতেই খাবার জলের পাত্রটাকে ওরা মালাকে ছুঁতে দেয় না। বড়ো জাকে বলল, ‘জলটা তোমরা আমাকে ঢেলে দিচ্ছ কেন, ওটা তো আমি ঢেলে খেতে পারি!’

উত্তরে বড়ো জা মাধুরী বলেছিল, ‘শ্বশুর-শাশুড়ি এখান থেকে জল খায় তো, এটা তোমার না ছোঁয়াই ভালো!’

কথাটা শুনে মালা কয়েক মিনিটের জন্য বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। খুব পরিষ্কার করে বুঝতে পারে শ্বশুর-শাশুড়ি, জা, ননদ কেন ওকে ডাকখোঁজ করে না। পাছে অজাতের ছোঁয়া লেগে ব্রাহ্মণত্ব নষ্ট হয়ে যায় এই ভয়ে। বাইরের চালচলনে এদের এইসব সংস্কারাচ্ছন্ন মুখোশটা প্রতিবেশীরাও বুঝতে পারে না। শ্বশুর বাইরের কিছু না খেলেও, শাশুড়িমা দিব্যি নেমতন্ন বাড়ির ভোজ খেতে যান। ননদটিও বাইরে কোত্থাও খাবেন না। বড় জা মাধুরী যেহেতু জাতের বউ তার অহংকারের প্রকাশটাই অন্যরকম। একবার দুবার মালার ঘরে এসে গল্প করে গেছে, তাও বেশিক্ষণ নয়। সংসারের কোনো ব্যাপারেই মালাকে গুরুত্ব দেয় না। অথচ ওই বাড়ির একমাত্র রোজগেরে মালার বর অয়নই। পাশাপাশি মালাকে ওদের সহ্য করার কারণও অয়নের আয়ে এই সংসারটা চলে বলে।

বাড়ির ছোট বউটিকে সবাই মিলে একঘরে করে রাখার প্রক্রিয়াটা আরো সক্রিয় হয়ে উঠল। একটা কুচুটে মেঘ রঙিন আকাশটাকে ধীরে ধীরে গিলে ফেলছিল, খুবই নমনীয়ভাবে উত্তেজনাহীন। শ্বশুরবাড়িতে প্রথমদিন থেকেই দুপুরে এবং রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর  অয়ন এবং তার নিজের এঁটো থালাবাটি-গ্লাস ধোয়াটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে মালার। সেটা বুঝতে পেরেও কাউকে অভিযোগ করেনি। অয়নও তার স্ত্রীকে করা অপমানটি বুঝেও চুপ করে থাকল। ভাবল, দীর্ঘদিনের সংস্কার কাটাতে আরো সময় লাগবে। এখানেই অয়নের অজ্ঞতা। অয়নের মায়ের এটা ব্যক্তিগত বিদ্রোহ। প্রেম করে আনা নমশূদ্রের মেয়ের হাতের জল তিনি খাবেনও না, কাউকে খেতেও দেবেন না। অয়ন বড় মাসির পছন্দ করা এমএ পাশ জাতের মেয়েকে বিয়ে করতে অস্বীকার করে মালাকে বিয়ে করেছে। এই অপমানের প্রতিশোধ তিনি মালার ওপরই ওঠাবেন। দিন থেকে মাস গড়াতে গড়াতে এবার ছকটা পাল্টে ফেললেন অয়নের মা। দুপুরে এবং রাতে কলতলায় এঁটো বাসনের স্তূপ বাড়তে লাগল। প্রথম প্রথম বড় ননদ এবং বড় জা মাধুরী, মালা বাসনের স্তূপ মাজার পর টিউবয়েলটা চেপে দিয়ে মালাকে সাহায্য করত। অল্প কয়েকদিন পর থেকে দুজনে বিভিন্ন অজুহাতে এঁটো বাসন স্তূপাকার রেখে চলে আসত। মালা নীরবে ধুয়ে ঘরে নিয়ে আসত। সারাদিনে ওই দুটো কাজ পেয়ে মালা বেঁচে থাকার কিছুটা অক্সিজেন পেত। কিছুদিন চলার পর সেখানেও কাঠি করলো‌ শাশুড়ি।

রাতের খাওয়া শেষে বাসনপত্র কলতলায় জমা করতেই মালা বড়ো জা মাধুরীকে বলল, ‘দিদি এসো না আজ আমাকে একটু সাহায্য করো। তোমার দেওর ভোরবেলা অফিসের কাজে কৃষ্ণনগর যাবে। ব্যাগটা গোছাতে হবে।’

উত্তর দিলো জনান্তিকে শাশুড়ি, ‘অয়নের ব্যাগ তো অঞ্জনাই গোছায়, ও কী করবে?’

মাধুরী শাশুড়ির কথাটা শুনল, কোনো প্রতিক্রিয়া জানাল না। নীরবে মালার পাশাপাশি কলতলায় এসে দাঁড়াল। মালা বলল, ‘তুমি কিছু মাজো আমি কিছু মাজব, তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।’ মাধুরী নীরবতা দিয়ে বোঝাল সে বাসনে হাত দেবে না। অগত্যা মালাই পুরো বাসনাটা হাত চালিয়ে মাজতে শুরু করলে, মাধুরী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অহেতুক টিউবওয়েলে চাপ দিতে শুরু করল। মালা বলল, ‘এখন চাপ দিও না ভিজে যাব, মাজাটা আগে শেষ হোক।’

মাধুরী সামান্য বিরতি দিয়ে আবারো চাপ দেওয়া শুরু করলো। এবার নিজের হাতটা জলে লাগিয়ে বারবার ধুতে লাগল। মালার গায়ে-মাথায় নখের জল ছিটাতে লাখল। মালা বাধ্য হয়ে বলল, ‘নখের জল গায়ে পড়ছে দিদি, ওভাবে হাত ঝেড়ো না। হয়ে গেলে একবারে দুজনে মিলে হাত-মুখ ধুয়ে নেব।’ মাধুরী উত্তরে বলল, ‘তাড়াতাড়ি কর, মশার জন্য দাঁড়ানো যাচ্ছে না, বড্ড মশা!’

– মশা তো তোমাকে একা নয়, আমাকেও ধরেছে দিদি! দাঁড়াও এই তো হয়ে গেল।

মাধুরী এমনিতেই কম কথা বলে। প্রয়োজনের বাইরে কোনো কথা বলে না। সেই স্বভাবটা বজায় রেখেই নিজের গোঁয়ার্তুমিটা করেই যাচ্ছে। এবার চাপ কোষে নিয়ে বারবার নিজের পা ধুতে লাগল, মালাকে ভিজিয়ে যেতে লাগল। পুরোটা ভিজে যাওয়ার পর্যায়ে আসতেই মেজাজ ধরে রাখতে পারল না মালা।  বেশ কঠিন স্বরেই বলল, ‘তুমি কি বলদ, বোধবুদ্ধি তোমার কবে হবে? আমি নিচে বসা তুমি অকারণেই হাত-পা ধুচ্ছো! বুঝতে পারছ না আমি ভিজে যাচ্ছি!’

এতক্ষণে মাধুরী সুযোগ পেল। প্রত্যুত্তর করল, ‘তাই বলে তুমি আমাকে বলদ বলবে! তোমাকে এত বড় সাহস কে দিয়েছে?’ বলতে বলতে সোজা ঘরের দিকে গজগজ করতে করতে চলে এলো। মালা কলতলা থেকে টের পেল, বড় জা সাতকাহন করে রং চড়িয়ে মিথ্যে কথা বলছে। সামান্য সময় পরেই ঘর থেকে ভাসুর চয়নের কথা শুনতে পেল মালা, ‘অজাত-কুজাত কী সাধে বলে! ছোট জাত না হলে বড়ো জাকে বলদ বলে কেউ!’

অয়ন ঘরে খাটের ওপর আধশোয়া অবস্থায় ছিল। বউদির নালিশ আর দাদার প্রতিক্রিয়া দুটোই শুনতে পেল। কলতলায় এসে মালাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’

অয়ন নিজেই দেখল ভেজা শাড়িতে মালা একা একা ঢাঁই করা বাসন মাজছে। মালা অয়নকে দেখে কিছুটা হতবাক হয়েই বললো, ‘এই দ্যাখো না, আমি নিচে বাসন মাজছি তোমার বউদি কলে চাপ দিয়ে আমাকে পুরো ভিজিয়ে দিয়েছে। বারবার বারণ করলেও শুনছে না দেখে বলদ বলেছি!’

অয়ন সোজা ঘরে চলে এসে দাদাকে বলল, ‘তুই বড়জাত ব্রাহ্মণ হয়ে কী করলি? বউদি মালার সঙ্গে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করে এসে, তোকে মিথ্যে নালিশ করল, আর সঙ্গে সঙ্গে জাত তুলে গালাগাল শুরু করে দিলি! দেখলি না‌ কী হয়েছে!’

আর কোনো উত্তর নেই চয়নের মুখে। অস্পষ্ট গোঁয়ার্তুমির শব্দ গুনগুন করতে থাকলো চয়ন। অয়নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এরা কেউই যুক্তিনির্ভর কথা বলতে পারে না। প্রথম প্রথম অয়নের মধ্যে একটা ধারণা হয়েছিল, মালাই বোধহয় তার পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে না। কয়েকটি পারিবারিক ঘটনায় কাকতালীয়ভাবে অয়নের উপস্থিতিতে ওরা কেউই সেটা সামলাতে না পেরে অয়নের কাছে ধরা পড়ে গেছে। ফলে, মালার সহনশীলতা নিয়ে অয়নের ধারণা দিন দিন পালটে যাচ্ছে। বড় ছেলের ল্যাজেগোবরে অবস্থা দেখে মা বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। মৃদু ধমকে বড়ো ছেলেকে বলল, ‘উল্টোপাল্টা কথা বলিস কেন, রাতের বেলা পাড়ার লোক হাসাবি! যা ঘরে যা!’

ব্যাস,  ওই পর্যন্তই। এই পরিবারে কেউ গলা তুলে ঝগড়া করে না। ব্যবহারে, হাঁটাচলায়, চোখমুখের অভিব্যক্তিতে এদের উপলক্ষকে বুঝিয়ে দেয়। অয়ন ঘটনাচক্রে বাড়ি থাকলে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলে, মা এসে ম্যানেজ করে নেয়।

অয়নের রোজগারে নতুন পাকা ঘর হয়েছে। সবার আলাদা আলাদা রুম হয়েছে। বাজারে দাদা চয়নকে একটা ব্যবসা করে দিয়েছে। দাদা, আধা বেকার হলেও নিজের বিয়ের আগে  এইট পাশ জাতের মেয়ে মাধুরীর সঙ্গে ধুমধাম করে বিয়ে দিয়েছে। বড় দিদি অঞ্জনার জন্যও বিয়ের চেষ্টা করেছিল, অত্যধিক বয়স এবং শুচিবাতিকগ্রস্ত হওয়ার জন্য পাত্র পাওয়া যায়নি। ছোট হয়েও পরিবারের পাহাড়প্রমাণ অভাব-অভিযোগের সুরাহা করেছে। তারপর নিজের পছন্দের প্রেমিকা, অব্রাহ্মণ শুধু নয়, নমশূদ্রের মেয়ে মালাকে বিয়ে করে এনেছে। মালা আর্ট কলেজের ছাত্রী, স্নাতক, সুন্দরী। বিয়ের দিন দাদা চয়ন আর বাবা বরযাত্রী গেলেও শূদ্রের বাড়ির জলস্পর্শ করেনি। যদিও বিয়েটা ভাড়া করা অনুষ্ঠান বাড়িতে হয়েছিল। ফলে, সেটা ভয়ংকর আক্রমণে পৌঁছাতে না পারার কারণ এই পরিবারের ভরণপোষণ করার একমাত্র রোজগেরে ছোট ছেলে অয়ন। এই বোধটা বোধহয় ওদের অবচেতনে কিছুটা হলেও ধাক্কা মারে। শিক্ষিত মালা ওদের সঙ্গে কিছুদিন থেকে এটা বুঝতে পারছে, অয়ন বাড়ি থাকলে ওদের চোখের শরীরের ভাষা সম্পূর্ণ বদলে যায়। অয়ন বাইরে জীবন জীবিকার ক্ষেত্রে যতটা স্মার্ট এবং ডায়নামিক, সংসারের রাজনীতিতে ততটাই কাঁচা। মালার ধারণা, একেবারেই নাদান শিশু। ফলে অয়নের প্রতি মালার কোনো বিদ্বেষ তৈরি হয়নি। এটাও বুঝতে পারছে, শাশুড়ি কলকাঠি নাড়িয়ে ওদের দুজনের মধ্যকার ভালোবাসাকে ভেঙে দিয়ে অশান্তি বাঁধাতে চাইছে। মালার জামাইবাবু কালেভদ্রে শ্যালিকার খোঁজখবর করতে এলে, কথা বলার সময় কে যেন আড়ালে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যায়। শাশুড়ির এই মিশনের প্রধান যোদ্ধা বড় মেয়ে অঞ্জনা। মালাও ঠান্ডা মাথায় সংঘাত এড়িয়ে যাচ্ছে। অয়নকে সব কথা বলে না। তারপর শুরু হলো বড় ননদের গায়েপড়া বিরক্তিকর ব্যবহার।

সকালবেলা অঞ্জনার ধাতানি, ‘অয়নের এই জামাটা ধোয়ার জন্য তোমাকে কে বের করতে বলেছে? মাত্র দুদিন পরেছে। জমিদারি দেখাচ্ছো নাকি? সাবান-সোডা কিনতে পয়সা লাগে না! কাজ না খুঁজে পেলে ঘরগুলো মুছে ফেলো!’

মালা খুবই সংযতভাবে বলল, ‘গরমের সময় একটা জামা দুবারের বেশি পরে অফিস করা যায় না দিদি! ওটা অফিস, তোমার বাড়ি নয়। আমি কেচে দিচ্ছি তোমাকে কাচতে হবে না।’

বলতেই অঞ্জনা চোখমুখ কটমট করে ধোয়ার জন্য রাখা জামাটিকে গামলা থেকে তুলে পুনরায় ভাঁজ করে নিজের আলমারিতে নিয়ে রেখে দিলো।

রাতে অয়ন ঘটনাটা জানতেই অঞ্জনাকে ডেকে বলল, ‘আমি যাওয়ার সময় মালাকে বলে গেছিলাম জামাটা ধুয়ে আয়রন করতে দিতে, তুই জামাটা তোর আলমারিতে নিয়ে রেখেছিস কেন?’

ভাইয়ের আওয়াজ শুনে অঞ্জনা পুরো ভোল পাল্টে দিলো। মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘আমি ভাবলাম ধোয়ার হলে তো তুই আমাকে বলে যেতিস। বলিসনি বলে আমি জামাটা তুলে রেখেছি। দাঁড়া এনে দিচ্ছি!’

বলেই কিছুই যেন হয়নি এরকম একটা ভাব নিয়ে জামাটা খাটের ওপর রেখে গেল। মালা খেই খুঁজে পায় না এই পরিবারের লোকগুলির ভোল পাল্টাবার মুনশিয়ানা দেখে। কী নিখুঁত পরিকল্পনামাফিক এদের মানসিক অত্যাচার। বাইরের লোক তো দূর অস্ত, নিজের স্বামী পর্যন্ত পুরোটা বুঝতে পারে না।

অয়ন ঘরে ফিরলে শাশুড়ির হাজার এক শরীর খারাপের ফিরিস্তি, ‘বুঝলি অয়ন, আমার না বিকেল হলেই কাশি ওঠে। কাশতে কাশতে বুকটা ব্যথা করে।’ সঙ্গে আরো খুচরো অনেক অসুবিধা জুড়ে দেয়। অয়ন সব শুনে বলে, ‘তোমাকে একজন হার্টের ডাক্তার দেখাতে হবে। আমি নাম লিখিয়ে রাখব, মালা তোমাকে নিয়ে যাবে।’

এইভাবে শাশুড়ি প্রসঙ্গ ভুলিয়ে দিত অয়নকে। অয়নও বুঝত। সময় নিয়ে হলেও ওর পরিবার যেন মালাকে মেনে নেয় তার জন্য সংসারের সমস্ত বাড়তি দায়িত্ব ও মাথা পেতে নিত। অয়নেরও যে সহ্যক্ষমতার একটা সীমা আছে, সেটা ওর পরিবারের ধারণা ছিল না। বিয়ের এক বছরের মধ্যে চোর-পুলিশের  সংঘাতটা চরমে গিয়ে পৌঁছাল।

গ্যাসে ভাত বসিয়ে ননদ অঞ্জনা অন্য কাজে ছিল। ভাতের মাড়টা উথলে উঠছে। মালা দেখতে পেল। ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে ওভেনের নবটা ঘুরিয়ে আগুনটাকে ছোট করে দিলো। ভাতের ঢাকনাটা সরিয়ে চামচটা হাতে নিয়ে ভাতের ফেনা কাটতেই অঞ্জনা রান্নাঘরে এসে মালাকে ধমকাতে শুরু করল, ‘তুমি ভাতের হাঁড়ি ধরলে কেন?’

মালা থতমত খেয়ে বলল, ‘মাড় উথলে উঠেছিল বলে জ্বালটা কমালাম, ফেনাটা কেটে দিচ্ছিলাম।’

অঞ্জনার ধমকের জোর এবার দ্বিগুণ হয়ে গেল, ‘ভাতের হাঁড়িটা তুমি ধরলে কেন? ন্যাকা তুমি, বোঝো না!’

মালা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও মাথাটা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করলো, বলল, ‘আমি ভাতের হাঁড়ি মাজতে পারব, ভাতের হাঁড়ি ধরতে পারব না, এ তোমাদের কী রকম নিয়ম?’

অঞ্জনার চোখমুখের অভিব্যক্তি ক্রমশ হিংস্র হয়ে উঠল। চক্ষুলজ্জার পর্দাটা নিমেষে সরে গিয়ে আসল মুখটা বেরিয়ে এলো। সেই ভয়ঙ্কর অশালীন মুখটা মালাকে আক্রমণ করে বলল, ‘মাকে অথবা মাধুরীকে তুমি বলতে পারতে! ভাতের হাঁড়িটা ছুঁলে কেন? তোমার ছোঁয়াটা এখন মাকে দেবো, বাবাকে দেবো, আমি খাব, চয়নকে দেবো? ওরা তিনসন্ধ্যা গায়ত্রী করে। তুমি ছোট জাত কী করে বুঝবে!’

অঞ্জনার রুদ্রমূর্তি দেখে মালা ভয় পেয়ে গেল। অঞ্জনার আক্রমণে নিজের ঘরে বসা শাশুড়িও রান্নাঘরে চলে এলো।  মেয়ের কথার তালে তাল মিলিয়ে খুব শান্তভাবে বিধান দিলেন, ‘অজাত-কুজাতের থেকে আর কী আশা করবি! চেঁচামেচি করিস না, হাঁড়ি ধরে ফেলে দিয়ে আবার ভাত বসা!’

বিধান দিতে দেরি আছে, মাধুরী রান্নাঘরে এসে গ্যাস নিভিয়ে ভাতের হাঁড়িটা নামাল। তারপর সোজা নিয়ে গেল কলপাড়ের নর্দমার দিকে। মালা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল জা আর ননদ মিলে হাঁড়ির পুরো ভাতটা নর্দমায় ঢেলে দিলো শাশুড়ির বিধান অনুসারে। বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ এইসময় সাধারণত থাকে না, আজো নেই।

মালা তার নতুন সংসার নিয়ে অন্যরকম একটি বোধোদয় পেল। ভাত ফেলে আসার পর তিনজনের অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠেছিল, আজ ওরা একটা মনের মতো শিক্ষা দিতে পেরেছে মালাকে। ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কারের নিকৃষ্টতম একটি অসভ্য ধারণা অয়নের বাড়িতে যত্নে লালিত হচ্ছে, সভ্যসমাজ তো দূরের কথা প্রতিবেশীরাও কেউ সেটা বুঝতে পারলেন না। এতদিনে মালার   মনে হলো, প্রতিহিংসার সঙ্গে সংস্কারকে মিশিয়ে ওরা বারবার এভাবেই বিভিন্ন ইস্যুতে হেনস্তা করবে। ওকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে, অয়নকে ও কী বলবে!

সারাদিন নিজের ঘরে শুয়েছিল মালা। দুপুরে কেউ ওকে খেতেও ডাকেনি। রাতে অয়ন বাড়ি ফিরলে মালা আর নিজেকে চেপে রাখতে পারেনি। গলাটা চড়িয়ে বেশ জোরেই অয়নকে বলল, ‘আমি ভাতের হাঁড়ি ধরেছি বলে মা-দিদি পুরো ভাতটা ড্রেনে ফেলে দিলো, এরপরও তুমি আমাকে কীভাবে মানিয়ে নিতে বলো?’

বাড়িতে তখন সবাই আছে। সবার কানেই কথাটা গেল। তাৎক্ষণিক উত্তরটুকুও কেউ দিলো না। ভাসুর চয়ন প্রতিদিনের মতো রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর বারান্দায় পায়চারী করছিল। তবুও কয়েকটি কথা বাবাকে না বললে অয়ন মানসিক স্থিরতা পাচ্ছিল না বলে বলল, ‘মালাকে তোমরা কেউ সহ্য করতে পারছো না। বউদি আর দিদি আমি বাড়ি না থাকলে মালাকে মানসিক নির্যাতন করে। সেটা করায় মা। আর তুমি সেটা জেনেও কোনো কথা বলো না। কাল যেটা হয়েছে, হাঁড়ি ধরে ভাত ফেলে দেওয়া, সভ্যসমাজে একথা বললে গায়ে থুথু দেবে মানুষ।’

অনুকূল বাবু শুনলেন, পরিবর্তে অপ্রয়োজনীয় একটা ক্ষোভ উগরে দিলেন, যা অভিভাবক হিসেবে নিজের দায়িত্বটা এড়িয়ে যাওয়া, বললেন, ‘আমার ফাটা কপাল নিয়ে আমাকেই থাকতে হবে, যা ভালো বুঝবি তাই কর।’

কোনো বলিষ্ঠ মতামত দিলেন না। ফলে অয়ন না বলে পারল না, ‘এরপরও আমি এই বাড়িতে থাকলে যে-কোনো সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। বাড়িসুদ্ধ সকলের কোমরে দড়ি পরবে। হাজতবাস করতে হবে।’

মালা উঠোনে দাঁড়িয়ে শুনছিল ওদের কথা। বিয়ের অল্প কয়েক মাসে বুঝে ফেলেছে, এই সংসারে তার শাশুড়ির কথাই শেষ কথা। শ্বশুরের এতটুকু ক্ষমতা নেই নিজের স্ত্রীর বিরুদ্ধে কিছু বলবেন। শাশুড়ির প্ররোচনায় বড়ো ননদ অঞ্জনা বড়ো জা মাধুরীকে বলতে শুনেছে, ‘অজাত-কুজাতের কোলে সেবককে দেবে না।’

তারপর থেকে মালা ভাশুরের ছেলেকে কখনো কোলে নেয়নি। এমনকি কথাটা অয়নকে জানাতেও ওর রুচিতে বেধেছিল।

অনুকূল বাবু সামান্য ফার্মাসিস্ট, যৎসামান্য আয়। স্ত্রীর খুবই বাধ্য। মালার জীবনে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। অয়নের টাকায় এখনো এদের চিকিৎসা, খাওয়া-দাওয়া চললেও মালাকে ওরা মেনে নেবে না। মালা বেশ বুঝতে পারছে অয়নের বুক ফেটে গেলেও মুখে কিছু বলবে না। জামাইবাবুর ডাকা ভ্যানে ঘুমন্ত মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বসেও তার অন্তর্জগৎ আক্রোশে ফেটে পড়লো। একতরফা  অন্যায়কে এভাবে মেনে নেব কেন?

খুব সংযতভাবে ভ্যান থেকে নেমে ঘরে ঢুকল পুনরায়। তারপর  শাশুড়ির  চোখের দিকে সরাসরি তীক্ষè চোখে তাকালো। মালা আজ ভয়ংকর। নববধূর নমনীয়তা সে ঝেড়ে ফেলতে চায়।