উপাগত : দৃশ্যশিল্প প্রকল্পে নিকটবর্তী ‘অপর’

সম্প্রতি ঢাকা মহানগরের প্রান্তগুলিতে দৃশ্যশিল্পীদের বেশ কিছু স্টুডিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হাজারীবাগে চর্মশিল্প কারখানার পরিত্যক্ত কিছু শেডে যেমন, ১, ২ ও ৩নং বুড়িগঙ্গা ব্রিজের উভয় পাশে তরুণ, এমনকি অগ্রজ শিল্পীরা যৌথ বা একক উদ্যোগে গড়ে তুলছেন এই স্টুডিওগুলি। ভাড়া, লিজ বা কেনা জায়গায় গড়ে ওঠা এই স্টুডিওগুলি বেশ কিছু কৌতূহলোদ্দীপক শিল্প কার্যক্রম গ্রহণ করছে। ভাস্কর হিসেবে সুপরিচিত দৃশ্যশিল্পী তৌফিকুর রহমান ঢাকার মোহাম্মদপুরের নিকটবর্তী ৩নং বুড়িগঙ্গা সেতুর কাছে শ্যামলাপুরে তার ব্যক্তিগত স্টুডিওতে ‘উঠান’ নামে একটি সমকালীন শিল্প কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন। উঠান-এর উদ্যোগে অতি সম্প্রতি কয়েকটি শিল্প-প্রকল্প পরিচালিত হয়েছে। বসিলার একটি ইটের ভাটায় এবং আটি বাজারের কাছে একটি বাঁশপট্টিতে পরপর দুটি শিল্প-প্রকল্প আয়োজন করে উঠান। মূলত আশপাশে বসবাস করছেন কিংবা একই ধরনের স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেছেন এমন অপেক্ষাকৃত তরুণ চিত্রী ও ভাস্করবৃন্দ এই দুটি শিল্প প্রকল্পে যুক্ত হন। উভয় প্রকল্পে অংশ নেওয়া শিল্পীদের লক্ষ্য ছিল স্থান-নির্দিষ্ট (সাইট-স্পেসিফিক) স্থাপনাধর্মী শিল্পকর্ম নির্মাণ। স্থানীয় সংস্কৃতিকে বিবেচনায় নিয়ে এবং মুখ্যত স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত উপকরণ দিয়ে ক্ষণস্থায়ী বিভিন্ন শিল্প-স্থাপনা নির্মাণ করেন তাঁরা। প্রক্রিয়া শেষে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে দর্শকদের আহ্বান জানানো হয় উন্মুক্ত (ওপেন স্টুডিও) প্রদর্শনীতে।

কোভিড পরিস্থিতি অনেকটা থিতু হয়ে আসার পর গত ২৫ থেকে ২৭ নভেম্বর, ২০২২ তারিখ পর্যন্ত উঠান-এর উদ্যোগে ‘উপাগত’ শিরোনামে এ-ধরনের তৃতীয় উদ্যোগটির উন্মুক্ত প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। প্রকল্পটিতে মোট এগারোজন ভাস্কর, চিত্রকর ও ছাপচিত্রী অংশ নেন। নভেম্বরে মাত্র তিনদিনের জন্য প্রদর্শনীটি  উন্মুক্ত  হলেও প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয় মে মাস থেকে। অংশ নেওয়া শিল্পীরা হলেন – আফসানা হাসান সেঁজুতি, আরজানা তাবাসসুম, ইফাত রেজওয়ানা রিয়া, এ এইচ ঢালী তমাল, জাফরিন গুলশান, তারেক মেহেদী, মনজুর রশীদ, রূপম রায়, সনদ বিশ^াস, সৈয়দ তারেক রহমান এবং প্রকল্পটির কিউরেটর তৌফিকুর রহমান। প্রদর্শনীটি উপস্থাপিত হয় নির্মাণাধীন ওয়াশপুর গার্ডেন সিটির আপাতত বন্ধ থাকা ‘ক্যাফে গার্ডেন সিটি’ নামে একটি রেস্টুরেন্টে। শিল্পীরা চিত্র, ভাস্কর্য, স্থাপনা ও পারফরম্যান্সের ভাষা ব্যবহার করে প্রকল্পটির জন্য নির্ধারিত একটি নির্দিষ্ট থিমের ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন মোট এগারোটি শিল্পকর্ম উপস্থাপন করেন। সব শিল্পকর্মই প্রদর্শিত হয় ক্যাফেটির খোলা চত্ব¡র ও সংলগ্ন কক্ষগুলিতে।

`উপাগত’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ সমীপাগত বা নিকটে এসেছে এমন। উঠান-আয়োজিত দৃশ্যশিল্প প্রকল্পটির শিরোনাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে উপাগত শব্দটি। প্রকল্পে অংশ নেওয়া শিল্পীরা প্রত্যেকে খুঁজে নিয়েছেন একজন করে ব্যক্তিকে – যাঁরা অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অর্থে ‘সুবিধাবঞ্চিত’। এঁরা কোনো না কোনোভাবে শিল্পীদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সম্পর্কিত। শিল্পীরা তাঁদের নির্দিষ্ট করা এই ব্যক্তিদের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ককে ভিত্তি ধরে শিল্প অভিব্যক্তি নির্মাণে উদ্যোগী হন। এই নির্ধারিত ব্যক্তিদের বিভিন্ন পেশাগত পরিচয় রয়েছে। যেমন – গৃহকর্মী, নিরাপত্তাকর্মী, রিকশাচালক, রাজমিস্ত্রি, ঝালমুড়ি বিক্রেতা, চা-দোকানি, কেয়ারটেকার, স্টুডিও টেকনিশিয়ান, লন্ড্রিম্যান প্রভৃতি। এঁদের লৈঙ্গিক বিভিন্নতাও রয়েছে। আছে আঞ্চলিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা। তবে সকলেরই সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো – তাঁরা উল্লিখিত শিল্পীদের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত। সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামো অনুসারে শিল্পীরা ‘ঊর্ধ্বতন’ বেদিতে অবস্থান করছেন এবং যাঁদেরকে এই প্রকল্পের বিষয় করছেন তাঁরা ‘অধস্তন’। শিল্পীদের সঙ্গে তাঁদের কমবেশি একটি নিয়মিত অর্থনৈতিক আদান-প্রদানের সম্পর্ক রয়েছে। প্রকল্পের প্রয়োজনে শিল্পীরা যাঁর যাঁর মতো করে তাঁদের পূর্বপরিচিত এসব ব্যক্তির সঙ্গে নতুন করে সংযোগ স্থাপন করেন এবং ব্যক্তিক বোধের ভিত্তিতে তাঁদের দৃশ্যায়িত করেন। প্রতিটি শিল্পকর্মের কেন্দ্রে ছিল কাজটির জন্য নির্ধারিত ‘সুবিধাবঞ্চিত’ ব্যক্তির ইমেজ – যার সঙ্গে নানা বস্তু ও উপাদান যুক্ত করে শিল্পীরা উক্ত ব্যক্তি প্রসঙ্গে তাঁদের অভিজ্ঞতার নান্দনিক প্রকাশের প্রচেষ্টা নেন। প্রতিটি কাজের সঙ্গে ইমেজের  আবশ্যকীয় ব্যবহার পুরো প্রদর্শনীটিকে একসূত্রে গ্রন্থিত করে। বলা যায়, কিউরেটর সচেতনভাবে এ-বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এই শিল্প প্রকল্পে আফসানা হাসান সেঁজুতির উপস্থাপিত শিল্পকর্মের শিরোনাম ‘হুইলস অব লাইফ’। তিনি তাঁর উপস্থাপনার কেন্দ্রে রাখেন মোহাম্মদ নুরুল হক নামে পঁচাত্তর বছর বয়সী এক রিকশাচালককে – যিনি শিল্পীকে তাঁর প্রাত্যহিক যাতায়াতে পরিবহনসেবা দিয়ে থাকেন। ফলে তাঁদের মধ্যে চালক ও যাত্রীর নিয়মিত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তবে এই সাধারণ যোগাযোগের বাইরে তাঁদের আলাদা নৈকট্য তৈরি হয়েছে বলে দাবি করেন শিল্পী। সেই যোগাযোগের ভিত্তিতে সেঁজুতি একটি ক্যানভাসে রিকশার চাকা ও চালকের প্রতিকৃতির কোলাজ তৈরি করেছেন। চিত্রটি যে দেয়ালে ঝোলানো হয়েছে তার পাশের দেয়ালে যুক্ত করেছেন একই ধরনের চাকা ও প্রতিকৃতিযুক্ত প্লাস্টিকের বিভিন্ন রঙের একবার ব্যবহারযোগ্য থালা। কৌণিক এই স্থাপনার ভূমিতে থালার সারি নেমে এসে নিরাবলম্বভাবে দাঁড়িয়ে থাকা একটি প্রকৃত রিকশার চাকার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েছে। উপস্থাপনাটি ত্রিমাত্রিকতা ও দ্বিমাত্রিকতার একটি যৌগে পরিণত হয়ে রিকশাচালকের পেশাগত জীবন এবং শিল্পীর সঙ্গে তাঁর সংযোগকে বর্ণিল রূপে উদ্যাপন করে।

আরজানা তাবাসসুমের কাজটি মুখ্যত ভাস্কর্যধর্মী দুটি নির্মাণের যৌগ। ‘রূপালী’ শিরোনামের এই উপস্থাপনাটিতে ‘রূপালী’ নামে একজন গৃহকর্মীর প্রতিকৃতির ডিজিটাল ইমেজ দেয়ালে ঝোলানো হয়। শিল্পী  ইমেজটির নিচে দুটি হাত একটি অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি ঘষে পরিষ্কার করছে Ñ এরকম ত্রিমাত্রিক গড়ন যুক্ত করেন। ভূমিতে প্লাস্টিকের গামলায় আরো দুটি হাত কাপড় ধোয়ার ভঙ্গিতে রেজিন কাস্টিংয়ে যুক্ত করেন। লাইফ কাস্টে সৃষ্ট দুই জোড়া হাতের ক্ষেত্রেই একটি নিজের, অপরটি গৃহকর্মীর হাত থেকে ছাঁচ নিয়ে গড়া বলে জানান শিল্পী। ডিজিটাল ইমেজের সঙ্গে দেয়ালের রিলিফসদৃশ গড়ন ও ভূমির নিরাবলম্ব গড়ন ঐক্যবদ্ধরূপে গৃহকর্মীর সঙ্গে শিল্পীর লৈঙ্গিক মিত্রতা ও সমমর্মিতার বোধ প্রকাশের প্রচেষ্টা বলে মনে হয়।

ইফাত রেজোয়ানা রিয়া গ্রাম থেকে নগরে আসা একজন নির্মাণ শ্রমিকের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জীবনের ক্লান্তি ও ফেলে আসা বর্ণময় অতীতের স্মৃতিকাতরতাকে বিষয় করে তাঁর পারফরমেটিভ স্থাপনাটি নির্মাণ করেন। আবদ্ধ স্থানে ইটচাপা কাগজকে ক্রমাগত কেটে তিনি তাঁর অনুভব প্রকাশ করেন।

জাফরিন গুলশানের ‘সম্পর্কের প্রপঞ্চ’ শিরোনামের কাজটি মূলত তাঁর গৃহকর্মে সহায়তাকারী নাহার আপার সঙ্গে প্রাত্যহিক যোগাযোগকে উপলক্ষ করে সৃষ্ট একটি স্থাপনাধর্মী উপস্থাপন। শ্রেণিগত বৈষম্য ও সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক সত্ত্বেও লৈঙ্গিক ঐক্যকে বিবেচনায় নিয়ে উভয়ের গার্হস্থ্য ও ব্যক্তিগত ব্যবহার্যের সমন্বয়ে একটি আবদ্ধ কক্ষে স্থাপনাধর্মী কর্মটি উপস্থাপন করা হয়। স্থাপনাটিতে সোনালি তবক বা ফয়েল ব্যবহার করা হয়েছে। সোনালি রঙের প্রয়োগ দেখা যায় নাহারের প্রতিকৃতিতে, ব্যবহার্য পাদুকা, তৈজস, পোশাক ও দেয়ালের ইটে। অন্ধকার প্রকোষ্ঠের বিষণ্নতার সঙ্গে উজ্জ্বল সোনালি মোড়কের উপস্থিতি আশা, আনন্দ আর সম্ভাবনার বোধ তৈরি করতে সচেষ্ট।

তারেক মেহেদী অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে নগরের ফ্ল্যাটবাড়ির একজন নিরাপত্তাকর্মীর প্রতিকৃতি এঁকেছেন। প্রতিকৃতির সামনের ভূমিতে স্থাপন করেছেন লোহার তার দিয়ে সেলাই করে মেরামত করা একটি চেয়ার এবং তাতে হেলান দিয়ে রাখা নিরাপত্তাকর্মীর লাঠি। সামনে একটি লোহার দরজাসদৃশ ফ্রেমে ঝুলিয়েছেন অনেক চাবি। দেয়ালে ঝোলানো ক্যানভাসটিকে একটি তালার আকার দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তার ওপরে যুক্ত করেছেন বেশ কয়েকটি সিসি ক্যামেরা। দেয়ালে লিখেছেন কিছু বাক্য। বাক্যগুলি ব্যক্তি নিরাপত্তাকর্মীর প্রসঙ্গ অতিক্রম করে নাগরিক জীবনের অবিশ^াস, অনিরাপত্তা, বিচ্ছিন্নতা প্রভৃতি প্রসঙ্গে নানা বোধের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে। বিষয়ের নানামুখী বিস্তারের কারণে রেডিমেডস, চিত্রকলা, গ্রাফিতির জমকালো ব্যবহার ঘটে ‘অবিশ^াস সমাচার’ শিরোনামের এই উপস্থাপনাটিতে।

মঞ্জুর রশীদ পরিচিত চায়ের দোকানিকে নিয়ে সাজিয়েছেন তাঁর নিজস্ব বর্ণনা ‘বিহাইন্ড কবির মিয়া শিরোনামে। ক্যানভাসে চায়ের দোকানির প্রতিকৃতির সঙ্গে যুক্ত করেছেন চা-দোকানের পরিচিত পণ্য সিগারেটের প্যাকেট, কলার ছড়া ইত্যাদিকে। চায়ের দোকানির হিসাব লেখার চিরকুটের লেখনী ক্যানভাস অতিক্রম করে গ্রাফিতির আদলে দেয়ালে বিস্তৃত হয়েছে। ক্যানভাসের সঙ্গে দেয়ালে তিনি আরো যুক্ত করেন পলিথিনে ঝোলানো কেক, বিস্কুট, সিগারেটের প্যাকেট ইত্যাদি। সামনে একটি প্যাডেস্টেলে রাখেন চা-দোকানের অপরিহার্য অনুষঙ্গ অ্যালুমিনিয়ামের কেটলি। এইভাবে তিনি কবির মিয়ার দৈনন্দিন রূপটির প্রতিবেশগত বর্ণনা উপস্থাপন করেন।

রূপম রায়ের সাম্প্রতিক নির্মাণসমূহ সংক্ষেপণধর্মী। ‘সংলাপ’ শীর্ষক ভাস্কর্যধর্মী রচনাটিতে তিনি তাঁর হাজারীবাগের স্টুডিও সহকারী মনিরের সঙ্গে পারস্পরিক নৈমিত্তিক কাজের বাইরের যোগাযোগকে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। দুটি কেমিক্যাল গ্যালনকে একটি ধাতব পাইপ দিয়ে যুক্ত করে তিনি উপস্থাপন করেছেন ক্যাফের একটি টেবিলের ওপর। পেছনের দেয়ালে আগে থেকে আড়াআড়ি করে ঝুলে থাকা প্লাস্টিকের পাইপের সঙ্গে পতাকার মতো করে ঝুলিয়ে দেন মনিরের ডিজিটাল ইমেজ।

সৈয়দ তারেক রহমান তাঁর স্টুডিওর সামনের ঝালমুড়ি বিক্রেতাকে বিষয় করেছেন। ঝালমুড়ি বিক্রেতা আব্দুল কুদ্দুস হাজারীবাগে রাস্তার ধারে যেখানে ঝালমুড়ি বিক্রি করেন  সে-স্থানটিকে গুগল ম্যাপের সাহায্যে চিহ্নিত করেন তিনি। এরপর মানচিত্রের ইমেজ ও আব্দুল কুদ্দুসের

প্রতিকৃতির ইমেজকে একসঙ্গে যুক্ত করে ডিজিটাল প্রিন্ট নেন। প্রিন্টটিতে হালকাভাবে ছাপ নেওয়া লোকেশন পিন বরাবর একটি ছোট বৈদ্যুতিক বাল্ব যুক্ত করে আলো জ্বালিয়ে একটি আবদ্ধ কক্ষের দেয়ালে ঝুলিয়ে দেন। প্রতিকৃতি ও গুগল ম্যাপের যুগপৎ ইমেজটি দৃশ্যত কুদ্দুসের উপস্থিতির স্থানের একটি ভার্চুয়াল নির্দেশনা দেয়। প্রতিকৃতির সামনে একটি প্লাস্টিকের টুলের ওপর গামলায় চানাচুর, মুড়ি ও মরিচ উপস্থাপন করে কুদ্দুসের প্রতিবেশের সত্যিকার অভিজ্ঞতা হাজির করা হয়। তারেক অবশ্য মনে করেন, কুদ্দুসের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত তাৎক্ষণিক যোগাযোগের ভিত্তিতে অনুভব নির্ভর কোনো প্রতিক্রিয়া নির্মাণ কঠিন। নির্মিত উপস্থাপনাটিও  শেষ পর্যন্ত দর্শকের যাঁর যাঁর ব্যক্তিক অভিজ্ঞতার সঙ্গেই যোগাযোগ স্থাপন করাবে।

সনদ বিশ্বাস এবং এ এইচ ঢালী

যথাক্রমে তাঁদের ভাড়াবাড়ির কেয়ারটেকার এবং বাসার সামনের ফল বিক্রেতাকে প্রতীকীরূপে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। সনদ তার বাড়ির কেয়ারটেকার Ñ যার সঙ্গে বাড়িটির সম্পর্ক অপ্রত্যক্ষ, তাকে উপজীব্য করে ‘মিশ্রির ঘর’ নামে তালমিশ্রির একটি ত্রিমাত্রিক গড়ন তৈরি করেন। তমাল ক্যাফের পরিত্যক্ত একটি গ্রিলকে মুড়ে দেন কাগজের তৈরি ফলের মোড়ক ও তার পরিচিত ফল বিক্রেতার ইমেজ দিয়ে।

প্রকল্পটির কিউরেটর তৌফিকুর রহমান নির্মাণ করেন একটি বাস্তবের চাইতে বড় আকৃতির লোহার ইস্তিরি। পুরনো কয়লার ইস্তিরির আদলে তৈরি গড়নটিকে বাস্তবিক বিশ^াসযোগ্যতা দিতে ভেতরে ব্যবহৃত হয় কয়লা ও ডিজিটাল লাল আলো। লন্ড্রি কিংবা গৃহে কাপড় ইস্তিরি করার জন্য ব্যবহৃত আয়রন-টেবিলের আদলে নির্মিত কাঠামোর ওপর ইস্তিরি করার জন্য প্রস্তুত করা কাপড়ের দলা রেখে এবং কিছু কাপড়কে টেবিলের নিচে জড়িয়ে দিয়ে পুরো গড়নটিতে নরম এবং শক্ত, যান্ত্রিক এবং জৈবিক Ñ এই দুই বৈপরীত্যের ঐক্য প্রদান করেন। গড়নটির আনুভূমিক বিস্তৃতি দিতে কাপড়ের পুঁটলি, কাগজের খালি এবং কয়লা ভর্তি ঠোঙা যুক্ত করেন। ‘হাঁটু ভাঙ্গা দ’ শীর্ষক ভাস্কর্যধর্মী এই স্থাপনায় ‘দুলাল’ নামে একজন লন্ড্রিম্যানকে কেন্দ্র করে শিল্পী তাঁর ব্যক্তিক মনোজাগতিক বোধকে প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়।

বাংলাদেশের সমকালীন শিল্পজগতে এ-ধরনের

থিমভিত্তিক যৌথ দৃশ্যশিল্প প্রকল্প এখন আর নতুন নয়। বিশ শতকের শেষ দশকে স্থাপনা ও পারফরম্যান্সধর্মী এ-ধরনের প্রকল্প নতুন প্রবণতা হিসেবে বিবেচিত হলেও গত দুই দশকে এদেশে নিয়মিত চর্চায় পরিণত হয়েছে। বিশ^শিল্পের কেন্দ্রীয় প্রবণতার অভিঘাতে এদেশের সমকালীন দৃশ্যশিল্পে ইন্টারডিসিপ্লিনারি চর্চার পটভূমি তৈরি হয়েছে। নিয়মিতভাবে শিল্পীরা দেশ ও বিশ্বের নানা স্থানে প্রকল্পভিত্তিক শিল্প কর্মকাণ্ডে যুক্ত হচ্ছেন।

উঠান-এর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘উপাগত’ শীর্ষক যৌথ শিল্প প্রকল্পটিতে অংশ নেওয়া শিল্পীরা দীর্ঘ সময় নিয়ে তাঁদের থিমভিত্তিক চিন্তা প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখে অবশেষে সম্পন্ন প্রকল্পটি দর্শকদের সম্মুখে উপস্থাপন করেন। গবেষণা ও প্রক্রিয়ার দৈর্ঘ্যটি নিঃসন্দেহে আলাদা তাৎপর্য বহন করে। শিল্পীরা নিজেদের শিল্পকর্মে ‘অপর’ ব্যক্তিকে বেছে নিয়েছেন, যা শিল্প নির্মাণ প্রক্রিয়ার জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। ব্যক্তিক বোধ প্রকাশে নির্দিষ্ট কোনো অন্যকে বিষয় করা হলে তা অনেক ক্ষেত্রেই অনধিকার অনুপ্রবেশ এবং আরোপিত হয়ে ওঠার ঝুঁকি সৃষ্টি করে।

‘উপাগত’ শীর্ষক দৃশ্যশিল্প প্রকল্পের উন্মুক্ত প্রদর্শনীর উদ্বোধনী দিনে আমন্ত্রিত অন্য অনেকের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দৃশ্যশিল্পী ও কিউরেটর ওয়াকিলুর রহমান, অধ্যাপক লালা রুখ সেলিম, শিল্পী ও শিল্পলেখক জাভেদ জলিল, স্থপতি সাইফুল হক, শিল্পী তরুণ ঘোষ প্রমুখ। ফিতা কেটে প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন রিকশাচালক মোহাম্মদ নুরুল হক। প্রদর্শনীর সমাপনী দিনে প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের সঙ্গে মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক লালা রুখ সেলিম, নাসিমা হক মিতু ও নাসিমুল খবির।