এখন কবি মোহাম্মদ রফিক

সনৎকুমার সাহা

রবীন্দ্রনাথ দিয়ে শুরু করি। যদিও এখানে তিনি কোনো বিষয় নন। সরাসরি জানিয়ে রাখি কবি মোহাম্মদ রফিকের সাম্প্রতিক কবিতাগুচ্ছের দিকে আমাদের চোখ। সেখানে যাওয়ার পথ কাটতে রবীন্দ্রনাথের শরণ নেওয়া। এ থেকে আগেভাগে কেউ যেন এমন ধারণা না করেন যে, রবীন্দ্রনাথ ও রফিক কবিতায় একই পথের পথিক। কালের তফাৎ, বাস্তবের অভিঘাত, ঐতিহ্যে পালাবদল, আশা-নিরাশার প্রান্তরে রূপে রূপে প্রতিরূপে অপরূপত্বের তৃষ্ণার অবয়বে সংযোগহীন ভিন্নতা দুজনকে অনিবার্যভাবে দুই আলাদা গোলার্ধে ঠেলে। এবং এটিই প্রত্যাশিত। কবিতার শিরায় ও ধমনীতে রক্তসঞ্চালনেও অনুকূল। কবিতা স্বয়ং যদি বিপন্নতার ও বিষাদের কুয়াশায় ডুব দিয়ে তীরের নাগাল না পায়, তবু। তার সচল সত্য-অনুভবের অন্বেষণ অনুসরণ করে চলে বহুমাত্রিক জীবন প্রবাহে অস্থির আপেক্ষিকতাকে। ধ্রুবপদের নিশ্চয়তা বুঝি অলীকই থেকে যায়।

তারপরেও যাত্রারম্ভ, আমাদের রবীন্দ্রনাথে। আমরা দেখি, বয়স যখন তাঁর পঁচিশ, তখন তিনি গাইছেন, ‘কেন চেয়ে আছ গো মা, মুখপানে।’ আক্ষেপ তাঁর কোনো আড়াল মানে না; খেদ তাঁর দ্ব্যর্থহীন ঝরে পড়ে – ‘এরা চাহে না তোমারে চাহে না যে, আপন মায়েরে, নাহি জানে।/ এরা তোমায় কিছু দেবে না, দেবে না – মিথ্যা কহে শুধু কত কী ভাবে\’ আশাহীন সমাপ্তি টানেন এই বলে, ‘মুখ লুকাও, মা, ধূলি শয়নে – ভুলে থাকো যত হীন সন্তানে।/ শূন্য-পানে চেয়ে … প্রহর গনি গনি দেখ কাটে কিনা দীর্ঘ রজনী।/ দুঃখ জানায়ে কী হবে, জননী, নির্মম চেতনাহীন পাষাণে \’

সবাই জানেন, ব্যক্তিসত্তার অনিরুদ্ধ উন্মেষের অভূতপূর্ব বার্তা নিয়ে তাঁর আবির্ভাব। একুশ বছর বয়সেই তা তিনি জানিয়ে দেন ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ ও ‘প্রভাত উৎসবে’র অমর পঙ্ক্তিমালা রচনা করে। কিন্তু ব্যক্তি একা বাঁচে না। তার মর্যাদার জায়গা চাই; সাড়া জাগিয়ে সাড়া দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথ চাই। তাতেই সকলের সঙ্গে সকলের, প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের যোগাযোগ। আকার নেয় দেশ। প্রাণময়ী হয়। তারই লাঞ্ছনায় বেদনার্ত কবির হৃদয়। তা আরো বেড়ে যায় স্বদেশবাসীর নিস্পৃহতায়, তাদের অরুচিকর স্বার্থপরতায়। তবে এই বেদনা তাঁকে নির্জীব করে না। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত না থেকেও তিনি নিজেকে বিকশিত করে চলেন।

এদিকে স্বদেশে ব্যক্তি ও সমষ্টি সমলয়ে এসে আবেগের বিরল ঐক্য এক রচনা করে ১৯০৫-এ ব্রিটিশ শাসকের বাংলা ভাগ করার সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায়। সদিচ্ছার, সহমর্মিতার, সমবেদনার ও সংঘবদ্ধ সক্রিয়বাদের উচ্ছ্বাসে রবীন্দ্রনাথও পারস্পরিক বিভেদের ও বিরোধের প্রাচীরগুলো ভেঙে পড়ছে বলে মনে করেন। সেইসঙ্গে দেখেন, বাঙালির হার-না-মানা জিদ; দেখেন তাদের ব্যক্তিস্বার্থের ওপরে ওঠার সাধনা। এবং এসবই অপমান-লাঞ্ছিতা বাংলা মায়ের ব্যবচ্ছেদ রুখার জন্য। এই মিলনের মহাযজ্ঞে তিনিও শামিল হন। তার পরিণামে রচনা করেন বাস্তবের ন্যায়শুদ্ধ (তেমন হলেও প্রত্যক্ষে তার বিরোধিতা ও উৎকটস্বার্থ-অভিক্ষেপ পথ আগলে থাকতে পারে, সজ্ঞানে অথবা অজ্ঞানে), আবেগঋদ্ধ, অখন্ড মানবিকবোধে উদ্দীপ্ত একের পর এক কালজয়ী গান। ভাব সেসবে পূর্ণতা পায়। বাঙালি অখন্ডতার সত্য অনুভব ও মনুষ্যত্বের আরাধ্য বিভাস কথায় ও সুরে একাকার হয়ে মেলে। ঘটনা যেদিকেই যাক না কেন, তা স্থায়ী হয়। তখন, এখন এবং ভবিষ্যতের অন্তহীন এখনে। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ – ওই সময়ের নিখাদ উচ্চারণ। এখনো তেমনি। একই রকম, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা’, ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’, ‘আমি ভয় করব না ভয় করব না। দু বেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না!’, ‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি, বারে বারে, হেলিস নে ভাই!’ ‘বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল -/ পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান’ \ – এসব গান। এরকম আরো আছে এবং সবগুলোই যেন মন্ত্রসিদ্ধি পায়। আবেগের জায়গাটা একসময় পেছনে পড়ে ধুলোয় হারায়। বাস্তব ভোল পালটায়। কিন্তু গানগুলোর ব্যঞ্জনা এই বাংলাদেশে আমাদের কাছে আরো সদর্থক হয়ে ওঠে।

আমরা জানি বাংলা-ভাগ রদ করতে ব্রিটিশ শাসকেরা বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু মানুষে-মানুষে বিভেদের রেখাগুলো মিলিয়ে যায়নি। বরং তাদের ফাটলগুলো প্রকট থেকে প্রকটতর হয়েছে। শাসকের প্রশ্রয় ছিল। কিন্তু কার্যোদ্ধার হবার পর আমরাও যার যা কায়েমি স্বার্থ, অথবা অলীক স্বপ্নের প্রলোভন, তার আকর্ষণে পথ ভুলি। এসবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে মেলাতে পারেন না। দূরে সরেন। তাই বলে জীবনে পূর্ণ প্রাণের আকাঙ্ক্ষা থেকে নয়। সৃষ্টিশীল উদ্যমে আপন ভাবনার বহুমুখে প্রকাশ থেকেও নয়। কর্মক্ষেত্রেও উদ্যোগী হন। পল্লী উন্নয়নে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগোতে চান। শিক্ষায় আপন স্বপ্নে যে উদার মুক্তির আকুতি, তার বাস্তব রূপায়ণ-কলা খোঁজেন। দুটোই সমুদ্রে গোষ্পদ তুল্য। কিন্তু আন্তরিকতায় ও ব্যক্তিস্বার্থহীন শ্রেয়-ভাবনায় খাদ থাকে না এতটুকু। একই সঙ্গে আপন বিশ্বাসের জায়গাটাকেও তিনি প্রশ্নাতীত রাখেন না। বেদনা ও নিরাসক্তি, দুটোই তাতে ভর করে।

বাস্তব কিন্তু থেকে যায় নানা স্বার্থের জটাজালে আকীর্ণ। কাজ উদ্ধার হবার পর বঙ্গভঙ্গ-রদ আন্দোলনের আবেগে আসে ভাটার টান। মানুষে-মানুষে ভাগাভাগির রেখাগুলো আবার আগের চেয়েও প্রকট স্পষ্টতায় ফুটে উঠতে থাকে। কবির উদ্বেগ যুগের ধিক্কার হয়ে বাজে : – ‘কার নিন্দা করো তুমি? মাথা করো নত।/ এ আমার এ তোমার পাপ।/… ভীরুর ভীরুতাপুঞ্জ, প্রবলের উদ্ধত অন্যায়,/ লোভীর নিষ্ঠুর লোভ,/ বঞ্চিতের নিত্য চিত্তক্ষোভ,/ জাতি-অভিমান,/ মানবের অধিষ্ঠাত্রী দেবতার বহু অসম্মান,/ বিধাতার বক্ষ আজি বিদীরিয়া/ ঝটিকার দীর্ঘশ্বাসে বেড়ায় ফিরিয়া।’ (‘দূর হতে কী শুনিস’, বলাকা, ১৯১৫)

আরো দশ বছর পর কলকাতায় এক দাঙ্গা বাধে। কবি স্বচক্ষে দেখেন, ভীতসন্ত্রস্ত জনগণ প্রাণভয়ে নিরাপত্তার আশায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। মর্মাহত কবি           পরে শান্তিনিকেতনে ফিরে প্রার্থনা-মন্দিরের বেদিতে দাঁড়িয়েই যন্ত্রণাদগ্ধ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় সবাইকে শুনিয়ে বলেন, ‘…মোহমুগ্ধ ধর্ম-বিভীষিকার চেয়ে সোজাসুজি নাস্তিকতা অনেক ভালো। ঈশ্বরদ্রোহী পাশবিকতাকে ধর্মের নামাবলী পরালে যে কী বীভৎস হয়ে ওঠে তা চোখ খুলে একটু দেখলেই বেশ দেখা যায়।… নাস্তিকতার আগুনে তার সব ধর্মবিকারকে দাহ করা ছাড়া একেবারে নূতন করে আরম্ভ করা ছাড়া আর কী পথ আছে বুঝতে তো পাচ্ছিনে।’ (প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রজীবনী, তৃতীয় খন্ড, প্রথম সংস্করণ, পৃ ২৪০)। এর প্রতিক্রিয়ায় রচিত হয় তাঁর বিখ্যাত গান, ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো।/ একলা রাতের অন্ধকারে আমি চাই পথের আলো।’ আরো একটি গানে ফুটে ওঠে তাঁর অতলস্পর্শী যন্ত্রণার্ত আকুতি, – ‘পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে!’ মনে মনে ভাবেন, ‘মরীচিকা-অন্বেষণ’ই বুঝি অবিকল্প ভাগ্যলিপি। আর, কেবল, ‘হাল-ভাঙা পাল-ছেঁড়া ব্যথা চলেছে নিরুদ্দেশে।’

এতে কি স্বদেশ-মাতৃকার যে রূপের বন্দনায় তিনি মুখর হয়েছিলেন ১৯০৫-এ, তা মিথ্যা হয়ে যায়? অবশ্যই নয়। ওই রূপে যে ভাবের পূর্ণতা তা-ও সত্য। তবে তা প্রতিদিনের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে বিপর্যস্ত নয়। সব দ্বন্দ্ব পেরিয়ে স্বপ্ন-কল্পনায় যা অক্ষয় হয়ে থাকে, যার পদতলে মাথা নুইয়ে দিয়ে আমরা ব্যক্তি ও সমষ্টিজীবনে সমীকরণসিদ্ধ সার্থকতা খুঁজি, সে তা-ই। তেমন সন্ধিলগ্ন কখনো কখনো আসে, আবার হয়তো কোনোদিনই আসে না, কালে-কালে তার রূপও পালটায়; তবু তা থাকে, তার উজ্জ্বলতা কমে না। বিরল কোনো ক্ষণে যদি তা প্রত্যক্ষের বাস্তবতায় মেলে, তবে পরমুহূর্তেই তা আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে। যায়। কারণ, সবাইকে নিয়ে সমীকরণের চেহারা বদলে যায়। কালস্রোতে কোনো স্থিরবিন্দু নেই। কিন্তু ব্যক্তির লক্ষ্য, ওই প্রবহমান কালের মূল স্রোতের সঙ্গে অন্বয় খোঁজা। রবীন্দ্রনাথও তাই করে চলেছেন বিরতিহীন সারাজীবন।

১৯৩৬-এ, যখন তাঁর বয়স প্রায় পঁচাত্তর তখন সব সংশয়, সব পিছুটান ঝেড়ে ফেলে প্রশান্ত চিত্তে, দ্বিধাহীন কণ্ঠে তিনি জানিয়ে দেন, ‘আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন।’ তাঁর ব্যঞ্জনা ও ব্যাপ্তি নিজেই তিনি ধরিয়ে দেন –

কবি আমি ওদের দলে –

আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন,

দেবতার বন্দীশালায়

আমার নৈবেদ্য পৌঁছল না।

পূজারি হাসিমুখে মন্দির থেকে বাহির হয়ে আসে,

আমাকে শুধায়, ‘দেখে এলে তোমার দেবতাকে?’

আমি বলি, ‘না।’

অবাক হয়ে শুনে, বলে, ‘জানা নেই পথ?’

আমি বলি, ‘না।’

প্রশ্ন করে, ‘কোনো জাত নেই বুঝি তোমার?’

আমি বলি, ‘না’।

 

এরপর তাঁর অম্লান স্বীকারোক্তি –

শুনেছি যাঁর নাম মুখে মুখে,

পড়েছি যাঁর কথা নানা ভাষায় নানা শাস্ত্রে,

কল্পনা করেছি তাঁকেই বুঝি মানি।

তিনিই আমার বরণীয় প্রমাণ করব বলে

পূজার প্রয়াস করেছি নিরন্তর।

আজ দেখেছি প্রমাণ হয়নি আমার জীবনে।

কেননা, আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন।

মন্দিরের রুদ্ধদ্বারে এসে আমার পূজা

বেরিয়ে চলে গেল দিগন্তের দিকে –

সকল বেড়ার বাইরে,

নক্ষত্রখচিত আকাশতলে,

পুষ্পখচিত বনস্থলীতে,

দোসর-জনের মিলন-বিরহের

বেদনা-বন্ধুর পথে।

(‘ওরা অন্ত্যজ, ওরা মন্ত্রবর্জিত’, পত্রপুট)

মানস-মুক্তির এই বোধ রবীন্দ্রনাথের একদিনে আসেনি। বাস্তবের ঘাত-প্রতিঘাতে তা চেতনায় তাঁর নিরন্তর বিকশিত হয়ে চলেছে। এইভাবে স্বদেশ একসময়ে তাঁর সামনে প্রতিমা হয়ে উঠেছে। পরে সেই প্রতিমা আর কোনো গন্ডিতে বাঁধা থাকেনি। ব্রাত্য-মন্ত্রহীনের বেদনা-মথিত সমগ্রতাকে সে ধারণ করেছে। বাংলা-মায়ের মুখ বিশ্ব-মায়ের মুখ হয়ে উঠেছে। ‘সবার পিছে সবার নিচে সবহারাদের মাঝে’ চরণ তার রাজে।

বাস্তব কিন্তু অনুভবের অনুসারী হয়। অনেক ক্ষতলাঞ্ছনা পেরিয়ে, ক্ষতির পাহাড় ডিঙিয়ে তারই বিকাশমান-জাজ্বল্যমান-যুযুধান রূপ আমাদের এই বাংলাদেশ। পতনে-উত্থানে-ধ্বংসে-সৃষ্টিতে-অর্জনে-বিসর্জনে অনিশ্চিত বন্ধুর পথে তার চলা। পদে-পদে কুসংস্কার আর ধর্মান্ধতার বেড়াজালের প্রতিরোধ। লোভের আগ্রাসন ও বিকারের রক্তবীজ ছড়ায়। তবু বিরাম নেই আমাদের নির্বিকার মনুষ্যত্বের সাধনায়। সব মিলিয়ে আমরা সামনেই এগোই।

তবে মজা এই, ঘটনা স্বয়ং এখানে পথ দেখায়। ঘটনার কারিগর যাঁরা, তাঁরাও সবসময় তার সম্ভাবনা পরিমাপ করতে পারেন না। কিন্তু তা নিজেই নিজের মহিমায় আকাশ ছায়। গণমানুষ তারই প্রেরণায় আকাশ-পানে হাত বাড়ায়। অধিনেতা জেগে ওঠেন তাদেরই ভেতর থেকে, তাদের আশা-নিরাশায়-স্বপ্নসাধনায় একাত্ম হয়ে।

এটা আমরা লক্ষ করে আসছি বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের সময় থেকেই। ওই সময়ে যাঁরা ছিলেন সংগ্রামের অগ্রপথিক, তাঁরা সবাই তার যৌক্তিক ও নৈতিক লক্ষ্যের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি। লক্ষ্যচ্যুত হয়েছেন। আদর্শভ্রষ্টও। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি নিজেই তার বহুমাত্রিক ঐশ্বর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। যতদিন যায়, ততো গণমানুষ – নতুন যুগের নতুন মানুষও – তার কাছে আসে। আত্মজিজ্ঞাসার উত্তর খোঁজে তাতে। একই রকম প্রাণময় হয়ে ওঠে ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিসংগ্রাম। পরে প্রতিবিপ্লব যখন হানা দেয়, দেশকে লন্ডভন্ড করে, তখন ওইসব ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনার নেতৃস্থানীয় অনেককেই দেখি আত্ম-স্বার্থপরায়ণতার কাছে পরাজিত হয়ে মানুষের উন্নয়ন ও কল্যাণের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে সুযোগ-সন্ধানে ব্যস্ত। ঘটনাগুলো কিন্তু হারিয়ে যায় না। মানুষের চেতনায় বারবার জাগে। বারবার শক্তি জোগায়। যদিও সময়ের অনেকটাই কাটে সমর-শাসনের পাশবিকতায়, যা নষ্ট-ভ্রষ্ট ও বিকারগ্রস্ত করে জনসমাজের স্বাভাবিক হয়ে ওঠা। বাস্তবের ছিন্নমস্তা বীভৎসা নগ্ননৃত্যে মেদিনী কাঁপায়। হতাশা কখনো কখনো চেতনাকে অবশ করে।

কিন্তু এরই ভেতরে গত শতকে নববইয়ের দশকের গোড়ায় মাথা তুলে দাঁড়ায় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি (১৯৯২)। যে-মুক্তির আহবান ছিল রবীন্দ্রনাথে, তাকেই আবার অাঁকড়ে ধরি। শুধু তাই নয়, যারা একাত্তরে আমাদের মুক্তি-সংগ্রামের বিরোধিতায় হানাদার ঘাতক দখলদারদের সহযোগিতা করে, তাদের তোষামোদী ভৃত্য সেজে প্রতিবিপ্লবের প্রকাশ্য কর্তৃত্বপরায়ণতায় আবার আসরে নেমে ডুগডুগি বাজাতে শুরু করেছে, তাদের তালিকা তৈরি করে উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে এসব অবাঞ্ছিত বিকারের নির্মূল ঘটাবার দাবি তুলি। সমাজে স্ববিরোধ অবসানের ও কলঙ্কমোচনের পথই আমরা খুঁজি। কিন্তু বিকারের বিপুলতা প্রবলতর হয়ে তার পরিণাম-সিদ্ধি ঘটতে দেয় না। বিষাদ ও হতাশা অনেককে আমাদের গ্রাস করে। গ্রাস করে মোহাম্মদ রফিককেও। সঙ্গে যোগ হয় একসময় ব্যক্তিগত শোকের দায়ভার। কবিতা তিনি লেখেন। উৎকৃষ্ট কবিতাই। কিন্তু তাদের বিষণ্ণতা আমাদেরও আচ্ছন্ন করে। তার শিকড় ছড়ায় প্রত্যক্ষের গ্লানি থেকে অস্তিত্বের গভীরতর অনিবার্যতার মর্মমূলে। সুখ তাঁকে প্রলুব্ধ করে না। দুর্যোগেই সত্যের বিপরীত মুখ প্রত্যক্ষ করেন। বানানো কথায় মন জোগাবার ফাঁকি দিয়ে মিথ্যার বেসাতি করেন না। অসহায় বোধ করেন নিজেও। কারণ, নেতির-অরণ্যে কোনো আশ্রয় মেলে না। যদিও তা আমাদের নিত্যদিনের সহচর।

কিন্তু এই ২০১৩-র ফেব্রুয়ারিতে হঠাৎই এক প্রবল বিস্ময় গনগনে অাঁচে আমাদের চেতনার আকাশের সমস্তটা রক্তিম করে তোলে। হঠাৎ, কিন্তু অমূলক নয়। যেন ‘মৌন মন্তরে’ নিত্যদিন যপা। তবে ‘মহা-আশঙ্কা’ নয়, শিকড়ে সঞ্চিত তিল-তিল করে জমা বিপুল প্রত্যাশা। এ সমষ্টির; ব্যক্তিরও, – যদিও ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা আলাদা থাকে না, একাকার হয়ে মিশে যায় সমষ্টি-চেতনায়। কোথাও কোনো প্রস্ত্ততি নেই, স্বতঃস্ফূর্ত জেগে ওঠে ঢাকায়  শাহবাগে তরুণ প্রজন্মের আহবানে গণজাগরণ মঞ্চ। তারা চায়, স্বাধীনতা-সংগ্রামের সময় এই বাংলায় যারা মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধে লিপ্ত ছিল, তাদের সম্পূর্ণ বিচার ও চূড়ান্ত শাস্তি বিধান। শুধুই কাগজে-কলমে নয়, প্রত্যক্ষের ঘটনায়। এ নিষ্ঠুরতা নয়, জমে থাকা অন্যায়-অপমানের জঞ্জাল থেকে শুদ্ধি-স্নান। সঠিক শাস্তি যদি হয় মৃত্যুদন্ড, তবে তা প্রকৃতপক্ষে অপরাধীর প্রতি করুণা। কারণ, এতেই ঘটে তার পাপস্খলন।

তারা আরো ফিরে যায় ‘জয়-বাংলা’ মিলিত গর্জনে। দূর থেকে আমাদের কানে ভেসে আসে ‘আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে।’ শাশ্বত বাংলা প্রাণময়ী হয়, যা পূর্ণতা পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের             বেলা-শেষের উপলব্ধিতে – ‘আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন’। ‘ধর্ম-বিভীষিকা’কে ছুড়ে ফেলে তারা প্রকাশ্যেই। প্রত্যাঘাত আসে। কিন্তু তারা দমে না। বিশৃঙ্খল সন্ত্রাসের দিকেও যায় না। পূর্ণপ্রাণে বাঙালির মানুষী মর্যাদাকেই কুণ্ঠাহীন দেখায়। ‘আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা’ এ-জীবনে এক ঘাট থেকে আরেক ঘাট পেরিয়ে ‘সত্যের দারুণ মূল্য লাভ’ করে রবীন্দ্রনাথ যেখানে এসে থামেন, সেখান থেকেই গণজাগরণ মঞ্চের উত্থান।

সাড়া জাগে তাৎক্ষণিক ও সর্বাত্মক। এ এক অবাক-করা ঘটনা। কোনো দলগত প্রস্ত্ততি নেই, কায়েমি-স্বার্থের হিসাব-নিকাশ নেই, ক্ষমতার পাশাখেলা নেই, শুধু শুদ্ধচিত্তে আমাদের স্বাধীনতার মন্ত্রকে ঝালিয়ে নেওয়া, তার মানে মুক্ত মানবিক-বোধের উদ্বোধন ঘটানো। আমরা যারা হতাশায় ডুবতে বসেছিলাম, ক্লেদাক্ত লোভের অসংযমী দুরাচারে মানুষের ওপর আস্থা হারিয়ে কোটরবাসী হয়ে পড়ছিলাম, তারাও উঠে বসি। সামনে তাকাই। প্রেরণার সোনার কাঠি ছুঁয়ে যায় রফিককেও।

তার মানে এ নয়, এই উদ্দীপনাই কবিতা রচনার পূর্বশর্ত। গভীর হতাশা, এমনকি অতি-মানবিক বিতৃষ্ণাও থাকতে পারে কোনো কোনো অসামান্য কবিতার উৎসে। বুদ্ধদেব বসুর হাত ঘুরে বোদলেয়ার তো একসময় এই মন্ত্র জপিয়েই আমাদের কবিদের অনেকের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে অতিক্রম করে কবিতা যখন শক্ত জমি পায় এবং অনুভবে তা সত্যও থাকে, তখন তার মহিমা আলাদা মাত্রা পায়। সত্যের সঙ্গে শিব যুক্ত হয়। মানুষ সামনে তাকাতে আস্থার জায়গা একটা খুঁজে পায়। আমরা যারা পড়ি, তারা অনেকখানি স্বস্তি বোধ করি। শুধুই কবি-প্রতিভার বিস্ময় নয়, কবি-ভাবনার মানুষী কল্যাণও আমাদের টানে। একজনের নয়, যৌথ জীবনযাপনে সমষ্টির। ব্যক্তি হৃদয়ে ঢেউ তুলেও কবিতা ব্যক্তিতাকে ছাড়িয়ে যায়। এই বাড়তিটুকু অশেষ। মানুষকে তা তার ‘আপনার নিরানন্দ অন্ধ কারাগার’ থেকে বাইরে এনে মুক্তির স্বাদ জোগায়। যদিও সে-মুক্তিও কোনো পরম একক নয়। বাস্তবের আপেক্ষিকতায় তা ফুটে ওঠে; আবার তার পালাবদলে সে-ও ভোল পালটায়। এর শেষ নেই। অন্তত ‘মানুষের সীমা’য় নেই। কবিতায় ‘শেষ কথা’ও নেই।

আমরা দেখি, ‘গণজাগরণ মঞ্চে’র উদার অভ্যুদয়ের কালেই – মোটামুটি ফেব্রুয়ারি-জুন, ২০১৩-তে – মোহাম্মদ রফিকের কবিতায় প্রাণের উৎসাহ আবার জেগে ওঠে। নৈরাশ্যের দেয়াল ভেঙে পড়ে। কবিতার অঞ্জলি তাঁর দুহাত ভরেও উপচে পড়ে। আমরা উৎফুল্ল হই। তবে জীবনভাবনার অঙ্কে ঐকিক নিয়মে সমাধান মেলে না। সরল যোগ-বিয়োগেও না। অনিশ্চয়তা-নিরাশা ও বেদনার ধারাবাহিক-কমবেশি মিশ্রণের রেশ অবিরাম বয়ে চলে। তারই ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আচমকা আশার উন্মাদনা। যদিও তারও উৎস জীবনই – আমাদের বেঁচে থাকা-হয়ে ওঠার মৌলিক               বাস্তবতাতেই তার পুষ্টি। খেয়াল করি বা না-ই করি। এসব থেকে রফিকের দুটো কবিতার বই বেরিয়ে আসে ২০১৩-র অক্টোবর-নভেম্বরে : কালের মান্দাস ও ঘোরলাগা অপরাহ্ণ। প্রথমটি ছেপেছে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, দ্বিতীয়টি শুদ্ধস্বর। এই বই দুটো নিয়েই আমার কথা।

তার আগে আরেকবার মনে করিয়ে দিই, আমাদের জীবনে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি যেমন, ২০১৩-র গণজাগরণ মঞ্চও তেমন। একই রকম নির্ণায়ক তার ভূমিকা। হয়তো চোখের সামনে বলেই আমরা তার সুদূরপ্রসারী অনপনেয় অভিজ্ঞানের সবটা ঠাহর করতে পারি না। তার মন্ত্রে উজ্জীবিত যাঁরা ধর্মান্ধদের আক্রোশের শিকার হলেন, তাঁরা মনে করি, ভাষা-শহীদদের মতোই অমরত্বে উত্তীর্ণ। বাংলাদেশ যদি তার একাত্তরের অগ্নিশপথ পূর্ণ করে, তবে তাঁদের মহিমা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে আমাদের পথ দেখিয়ে চলবে।

 

দুই

যদিও প্রকাশকালের দিক থেকে ঘোরলাগা অপরাহ্ণই অগ্রজা, মাত্র দু-এক সপ্তাহের ব্যবধান, আমার চোখে আগে পড়ে, কালের মান্দাস। এতে বড় কোনো বিভ্রাট ঘটেছে বলে মনে হয় না। অঙ্গসৌষ্ঠব দুটোরই রুচিস্নিগ্ধ। প্রথমটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন তৌহিদ হাসান। দ্বিতীয়টির ঢালী আল মামুন। তাতে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ চলমান কালের প্রেক্ষাপটে মিশে যাওয়া এক নারীপ্রতিমার আবছা ইঙ্গিত। আবছা, কিন্তু চোখ আটকে রাখে। অন্তত আমার তেমনই মনে হয়। আজকাল অবশ্য একই ছবি একাধিক ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে তুলতে পারে। যেমন পারে কবিতাও। এই বইতে আরো আকর্ষণ করে তার উৎসর্গের পাতা। কবির উৎসর্গের পাত্র, ‘তরুণ প্রজন্ম’। দ্ব্যর্থক হবার কোনো সুযোগ নেই এখানে। প্রত্যাশাও একটা জাগে। এবং তা স্পষ্ট। প্রথম বইটির উৎসর্গের পাতায় লেখা, ‘শেষ-প্রহরের বন্ধু, উদ্ভ্রান্ত রজনীর শুকতারা।’ কাব্যিক তো বটেই; সেইসঙ্গে বৈপরীত্যের (অক্সিমোরোন) সংঘর্ষে চেতনায় আলো জ্বলে – পতনের আভাস ও উঠে দাঁড়াবার অবলম্বন, দুই-ই তাতে ফুটে ওঠে। একদিকে শেষ প্রহরের উদ্ভ্রান্ত রজনী, অন্যদিকে বন্ধু মেলে শুকতারা, যা আনবে প্রভাত, – আনবেই। কোনো বিকল্প নেই তার। ভেঙে বললে, তা ওই তরুণ প্রজন্মের হাতেই পরম বিশ্বাসে তুলে দেওয়া। চকিতে মনে জাগে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গান – ‘যেতে যেতে একলা পথে নিবেছে মোর বাতি’ – যার শেষ দুচরণ – ‘বুঝি বা এই বজ্ররবে নূতন পথের বার্তা কবে -/ কোন পুরীতে গিয়ে তবে প্রভাত হবে রাতি \’

তবে মোহাম্মদ রফিক একালের এবং বাংলাভাষায় এই সময়ের সেরা কবিদের একজন। কবিতা অনেকরকম হতে পারে, আমরা জানি। কিন্তু সময়ের কণ্ঠস্বরে জীবনের কলধ্বনি যদি সত্য হয়ে তাতে ধরা না পড়ে, তবে তা শুধুই শব্দের ধারাপাত। হতে পারে সাজানো-গোছানো। কিন্তু তাতে কবিতার মূল্য কিছু ধরা পড়ে না। ওই সত্য যে অবিকল্প, এমন না-ও হতে পারে। কিন্তু চলমান জীবনের মৌলবাস্তবতায় তা লগ্ন থাকে অবশ্যই। যেভাবে সে-লগ্ন থাকে, তা-ই ফুটিয়ে তোলে তার রূপ। গতির ছাপ পড়ে তার ওপর অনিবার্য। দর্শনে, মননে, চিন্তনে ধাবমান সময়ের পর্ব থেকে         পর্বান্তরে সজাগ থাকা তাই কবির ভাগ্যলিপি। ‘কান পেতে রই’ – এটা তাঁর শখ মেটাবার ছল নয়, মর্মার্থী হবার আপন কর্তব্যে প্রথম অঙ্গীকার। রফিক এইখানেই আলাদা হয়ে যান অন্যদের থেকে। ওপর চালাকি তাঁর নেই। এবং জীবনের আন্তরমূল্যের স্বরূপ অন্বেষণ তাঁর নিরন্তর। তাতে ছাড় দেন না এতটুকু। বস্ত্তমায়ায় সজাগ-সচেতন অভিনিবেশে তার প্রকৃত চেহারা তুলে আনার স্বেচ্ছা-আরোপিত দায়িত্ব ঠিক করে দেয় তাঁর কবিতার গড়ন, তাঁর শব্দপ্রতিমা, তাঁর গন্তব্যের অনুভব। এবং সব মিলে তার প্রাণময়ী-লাবণ্যময়ী-চৈতন্যের আলোর শিখায় তিমিরবিদারী প্রতিমা। কালের মান্দাস ও ঘোরলাগা অপরাহ্ণে তাদের দেখা পাই আমরা বারবার। তবে তারা আগের কীর্তির পুনরাবৃত্তি করে না। যদিও পূর্ব-ভাবনার বৃত্ত থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসে তাও বলা যাবে না; কারণ সেসবেও ছিল জীবনপাঠের মর্মান্তিক সাধনা, – তাতে যথার্থ অর্থমূল্য যোগ হয়েছে অবশ্যই; কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চের উত্থানে মানুষের প্রতি বিশ্বাসে যে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি, তাতে যেন আগামী দিনে মানবমুক্তির দিগন্তহীন প্রাঙ্গণের প্রবেশ-পথ তাঁর সামনে খুলে গেছে অনেকখানি। তাঁর আবেগ ও অনুভূতি কবিতার পর কবিতায় রণিত হয়ে চলে। বিষাদ পিছু হটে। এ যেন কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে দুঃখ-ভারাক্রান্ত অর্জুনের সামনে নিরাসক্ত শ্রীকৃষ্ণের ত্রিকালপ্রসারী উদ্দীপনা। অর্জুন ও শ্রীকান্ত দুই-ই বাস্তব। তবে অর্জুনের মতো মোহাম্মদ রফিক উঠে দাঁড়ান। গণজাগরণ মঞ্চে তরুণ প্রজন্মের আহবানে সুদূর বিপুল সুদূরে চোখ রেখে কবিতায় গান্ডিবের টংকার তোলেন। আমরাও তিমির-হননের আশায় মাথা তুলে আকাশে হাত বাড়াই।

মোহাম্মদ রফিকের কবিতা যাঁদের পড়া, তাঁদের কাছে এটা বলা বাহুল্য, কী বিপুল সংযম কাজ করে তাঁর প্রতিটি উচ্চারণের পেছনে। ভাস্কর যেমন ছেনি দিয়ে পাথর কেটে কেটে মূর্তি বানিয়ে তাতে প্রাণের হিল্লোল বইয়ে দেন, তিনিও তেমনি শব্দের পর শব্দে বাড়তি মেদ ঝরিয়ে যেটুকু অপরিহার্য, সেটুকুই শুধু রাখেন, প্রতীকে যেখানে ইশারাই যথেষ্ট, সেখানে তার ব্যাখ্যায় একটি বর্ণও যুক্ত হয় না, উপমায় থাকে অলিখিত দূরান্বয়ী সংযোগ। প্রতিটি অব্যর্থ। আমাদের গভীরতার দিকেই টানে। কখনো বা বাচ্যার্থের মহিমা স্বয়ং চেতনায় ঢেউ তুলে তাতেই ক্ষান্ত হয় না। ব্যঞ্জনা তার ভাবের ও অর্থের ব্যাপ্তি ঘটিয়ে আমাদের অনুভবকে সমৃদ্ধতর করে। মননও হর্ষ জাগায় অ-প্রাণ অশ্রুপাতক্ষম হয়। এই বাংলায় সত্তার মর্মমূল থেকে যে-সংগীত ভেসে আসে, তা বহু মানুষের বহু স্বরের অভ্রান্ত কেলাসন। কোনো শুচিবায়ুতায় তা মলিন হয় না। যেমন হয় না, আমরা দেখেছি রবীন্দ্রনাথে। হয় না মোহাম্মদ রফিকেও। কবিতার ভাষা দুজনের এক নয়। সত্য অনুভব ফুটে ওঠে যদি অভিন্ন তবুও। সময় আমাদের ভাষার অভিজ্ঞান বদলে দেয়। রূপকলাতেও ঘটে চলে কাটাকুটি-দৌড়ঝাঁপ-প্রবেশ ও প্রস্থান। একই ঘাটে নোঙর ফেলে আমরা যুগ-যুগ পড়ে থাকি না। পড়ে থাকতে চাওয়াটাও স্বাস্থ্যকর নয়। এসবেরই নির্ভুল ছাপ পড়ে কালের মান্দাসে। পড়ে ঘোরলাগা অপরাহ্ণতেও। তাদের দিকে নজর দিই এবার।

দুটোরই রচনাকাল এক। কাজেই আগে-পিছে সাজানোয়  যোগ-বিয়োগ তেমন কিছু হয় বলে মনে হয় না। ভাবগত ও কাঠামোগত বিন্যাস যেন একই ধাঁচের। দুটোতেই এমন কিছু রচনা আছে, যা ন্যূনতম শব্দের বন্ধনে গোটা দু-তিন চিত্রমায়া নিরাবেগ তুলে ধরেই শেষ। তাই বলে অসংলগ্ন নয়। গভীরে যোগসূত্র কবিতার পূর্ণতা দেয়, যদিও তা অস্পষ্ট থাকে; এবং অস্পষ্ট থাকে বলেই আমাদের ভাবনা তার রহস্যজালে বাঁধা পড়ে। এই লক্ষণ কিন্তু ধরা পড়ে অন্যসব কবিতাতেও। শব্দরা একই সঙ্গে প্রকাশমান ও গোপনতাসঞ্চারী। এবং কোথাও তারা বিশদ হয় না। ধ্বনির আড়ম্বরও তিনি পরিত্যাগ করেন। প্রতীকের চলাচল এতে বাধা পায় না। বীভৎসা, ও তার বিপরীতে জিজীবিষা, সেইসঙ্গে আশা-নিরাশায় দোলায়মান সর্বাত্মক মানবিক উত্থানের করুণা ও উত্তেজনা ফুটে ওঠে তাতেই। আমরাও সম্মোহিত হই। সুখে নয়, দুঃখেও নয়, তাদের অতিক্রম করে কালের ভেলায় অবিরাম যাত্রায় মানুষের ভাগ্যলিপি পাঠোদ্ধারের চেষ্টায়।

আমরা দেখেছি আগের বইতে শোক ও বিষণ্ণতা প্রধান হয়ে উঠে তাঁকে যেন গ্রাস করতে চাইছিল। তাঁর বিপন্নতা তাঁর কবিতাকে অবশ্য বিপন্ন করেনি। অনুভবের অসহায় আর্তিকে আমরা অনুমান করতে পেরেছি, এবং তা তাঁর কবিতার শৃঙ্খলাতেই। তবু এই সম্ভাবনাও উঁকি দিতে শুরু করেছিল, তিনি বুঝি ওই বিষাদের বৃত্তে বাঁধা পড়তে চলেছেন। যদিও কবিতা যে তাতে মিছে হয়ে যায়নি বরং নিষ্ঠুর হলেও তার উৎসভূমির হাহাকার অসংযমী না হয়েও আপন সীমা ছাড়িয়ে বোদ্ধা পাঠককে পরিশুদ্ধ বেদনায় আর্দ্র করেছে, এটা আমরা মেনে নিয়েছি। এখন এই যুগল প্রকাশনা জানিয়ে দেয়, ওই শোচনা-বৃত্তে তিনি আটকে নেই। নতুন প্রজন্মের গণজাগরণ মঞ্চ ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সমষ্টির উত্থানে যে-প্রেরণা জাগায় তা তাঁকেও সত্য পরিবেশনার অভিঘাত থেকে সমগ্রের বৈষম্যহীন উদ্বোধনের দাবিতে একাত্ম করে। কবিতাও সেই অনুযায়ী বদলে যায়। যেখানে বিষয় ভিন্নতর, সেখানেও। দুটো বইতে জায়গা করে নিয়েছে একই ধারার কবিতা। ছন্দ-যতি-মিলে-অমিলে তফাৎ নেই। বিশ্বাসের উজ্জীবনের পাশাপাশি হতাশায় নিমজ্জনও থেকে যায় একই ভঙ্গিমায়। প্রত্যক্ষের ঘটনায়, মনে হয়, গণজাগরণ মঞ্চ যেমন চাঙা করে তুলেছে, রানা প্লাজায় ধস বা তাজনীন অগ্নিকান্ড তেমনি মনকে দমিয়ে দিয়েছে। এদের কালিমাও গাঢ় হয়ে পড়েছে কবিতায়। তবে তা পা ফেলেছে একই চালে। মেদহীন-আতিশয্যহীন প্রকাশ সবগুলোয়। ভার অবশ্য প্রত্যেকটিতেই বিপুল। কোথাও বা অসহনীয়।

একটা কবিতা আমাকে কিঞ্চিৎ ভাবায়, এ কি এই পর্বের ঠিক আগে তাঁর যে-মনস্তাপ কবিতায় পৌনঃপুনিক ছায়া বিছায়, কোথাও বা ঘন হয়ে জমে, তারই কিঞ্চিৎ কৈফিয়ত অথবা বিষাদেরই ক্ষমাহীন অবশেষ? দীর্ঘ কবিতা নয়, – কোনোটিই তো নয়, –  পুরোটাই উদ্ধার করি –

 

বহু কিছু ছেড়েছি জীবনে

এমনকি তোমাকেও

অথচ তুমিই করে গেলে দান

অন্ধকূপে প্রায়-অন্ধ যাত্রা,

তুমি শুধু বয়ে গেলে আলোর বর্তিকা

দিগ্বিদিক শূন্য পথে-পথে

কখন ছড়িয়ে গেলে মণিমুক্তাসম

মাঝে মাঝে মুমূর্ষু শ্বাসের মতো

নুড়িবালুপাথরের শব্দ চিত্রকল্প পঙ্ক্তির সংঘাত

দ্বিখন্ডিত মস্তকে দিগ্ভ্রান্ত আশীর্বাদ

পারাপারহীন ওপারের আদিগন্ত রেখা

হাতছানি কোনো-এক অক্ষয় ছায়ার

তুমি তবু দিনরাত্রি অতলের তলে

গহিন আঁধারে সদ্য ফুটে ওঠে পুষ্পের সুঘ্রাণ,

তোমাকে ছেড়েছি বলে

বয়ে চলি স্তবকে-স্তবকে কবিতার অভিশাপ,

মিটে যাক ইহজনমের দায়ভার!

(‘মিটে যাক’, ঘোরলাগা অপরাহ্ণ)

 

এ কি কবির উভয়-সংকট নয়? এবং একান্ত তাঁরই? আপস তিনি করেন না। বেছে নেন কবিতা। তারও দাম আছে। দায়ভার আছে। ‘কবিতার অভিশাপ’ই তা। নুয়ে পড়েন। কিন্তু থেমে যান না।          দিক-বদল করেন না। ওই ‘অভিশাপ’ই ললাটলিখন মেনে নেন। কবিতা ছাড়েন না। পায়ে কাঁটা ফোটে। মাথার ওপরে ঝড়-জল-বজ্রপাত। কালের বোঝা পিঠে নিয়ে তিনি চলেন। অকূল সাগরে নাও ভাসান। দূরে আশার প্রদীপ জ্বলে-নেভে-জ্বলে। এ এক বীরের সংগ্রাম। তবু তার রক্তক্ষরণ – নিজের, এবং আপনজনেরও – আমাদের চেতনায় বিষাদের চাবুক হানে। আমরা তো উপভোক্তা। ভাবি, এই দুঃখবরণ তো আমাদের মুখের দিকে তাকিয়েই। এবং তাতে খাদ নেই এতটুকু। অনুশোচনায় দগ্ধ হই আমরাও। যদিও তাঁর কবিতার রসে আমরা মজি। হতাশা-বেদনা ও উজ্জীবনের তৃষ্ণা দুই-ই আমাদের ভেতর জাগে। বিষয় ছাড়িয়ে তারা স্বয়ংক্রিয় হয়। মাঝি থাক-বা-না থাক, ভেলা তারা নিজেরাই ভাসিয়ে নিয়ে চলে। যেমন চলে রবীন্দ্রনাথের ওইসব অমর পঙ্ক্তিমালা।

সভ্যতার ঊষাকাল থেকেই আমরা জানি, মানুষ প্রার্থনা করে আসছে, আমাকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে চলো। চেতনায় অন্ধকার পুরো কাটে না। আলোর পথে যাত্রারও বিরাম নেই। কারণ গন্তব্য কোনো স্থান-কালে স্থিরবিন্দু নয়। অন্ধকারও এক জায়গায় জমাট বেঁধে থাকে না। আলো ফুটলে অন্ধকারও তার পিছু পিছু আসে। তাকে গ্রাস করে। আংশিক। কখনো বা সবটুকুই। আলোকেও তাল মিলিয়ে তাই নতুন হতে হয়। আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠতে হয়। এর কোনো বিরাম নেই। কারণ জীবন অনিত্য। তার সম্ভাবনাও অসংখ্য। এবং প্রত্যেকটিই বহুভুজা। আলো-অন্ধকার, দুটোরই তার প্রতিটিতে বিচ্ছুরণ।

মোহাম্মদ রফিকের কবিতার বই দুটো পড়তে গিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কথাগুলো আবার মনে হয়। ঠিক আলো-অন্ধকার নয়, তাদেরই প্রতিফলনে আশা-নিরাশা, উত্থান-বিপর্যয় আবার সামনে এগিয়ে যাবার পথ খোঁজা-পথ পাওয়া, – এগুলোই কবিকে ভাবিয়েছে। ব্যক্তির যেমন, সমষ্টিরও তেমন। বারবার আসে ধুলো-ঝড়। বারবার নামে অাঁধি। তাকানো যায় না চোখ খুলে। হতাশার আবর্জনা জমে। কি ভালো – কি মন্দ, সেটাও চেনা যায় না সহজে। তারও ক্ষণে-ক্ষণে সাজ-বাজ-বদলে-ফেলে বিভ্রান্তি ছড়ানো। তবু উঠে দাঁড়াতে হয়। কবিকে। আমাদেরও। তার অনিঃশেষ প্রেরণাই বই দুটোতে অনেক ব্যর্থতা পেরোতে পেরোতে হাজার হয়ে বাজে।

আশা জাগিয়েও বাস্তব যে ছলনা করে, নির্বিকার মুখ ফেরায়, তার চিত্রকল্প হানা দেয় এখানে –

অবিশ্বাস্য ধ্বনিপুঞ্জ মাতাল করেছে

আমি নামি মাঠে, ভরা ফসলের ক্ষেতে

কাস্তে হাতে কাটি ধান, দুরাশার;

 

অাঁটি বেঁধে নিয়ে চলি, উঠানের কোণে

থরে থরে রেখে, ভাবি, বেলা হলো

অাঁটির উপরে অাঁটি বুঝি সময়ের মাপকাঠি;

এল মাড়াইয়ের কাল লাঙল-জোয়াল-গরু

খুঁজে ফিরি এদিক-ওদিক, অবশেষে সাহায্যের

হাত কেউ মেলে ধরে, ভাবি পার পাওয়া গেল

 

এখন মাড়াই শেষ, আঁতকে উঠি ভয়ে ও সন্ত্রাসে

এ কী, দেখি সব চিটে ধান, শুধু খোসা

কপাল যদি-বা পোড়ে, সব তবে ভাগ্যের বিদ্রূপ!

(‘অভাজন’, কালের মান্দাস)

ভাবে না হলেও মেজাজে প্রায় একই-রকম ঘোরলাগা অপরাহ্ণতে ‘আরোহণ’ কবিতাটি। শেষ চার-চরণে পড়ি :

আমি শুধু অচেতন ঘোরে

খাবি খাই স্বপ্নের প্রহারে;

জেগে দেখি, আমি নেই, গাছও নেই

একটি ম্লান সূর্যরশ্মি বুনে চলে ঘনছায়া!

মনে হয় এ যে-কোনো সত্যিকারের কবিরই বিড়ম্বিত ভাগ্যলিপি। তবে আমরা শুধু এটুকুই দেখি না। কবির পশ্চাৎভূমিতে যে-মানবজীবন এ তো তারও ললাট-লিখন। হয়তো এ-ই সব নয়। আরো আছে। রফিক বলেন, ‘- স্বপ্ন বেঁচে থাক তবু!’ (‘স্পর্শমাত্র (২)’, ঘোরলাগা অপরাহন) এবং তা-ই তা থাকে। বাস্তব তার কর্ষণায়-কর্ষণায় কখনো-কখনো সোনা ফলায়। মানুষ এগোয়। যদিও প্রত্যক্ষে পর্দায় নিশ্চিত ভেসে ওঠে –

মহাশ্মশানের ঘাট জলে গেছে ডুবে,

দু’চারটে মাছেদের আনাগোনা

আশপাশ ঘিরে, ঠোকরায় ভাঙা ইট

পাথরের চাঁই মুখভর্তি উঠে আসে

পোড়া মানুষের গন্ধ, ছাই!

(‘কাল’, কালের মান্দাস)

অথবা, পরাবাস্তবতায় একাকার হয় –

…  …  …

একটি শব্দ, একটি চিত্র, একটি আরাধনা

শেষ যুদ্ধ ঘোষণা করেছে,

ফিরে চলো ঘরের দুয়ারে, মাঠে-মাঠে

খুঁটে তোলো ধান;

 

বিচ্ছিন্ন খড়ের স্তূপে মুখ ঢেকে

নাও তার ঘ্রাণ,

দিকে-দিকে মিলিয়ে এসেছে আলো

যাত্রা অবশেষ;

 

অবুঝ নেশার টান, নীরক্ত বিষাদ

শুধুই সম্বল,

তুমি মাত্রা, ছন্দ ভাঙা লয়, পরিত্যক্ত পঙ্ক্তি

ঘোর অপচয়!

(‘খুঁটে তোলো ধান’, কালের মান্দাস)

‘অপচয়’ অবশ্যই নয়। এ-জাতীয় পদাবলি রচনায় রফিকের সিদ্ধি প্রবাদতুল্য। তাঁর পুনর্বিবেচনা নতুন কিছু যোগ করে না।

গত বছর এপ্রিলে ঘটে সাভারের রানা প্লাজায় এই মানুষেরই সীমাহীন লোভের নারকীয় মুখব্যাদান। ধ্বংসকান্ড গিলে খায় সহস্রাধিক অসহায় শ্রমজীবী মানব-মানবী। তার যন্ত্রণা দগ্ধ করে, দগ্ধ করে, দগ্ধ করে কবিকে। সান্ত্বনাহীন উচ্চারণ তাঁর –

চুন, বালি, ইট-সুরকি ধ্বংসযজ্ঞ ভবনের

অন্তহীন নির্বিবেক বিকারের ঘোরে,

জানি, তুমি জেগে উঠবে বারবার কবরের মাটি ফুঁড়ে।

(‘শাহীনা’, কালের মান্দাস)

অথবা, তার পরের কবিতাটিতেই –

শুধু সত্য এই মৃত্যু ধ্বংসযজ্ঞ

নরকের চেয়ে নারকীয়

লোভ-লালসার যূপকাষ্ঠে

অন্ধ বলিদান;

বাংলাদেশ আজ এক-একটি লাশ।

(‘এক-একটি লাশ’, কালের মান্দাস)

ঘোরলাগা অপরাহ্ণতেও আছে ওই ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে বেঁচে থাকা এক মেয়ের কথা, ‘রেশমা’। মৃত্যুকে সতেরো দিন ঠেকিয়ে রেখেও অলৌকিক বেঁচে যাওয়া এই মেয়ের ‘নিরাবলম্ব’, ‘নির্মম’, ‘অধিক বিস্তৃত’, ‘কালের গহবরে’ ফিরে আসা। কবির বিষণ্ণ স্বগতোক্তি –

অতলে তো ঠাঁই নেই কোনো

শুধুমাত্র কাহিনি অক্ষয়।

আমাদের তার সঙ্গে একাত্ম করে। যে-জাগতিক বিপন্নতা ভুলে থেকে বাঁচি, তা-ই আমাদের প্রত্যেকের একান্ত বিচ্ছিন্ন সত্তায় হানা দেয়।

মাকে নিয়ে রফিকের কবিতা রয়েছে আগের-আগের বইতেও। কালের মান্দাসে আবার তা ফিরে আসে। কিন্তু চেতনায় চোখের সামনে থেকে চোখের বাইরে বাংলার সমস্তটায় তার প্রসারণ ঘটে। এই প্রসারণে রয়েছে তাঁর বই-দুটিতে যে জিয়ন কাঠি তাঁকে শূন্যের কিনার থেকে পূর্ণতার দিকে টেনে তোলে, তাঁর ছোঁয়া। সে-প্রসঙ্গে আসার আগে কবিতা দুটোয় একবার চোখ বুলিয়ে নিই। প্রথমটির কিছুটা –

আমার মা। বয়স ছিয়াশি।

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে-চলে

ভাঙা হাতে খোঁজে ওষুধের

কৌটা, ঠোঙা, বেদানার দানা।

…   …   …

নিদ্রাহীন আমৃত্যু অমর

চক্ষু দুটি মশালের আলো

খোঁজ নেয় প্রতি সন্তানের

যারা খাটে মাঠে-তেপান্তরে,

 

স্বকালের কিংবা স্বদেশের

হয়তো-বা প্রতিমূর্তি নয়

ঘরে-ঘরে জ্বেলে দেয় আলো

সামলে রাখে আপন চৌকাঠ!

(‘মা’, কালের মান্দাস)

এখানে আমরা আমাদের সময়ের আপন-আপন মায়ের প্রতিকৃতি দেখি, কালের ইঙ্গিত একটা আছে : ‘বয়স ছিয়াশি।’ হওয়ার এবং করারও : ‘ঘরে ঘরে জ্বেলে দেয় আলো/ সামলে রাখে আপন চৌকাঠ!’ হয়তো যে মায়ের বয়স পঞ্চাশ-ষাট বছর কম, তাঁকে আমরা এখানে কল্পনা করি না। কিন্তু তাঁর বাস্তবতায় তিনি সত্য হয়ে ওঠেন। একজনের কাছে নয়, এরকম সবার কাছে। তাতে একটা সাধারণ রূপ ফুটে ওঠে। এবং আমাদের আলাদা-আলাদা ছোট-ছোট জীবনকথার সঙ্গে তা মানিয়ে যায়।

কিন্তু পরের কবিতাতেই এই মা কারো একার নয়, বাংলাদেশে তা সবার। ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ যে তাঁর চেতনার সব কপাট খুলে দেয়, বাংলা-মায়ে যে সব মা মিশে যায়, অথবা সব মায়েই বাংলা-মায়ের আসন পাতা দেখি, তারই বিশ্বাস-শানিত চেতনাদীপ্ত দূরান্বয়ী উচ্চারণ শুনি এখানে। ছোট কবিতা। পুরোটাই শোনাই –

মাতৃমূর্তি কালের প্রহরা

চক্ষুদুটি জ্বলছে অনির্বাণ,

তোমার পৌত্রেরা মাঠে-পথে

তুলছে মুঠি অগ্নিশপথের,

পাথরে খোদিত শুধু নয়

তুমি চেতনার অগ্নিবাণ

ঘরে-ঘরে পাটের খড়ির

চোখে-মুখে বজ্র বিদ্যুতের,

 

কে বলেছে নিথর নিশ্চল

মুক্তিস্রোতে তোমার স্বাক্ষর

চির-বহমান জলস্রোত

হাঁক দেয় পদ্মা-মেঘনায়

 

কালের বেদিতে সমর্পিতা

তুমি বাংলা মাটি তেপান্তর

কাল নয় স্থবির নিঃশেষ

তুমি জাগরণ, মহাকাল!

(‘প্রতিমূর্তি’, কালের মান্দাস)

এ-কবিতা বারবার পড়বার; বারবার শোনাবার। রবীনদ্রনাথের ‘পোহায় রজনী, জাগিছে জননী বিপুল নীড়ে’ – তারই প্রতিধ্বনি যেন বাজে। আমরা রফিকের বাঁক ফেরা দেখি। আশায় উন্মুখ হই। যদিও জানি, বাস্তবে প্রতিদিনই অলৌকিকের দেখা মেলে না এবং দিনগত পাপক্ষয়ের জোয়াল টানার শেষ নেই। তারপরেও আসে একুশে ফেব্রুয়ারি, আসে একাত্তর, আসে গণজাগরণ মঞ্চ। একই জায়গায় আমরা ঘুরপাক খাই না, রফিকও অচিন বাতাসে গুণ টানেন! (‘কিছু তবু’, কালের মান্দাস)। আবার আশার কলধ্বনি শোনেন, আর দেখেন,

একটি মানচিত্র নবজন্ম পায় অজেয় গৌরবে;

তরুণ প্রজন্মে উষ্ণ শ্বাস ফেলে নব্য বাংলাদেশ!

(‘দেখো আজ’, কালের মান্দাস)

 

তখন –

নবজন্ম ঘটে যায় একটি দেশের জনমানুষের

এবং তখন কেউ নয় বিচ্ছিন্ন বদ্বীপ বুকে-বুকে

জ্বলে ওঠে প্রদীপের শিখা চোখে চোখে

অগ্নিবাণ সম্প্রীতির বিশ্বাসের দৃঢ় অঙ্গীকার

 

জয় হবে, হবে জয়, শোনো ওই কালের নিনাদ,

জাগো, ঢেউ উঠছে তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ!

(‘প্রতিধ্বনি’, কালের মান্দাস)

আবার গর্জে ওঠে শত-সহস্র কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’-ধ্বনি, যা প্রকৃতপক্ষে পূর্ব-প্রজন্মে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ থেকে ‘আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীনের’ই প্রলম্বিত বিস্তার। কবি মোহাম্মদ রফিক একা নন, আমরাও ব্রাহ্মমুহূর্তের অপেক্ষায় থাকি। তবে এও জানি, সংক্রান্তিপুরুষ আমরা চাইলেই ছাইপুরী সুবর্ণপুরী করেন না। চাওয়াটাও খাঁটি হওয়া চাই। একার নয়, সবার এবং যোজনায় ও যোঝায় তা অশেষ। মাঝখানে কালের আহ্নিক ও বার্ষিক গতির নিত্যপরিক্রমায় একের পর এক চড়াই-উতরাই পার হয়ে লক্ষ্য ঠিক রেখে পথচলা। ‘তা বলে ভাবনা করা চলবে না।’ আপনজনে হয়তো ছাড়বে। আশালতা হয়তো ছিঁড়ে পড়বে। তবুও না।

এমন উত্তরণের কবিতা ঘোরলাগা অপরাহ্ণতেও আছে। প্রথম কবিতা ‘জন্ম’তেই তার বোধন শুনি –

…     …    …

জাগরণ মোহন মন্ত্রের

অচিন ধ্বনিরা ফিরে আসে

ক্ষণ গোনে নিরশ্বাস মুক্তি;

কুটিল কাঁটার ব্যথা সয়ে

 

জন্ম নেয় একটি ফুল

সুবাস ছড়ায় দিগন্তরে!

 

পরের কবিতাটিতেও জ্বলে দুরাশার আলো –

…        …         …

গায়ে গায়ে জমে ওঠে ঘাম অগ্নিদীপ্ত দুরাশায়

ঠাঁই মাপে মানবিক জয়ের যাত্রার!

সামাল সামাল দৃশ্যহীন চুম্বনের দাগ

পাপভ্রষ্ট দিনান্তের এক একটি মন্ত্র, আশীর্বাদ!

(‘উহ্য থাক’, ঘোরলাগা অপরাহন)

 

অন্য আরেকটা কবিতা সবটাই পড়ি –

কবিতা ছাপিয়ে আসে

তট উছলে বানের আকার

বলে উঠি, সামাল সামাল,

 

কে-বা শোনে কার কথা

মাঠ-ক্ষেত জুড়ে ছোটে জল,

ঘুচে যাবে কালের আকাল

মৃত মাটি শ্বাস গোনে

প্রাণে প্রাণে হৃদয়-স্পন্দনে

মুক্তি পাক স্বদেশের ধ্যান

 

ধানের গুচ্ছের ফাঁকে

থরে-থরে বিপুল ফলনে

শোনো, জনমানুষের জয়গান

(‘জয়গান’, ঘোরলাগা অপরাহ্ণ)

সব কবিতা এরকম নয়। তবে এরা বিশেষ হয়ে ওঠে। আমাদের ‘শুভ কর্মপথে’ নির্ভর-যাত্রায় সংঘ-চেতনা জাগিয়ে। রফিকের উত্থানকেও চিনিয়ে দিয়ে। আগেও দেখেছি, প্রতীক তাঁর কবিতায় প্রাণসঞ্চার করে। এমনকি প্রায়ই নিয়ন্তার ভূমিকায় চলে আসে। এটা কিন্তু আমাদের জীবনাচারেই মিশে আছে। যৌথ চেতনাতেও তা আকার পায়। তবে রফিক তাতে বৈচিত্র্য আনেন। নিজস্ব বৈশিষ্ট্যও। আমরা তাঁর কবিতার নমুনা এখানে যেটুকু তুলে ধরেছি, তাতে তার পরিচয় মেলে। আছে তা পূর্বাপর। বিষয়ের গভীরে যে-নিবিড়তা, যে অব্যক্ত অনুভূতির ক্রিয়াশীলতা, তা যেন চেতনায় ছবি হয়, ছবি রূপান্তরক্ষম-গতি পেয়ে অদৃশ্যের দৃশ্যমানতায়  অভীষ্ট লক্ষ্যকে চিনিয়ে দেয় – আমরা স্তম্ভিত হই। এই স্তম্ভিত হবার কার্যকারণ-সম্পর্ক হতে পারে এক-একজনের বেলায় এক-একরকম; তবু তার অভিঘাত অনিবার্য। কবিতার অনেকান্তিক আবেদন রচনা দোষের কিছু নয়। উৎসভূমির উদ্দীপনাতে একাত্ম হতে পারাটাই বড় কথা। এখানে, মনে হয়, আমরা ভুল করি না। তবে রফিক আটপৌরে জীবনের বৃত্তেই ন্যূনতম শব্দে-বর্ণে প্রতীকের পূর্ণরূপ ফুটিয়ে তোলেন। এতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। আমাদের মুগ্ধতা এই বই-দুটো, কালের মান্দাস ও ঘোরলাগা অপরাহ্ণতে এতটুকু বিচলিত হয় না।

এক জায়গায় অবশ্য আমার একটু খটকা আছে। তা বলে ফেলে এই আলোচনা শেষ করি। কালের মান্দাসে আছে কবিতাটি : ‘পার্থ’। পুরোটাই পড়ি –

এই রথ অবিশ্রাম গতিপথে

উলটে গেছে যুদ্ধক্ষেত্রে,

পার্থ, তুমি হারিয়ে ফেলছ

তীর, ধনু, সাজ-সরঞ্জাম

 

সম্পূর্ণ নির্বাক চেয়ে আছ

দিগন্তের অবসান কালে,

সেখানে ধূলির কুন্ডলী শত্রুসেনাদের

হই-হই রবে ঘিরে আছে চতুর্দিকে

 

একমাত্র সূর্যাস্তের আলো

উদ্ধার তোমার, তুমি অসহায়

প্রেতমূর্তি, বাম হাতে ধরে থাকো

ভাগ্যের রথের ভাঙা চাকা, নির্বিকার!

এই কবিতার নাম এবং প্রতীক ‘পার্থ’ না হয়ে ‘কর্ণ’ হলেই কি যথার্থ হতো না। কবিতাতেও তৃতীয় চরণে ‘পার্থ’র জায়গায় ‘কর্ণ’ বসালে এর গড়নে কোনো হেরফের চোখে পড়তো না। ‘পার্থ’ নামটিও এই কবিতায় ওই একবারই আছে!

মহাভারতে পড়ি, কর্ণার্জুন-অন্তিম যুদ্ধে অর্জুনের (পার্থর) নয়, কর্ণের রথের চাকাই মাটিতে বসে গিয়েছিল। তিনিই ভুলে যান শত্রুঘ্ন-অস্ত্রপ্রয়োগ, রথ থেকে ভূমিতে অবতরণ করে ‘অসহায় প্রেতমূর্তি’ ‘বাঁ হাতে ধরে’ থাকেন ‘ভাগ্যের রথের ভাঙা চাকা, নির্বিকার।’

কর্ণই সূর্যপুত্র। তাই ‘একমাত্র সূর্যাস্তের আলো উদ্ধার তোমার’ তাঁকেই মানায়। অর্জুনের কর্ণবধও ওই সূর্যাস্তের প্রাক্-মুহূর্তে। এই মৃত্যু বিজয়ী পার্থকে নয়, ভাগ্যবিড়ম্বিত কর্ণকেই মহিমান্বিত করে। প্রতীকী ব্যঞ্জনাও তার বিপুল। অমরতা তাঁকে স্পর্শ করে। নির্বিশেষ অর্থে অবশ্য সব পৃথা (কুন্তি)-পুত্রই পার্থ। তাতে কর্ণও বাদ যান না। কিন্তু মহাভারত শুধু অর্জুনেই তা আরোপ করে। গণজাগরণ মঞ্চের আহবানে কবি মোহাম্মদ রফিকের বিষাদ-মগ্নতা কেটে যায়। আবার খোঁজেন তিনি মহাজীবনের পথ। তাতে সমষ্টির উত্থান। সংস্কারের মন্ত্র থেকে সমগ্রের মন্ত্রহীনতায় তার মুক্তির নির্দেশ। কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার কোনো সরলরেখা নেই। রফিকও তা জানেন। তা নইলে কেন বলবেন, ‘স্বপ্ন বেঁচে থাক তবু’! (‘স্পর্শমাত্র’, ঘোরলাগা অপরাহন) সেটিই নিয়ে যাবে মানবমুক্তির যাত্রায়। গণজাগরণ মঞ্চ তার একটা ধাপ পার করে। যেমন আগে পার হয়েছিল বায়ান্ন, বাষট্টি, ঊনসত্তর, একাত্তর। শেষ লক্ষ্যে মানুষ পৌঁছবে না কখনোই। কারণ, সব অর্জনই দ্বন্দ্বের বীজ বোনে। তবু লক্ষ্যটা সামনে থাক! ‘স্বপ্ন বেঁচে থাক।’ নইলে ঠেকানো যাবে না সমূহ পতন। সেটাও মানুষের ইতিহাসেরই শিক্ষা।