কবিতায় বঙ্গবন্ধু-কথা

‘Some are born great, some achieve greatness,
and some have greatness thrust upon them.

শেক্সপিয়রের এই ধ্রুব কথাটির সর্বাংশ কী আশ্চর্যের মতোই না মিলে যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে! তাঁর সম্পর্কে ‘জাতির পিতা’ শব্দটি যে উচ্চারিত হয়, তা কেবল গতানুগতিক একটি শিরোপা নয়, তা এক অসাধারণ জননেতার প্রতি সসম্ভ্রম উচ্চারণ। তাই তাঁর জন্মশতবর্ষকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে এবং বিশ্বের অন্যত্র তাঁর প্রতি শ্রদ্ধানিবেদনের নানা আয়োজন চোখে পড়ে, তাঁকে নিয়ে অসংখ্য গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ-উপন্যাস-স্মৃতিচারণের প্রয়াস দেখা যাচ্ছে।

এই মহা-উৎসবে শামিল হয়েছেন বাংলাদেশের প্রবুদ্ধ ও প্রবীণ কবি শাহেদ রহমান। পেশায় তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত আমলা, কিন্তু কবিতার জগতে তাঁর তারুণ্য, প্রৌঢ়ত্ব এবং আজকে তাঁর বার্ধক্য জানুলম্বিত। মুজিব জন্মশতবর্ষে তাঁর বিতত অর্ঘ্য মুজিবকে নিবেদিত ষাটেরও অধিক কবিতার মালা। অতি সংগত কারণেই বইটির নাম রাখা হয়েছে, স্মৃতি নও, তুমি নিত্য দীপ্যমান, কেননা মুজিব তো প্রকৃত প্রস্তাবে দীপশিখা, বাতিঘর, অগ্নিপুরুষ, যুগনায়ক ও একই সঙ্গে হৃদয়ের ধ্রুবতারা। যা বর্ষচন্দ্রদিবাকর মুজিব এক অমর আত্মা।

মহান ব্যক্তিদের নিয়ে কবিতা লেখা, এমনকি একটি-দুটি হলেও কঠিন, সুকঠিন। তার ওপর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হলে তা আরো অধিক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। শেক্সপিয়র বা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অসাধারণ সব কবিতা আছে, কিন্তু সিজার, নেপোলিয়ন, গান্ধী বা ম্যান্ডেলাকে নিয়ে গুটিকয় উত্তীর্ণ কবিতা যে লেখা হয়নি তা নয়। ‘… rise up and hear the bells : / Rise up Ñ for you the flag is flung …’ – হুইটম্যানের লিঙ্কন-শোকগাথার মতো শ্লোকপঙ্ক্তি আর কজন জননায়কের উদ্দেশে লেখা হয়েছে? কবি শাহেদ রহমানের কাছে তাই চ্যালেঞ্জ ছিল দুস্তর।

কবিতাগুলি বঙ্গবন্ধুর জীবন-মানচিত্র-চিহ্নিত। এজন্য মহাকাব্যিক মেজাজ আনা হয়েছে সমগ্র কাব্যগ্রন্থটিতে। বঙ্গবন্ধুর আবির্ভাবমুহূর্তকে স্বাগত জানাচ্ছে মানুষ, পশুপাখি, চরাচর। নদীর ভাটা জোয়ারে পরিণত। হোমারের ইলিয়াড শুরু হয় গ্রিক বীর একিলিসের কথা দিয়ে, যদিও মহাকাব্যটিতে বিষাদের কাজরীগাথা-আচ্ছন্ন গোড়া থেকেই, যেখানে ‘The souls of mighty chiefs untimely slain.’ অন্যদিকে কবি শাহেদ রহমান ধরলেন ‘ভোর ভোই’ সুর।

কবিতাগুলির উৎস কখনো বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী, কখনো তাঁর জীবনের ঘটনাবলি নিয়ে লেখা ইতিহাসবিদদের রচনা। কখনো কখনো কবিতার গোড়ায় ভূমিকা হিসেবে তিনি উৎসমূল নির্দেশ করেছেন, কবিতাটির প্রেক্ষাপট বুঝতে যা অনন্য সহায়ক। ‘দুঃখিনী বাংলার নির্ভীক সৈনিক’ কবিতাটির তাৎপর্য পাঠকের কাছে ধরা পড়ত না, যদি না কবিতাটির আগে কবিকৃত টীকাটি, যা আসলে বঙ্গবন্ধুর রচনাংশ, যুক্ত না হতো, ‘খন্দকার শামসুল হক ওরফে বাসুমিয়া মোক্তার সাহেব (পরে মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন) ডেকে বললেন, ‘মালেককে হিন্দু মহাসভার সভাপতি সুরেন ব্যানার্জির বাড়িতে ধরে নিয়ে মারপিট করছে। যদি পার একবার যাও। তোমার সাথে ওদের বন্ধুত্ব আছে বলে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসো।’ আমরা দরজা ভেঙে মালেককে কেড়ে নিয়ে আসি।’ ঘটনাটির বহ্নিময়তা এভাবে ছুঁয়েছে কবিকে,  ‘… খোকা। জানিয়ে দিলেন বাংলার নদীকে। হাওয়া ও পাখিদের কানে কানে। এসেছে মহান ত্রাণকর্তা এই জনপদে।’

‘নিবেদন’ অংশে কবি লিখেছেন এক জায়গায়, ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং কারাগারের রোজনামচা প্রকাশিত হওয়ার পর … দুটো বই ক্রয় করি। এই দুটোর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পড়তে গিয়ে আমার মনে হচ্ছিল, আমি একটি আলোর মহাসড়কে প্রবেশ করছি।’ এই সড়ক ধরে হাঁটার ফলশ্রুতিতেই রচিত হয়েছে আলোচ্য বইয়ের কবিতাগুলি। কবিতাগুলি কখনো আশ্বাসের বাণী বয়ে আনে, কখনো উদ্দীপ্ত করে আমাদের; প্রেরণার মুদ্রাঙ্কিত কোনোটি, আবার কখনো সন্ধ্যায় গাঢ় মøান আকাশের অরুণতুদ বার্তাবহ হয়ে ওঠে।

মুজিব বেদনার, আনন্দের, দ্রোহের, ভালোবাসার, সম্মোহনের। জীবিতকালের ক্রুশক্ষত মুজিব। ‘এক জাহাজে আমি এসেছি। আর এক জাহাজে ওরা ঢাকা গিয়েছে। দুই জাহাজের দেখাও হয়েছে একই নদীতে। শুধু দেখা হল না আমাদের।’ মুজিব জীবনের এমন ট্র্যাজেডি যা ধরা পড়েছে তাঁর মরমি ভাষায় রচিত আত্মজীবনীতে, তা কি রক্তাক্ত যিশুর যন্ত্রণারই সমরেখ নয়? ঘটনাটিকে বিষয় করে শাহেদ লেখেন, ‘হৃদয়ে জাগে সাহসের ঢেউ। নেমেছি দেশের কাজে, এটাই তো জীবনের ব্রত। কষ্ট, অত্যাচার সহ্য করতেই হবে’ (‘শুধু দেখা হলো না আমাদের’)।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নির্মলেন্দু গুণের একটি কবিতায় পাই, ‘সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপফুল খুব ভালোবাসি,/ রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ/ গতকাল আমাকে বলেছে/ আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।’ সহজ বাক্য, উপমা-উৎপ্রেক্ষা-রূপক-অনুপ্রাসের কারুকার্য দরকার পড়েনি, অথচ মন দ্রবীভূত হয়ে যায়। এমন  কাব্যসিদ্ধি ঈর্ষণীয় এবং এমন ঈর্ষণীয়তা শাহেদ ছুঁয়েছেন, ‘যখন যে-পথ দিয়ে যেতেন মুজিব গ্রাম থেকে গ্রামে/ সে-পথে,    দু-পাশে, হাটে-মাঠে মানুষেরা/ নাড়িয়ে নাড়িয়ে হাত/ বলতেন মায়াভরা স্বরে, ‘এসো, এসো, প্রিয় নেতা।’ ‘মায়াভরা স্বর’, এই সহজতার কৌলীন্যেই কবিতাটি (প্রতিষ্ঠা) উত্তরিত হয়েছে সামান্য থেকে বিশেষ, পদ্যবন্ধ থেকে যথার্থ কাব্যে। সংস্কৃত রসশাস্ত্রে বলা হয়েছে, ধ্বনি-ই কাব্যের আত্মা বা অন্তঃস্থিত সম্পদ, ‘ধ্বনিরাত্মা কাব্যস্য’। ধ্বনি কী? ওয়ার্ডসওয়ার্থ কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে যা বলেছেন, ধ্বনি-প্রসঙ্গে তা শিরোধার্য আমাদের, ‘The best word in its best form।’ শাহেদ রহমানের ‘মায়াভরা’ এমন-ই একটি অব্যয় ও অক্ষয় কারুকাজ কবিতাটির অবয়বে নন্দিত গর্জন হয়ে ফুটে আছে।

বইটির একটির পর একটি কবিতা পাঠ যেন হৃদয়ে হয়ে ওঠে পূর্ববঙ্গ থেকে বাংলাদেশ জন্ম নেওয়ার ইতিহাসপাঠের সমান্তরাল। বানভট্টের হর্ষচরিত বা এডমন্ড স্পেন্সারের The Faerie Queene-এর প্রকল্প যেন আধুনিক সময়ের এক যুগপুরুষকে কেন্দ্র করে পুনরাবর্তিত হয়েছে। তফাৎও আছে আবার : বানভট্ট তাঁর কাব্যে অতিরিক্ত প্রশস্তিকার, আর রানি প্রথম এলিজাবেথকে নিয়ে লেখা কাব্যটি স্পেন্সারের স্বপ্নবিলাস। অন্যদিকে শাহেদ রহমানের প্রতিটি কবিতা খুব ঘনিষ্ঠভাবে রক্তমাংসের মুজিবকে চিনিয়ে দেয়।

দীর্ঘ আট পৃষ্ঠার একটি রচনা রয়েছে মনস্বী লেখক, চিন্তাবিদ ও কবি মনিরুজ্জামানের, ‘ভূমিকার পরিবর্তে’। নিপুণ শল্যবিদের মতোই কাব্যটির বিশ্লেষণ পাই এখানে। বস্তুত এ-লেখা শাহেদ-নির্মিত কাব্যটির অনবদ্য পরিপূরক-পাঠ হিসেবে প্রশংসনীয়। শাহেদ রহমানের কবিপ্রতিভার পূর্বাপর আলোচনা পাই এ লেখাটিতে। এখানে যা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো, শাহেদ রহমান মূলত প্রেমের কবি। মনিরুজ্জামান লিখছেন, ‘প্রথম কাব্যে এবং পরেও তিনি সব সময়ই ছিলেন প্রেমের ও রোমান্টিক পথু।… আমরা এবার পেলাম নতুন শাহেদ রহমানকে … পূর্ব কাব্যধারার স্পর্শচ্যুত বাস্তবিক ভিন্ন এক কবিস্রষ্টা হয়ে উঠলেন তিনি।’

বর্ণে বর্ণে সত্য। শাহেদ রহমান তাঁর কবিতায় এ-কাব্যরচনার আগে যেসব চূর্ণ শব্দাবলি ব্যবহার করেছেন, সেগুলি হলো ‘স্নিগ্ধ উদ্যানের মত সিঁথি’, ‘মূর্তিসম পরমা’, ‘গন্ধস্নিগ্ধ সুখের জোয়ার’। আর এই কাব্যে এসে তিনি তাঁর মঙ্গাক্রান্তাকে নিয়ে গেছেন সামস্তেÍাত্রে।

একটু উদাহরণ দেওয়া যাক :

১. যাঁরা রাজনীতিবিদ তাঁরা নদীর মতন -/ … সমাজ, মানুষ আর দেশ ছাড়া/ কাটে না তাদের একটি মুহূর্ত। (‘তরুণ বয়সে তিনি পথের কাণ্ডারি’)

২. অভাবী মানুষ আর ছাত্রদের পাশে/ দাঁড়িয়ে বীরের মতো/ করতেন তিনি নানা উপকার -/ রৌদ্রদগ্ধ করোটিতে যেন বৃক্ষের শীতল ছায়া। (‘ভেঙে ফেলতেন বাধা’)

৩. মনে হত শুকনো চাঁদের বিল থেকে/ নির্মম বাতাস তাঁকে/ বলে যেত, ‘হতাশ হবে না বন্ধু,/ স্বাধীনতা আসবে নিশ্চিত।’ (‘হতাশ হবে না বন্ধু’)

৪. কী করে, কীভাবে মানুষেরা পরস্পরে/ জঙ্গলের পথ হয়ে যায়/ উলুধ্বনি আর আযানের বৈরীতায়/ যদিও উভয় ধর্ম আচারে ও কর্মকাণ্ডে/ দাবি করে/ মানুষের মঙ্গল সাধন তাদের মহান কাজ। (‘দাঙ্গায়ও তাঁর মানবিক হাত’)

৫. স্কুলের ছুটির ঘণ্টা, পিতলের থালা, বাসনকোসন বাজবে না/ সোনার বাংলায়; মেঘের প্রাসাদ ফেটে যাবে, সূর্যের কিরণ/ কুয়াশার আচ্ছাদনে নিশ্চিত থাকবে ঢাকা বহুদিন। (‘পনেরো আগস্ট : শেখ সায়েরা খাতুনের আর্তনাদ’)

৬. তিনি আমাদের প্রাণপ্লাবী কণ্ঠস্বর/ শতাব্দীর মেঘে-মেঘে জমে থাকা দুঃখের উদ্ধার? (‘স্মৃতি নত তুমি নিত্য দীপ্যমান)

উদাহরণ আরো বাড়ানো যায়। তাঁর রচিত ‘স্পন্দিত সৌভিক দুটি ঠোঁট’ অথবা ‘প্রেমহীন মানুষের দুর্গন্ধ নিঃশ্বাস জ্বালাময়। বিধ্বস্ত করছে নিত্য এ-পৃথিবী পাশব আক্রোশে’ থেকে মেজাজে ও গাম্ভীর্যে কী বিপুল ভিন্ন এসব কাব্যপঙ্ক্তি!

‘তাঁর মুখে আমরা শুনেছি বহুবার। সুন্দর ও আলোকের নান্দীপাঠ।’ বটেই তো। তাঁকে এজন্যই রাজনীতির কবি বলা হয়। তাঁকে নিয়ে লেখা কবিতাগুলির আলোচনা প্রসঙ্গে এ-তথ্যটিও জানা জরুরি আমাদের, বঙ্গবন্ধু কবিতা বড় ভালোবাসতেন। জনসভায়, কারাগারে তিনি একের পর এক কবিতা মুখস্থ বলে যেতেন। এখানে একটি সমাপতন লক্ষযোগ্য। নেলসন ম্যান্ডেলাও ছিলেন কবিতাপ্রেমী। দীর্ঘ ২৭ বছরের কারাবাসে তিনি যেসব কবিতাকে জীবনে ধ্রুবপদ করে নিয়েছিলেন, তার মধ্যে একটি হচ্ছে ভিক্টোরীয় যুগের কবি উইলিয়াম আর্নেস্ট হেনলি (William Earnest Henley)-রচিত ‘Invictus’ (ল্যাটিন এই শব্দটির অর্থ Unconquerable) – ‘It matters not how strait the gate,/ How charged with punishments the scroll,/ I am the master of my fate’ অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর গণভবন অফিসে টানিয়ে রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের একটি তাৎপর্যপূর্ণ কবিতা, ‘অবসান হল রাতি/নিবাইয়া ফেল কালিমা-মলিন/ ঘরের কোণের বাতি।/ নিখিলের কালো পূর্ব-আকাশে/ জ্বলিল পুণ্য-দিনে/ একপথে যারা চলিবে তাহারা/ সকলকে নিক চিনে।’

কবিতাগুলি পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, সেই বৈষ্ণব যুগ থেকেই তো বাংলাসাহিত্যে শ্রীচৈতন্যকে নিয়ে যে-কাব্য রচিত হয়েছিল, তার পরম্পরা কী আশ্চর্যজনকভাবে আজো বহমান। কোনো মহামানবকে একটি-দুটি কবিতায় ধরা নয়, সহাস্য ঝুলবে গলায়।

তাঁর গোটা জীবনকে নিয়ে চরিতকাব্য লেখার কথা বলছি, যা দেখা গেছে মধ্যযুগের কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ দিয়ে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এমন আছে, আছে শ্রীরামকৃষ্ণকে নিয়ে। হজরত মুহম্মদ (সা.)-কে নিয়ে আছে, যার একটি কাজী নজরুলের। শাহেদ রহমানও অনন্য এক্ষেত্রে।