জীবন ও স্মৃতির সারগাম

অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের ছন্দে বাঁধা মানবজীবন। জীবনের পরতে পরতে ঘটে যায় বহু ঘটনা, যার কিছু কিছু ভেসে বেড়ায় হাওয়ায়, আর কিছু থেকে যায় হৃদয়ে কিংবা দৃষ্টির অগোচরে। কবি পিয়াস মজিদের দীর্ঘ কবিতা ‘এইসব মকারি’ মূলত হৃদয়ের গহিনে থেকে যাওয়া প্রেম, দহন কিংবা স্মৃতির অনুরণন; অথবা বাস্তবতার ছকে আঁকা এক দুষ্প্রাপ্য চিত্রপট – যা আমাদের পরিচিত, তবু দীর্ঘকাল ধরে রয়ে গেছে আড়ালে। কবি তো তিনিই, যিনি মানুষের মনের অদৃশ্য অনুভব ও অনুভূতির কথা বলেন; যিনি এমন একটি করুণ সুর তোলেন তাঁর শব্দের এস্রাজে, যা পাঠককে করে তোলে বিমোহিত কিংবা আপ্লুত।

অনেকটা প্রেমকে উপহাস করেই এইসব মকারি কাব্যগ্রন্থের সূচনা। তারপর প্রেমের স্মৃতিকে বহন করে একটি বিচূর্ণ আত্মার ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে চলা। কখনো নিতান্তই ভেঙে পড়া আবার কখনো বিধ্বস্ত স্মৃতিকে বিদ্ধ করে দুর্বার হেঁটে চলা বাস্তবতার দিকে।

জগতের সকল প্রাণীর

প্রেম ব্যর্থ হোক

নিশ্চয়ই দীর্ঘজীবী হবে

রেভুল্যুশনারি স্পিরিট।

কবি এখানে প্রেমের ব্যর্থতাকে পরিহাস করে একটা বৈপ্লবিক ভাবনায় যেন এগিয়ে যেতে চাইছেন সম্মুখে। কিন্তু ‘পরিদের আবাসিক এলাকা অভিমুখী’ হয়ে তিনি লংমার্চ শুরু করেন। যেতে যেতে ব্যর্থ হওয়া প্রেমকেই হয়তো জিজ্ঞেস করেন –

দু’বছর আগে বালির বিচে গিয়ে

যে ট্যাটুটা এঁকেছি

তা দেখার জন্যে

তোমার চোখ এখনও কি

যথেষ্ট নগ্ন, হ্যাশট্যাগ?

এভাবেই কবি হাঁটতে থাকেন কল্পনা ও বাস্তবতাকে সঙ্গে নিয়ে। তিনি ‘হিমায়িত প্রেমের দামে’ কিনতে চান বিভার ব্রায়ে হেলে পড়া বিকেল। তাঁকে যেন ক্লিষ্ট করে রাখে একটা দীর্ঘ সফর, যেখানে তিনি প্রেম, হাহাকার কিংবা জীবনের মৃত্যু দেখতে পান।

মৃত্যুর মেহফিলে অভ্যাগতরা এসে গেছে

জিন্দেগি যদিও এক মওতের মহল্লা

প্রতিটি শ্বাসে তৈরি করে চলেছি

আমাদেরই কবর কাঠামো

‘পরিদের গোরস্তান’ পেরিয়ে জমে থাকা স্মৃতির পলি নিয়ে ক্লান্ত কবি কিছুক্ষণের জন্য তাঁর জানটা লুকিয়ে রাখেন ‘জেনেভা কনভেনশনের পরিশিষ্ট পাতায়।’ এখানে এসে আমরা দেখতে পাই, তিনি নৈশচিত্রশালায় দিনগত কান্না ভুলে ‘ডুগডুগি’ বাজাচ্ছেন। কারণ ‘জীবন যখন জখমি জলসা’ তখন এই ডুগডুগি বাজানো বা এর উন্মাদ খেলা দেখাই তো শ্রেষ্ঠ আরাধনা। তবে অতীত আর ভবিষ্যতের দোলাচালে ‘নিঃসঙ্গ ন্যাংটা বাস্তব’ মর্মন্তুদ কবিকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তখনো। তাঁর কাছে ধীরে ধীরে মনে হতে থাকে –

পপকর্ন খেতে খেতে

এক একজন পর্নস্টার সব্বাই।

মূলত এই পঙ্ক্তিটির মাধ্যমে কবি বোধের যথার্থতা যেন আমাদের সামনে তুলে ধরেন। মানুষ বাস্তবতার মেকআপ লাগিয়ে কল্পনায় হয়তো অনেকটা জঘন্য কিংবা কখনো কখনো নগণ্যই হয়ে ওঠেন। সম্ভবত তারই চিত্র আঁকতে চেয়েছেন কবি এই চরণ দুটিতে।

এবার কবি বিফল শরতের দিনে অমলিন স্মৃতির গায়ে হাত বুলাচ্ছেন। শৈশবে ফেলে আসা এক মরা বিকেল কবির ভেতরকে অবসন্ন করে দিচ্ছে যেন। ‘বনের বিভায় বসে বসে চৌচির’ কবি তাই স্বগতোক্তি করছেন –

সঙ্গমের সেঁদো গন্ধে পুরোটা না হারিয়ে তোমাকে

কিছু থাকুক উল্লাস

রক্তের তোড়ায় মোড়া তাজিয়া

হায় হাসান হায় হোসেন কারবালাকুসুম

যে পথে মৃত্যু লেখার টিপের দোকান

তাকে ভুলে গিয়ে

মিউট করা গুহার গহনা

তারপর কবিকে ‘স্নোফলের কাল’ রসাতলে ডাকলেও সন্ধ্যার সিঁড়িঘরে বসে তিনি গতকাল বিকেলে যে-বুড়ো বেলস পার্কে আত্মার আউটলাইন নিয়ে বসেছিলেন, তারই কথা ভাবেন। স্মৃতিকাতর কবির স্মৃতি যেন এই পর্যায়ে এসে ‘বুড়ো বেলস পার্কে’ নুয়ে পড়ছে বয়সের ভারে। অথচ তিনি কত বিপ্লবের ছাই পড়ে থাকতে দেখেছেন শংকর মাঠে।

দুই

কবিতার বইটি পড়তে পড়তে শুরুতে যদিও মনে হয় কবি গত হওয়া প্রেমকে উপহাস করছেন, একটা ‘ইয়ো, ইয়ো’ ফিলিংস নিয়ে কিছুটা ইগনোর করছেন তিনি স্মৃতিকে; কিন্তু শেষদিকে এসে দেখা যাচ্ছে তিনিই আবার প্রচণ্ড স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছেন, যা বাস্তবতারই রূপান্তর। তার ভেতর কীসের যেন একটা হাহাকার জেগে উঠছে। একটা প্রবল আকুতি ক্রমাগত প্রলুব্ধ করছে তাঁকে।

নক্ষত্রের কাফেলা হয়ে

পাতাল-আত্মার আকাশে

ঝিকমিক ঝিকমিক হ্যালোইন জ্বলে

স্তনের তটিনীতে

ঢেউ খেলে গতিহীন জীবনের হারানোর সুর

নিদ্রাফুল আবার জেগে ওঠো

সে সুবাসের তছনছে।

মানুষ এমন মোহের মেহমান

গাছেদের সবুজ হরফ

ঝরে পড়ার মহিমা বাড়ায়

ঝরে পড়ি

পৃথিবীর সময়শালায় ঝুলে থাকে প্রেমপঞ্জি

সেইসঙ্গে কবি এবার তাঁর প্রেমিকের কাছে কিছুটা অভিমান করেই যেন আবেদন করছেন, তাঁকে স্মৃতিদগ্ধ না করে একেবারে নিঃশেষ করে দেওয়ার, গিলে খাওয়ার। কারণ প্রেমের মৃত্যু, কান্না বা করতালি নিতে নিতে তিনি ক্লান্ত।

ধীরে ধীরে আমাকে গিলে খাও

মুহাব্বাত কি শায়েরিতে,

ঝরে পড়ার একটা সময়সৌন্দর্য আছে

তোমার মালঞ্চে

অযথা ফুটে না থেকে

পাল তোলা পাপের রূপচাপে

মৃত্যু নিতে নিতে

ছেঁকে তুলি ভুবনের ঘাটে নোঙর করা

কান্না ও করতালি।

তবু রিক্ত কবি চাইছেন পুনরায় প্রেমিকাকে আকৃষ্ট করতে। তাই বলছেন Ñ ‘তোমার শরীরের কলোনি/ আমার স্পর্শ পেলেই/ লৌকিক ভাঁজ খুলে/ ফলাবে শস্যদানা; রূপকথা।’ এবং একই সঙ্গে জীবনের কাছে প্রত্যাশা করছেন, তিনি যেন লিখতে পারেন ‘হ্যাপেনিং নাউ।’

কিছুক্ষণ পর হতাশ হয়ে কবি এবার নিজেকেই নিজে উপহাস করছেন। ভর্ৎসনা করে বলছেন, ‘নিজেই নিজের হার্ডলি সাকার।’ তার পরপরই ভালোবাসার বিপরীতে প্রত্যাশা করছেন তিনি যৌনতা। কারণ তিনি ভাবছেন হয়তো – ‘যৌন-বন্ধুত্বের মৌসুম শেষে/ একদিন ভালোবাসাও জন্ম নিতে পারে’।

প্রেমের উপহাস, স্মৃতিচারণ আর আকুতি শেষে এবার কবি সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন নিজের মনকে। ভার কমাতে চাইছেন যাতনার। হয়তো অশ্রুপাতেও হালকা হতে চাইছেন কিছুটা এবং অভিমানী হয়ে স্মৃতির মৃত্যুও যেন কামনা করছেন এবার তিনি।

ঝরো বকুল, ডালের ভার কমাও

মাইল মাইল বনের বাইনারি

কাট শট কাট

আমার রক্তের কাসকেট

নীলিমা নেকাব খুলে

বেশরম দ্যাখে

এত এত

প্রেতপবন পেয়ে

নিরালা বন্দিশ।

অথবা,

স্মৃতির অসুর এইবার বধ হবে

একমাত্র মায়াঘৃণাবতী রাতের রেণু জানে

আমার গঠন ও সংহারশৈলী।

সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিচ্ছেন – ‘স্তব্ধতার ভাষাভঙ্গি/ আয়ত্তে আমার।’ অর্থাৎ এবার তিনি মূলত নীরব থাকতে চাইছেন এবং হয়তো নিঃসঙ্গও। সে-কারণেই জানাচ্ছেন –

শীতের আগেই যেতে হয় শীতঘুমে

আর দেহের দেরাজ বেয়ে

মেঘফুল ঘনালে

দিগন্ত গলায় পড়ে নীল নেকলেস।

আমার চোখ থেকে যদিও মুছে যাবে

জীবন-যাপন চিত্রকলার

যাবতীয় কালার অব প্যারাডাইস।

তিন

কাব্যগ্রন্থটিতে এই যে স্মৃতির দহন, কখনো হাঁটু ভেঙে পড়ে যাওয়া জনশূন্য মরুতে, প্রেমিকার কাছে পুনরায় প্রেম আবেদন, আবার একটু উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা, ভাবলেশহীন চেয়ে থাকা – এসব কিছুই যেন মানবজীবনে ঘটে যাওয়া প্রতিটি মানুষের মনের বাস্তব প্রতিবেদন। যাপিত জীবনে মানুষ এভাবেই বয়ে বেড়ায় স্মৃতি, প্রেম, দহন এবং শক্তিকে। তাই বলা যায়, এইসব মকারি জীবনের মৃত্যু কিংবা ধূসর স্মৃতির প্রতিরূপ।

বইটি পাঠান্তে মনে হয়, কবি তাঁর দীর্ঘ কবিতার আড়ালে পাঠককে পরিভ্রমণ করিয়েছেন যাপিত ও প্রত্যক্ষ জীবনে। একই পটে তিনি এঁকেছেন বিমূর্ত স্মৃতি, উন্মত্ততা, পরিমিতিবোধ – যা মূলত সার্থক কবিতারই বৈভব। তাই পিয়াস মজিদের দীর্ঘ এই কবিতাবইটিকে পাঠক সংক্ষেপে বলতেই পারেন, জীবন ও স্মৃতির সারগাম।

দূর পরবাস থেকে

দেখে যেও এসে

নদীর প্ররোচনা পেয়ে

একদার ফুলচাষি মালির ভেতরে

এখন কত কত আর্ট অব ওয়ার চলে!

কবিতার অনন্য যেসব বৈশিষ্ট্য – শব্দের রূপবৈচিত্র্য ও ব্যবহারের সৌন্দর্য, তা এই কবিতায় দেদীপ্যমান হয়ে ধরা দেয়। আটপৌরে অথচ সুনিপুণ শব্দের ইন্দ্রজালে পাঠক ঘুরপাক খেতে বাধ্য। পাশাপাশি কিছুটা সংক্ষিপ্ত বাক্যে ভাবময় করে তোলা হয়েছে পঙ্ক্তিগুলিকে। তাই সহজেই পাঠকচিত্ত কল্পনায় মত্ত হয়ে ডুবে যায় কবিতায়।

আমাদের ঘিরে বয়ে চলা সময়

ঘড়ির ঘাম

টুপটাপ ঝরে পড়া একলা রাতের কেতন

চোখের ভেতর জলের বুনন।

শাড়ির শরীর থেকে

হিমাকে মুক্ত করে

সমকালীন জোচ্চর বাণীবিন্দুতে

ভরে তোলা গতর

এই অভিশপ্ত নগর।

এছাড়া কবিতার বড় যে আবেদন, একটা ইমেজ তৈরি করা অথবা একটা কল্পনার আভা ভাসিয়ে তোলা পাঠকহৃদয়ে, তার বাস্তবিক পরিস্ফুটন পাওয়া যায় বইটিতে।

ফুলের বাগানে সাপ দেখে

পুষ্পবিতান ছেড়ে

যখন ছুটছি অগ্নিস্তবকে।

দাউ দাউ কাঁপছি দাহের শিশিরে

প্রয়াত আমার নোনা নিশ্বাসে

পৃথিবীর মধুমেহ রোগ সেরে যাবে।

অথবা,

শহরে শীত ঢুকতে থাকলে যে বিধুর বৈভব

সন্ধ্যার উপকূলে বুনে যেতে থাকে

মৃত্যুর মিহি-হিম মসলিন,

তাকে সাক্ষী রেখে

টান দেই গালে, ওয়ান টাইম রেজারে।

চার

মানুষের ব্যর্থ স্বপ্ন বা ভগ্নহৃদয় নিয়ে বিচলিত হওয়ার যে কোনো কারণ নেই, কবি তাঁর ভাষায় সে-কথাও বলেছেন এইসব মকারিতে। বলেছেন, হতাশার চোরাবালিতে জখম নিয়ে পড়ে থাকতে পারেন আপনি, কিন্তু সমাজের যাবতীয় ডাকাতি চলেছে, চলছে, চলবেই। এবং ‘বেশরম চুম্বনের রেজিস্ট্রেশন শেষ করে/ পেশ হবে ছহি জঙ্গনামা।’

একজন কবি আর সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য হলো, কবি মূলত মানুষের মনের অব্যক্ত আর্তনাদ তাঁর কবিতায় ফুটিয়ে তোলেন গভীর অভিনিবেশে। কবি পিয়াস মজিদ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তারই সচিত্র প্রতিবেদন এঁকেছেন তাঁর এইসব মকারিতে। তাই বইটি পাঠশেষে পাঠক তাড়িত হবেন কবির অনুভূতির মতো একই অনুভবে।