গল্পের রূপবৈচিত্র্য

(গত সংখ্যার পর)

তিন

আমাদের হবু গল্পকারের নাম সদরুদ্দীন খান পাঠান। চাকরিজীবনে তাঁর গোঁফ-দাড়ি ছিল না। সরকারি চাকরি করার সময় প্রতিদিন ক্লিন-শেভড হয়ে অফিসের গাড়িতে বসতেন। কোনো কারণে ছুটির দিনে একদিন শেভ করতে না পারলে উসখুস করতো মন। অবসরগ্রহণের পর এখনো সেই অভ্যেসটা রয়ে গেছে।

একসময় লোকজনকে দাবড়ে বেড়াতে ভালোবাসতেন। সাংসারিক যত সিদ্ধান্ত সব তিনি একাই নিতেন। কেউ এর বাইরে কথা বলতে চাইলেই ধমকে দিতেন, ‘কী বোঝ তুমি, এ্যা!’ একটাই মেয়ে; ব্যারিস্টারি পড়াতে ইংল্যান্ড পাঠালেন। ভেবেছিলেন মেয়েটি দেশে ফিরে ব্যারিস্টারির দফারফা করে ছাড়বে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, মেয়েটি পড়াশোনা বাদ দিয়ে এক নাইজেরিয়ান নিগ্রোকে বিয়ে করে লন্ডনের শহরতলিতে বসবাস করতে শুরু করে। রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে, অভিমানে মেয়ের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করলেন তিনি। এখন বন্ধুবান্ধবের সফল-সার্থক কন্যার কথা কানে গেলেই হয়তো ক্ষেপে যান, নয়তো কান্না মেশানো দীর্ঘশ্বাসে ব্যাকুল হন বারবার।

সেই মানুষটি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর একদম একা হয়ে পড়লেন। স্ত্রী রোখসানা বেগমও মেয়ের সঙ্গে লন্ডনে থাকতে শুরু করেছেন। শুধু তিনি একঘরে হয়ে রইলেন।

লন্ডনে তিনি যে যাননি, তা নয়। স্ত্রীর প্ররোচনায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে কদিন থেকেছেনও। একে তো মেয়ে-মেয়েজামাইয়ের সঙ্গে রোখসানার মতো তাঁর মতের মিল হচ্ছে না। তার ওপর এই কবছরে একনাগাড়ে বিদেশে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন।

 নিজের পরিচয়হীনতা এমনভাবে তাঁকে বিদ্ধ করতে থাকে যে তিনি ছুটে এলেন দেশের মাটিতে। এমন ক্ষমতাশালী ব্যুরোক্র্যাট, অথচ কেউ তাঁকে জানবে না, তা কী করে সম্ভব?

এই ভাবনা থেকেই তিনি দেশে ফিরে একাকী জীবন কাটাতে শুরু করেন এবং একসময় লেখালেখির প্রতি মনোযোগী হয়ে ওঠেন। কিছু একটা লিখতে চান, নিজের সম্পর্কে বলতে চান শেষবেলায় দাঁড়িয়ে। এই বলার আকুতিটাই হাত ধরে এ-গল্পনদীর তীরে দাঁড় করিয়ে দিলো তাঁকে। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, মন্ত্রণালয় চালানোর মতো নিশ্চয়ই সহজতর কাজ হবে গল্প-রচনা। নিজে সাহিত্যের ছাত্র হয়েও শিপিং-মিনিস্ট্রি চালাতে তাঁর কি কোনো অসুবিধা হয়েছে? বরং তিনি যেসব প্রকল্প চালু করে এসেছিলেন, সেগুলিই তো এখন জনপ্রিয়। সেখানে পা রাখলে এখনো পুরনো কেউ বিনয় বিগলিত স্বরে মুখ ভার করে বলে ওঠে, ‘সেই দিন আর ফিরে আসবে না স্যার।’ শুনে বুকটা ভরে ওঠে গর্বে। মনে মনে সন্দেহ জাগে, তবু ভেতরে পুলক বোধ করেন খুব। সেভাবেই গল্পের নদীটাকে শাসন করে ঘরে তুলতে চেয়েছেন রাশি রাশি সাফল্য। কিন্তু এ তো পাহাড়ি নদীর চেয়েও ভয়ংকর, নিজেকে ভাসিয়ে রাখা রীতিমতো দুঃসাধ্য এক কাজ। এ যেন বাষ্পের ভেতর হাত ঢুকিয়ে জলপান করার মতো কঠিন এক অবস্থা। তৃষ্ণা তো মেটেই না, হাতটা পর্যন্ত ভিজতে চায় না!

তিনি শুরুর দিকে ভেবেছিলেন সাহিত্যের নানা দিকের ভেতর সম্ভবত গল্প বলাটাই সবচাইতে সহজতর কাজ। এটি শেখার জন্য কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণের দরকার পড়ে না। কবিতা লিখতে হলে ছন্দ জানতে হয়, প্রবন্ধ লিখতে হলে প্রচুর পড়াশোনার দরকার হয়। নাটক রচনা করতে গেলেও মঞ্চ সম্পর্কে হাতে-কলমে ধারণা অর্জন করতে হয়। শুধু গল্প বলার সময় তেমন কোনো টুলের ওপর চেপে বসতে হয় না!

অন্তরে গল্প জমা হয়েছে, ঝেড়ে দিন এক-একটি গল্প। হুমায়ূন আহমেদের গল্প পড়লে তো সেরকমই মনে হয়। এতো সহজ গল্প রচনা? হিন্দি ছোটগল্পকার কৃষণচন্দরের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর ব্যঙ্গাত্মক গল্প ‘জামগাছ’, মুন্সী প্রেমচাঁদের গ্রামীণ সামন্ততান্ত্রিক সমাজে বসবাসকারী দলিত মানুষের অর্থনৈতিক নিষ্পেষণের গল্প ‘কাফন’, উর্দু লেখক সাদাত হাসান মান্টোর সাতচল্লিশের দেশভাগের ওপর করুণ গল্প ‘তোবা টেক সিং’, অসমিয়া লেখক লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়ার স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের টানাপড়েনের ওপর গল্প ‘ভাদারি’, উড়িয়া লেখক ফকির মোহন সেনাপতির নারীশিক্ষা বিষয়ে সামাজিক ও মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির বৈপরীত্যের ওপর ভিত্তি করে লেখা গল্প ‘রেবতী’, মৈথিলী লেখক ললিতের ‘রামজানি’, মনিপুরী লেখক কুঞ্জমোহন সিংয়ের ‘হিলসার স্বাদ’, পাঞ্জাবি গল্পকার কার্তার সিং দু¹ালের দেশভাগের ওপর গল্প ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ প্রভৃতি গল্প তিনি পাঠ করেছেন নানা সময়ে। খুব কি কঠিন লেগেছে গল্পগুলি? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন তিনি।

যেহেতু হবু গল্পকার একজন লেখাপড়া-জানা মানুষ সেহেতু তিনি বাংলা সাহিত্যের ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ ছোটগল্পকার রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি ঊনবিংশ শতকের শেষে এবং বিংশ শতকের গোড়ার দিকে যাঁরা এই উপমহাদেশে ছোটগল্প রচনায় অবদান রেখেছেন তাঁদের পাঠ করার চেষ্টা করেছেন। এই গল্পগুলির রচনাকাল ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের ঠিক মোচড়ের কাছাকাছি সময়ে রচিত। তাই দেশ-ভাগ, নারী-শিক্ষা, সামজিক কুসংস্কার, গ্রামীণ পরিকাঠামোর ভগ্নদশা, নর-নারীর বৈধ-অবৈধ সম্পর্ক ও নানাবিধ বঞ্চনা নিয়ে গড়ে উঠেছে এই গল্পবলয়। এ-ধরনের সনাতনী অথচ চিরনতুন গল্পধারার বেশিরভাগ কাঠামো হলো ঘটনাকেন্দ্রিক। ‘ভাদারি’ গল্পটিতে দেখা যায় স্বামী শিশুরাম রাগের বশে স্ত্রীকে মারধর করায় স্বামী শিশুরামকে জেলে যেতে হয়। কিন্তু স্ত্রী ভাদারি এক পর্যায়ে স্বামীর ওপর উত্থাপিত তার সমস্ত অভিযোগ থেকে দায়মুক্তির অনুরোধ জানান ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। অপরদিকে শিশুরাম তার বিরুদ্ধে আনীত সমস্ত অভিযোগ স্বীকার করে নিয়ে জেল খাটে। কার্তার সিং দু¹ালের গল্প ‘ট্যাক্সি-ড্রাইভারে’র কথাই ধরা যাক। দিট্টু দেশভাগের শিকার এক ট্যাক্সিওলা, যে তার নিজের ট্যাক্সিতে একদিন প্যাসেঞ্জারের ফেলে যাওয়া একটি মাানিব্যাগ কুড়িয়ে পায়। টাকাভর্তি মানিব্যাগটি সে বাসায় নিয়ে আসে এবং স্থির করে যে, সেটি প্যাসেঞ্জারের ঠিকানায় ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু স্ত্রী বান্টি তাতে রাজি নয়। সে চায় সেটি রেখে দিতে। এরকম কঠিন বাস্তবতা ও আদর্শবাদের মুখোমুখি সংঘর্ষ নিয়ে এ-গল্প। সাদাত হাসান মান্টোর ‘টোবা টেক সিং’ গল্পটি রীতিমতো মর্মপীড়াদায়ক এবং দেশভাগের করুণ ইতিহাসের ওপর রচিত। গল্পটি শুরু হয়েছে এভাবে : ‘দেশভাগের কয়েক বছর পর হঠাৎ করেই পাকিস্তান ও হিন্দুস্তানের সরকারি লোকজনের মনে হলো সাধারণ কয়েদিদের মতো দুই দেশের ভেতর পাগল-বিনিময় হওয়া দরকার।’ মান্টো এ-গল্পে রূপকার্থে পাগলখানার যে-বর্ণনা দিয়েছেন তা সত্যিকার অর্থে উপমহাদেশের ফোকলা রাজনীতির অন্তঃসারশূন্য চিত্রটি মূর্ত করে তুলেছে। ইসমত চুঘতাইয়ের ‘কুইল্ট’ গল্পটি সেই সময় নারীর সঙ্গে নারীর যৌন সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে রচিত, যার বিরুদ্ধে ব্রিটিশরাজ অশ্লীলতার অভিযোগ দায়ের করেন আদালতে এবং চুঘতাই সেই মামলায় জয়ী হন শেষ পর্যন্ত।

গল্পগুলি পাঠ করার সময় পাঠান সাহেবের বেশ ভালোই লাগে। কখনো মন খারাপ হয়, কখনো মাথার ভেতর চোরাগোপ্তা চিন্তার স্রোত বয়ে চলে। কখনো নির্মল হাসিতে মন ভরে ওঠে।

এই যে গল্পবৈচিত্র্য তা কি করে নিজের ভেতর তৈরি করা সম্ভব তা নিয়ে তিনি এখন চিন্তিত। শুরুতে ভেবেছিলেন গল্প লেখাটা সবচাইতে সহজ এক কাজ। কিন্তু লেখার সময় মনে হচ্ছে যা তিনি চাইছেন, যতোটুকু চাইছেন এবং যেভাবে চাইছেন, তা গল্পে আসছে না। সুস্মিতার করুণ কাহিনি বয়ানের ভেতর দিয়ে তিনি এ-সমাজে নারীর অবস্থান ব্যাখ্যা করতে চাইছেন। যেমনটি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘গয়নার বাক্স’ গল্প পাঠ করে তাঁর মনে হয়েছিল। একজন ভূতিনী কীভাবে একজন অবলা নারীকে সম্পদশালী ও সবলা হিসেবে গড়ে তুলে স্বামীসহ সবার কাছে সামাজিক মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে দেন, সেসবের মজাদার আখ্যান। গল্প বলার ছলে বায়োস্কোপের ছবির মতো লাগাতার সমাজচিত্র দেখিয়ে চলেছেন লেখক, সেগুলি যেমনি সুখপাঠ্য তেমনি চিন্তাবর্ধক। সুস্মিতার গল্পটি বলতে গিয়ে কি তিনি সেরকম কোনো আধিভৌতিক চরিত্রের আশ্রয় নেবেন? যেমনটি ফ্রানজ কাফ্কার ‘মেটামরফোসিসে’ রয়েছে, গ্রেগর সামসা নামে এক ট্রাভেলিং সেলসম্যানের মনে হলো, সে ধীরে ধীরে এক গুবরে পোকায় পরিণত হচ্ছে। আচরণ বদলাচ্ছে, গলার কণ্ঠস্বর কেউ বুঝতে পারছে না। অথচ জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ ঠিকই এগোচ্ছে কিংবা হোঁচট খেতে হচ্ছে বারবার। এই যে আধুনিক জীবনের জটিলতা তা কি সুস্মিতাকে ঘিরে ঘটতে পারে না?

পাঠান নিজেকে প্রশ্ন করেন, তাহলে গল্পটি কীভাবে এগোবে? তিনি পুনরায় লিখলেন এভাবে –

সুস্মিতা আজ চলে গেলো। ও যতোক্ষণ এখানে ছিল ততোক্ষণ একটা পাখির অস্তিত্ব সদরুদ্দিন টের পেতে থাকে। সেই পাখিটার গা থেকে একটি পালক উড়তে উড়তে পাতা বাহারের ঝোপে গিয়ে আটকে রইলো। লাওয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের এক বনমোরগ যেন খুব কাছ থেকে ডেকে উঠলো এ সময়। পাহাড়ি ঢালে অজস্র লেবু বাগানের ভেতর দিয়ে চোখ পড়ল হাকালুকি হাওড়ের টলটলে জল। একঝাঁক বক সেখান থেকে উঠে এসে দুম করে ওর বুকের তলায় সেঁধিয়ে গেল। ওরা দলবেঁধে ওর সঙ্গে হাঁটছে আর সুস্মিতার কথা জানতে চাইছে। সে কিভাবে সুস্মিতাকে চেনে? কতদিনের পরিচয়? খুব চেনা প্রশ্ন, তবু সদরুদ্দিনের বুকের অনন্ত জুড়ে ধোঁয়াশা; সব অস্পষ্ট, শুধু চোখের সামনে সাদা মেঘে ঢাকা একটা পাহাড়-চূড়া। গহিন তার বনভূমি আর নিরাকার এর ব্যাপ্তি।

সহসা একটি বক গলা ছেড়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘এ্যাইডা তুমার বউ, না প্রিয়া?’

এ পর্যন্ত লিখে পাঠান ভাবলেন, গল্পটির ফর্মের কথা। গল্পের কি বিশেষ কোনো ফর্ম রয়েছে? কেউ যদি সোফোক্লিসের গ্রিক নাটক ইডিপাস পাঠ করেন এবং পরবর্তীকালে সিগমন্ড ফ্রয়েডের ইডিপাস কমপ্লেক্স (Oedipus Complex) থিওরি বা দর্শন দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি আধুনিক গল্প লিখতে চান এ-সময়ে, তবে সেটি কতটুকু যুক্তিযুক্ত হবে? যেখানে ডি এইচ লরেন্সের মতো ডাকসাইটে লেখক এই তত্ত্বের ওপর গভীরভাবে কাজ করেছেন, সেখানে হবু লেখক নতুন কোনো বাঁকের সন্ধান করে কতটুকু সফল হবেন তা নিয়ে রীতিমতো সন্দেহ থেকে যায়।

সাহিত্যে বেঁচে থাকার একটাই উপায়। আর তা হলো, নতুন কিছু খুঁজে বের করা। সেটি যেমন কোনো নতুন তত্ত্বজ্ঞান উপস্থাপনের বেলায় প্রযোজ্য, তেমনি বৈচিত্র্যময় কাহিনি-বিন্যাস, অপরিচিত চরিত্র, বাক্যগঠন ও শব্দ বুননটিও বাদ থাকে না। গল্পের কোনো বাধা-ধরা নিয়মবিধি নেই। যে যখন খুশি, যেভাবে ইচ্ছে হয় একে নতুন রূপ প্রদান করার অধিকার রাখেন। তবে নান্দনিকতাবোধ ও এর ব্যবহারের একটি মাত্রা রয়েছে যা লঙ্ঘিত হলে পাঠকের শিরঃপীড়ার কারণ হতে পারে। এ- ব্যাপারে কিঞ্চিৎ সচেতন থাকা বাঞ্ছনীয়।

সদরুদ্দিনের মাথায় রয়েছে নানারকম গল্পের উদাহরণ। বাস্তব-অবাস্তবের সঙ্গমে যেমন গল্প রয়েছে তেমনি রয়েছে সরল-সাধারণ গল্পের প্রকরণ, যা একইভাবে তার মনে দাগ কেটে যায়। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের গল্প বলার সোজাসাপ্টা স্টাইল তাঁকে বেশ ভাবায়। ওই যে ‘Cat in the Rain’ গল্পটির কথাই ধরা যাক। কোনো এক আমেরিকান দম্পতি ইতালিতে বেড়াতে এসে হোটেলে উঠেছেন। বাইরে চলছে তুমুল বৃষ্টি। আনমনা স্ত্রী তাকিয়ে রয়েছেন বাইরে, বৃষ্টির ঘোর অন্তরে। সহসা মহিলা একটি অসহায় বিড়ালকে দেখলেন বৃষ্টিতে ভিজতে। তার খুব শখ হলো বিড়ালটিকে তিনি হোটেল-কক্ষে নিয়ে আসবেন, বৃষ্টির উৎপাত থেকে নিরীহ প্রাণীকে তিনি বাঁচাবেন। কিন্তু বাস্তবে হোটেলের নিচে নেমে তিনি আর বিড়ালটি খুঁজে পাননি। লেখক হেমিংওয়ে যা বলেন তা সরাসরি ও সুস্পষ্ট করে বলেন। তাঁর গল্পের সংলাপ, বর্ণনা একেবারেই সাদামাটা – কোনো অন্তর্নিহিত অর্থ খুঁজে ফেরার প্রয়োজন নেই পাঠকের। তবু এ-গল্পটিকে বলা হয়ে থাকে হেমিংওয়ের প্রতীকী গল্পের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। বিবিধ ব্যাখ্যা রয়েছে গল্পটির। কেউ বলছেন, গল্পের মহিলাটি নিঃসঙ্গতার প্রতীক, বিষণ্ন এ-রমণীর নিকট বিড়ালটি আকাক্সক্ষা বই অন্য কিছু নয়। কারো মতে, মহিলা অন্তঃসত্ত্বা হতে চাইছেন, বুকে জড়িয়ে আদরে-আদরে ভরিয়ে দিতে চাইছেন আপনজনকে, বিড়ালটি সেদিকেই ইঙ্গিত করছে, বৃষ্টি হলো উর্বরতা। আবার কেউ বলছেন, পোয়াতি মহিলার ভেতরে বয়ে চলা ইচ্ছেগুলোর বাস্তবতাই হলো গল্পের মূল প্রতিভাস। গল্পটি সদরুদ্দিনের ভালো লাগলো এজন্য যে, একটানে এটি পাঠ করা যায় এবং পাঠশেষে একধরনের আচ্ছন্নতা তৈরি হয় ভেতরে। এ-বোধ বিষণ্নতার কি না তা তাঁর জানা নেই। তবে ভালো গল্পমাত্রই পাঠশেষে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুরণন রেখে যায় পাঠকের অন্তরে। একটি আধুনিক শক্তিশালী গল্প শেষ করার পর শুধু একটি ভাবনা নয়, অনেক ভাবনার মুখ খুলে যায় একসঙ্গে। পাঠকের বোধ-বুদ্ধি সব দখল করে নেয় গল্প। পাঠকের সক্ষমতা খুঁড়ে-খুঁড়ে গল্পের গহিন-অর্থ উদ্ধারে সাহায্য করে এখানে। আগেকার মতো একটিমাত্র অর্থ সম্বল করা গল্প চূড়ান্ত আধুনিকতার বিচারে ভালো গল্পের উদাহরণ নয়। আজকাল মানুষের জীবনে জটিলতার পাঁচ-মুখ, ভালোবাসার পাঁচ-পা। গল্পের বহিরঙ্গ যতোই সহজ-সরল হোক, এর অন্তর্নিহিত অর্থ হবে মাকড়সার জালের মতো জটিল ও গভীর। সহজ করে নিলে সহজ, প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো বোদ্ধা পাঠকের হাতে পড়লে হীরক-খণ্ড। এভাবেই একজন যথার্থ আধুনিক লেখক ইশারা, প্রতীক, সংকেত, সংলাপ, সুচারু ঘটনা আর অর্থবহ চরিত্রের বিন্যাস ও বিক্রিয়া ঘটিয়ে এক-একটি মূল্যবান গল্প তুলে দেন পাঠকের হাতে। সদরুদ্দিনের কাছে এটাই উত্তীর্ণ গল্পের সর্বোচ্চ যথার্থ রাস্তা। তিনি যদি পারতেন এরকম একটা গল্প লিখতে? প্রশ্নটা মনের ভেতর চেপে রাখেন তিনি।

আরো একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন খুব স্বাভাবিক কারণেই সদরুদ্দিনকে খামচে চলে আর তা হলো, যে-লেখকের এক-একটি আধুনিক গল্প পাঠ করে তিনি এমন পুলক বোধ করেন, জগৎ-সংসার নিয়ে এতোসব ভাবনাচিন্তা জাগে মনে, তাঁর স্বরূপটি কেমন হবে এ-সমাজে? চুপিচুপি তিনি কি অনাধুনিক একজন মানুষ হলেও চলবে? গল্পকার ফিক করে হেসে ফেললেন নিজের এ-প্রশ্নে। পরক্ষণে নিজেই উত্তর দিলেন, একটা হাজামজা পুকুরের মতো যদি পাঠহীন ভাবনাহীন জিজ্ঞাসাহীন অন্তর হয় লেখকের তো সেখানে কি স্রোতের তীব্রতা আশা করা যায়? যেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে লেখকের ভাবনা ও ব্যাখ্যা জন্মায়, যেখানে লেখক একজন আধুনিক মানুষের আদর্শ রূপরেখা তৈরি করেন, সেখানে কি বিজ্ঞান থাকবে না? সেখানে কি দ্রোহবোধ বিস্তৃত হবে না? শুধু নান্দনিক বোধ আর প্রকৃতি-সংগীত দিয়ে কি শরৎচন্দ্রের ইন্দ্রনাথের মুখ থেকে বের করা যাবে, মড়ার আবার জাত কী?

পাঠান সাহেবের কাছে বাংলাদেশের গল্প-ছবিটাও খুব একটা অস্পষ্ট নয়। তাঁর প্রিয় গল্পকার সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। এককালে একটি তুলসী গাছের কাহিনি পাঠ করে তিনি বড় তৃপ্তি বোধ করেছিলেন। গল্পটি শুরু হয়েছে ‘ধনুকের মত বাঁকা কংক্রিটের পুলটির পরেই বাড়িটা।’ দিয়ে আর শেষ হয়েছে এভাবে, ‘উঠানের শেষে তুলসী গাছটা আবার শুকিয়ে উঠেছে। তার পাতায় খয়েরী রঙ। সেদিন পুলিশ আসার পর থেকে কেউ আর গোড়ায় পানি দেয়নি। সেদিন থেকে গৃহকর্ত্রীর ছলছল চোখের কথাও আর কারো মনে পড়েনি। কেন পড়েনি সে-কথা তুলসী গাছের জানবার কথা নয়, মানুষেরই জানবার কথা।’ দেশভাগের ওপর এমন বাস্তব ও দরদি গল্প কম চোখে পড়ে। গল্পটির ভাষা, পরিমিতিবোধ ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি আজকের অনেক গল্পকারের পাথেয় হওয়া উচিত। একটি ঘটনাকে একজন গল্পকার কী দৃষ্টিভঙ্গির বাহনে চড়ে প্রকাশ করেন, সম্ভবত লালিত্যের এই মাত্রাবোধকেই নান্দনিকতা বলে সাহিত্যে। হাসান আজিজুল হকের ‘পরবাসী’ গল্পটি বাদ যাবে কেন? রায়টের ভেতর যে-লোকটি কলকাতা থেকে আপনজন হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পাকিস্তানে আশ্রয়ের খোঁজে ঝোপেঝাড়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে, সেই লোকটি চোখের সামনে ধুতি-চাদর পরিহিত পূর্ব পাকিস্তানের একজন হিন্দুকে দেখতে পেয়ে হাতের কুড়ালটা নিমেষে মাথা বরাবর বসিয়ে দিলো। ধর্মীয় রাজনীতি শুধু বিভাজনই নয়, মানুষের স্বাভাবিক মূল্যবোধকেও খেয়ে ফেলে এ-লেখক নন, নির্মম বাস্তবতাই লেখককে গল্প লিখতে বাধ্য করে। আবার সৈয়দ শামসুল হকের ‘আনন্দের মৃত্যু’ অন্যরকম মাত্রা তুলে ধরে মানবচরিত্রের। এটি পানশালার গল্প। ঘটনা পুরোটাই স্পষ্ট; তেরো বছরের পুরনো বন্ধু ওরা অথচ ‘জীবনে স্ফূর্তি নাই’ বিশ^াস ছাড়া আর কোথাও তাদের মতের মিল হয় না, সদ্য লাইসেন্স পেয়েছে পাকিস্তানে পান জোগানের, সেই আনন্দে গদগদ বন্ধুরা সন্ধ্যায় এসে মিলিত হয় পানশালায়। এখানেই অদ্ভুত এক লোককে ওরা দেখতে পায়। পাশের টেবিলে এসে একাকী বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একা-একা বিয়ার পান করে, সিগারেট ধরায় এবং একসময় উঠে চলে যায়। লোকটা ওঠার সময় ‘একটা টাল খেতে খেতে নিজেকে সামলে নিয়ে সরলরেখায় হেঁটে চলে যাবে।’ এ-দৃশ্যটা বন্ধুরা খুব উপভোগ করে। প্রতিদিন ওরা অপেক্ষা করে, লোকটি কখন টেবিল ছেড়ে উঠবে এবং টাল খেতে খেতে সরলরেখায় হেঁটে চলে যাবে বাইরে। হঠাৎ একদিন ওদের হতবাক করে দিয়ে ‘অ্যাম্বোলেন্স আসে। লোকটা স্ট্রেচারে করে লাশকাটা ঘরে যায়’। শেষ পর্যন্ত একটি রহস্যময় আবহ থেকে যায় পাঠকের মন জুড়ে, ‘কিছুই কিছু না, আর সেই যে কিছু না তাও কিছু না।’ মজার ব্যাপার হলো, চরিত্রগুলি স্পষ্ট হলেও কারো কোনো নামধাম নেই। অথচ গল্পের ঝটকা ঠিকই পাঠকের মনে লাগে।

শুধু এরকম একটি গল্প নয়। সদরুদ্দিন সাহেব শওকত ওসমানের ‘আখেরী সংক্রান্ত’, আবু ইসহাকের ‘বনমানুষ’, হাসান হাফিজুর রহমানের ‘আরো দুটি মৃত্যু’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘ছুরি’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘মিলির হাতে স্টেনগান’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘আনন্দের মৃত্যু’, হাসান আজিজুল হকের ‘মা-মেয়ের সংসার’, সেলিনা হোসেনের ‘আমিনা ও মদিনার গল্প’, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ‘যে তোমায় ছাড়ে’, রাহাত খানের ‘রক্তপাত’ প্রভৃতি গল্পও পাঠ করেছেন।

প্রতিটি গল্প পাঠ করার পর যেমন তাঁর ভেতর এক নবতর চৈতন্যের উদয় হয়, তেমনি নিজের গল্পের ভেতরও তিনি সেই উৎকর্ষ আনতে চাইছেন। গল্পের পরিকাঠামো যেমন আধুনিক হবে, তেমনি এর পাঠযোগ্যতাকেও ধ্বংস করা যাবে না। উত্তরাধুনিকতার সকল বৈশিষ্ট্য দিয়ে সাজানো একটি গল্প অথচ কোথাও কোনোরূপ কষ্টকল্পনার ছাপ থাকবে না। পাঠক গল্পটি পাঠ করতে গিয়ে মোহগ্রস্ত হবেন, এক ধরনের মোহের ভেতর প্রবেশ করবেন। কিন্তু দিকভ্রষ্ট হয়ে এলোমেলো ঘোরাঘুরি করবেন না। শিক্ষিত পাঠক যেন কোনোভাবেই না ভাবেন যে, গল্পটি তাঁর আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। একজন কমলকুমার মজুমদারকে অনুসরণ করতে গিয়ে যেন নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে না যায়। সংগীতে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের ফিউশন করে তৃতীয় মাত্রা বের করা যেমন অতি দুর্লভ একটি কাজ, তেমনি পুরনো গল্পের সঙ্গে এখনকার গল্প মিশিয়ে নতুন কোনো ধারাকে আহ্বান করা মোটেই সহজ কাজ নয়। প্রতিদিন যেখানে গল্পের সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে, সেখানে নিজেকে দাঁড় করানো শুধু ভাবনার কাজ নয়, প্রতিভারও প্রয়োজন।

সদরুদ্দিন গল্পের শুরুর মতো সমাপ্তি নিয়েও রয়েছেন এক ধরনের সন্দেহের দোলাচলে। ও’হেনরির বহুপঠিত ‘The Cop and the Anthem’ গল্পের কথা মনে পড়ে যায়। আমেরিকাবাসী একজন গৃহহীনের গল্প। সোপি নাম তার। গ্রীষ্মে সে পার্কে পড়ে থাকে। কিন্তু শীতকাল আসতে শুরু হলে সে পড়ে যায় মুশকিলে। তখন তার থাকার জায়গা থাকে না। সব বরফে ঢাকা পড়ে থাকে। বেচারা তখন অপরাধের ভান করে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেলে কাটিয়ে দেয় পুরো শীতকালটা। এবারো সে একই কর্মে লিপ্ত। শীত আসি-আসছি করছে নিউইয়র্ক শহরে। তাই সোপি পুলিশের হাতে ধরা পড়তে দিনভর নানা পাগলামো করে বেড়িয়েছে। রাস্তার মাঝপথে পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে নর্তনকুর্দন করেছে, ঢিল ছুড়ে এটা ভেঙেছে, ওটা অমান্য করেছে। কিন্তু কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাকে ধরতে এলো না। সারাদিন পর সে নিরাশ হয়ে সন্ধ্যায় একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসল। পাশেই গির্জা। সেখান থেকে ছোটবেলায় শোনা ওর প্রিয় একটি ধর্মীয় সংগীত ভেসে এলো ওর কানে। মনটা পবিত্র আবেগে আর্দ্র হয়ে উঠল। শৈশবের অমলিন নিষ্কলুষ স্মৃতিগুলি শান্ত স্থির করে দিলো ওর অন্তরকে। সে গির্জা থেকে ভেসে আসা পরিচিত গানটা গুনগুন করতে থাকে। সে এ-সময় ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি পরিকল্পনা কষে ফেলে – আগামীকাল থেকেই সে একটি চাকরি খুঁজতে শুরু করবে এবং আর কখনো সে আইন নিজের হাতে তুলে নেবে না। আর ঠিক সে-সময় পুলিশ এসে ওকে ধরে নিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দিলো। গল্পের পরিসমাপ্তি এখানেই। জিম আর ডেলা দম্পতির পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, ত্যাগ প্রভৃতি সেন্টিমেন্ট নিয়ে একই ঘরানার অসাধারণ ছোটগল্প ‘The Gift of the Magi’। দুটি গল্পের সমাপ্তিতে দুটো মোচড় বা মাত্রা রয়েছে। প্রথম গল্পে লেখক মানবচরিত্রের নেতিবাচক আবেগের ইতিবাচক রূপান্তর তুলে ধরেছেন এবং একই সঙ্গে সমাজের নিরেট বাস্তবতাকেও আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন। দ্বিতীয় গল্পটিতে ক্রিসমাসের শাশ^ত ত্যাগের রূপ উঠে এসেছে পরম মমতায়।

গল্পকার শুধু মনেরই খবর নেন না। মনের সঙ্গে তিনি সমাজ ও সময়কেও ধারণ করে রাখেন। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত গল্পকার সুবোধ ঘোষের ‘অযান্ত্রিক’-এর উদাহরণ টানা যায়। শুরুতে পুরো সারাংশটুকুই লেখক তুলে ধরছেন একটিমাত্র বাক্যে ‘বিমলের একগুঁয়েমি যেমন অব্যয়, তেমনি অক্ষয় তার ওই ট্যাক্সিটার পরমায়ু।’ জড়-জীবের সখ্য নিয়ে ছোটগল্প। লেখক চমকে দিয়েছিলেন তখনকার পাঠককুলকে। ‘এই কম্পিটিশনের বাজারে এই বুড়ো জগদ্দলই তো দিন গেলে নিদেন দুটি টাকা তার হাতে তুলে দিচ্ছে’, অথচ গল্পের শেষে যখন ঠং-ঠং ঠকাং ঠকাং শব্দে লোহার টুকরো হয়ে জগদ্দলের ‘সমাধি তৈরি হচ্ছে’ তখন পাঠকের মন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে অসহায় কষ্টে। ‘জগদ্দল’ তখন আর কোনো জড় ট্যাক্সি থাকে না, পাঠকের বন্ধু হয়ে যায়। একইরকম কষ্ট তৈরি হয় ‘ফসিল’ গল্পটি পাঠ করার পর। শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ বা তারাশঙ্করের ‘কালাপাহাড়’ গল্পদুটিও একইভাবে ভাবাবেগ বা পশুপ্রেম তৈরি করে মনে। সদরুদ্দিন চান এরকম মনছোঁয়া ছোটগল্প, যা লিখে পাকা তীরন্দাজের মতো পাঠকের হৃদয় জয় করে নেবেন।

এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ গল্পের শেষটুকু এখানে তুলে ধরা যেতে পারে – ন্যায়পরায়ণ অনুকূল কহিলেন, “য কাজ করিয়াছ উহাকে মাপ করা যায় না।”

রাইচরণ অনুকূলের পা জড়াইয়া কহিল, “আমি করি নাই, ঈশ্বর করিয়াছেন।’’

নিজের পাপ ঈশ্বরের স্কন্ধে চাপাইবার চেষ্টা দেখিয়া অনুকূল আরো বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “যে এমন বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করিয়াছে তাহাকে আর বিশ্বাস করা কর্তব্য নয়।”

রাইচরণ প্রভুর পা ছাড়িয়া কহিল, “সে আমি নয়, প্রভু।’’

“তবে কে?’’

“আমার অদৃষ্ট।’’

কিন্তু এরূপ কৈফিয়তে কোনো শিক্ষিত লোকের সন্তোষ হইতে পারে না।

রাইচরণ বলিল, “পৃথিবীতে আমার আর কেহ নাই।’’

ফেল্না যখন দেখিল, সে মুন্সেফের সন্তান, রাইচরণ তাহাকে এতদিন চুরি করিয়া নিজের ছেলে বলিয়া অপমানিত করিয়াছে, তখন তাহার মনে মনে কিছু রাগ হইল। কিন্তু তথাপি উদারভাবে পিতাকে বলিল, “উহাকে মাপ করো। বাড়িতে থাকিতে না দাও, উহার মাসিক কিছু টাকা বরাদ্দ করিয়া দাও।’’

ইহার পর রাইচরণ কোনো কথা না বলিয়া একবার পুত্রের মুখ নিরীক্ষণ করিল, সকলকে প্রণাম করিল, তাহার পর দ্বারের বাহির হইয়া পৃথিবীর অগণ্য লোকের মধ্যে মিশিয়া গেল। মাসান্তে অনুকূল যখন তাহার দেশের ঠিকানায় কিঞ্চিৎ বৃত্তি পাঠাইলেন তখন সে টাকা ফিরিয়া আসিল। সেখানে কোনো লোক নাই।

এই গল্পটিকেও দ্বিমাত্রিক গল্পের নমুনা হিসেবে ধরা যেতে পারে। প্রথমত গল্পের শেষপ্রান্তে এসে ফেল্নার প্রবেশ এবং রাইচরণকে মাপ করে দেওয়ার প্রস্তাব। এটি যদি সমাপ্তিপর্বের প্রথম মাত্রা হিসেবে বিবেচিত হয় তাহলে দ্বিতীয় মাত্রা হতে পারে রাইচরণের দেশের বাড়ি থেকে টাকা ফেরত আসার সংবাদটি।

আবার অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা যায় গল্পটির সমাপ্তিপর্বকে। ‘আমার অদৃষ্ট’ বলেই গল্পটি শেষ হয়ে যেতে পারত। গল্পে সেটি ঘটলে একমাত্রার গল্প হতো এটি। আবার ফেল্নার উক্তির পরও গল্পটির ইতি টানা যেত। সেক্ষেত্রে এটি হতো দ্বিমাত্রিক গল্পের উদাহরণ। কিন্তু বাস্তবে গল্পটি শেষ হয়েছে একটি সংবাদ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে আর সেটি হলো, বিতাড়িত রাইচরণ নিজের দেশের বাড়ি ফিরে যায়নি। কারণ তার টাকা ফেরত এসেছে। এটি হতে পারে গল্পের তৃতীয় মাত্রা। তাহলে গল্পটিকে ত্রিমাত্রিক গল্প  হিসেবে বিচেনা করলে কি ভুল হবে?

সদরুদ্দিন ভাবছেন আর মাথা গরম হচ্ছে তাঁর। এসময় তাঁর এডগার এলান পো’র বিখ্যাত গল্প ‘The Telltale Heart’ গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। একটি ক্রাইম-থ্রিলার ছোটগল্প। গল্পটির শুরু এবং শেষটা কী যে অদ্ভুত! খুনির বয়ানে গল্পটি শুরু হয়েছে – ‘True! Nervous – very nervous, dreadfully nervous I had been and am. But why will you say that I am mad? The disease had sharpened my senses – not destroyed, not dulled them. Above all was the sense of hearing acute. I heard all things in the heaven and in the earth. I heard many things in hell. How then am I mad? Hearken, and observe how healthily, how calmly I can tell you the whole story’ লক্ষ করার মতো অসাধারণ এক ছোটগল্পের সূচনা। শব্দের শক্তিশালী প্রয়োগ কামড়ে ধরে পাঠককে। তাহলে এই পাগল লোকটা কেন বুড়ো মানুষটাকে খুন করল? কেন? খুনি জানাচ্ছে, ‘I loved the old man. He had never wronged me. He had never given me insult. For his gold I had no desire. I think it was his eye! Yes, it was this! He had the eye of a vulture, a pale blue eye, with a film over it. Whenever it fell upon me my blood ran cold; and  by degrees, very gradually. I made up my mind to take the life of the old man, and thus rid myself of the eye forever.’

গল্প বলায় পো’র এমনই দক্ষতা ও চাতুর্য যে, পাঠক এটি শেষ পর্যন্ত না পড়ে থাকতেই পারবেন না। পাগল খুনি বৃদ্ধের দেহ টুকরো-টুকরো করে বাথটাবের ভেতর ঢুকিয়ে তার ওপর কাঠের পাটাতন আর বসার চেয়ার রেখে এমনভাবে ঢেকে দিলো যে কারো বোঝার জো নেই লাশটি এ-ঘরেই রয়েছে। পুলিশ এসে যখন জেরা করছে তখনো সে হাসিখুশি সময় পার করছে। অনর্গল গল্প করছে তাদের সঙ্গে। খুনি যে চেয়ারে বসে রয়েছে এর নিচেই বৃদ্ধের লাশ। কে জানবে সে-কথা? কিন্তু একটু বাদে অদ্ভুত এক শব্দ খুনির কানে আসতে থাকে। প্রথমে বুঝতে পারেনি। পরে স্পষ্ট হচ্ছে, চিনতে পারছে – ‘I knew that sound well, too. It was the beating of the old man’s heart. It increased my fury, as the beating of a drum stimulates the soldier into courage.’ ক্রমশ এ শব্দ এতোই তীব্র আর বিদারী হয়ে খুনির কানে বাজতে থাকে যে পুলিশের সামনে চিৎকার করে স্বীকার করতে বাধ্য হয় নিজের খুনের কথা – ‘Villans! I shrieked. Dissemble no more! I admit the deed ! Tear up the planks! Here , here! It is the beating of his hideous heart!’ গল্প এখানেই শেষ। পাঠককে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখার এই যে দক্ষতা ও কৌশল, তা শ^াসরুদ্ধকর ঘটনা বা ভাষাশৈলী বা অদ্ভুত চরিত্রচিত্রণ যা-ই দিয়ে হোক, গল্পটি সর্বকালের অন্যতম একটি উৎকৃষ্ট ছোটগল্পের উদাহরণ।

সদরুদ্দিন হাঁপিয়ে উঠছেন ভেবে ভেবে। শেষমেশ মনে হলো, অতকিছু ভেবে কেউ গল্প লেখেন না। গল্প তো আর অংক কষা নয় যে সূত্রের বাইরে যাওয়া যাবে না। বরং সূত্র ধরে কাজ করে সূত্রের বাইরে যেতে পারাটাই সফল গল্পকারের কাজ। এই ভাংচুরের কাজটি তিনিই পারেন যার সূত্রটি ভালো করে জানা রয়েছে। যাঁর ছন্দের ওপর মোটেই দখল নেই তিনি কি করে প্রথাগত ছন্দ ভাঙবেন? যিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে গল্প বলতে জানেন না তিনি কিভাবে ভাংচুর কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মতো কঠিন ব্রত কাঁধে নেবেন?

সদরুদ্দিনের ফের মাথা গরম হচ্ছে। তাড়াতাড়ি বেল টিপে কাজের লোককে চা দিয়ে যেতে বললেন।

চার

নানারকম গল্প পড়ে সদরুদ্দিনের মনে হচ্ছে, গল্পকার আসলে আখ্যানের খোলসে বিপন্ন মানুষকেই আঁকতে চান। বিপর্যয় বা ব্যত্যয়কে সামনে নিয়ে আসাই যেন লেখকের কাজ। বিপন্নতাবোধ ছাড়া সাহিত্যের গল্প হয় না – এটা তিনি খুব বুঝতে পারেন। জাদুবাস্তব ঘরানার গল্পকার শহীদুল জহিরের ‘আগারগাঁও বস্তিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই’ গল্পটির শুরুটাই যেন কোনো এক ভয়ংকর মানবিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দেয়, ‘ভূমিকম্পে শহরের সাতাশটি দালানে ফাটল ধরে, রামপুরায় জলার ধারের একটি দালান কাত হয়ে যায় এবং আগারগাঁও কলোনিতে সকল নয়নতারা গাছ এবং আবদুস সাত্তার ভূপাতিত হয়।’ পাশাপাশি প্রখ্যাত কথাকার মঈনুল আহসান সাবেরের অবদমিত যৌনতা নিয়ে ‘অস্পষ্ট মুখ’ শিরোনামের একটি গল্প রয়েছে যার শুরুটা আরো চমকপ্রদ, ‘একটা অবৈধ স্বপ্ন দেখে শেষরাতে তার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমের মধ্যে একজনের সঙ্গে তার ওটা হয়ে গেছে।’ দুটো গল্প দুভাবে বলা; কিন্তু অন্তর্নিহিত সামাজিক কিংবা মানসিক ব্যত্যয় কিন্তু দুখানেই দীর্ঘশ^াস ফেলছে। চট করে সদরুদ্দিনের মনে পড়ে গেল বুদ্ধদেব বসুর বিখ্যাত গল্প ‘আমরা তিনজনে’র কথা। শুরু ও শেষটুকু যেন ওর মনে গেঁথে রয়েছে। ‘আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি, অসিত আর হিতাংশু, ঢাকার পুরানা পল্টনে, উনিশশো সাতাশে। সেই ঢাকা, সেই পুরানা পল্টন, সেই মেঘে ঢাকা সকাল!’ দিয়ে শুরু যে অনবদ্য গল্পের তা শেষ হয় এভাবে, ‘আর আমি – আমি এখনো আছি, ঢাকায় নয়, পুরানা পল্টনে নয়, উনিশশো সাতাশে কি আটাশে নয়, সে-সব আজ মনে হয় স্বপ্নের মতো, কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু স্বপ্ন, ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে একটু হাওয়া – সেই মেঘ ঢাকা সকাল, মেঘ-ডাকা দুপুর, সেই বৃষ্টি, সেই রাত্রি, সেই – তুমি ! মোনালিসা, আমি ছাড়া আর কে তোমাকে মনে রেখেছে!’ প্রথম যৌবনের মুকুলিত এ আবেগ কেবল লেখকের নয়, পাঠকেরও। পাঠক-লেখক দুজনই ডুবে যান এ আতিশয্যে, এখানেই লুকানো থাকে বড় লেখকের চতুরালি!

মোদ্দাকথা, বিপন্নতার ছায়া ঘিরে হাট বসায় সাহিত্য। বাংলাদেশে বড় বিপন্নতাবোধ জন্মায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। এ-সময়টায় এদেশের মানুষ যতো দীর্ঘশ^াস ফেলেছেন ততো আর কখনো নয়। যিনি লেখক তিনি এসব দ্বারা প্রভাবিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। তাই মুক্তিযুদ্ধের গল্প এদেশের গল্পসমগ্রের অনেকখানি দখল করে রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প-উপন্যাস লেখেননি এরকম লেখক এদেশে বিরল। সত্যেন সেন থেকে হারুন হাবীব সবাই লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প। এ-ধরনের গল্প লেখা বেশ কঠিন। কেননা এর সঙ্গে লেখকের ভাবাবেগ মিশে থাকে। তাই বাস্তবতার মাটি থেকে তুলে এনে গল্পকে সাহিত্যের আভরণে সাজানো বেশ কঠিন এক কাজ। লেখককে সারাক্ষণ স্মরণ রাখতে হয় যেন আতিশয্যের পোকা গল্পটি খেয়ে না ফেলে। যে-লেখক যতো শক্তিশালী তিনি ততো পরিমিতিবোধ ও সংযমের ভেতর দিয়ে সাহিত্যের বাস্তবতাকে বজায় রাখেন এ-ধরনের গল্প রচনায়।

মুক্তিযুদ্ধের এই গল্পধারা দু-ধরনের – প্রথম ধারায় উঠে এসেছে নয় মাস স্থায়ী এ-যুদ্ধে পাকা হানাদার বাহিনীর নির্মম-নির্দয়-নিষ্ঠুর-পৈশাচিক অত্যাচারের প্রত্যক্ষ বর্ণনা। শওকত ওসমানের গল্প ‘জন্ম যদি তব বঙ্গে’, হাসান আজিজুল হকের ‘ভূষণের একদিন’ কিংবা

‘কৃষ্ণপক্ষের দিন’, সেলিনা হোসেনের ‘আমিনা ও মদিনার গল্প’ পাকিস্তানি নরপশুদের পৈশাচিক অত্যাচারের স্মারক হিসেবে পাঠককে মূহ্যমান করে রাখে। অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধকে বর্তমান বাস্তবতার আয়নায় দেখার গল্পও রয়েছে প্রচুর। রাহাত খানের ‘মধ্যিখানে চর’ কিংবা ‘মুক্তিযোদ্ধার মা’ সেরকম দুটি গল্প। মোদ্দা কথা, গল্প লেখার প্রধানতম উৎস মানবজীবনের কোনো ত্রুটি, ক্ষত বা ব্যত্যয়। লেখক হলেন তিনি, যিনি সেই স্খলনকে এমনভাবে আঁকেন যে পাঠক কখনো হো-হো করে হেসে ওঠেন, আবার কখনো বা গম্ভীর হয়ে ভাবেন, এরকমও সম্ভব?

জীবন খুঁড়ে এভাবেই একজন লেখক তৈরি হন। তিনি যে সমাজেই বাস করুন, যেরকম জীবন যাপনে অভ্যস্ত হোন, শেষ পর্যন্ত নিজেকে আবিষ্কারের নেশা থেকেই একজন লেখক তৈরি হন। তাঁর উপলব্ধিগুলিই তাঁর স্বর্ণখনি। যে যতো গভীরে ডুবতে জানেন তিনি ততো সফল। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে যখন লেখক হুমায়ূন আহমেদ কান্তকবির অমর সংগীত ‘আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাও নি’ শুনে অঝোরধারায় চোখের জল ফেলেন তখন প্রকারান্তরে লেখকের উপলব্ধিরই বিজয়কেতন ওড়ে। লেখক ছাড়া অন্তিমের এই গভীর উপলব্ধি আর কারো পক্ষেই বুকে ধারণ করা সম্ভবপর নয়। যুগের পর যুগ বাহিত এই বোধগুচ্ছের নাম হলো সাহিত্য। এটি শুধু গল্প-কবিতার বেলায় নয়, শিল্প-সাহিত্যের যে-কোনো মাধ্যমের বেলায় সমানভাবে প্রযোজ্য। সাধারণ মানুষ যা বছরের পর বছর চর্চা করছেন কিংবা অনুভব করছেন, লেখক তার ব্যাখ্যা উপস্থাপন করছেন তাঁর সৃজনশক্তি খাটিয়ে, এর নাম সৃজনশীলতা।

সদরুদ্দিন ফের গেলেন একজন লেখকের কাছে। বেশ কদিন গল্প করার পর তিনি লেখককে প্রশ্ন করে বসলেন, ‘লেখক হবো কেমন করে? একটা ভালো গল্প লিখব বলে লন্ডনের মায়া ছেড়ে এদেশে থাকছি। একা-একা জীবন কাটাচ্ছি। হবে না আমাকে দিয়ে?’

তিনি নির্নিমেষে তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে। তারপর বলে উঠলেন, ‘কাঁদতে জানেন?’

সদরুদ্দিন অবাক হয়ে গেলেন একথায়। তিনি একজন জ্যেষ্ঠ আমলা। তিনি অন্যকে কাঁদাতে পারেন, নিজে কাঁদবেন কেন? তিনি কি দুর্বল শ্রেণিভুক্ত?

‘বুঝলাম না ভাই?’

‘শোনেন, বুকের ভেতর কী যেন থাকে, মন বলি আমরা। যেখানে অনেক কিছু অনুভব করতে পারি আমরা। যদিও অনুভব-অনুভূতিগুলি সবই মগজের ভেলকিবাজি – বিজ্ঞানীরা বলেন। আমরা একেই মন বলে ধরে নিচ্ছি। সেই জায়গাটায় বেশি আগাছা থাকলে গভীরভাবে কোনোকিছু অনুভব করা যায় না। যে-লেখক যতো শুদ্ধ তিনি ও তাঁর মন ততো আগাছাহীন। তিনি ততো কাঁদতে জানেন, আবার হাসতে আর হাসাতেও জানেন। হা-হা-হা। আপনি সেগুলি টের পান?’

সদরুদ্দিন আর কথা বাড়াননি। মানুষটাকে পাগলাটে বলেই মনে হলো। তিনি ফিরে এলেন।

স্ত্রী রোখসানা রিং করে বলে উঠলেন, ‘আর কত? এবার চলে আসো।’

‘একটা ভালো গল্প লেখার যে বড় শখ আমার। জীবনে কোনোদিন হারিনি। এ খেলায় হেরে যাবো?’

সুস্মিতার ঝাপসা একটা চেহারা ভেসে উঠল সদরুদ্দিনের চোখের সামনে। ওপাশ থেকে রোখসানা বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন, ‘ভালো করে খেল। পাগলের গুষ্টি, পাগলামি ছাড়া আর কী আছে?’ বলে মোবাইলের লাইনটা কেটে দিলেন।

সদরুদ্দিন হো-হো করে হেসে উঠলেন খালি ড্রয়িংরুমে বসে। হাসিটা প্রতিধ্বনি তোলে বিশাল কক্ষে। সহসা মনে হলো, চাকরিতে থাকতে এদ্দিন তো লেখক-কবিদের একধরনের পাগলই ভেবে এসেছেন তিনি। সবাই রবীন্দ্রনাথ-নজরুল হবেন ভেবে কেবল লিখেই চলেছেন। এরকম অনিশ্চিত যাত্রাপথের পথচারীকে তো পাগল ভাবাই স্বাভাবিক!

সদরুদ্দিন কি তাহলে এ-পথেই রওনা দিতে চান?

প্রশ্নটা নিজেকে জিজ্ঞাসা করে পরক্ষণে লেখার টেবিলে গিয়ে বসে পড়েন তিনি। ভাবতে থাকেন সুস্মিতার জীবনালেখ্য নিয়ে।

তাঁর পেছনে, সামনে, ডানে, বাঁয়ে তাঁরই মতো লক্ষ লক্ষ চেনা-অচেনা মানুষের ছায়া, তারাও কি একটা ভালো গল্প, কবিতা, গান কিংবা শিল্পকর্ম রচনা করে অমর হয়ে থাকতে চায় মানুষের হৃদয়ে?

কে জানে!