কর্কট রোগ আর লাল নীল রুমাল

মিঠি আর কিছুটা ছুটি 

মিঠি দিদির কানে মুখ লাগিয়ে বলে, ‘এই হনুমানটার হাত থেকে মুক্তি কী করে পাওয়া যায় বল তো?’ ছুটি আড়চোখে হনুমানটাকে দেখে নেয়। হনুমানটা ওদের বাঁদিকের পেছনের সারির ধারের সিটে বসে একটা ইংরেজি খবরের কাগজ পড়ছে। আলগোছে বলে, ‘একবার রাবণের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দে না, দেখবি গুটনো লেজ লম্বা করে পালাবে।’ ফিক করে হেসে ফেলে মিঠি। রাবণকে একবার কথাটা বলে দেখতে হবে তাহলে।

প্লেনের ভেতরে জানালার সরানো পর্দার ফাঁক গলে রোদ্দুর কাটা কেকের মতো সামনের সিটের পেছন দিকে পড়ছে। তার আগে আদর করে দিদির গালটা একটু ছুঁয়ে দেয়। এমনিতেই দিদি ফর্সা। তার ওপর কেমো চলে যেন মোমের পুতুল হয়ে গেছে। মাথায় ববি প্রিন্টের লাল রুমাল বাঁধা। মিঠির গাটা শিরশির করে ওঠে, দিদিকে পরিটরি মনে হয়। নিদেনপক্ষে অন্য দেশের মানুষ। একদম বদলে গেছে ছুটি। মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখলে মানুষ বোধহয় অন্যরকম হয়ে যায়। দিদি কিন্তু চিরকালই একটু অন্তর্মুখী। ওর চরিত্রের সঙ্গে হালকা ইয়ার্কি ঠিক খাপ খায় না। অথচ ছুটি এখন কত সহজে মজা করতে পারে।

রাবণ মিঠির ক্লাসমেট। ঠিক নাম শুভ্র। কলেজে ঢুকেই মিঠির পেছনে ইট রেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে। গত দু-বছর ধরে অন্য কারো প্রেমে পড়া থেকে মিঠিকে সযত্নে আগলে রেখেছে। বান্ধবীরা বলে বডিগার্ড। যে-কোনো দিন হাঁটু গেড়ে প্রপোজ করবে। সারাক্ষণ জিন্স পরে থাকে বলে নেহাতই পাটা ভাঁজ করতে পারছে না তাই। তবে খুব ভালো বন্ধু। হনুমান যে পেছনে পড়েছে সেটা জানলে হনুকে আর আস্ত রাখবে না।

হনুমানের ভালো নাম অনঘজ্যোতি। এরকম বিটকেল কারো নাম হওয়া উচিত নয়। ডাকনাম বিলু। অনঘজ্যোতি নামটা শুনলেই মনে হয় কেউ যেন সর্দিকাশি বসিয়ে ঘড়ঘড় করছে। প্রথমদিন শুনেই মিঠি বলেছিল, ‘আপনার কোনো সহজ-সরল নাম নেই?’ ওর যদি ডাকনাম বিলু না হতো তাহলে কোনোভাবে ওর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতো না মিঠি। মিঠি বিলুদা বলে ডাকে এবং ‘দা’ শব্দটার ওপর বেশিই জোর দেয়। লম্বা-চওড়া ছেলেদের একদম নাপসন্দ মিঠির। অহেতুক স্পেস কমিয়ে দেয়।

বিলুর সঙ্গে আলাপ মাসছয়েক আগে। সেই সময়টার কথা মনে হলে এখনো দম বন্ধ হয়ে আসে মিঠির। তার কয়েকদিন আগে থেকেই অন্যমনস্ক লাগছিল ছুটিকে। ওরা দুই বোন এক ঘরে শোয়। বাবার সেরিব্রাল অ্যাটাক হওয়ার পর থেকে মিঠি ছুটির ঘরে চলে এসেছে। মিঠির ক্লাস টেনে পড়ার সময় বাবার অ্যাটাকটা হয়। তার আগে একঘরে বাবা-মা আর মিঠি শুতো। দিদির জন্য আলাদা ঘর। বেশ বড়। আসলে বাবা উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার ছিলেন। ফলে সচ্ছলতার অভাব ছিল না। বাবা খুব পরিকল্পনামাফিক সবকিছু সাজিয়ে ছিলেন বলে তার হঠাৎ হওয়া অসুস্থতা সংসারকে বিপদে ফেলেনি। শুধু মা যেন বাবাকে হারানোর ভয়ে বাবার সম্পর্কে অতিরিক্ত সচেতন হয়ে পড়েছিল। মিঠি ছুটির ঘরে চলে এলেও দিদির দিক থেকে একটা দূরত্ব রয়ে গিয়েছিল। এক বিছানায় শুয়েও দুজনের মধ্যে এক পৃথিবী দূরত্ব ছিল। তবু ছুটিকে বেশ ভালো বুঝতো মিঠি। তাই অস্বাভাবিকতাটা চোখে পড়ে যায়। শুকনো মুখ, অনেক রাত পর্যন্ত মোবাইলে কীসব দেখে। লক্ষণগুলি ভালো নয়। নির্ঘাত প্রেমে ঝাড় খেয়েছে। এরকম গুডি গুডি মার্কা মেয়েদের নিয়েই প্রবলেম। মিঠি নিজের মতো করে হিসাব করে নেয়। তারপর একদিন কথাটা পেড়ে ফেলে, ‘তুই এরকম সর্বহারার মহান নেতাদের মতো মুখ করে ঘুরছিস কেন? তুই কি এখনো শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্রের আমলে পড়ে আছিস? লোকে এখন রিটার্ন টিকিট কেটে প্রেমে পড়ে। ঝট করে বলে ফেলতো মালটা কে?’

মিঠি ভেবেছিল মনের কথা বেরিয়ে এলেই সহজ হয়ে যাবে ছুটি। অনেকক্ষণ ধরে মিঠির দিকে তাকিয়ে ছিল ও। তারপর কাটা কাটা স্বরে জানিয়েছিল ওর ক্যান্সার হয়েছে। আকস্মিকতায় কী, কেন, কোথায় প্রশ্নগুলি তালগোল পাকিয়ে আটকে গিয়েছিল মিঠির গলায়।

কয়েকদিন আগে স্নান করার সময় বুকে একটা গুটলির অস্তিত্ব টের পায় ছুটি। ছুটি বিজ্ঞানের ছাত্রী। গবেষণা করছে এখন। সাধারণ মানুষের থেকে আইকিউ বেশি। তাই প্রথমেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েনি। স্থানীয় একটা ডাক্তার দেখিয়েছিল। ডাক্তারবাবুও খুব খারাপ কিছু সন্দেহ করেননি। কিছু পরীক্ষা করতে দিয়েছিলেন। রিপোর্টগুলি দেখে ছুটির নিজের সন্দেহ হয়েছিল। ডাক্তারের কাছে জানা গেল ক্যান্সার হয়েছে। সেখান থেকে ফিরে একলা ছাদে বসে ছিল ছুটি। আকাশভর্তি ঝিলমিল তারা। চাঁদ ছিল না। তারাগুলির দিকে তাকিয়ে অনেক কিছু ভেবেছে ও। বাবার অসুস্থতা থাকলেও ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াচ্ছিল ওদের পরিবার। বাবা-মাকে কীভাবে ওর নিজের অসুস্থতার কথা জানাবে? বোনই বা কীভাবে নেবে? কতদিন চিকিৎসা করতে হবে? শেষ পর্যন্ত আদৌ বাঁচবে কি না? সব থেকে বড় অভিমান অদৃষ্টের ওপর – ও তো জীবনটা এখনো শুরুই করেনি। সবকিছুর আড়ালে যদি কেউ থেকে থাকেন, তাঁর এ কেমন বিবেচনা?

এক আকাশ তারাগুলিকে সাক্ষী রেখে হাপুস নয়নে কেঁদেছিল ছুটি। একসময় ক্লান্ত হয়ে ভবিতব্যকে অদৃষ্টের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ঠিক ভেবেছিল ও।

এরপর থেকে নেটে প্রায়ই ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রগনোসিস খুলে দেখতো। মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা কতটা কষ্টদায়ক হবে? মিঠিকে বলতে মন চায়নি। কী হবে বলে? কীই বা করতে পারে সদ্য কলেজে ওঠা একটা মেয়ে?

কিন্তু মিঠি যখন ওর মন খারাপের কারণ জিজ্ঞেস করেছিল তখন একদম ভেঙে পড়েছিল ছুটি। বোনকে জড়িয়ে ধরতেও অস্বস্তি লাগছিল – যেন ছোঁয়াচে রোগ, ওর কাঁধে মাথা রাখলে যদি কোনো ক্ষতি হয় মিঠির। মিঠিই কিছুক্ষণ পরে ছুটিকে জড়িয়ে ধরে। সেই মুহূর্তে ও দিদির থেকে অনেক বড়ো হয়ে যায়। ছুটি বুঝতে পারে, ওই ছোট্ট মেয়েটার কাঁধ অনেক চওড়া।

ওরা ঠিক করে নামকরা কোনো ক্যান্সার স্পেশালিস্টকে দেখাবে। বাবা-মাকেও তো ব্যাপারটা জানানো উচিত। তবে ধীরে ধীরে। শুধু কোনো একটা অসুখ হয়েছে জানাবে। তাই হলো। নেট ঘেঁটে ফাইভ স্টারওয়ালা ক্যান্সার স্পেশালিস্টও মিলল।

ডাক্তারের চেম্বার তো নয়, যেন শিয়ালদহ স্টেশন। হরেককিসিমের মানুষের ভিড়। কেউ রোগী তো কেউ তার সঙ্গে এসেছে। রিপোর্টের একটা দল, পুরনো রোগীর দল, তার সঙ্গে মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ। মিঠি দেখেই বলেছিল, এখানে ঠিক হবে না। আর নাম লেখানোর নিয়ম জানা ছিল না বলে নামও ডাকা হবে বেশ পরে। রিসেপশনিস্ট মেয়েটিও বিচ্ছিরি রকম হুঁকোমুখো। মেয়েটির বাবার নাম নির্ঘাত রামগরুড়। এক ঘণ্টা সময়ের মধ্যে একবারও হাসেনি। ওই চেম্বারেই বিলুর সঙ্গে দেখা। বিলুদা ওর মাকে চেকআপে এনেছে। ডাক্তার চৌধুরীই ওনার অপারেশন করেছিলেন। তিন বছর হয়ে গেছে, এখনো ভালোই আছেন। বিলু দিদির মুখচেনা। কোনো একটা ব্যাংকে কাজ করে। ক্যাবলা ক্যাবলা মুখ করে দিদিকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনি এখানে?’ মিঠির মনে হচ্ছিল ঠাস করে একটা বসিয়ে দেয়। মিঠি দিদির হয়ে উত্তর দিয়েছিল, ‘হ্যাঁ, অনেকদিন চিড়িয়াখানা ঘুরতে যাওয়া হয়নি বলে এসেছে।’ দিদিই অবশ্য হেসে ম্যানেজ দিলো। তাতে লাভই হলো। ডাক্তারের সঙ্গে বিলুদার সম্পর্ক ভালো বলে কায়দা করে আগে দেখানোর ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল।

সমস্ত কাগজ দেখে ডাক্তারবাবু জানালেন, অপারেশন করতে হবে, এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। দিশেহারা দুই বোনের পাশে তখন বিলুদা এসে দাঁড়িয়েছিল। ডাক্তার চৌধুরী বিলুদার মায়ের অপারেশন করেছিলেন এবং তিনি ভালো আছেন। মাসিমাও জানালেন, ডাক্তারবাবুর হাত ভালো। তবুও মিঠির মন চাই ছিল না। যেন বড্ড তাড়াহুড়ো ওনার। ডুবতে থাকা মানুষ খড়কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরে। বিলু অযাচিতভাবেই পরামর্শ দেয় বাড়িতে গিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলার। সেটাই উচিত। বরং তারা পরে জানতে পারলে কষ্ট বেশি পাবেন। আর ক্যান্সার ঠিক সময়ে চিকিৎসা করলে সেরে যায়। বিলুদার মা তো তার উদাহরণ। বিলুদার মতো ওর মাও বেশ আগ বাড়িয়ে সাহায্য করতে ভালোবাসেন দেখা গেল। প্রয়োজন হলে উনিও বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলতে রাজি।

বাড়িতে এসে কিন্তু এতো সহজে সবকিছু বলা গেল না। সেই শরীর খারাপ বলে বাবা-মাকে বোঝানো হলো। কিন্তু সপ্তাহখানেক পরেই বিলুদা আর ওর মা হাজির। কী অস্বস্তি! কিন্তু একটা ব্যাপার বোঝা গেল যে, বাবা-মা এরকমই কিছু একটা সন্দেহ করেছে। ফলে আঘাতটা ততো জোরালো লাগেনি। বাবা প্রস্তাব দিলো সাউথে যাওয়ার। ওখানকার চিকিৎসাব্যবস্থা অনেক আধুনিক। কিন্তু কার সঙ্গে যাবে ছুটি? আসলে বিশ্বাসযোগ্য নিকটাত্মীয়র বড়ো অভাব। ওদের আদি বাড়ি ওপার বাংলায়। আর রোগটাও এমন যে সবার কাছে খোলামেলা আলোচনা করা যায় না। নয়তো ওদের বাবার বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা বেশ ভালোই। এবারেও মুশকিল আসান হলেন বিলুদার মা। ‘কেন? বিলু যাবে ওর সঙ্গে।’ বিলুদা শুনেই চমকে তাকিয়েছিল মিঠির দিকে। অচেনা-অজানা ছেলের সঙ্গে পাঠাবেই বা কেন ওদের বাবা-মা।  মা শুনেই নাকচ করে দিয়েছিল।

কিন্তু কিছু করার ছিল না। আরো এক সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে গেল ছুটি আর মা যাবে বিলুর সঙ্গে। বাবার কাছে মিঠি থাকবে। এর মধ্যে বাবার এক বন্ধু জানা গেল বিলুদের পাড়ায় থাকেন।  বিলু যে পরোপকারী এবং মানুষ হিসেবেও ভালো সেই সার্টিফিকেট তিনি দিলেন। বাবা বিলুর খরচটা দিতে চেয়েছিল। বিলু রাজি হয়নি। মিঠির অস্বস্তি লাগছিল। কোথাও যেন ঋণের জালে জড়িয়ে যাচ্ছে ওরা। এটা ভালো নয়। কোনোদিন যদি বিলুদা কোনো সম্পর্ক দাবি করে তাহলে ভেতর থেকে বাবা-মাকে হয়তো ক্ষমা করে উঠতে পারবে না মিঠি।

শুভ্রকে জানিয়েছে মিঠি। মা আর দিদি একজনের সঙ্গে ভেলোর যাচ্ছে। ছেলেটার সঙ্গে অল্পদিনের পরিচয়। তার বেশি কিছু না। আশা করেছিল শুভ্র হয়তো দায়িত্ব নিতে চাইবে। শুভ্র কলেজের ইলেকশন নিয়ে বেশি চিন্তিত দেখা গেল। কথাটার তেমনভাবে গুরুত্ব দেয়নি। মিঠিও বেশি কথা বাড়ায়নি।

তবে দেখাতে গিয়ে যে একেবারে অপারেশন করিয়ে আসবে সেটা আগে থেকে ভাবতে পারেনি মিঠি। ওরা যাওয়ার দুদিনের মাথায় দিদি ফোন করে জানালো যে, পরদিন অপারেশনের কথা বলছে ওখানকার ডাক্তারেরা। ভিডিও কলে মায়ের সঙ্গেও কথা হলো। অপারেশন যখন করাতেই হবে তখন শুধু শুধু সময় নষ্ট করে এবং রোগটাকে জটিল করে তো কোনো লাভ নেই। মিঠি অবশ্য চাইছিল না এভাবে দিদির অপারেশন হোক। কিন্তু যুক্তির দিক দিয়ে মিঠি হেরে গেল। বিলুদার সঙ্গেও কথা হলো। আশ্বস্ত করল। তবে বিলুদার সঙ্গে কথা বলতে মোটে ভালো লাগছিল না মিঠির।

পরদিন আর কলেজ যায়নি মিঠি। ওটিতে ঢোকানোর পরেই ফোন করেছিল বিলু। কিন্তু তারপর আর ঘণ্টাচারেক ফোন নেই। না মাকে পাওয়া যায়, না বিলুদাকে। দুজনেই এমন জায়গায় ছিল যেখানে জ্যামার লাগানো। কোনোভাবেই ফোন ঢুকবে না। টেনশনে একটা সময় প্রায় কেঁদে ফেলে মিঠি। খুব খারাপটা ভেবে নিয়েছিল ও। ফলে বিলুর ফোনটা আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় কেঁদে ফেলে মিঠি। বিলু অনেকটা সময় নিয়ে আশ্বস্ত করে। অপারেশন ভালো হয়েছে। সদ্য বেডে দেওয়া হয়েছে ছুটিকে।

বিলু আস্তে আস্তে মিঠির সঙ্গে সম্পর্কটা সহজ করে নিচ্ছিল। মিঠিও কিছুটা অসহায়ের মতো প্রশ্রয় দিচ্ছিল বিলুকে। প্রথম দু-একদিন মায়ের ফোনে কথা বলছিল বিলু। তারপর নিজেই সরাসরি ফোন করে, দু-বেলা। দিদির সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়। এমনকি একদিন ভিজিটিং আওয়ারে বিলুদার ফোনে ভিডিও কল করে কথা বলে দিদি।

ওখান থেকে ফিরে আসার দিন বাবা আর মিঠি এয়ারপোর্টে গিয়েছিল। সে আরেক অস্বস্তিকর ব্যাপার। বাবা কৃতজ্ঞতা জানাতে বারবার বিলুদার হাত ধরছিল। একদম ভালো লাগছিল না মিঠির। লোকটার বদমায়েশি ধরতে পারছে না ওদের সহজ-সরল পরিবার। মিঠি জানে, ও বেশ সুন্দর দেখতে। সবার চোখে নিজের সৌন্দর্য পড়তে পারে মিঠি। বিলুদার সঙ্গে একটা জীবন কাটাতে পারবে না ও। কোনোদিক থেকেই ওর যোগ্য নয় বিলুদা।

সেদিন রাতে দুই বোন শুয়ে শুয়ে গল্প করছিল। ওখানকার ডাক্তাররা মানুষ হিসেবে খুব ভালো। ব্রেস্ট ক্যান্সার নাকি এখন কোনো ভয়ের রোগই নয়। ওরা আশ্বস্ত করেছে যে, ছুটি সেরে যাবে। কেমোথেরাপি কদিন বাদে শুরু হবে। ওখান থেকে বলেছিল যে, কলকাতাতেই ওরা কেমো নিতে পারে। তবে ছুটির ইচ্ছে প্রথম কেমোটা ওখান থেকে নেওয়ার।

এই  রে, তাহলেই তো হয়েছে। আবার তাহলে বিলুদা ঘাড়ে চাপবে। দিদিকে অন্তত ব্যাপারটা জানিয়ে দেওয়া উচিত। মিঠি একটু ঘন হয়ে আসে ছুটির কাছে। এক হাত দিয়ে দিদিকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘তোর সঙ্গে একটা কথা আছে।’ বিলুদার অভিসন্ধিটা বুঝিয়ে বলার পর চোখ গোল গোল করে ছুটি বলে, ‘এ তো সত্যিই চিন্তার বিষয়। তবে কায়দা করে ঝেড়ে ফেলে দিবি লোকটাকে।’ তারপর খুব চুপিচুপি জিজ্ঞেস করে, ‘তোর কি কেউ আছে?’

শুভ্রর ব্যাপারটা ছুটিকে খুলেই বলে মিঠি। মোবাইলে ফেসবুকে শুভ্রর ছবি দেখায় দিদিকে। ‘বেশ মিষ্টি দেখতে তো।’ ছুটি বলে ওঠে।

‘হ্যাঁ, অন্তত বিলুদার মতো হাতি আর জিরাফের কম্বোপ্যাক নয়।’ মিঠির কথায় ছুটি হেসে ফেলে। তারপর একটু চিন্তা করে বলে, ‘তাহলে শুভ্রকেই বল বরং আমাদের নিয়ে যেতে।’

এবার একটু চুপসে যায় মিঠি। শুভ্রর ওপর কি ভরসা করা যেতে পারে? ঢোক গেলে মিঠি। ‘তুই আর আমি গেলেই তো হয়। আবার হাতি মেরে সাথি করার কী প্রয়োজন?’ অবশ্য নিজেও বুঝতে পারছিল সেটা ঠিক হবে না। শেষ পর্যন্ত সেই বিলুদাই ভরসা।

আর বিলুদা মিঠিদের পরিবারটার ওপর যেন দখল নিয়ে নিচ্ছিল। বাবা তো ছিলই, মাও এখন কারণে-অকারণে তাদের আদরের অনঘজ্যোতিকে ফোন করে পরামর্শ নেয়। এমনকি ছুটির প্রথম কেমো নেওয়ার জন্য যখন সাউথে যাবেই ঠিক হলো, তখন নির্দ্বিধায় বাবা-মা বিলুকে সঙ্গে পাঠানো ঠিক করল। একা ছুটি গেলে দৃষ্টিকটু লাগবে বলে মিঠিকেও মা জুড়ে দেবে। বাবার প্রেশারটা ভীষণ ওঠানামা করছে বলে মা এবারে আর যাবে না। মিঠি প্রথমে রাজি হচ্ছিল না। পরে ছুটির কথা ভেবে রাজি হয়েছে।

ওদের সঙ্গে অবশ্য আরেকটা গ্রুপও এবার গিয়েছিল। মামা আর মামিমা নিজেদের চেকআপ করাবে ঠিক করেছে। অবশ্য কিছুটা মায়ের অনুরোধে। না হলে দুটো অবিবাহিত মেয়েকে বিলুর সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া দৃষ্টিকটু লাগবে। মামা-মামিমার বেশ বয়স। ওরাও কিন্তু এই কদিনে অনঘজ্যোতিকে অনি বানিয়ে ফেলেছে। ছেলেটার মধ্যে যে বুড়ো-বুড়িরা কী পায়!

এক সপ্তাহের এই ট্যুরটায় বিলুকে অবশ্য মিঠি বুঝিয়ে দিতে পেরেছে যে, ওর পেছনে ইট পেতে লাভ নেই। কলকাতা এয়ারপোর্টে মিঠির বড় ব্যাগটা বিলুদা নিতে গিয়েছিল। মিঠি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে যে, ওর জিনিসে হাত দেওয়া পছন্দ করে না। ব্যাগটা অবশ্য বেশ ভারি ছিল। মামা-মামিমার ডাক্তার দেখানো দুদিনেই সারা হয়ে গিয়েছিল। ওরা আশেপাশের জায়গাগুলি বাকি কদিন ঘুরে কাটিয়েছে। ছুটির যেদিন কেমোথেরাপি দেওয়া হলো, সেদিন বাধ্য হয়ে মিঠিকে বিলুদার সঙ্গে লাঞ্চ করতে হয়েছে। মিঠির অসহ্য লাগছিল। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে শুধু নিজের বিলটা মিটিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। অপমানে বিলুদার মুখটা যা হয়েছিল না! এর পরেও যদি লোকটা মিঠিকে প্রপোজ-টোপোজ করে ফেলে তাহলে বুঝতে হবে মেরুদণ্ড বলে কোনো বস্তু ওর পেছনে লাগানো নেই। কিন্তু অসুবিধে এক জায়গায়, সরাসরি যদি ওদের বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে তাহলে বাবা-মানা করবে না। সেই সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনাশ করতে হবে। ফেরার আগের দিন আবার ন্যাকামো করে দু-বোনের জন্য দুটো বড় বড় রুমাল কিনেছে। কেমোথেরাপির পরদিন ছুটির মাথায় হাত বুলিয়ে দেখেছে মিঠি, দিব্যি সুন্দর চুল আছে। ওর জন্য মাথায় দেওয়ার রুমাল কেনা তো একরকম অপমান করা, ওর রোগ সম্বন্ধে ওকে সচেতন করে দেওয়া। সেই বোধটুকুও নেই। বেশ একচোট কথা শুনিয়ে নিজের নীল রুমালটা ফিরিয়ে দিয়েছে মিঠি। দিদি অবশ্য ‘ভালোই তো লাগছে’ বলে তারপর থেকে মাথায় রুমাল বেঁধে ঘুরছে। আসলে দিদিও মনে হয় কৃতজ্ঞতাপাশে বাঁধা পড়ে আছে। মানুষ খুব স্বার্থপর হয়, ভাবে মিঠি। ওর বিপদে সাহায্য করছে বলে নিজের বোনকেও ও বিক্রি করতে দ্বিধা করবে না।

দমদম এয়ারপোর্টে বিশ্রী একটা ব্যাপার হলো। কনভেয়ার বেল্টে সবার লাগেজ এসে গেলেও মিঠির ব্যাগের আর পাত্তা নেই। লাগেজ হারিয়ে গেলে নাকি অনেক ঝামেলা। বিলুদা হনহন করে এগিয়ে বেল্টের মুখে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর সব থেকে বাজে ব্যাপার ও-ই প্রথম ব্যাগটাকে দেখতে পেল। ব্যাগটাকে গন্ধমাদনের মতো ঘাড়ে তুলে যখন বিলুদা ওদের দিকে বোকা-বোকা মুখ করে আসছিল, তখন মিঠি ঠিক করে নেয় যে, এবারই তুমুল ঝাড়টা দেবে। কোনোদিন যেন ওর দিকে মুখ তুলে তাকাতে না সাহস পায়।

ছুটি

বিলু মিঠির ব্যাগটা কাঁধের ওপর নিয়ে এগিয়ে আসছে। ছুটি মিঠির মুখের দিকে তাকিয়ে প্রমাদ গোনে। মিঠি গড়পড়তা মেয়েদের থেকে ভালো দেখতে। রেগে গেলে ওর নাকের ডগাটা লাল হয়ে যায়। আর ইদানীং বিলুকে দেখলেই ওর নাকটা লাল হয়ে উঠছে। হাসি আর দীর্ঘশ্বাস একসঙ্গে গোপন করে ছুটি।

আসলে কটা মাস একেবারে জীবনটাকে বদলে দিয়েছে ছুটির। নিজের ক্যারিয়ার, পড়াশোনা, স্বপ্ন সব একসঙ্গে তালগোল পাকিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ স্বপ্নগুলির ওপর এক ঝটকায় কালো কালি উপুড় হয়ে গেছে। পুরো কালো ক্যানভাসের ওপর আস্তে আস্তে নতুন করে সাদা রং বুলিয়ে নতুন ছবি আঁকার চেষ্টা করছে ছুটি। আর সেই চেষ্টায় রংতুলি নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে বিলু।

অপারেশন। নারীত্বের চিহ্ন শরীর থেকে বাদ দিতে হবে। হাত-পাগুলি অবশ হয়ে এসেছিল শুনে। ডাক্তারের চেম্বারে ছুটি খুব মনোযোগ দিয়ে কথাগুলি শুনছিল। তারপরেও চিকিৎসা চলবে। আদৌ চিকিৎসার পরে বাঁচবে কি না তার গ্যারান্টি নেই। এরকম অদ্ভুতভাবে বেঁচে থাকা যায়? ছুটি নিজের মতো করে ভবিষ্যৎ ভেবে নিয়েছিল। 

বাবার ড্রয়ারে একগুচ্ছ ঘুমের আর হার্টের ওষুধ আছে দেখে নিয়েছিল ছুটি।

সেই রাতটা বড়ো অদ্ভুত। মোবাইলের ডকুমেন্টে গিয়ে একটা ভাঙাচোরা চিঠি লিখেছিল ছুটি। তার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। ওষুধগুলি বাবার ড্রয়ার থেকে বার করে নিয়ে ছাদে এসে বসেছিল ছুটি। ভগবান এক আকাশ তারা উপুড় করে ছড়িয়ে দিয়েছেন মাথার ওপর। সঙ্গে একচিলতে দ্বিতীয়ার চাঁদ। ছুটির বড়ো আদরের শরীরটা আজ হারিয়ে যাবে। কান্না চাপার চেষ্টা করেনি ও। নিজের গোঙানির শব্দ ছাপিয়ে মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠেছিল। এতো রাতে কারো ফোন আসার তো কথা নয়! কিছুটা বিস্ময়ে আর কিছুটা রিফ্লেক্সে ফোনটা ধরেছিল ছুটি।

আদেশ ছিল?  না অনুরোধ? একটা অল্প চেনা ছেলে কী করে জানতে পারে ও সুইসাইড করতে যাচ্ছে? কিন্তু বিলু যখন ছাদ থেকে নেমে আসতে বললো তখন প্রায় হুকুম তামিল করার মতো করে নেমে এসেছিল ছুটি। এমনকি পরদিন বিকেলবেলায় বিলুর বলা জায়গায় দেখাও করতে গিয়েছিল ছুটি। নিজের ভেতর যে একটা অন্য ছুটি বাস করে সেটা জানতো না ও।

আসলে ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে একটা বড়ো লড়াই জেতা হয়ে গেছে বিলুর। ছোটবেলায় বাবা হারানো ছেলেটার কাছে মা ছিল সবকিছু। এই  রোগে সময়মতো রুখে দাঁড়ানোটাই জরুরি। সেদিন সেটা বোঝানোর চেষ্টা করেছিল বিলু। খুব ভালো একটা বন্ধুর চোখে অন্য কিছুও খুঁজে পেয়েছিল ছুটি। মেয়েরা পুরুষের চোখ চেনে।

সেদিন ওরা দুজন শুরু করেছিল নতুন লড়াই। বিলু এই  রোগ নিয়ে বেশ পড়াশোনা করেছে। আর্লি স্টেজে এখন নাকি পুরো বুক বাদ না দিলেও চলে। লাম্পেকটমি, কোয়াড্রেন্টেকটোমি – এসব খটোমটো মেডিক্যাল শব্দ একচিলতে আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ছুটির অন্ধকার মনে। অল্পবয়সী দুটি নারী-পুরুষ পাশাপাশি বসে একটাও প্রেমের কথা উচ্চারণ করেনি সেদিন।

কয়েকদিন বাদে বিলু ওকে নিজেদের বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। মাসিমা ভীষণ হাসিখুশি মহিলা। রোগটা কোনো ব্যাপারই নয় – কথায় কথায় বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। আর সত্যি, কাছ থেকে একই রোগে আক্রান্ত আরেকজনকে দেখে ভরসা লাগছিল তো বটেই। বিলুকে কিছুক্ষণ বাদে প্রায় জোর করে তেলেভাজা আনতে পাঠালেন। বিলুর যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। বিলু বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাসিমা ছুটির একদম কাছে এসে বসেন। এক হাতে ছুটির থুঁতনিটা উঁচু করে ধরে মুগ্ধচোখে কিছুক্ষণ দেখে বলেন – ‘আমার ছেলেটাকে কোনোদিন কষ্ট দিবি না, মা।’ লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল ছুটি। ফেরার সময় বিলু বাসে তুলে দিতে এসেছিল। ভালো করে ওর মুখের দিকে তাকাতে পারেনি ছুটি। নাহ্, তখনো ওকে ভালোবাসার কোনো কথা বলেনি বিলু।

বাকি সবকিছু পরিকল্পনামাফিক এগিয়েছিল। পরদিন মাসিমা আর বিলু ওদের বাড়ি এসেছিলেন। দক্ষিণ ভারতে যাওয়া ঠিক হওয়ার পর বিলু যাবে শুনে অনেকটা আশ্বস্ত হয়েছিল ছুটি।

ওখানে যাওয়ার পরে জানা গেল রোগ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। শুধু টিউমারটাকে বাদ দিলেই চলবে। পরে অবশ্য কেমোথেরাপি দিয়ে নিতে হবে। কষ্টের অথচ কি প্রতীক্ষার দিন গেছে ছুটির। বিলু ভালো লাগার কথা বলেনি তখনো। অপারেশনের আগের দিন ছুটিকে ভর্তি হতে হয়েছিল। মা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগে খুব কান্নাকাটি করছিল। ছুটিই পরিবেশটা হালকা করার জন্য গুনগুন করে গান গাইছে – যেন অপারেশনটা কোনো ব্যাপারই নয়। গাড়িতে করে হাসপাতাল যাওয়ার সময় বিলুও বেশ গম্ভীর, বোঝা গেল টেনশন করছে। ভেতরে ভেতরে কি ছুটির ভয় লাগছিল না? হয়ত কালকে অপারেশন থিয়েটারে ওর জ্ঞানই ফিরলো না। মনে আছে, গানটা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে বিলু চমকে ওর দিকে তাকিয়েছিল। ‘সেই ভালো সেই ভালো, আমারে না হয় না জানো …’।

জ্ঞান ফেরার পরে প্রথম মায়ের সঙ্গে দেখা। ভেতরে ভেতরে বিলুকে খুঁজছিল ছুটি। আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল ও। দ্বিতীয়বার যখন চোখ খুলল তখন বিলু পাশে বসে আছে। এক হাতে রক্ত চলছে ছুটির। অন্য হাতটা বিলু আলতো করে ধরে আছে। হাসপাতালের ভেতর টাওয়ার নেই বলে মা বাইরে গেছে বাড়িতে ফোন করতে। খুব উতলা হয়ে বিলু জিজ্ঞেস করে ও ভালো আছে কি না। তারপর ছুটির হাতটা নিজের দু-হাতের মধ্যে নিয়ে বলে, ‘আমি তোমায় খুব ভালোবাসি ছুটি।’ হাজারটা গোলাপ ফুল ঝরে পড়ে ছুটির হাতের ওপর। ভালোলাগায় চোখ বোজে ছুটি। শুনতে পায় বিলু খুব আস্তে আস্তে বলছে, ‘তোমায় এখনই উত্তর দিতে হবে না। আর উত্তরটা ‘না’ হলেও আমাকে সারাজীবন বন্ধু করেই রেখো। দূরে ঠেলে দিও না।’

ছুটি উত্তর দেয়নি। কোনো মেয়েই উত্তর দেয় না সঙ্গে সঙ্গে। শুধু বুঝতে শুরু করে ওর কালো হয়ে যাওয়া ক্যানভাসের ওপর নতুন একটা সূর্য ওঠার ছবি আঁকা শুরু হয়েছে। কালো অন্ধকার ভেদ করে কমলা রং ছড়িয়ে নতুন ভোর আসছে।

এর মধ্যে মিঠি গেল বিগড়ে। বিলুর ওদের পরিবারের সঙ্গে এতো মেলামেশার আগ্রহ দেখে বেচারী টেনশনে ঘেঁটে গোল হয়ে আছে। বিলুও ওর বিরক্তি বুঝতে পারে। ওর নিজের মতো করে সম্পর্কটা সহজ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ছুটি কিছু বলে না। বিলু প্রায়ই ওকে দেখতে আসে বাড়িতে। ছুটির সঙ্গে গল্প করে। ঠিক আধঘণ্টা। আর সবসময় খেয়াল রাখে যাতে শোভনতার মাত্রা না অতিক্রম করে। বিলুর মাও এসেছিলেন কয়েকবার।

কেমোথেরাপি কলকাতাতে দিতে পারতো ছুটি। ইচ্ছে করেই আবার সাউথে যেতে চেয়েছে। মিঠি, মামা, মামিমাকে নিয়ে বেশ বড়ো টিম। কেমোথেরাপি চলাকালে ডাক্তার পালানিভেলু জানালেন যে, বায়োপসি রিপোর্টে বলেছে খুব ভালো অপারেশন হয়েছে। টিউমার মার্জিন ইজ ফ্রি অফ ক্যান্সার। পুরো খারাপ টিস্যুটাই উপড়ে ফেলা গেছে। ভয়ের আর কোনো কারণ নেই।

মন খুব ভালো ছিল। পরদিন রাতের দিকে হোটেলের ঘরে বসে ছিল ছুটি। ওর মন বলছিল বিলু ওদের ঘরে আসবে। মিঠিকে জোর করে মামাদের লাগেজ প্যাক করতে ওদের রুমে পাঠিয়ে দিয়েছিল ছুটি। ওর হিসাবমতো বিলু এসেছিল। ওকে একা দেখে বেরিয়েও যাচ্ছিল। ছুটি প্রায় জোর করেই ওকে বসিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ উল্টোপাল্টা গল্প করার পর বলে, ‘তোমার সেদিনের করা প্রশ্নটার উত্তর তো শুনলে না?’ মুহূর্তে বিলু ‘ফ্রিজ শট’। ওর অবস্থা দেখে হেসে ফেলে ছুটি। তারপর চোখ বুজে বলে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ।’ চোখ বোজা অবস্থায় বুঝতে পারে ওর কপালে ঠোঁট রেখেছে বিলু। ছুটি সপাটে জড়িয়ে ধরে ওর ভালো লাগার মানুষটাকে। কপাল থেকে ওর ঠোঁটটা নামিয়ে এনে নিজের ঠোঁটের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়।

মিঠি, ছুটি আর বিলু

‘ওর দিকে ওরকম রাগী চোখে তাকিয়ে আছিস কেন? সব হবু জামাইবাবুই তো শ্যালিকাদের মন জিততে চায়।’ প্রায় মরিয়া হয়ে বলে ওঠে ছুটি। মিঠি অবাক হয়ে ছুটির দিকে ফিরে তাকায়। ‘মানে?’ এবার বিলুদার দিকে ঘুরে তাকায় মিঠি – দূর থেকে মিঠির গন্ধমাদনটা ঘাড়ে করে আনছে বিলুদা। মামা-মামিমা নিজেদের জিনিসপত্র নিয়ে অনেকটা দূরে চলে গেছে। কাঁচুমাঁচু মুখ করে ওদের কাছে এসে ব্যাগটা নামিয়ে রাখে বিলু।

‘কী ব্যাপার? ব্যাগটা আমাকে দিয়ে বওয়াবেন নাকি?’ ভুরু নাচিয়ে বিলুকে বলে মিঠি। ‘যতদিন না রাবণরাজা দশটা মাথা নিয়ে হাজির হচ্ছে ততদিন কাজে ফাঁকি দেওয়া চলবে না।’

‘আর তাড়াতাড়ি নীল রুমালটা বার করে দিন। আমিও মাথায় বেঁধে স্টাইল করবো।’

ভয়ে ভয়ে নিজের স্যুটকেস খুলে মিঠির জন্য কেনা নীল রুমালটা বার করে দেয় বিলু। লাল আর নীল রুমাল বেঁধে দুই  বোন হাহা-হিহি করে হাসতে হাসতে এগিয়ে যায়।

একপাল মালপত্র নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অনঘজ্যোতি মনে মনে বলে, ‘শালির মাথায় এক গোডাউনভর্তি ছিট আছে।’