কলম্বাস ও নরখাদক নরগোষ্ঠী

ভূমিকা ও অনুবাদ : সুরেশ রঞ্জন বসাক

ভূমিকা

‘ক্যানিবালস’ বা ‘নরমাংসখেকো নরগোষ্ঠী’ সম্পর্কে আলোচনার আগে এমন প্রাণীর অস্তিত্বের উদ্ভাবক কলম্বাস ও তাঁর ডায়েরি সম্পর্কে কিছু সাধারণ তথ্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক। কলম্বাস একাধারে অনেক কিছু ছিলেন : খ্যাতিমান নাবিক, মানচিত্রকার, প্রাচ্য বিশেষজ্ঞ, ভ্রমণ সাহিত্যের লেখক এবং সর্বোপরি, ‘নিউ ওয়ার্ল্ড’ বা আমেরিকা মহাদেশের (যা প্রকৃতপক্ষে বাহামা দ্বীপপুঞ্জ) আবিষ্কারক। ১৪৯২ সালে তিনি স্পেনের রাজা ফার্ডিনান্ড ও রানি ইসাবেলার আনুকূল্যে এশিয়া মহাদেশের নৌপথ আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে সমুদ্রযাত্রা শুরু করেন। জাহাজের দৈনন্দিন কার্যবিবরণীর পাশাপাশি তিনি যা যা দেখেছেন বা শুনেছেন সেসব লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর লগ-বুক বা ডায়েরিতে। সাহিত্যসমালোচক মাইকেল প্যালানসিয়া রথ আমাদের জানাচ্ছেন, ৯ই সেপ্টেম্বর কলম্বাস সমুদ্রযাত্রার দূরত্ব লিখে রাখার জন্যে দুটো ডায়েরি লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন : একটি তাঁর নিজের জন্য (যা হবে ‘false’ বা ‘সত্যনির্ভর’) এবং অপরটি তাঁর অধীনস্থ নাবিকদের জন্যে (যা ‘ভধষংব’ বা ‘বানোয়াট’)১। অনুমান করা চলে, যিনি তাঁর সহকর্মীদের কৃতিত্ব ভাগাভাগির ভয়ে অসত্য তথ্য পরিবেশন করতে পারেন,  তিনি বৃহত্তর স্বার্থে রাজা-রানির ক্ষেত্রেও তা করবেন। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, তিনি তা-ই করেছেন। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এর সঙ্গে আরো একটি চমকপ্রদ তথ্য যোগ করেছেন : প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের শেষে তিনি দুটি ভার্সন দুই জায়গায় লিখে রাখতেন২। তাঁর প্রথম সমুদ্রযাত্রা শেষে স্পেনে ফেরার কয়েক  রাত আগে কলম্বাসের জাহাজ তীব্র ঝড়ের কবলে পড়ে। তিনি ভাবলেন, তাঁর নাবিকেরা কেউ বাঁচবে না এবং তাঁর কীর্তির পুরো কৃতিত্ব পেয়ে যাবেন অগ্রগামী জাহাজের ক্যাপ্টেন মার্টিন অলনজো পিনুজন। নিজের কৃতিত্ব যাতে বেহাত না হয়, সেজন্য তিনি তড়িঘড়ি তাঁর সমুদয় অভিযান ও আবিষ্কারের বর্ণনা লিখে কাগজগুলি একটি পানিনিরোধক ব্যারেলে ঢুকিয়ে সেটি সমুদ্রে ভাসিয়ে দিলেন। অধস্তনদের প্রতি তাঁর অবিশ্বাস এত বেশি ছিল যে, তিনি তাদের জানালেন, মাতা মেরির কাছে ঝড় থামানোর প্রার্থনার বাণী লিখে তিনি ব্যারেলটিকে সমুদ্রে ভাসিয়েছেন। তাঁর মন্দ কপাল, পরে ঝড় থেমে গিয়েছিল, কিন্তু ব্যারেলটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এসব তথ্য গার্সিয়া মার্কেস তাঁর প্রাগুক্ত সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন৩। কলম্বাসের জাহাজ যদি ডুবে গিয়ে থাকে, তাহলে তাঁর বিবরণও হারিয়ে গেছে। সঙ্গে দ্বিতীয় ভার্সনটিও কি হারিয়ে গেছে? তাহলে কলম্বাসের ডায়েরি কোত্থেকে এলো?

আলোচ্য ডায়েরিটি তাঁর প্রথম সমুদ্রযাত্রাভিত্তিক। তাছাড়া তিনি আরো তিনবার সমুদ্রযাত্রায় বেরিয়েছিলেন। তথ্যমতে, প্রথম সমুদ্রযাত্রা শেষে স্পেনে ফিরে তিনি রানি ইসাবেলাকে তাঁর মূল পাণ্ডুলিপি উপহার দিয়েছিলেন। রানী মূল পাণ্ডুলিপিটি নিজের কাছে রেখে এর একটি অনুলিপি কলম্বাসকে দেন। কলম্বাসের মূল ডায়েরি বা ডায়েরির অনুলিপির কোনো কপি পাওয়া যায়নি। রানী ইসাবেলাকে দেওয়া মূল পাণ্ডুলিপিটিরও সন্ধান নেই। বর্তমানে ‘কলম্বাসের ডায়েরি’ নামে যা পরিচিত তা ডিউক অব দ্য ইনফানদা লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ৭৬টি ফলিওর সারসংক্ষেপ। লাস কাসাসের  সারসংক্ষেপটি ইনফানদা সংস্করণের সারসংক্ষেপেরও সারসংক্ষেপ। আরো স্পষ্ট করে বলা যায়, এটি লাস কাসাসের একদা-পাঠের স্মৃতি থেকে পুনর্নির্মিত কলম্বাস-কাহিনি। অনূদিত এই প্রবন্ধে পিটার হিউম লাস কাসাসের সংস্করণকে প্রধান সূত্র ধরে ভৌগোলিক, নৃতাত্ত্বিক, ভাষাতাত্ত্বিক ও ইউরোপীয় মানস কাঠামো ইত্যাদির আলোকে ‘ক্যানিবাল’ শব্দটির সম্ভাব্যতা/ অসম্ভাব্যতা ও যৌক্তিকতা/ অযৌক্তিকতা পর্যবক্ষণ করেছেন। ক্যানিবালের অস্তিত্ব সম্পর্কে কলম্বাসের দোদুল্যমানতা উন্মোচন করে, কলম্বাসকেই সাক্ষী মেনে, পিটার হিউম এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন : মানুষখেকো মানুষ বলে আসলে কিছু ছিল না; ওরা সব গ্র্যান্ড খানের (কুবলা খান) জনগোষ্ঠী। সেই ইউরোপীয় মগজে ক্যানিবাল আসন গেড়ে বসেছে, তা আর নামানো যায়নি। উইলিয়াম এফ কিপানকে উদ্ধৃত করে স্টেফানি লিভিংস্টোন সাম্প্রতিককালে (২০১৫) মতৈক্যে পৌঁছেছেন, ‘Europeans were fascinated by the notion of cannibals, but there’s no evidence that the ancestors of modern Caribs were ever Cannibals৪’। কৌতুককর বিষয় হচ্ছে, উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগে ‘ক্যানিবাল’ ভিন্ন ভিন্ন ছদ্ম তকমায় অ-ইউরোপীয়দের জন্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বলা যায়, ওরা এখনো ক্যানিবাল ও ক্যালিবানের যুগ্ম সংস্করণ!

বর্তমান প্রবন্ধে পিটার হিউম বারবার ডায়েরিটিকে অপ্রাসঙ্গিকতার চরম নিদর্শন হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন।

প্রথমত, কীর্তি ও প্রাপ্তির প্রত্যাশায় বড় কোনো ভূখণ্ড আবিষ্কারের অন্তর্তাগিদ কলম্বাসকে অতিরঞ্জন ও অপ্রাসঙ্গিকতার দ্বারস্থ করেছে। দ্বিতীয়ত, তাঁর ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক উচ্চমন্যতা, ঔপনিবেশিক মানসগঠন, সাম্রাজ্য ও ধর্মবিস্তারের স্পৃহা, অ-ইউরোপীয়দের প্রতি অপরত্ব (otherness) আরোপের মানসিকতা এবং ইউরোপীয় ধাঁচের বোধ-পূর্ব সংস্কার (হাইডেগারের ভাষায় ‘pre-understanding’) ইত্যাদি একজন অনুসন্ধিৎসু নাবিকের নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। তিনি হয়ে উঠেছেন একজন উপনিবেশবাদী ‘এল ডোরাডো’ (স্বর্ণরাজ্য)-সন্ধানী আধা বিজ্ঞানী, আধা যাজক, আধা লেখক এবং শতভাগ ঔপনিবেশক। তাঁর ঐতিহাসিক ভুল পর্যবেক্ষণগুলি দেখলে এ-ধারণার যথার্থতা বোঝা যাবে। ৯ই জানুয়ারি ১৪৯৩ ভুক্তিতে তিনি আফ্রিকার সমুদ্র-উপকূল থেকে দূরে গরুসদৃশ সামুদ্রিক প্রাণী (‘manatees’) দেখে  মৎস্যকন্যা বলে (‘mermaid’) উল্লেখ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে পুরাণ কাহিনিতে এর দেখা মেলে, বাস্তবে নয়। তিনি বাহামা দ্বীপপুঞ্জে (গুয়ানাহানি) পৌঁছে ভেবেছিলেন এশিয়ায় পৌঁছে গেছেন। অথচ তখন তিনি চীন থেকে ৮০০০ মাইল দূরে অবস্থান করছিলেন। তাঁর অভিযানের লক্ষ্য ছিল গ্র্যান্ড খানের রাজ্যে পৌঁছানো এবং ভারত, জাপান ও চীনের জলপথের সন্ধান। তিনি পৌঁছেছিলেন গুয়ানাহানিতে, অথচ তিনি আমৃত্যু বিশ্বাস করেছিলেন তিনিই আমেরিকা আবিষ্কার করেছেন। ইতিহাস বলে, কলম্বাসের কথিত আমেরিকা আবিষ্কারের ৫০০ বছর আগে লেইফ এরিকসনের নেতৃত্বে একদল ভাইকিং উত্তর আমেরিকায় পা রেখেছিল এবং বসতি স্থাপন করেছিল। আরো ন্যক্কারজনক সত্য হলো, স্পেনীয় নাবিক রদ্রিগো দি তিয়ানা সর্বপ্রথম আমেরিকার ভূমি দেখে চিৎকার করে উঠেছিলেন, ‘Tierra! Tierra!’ (ওই যে স্থলভাগ দেখা যায়)! এ তথ্য রদ্রিগোর ক্যাপ্টেন (অন্য জাহাজের) কলম্বাসকে জানান। এদিকে কলম্বাস তাঁর ডায়েরিতে দাবি করেছেন, তিনি রদ্রিগোর চার ঘণ্টা আগে ‘একটি মোমবাতির মতো আলো দেখেছিলেন, তবে এটি যে স্থলভাগ ছিল তা অস্বচ্ছতার জন্যে দাবি করার সাহস পাননি৫’। ৭ই জুলাই ১৫০৩ ভুক্তিতে তিনি পশ্চিমে ‘লঙ্গা নদী’ থেকে মাত্র উনিশ দিন দূরত্বে অবস্থান করছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। ওই সময়ে কিন্তু তিনি জ্যামাইকা, কিউবা, হন্ডুরাস ও নিকারাগুয়া পরিভ্রমণে ব্যস্ত। তাঁর সবচেয়ে বিতর্কিত ভুক্তি হলো ক্যানিবালবিষয়ক। ইউরোপীয় মানসে বহু আগে থেকেই কুকুরের-মতো-মাথাঅলা মানুষের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। কলম্বাস বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীর সর্বদক্ষিণে মানুষখেকো মানুষ প্রকৃতই বিদ্যমান ছিল। অতএব যখন তাঁকে স্থানীয় অধিবাসীরা জানাল, জাহাজে চেপে এক হিংস্র যুদ্ধংদেহী প্রজাতির মানুষেরা এসে ওদের কাউকে কাউকে ধরে নিয়ে গেছে যারা আর ফেরেনি, অতএব আগন্তুকেরা মানুষখেকো মানুষ। তাঁর বোধ-পূর্ব সংস্কার ও নতুন তথ্যের চাক্ষুস সত্যতা ব্যতিরেকে কেবল অনুমানের ওপর ভর করে জন্ম নিল ‘ক্যানিবালস’ তত্ত্ব। অন্যান্য ঔপনিবেশিক তত্ত্বের সঙ্গে এই তত্ত্ব সভ্য-অসভ্য দ্বান্দ্বিকতার মাত্রাকে মিথের উচ্চতায় নিয়ে গেছে। পিটার হিউমের প্রবন্ধটি এই তত্ত্বের বিপৌরাণিকায়নের একটি ধীমান প্রচেষ্টা।

মূল রচনা

অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধানের প্রাথমিক ভুক্তিতে ‘cannibal’ শব্দটির সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে : ‘একজন মানুষ (বিশেষত, অসভ্য) যে নরমাংস খায়; নরখাদক, রাক্ষস।

আদিতে অ্যান্টিলিজ বা দক্ষিণ আমেরিকার দ্বীপপুঞ্জে বসবাসরত রেড ইন্ডিয়ান নরখাদক গোষ্ঠীর নামবাচক বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো।’ রূপতত্ত্বের বিচারে কিংবা অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধানে ‘cannibal’ শব্দটির গঠন-ইতিহাসের ব্যাখ্যা অনেকটা সতর্কতামূলক। ভুক্তির মূল অংশের পাঠ এরকম : (ষোড়শ শতকে প্রচলিত, বহুবচন ‘Cannibales’, বানান Canibales-এর ব্যুৎপত্তি Carib বা Caribes – নৃতত্ত্বিক এই দুটো নামের যে কোনো একটি থেকে, এরা ওয়েস্ট ইন্ডিজের একটি হিংস্র জাতি, যাদেরকে মানুষখেকো হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, এবং পরবর্তীকালে ‘ক্যারিব’ বা ‘ক্যারিবস’ নাম থেকে এই বর্ণনাত্মক শব্দটির সম্প্রসারিত রূপ উদ্ভূত …)

এই হচ্ছে ‘cannibal’ শব্দটির ইংরেজিতে ধারণকৃত ‘অকৃত্রিম’ রূপতাত্ত্বিক বর্ণনা। তবু এটি আদর্শিক বিবরণই থেকে যায় যা শব্দটির ব্যবহারবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক প্রশ্নগুলিকে ধামাচাপা দেওয়ার কাজ করে – ভাষাতাত্ত্বিক রূপতত্ত্বের চেয়ে অসংলগ্ন শব্দগঠনের উৎস সন্ধানের নামে। ‘যাদেরকে মানুষখেকো হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে’ – এই শব্দবন্ধে অবদমনের আলামত স্পষ্ট যা আপাতনির্দোষ পরোক্ষ উক্তিতে, কোনো বিশেষজ্ঞ কর্তৃপক্ষের (যেমন বিশেষজ্ঞ প্রণীত গ্রন্থের উল্লেখ) অনুপস্থিতিতে, নিরপেক্ষ ও যথার্থ পর্যবেক্ষণের মুখোশ পরে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ইতিহাস উপস্থাপন করে।

‘… লিপিবদ্ধ করা হয়েছে’ – এর স্বরভঙ্গি এমন একটি ধারণা দেয় যেন এক উনিশ শতকি নৃতত্ত্ববিদ নোট বুক ও পেনসিল নিয়ে প্রসন্নমনে তাঁর সামনে দৃশ্যমান অসভ্য বর্বরদের আচারানুষ্ঠানের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করছেন। ‘নিরপেক্ষ প্রতিবেদন’ হিসেবে এটাকে আজকের দিনে অগ্রহণযোগ্য মনে হতে পারে, তবুও নথিভুক্ত নিচের উদ্ধৃতির জটিলতার তুলনায় সরলতার প্রতিমূর্তি মনে হবে।

১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে নভেম্বর ক্রিস্টোফার কলম্বাস একটি দ্বীপে এসে পৌঁছলেন। ‘তাঁর সহগামী রেড ইন্ডিয়ানরা এটাকে ‘বোহিও’ নামে ডাকতো’। কলম্বাসের জার্নাল অনুসারে, এসব ইন্ডিয়ানকে তিনি অ্যারাওয়াক্স নামে উল্লেখ করেছেন :

আমাকে জানিয়েছে, অঞ্চলটি ছিল বিরাট ও বিস্তীর্ণ। ওখানে এমন এক প্রজাতির মানুষ ছিল যাদের কপালে ছিল একটি চোখ। আরেক প্রজাতির মানুষও ছিল যাদেরকে ওরা cannibal বা মানুষখেকো মানুষ নামে ডাকতো। শেষোক্তদেরকে ইন্ডিয়ানরা ভীষণ ভয় পেতো এবং ওরা যখন দেখতো এই পথ দিয়ে নরখাদকরা এগিয়ে আসছে, ওরা নির্বাক হয়ে যেতো। কারণ ওরা জানে, এই নরখাদকেরা তাদের অতীতে খেয়ে ফেলেছিল এবং এরা দেখতে বেশ যুদ্ধংদেহী। (কলম্বাস [১৮২৫] ১৯৬০ ৬৮-৯)

এই প্রথম কোনো ইউরোপীয় টেক্সটে ‘পধহরনধষবং’ শব্দটি দৃশ্যমান হলো এবং এটি তৎক্ষণাৎ মনুষ্য-মাংস খাওয়ার প্রথার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল। অতএব কলম্বাসের জার্নাল, ন্যূনতম অর্থে হলেও, একটি ‘সূচনাকারী টেক্সট।’

কিন্তু ঠিক কোন অর্থে এই নামকরণ এবং এই বর্ণনা ‘রেকর্ড’ হিসেবে অভিহিত হতে পারে? প্রথমেই বিবেচনা করা যাক, আসল টেক্সটটি যেখানে, ধারণা করা হয়, কলম্বাস নামটি লিখেছিলেন – সেটি ষোলো শতকের মাঝামাঝি একটিমাত্র জ্ঞাত কপিসহ হারিয়ে যায়। কেবলমাত্র যে-ভাষ্যটি আমাদের রয়েছে এবং ওপরের উদ্ধৃতিটি যে-ভাষ্য থেকে নেওয়া হয়েছে, তা একটি হাতে-লেখা সারাংশ এবং এটি লিখেছেন বার্তোলোমি ভি লাস কাসেস, সম্ভবত ১৫৫২ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি সম্ভবত সেভিয়ের স্যান পাবলো মঠে সংরক্ষিত কলম্বাসের মূল কপি থেকে নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে লাস কাসেসের মূল পাণ্ডুলিপির কতিপয় প্রতিলিপি প্রকাশিত হয়েছে। অতএব অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারির ভুক্তির ‘যাদেরকে মানুষখেকো হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে’ – বাক্যাংশের আপাতস্বচ্ছতা ভাষার ক্রমশ ঘনতর স্তরের প্রলেপে দ্রুত অস্বচ্ছ হয়ে যায়। ফলত আমরা পাচ্ছি : একটি হারিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপির কপির সারাংশের প্রতিলিপি। এটি একটি সংশোধিত সংস্করণ এবং কিছু সম্ভাবনা-সাপেক্ষ কিন্তু সুনিশ্চিত কিছু নয়। যা আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ তা হলো বিবরণটির অন্তঃস্থ অনচ্ছতা। কলম্বাসের ‘রেকর্ড’ জানাচ্ছে ‘canibales’ প্রজাতির মানুষগুলি ভিন্ন প্রজাতির মানুষদের খেয়ে ফেলত, যা কোনো মৌলিক পর্যবেক্ষণ নয়, বরং এটি অন্য এক ব্যক্তির বর্ণনার তস্য বর্ণনা। অধিকন্তু উদ্ধৃত শব্দসমষ্টি এমন একটি ভাষায় বিনিময় হয়েছিল যে ভাষা সম্পর্কে কলম্বাসের কোনো পূর্বজ্ঞান ছিল না। তিনি ভাষাটি বোঝা ও চর্চার জন্য সময় পেয়েছিলেন সর্বোচ্চ ছয় সপ্তাহ।

এই অনুচ্ছেদটি ঘিরে একগুচ্ছ জাতিতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক প্রশ্ন আবর্তিত। … এখানে আমার প্রধান যুক্তি হলো, গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও জাতিতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক প্রশ্নগুলি বয়ানভিত্তিক অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নাবলির তুলনায় গৌণ অবস্থানে চলে গেছে। একটু ঘুরিয়ে যদি বলি, এটা-সেটা প্রমাণের জন্যে সাক্ষ্য হিসেবে বিভিন্ন অনুচ্ছেদ থেকে বিক্ষিপ্তভাবে যেসব উদ্ধৃত করা হয়েছে, সেগুলির চাইতে বরং মূল টেক্সটের বৃহত্তর অংশ এবং এর ওপর প্রণীত ব্যাখ্যাগুলি সর্বাগ্রে নিরীক্ষণ করা প্রয়োজন। তা না হলে আদৌ কোনো অর্থপূর্ণ সিদ্ধান্তে আসা যাবে না।

El diario de colon বা কলম্বাসের জার্নাল সম্পর্কে কিছু লেখার আগে আমাদের কেবল বিশ্বাসে ভর করে এক বিশাল লাফ দিতে হবে, যার অর্থ হলো, আমাদের এমন একটি পূর্বানুমান করে নিতে হবে যেন মূল পাণ্ডুলিপির সারাংশের প্রতিলিপির সঙ্গে ১৪৯২-৯৩ খ্রিষ্টাব্দের শীতের মাসগুলিতে কলম্বাসের আটলান্টিক পেরিয়ে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত ভ্রমণের ঐতিহাসিক বাস্তবতার কোনো অর্থবহ সম্পর্ক রয়েছে!

একেবারে কোনো সম্পর্কই নেই, এমনটি ধরে নেওয়া যেমন অসহায়ক, চিত্তবৃত্তির পরিচায়ক হবে, তেমনি, অতিবিশ্বাস ও চিন্তনহীনতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে যদি আমরা জার্নাল-এর ‘সব কথাকে অকপট, অকৃত্রিম ও নিরলংকার’ ভেবে বসি। এ কাজটি কেউ কেউ করেছেন। এখানে সুনিশ্চিত সতর্কতা প্রয়োজন। তারপরও জার্নালটিকে একজন প্রাধিকারভোগী প্রত্যক্ষদর্শীর আবিষ্কারের ডকুমেন্ট কিংবা একটি নির্ভুল নৃকুলতাত্ত্বিক রেকর্ড হিসেবে বিবেচনা না করে যদি আমেরিকা মহাদেশে ইউরোপীয় অভিযানের আদি আখ্যান হিসেবে গণ্য করা হয়, তখন এর জটিল মূল পাঠবিষয়ক ইতিহাস এবং কিঞ্চিৎ সংশয়াত্মক অবস্থান বর্ণিত অবিশ্বাস্য কাহিনির তুলনায় গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।

সে যাক। এ যুক্তি মোটেও কলম্বাস ও তাঁর জার্নালকে ইতিহাস থেকে উৎপাটনের পক্ষে নয়। … বরং বলা যেতে পারে, এ-যুক্তির উদ্দেশ্য হলো কিছু প্রশ্নের ঐতিহাসিক নির্ভুলতা ও বিশ^াসযোগ্যতা যাচাই-বাছাই করা যেন সম্পূর্ণ টেক্সটিকে যথা আলোকে প্রত্যক্ষ করা যেমন সম্ভব হবে, তেমনি এর বর্ণনাশৈলী সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সম্ভব হবে। অধিকন্তু পারস্পরিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ারও ভাষাতাত্ত্বিক প্রসঙ্গাদির এবং অলংকারের প্রকারাত্মকতার মূল্যায়নও সহজ হবে। এমন পঠন-প্রক্রিয়ায় আত্মজৈবনিক প্রশ্নগুলিকেও আপাতত মুলতবি রাখা যায় : আমরা যে কলম্বাসের কথা বলছি, সেই ব্যক্তি কলম্বাস এই মুহূর্তে প্রকৃত পাঠাংশের প্রয়োগিক কর্ম (texture function) বই বেশি কিছু নয়।

জার্নাল-এর ‘আমি’ প্রতিলিপিকারের ‘আমি’র হস্তক্ষেপের ঠেলায় মাঝেমধ্যে নাম পুরুষে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।

জার্নালটি শ্রেণিগত বিবেচনায় অদ্ভুত বইকি। এটি অংশত একটি  লগ-বুক বা দৈনন্দিন কার্যাবলির লিখিত বিবরণ। এখানে কলম্বাসের সমুদ্র অভিযান চলাকালে তাঁর জাহাজের যাত্রাপথ, অবস্থান ইত্যাদির আদ্যোপান্ত বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে। ভাষ্যকারেরা প্রায় সবাই এ-ব্যাপারে একমত যে, সাড়ে ছয় মাস সমুদ্রযাত্রার প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় কলম্বাস তাঁর ডায়েরি লিখতেন; তিনি কখনো তা পরিমার্জন করেননি কিংবা পুনর্বার লেখেননি এবং প্রকাশনার কথা মাথায় রেখে লেখেননি। এতে এই ধারণা সুনিশ্চিতভাবে স্পষ্ট হয় যে, এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো : প্রতিদিন নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ ও সমস্যাকে কলম্বাস কীভাবে মোকাবিলা করেছেন জার্নালে সেসবের উপস্থাপন। তা সত্ত্বেও গোত্রগতভাবে জার্নাল যদি নৌ বা নাবিক সংক্রান্ত নথি হয়ে থাকে, তাহলে ভিন্নার্থে এটি একটি ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা, একটি নৃতাত্ত্বিক নোটবই এবং প্রাচ্য সম্পর্কে ইউরোপীয় উদ্ভট কল্পনার সংকলন – একটি যথার্থ প্রক্ষিপ্ত ও পুনর্লিখিত পাণ্ডুলিপি।

‘যার কাছ থেকে পরবর্তীকালে নামটি একটি বর্ণনাত্মক শব্দ হিসেবে বিস্তৃতি লাভ করেছে।’ ভাষাতাত্ত্বিক শব্দগঠনবিদ্যা ‘নরমাংসাশী’ এবং নরমাংসভক্ষণ প্রথা – এই দুইয়ের আন্তঃসম্পর্কের ওপর কেবল মনোনিবেশ করেছে। আমরা এই প্রথমবারের মতো কোনো ইউরোপীয় টেক্সটে শব্দটির উল্লেখ দেখলাম এবং তা উপর্যুক্ত প্রথার ছদ্মাবরণে ব্যাখ্যাত হয়েছে। ভাষাতত্ত্ববিদের জন্য এটি সন্তোষজনক বটে, কিন্তু মোটেও সহজাত আগ্রহোদ্দীপক নয়। বিশেষত আমরা যখন দেখি, ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে নভেম্বর কলম্বাস-কর্তৃক ভুক্তির পর থেকে অদ্যাবধি শব্দটি যতবার প্রামাণ্য দলিলপত্রে ব্যবহৃত হয়েছে, ততবারই তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপর্যুক্ত প্রথার অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে। এটি ইউরোপীয় ভাষা-পরিবারের অন্তর্জগতে এত দ্রুততা ও সাগ্রহে গৃহীত হয়েছে যে, মনে হওয়া স্বাভাবিক যেন সেসব ভাষার অন্তঃকরণে শব্দটির জন্যে একটি শূন্যস্থান উষ্ণ আতিথেয়তা নিয়ে এতদিন অপেক্ষা করে ছিল। ‘নরমাংসভোজন’ (anthropophagy) নামক বেচারা পারিভাষিক শব্দটি যদিও ঠিক অনাথ হয়ে যায়নি, তবে তাকে অন্তত উনিশ শতক পর্যন্ত হিমঘরে পাঠানো হয়েছিল। ওই সময়ে নতুন নতুন জ্ঞানকাণ্ডের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পণ্ডিতেরা নির্ভরযোগ্য তথ্যের জন্যে, ধ্রুপদী পরিভাষার দ্বারস্থ হতে থাকেন এবং বিলম্বে হলেও শব্দবন্ধটিকে পুনর্বাসিত করলেন।

সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, প্রারম্ভিক অনুচ্ছেদের একেবারে  শুরুতেই ‘ক্যানিবাল’ শব্দটি এবং নরমাংস ভক্ষণের ধারণার মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক সংশয়বিদ্ধ হয়ে পড়ে। লা কাসাস লিখেছেন :

অ্যাডমিরাল জানালেন যে, তিনি বেশ বিশ^াস করেন এর মধ্যে কিছু একটি ‘কিন্তু’ রয়েছে। যেহেতু তারা অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ছিল, তাছাড়া তারা বুদ্ধিমান প্রাণী (সাংস্কৃতিকভাবে হিস্প্যানিক) এবং তাঁর ধারণা, তারা কিছু মানুষকে আটক করে রেখেছে; যেহেতু আটককৃত মানুষেরা তাদের স্বভূমিতে ফিরে আসেনি, তাই এরা বলছে, ওরা মানুষগুলোকে খেয়ে ফেলেছে।

যেহেতু কলম্বাস তাঁর সংশয়াত্মক অবস্থানের কারণে শব্দটির ইতিহাস সন্ধান করেননি, তাই এই অনুচ্ছেদের প্রতি ভাষাতাত্ত্বিক শব্দগঠনবিদ্যার কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। নৃকুলবিদ্যার জন্যও বিষয়টি সম্ভবত আগ্রহোদ্দীপক ছিল না; ফলে তা কেবল কলম্বাসের প্রাথমিক সংশয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তা সত্ত্বেও নৃবিজ্ঞান শেষ পর্যন্ত কলম্বাসকে অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী হিসেবে মেনেছে। সংশোধনবাদী নৃকুলবিদ্যা স্থানীয় ‘নরমাংসভক্ষণ’ তত্ত্বটি অতিরঞ্জন বর্জন করে বিশ্বাস করেছে বিধায় প্রাগুক্ত অনুচ্ছেদটিকে ইউরোপীয় যুক্তিবাদের ক্ষণস্থায়ী কণ্ঠস্বর হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু তা শেষতক অ্যারাওআকদের (ক্যারিবীয়) চিরাচরিত শত্রুপক্ষের ‘মান গেল, মান গেল’ উচ্চ নিনাদের আড়ালে চাপা পড়ে যায়। গভীর পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে টেক্সটের বৌদ্ধিক জটিলতাগুলি একটি ভিন্ন পাঠের ইঙ্গিত দেয়। কলম্বাসের জার্নালের সবচেয়ে বড়ো বৈপরীত্য হলো : যদিও ১৪৯২-৯৩ খ্রিষ্টাব্দের এই সমুদ্রযাত্রা ইউরোপ ও আমেরিকায় একটি ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রেখেছিল এবং এখনো তা মানবজাতির অসাধারণ অর্জনগুলির একটি হিসেবে বিবেচিত, তথাপি তা বহু ভুল বোঝাবুঝি, ব্যর্থতা এবং হতাশারও কারণ হয়েছিল। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো ভুল ছিল – তিনি এশিয়ায় পৌঁছেননি, যা ব্যর্থতার পরিমাপে এত অবিশ্বাস্য ছিল যে, কলম্বাসের জন্যে তা স্বীকারের দায় দুর্বহ ছিল। আর ছোটখাটো ভুলের জায়গাগুলিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

সংক্ষেপে, জার্নালের লক্ষণাত্মক পাঠ দুটো ভিন্ন ধারার বৌদ্ধিক পাঠ-কাঠামো নির্দেশ করে। মোটা দাগে, প্রতিটি ডিসকোর্স কতগুলি প্রধান শব্দ দিয়ে চিহ্নিত করা যায়। একটিতে যেমন ‘স্বর্ণ’, ‘ক্যাথে’  (‘চীন’ বোঝাতে), ‘গ্র্যান্ড খান’, ‘বুদ্ধিমান সৈনিক’ ইত্যাদি শব্দের প্রাবল্য রয়েছে, অপরটিতে তেমনি ‘স্বর্ণ’, ‘আদিমতা’, ‘পৈশাচিকতা’, ‘নরমাংসভক্ষণ’ ইত্যাদি শব্দের পুনঃপৌনিকতা দৃশ্যমান। সমন্বিত বিবেচনায়, প্রতিটি ডিসকোর্সকে যথাক্রমে মার্কো পোলো ও হেরেডেটাসের  একক উৎস টেক্সটের গোত্রভুক্ত করা যায়। অধিকতর সাহসী বিশেষজ্ঞরা এর একটিকে প্রাচ্য সভ্যতার ডিসকোর্স এবং অন্যটিকে বর্বরতার ডিসকোর্স হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ দুটোই ক্ল্যাসিকাল যুগের ‘বিষয়’ ও ‘উদ্দেশ্য’-ভিত্তিক দলিল-দস্তাবেজের মহাফেজখানা। অনেকে বলতে প্রলুব্ধ হন, প্রথম ডিসকোর্সটি ভূয়োদর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং শেষেরটি মনোগত প্রক্ষেপণ। কিন্তু এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হবে আন্তঃদ্বান্দ্বিকতা। ইউরোপ ও দূরপ্রাচ্যের মধ্যে, সবিরাম হলেও, শত শত বছর ধরে যে বাণিজ্য চলেছিল, এর বস্তুগত বাস্তবতা বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে কিংবা এর ফলাফল হিসেবে কিছু ইউরোপিয়ান দূরপ্রাচ্য ভ্রমণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা যা লিখেছেন, তা কোনোভাবেই ‘তাঁরা যা দেখেছেন’ তার সরল প্রতিফলন নয়। এজন্যে আমাদের শনাক্তযোগ্য ডিসকোর্সের দিকে মনোনিবেশ করা শ্রেয় হবে। সেখানে আমরা দেখি, প্রাচ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে শব্দ ও শব্দবন্ধের এক রীতিমতো দুর্দান্ত প্রদর্শনী করা হয়েছে : অধিকাংশই সম্পদ ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক। তা তাঁরা করতেই পারেন, কেননা তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন তাঁদের ইউরোপ কি না বহু বছর ধরে প্রাচ্যে সোনা-রুপার বিশাল বিশাল চালান পাঠিয়েছিল। ইত্যাকার চিরাচরিত ধারণাসূত্রের সুপরিচিত প্রয়োগ দেখা যায় মার্কো পোলোর বিবরণে। বস্তুতপক্ষে গ্রিসের ‘আদিম অসভ্য’ প্রতিবেশীদের বিষয়ে হেরোডেটাসের ‘তদন্ত’ (‘Investigation’) প্রকাশের কাল থেকে এই অসভ্যতা-বর্বরতার ডিসকোর্স খুব সামান্যই বদলেছে। স্থানের পরিবর্তন হয়েছে বটে, কিন্তু আমাজন জঙ্গল, মনুষ্যমাংস ভক্ষণ, আফ্রিকা-ইন্ডিয়ার কুকুর-মাথা নরকুল (cynocephali) – ইত্যাদির বিবরণ অপরিবর্তনীয় রয়ে গেছে টিটিয়াস (Tetius, গ্রিক ইতিহাসবিদ), প্লিনি (Pliny, রোমান অভিধানবিদ ও লেখক), সলিনাস (Solinus, রোমান ভূগোলবিদ ও সংকলক) এবং আরো অনেকের লেখায়। এই ডিসকোর্স ছিল আধিপত্যবাদী, এই অর্থে যে, এটি একটি জনপ্রিয় শব্দভাণ্ডারের জোগান দিয়েছিল যার লক্ষ্য ছিল ‘অন্যত্ব’ (otherness) প্রতিষ্ঠা করা। এবং এটি টেক্সটের অনুকরণের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। পাঠগত নির্ভরযোগ্য জ্ঞান বলতে যা বোঝায় তা কলম্বাস পেয়েছিলেন পিয়ের দ্য এইলি ও অ্যানিয়াস সিলভিয়াসের কাছ থেকে এবং অবশ্যই ‘মার্কো পোলো’ নামে পরিচিত টেক্সট থেকে। শেষোক্ত উৎসটিকে ফরাসি ভাষার রোমান্স লেখকের১ ‘বিভাজিত বিশ্ব’ (Divisament dou Monde) হিসেবে গণ্য করা সংগত হবে; বইটি ইতোমধ্যে জট-খোলার-অযোগ্য অপ্রাসঙ্গিকতার সংযোগস্থল হিসেবে বিবেচিত।

কলম্বাস শুরুর দিকের সপ্তাহগুলিতে বিদ্যমান দুটো ডিসকোর্সের মধ্যে নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষায় এক ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন বলে প্রতীয়মান, কিন্তু তিনি বাহ্যত কোনো সাংঘর্ষিক অবস্থানে যাননি। তিনি পারস্পরিক সম্পর্কের তুলনা করেছেন অতীত ও বর্তমান – দ্বান্দ্বিকতার সঙ্গে :  এটি হলো আদিম বর্বর ‘বিশ্ব’ যার সঙ্গে আমরা ‘ক্যাথে’র (প্রাচীন চীন) যোগসূত্র খুঁজে পাই। কিন্তু দ্বান্দ্বিকতার দুটো সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র রয়েছে : একটি সচেতন স্তরে যা টেক্সটের অন্তর্গত বর্তমানে নিহিত, অপরটি অচেতন স্তরে অর্থাৎ যা টেক্সটে অবর্তমানতার জন্যই উপস্থিত বা বর্তমান এবং যাকে ফেলে যাওয়া স্মৃতিচিহ্ন থেকে পুনর্নির্মাণ করতে হয়। সচেতন দ্বন্দ্বের দুটো মৌলিক উপাদান – এক. মার্কো পোলোর ডিসকোর্সের ‘গ্র্যান্ড খানের সৈন্যসামন্তগণ’; দুই. হেরোডেটাসের ডিসকোর্সের ‘কর্তৃত্বপরায়ণ বর্বর জনগোষ্ঠী’। উভয়েই একমাত্র পরিচায়ক চিহ্ন (signifier) – ‘ক্যানিবাল’ শব্দটির জন্য যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ২৩শে নভেম্বরের ভুক্তিতে কলম্বাসের দোদুল্যমানতা একটি বৃহত্তর রেফারেন্স কাঠামোর অন্তর্গত যেখানে ‘ক্যানিবাল’ শব্দটিকে তাঁর আতিথ্যপ্রদানকারী আদিবাসীরা নিরন্তরভাবে ‘মানুষখেকো’ হিসেবে তকমা প্রদানের চেষ্টা করেছে, যা তাঁকে অবধারিতভাবে ‘দ্য গ্রান খান’ (El Gran Can)-এর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল। অনেক ভুক্তিতে এই ‘ধ্বনিগুচ্ছ’কে বারবার প্রতিধ্বনিত হতে দেখি। ২৩শে ডিসেম্বরে এসে ‘ধ্বনিগুচ্ছ’ শেষতক একটি অন্তর্গত মীমাংসায় পৌঁছে :

মনে হওয়া স্বাভাবিক, ওরা অপর একটি বুদ্ধিমান জাতির দ্বারা বারবার পর্যুদস্ত হচ্ছে। এসব দ্বীপের অধিবাসীরা মানুষখেকো মানুষদের ভয়ে সারাক্ষণ তটস্থ থাকে। এবং আমি বিভিন্ন সময়ে যা বলেছি, এখানে তার পুনরাবৃত্তি করছি : মানুষখেকো মানুষ আসলে গ্র্যান্ড খানের (Grand Can) জনগোষ্ঠী ছাড়া কিছু নয় (que Caniba no es otra sino la gente del Gran Can) যারা খুব সম্ভবত আশেপাশে কোথাও বাস করে। তাদের জাহাজ রয়েছে, অতএব তারা দ্বীপবাসীদের ধরে নিয়ে যেতে আসবেই। যেহেতু বন্দিরা ফিরে আসে না, তাই তারা বিশ্বাস করে, তাদেরকে খেয়ে ফেলা হয়েছে। (কলম্বাস ১৯৬০ : ৯২-৯৩)

দুই ‘ÔCan’ আসলে এক। এই গুরুত্বপূর্ণ শনাক্তকরণও সেকেলে হয়ে গেছে বহু আগে। অতএব ‘Canibal’ অর্থাৎ নরমাংসখেকো মানুষ  – ধারণাটি স্রেফ বাতিল হয়ে যাওয়া উচিত।

তথ্য নির্দেশ : ভূমিকা

১. Palencia-Roth, Michael. “Prisms of Consciousness : The ‘New Worlds’ of Columbus and García Marquez.” Shaw, Bradley A. and Vera-Godwin, Nora (eds.), Critical Perspectives on Gabriel García Márquez. Soeity of Spanish and Spanish American Studies, USA, 1986. pp 15-32.

২. উদ্ধৃত। প্রাগুক্ত।

৩. প্রাগুক্ত।

৪. William F Keegan. D×…Z  Stephanie Livingston, ‘History Re-written: Christopher Columbus and the cannibals’. Florida Museum of Science, March 9, 2015.

৫. ঝধসঁবষ ঊষরড়ঃ গড়ৎরংড়হ, অফসরৎধষ ড়ভ ঃযব ঙপবধহ ঝবধ: অ খরভব ড়ভ ঈযৎরংঃড়ঢ়যবৎ ঈড়ষঁসনঁং. ইড়ংঃড়হ, ঘঅ : খরঃঃষব ইৎড়হি, ১৯৯১. ঢ়ঢ়. ২২৪-২৫.

৬. Samuel Eliot Morison, Admiral of the Ocean Sea: A Life of Christopher Columbus. Boston, NA : Little Brown, 1991. pp. 224-25

তথ্য নির্দেশ : মূল

1. Rustichello da Pisa.