কাঁটাতারের গল্প

প্রেমের গল্প কি কখনো মৃত্যুর আখ্যানে শুরু হয়! মৃত্যু তো শেষ পর্যন্ত সব নেয়। ভালোবাসা সেখানে ছাড় পাবে কেন! কিন্তু সুদর্শনের চলে যাওয়ায় তো তাই হলো। চিতাভস্ম থেকে জেগে উঠল অন্য আখ্যান।

মণিরেখা ফোন পেয়েছিলেন সুদর্শন চলে যাওয়ার এক মাসের মাথায়। জানুয়ারির পনেরো, ফেব্রুয়ারির সতেরো। বিকেলের দিকে ফোন এসেছিল। হোয়াটসঅ্যাপ কল। মণিরেখা স্কুল থেকে ফিরেছেন। মাঝারি ফ্ল্যাটটায় আপাতত তিনি একা। স্ক্রিনে অচেনা নম্বর। হোয়াটসঅ্যাপের ডিপিতে কয়েকটি পেকে ওঠা ধানের ছড়া।

গত এক মাস ফোন তুলে তিনি আগের মতো ‘হ্যালো’ অথবা ‘কে বলছেন’ বলেন না। স্কুল থেকে বড় ছুটি নিয়েছিলেন। কাজে যোগ দিয়েছেন দিন সাতেক হলো। সুদর্শন না থাকায় সকালের দিকে ব্যস্ততা অনেক কম। তবু নিজের বেরুনো শুরু হয়েছে।

তবে কাজ থেকে ফিরে বিকেলবেলায় একা। চাপা নিঃসঙ্গতা বিকেলের রোদ এড়িয়ে ফ্ল্যাটের চারতলার ঘরগুলির এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়। মেয়ে হায়দরাবাদে কাজে ফিরে যাওয়ার পর এই একাকিত্বের শুরু। সঞ্চারী যে ক’দিন ছিল প্রায় সময়ই কথা হতো দুজনের। সুদর্শনকে নিয়েই কথা। সঞ্চারী কাজে ফিরে যাওয়ায় এখন তা আর নেই।

সেদিন অচেনা নম্বর চুপ থাকল কিছুক্ষণ। যেন দুদিক থেকেই যতটুকু হয় নীরবতা রাখার চেষ্টা। তারপর কথা বলল ওদিকই। বেশ থেমে বলা কথা। – আমি সিন্ধু। সিন্ধু ইসলাম। রাজশাহী থেকে দূরে আত্রাইতে থাকি।

দপ করে একটি বিদ্যুৎ শিহরণ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত এক মাসে মণিরেখা আর কোনো সংযোগে নেই। মাঝরাতের বুকে ব্যথায় সুদর্শন হঠাৎই চলে যাওয়ার পর সুদর্শন ছাড়া সমস্ত অতীত এখন মৌন। পাহাড়ের মতো নির্বাক। একটি নুড়িও ছিটকে ওঠে না। মণিরেখা বললেন, তুমি কি আর কিছু বলবে?

ও-প্রান্ত বলল, দিনদশেক আগে খবর পেয়েছি। আর কী-ই বা বলার আছে আমার! রাখি।

তারপরও লাইনটা টিকে ছিল কয়েক সেকেন্ড। বাইরের রোদ বেয়ে সময় হেঁটে যাচ্ছিল। রাস্তার মোড়ে গাড়ির এক-দুটি হর্ন। লাইন কেটে গেল।

মাস ছয়েক আগেও যে নাম নিয়ে হুলস্থূল, কখনো তর্ক, তারপর দীর্ঘ চুপ হয়ে যাওয়া, চব্বিশ বছর সংসারের শয়ন-খাটটির একটি পায়া যেন নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। সেই নাম শেষ বিকেলে উঠে এলো কানে। স্কুলফেরত মণিরেখা। নিঃসঙ্গ মণিরেখা। এই নামটি জেনে যাওয়ার পর তা মুখে আনেননি কখনো।  সুদর্শন কখনো বলে ফেললে শুনতে অস্বস্তি হতো একসময়।

কখনো মেয়েটির সঙ্গে কথা হয়নি মণিরেখার। একবার অবশ্য ভেবেছিলেন সুদর্শনের ফোনের কল রেকর্ড ঘেঁটে নম্বরটি বের করেন। সুদর্শন মেয়েটির সঙ্গে কত দূর এগিয়েছে জানা নেই। মণিরেখা ভেবেছিলেন, সুদর্শনের আড়ালে মেয়েটিকে নিজেদের স্থিত দাম্পত্যের কথা জানাবেন। সঙ্গে কয়েকটি মৃদু ধমক। কিন্তু পরে মনে হয়েছে, ঘর না সামলে বাইরেটায় হাত দেওয়ায় হয়তো কিছু রুচিহীনতা রয়ে যায়।

তবে শেষ বিকেলে সিন্ধু নামটিতে আর কোনো অস্বস্তি নেই। কোনো বিরাগ নয়। ছেচল্লিশ বছর বয়স ও কানের ওপর
দু-একটি চুল সোনালি হয়ে-ওঠা মণিরেখার কাছে সিন্ধু যেন গতজন্মের শব্দ। আগে কখনো চেনা। অধুনা বিস্মৃত।

মেয়েটির সঙ্গে ফোনে কথা হলেও তেমন কিছু সে বলেনি। কথা এগোতেও চায়নি। যেন সংক্ষিপ্ত আলাপ করা মাত্র। সুদর্শন একদিন যে শব্দটিকে ঘরে বয়ে এনেছিলেন, প্রথম প্রথম মণিরেখাকে জানিয়েছেন সাধারণ ব্যাখ্যায়, তারপর মণিরেখার একদিন সুদর্শনের অসতর্ক মোবাইলে প্রায় তিন মাসের মেসেজ আবিষ্কার, যেখানে ক্রমাগত নিবেদনের পর নিবেদন, রবীন্দ্রনাথের ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ পাঠ করে সুদর্শনের পাঠানো ভয়েস, ও-প্রান্ত থেকে ভালোবাসার ইমোজি, দেখা হওয়া কিংবা আর কখনো দেখা না হওয়ার আক্ষেপ, মণিরেখার মনে তখন থেকেই আশ্বিনের ঝড়। তর্ক ও রাতের বালিশে নিঃশব্দ অশ্রুপাত। মেয়ের বয়সী একটি মেয়ের সঙ্গে এত দূর?  মণিরেখা চোখ মুছে একদিন সুদর্শনকে বলেছিলেন, চারপাশের অনেক ভাঙনের মাঝে আমাদের ঘরকে আলাদা ভেবে এসেছি। আগামী বছর একসঙ্গে থাকার পঁচিশ বছর হবে আমাদের। তার কাছাকাছি পৌঁছে এই পাওনা!

সুদর্শন চুপ করে থাকতেন।

অথবা বিড়বিড় করে বলতেন, নিজেকে তাড়াতাড়ি সরিয়ে নিয়ে আসব মণি। কখনো বলেছেন, সম্পর্কটি রাজশাহীর মেলায় গিয়ে দুদিনের দেখা হওয়া মাত্র, এর বেশি কিছু নয়। বাকি যা দেখেছ সব ভার্চুয়ালিটি …।

তারপর একসময় বাড়িতে ফোন ধরেননি সুদর্শন। সিন্ধু নামটি উচ্চারণও করতেন না ঘরে। মণিরেখা অবশ্য আপাত শীতলতার ভেতরেও সন্দেহ রেখে গেছেন। সুদর্শনের মধ্যে কোথাও যেন একটি আড়াল। যে-আড়াল বহন করা হয়েছে বাকি ছ-মাস। আকস্মিক মৃত্যু পর্যন্ত।

মণিরেখা স্কুল থেকে ফিরে কিংবা রাতের কথায় মেয়েকে বললেন একদিন। হায়দরাবাদ থেকে সঞ্চারী অবাক হলো শুনে।

বাবার জীবনের সংক্ষিপ্ত একটি আবেগ ও বাড়ির টানাপড়েন আগেই জেনেছিল মায়ের বলায়। সুদর্শন তখন বেঁচে। সঞ্চারী এ-ও জানত, বাবা যেখানে সাময়িক জড়িয়েছে সেই মেয়েটি তার নিজের থেকেও বয়সে ছোট। কিন্তু কী আশ্চর্য তার বাবার মন! মানুষের মন। কোথায় সীমান্তের ওপারের এক মেলা, সেখানে সিন্ধু নামের মেয়েটিও নাকি একা হাঁটছিল। সারারাত গান শোনার ঠেক খুঁজছিল। তারপর বাবার সঙ্গে চা খেতে খেতে দেখা হওয়া। পাশে বসে গান শোনা ও পরে অন্ধকার মাঠ ধরে হাঁটা দুজনের। মায়ের কাছে ধরা পড়ার পর বাবা আবেগে একদিন বলে ফেলেছিলেন, মুর্শিদের খোঁজে হাঁটছিল দুই অন্ধ মুরিদ।

কিন্তু তা-ও ভালো। বাবার ওই যে কর্মব্যস্ত জীবন, চাকরি করতে করতে একঘেয়ে হয়ে ওঠা পেশা, তার ভেতর এদিকের শান্তিনিকেতন, জয়দেবের মেলা, ওদিকে কুষ্টিয়া, সিলেট, শাহজালালের মাজার – বছর বছর এসব থাকছিল। কিন্তু অজান্তে জীবনের শেষ ছ-মাস কী যে হলো! কোত্থেকে জুড়ে এলো অমন একজন। বাবা কেমন বুঁদ হয়ে থাকতেন শেষবার রাজশাহী ঘুরে আসার পর। যেন অন্য কোনো ভাবনা, আর কোনো ডাক। মাকে একদিন বলেছিলেন, মেয়েটির ওই বয়সের বিশ্বাস আমায় টেনেছে …।

মা রাগত স্বরে বলেছেন, অনেক হয়েছে, এবার তুমি ফেরো। দুদিনে এমন কী পেয়েছো যে আমাদের চব্বিশ বছরের মিলিত বিশ^াস ফিকে হয়ে এলো?

বাবার চলে যাওয়া ও মেয়েটির ওই ফোনের পর সঞ্চারী মাকে বলল, তুমি ওকে একদিন ফোন করো মা। এখন আর তেমন চাপের কিছু নেই। শুনে বোঝো কী বলতে চায়। বাবা এমন কিছু করে রেখে যায়নি তো যাতে বড় কোনো টানাটানি হয়! তাছাড়া সীমান্তের এপার-ওপারের ব্যাপার।

মণিরেখা বলেন, তেমন ভুল কি তোর বাবা করবেন? বিশ্বাস করতে পারি না। তবে শেষের ছ-মাস আমার কাছেও তিনি খানিকটা অচেনা হয়ে যাচ্ছিলেন।

সেদিনের সেই নম্বরটিতে তিনি ফোন করলেন অন্য একদিন। নিজের মোবাইলে আগের দিন সেভ করে রাখেননি। পাওয়া গেল প্রয়াত সুদর্শনের ফোন ঘেঁটে। আগে নামে রাখা ছিল, পরে সেভ করা অন্য শিরোনামে – দ্য লাস্ট ইউ। কল করার আগে মণিরেখার মনে দ্বিধা ছিল। ঠিক জায়গা তো! যদিও অনুমান শেষ পর্যন্ত মিলে গেল।

সিন্ধু চিনল। নিশ্চয়ই নম্বরটা ফোনে গুছিয়ে রেখেছিল। বলল, এখন তো টিউশন পড়াতে যাচ্ছি। আপনাকে রাতে বা অন্য কোনো দিন কল করি।

মণিরেখা একটু চুপ হয়ে থাকলেন স্বরের চলনে। হালকা স্নিগ্ধ গলা। বললেন, আমি ফাঁকা। তুমি রাতেও করে নিতে পারো।

সঞ্চারী শুনে হায়দরাবাদ থেকে বলল, কোনোভাবে তুমি আর কল করো না মা। মেয়েটি করলে আলাদা। আর শোনো, কোনো কাগজপত্রের যদি ছবি পাঠাতে বলে ভুলেও দিয়ে ফেলো না। বলবে সব আমার কাছে। আমি নিয়ে গেছি।

মণিরেখা খানিকটা সতর্কই হলেন। আগ বাড়িয়ে ফোন করলেন না। কিন্তু ওদিকের কল আবার এলো দিন তিনেকের মাথায়। সন্ধেয় মণিরেখা বারান্দা থেকে শহর দেখছিলেন। নিচের ডান দিকে কমপ্লেক্সের বড় লোহার গেট। কখনো কোনো গাড়ি এলে-গেলে সে গেট খোলা হয়। নইলে পাশে চলাচলের ছোট গেট। কিছুদিন আগে সুদর্শনকে নিয়ে কাচ-ঢাকা-গাড়ি বড় লোহার গেট পার হয়ে মিলিয়ে গিয়েছিল রাস্তায়। মণিরেখা ওপরের বারান্দা থেকে ভেজা চোখে দেখে গেছেন। পাশে তখন মহিলা-পরিজনরা কেউ কেউ।

ওদিকের গলা বলল, আপনি সেদিন যখন ফোন করলেন আমি তখন সাইকেল নিয়ে পড়াতে যাচ্ছি। কথা হতে পারেনি। আজ তেমন কাজ নেই আমার।

আচমকা ফোন। তবু মণিরেখা যেন কথা বলতে চান। বললেন, তুমি সিন্ধু তো?

ও-প্রান্ত বলল, আমারও মনে হয়েছে কখনোা আপনার সঙ্গে একটু কথা বলি। আপনার নিশ্চয়ই অনেক অভিমান জমা আমার ওপর।

মণিরেখা চুপ করে থাকলেন। গলা শুনে মনে হয় যেন সঞ্চারীর মতো কেউ। সিন্ধুর গলা ধীর ও শান্ত। সুদর্শন কি স্বরের-ও মোহে পড়েছিল! বাড়িতে প্রথমদিকে বলেছিল, রাজশাহীর মেলায় গিয়ে আলাপ। রাতে পাশাপাশি বসে গান শুনতে শুনতে কিছু কথা হয়। অবশ্য মণিরেখা সুদর্শনের হোয়াটসঅ্যাপে দুজনের কথোপকথনের যে আঁচ পেয়েছিলেন, তাতে তার পক্ষে এটিকে অন্য রকম সম্পর্ক ছাড়া আর কী-ই ভাবা সম্ভব! মেয়েটি সুদর্শনকে এক জায়গায় লিখেছিল, রাজশাহী থেকে অল্প দূরে নাটোরে রাণী ভবানীর দেউলে সারা রাতের মেলা হয়। গান হয়। তাছাড়া আত্রাইতে আমাদের গ্রাম ছাড়িয়েই পতিসর, রবি ঠাকুরের কাছারি। তুমি আসবে না? সুদর্শন উত্তরে লিখেছে, সম্ভবত আর কখনোই আমাদের দেখা হবে না সিন্ধু …। মণিরেখা ভেবেছেন, সঞ্চারীর বয়সী একটি মেয়ে সুদর্শনকে তুমি করে কেন-ই বা লিখবে!

খানিক চুপ থাকার পর মণিরেখা বললেন, অভিমান নয়, তোমার ওপর আমার রাগ জমে ছিল। অনেক রাগ। তোমাকে ফোনে ধমকানোর কথাও ভেবেছি। তবে এখন সবই অতীত। রাগ-অভিমান সব। ১৫ই জানুয়ারি উনি সব নিয়ে গেছেন।

সিন্ধু বলল, উনি যখন রাতের দিকে কল করতেন, জানি না তখন কেন অলৌকিকের মতো কথা আসত। নিজের মৃত্যুর কথা বলতেন বারবার। আপনাদের পারিবারিক সম্পর্ক যে বেশ গোছানো তা-ও বলতেন। তবু বলতেন সবকিছু ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা। বলতেন, আমাদের সবাইকে ছেড়ে দূরে কোথাও যাবেন।

তখন খানিকটা এগোচ্ছে মণিরেখার টেলিফোন সংলাপ। বারান্দায় একলা বসে তিনি বললেন, সে-কথা অনেকদিন ধরে আমাদেরও শোনাতেন। আমাকে। মেয়েকে। আমরা শুনতে চাইতাম না। বেশির ভাগ সময়ই হেসে ওড়াতাম। মাস চারেক আগের যে চেকআপ, সেখানে ইসিজি-ইকো সব নরমাল। তবু এমনটা তো হলো …!

রাজশাহী কিংবা আত্রাইর গ্রাম থেকে সিন্ধু কথা বলছিল ধীরগলায়। গোরাই নদীর কাছাকাছি ওদের গ্রাম। সে-গ্রামের ধানের ছড়াই হয়তো ওর ফোনের ডিপি। মেয়েটি বলল, মৃত্যুর কথা আমাকেও বলতেন। বলতেন, খবর পেলে আমি যেন যাই। ওনাকে যেন গোরাই নদীর তীরে নিয়ে আসি। আমি কিছু বলতে চাইতাম না। মনে হতো, মানুষকে তার মৃত্যুর স্বপ্নও বলতে দিতে হয়।

মৃত্যুরও স্বপ্ন থাকে মানুষের! মণিরেখা তার এই ছেচল্লিশ বছর বয়সে শুনলেন। তাকে জানাচ্ছে তার মেয়ের বয়সী একটি মেয়ে, যে সুদর্শনের মৃত্যুভাবনাকেও প্রশ্রয় দিয়েছে। মণিরেখা অবাক হয়ে যান। সিন্ধুকে বলেন, তোমাকে আর কী বলে গেছেন উনি?

বহুদূর অন্ধকার থেকে সিন্ধুর টেনেটেনে বলা কথা। মণিরেখার কানে সুদর্শনের স্মৃতিচারণ। সিন্ধু বলে, আপনাদের সম্পর্ক চব্বিশ বছরের স্থায়ী। সেখানে আমি কে! তবু উনি আমার সঙ্গে জড়ালেন। পরে আমিও খানিকটা। কোনো পরিণতি নেই বুঝে, শেষ পর্যন্ত দূরে যেতে হবে জেনেও। বিচ্ছেদের এটুকু ভাবনা ছাড়া ভালোবাসা গাঢ় হয় না মনে হয়।

সিন্ধু থামল। থেমেই থাকল। অথচ লাইন কেটে গেল না। মণিরেখার মনে হলো ফোনের ওপারে কেউ যেন নীরবে কাঁদছে। সুদর্শনকে যে পেতে চেয়েছে ও চায়নি। না-পাওয়া নিশ্চিত জেনেও এগিয়েছে। সুদর্শনও তাই।

ফোন হাতে নিয়ে মণিরেখা নিথরের মতো বসে থাকলেন বারান্দায়। নিচে পাঁচিলের বাইরে তাদের পাড়ার রাস্তা। বড় রাস্তা খানিকটা দূরে। এদিকটায় কলকাতা শহরের কলরোল ততটা নেই। সুদর্শন দেখে দেখে অপেক্ষাকৃত কম ব্যস্ত এলাকার চারতলায় ফ্ল্যাট নিয়েছিলেন। দূরে চওড়া রাস্তায় পরপর গাড়ি। দূরত্বটুকুর কারণে রাস্তার শব্দও অনেক কম।

অনেক রাতে তিনি কথা বললেন সঞ্চারীর সঙ্গে। মেয়ে শুতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মায়ের কথা শুনল সে। সেদিন যেন মায়ের ভেতরের থেকে বলা কথা। মাকে সিন্ধু যেভাবে যা বলেছে। সঞ্চারী বলল, আমিও আশ্চর্য হচ্ছি মা। এমনটাও হয়!

সঞ্চারী রাগ করল না সেদিন। মাকে কোনো সতর্কতাও শোনাল না। বরং চলে যাওয়া বাবার প্রতি যেন আর একটু মায়া হলো। এত বছর দেখা ও পরে মায়ের হয়ে কথা শোনানোর বাইরে যেন আর এক বাবা। মণিরেখা যখন সম্পর্কটা আবিষ্কার করেছিলেন প্রায় তার পরপরই মেয়েকে খানিকটা বলেছেন। সঞ্চারী দূর থেকে বাবাকে খানিকটা বকাবকিও করেছে। বলেছিল, মাকে যদি আমার কাছে নিয়ে আসি একা তুমি সামলাতে পারবে তো সব?

এদিন সঞ্চারী ঘুমানোর আগে মাকে বলল, তোমার যদি মনে হয় তুমি ওর সঙ্গে যোগাযোগ রাখো। মাঝেমাঝে কথাও বলতে পারো। নিশ্চয়ই খারাপ কিছু হবে না। পারলে ভিসা-পাসপোর্ট করে ঘুরে যেতে বলো একবার।

ফলে মণিরেখা ফোন করলেন আরো একদিন, বিকেলের দিকে। মনে হচ্ছিল বেশ চেনা কাউকে কল করছেন সেদিন। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ওপাশের সেই নরম গলা বলল, আপনাকে আমার মনে আছে।

মণিরেখার গলায় অকারণ ব্যাকুল ভাব। বললেন, কাগজপত্র করে সীমান্ত পেরিয়ে তুমি একবার কলকাতায় এসো। তোমাকে দেখতে চাই, তোমাকে কিছু দিতে চাই আমি। এই যোগাযোগটুকু আমাদের থেকে যাক সিন্ধু।

ওপাশের গলা সামান্য হাসল। বলল, আমাকে উনিও দেখা করার জন্য কলকাতায় যেতে বলতেন। কিন্তু ভিসা-পাসপোর্টের কত যে ঝামেলা। তাছাড়া সময় পাইনি, আবার ভেতর থেকে রাজিও হইনি। বরং চাইতাম কুষ্টিয়া বা সিলেটের কোনো মেলায় আমাদের আবার কোনো দিন দেখা হোক …। আপনি বরং একবার বাংলাদেশে আসুন। আমাকে আপনি কখনো কিছু দেবেন না। আপনাকে বরং আমাদের স্মৃতির জায়গাগুলি ঘুরে ঘুরে দেখাব।

মণিরেখা বললেন, যাব সিন্ধু। কখনো তোমার সঙ্গে দেখা হবে। ওনার স্মৃতির জায়গাগুলি ঘুরে দেখে আসব।