নিতান্তই সহজ-সরল

ক্যানভাস জুড়ে ধীরে ধীরে একজন মানুষের আকৃতি স্পষ্ট হচ্ছে ।

মানুষটি একটা ভাঙা বাড়ির দাওয়ায় উবু হয়ে বসে রয়েছেন।

লম্বাটে মুখজুড়ে ক্ষুরধার দুটো চোখ; খড়ের মতো ঘন ঝাঁকড়া সাদা চুলের ঠিক মাঝখান বরাবর পাহাড়ি রাস্তার মতো চিকন সিঁথি। পরনে ধুতি আর সাদা ফতুয়া।

রেজা মাসুদের খুব চেনা লাগছে উবু হয়ে বসে থাকা ক্যানভাসের মানুষটিকে। তবু তিনি ঠিক চিনতে পারছেন না এ কার মুখ শিল্পীর তুলির আঁচড়ে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে চলেছে ক্যানভাসের গায়ে।

মানুষটার হাতে ধরা একটা সোনালি রঙের পুরনো দিনের দামি ঝরনা কলম। রোল করা দামি কাগজের ওপর ঝুঁকে ক্যানভাসের এ-চরিত্র আসলে কী করছেন তা-ই এক ধাঁধা হয়ে রয়েছে সমবেত শিল্পী-লেখকদের ভেতর।

কিছু কি ভাবছেন তিনি? মুখাবয়বের রেখাগুলি সে-কথা বলছে না; বরং তাকানোটা বড় বেশি বিষণ্ন ঠেকছে; প্রিয় কোনোকিছু হাতছাড়া হয়ে পড়লে মানুষকে যে রকম রিক্ত-নিঃস্ব দেখায়, সে রকম।

মানুষটার কী এমন হারিয়ে গেছে যে কলম নিয়ে ঝুঁকে

থাকতে হবে সাদা কাগজের ওপর?

রেজা মাসুদ ঘুরে-ঘুরে সব দেখছেন আর মাঝে মাঝে শিল্পী-লেখক-কবিদের উৎসাহ দিয়ে মৃদু কণ্ঠে স্মিত হেসে একটা-দুটো হালকা বাক্যবিনিময় করছেন। তাঁর গলায় জড়িয়ে রয়েছে লাল-হলুদ উত্তরীয়; পরনে সোনামুগ রঙের পাঞ্জাবি আর সফেদ পাজামা। ফোঁটা-ফোঁটা ঘাম জমেছে উজ্জ্বল গৌরবর্ণ টাকে। মুখজুড়ে একচিলতে তৃপ্তিভরা হাসি; চটজলদি মনে হবে, এরকম মানুষের কখনো কোনোদিন হতাশা কিংবা উৎকণ্ঠার সঙ্গে পরিচয় হয়নি। এমনি রকম শান্ত-ধীর-স্থির প্রশান্ত তাঁর প্রতিটি চাহনি ও পদক্ষেপ!

তাঁর আশেপাশে স্টিল ও মুভি ক্যামেরার সক্রিয় ছোটাছুটি। এখানেও তিনি সদা সচেতন। কোনোভাবেই যেন হাঁচি-কাশি বা মুখ-ভেংচির মতো শারীরিক কোনো চ্যুতি নিজের পারিপাট্যকে মøান করতে না পারে সেদিকে সতর্ক নজর তাঁর।

মাসুদ এককালে গান-টান করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানগুলিতে প্রায়ই তাঁকে সবার সঙ্গে এককাতারে দাঁড়িয়ে গান গাইতে দেখা যেত। ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ কিংবা ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে’ জাতীয় দেশাত্মবোধক কোরাস গানে জোরালো কণ্ঠে হাত তুলে হাওয়ায় ঘুষি মেরে-মেরে গলা মেলানোটাই ছিল ফেলে আসা সেই জীবনে তাঁর প্রধান সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। কখনো কেউ তাঁকে সলো কোনো গান করতে দেখেনি।

তা সত্ত্বেও রেজা মাসুদ নিজেকে একজন সংগীতশিল্পী হিসেবে পরিচয় দিতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সম্ভবত এই তাড়না থেকেই উজ্জীবিত হয়ে তিনি ক-বছর ধরে কবি-লেখক-শিল্পীদের একত্র করছেন গাজীপুরে, সবুজ ক্যানোপি দিয়ে ঢাকা প্রকৃতিমুখর নিজের বাগানবাড়িতে।

শিল্পীদের গাড়ি দিয়ে বাসা থেকে বয়ে আনা এবং গাড়ি করে বাসা পর্যন্ত আবার পৌঁছে দেওয়া – সব দায়িত্ব তাঁর একার কাঁধে। তাঁদের খাওয়ানো ও দামি-দামি সব উপহার দিয়ে তৃপ্ত রাখার এক অমলিন খায়েস জন্মেছে তাঁর ভেতর। ক-বছর ধরে বস্ত্র-ব্যবসার পাশাপাশি তিনি মেতে রয়েছেন এসব নিয়ে।

এ উপলক্ষে তাঁর গাজীপুরের বাগানবাড়িটি জমজমাট সাজে সেজে ওঠে প্রতিবছর। আজো এর ব্যতিক্রম নয়। পায়ের নিচে কোমল ঘাস আর মাথার ওপর রকমারি গাছের ছায়া সত্যি সত্যি মনোরম স্নিগ্ধ এক আবহ তৈরি করে রেখেছে এখানটায়।

স্টেজে চলছে একের পর এক জনপ্রিয় বাংলা গান। গাইছেন ঢাকার তরুণ শিল্পীরা। ড্রাম আর গিটারের উত্তাল শব্দ চারপাশে। যে-পাখিগুলির গাছে বিশ্রাম নেওয়ার কথা এ সময়, ভয়ে-ত্রাসে ওরা এখন নিঃসীম নীলাকাশে দিক্ভ্রান্ত, ছোটাছুটি করছে এখানে-ওখানে।

অভ্যাগতদের হাতে-হাতে চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়। সুবেশ-সুসভ্য পরিচারকগণ অতিযত্নে ক্ষুধাবর্ধক এসব খাবারের প্লেটগুলি অতি যত্নে তুলে দিচ্ছেন তাঁদের হাতে। ঘ্রাণে ম-ম চারদিক। শেফিং-ডিশে রাখা মুখরোচক খাদ্যদ্রব্য এমন করে সবাইকে ফিসফিসিয়ে ডাকতে থাকে যে সে কথা মনে হলে দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিস রোগী-শিল্পীও রেজা মাসুদের দাওয়াত পাওয়ামাত্র আবেগে একেবারে ছলকে ওঠেন, ‘ছেলেটা আসলে খুবই কাজের। শিল্পের এমন সমঝদার আজকালকার যুগে পাওয়া সত্যি মুশকিল!’

রূপা সবে ডায়াস থেকে দুটো পুরনো দিনের বাংলা গান গেয়ে নামল। রেজা মাসুদকে কাছে পেয়ে গলে একেবারে আইসক্রিম, ‘এই জায়গাটা এত্তো সুন্দর!! আচ্ছা রেজাভাই, পুকুর পাড়ে নাকি চন্দন গাছও আছে? প্লিজ, একটু নিয়ে চলেন না? আমি যে আর অপেক্ষা করতে পারছি না! ’ খলবল করে ওঠে রূপা।

রেজা ওর গানের ভক্ত। মহিলার নিজস্ব একটা সানুনাসিক গায়কী থাকায় নজরুলের গানে সুর লাগলেই বোঝা যায় এটা রূপা। রেজা ওর কৌতূহল দেখে উত্তর দিলেন, ‘চলুন না।’

ওরা হাঁটতে হাঁটতে পুকুরপাড়ের দিকে চলে এলো ।

রূপা বলছে, ‘আচ্ছা রেজাভাই, একটা সত্যি কথা বলবেন?’

‘বলুন। আমি কমই মিথ্যা বলি। বলুন না?’ আগ্রহ ঝরান তিনি।

‘আপনি নাকি চ্যানেল নামাচ্ছেন?’

‘কে বলছে?’ মুখে স্মিত হাসির রেখা।

‘বাজারে চালু আছে। নইলে আপনি ক-বছর ধরে অত শিল্পী-লেখক-বুদ্ধিজীবীদের তোয়াজ করে বেড়াচ্ছেন কেন?’ কণ্ঠের পেলব রসে ডুবুডুবু এক জিজ্ঞাসা।

রেজা তাকালেন রূপার দিকে। এই মহিলার একটা প্রধান গুণ হচ্ছে ঠুসঠাস কিছু বলে ফেলা। তবে অন্যদের মতো পিঠ চাপড়ে পরক্ষণেই পিঠে ছোরা বসানো ওর স্বভাব নয়। তাই ওর কোনো কথা ওকে খুব একটা ভাবায় না।

রূপার কৌতূহলের উত্তরে শুধু বললেন, ‘তাই? ইন্টারেস্টিং। আমি জানি না তো? জানি না কেন বলুন তো?’ বলে হেসে উঠলেন হো-হো করে।

‘ধ্যাৎ!’ বলে অন্যদিকে তাকায় রূপা। প্রসঙ্গটা জমল না বলে মন খারাপ।

রেজা মাসুদ এবার একটি গাছ দেখিয়ে বললেন, ‘এটাই হলো চন্দন গাছ। অন্যসব গাছের মতোই।’ অভ্যস্ত দৃষ্টি ওর গাছের ওপর। গাছটি এখনো চারদিকে ডালপালা ছড়িয়ে বড় হয়নি। সবে লাগিয়েছে, নাগালের বাইরে যেতে সময় নেবে।

রূপা গাছটির কচি ডালপালায় হাত রেখে শিশুসুলভ সারল্য নিয়ে বলল, ‘আমাকে কিন্তু একটি ডাল দিতে হবে।’

‘বড় হতে দিন। তখন বাসায় পাঠিয়ে দেব। আপনি বললে কি না করতে পারি বলুন? তাছাড়া আপনি নিজেই তো চন্দনবৃক্ষ। যিনি এমন ভালো গান করেন তিনি চন্দন ছাড়া আর কি? তাই না?’ কথাগুলি বলে থামেন রেজা মাসুদ। চোখ তাঁর শিল্পীর ওপর।

রূপা খিলখিল করে হেসে ওঠে। প্রশংসা পেলে আপনাআপনি টোল পড়ে ওর গালে।

‘আপনি আর কী কী করতে পারেন আমার জন্য? বউ ছেড়ে দিতে পারেন?’ ঠাট্টা করে বলে ওঠে রূপা।

‘আপনি বললে তাও চেষ্টা করে দেখতে পারি।’ আত্মবিশ্বাসী প্রত্যুত্তর রেজা মাসুদের। তিরিশ ছুঁই-ছুঁই লাবণ্যময়ী এক নারী এই রূপা। চোখে চশমা। হাইট পাঁচ-পাঁচ। আচার-আচরণে আভিজাত্য ও লাবণ্য মিলেমিশে একাকার। রেজা মাসুদের উত্তর শুনে সে মুখভরা কৌতুক নিয়ে শুধু একটি শব্দ উচ্চারণ করে, ‘ইস্!’ পরক্ষণে গম্ভীর হয়ে প্রসঙ্গ পাল্টায়। মুখে বলে, ‘আচ্ছা, ওই যে শিল্পী জগন্ময়, উনি আসলে কী আঁকছেন বলতে পারেন?’

‘একটা কিছু তো আঁকছেন। উপমহাদেশের এত বড় শিল্পী; যা আঁকবেন তাই সুষমামণ্ডিত হবে।’

‘আপনি বোঝেন সব?’ শিশুদের মতো দাঁত দিয়ে চন্দন পাতা ছিঁড়তে ছিঁড়তে প্রশ্ন করে রূপা। হাঁটতে গিয়ে হাইহিল মাঝে মাঝে দেবে যাচ্ছে নরম মাটিতে। সেদিকেও লক্ষ রাখতে হচ্ছে তাকে।

‘চেষ্টা করি। যেমনি ভাবে আপনার গান শুনে মুগ্ধ হই।’

‘বাজে কথা। আপনি সবসময় বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলেন।’ রূপার এলো চুলে ভরা দিঘির বাতাস খেলা করে।

‘ফের বলছি। আমি অনেকের চেয়ে কমই মিথ্যা বলি।’

‘ভাবি জানলে ঠ্যাং ভেঙে দেবে। ফ্লার্টিং করা ছাড়াবে কিন্তু।’

‘তাই?’

‘ঠিক তাই।’ বলেই ও আবার হেসে ওঠে খোলা প্রকৃতির মাঝখানে।

এ সময় রেজা মাসুদের সেলটা বেজে ওঠে। কানে লাগাতেই শীলা মাসুদ, ওর দাপটশালী বউ, ‘কোথায় তুমি ? রূপাও নেই, তুমিও নাই – ব্যাপারটা কি? ফ্লার্টিং করছো?’

‘কই, না তো?’ আমতা আমতা করে ওঠেন তিনি।

‘যেখানেই থাকো, চলে এসো সভায়। সবাই এখানে তোমার খোঁজ করছে। ’

রূপার চোখে চোরা হাসির ঝিলিক। তড়িঘড়ি করে অনুষ্ঠানস্থলের দিকে রওনা হতেই সে বলে উঠল, ‘ভাবি, না?’

‘হু।’

এবারো রূপা বাঁধভাঙা হাসি হেসে নেয় একচোট। এটা ওর বিদ্রƒপ প্রকাশের স্টাইল কি না বুঝতে পারেন না তিনি।

তাঁর তখন একটাই লক্ষ্য। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সভাস্থলে চলে যাওয়া, কারণ স্ত্রীর চোখে যে অপরাধী বনে গেছেন তিনি। প্রতি পদে এখন থেকে নাকাল হওয়ার আশঙ্কা।

শীলা কখনোই কোনোকালে ওকে সরাসরি আক্রমণ করে না। ওটা শীলার স্বভাবে নেই। ওর স্বভাবসুলভ ন্যাকা-ন্যাকা আহ্লাদী ভঙ্গিমায় নিজের ক্ষোভগুলি সে প্রকাশ করে থাকে। বিশ বছরের দাম্পত্যে এগুলি এখন বড়ই উষ্মা-উদ্রেককারী আচরণ বলে মনে হয় রেজা মাসুদের কাছে। স্রেফ প্যানপ্যানানি ছাড়া আর কিছু নয়। তিন বাচ্চার মাকে এখন আর এসব নিয়ে ঘ্যানরঘ্যানর করা শোভা পায় না। তবু সহ্য করতে হয়। এ দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি?

তিনি ত্রিপল টানানো আঙিনায় প্রবেশ করেন। চারপাশে এতসব গাছের ছায়া যে রোদ খুব একটা কাউকে কাবু করতে পারে না। পাশে টালি দেওয়া আধুনিক বাংলোঘর, আয়তনে বেশ বড়। চাইলেই কেউ গিয়ে শরীরে এসির বাতাস লাগিয়ে আসতে পারেন। হার্ড ড্রিংক-সফট ড্রিংকের সঙ্গে দেদার স্ন্যাকস বাইরের মতো ভেতরেও ছড়িয়ে রয়েছে প্রতিটি কাঠের থামের কোণে-কোণে। যে কেউ হলরুমে ঢুকে তা উপভোগ করতে পারেন। বুফে-কর্নার থেকে নিজে নিতে না চাইলে পরিচারকদের কাউকে চোখের ইশারা করলেই হলো। আপনার খেদমত করতে সঙ্গে সঙ্গে হাজির হবে তারা।

জগন্ময় শীল নিরামিষাশী মানুষ। বয়স প্রায় সত্তর। কুঁজো হয়ে হাঁটেন। ফর্সা লম্বা চেহারা। কণ্ঠস্বর পাতলা; বিনয় মিশে রয়েছে কণ্ঠনিঃসৃত প্রতিটি উচ্চারণে।

রেজা মাসুদের এক ভারতীয় বন্ধুর সুবাদে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। তখন থেকেই মানুষটাকে নিয়ে একটা জমায়েত করার ইচ্ছে ছিল গাজীপুরের এই বাগানবাড়িতে।

জগন্ময় শীলের নাম ওর এক শিল্পীবন্ধুকে জানাতেই সে হৈ-হৈ করে ওঠে, ‘খুব ভালো হয়। উনার ছবি আমার কাছে তো অন্যরকম লাগে। এমন বিষণ্ন তাঁর এক-একটি ছবি যে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকলে নিজের ভেতর পরিত্যক্ত এক বোধ জন্ম নেয়। ঠিক বোঝাতে পারি না রেজা। অদ্ভুত।’ বন্ধুটি  মুহ্যমান হয়ে পড়ে সেকথা বলতে গিয়ে।

রেজা মাসুদ বেশ উদ্দীপিত বোধ করেন সে কথা শুনে। শিল্পীকে পেতে নিয়মিত যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন।

বোলপুরে কোপাই নদীর তীরে একটা মাটির ডেরায় তিনি থাকেন। নেশার ভেতর শুধু হুঁকো টানেন আর মাঝে মাঝে মহুয়া পান করেন সাঁওতালিদের পরব-পার্বণে। নিয়মিত মদ্যপানের নেশা-টেশা নেই বললেই চলে; অকৃতদার মানুষটি মাঝে মাঝে চাঁদের নেশায় বুঁদ হয়ে কোপাই-ময়ূরাক্ষীর পাড়ে ঘুরে বেড়ান রাতের বেলায়। পাগলাটে স্বভাবের শিল্পী হিসেবে তাঁকে সবাই জানে ও চেনে।

ভারতীয় বন্ধুটি বলেছিল, ‘ম্যানেজ করতে পারবেন তো দাদা?’

‘কেন পারবো না ? আমার বাগানবাড়িটি পুরো খুলে দেবো তাঁর জন্যে। দিনের বেলায় শ্যামল প্রকৃতির মাঝে ঘুরে বেড়াবেন আর রাতে চাঁদ দেখবেন। কোনো অসুবিধা নেই।’

‘ঠিকাছে। দেখি রাজি হন কি না। একবার লস অ্যাঞ্জেলসের একজন বাঙালি এসেছিলেন তাঁকে সেখানে নিয়ে যাবেন বলে নেমন্তন্ন করতে। লোকটি টাকা-পয়সা নিয়ে কীসব উল্টাপাল্টা বলে ফেলেছিলেন যে, জগন্ময়দা খুন্তি নিয়ে লোকটিকে তাড়া করেছিলেন রাস্তা পর্যন্ত। সেই লোক কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে বেঁচেছিল সেই যাত্রায়। হাঃ হাঃ হাঃ।’

সব শুনেও রেজা মাসুদ দমে যাননি। নিজে ব্যবসায়ী মানুষ। তার ওপর শিল্পী-লেখকদের ঘিরে রয়েছে তাঁর অপার কৌতূহল। এঁরা যে এক-একজন ঘোরলাগা রহস্যময় মানুষ হন তা রেজা ভালোই জানেন। নিজে রহস্যময় না হলে অন্যের সৃষ্টিরহস্য নিয়ে কিভাবে কাজ করবেন?

তিনি শিল্পী জগন্ময় শীল সম্পর্কে খবরাখবর নিতে লাগলেন। খবর বলতে ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি আর বাংলাদেশের কিছু মুগ্ধ তরুণ বন্ধুবান্ধব, যাদের কাছে অনেকদিন থেকে এই শিল্পীর গুণগান শুনে আসছেন তিনি।

যেখানে শিল্পী থাকেন, সেখানকার পুরোটা সবুজ অন্ধকারে ঢাকা। বাড়ির সামনে বিশাল উঠোন। তারপর শনছাওয়া মাটির কুঁড়েঘর। ঘরটার ওপর দুটো সজনে গাছ একসঙ্গে হুমড়ি খেয়ে রয়েছে। একটা কিশোর কড়ই ছাতা হয়ে বেড়ে উঠতে চাইছে একদিকে আর অন্যদিকে কলাগাছের সারি। গাছে কলার কাঁদি ঝুলে না থাকায় কী কলা তা বুঝতে পারেন না রেজা মাসুদ।

তবে চারপাশে এত পুরনো গাছপালা থাকা সত্ত্বেও রেজা লক্ষ করলেন, উঠোন একেবারেই সাফসুতরো। কোথাও একটা পাতা পর্যন্ত পড়ে নেই।

তিনি যখন এদিক-ওদিক উঁকিঝুঁকি মারছেন তখনই হঠাৎ করে হাতে খুন্তি নিয়ে জগন্ময় শীল বেরিয়ে এলেন, ‘হুলো বেড়ালের মতো কাকে খুঁজছিস রে হারামজাদা?’

‘গুরুজি, আমি বিক্রমপুরের শ্রীনগর থেকে এসেছি।’

সঙ্গে সঙ্গে মানুষটা মিইয়ে গেলেন। আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন নিজেকে ভদ্ররূপে প্রকাশ করার। একসময় বলেই ফেললেন, ‘নিয়ে যাবি আমায়? খুব টানে পদ্মার পাড়। নিবি? থাকা-খাওয়ায় আমার কোনো বায়না নেই রে। আমার রান্না আমিই রেঁধে খাই।’ গুণী মানুষটা এমনভাবে বলছেন যে রেজা মাসুদ একেবারে হতভম্ব। চোখে জল চলে এলো। চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের কথা মনে হলো তাঁর। সারল্যের দিক দিয়ে দুজনার বিস্তর মিল লক্ষ করছেন তিনি।

‘আপনি যাবেন তো?’

‘কেন যাবো না? নদীটা তো এখনো আমায় ডাকে। সেই অশ্বত্থ গাছটা তো এখনো আমার মাথার ভেতর। এ-জীবনে কত অশ্বত্থ আর বটবৃক্ষ দেখেছি । কিন্তু ওই পদ্মাপাড়ের নিঃসঙ্গ বৃক্ষটির কি তুলনা হয় বল? আমার পুরো কৈশোরটাই তো ওই বৃক্ষটার নাড়িভুঁড়ির সঙ্গে পেঁচিয়ে রয়েছে। বুঝতে পারছিস?’ শিহরণ খেলে গেল রেজা মাসুদের শরীরে। যে-মানুষটির অনুভব এতো তীব্র, তাঁর সৃষ্টিকর্ম গভীর তাৎপর্যময় না হয়ে পারেই না, ভাবেন রেজা মাসুদ।

অবশ্য প্রথম দর্শনে এরকম তুই-তুকারি সম্বোধন মোটেই ভালো লাগার কথা নয়। কিন্তু জগন্ময় শীল উচ্চারিত এই তুই-তুকারি মোটেই রেজা মাসুদকে অপমানিত করছে না, বরং নিজের ভেতর মানুষটির প্রতি একধরনের গভীর আত্মীয়তাবোধ জাগিয়ে তুলছে। বড় আপন লাগছিল তাঁকে।

‘আমি আপনাকে সেই বৃক্ষটাই দেখাতে নিয়ে যাবো। যাবেন তো?’

‘আজ সজনের ডাঁটা দিয়ে মুগডাল আর ভাত রেঁধেছি। তুই খেয়ে যাস। অকৃতদার মানুষ হলেও আমার রান্নার হাতটা আঁকার মতোই মন্দ নয় রে!’

রেজা মাসুদ দুঁদে ব্যবসায়ী। মানুষের ভালো-মন্দ মুখোশ-অমুখোশ আবৃত অবয়বের অনেকখানিই তাঁর জানা। কাউকে তুষ্ট করতে গেলে কিভাবে এগোতে হয় তা তাঁর জানা-বোঝার বাইরে নয় বলেই তিনি আজ এত টাকার মালিক। নইলে সামান্য পুঁজি সম্বল করে যাঁর যাত্রা শুরু, তিনি কোনোদিন বস্ত্র-বিস্কুটের এরকম নামকরা শিল্প-কারখানার মালিক হতে পারতেন? ওরই বানানো বস্ত্র বিদেশিরা গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর ওর কারখানায় তৈরি বিস্কুট সৌদি আরব-দুবাই-সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়াসহ পুরো উপমহাদেশ জুড়ে দাবড়ে ব্যবসা করে বেড়াচ্ছে, এ কি সহজ কথা?

সেই রেজা মাসুদ মানুষটার সারল্যে এতটাই মুগ্ধ যে তিনি মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে তার সঙ্গে লাঞ্চ করলেন।

সেই তো শুরু। তারপর এদেশে শিল্পী জগন্ময় শীল এলেন।

যেদিন এলেন সেদিনই চলে গেলেন পদ্মাপাড়ে। একটা মরোমরো অশ্বত্থ গাছ পেয়েও গেলেন সেখানে। মানুষটির অবসেশনের সঙ্গে একেবারেই মিলে গেল জায়গাটা।

রেজা গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছেড়ে দিলেন শিল্পীকে। একছুটে জগন্ময় চলে গেলেন বৃক্ষের কাছে।

একটু বাদে রেজা দূর থেকে লক্ষ করলেন, মানুষটি বৃক্ষটিকে জড়িয়ে ধরে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে আদর করে চলেছেন। রেজার বড় কৌতূহল হলো; কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী খুঁজছেন অমন করে?’

‘আরে এইখানটায় একটা লেখা ছিল। গাছখোদাই আর কি। ওটা কই?’

রেজা হেসে ফেললেন এই পাগলামো দেখে। পঞ্চাশ বছর পর কেউ কখনো স্মৃতি-জাগানিয়া গাছখোদাই ফিরে পায়?

‘কী ছিল ওখানে?’

‘জগা যোগ মধু। হেঃ হেঃ হেঃ। মধু আমার কৈশোরের প্রেম। একটা বাহারি কবুতর। হেঃ হেঃ হেঃ।’

কিছক্ষণ পর ওকে চমকে দিয়ে মানুষটি পদ্মাপাড়ের ঢাল বেয়ে নদীতে নেমে গেলেন। শিশুর মতো ছোটাছুটি করছেন তীর ধরে। হাত-পা ছুড়ছেন আর মুখ দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে অদ্ভুত সব শব্দ করছেন। কতগুলি গাঙচিল উড়ে বেড়াচ্ছে মাথার ওপর। সম্ভবত ওরাও খুব মনোযোগ দিয়ে অদ্ভুত মানুষটিকে ওপর থেকে লক্ষ করছে।

এদিকটায় মানুষের যাতায়াত কম। তাই কারো নজরে পড়ছে না। নইলে এতক্ষণে একটা জমায়েত হয়ে যাওয়ার কথা শিল্পীকে ঘিরে।

সহসা তিনি লক্ষ করলেন জগন্ময় শীল নিজের দেহ থেকে ফতুয়া-ধুতি খুলে একেবারে দিগম্বর হয়ে পড়েছেন। তারপর সমস্ত শরীরে কাদা মেখে দেহকাণ্ডের অর্ধেকটা জলে আর অর্ধেকটা ডাঙার ঘাস-লতাপাতার ওপর এলিয়ে দিয়ে দিব্যি উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছেন। দূর থেকে মনে হবে কোনো এক ডলফিন বা শুশুক বুঝি ক্লান্তদেহে রোদ পোহাচ্ছে।

ঘণ্টাখানেক এরকমভাবে কেটে যাওয়ার পর মানুষটি নড়েচড়ে উঠলেন। স্নান সেরে আবার ধুতি-ফতুয়া গায়ে চড়িয়ে রেজা মাসুদের সামনে এসে বলে উঠলেন, ‘ফ্রেশ অইয়া গেলাম। একটা সাপ না মাছ যেন নুনুটারে চুমু খেতে চাইছিল। এইজন্য ঘোরটা কাইটা গেল। সময় পাইল না শালা!’

একথা শুনে রেজা হোঃ হোঃ করে হেসে উঠলেন। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন যে, প্রতিভাশালী খ্যাপাটে এ-শিল্পীকে এখানকার বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন তিনি।

সংবাদটি ওর অ্যাড ফার্মকে জানিয়ে দেন তিনি। ওরা ইভেন্ট-ম্যানেজমেন্টের কাজও করে থাকে। শুনে হইহই-রইরই করে ওরা কাজে লেগে গেল। আইডিয়াটা এরকম যে, শিল্পী জগন্ময় শীল একটি ছবি আঁকবেন দিনভর। বিশিষ্ট লোকজন হল্লা করবেন; গান-বাজনা হবে; খাওয়া-দাওয়া নাচ-গান চলবে। সবকিছুর মাঝে শিল্পী তাঁর ছবিটি আঁকবেন। এই ছবিটাই হবে রেজা মাসুদের জন্য এদেশে তাঁকে আনার মহামূল্যবান এক উপহার।

কথাটা জানাতেই জগন্ময় এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। কোনো ভনিতা না করে বলে উঠলেন, ‘জানিস, একজন জাত-শিল্পী সারাক্ষণ শিল্প-রচনা করে থাকেন। শরৎ-মানিক-বিভূতি-তারাশঙ্কররা কয়টা গল্প আর কাগজে লিখে গেছেন বল? ওঁদের মাথায় যত গল্প তৈরি হতো এর সব যদি প্রকাশ পেত তাহলে কটা যে লাইব্রেরি হতে পারত। হাঃ হাঃ হাঃ। গায়ককে দেখিস না সারাদিন গুনগুন করছেন? ওটা ওর প্যাশন। ওটা ছাড়া ওর চলে না। আমাকেও যেখানে আঁকতে দিবি,  ঠিক এঁকে দেবো। ওসব নির্জনতা-নীরবতার সাধনা, কী যেন বলে না, যতসব গালভরা কথা। সব শিল্পীদের বুজরুকি। নিজের গুরুত্ব বাড়িয়ে তোলা আর কি। বুঝলি না? আসলে যে-কোনো অঙ্গনের শিল্পীই মানে একজন সাধক। ওর কাছে ভূমানন্দ আর দুগ্ধফেননিভ শয্যা আসলে এক কথাই। আমি রাজি। তুই আয়োজন কর।’

সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল কাজকর্ম। রেজা মাসুদের অ্যাড ফার্ম উঠেপড়ে লেগে এই ফার্ম-হাউস মাত্র চারদিনে আয়োজনের উপযোগী করে তৈরি করে ফেলল। ভারতীয় শিল্পী জগন্ময় শীলের লাইভ আর্ট-শো। অর্থাৎ তিনি আঁকবেন আর আমাদের সব বুদ্ধিজীবী হাসিমুখে সেসব দেখতে দেখতে চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয়তে মজে থাকবেন।

আবৃত্তিকার আলিম খান কাছে এসে ফিসফিস করে বলে উঠলেন, ‘আমাদের দেশে অনেক গুণী আঁকিয়ে রয়েছেন; পাশাপাশি তাঁদের কাউকে রাখলে ভালো হতো না রেজা ভাই? আপনি বিতর্কে জড়িয়ে যাবেন তো?’

তরুণ তুর্কি, যা মনে আসে ঝটপট বলে ফেলতে পারে কোনো মুখবন্ধ ছাড়া। সম্পর্কে রেজা মাসুদের দূরসম্পর্কের শ্যালক হয়। বেশ রসালো ব্যক্তিগত সম্পর্ক ওর সঙ্গে।

রেজা মাসুদ ঠোঁটের ফাঁকে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে উত্তর দিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের পাশে নজরুল, এ রকম কিছু একটা আশা করছো, বলো?’

আলিম আর কথা না বাড়িয়ে খাদ্যের সন্ধানে ভেতরে ঢুকে পড়ল। সে আসলে হন্যে হয়ে যা খুঁজছে তা হলো হার্ড ড্রিংক। ওটা ছাড়া পার্টি জমে নাকি?

স্থপতি ইমরান সমসাময়িক বন্ধু রেজার। তিনি জগন্ময়ের দিকে চোখ রেখে বলে উঠলেন, ‘ইন্ডিয়ানরা কি পাগল হয় নাকি দোস্ত। আঁকতে আঁকতে কি রকম পাগলের মতো করছে। কোত্থেকে ধরে আনলি এঁকে?’

‘শিল্পীরা পাগলই হয়। ওদের সঙ্গে এসব পাগলামি কিভাবে যেন মিলেও যায়। তুই আমি কি সব ছেড়েছুড়ে ওঁদের মতো হতে পারবো কোনোদিন বল? তুই-আমি ব্যবসা করে দেদার টাকা-পয়সাও জমাবো আবার শিল্প-সাহিত্য নিয়ে একটুখানি ছুকছুকও করবো। দুটোই রাখবো, ছাড়বো না একটাও। হাঃ হাঃ হাঃ।’ রেজা মাসুদ হেসে ওঠেন গলা ছেড়ে।

‘আরে ভাই ইন্ডিয়ান শিল্পী এনে যখন শো করবারই ইচ্ছা তোর তো এই বুড়ো-ধুড়োদের কেন ভাই, অনিন্দিতা সোমদের মতো ইয়ং আর্টিস্টদের তো আনতে পারতি? গতবছর লন্ডনে দেখে এসেছি। কী রূপ রে ভাই। নিজেই একখানা জাগ্রত শিল্প। সামনাসামনি সে কথা বলেছিও।’ বলে এক চোখ ছোট করে ফেললেন ইমরান।

রেজা মাসুদ ওর কানে ফিসফিস করে বলে উঠলেন, ‘ভেতরে যা। একটা দামি জিন আছে। এই দুপুরবেলায় জিন উইথ লাইম খুব জমবে। যা।’

রেজা মাসুদ এ সময়ে এসব কথা যে পছন্দ করছেন না তা বুঝতে পেরে ইমরান আর কথা বাড়ান না। বিরস মুখে তিনি কিছুক্ষণ রূপার দৃষ্টি কাড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তারপর সম্ভবত জিনের খোঁজে বাংলোর ভেতর ঢুকে পড়েন।

ইমরানকে কাটিয়ে এবার রেজা মাসুদ এসে দাঁড়ালেন শিল্পীর সামনে। মানুষটি তুলি চালানোর চাইতে আঁকিবুঁকিপূর্ণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন অনেকক্ষণ। হয়তো ভাবছেন কিছু।

রেজাকে দেখতে পেয়ে হুড়মুড়িয়ে কথা বলতে শুরু করেন তিনি। বেশিরভাগ কথা এলোমেলো, কিছুটা জড়ানো। রেজা যত ছবি নিয়ে কথা বলতে চাইছেন তিনি তত এড়িয়ে চলছেন। তাঁকে সারাক্ষণ পেয়ে বসেছে পদ্মাপাড়ের সেই অশ্বত্থ বৃক্ষটি। কাছে ঘেঁষলেই তিনি শুরু করেন বৃক্ষ আর নদীর কথা।

রেজা তাঁকে এড়াতে চাইলেও পারেন না। কোথায় যেন একটা রহস্যাবৃত চাদর লুকিয়ে রয়েছে মানুষটার ভেতর। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে ক্লান্ত লাগে সত্য; কিন্তু সরে গেলে টানতে শুরু করেন ওঁর দিকে। প্রতিটি কথাই তখন মনে হয় অদ্ভুত।

‘আরে, বৃক্ষ আর নদী রে না জানলে তুই শিল্পী-লেখক চিনবি ক্যামনে? কবি-লেখকদের নেমন্তন্ন দেস নাই?’

‘দিছি।’

‘হেরা কই? মদ খাওয়ায় ব্যস্ত?’ বলেই হোঃ হোঃ করে হেসে ওঠেন।

‘হাসছেন যে বড়?’

‘লেখক-শিল্পীরা তো সাধু-সন্ন্যাসী-দরবেশ-আওলিয়ার জাত, বুঝলি না? বাইরে যতই কাঠখোট্টা হউক, ভেতরে-ভেতরে ঠিকই দিওয়ানা। আগেও শালারা গাঁজা-আফিমে মজে থাকতো। গাঁজায় দম দিয়াই নতুন কথা শুনাইত জগদ্বাসীরে। অহনও তাই। আইচ্ছা, এঁরা কাছে আসে না কেন আমার? কবি নাই এইখানে? গদ্যকার? কই তাঁরা? কস নাই? নাকি আমারে ইন্ডিয়ান মনে করতাছে? হাঃ হাঃ হাঃ। আরে আমি তো পদ্মাপাড়ের অশ্বত্থ বৃক্ষ। কাদা-কুদা মাখা একলা পাগল।’ বলে গুনগুন করে গান ধরেন জগন্ময়,‘দুইজনাই বাঙালি ছিলাম, দেখো দেখি কাণ্ডখান, আজকে তুমি বাংলাদেশি আমারে কও ইন্ডিয়ান।’

রেজা মাসুদ সরে এলেন শিল্পীর কাছ থেকে। বাংলোঘরের ভেতরে পা দিতেই ওঁর চক্ষু চড়কগাছ। জগন্ময় শীলের অনুমান একদম সত্য। সবাই এখানে একত্রিত হয়ে সুরাপান করছেন আর বিরামহীনভাবে এটা-ওটা ভক্ষণ করে চলেছেন। কেউ এখানকার হিমেল হাওয়া ছেড়ে শিল্পীর কাছে চালতা গাছতলায় যেতে চাইছেন না। রূপার গানের পর বাঁশি বাজানোর কথা হারুনের। তাকে দেখা গেল বিয়ারের ক্যান হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। শীলা মাসুদ সঞ্চালনার দায়িত্বে রয়েছেন। ওর কাছে এসে রেজা চোখ গরম করে বলে উঠলেন, ‘এখন তো বাঁশির সেশন। উনি কি কম পেমেন্ট নেবেন?’

‘এখন বিরতি চলছে। বাইরে তো গরম প্রচণ্ড। শিল্পীদের বিশ্রাম প্রয়োজন।’ সহজ করে উত্তর দেন শীলা।

‘আর মূল শিল্পী যে একা একা চালতা গাছের নিচে একনাগাড়ে এঁকে চলেছেন? তাঁর গরম লাগছে না? তিনি কি ফেলনা শিল্পী?’ চাপা গলায় একরাশ উষ্মা ঝরান রেজা মাসুদ।

‘অত টেন্সড্ হচ্ছো কেন জান? জগন্ময়বাবু তো এসবে অভ্যস্ত। কোপাই নদীর পাড়ে কুঁড়েঘরে থাকেন। তাঁর তো খারাপ লাগার কথা নয়। আমাদের শিল্পী-লেখকরা তো ওরকম জীবন যাপনে অভ্যস্ত নন। ব্যাপারটা বুঝতে হবে। টেক ইট ইজি মাসুদ। আমি দেখছি।’ বলে তিনি বাঁশিওলার সামনে গিয়ে কানে কানে কিছু বললেন। অমনি তিনি ঢকঢক করে পুরো ক্যান গলায় ঢেলে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন হাতের বাঁশি সঙ্গে নিয়ে। একটু পর শিল্পী কথা বলতে শুরু করেন বাঁশিতে; শচীন কর্তার ‘সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি’র সুর বাগানবাড়ির আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। নিমেষে চারপাশের আবহ বদলে যায়। শিল্পী জগন্ময় তুলি চালাতে থাকেন ক্যানভাসের গায়ে। রেজা মাসুদের মনে হলো, বাইরে চৈত্রের খরতাপ যেন সহসা নরম হাওয়ায় বদলে গেছে; গায়ে সেই হাওয়া আদর বুলিয়ে দিচ্ছে।

শীলা এসে দাঁড়ালেন রেজার পাশে। মুখ ভার করে বললেন, ‘এবারের গেস্ট সিলেকশনটা তোমার ঠিক হয় নাই জান।’ ন্যাকা কণ্ঠস্বর স্ত্রীর।

‘কী হলে ভালো হতো?’

‘গানের শিল্পী হলে ভালো হতো। আমার ফ্রেন্ডরা তো কেউ আসেইনি সেজন্য। তুমি তো ঠিকই রূপাকে নিয়ে পুকুরপাড় থেকে হানিওয়াক সেরে এলে।’ চোখেমুখে হতাশা। এরকম চলতেই থাকবে। কবে শেষ হবে তা রেজা মাসুদের জানা নেই।

‘কী আঁকছেন, কাছে গিয়ে দেখেছো?’ শীলার কথা গায়ে না মেখে পাল্টা প্রশ্ন করলেন।

‘দেখো, যত বড় শিল্পীই হোক, পাগলের সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে বলো না আমায়। প্লিজ! তুমিও থেকো না। রূপা তো আছেই।’ শ্লেষ মেশানো চোখে তাকান স্বামীর দিকে। একসময় উপস্থাপিকা ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের। এখন স্বামীর অনুষ্ঠান ছাড়া আর কোথাও সঞ্চালনা করতে দেখা যায় না।

‘তুমি এত বড় শিল্পীকে পাগল বলছো? তোমার মাথা ঠিক আছে তো? উনাকে বাংলাদেশে আনতে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আমার, তা জানো?’

‘তো আমি কি করবো?’

‘উনি তোমার গেস্ট। মনে রেখো।’

‘আমার নয়। তোমার।’ ঠোঁট উল্টে দেন শীলা।

‘বাজে কথা বলো না। ভেতরে গিয়ে সবাইকে বলো বাইরে আসতে। সেভেন্টি ওয়ানের পর আমরা যে কীরকম লোক দেখানো বড়লোক হয়েছি, আমাদের না দেখলে বোঝা দায়। একটুখানি সময় এসি’র কৃত্রিম হাওয়া ছাড়া বাঁচি না। ভান করে করে জীবনটা কাটিয়ে দিচ্ছি। যত্তোসব!’ চাপা গলায় রেজা মাসুদ নিজের ক্ষোভ ঝাড়েন।

শীলা ভেতরে চলে গেলেন। রেজা ত্রিপল টাঙানো খোলা জায়গাটায় ফের এসে দাঁড়ালেন। এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন শিল্পকর্মটি। প্রথমে যে-রকম লেগেছিল, এখন রেখাগুলি স্পষ্ট হচ্ছে। একটা মানুষ ঝুঁকে বসে রয়েছে একটি লেখার খাতার ওপর। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত, হতাশ আর বিমর্ষ মুখ তাঁর। আঙুলের ফাঁকে উল্টো করে ধরা কলমটি। চাঁচাছোলা চেহারার এক বৃদ্ধ কেন এভ

বে তাকিয়ে রয়েছেন, রেজা মাসুদ বুঝতে পারেন না ।

এ সময় পাশে এসে দাঁড়ালেন কবি সোহাগ কবীর। তাঁর কবিতার ধার অনেককেই স্পর্শ করছে ইদানীং। মুখ বাড়িয়ে ক্যানভাসের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে রেজাকে ফিসফিস করে বলে উঠলেন, ‘লোকটা কি পারভার্ট?’

‘কেন?’

‘দেখছেন না কী আঁকছেন?’

‘কী আঁকছেন?’

‘সঙ্গমের দৃশ্য। একটা লোক, তাও বৃদ্ধ, উপুড় হয়ে আছে এক নারীর ওপর। ছিঃ। বুড়ো হয়েছেন, তবু ভণ্ডামি যায় না।’

রেজা ফের তাকালেন ছবিটার দিকে। শিল্পী জগন্ময় নিবিষ্ট হয়ে রয়েছেন ছবিটায়; বিড়বিড় করে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলছেন। হাতে-মুখে আর কাপড়ে রঙের দাগ। গায়ে একটা ফতুয়া আর ধুতি। একসময় বেশ ফর্সা ছিলেন বোঝা যায়। সামনের পাটির দুটো দাঁত নেই। সেগুলি বাঁধানোর কোনো প্রয়োজন বোধ করছেন না। চুল সাদা। শুধু চোখ দুটো অসম্ভব ক্ষুরধার। অনেকটা ক্যানভাসের পলিতকেশ শিথিলচর্ম স্খলিত পদবিক্ষেপের মানুষটির চোখের মতো।

এসময় কথাকার জামাল নাসের পাশে এসে দাঁড়ালেন। চাপা গলায় বলে উঠলেন, ‘এ তো বাচ্চাদের ছবির মতো লাগছে। পেটে দ্রব্য পড়েনি?’

‘মহুয়া ছাড়া অন্যকিছু খান না তিনি। সাঁওতালদের সঙ্গে ভাব তো!’

‘এই একটা ম্যাদম্যাদা ছবি দেখানোর জন্য এত আয়োজন?’

রেজা মাসুদ মুখ ঘুরিয়ে নিলেন অন্যদিকে। সহসা তাঁর মনে হলো, তিনি জোর করে মানুষটিকে একটা বৈরী পরিবেশের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এখানকার কেউ তাঁকে বুঝতেই চাইছেন না। বরং তাঁকে কদিন প্রশান্ত পদ্মাপাড়ে ঘুরিয়ে কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেই ভালো হতো। কেন যে এখানে ছবি আঁকার লাইভ-শো করার ইচ্ছে হলো ওর। নিজের স্ত্রী পর্যন্ত মানুষটিকে নিতে পারছে না।

জগন্ময় শীল পিছন ফিরে তাঁকে ডেকে উঠলেন, ‘রেজা, দেখে যা।’ এমনভাবে ডেকে উঠলেন যে মনে হলো ওর মরহুম আব্বাজান। একইরকম আবেগ আর ভালোবাসা নিয়ে শিক্ষক বাবা তাঁকে ডাকতেন। সেই ডাকটা এখনো তিনি বুকের গহিনে নিয়ে চলেন।

রেজা শিল্পীর সামনে এসে দাঁড়ালেন। তিনি তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। মুখে মিঠা হাসির ছোঁয়া। সহসা হাতের তুলিটা আকাশের দিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘এইবার তোর লোকজনরে ডাক দে। জিগাইয়া দ্যাখ দেখি, কে বুঝতে পারছে ছবিটা? ছবিটার একটা নাম দিলাম – অপারগতা। জিগা, তাগাদা কইরা ডাক।’ শিল্পীর কথা বলায় কলকাতার কোনো সুর নেই। একেবারে বাংলাদেশি উচ্চারণ। মনে হচ্ছে বিক্রমপুর থেকে সবেমাত্র আজ সকালে ঢাকায় এসে পৌঁছালেন!

রেজার ডাকতে হয়নি; শিল্পীর পাগলপারা আচরণে বিস্মিত সবাই আপনা থেকে ছুটে এলেন এদিকে।

শিল্পীর সঙ্গে কারোরই তেমন পরিচয় নেই। ঘনিষ্ঠভাবে কাউকে তিনি চেনেনও না। এমনকি রেজা মাসুদকেও নয়। এক হপ্তায় কে কাকে চিনে ফেলে?

সবার আগে কবি সোহাগ কবীর এসে দাঁড়ালেন শিল্পীর সামনে। তাকে কাছে পেয়ে উচ্ছল কণ্ঠে জগন্ময় শীল বলে উঠলেন, ‘এই ছোকরা, ওই ঘরটার ভিতরে আমার একটা ঝোলা আছে। তাতে মহুয়া ভরা একটা বোতল আছে। আনবি? যা না রে?’

রেজা মাসুদের জিহ্বায় কামড় দেওয়ার মতো অবস্থা। বেশ অবস্থাপন্ন লোক এই সোহাগ কবীর। শুধু নামেই কবি, ব্যবসাপাতি করে রীতিমতো বড়লোক এখন তিনি। বয়স পঞ্চাশের ঘরে। তাঁকে এভাবে বোতল আনার কথা, তাও যেনতেন ভাবে, বললে কি হয়?

কিন্তু রেজাকে চমকে দিয়ে সোহাগ কবীর ছুটে গেলেন বাংলোঘরটার দিকে। তারপর বোতলটা এনে বেশ সমীহের সঙ্গে হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘নিন গুরুজি।’

জগন্ময় শীল বোতল থেকে বাসি মহুয়া বেশ খানিকটা ঢকঢক করে গলায় ঢেলে জোরালো কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘এবার তুই বল আমি কী এঁকেছি? তুই আমাকে মহুয়া এনে দিয়েছিস। তুই-ই বল সবার আগে?’

‘আমি?’ মিনমিন করে ওঠেন তিনি।

রেজা মাসুদের হাসি পাচ্ছিল বড়। একটু আগে যার কণ্ঠ থেকে এ রকম বিশ্রী মন্তব্য ঝরছিল, এখন তাকেই একই বিষয়ে মন্তব্য করতে বলছেন খোদ শিল্পী। কী বলবেন তিনি?

কবি সোহাগ কবীর ফস করে বলে বসলেন, ‘এ তো একটা পাহাড়, ঝুঁকে রয়েছে একটা বহতা নদীর ওপর। পাহাড় আর নদীর চুম্বনবন্দি যেন এ চিত্র।’

‘বাহ, কল্পনাশক্তি তো তোর খুব প্রখর। মা এদিকে আসো তো।’ এবার ডেকে উঠলেন খোদ শীলাকে।

শীলার পরনে মিরপুরী বেনারসি। বেশ ঝলমল করছে। কাছে আসতেই জগন্ময় বললেন, ‘মা বলতো এই অধম কী আঁকতে চাইছি? একটু দেইখা বল।’

‘একটা বিশাল আকৃতির বক নদীর তীরে এসে মাছ খুঁজছে নুয়ে।’ বলতে গিয়ে শীলার হাসি পাচ্ছিল বড়। কিন্তু এটা হাসির জায়গা নয় ভেবে কোনোভাবে নিজেকে চেপে উত্তর দিলেন।

‘সবাই তো দেখি এখানে খুব কল্পনাপ্রবণ। ভালো ভালো। মা কি স্বপ্ন দেখতে পছন্দ কর?’

‘স্বপ্ন ছাড়া কি মানুষ বাঁচে গুরুজি?’ শীলার আবেগহীন কাটাকাটা উত্তর।

‘তাও তো কথা। স্বপ্নই তো মানুষকে উড়তে শেখায়। আবার স্বপ্নই মানুষকে কর্মবিমুখ করে। এই তুই আয় তো?’ ডেকে ওঠেন আবৃত্তিকার আলিম খানকে। ঢুলুঢুলু দৃষ্টি। বিনা পয়সার দ্রব্য ম্যালা পড়েছে পেটে, তা সহজেই বুঝতে পারেন রেজা মাসুদ।

আবৃত্তিকার এবার শিল্পীর চোখের সামনে। সে এতটুকু না টসকে উত্তর দিলো, ‘এটা তো সিম্পল। একটা আজাইরা বুড়া বসে বসে সংসারের হিসাব করতেছে। এইটারে জীবনের হিসাবও কইতে পারেন। বাজারের হিসাব মিলে গেলেও জীবনের হিসাব তো কোনোদিন কারো আর মিলে না। ফানি।’ বলে মাতাল হাসি হাসতে থাকে বেশ কতক্ষণ।

‘হাঃ হাঃ হাঃ। আনন্দ পেলাম। তুই কিছু বলবি?’ এবার স্থপতি ইমরানের ওপর চোখ।

তিনি এতটুকু ইতস্তত না করে উত্তর দেন, ‘এক বুড়ো স্থপতি বাড়ির প্ল্যান তৈরি করছেন। মনে হয় না প্ল্যানটা সে এক্সিকিউট করতে পারবে।’ বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়েন। রেজার মনে হলো ইমরান তাঁর কোম্পানির বোর্ড মিটিংয়ে বসে মন্তব্য করছেন।

‘বাড়ির প্ল্যান তৈরিতেও শিল্পী হইতে হয় রে বাপ। বাবুই পাখিকে দেখ, আহা! যে শালার শিল্পবোধ নাই ও তো মতুয়া। ওইটারে কয় মতুয়ার সাতাছালা বুদ্ধি। বুঝছিস?’

এরকম ঢালাও তুই-তুকারিতে রেজা মাসুদ প্রথম থেকেই বড় অস্বস্তিতে। সুখের কথা এই যে, এখানে সবাই এগুলি বেশ সহজভাবে নিচ্ছে। কৃত্রিম মনে হচ্ছে না কিছু।

একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল রূপা। শিল্পী এবার একমুখ হেসে ওকে আহ্বান করলেন ছবিটি দেখার জন্য, ‘তুই ওভাবে রয়েছিস কেন? তোর গান শুনলাম তো। খুব ভালো গাস। কাছে আয় মা।’

রূপা কাছে এলে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘আমি কী এঁকেছি বলতে পারিস মা?’

‘এটা কি ছবি চেনা-বোঝার ওয়ার্কশপ গুরুজি?’

‘ওভাবে নিস না। শিল্পীর কৌতূহল হয় না? সেরকম। বলবি কিছু?’

রূপা কিছু একটা ভাবে । তারপর গুনগুন করে গেয়ে ওঠে, ‘এমন মানব জনম আর কি হবে, মন যা কর ত্বরাই কর এই ভবে …’

এসময় ভেতর থেকে টলতে টলতে ক্যানভাসের ঠিক সামনে চলে এলেন কথাসাহিত্যিক জামাল নাসের। ঘোর লাগা চোখে ছবিটি ভালো করে দেখে নিলেন কয়েক পলক। তারপর বলে উঠলেন, ‘আরে এ তো ডাচ শিল্পী পাগলাটে ভিনসেন্ট উইলিয়েম ভ্যান গগ। আত্মহত্যার ঠিক আগেকার সময়ে মানসিক ভারসাম্য হারানো গগ। ঠিক কি না গুরুজি?’

জগন্ময় কোনো কথা না বলে তুলি আর রঙের পাত্রটি জামাল নাসেরের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘তুই কি করিস রে বাবা? আমার মতো পাগলা দাশু?’

‘না গুরুজি। পাগলামি করার সুযোগ নেই এ-জীবনে। বাঁধাধরা জীবন আমার। একটু-আধটু গল্প-উপন্যাস লিখে

থাকি। এই আর কি।’ সৌম্যকান্তি নাসেরের হাতে ধরা তুলি আর ব্রাশ। এগুলি ধরে থাকবেন নাকি ফেলে দেবেন বুঝতে পারছেন না। সবার কৌতূহলী দৃষ্টি এখন তারই ওপর।

‘তাইলে তোর গুরুকে তুই চিনতে পারছিস না কেন? হাতের ওগুলি ছুড়ে দে মাথার ওপর। তারপর একটুক্ষণ তাকা বাছা এদিকে।’

জামাল নাসের মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। করপোরেট প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তাব্যক্তি। শখ করে গল্প-উপন্যাস লিখছেন। এ-লাইনে বেশিদিন না হলেও তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘তরবারির নেশা’ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার জিতে নিয়েছে। এ-লেখক অনেকদূর এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন বোদ্ধা ব্যক্তিবর্গ। তাঁকে আচমকা তুলি আর রঙের পাত্র শূন্যে ছুড়ে দিতে বললে তো চমকানোরই কথা।

‘কী হলো? হাতের ওসব ছুড়ে দে না? তারপর তাকা। ঠিক তুই সাইপ্রাসের গমের ক্ষেত থেকে হুগলিতে চলে আসতে পারবি। পর্তুগালের ভাস্কো দা গামা পারলে তুই পারবি না? আলবাৎ পারবি। তাকা বাপ?’

রেজা মাসুদের মনে হলো, মানুষটার কথায় এক ধরনের জাদু মেশানো সারল্য রয়েছে যা কখনো অস্বীকার করা যায় না। সহজেই সেঁধিয়ে যায় নিজের অস্তিত্বে।

জামাল নাসের গম্ভীরমুখে এক ঝলক তাকালেন শিল্পীর দিকে; তারপর সহসা অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে শূন্যে ছুড়ে দিলেন হাতে ধরা রং-তুলি সব। সঙ্গে সঙ্গে সমাগত অভ্যাগতরা আনন্দে হইহই করে উঠলেন। কেউ কিছু বুঝলেন না। তবু একটা উল্লাসের বলক ফুটছে সবার ভেতর।

এবার জগন্ময় শীল মহুয়া-নেশায় ঢুলুঢুলু চোখে দেখতে থাকেন ক্যানভাসে আঁকা ছবিটি। সব কেমন ঝাপসা হয়ে আসে। তবু একজন সৃজনীশক্তিরহিত অসহায় মানুষ স্পষ্ট ভেসে ওঠে শিল্পীর চোখের তারায়।

‘গুরুজি আপনিই বলুন।’ অনুরোধ ঝরে জামাল নাসেরের গলায়।

‘আরে বাপু এ-মানুষটা আর কেউ নন, স্বয়ং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। শ্রীকান্ত, পথের দাবী, চরিত্রহীন, পল্লীসমাজ, গৃহদাহ, শেষ প্রশ্নের লেখক। আমি যেমন এখন পারি না। তিনিও একটা সময়ে এসে আর লিখতে পারতেন না। আমি যেমন ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিষ্ফলা সময় কাটাই, দাঁত দিয়ে নখ কাটি, ওই মানুষটাও দামি কলম-কাগজ নিয়ে দিনের পর দিন বসে থাকতেন। লেখা বেরোত না। যা আসত তা মনঃপূত হতো না, ছিঁড়ে ফেলতেন কাগজ। ঠিক আমারই মতো। অবিকল আমার মতো! নিজেকেই যে নিজে আঁকলাম! তোরা কেউ ধরতেও পারলি না? ’ শেষের কথাগুলি বলতে গিয়ে কেমন বুঁজে আসে গলার স্বর তাঁর। এক অপরিমেয় কষ্টে ধনুকের মতো বেঁকে যায় ছোট শরীরখানা।

চারপাশ স্তব্ধ। এখানে যাঁরা নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন তাঁরা কোনো না কোনোভাবে শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে লগ্ন হয়ে রয়েছেন। এমন কি যাঁরা চার-হাতে টাকা কামাচ্ছেন বলে অন্যের চুলকানি হচ্ছে, তাঁরাও শিল্প-সাহিত্য নিয়ে মেতে থাকা মানুষজন।

রেজা মাসুদের সহসা মনে হলো – জগন্ময় শীলের কথা কিছুক্ষণের জন্য হলেও আত্মমগ্ন এই মানুষগুলিকে অস্থির করে দিয়েছে; ওদেরও চোখে-মুখে স্পষ্টতর হচ্ছে অপারগতার এক যন্ত্রণাবোধ।

এ সময় সবাইকে চমকে দিয়ে খালি গলায় রূপা গেয়ে উঠল, ‘অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ – তুমি করুণামৃতসিন্ধু করো করুণাকণা দান … শুষ্ক হৃদয় মম কঠিন পাষাণসম, প্রেমসলিলধারে সিঞ্চহ শুষ্ক নয়ান …।’ পিনপতন নীরবতায় ঢেকে গেল চারপাশ। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সমর্পণের করুণ সুর বাজছে সবার মাঝে। চৈত্রের দহনবায়ুর মতো যে অপারগতা, অক্ষমতা, অসহায়তা সবার বুকের ভেতর এতক্ষণ দাউ-দাউ করে জ্বলছিল, ধীরে ধীরে তা যেন শান্ত-শীতল হতে থাকে।

রেজা মাসুদ এগিয়ে যান শিল্পী জগন্ময় শীলের দিকে। তারপর শিল্পীর ছোটখাটো ভাঙাচোরা বুড়ো শরীরটিকে জড়িয়ে ধরে গভীর মমতায় বলে ওঠেন, ‘ভেতরে চলুন। লাঞ্চ লেগে গেছে।’

সহসা ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললেন তিনি, ‘আমরা পারি না কেন মাসুদ? একটা সময়ের পর এমনিভাবে আমরা ফুরিয়ে যাই কেন? আমরা কেন পদ্মাপাড়ের অশ্বত্থ হতে পারি না? কেন রে? পারি না কেন? হো হো হো।’

সবার পকেটের রুমাল তখন চোখের কোনায়।