ক্যাথারসিস এবং একটি সন্ধ্যা

অন্ধ্রের শ্রীধর ইধাপালাপ্পাকে দেখে ভাবনাটা এসেছিল। একখানা রঙিন পোস্টকার্ডের একদিকে তেলেগু ভাষায় লেখা ওর মায়ের চিঠি এবং অন্যদিকে বিশ^কর্মার মূর্তির ছবি। আমার জানা ছিল না পরদিনই বিশ^কর্মার পুজো, পূর্বদিন দেখেছিলাম মাঝারি সাইজের একটা ম্যারো কিনে এনেছিল সিটি সেন্টার থেকে। যাকে ঠিক চালকুমড়ো বলে তা এখানে এই ক্যামব্রিজে মেলা ভার। লন্ডনে গেলে বাংলাদেশি দোকানগুলিতে প্রচুরই মেলে এবং মেলে নানান সাইজের। শ্রীধরেরটা একটু লম্বাটে ধরনের, তবে বিশ^কর্মার অর্ঘ্যরে জন্যে মানানসই। স্নান সেরে ধুতি পরে পুজোর কাজ সারে সে। ফায়ারপ্লেসে আজ আর আগুন জ¦লে না। সেসব পুরনো দিনের আঙ্গিক। এখন রেডিয়েটর চালু হয়ে যায় শীতে। একটা মূল বৃহৎ বয়লারে সারাক্ষণ ফুটতে থাকে পানি। সেই প্রচণ্ড গরম তরলকে চালিত করা হয় লোহার রেডিয়েটরের পাইপের ভেতর দিয়ে। সেখান থেকে সঞ্চারিত হয়ে আসা তাপে গরম থাকবে ঘর। ফায়ারপ্লেসের কার্নিশের ওপর বিশ^কর্মার মূর্তি-সংবলিত পোস্টকার্ডটাকে একটা ছোট্ট সতেজ ফুলের মালার ফ্রেমে বৃত করেছে শ্রীধর। কিন্তু ওইটুকু আয়োজনের মধ্যে তার হৃদয়ের শ্রদ্ধাবোধের দারুণ প্রকাশ দেখে আমরা মনে মনে অনুপ্রাণিত বোধ করি। আমরা পূজার্থী ছিলাম না; কিন্তু শ্রীধরের পবিত্র আয়োজনের দর্শক হিসেবে ওর এইসব তৎপরতাকে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে আসা মহাদেশে শ্রীধরের নিজস্ব ভারতীয় বোধে যেন আমিও কোথাও খুঁজে পাই এক উপমহাদেশীয় চেতনা। পুজোর শেষে শ্রীধরের কল্যাণে আমরা কেইন্সসাইড হাউজের সবাই পেলাম ওর নিজের হাতে এবং নিজের হকিংস প্রেসার কুকারে রান্না করা সুস্বাদ সবজি, ডাল আর লেমন রাইস। ডেজার্ট হিসেবে একটা করে সন্দেশ। সম্ভবত ক্যাম নদীর ধারের ইন্ডিয়ান শপ থেকে কেনা।

দূর থেকে ফায়ারপ্লেসে পুষ্পাবৃত বিশ^কর্মাকে চোখে পড়ে। ছবিটা তত জাঁকজমকপূর্ণ নয়। আসনে বসা বিশ^কর্মার একটা পা ভাঁজ করে রাখা। পায়ের নিচে একটা হাঁস এবং ছড়ানো অনেকগুলি পদ্মফুল। দেশে হলে হয়তো ভাদ্রের গরমে এতক্ষণে তেতে উঠতো শ্রীধর; কিন্তু এখানকার ভাদ্র মানে খানিকটা শীতের আসন্নতা। শ্রীধর অক্লান্ত। ও যখন অনুচ্চ শব্দে ক্যাসেট চালিয়ে দিয়ে অনুপ জালোটার ভজন শোনে তখন আমার মাথায় ঘুরতে শুরু করেছে চিন্তাটা। ওভাল আকৃতির জানালা দিয়ে তাকালে প্রশস্ত দিগন্তরেখা। যেন বিপুলায়ত যবের ক্ষেত আর দিগন্তরেখার মধ্যে একটা সংযোগ সাধিত হয়েছে, যা আমার চর্মচোখে ধরা পড়ে না। আমি দেখি বিশাল প্রান্তরের ওপর দিয়ে বয়ে যায় ঢেউ আর হয়তোবা আলোরই ইল্যুশনে সেই ঢেউয়ে কাঁপতে থাকে দিগন্ত। তাই তো দিগন্তকেও যে এমন তরল আর সঞ্চরণশীল দেখাতে পারে তা আমার জানা ছিল না, যদি না একটু পরপর আচমকা ওঠা হাওয়ায় প্রলম্বিত প্রান্তরটা জন কনস্টেবলের ক্যানভাসের মতো দুলে উঠতো। ক্লেয়ার হলের পেছন দিককার সরু পথ ধরে জগিং করতে করতে ছুটে যাচ্ছিল সুইডেনের কামিলা লুন্ড এবং স্পেনের ফিওনা ভেলভেডিয়ার। ফিওনাকে নিয়ে আলাদাভাবে বলার মতো মেলা গল্প আছে আমার, যা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। আমার মনের মধ্যে তখন জার্মানির ড্যানিয়েল হোল্টগেন। ওকেই আমার দরকার; কিন্তু তার আগে দরকার শাহরিয়ার ফয়সালকে। ক্যামব্রিজে বাংলাদেশ সমিতির সেক্রেটারি তিনি। শ্রীধরের কর্মতৎপরতায় আমার মনের মধ্যে যে-অব্যবহিত ভাবনাটা জেগে ওঠে, সেটির বৃহত্তর সম্ভাবনাকে কার্যে পরিণত করার উদ্দেশ্যে আমি বেরিয়ে পড়ি ওয়েস্ট রোডের দিকে। ডারউইন কলেজের ডরমিটরিতে থাকেন ফয়সাল। বিষয়টা তাঁর সঙ্গে পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত করা যায়।

ওয়েস্ট রোড ধরে সামান্য এগোলে বেরি-ঝোঁপপ্রধান একটা রাস্তার বুক থেকে আরো একটা রাস্তা বেরিয়েছে, যেটা ধরে হেঁটে গেলে পাইনহার্স্ট। সেখানটায় থাকেন বিশ^বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। একদিন বলা যায় দৈবক্রমে এই রাস্তাটাতেই দেখা পেয়েছিলাম তাঁর। মাথাটা ডানদিকে ঝুঁকে রয়েছে, দেখেই বোঝা যায় শরীর সঞ্চালনের প্রবল অক্ষমতায় আক্রান্ত হকিং বেঁচে রয়েছেন কেবল পরিপোষকতার গুণে। দেখতেই বিস্ময় গ্রাস করে আমাকে। স্বয়ংচালিতের মতো মাথা থেকে ক্যাপটা নামিয়ে আনি, মাথা নেড়ে শ্রদ্ধা জানাই বিরল সেই মানবপ্রতিনিধিকে। হকিং আমাকে দেখেন কি দেখেন না, কিন্তু তাঁর স্ত্রী জেইন ওয়াইল্ড, যিনি তাঁর হুইল চেয়ারটা ঠেলে এগোচ্ছিলেন, আমার ‘নড’-এর প্রত্যুত্তরে তিনিও মাথা নাড়েন স্মিত মুখে। আমি উল্টো দিকের পথিক তবু যতক্ষণ ক্যামব্রিজ লাইব্রেরিমুখী হকিংয়ের হুইল চেয়ারটা গতিশীল থাকে ততক্ষণ আমার দৃষ্টিটাও নিবদ্ধ থাকে সেদিকে। ডারউইনের ডরমিটরিতে পৌঁছে আপাদমস্তক উত্তেজিত আমি আমাদের বাংলাদেশ সমিতির সেক্রেটারি ফয়সাল শাহরিয়ারকে জানাই স্টিফেনের সাক্ষাতের কাহিনি। ফয়সালের জানালা থেকে পাইনহার্স্টমুখী রাস্তার শুরুর অংশ চোখে পড়ে। তিনিও দেখেছেন হকিংকে ওয়েস্ট রোডেই প্রথম। তবে তাঁর অভিজ্ঞতা আমার চাইতে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। হকিংয়ের একটা সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন তিনি। একটা বিশেষ সাউন্ড ডিভাইস ব্যবহার করে বক্তব্য উপস্থাপন করেন হকিং। কেবল ডান হাতের একটা কি দুটো আঙুলই তাঁর ক্ষম। আঙুলের মাংসপেশির সেই ক্ষীণ ক্ষমতা দিয়ে তিনি সেটির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন তাঁর মস্তিষ্কের, যে-মস্তিষ্ক থেকে ক্রমাগত উৎপন্ন হয়ে চলেছে বিশে^র মানবজাতির জন্যে কল্যাণের বার্তাবলি। দেখে মনে হয় শীর্ণ-ক্ষীণ মানুষটা এখনই পড়ে যাবেন তাঁর হুইল চেয়ারের ফ্রেম থেকে, অথচ তাঁর একেকটা সেমিনারে তিল-পরিমাণ ঠাঁই থাকে না। সত্যি নিজেকে পরম সৌভাগ্যবান মনে হলো আমার, ক্যামব্রিজে না এলে কোনোদিনও তাঁকে দেখার সুযোগ হতো না আমার।

সৌভাগ্যের প্রসঙ্গে দেখা গেল বয়সে আমার চাইতে বছর পাঁচেকের বড় হলেও একদিক থেকে আমি তাঁর চাইতেও সৌভাগ্যবান। শাহরিয়ার ফয়সাল কখনো দেখেননি বাঙালির জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে; কিন্তু আমি তাঁকে দেখেছিলাম দুবার। প্রথমবার ১৯৭২ সালের ১০  জানুয়ারি। আগের দিন বাবা ধানমন্ডি লেকে বড়শি ফেলে মাঝ ধরেছিলেন। তখন জায়গাটা যথেষ্ট জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। ধানমন্ডি গার্লস স্কুলের উল্টোদিককার পাড়ে আসন পড়েছিল তাঁর। সেদিন রাতে উত্তেজিত বাবা আমাদের দুই ভাইকে জানান, কাল বঙ্গবন্ধু আসবেন, পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত বঙ্গবন্ধুকে দেখতে যাবো রেসকোর্সের ময়দানে। পরদিন বাবার কাঁধে আমি আর তাঁর ডান হাতে ধরা বড়ভাই বিশাল সেই জনতার মধ্যে প্রত্যক্ষ করলাম মহামানবের অহংদৃপ্ত অস্তিত্ব। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে তাঁকে আমি দেখি দ্বিতীয়বার। আমরা তখন সরকারি মুসলিম হাই স্কুলে পড়ি। বঙ্গবন্ধু যাচ্ছিলেন বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করতে, যাত্রাপথে আমাদের স্কুলের সংবর্ধনা নিয়েছিলেন তিনি লালদীঘির মাঠে নির্মিত মঞ্চে এসে। সেদিন মঞ্চে দাঁড়ানো আমরা ছিলাম তাঁর নিশ^াসের দূরত্বে। একানব্বইয়ের হকিং-দৃশ্য আমাকে নিয়ে যায় বাহাত্তরে এবং পঁচাত্তরে। শাহরিয়ার ফয়সালকে তখন বললাম মনের সুপ্ত ইচ্ছের কথাটা। বিলাতে এসে দেখলাম, পৃথিবীর সব জাতির লোকেরা নিজ-নিজ গৌরবের উদ্যাপনে তৎপর। বিদেশ-বিভুঁইয়ের অপরিচিত জলবায়ু-পরিবেশ-পরিস্থিতি তাদের সেই গৌরবের উদযাপনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। মাত্র কিছুদিন আগেই ক্যামব্রিজের কেনীয় শিক্ষার্থীরা কেনিয়ার স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন করছিল। রংবেরঙের পোস্টার-ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে তারা যে-মিছিল করেছিল সেটির মুখ ছিল কাউন্সিল হলের সামনে আর লেজটা ছিল গ্রনভিল কলেজ ছাড়িয়ে মডলেনের মাঝামাঝি, অথচ ক্যামব্রিজে কেনীয় শিক্ষার্থীও ততজন থাকার কথা নয়। দেখলাম, অকেনীয় এমনকি শে^তাঙ্গ লোকেরাও স্বাধীনতা উদ্যাপনের সেই মিছিলে সহযাত্রী। বিশ^ময় মানুষ সর্বদাই বন্দিত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও সম্মিলিত, তাই কেনীয় মিছিলে কেনীয়দের চাইতেও অকেনীয়দের উপস্থিতি ছিল অধিক।

আর কয়েক মাস পরেই আসবে শোক ও বেদনার ভয়াবহ আগস্ট মাস। শাহরিয়ার ফয়সালকে বললাম, আমরা ক্যামব্রিজে বাংলাদেশ সমিতির সদস্যরা ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের স্মরণে একটা সভা করবো, যেখানে

থাকবে আলোচনা সভা এবং তাঁর স্মরণে কবিতাপাঠ এবং স্বদেশপ্রেমের গানের আয়োজন। শুনে প্রথমে খানিকটা ভাবান্বিত হয়ে বললেন, দেখুন এটা তো আপনি-আমি চাইলে হবে না, সোসাইটির সকলের সিদ্ধান্তমতোই হবে। হ্যাঁ, সে-কথা যথার্থ। আমি তাঁকে পাল্টা যুক্তি দিই, সেক্রেটারি হিসেবে আপনি যদি সেটা উত্থাপন করেন তাহলে সেটির ভিত্তিমূলটা শক্ত হবে। ফয়সালকে আমার সবসময়েই মেধাবী মানুষ বলে মনে হয়েছে, যিনি ঠিক রাজনীতির ঘরানায় পড়েন না। সেটা বলছি এজন্যে যে, আমার কথাটার মধ্য থেকে তিনি কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের অন্বেষণ করেন না। সাদামাটাভাবেই জানালেন, অনুষ্ঠান একটা সামষ্টিক ব্যাপার, কাজেই সকলের মতামতের একটা গুরুত্ব থেকেই যায়। আবার, এটাও তিনি আমাকে স্মরণ করিয়ে দেন, : দেখুন সমিতির সবাই আমাদের দেশ থেকে আসা শিক্ষার্থী। কিন্তু সবাই যে সব বিষয়ে একমত তা নয়। কে কোন রাজনীতির অনুসারী সেটাও আমার জানা নেই, কেননা রাজনীতি নিয়ে সেভাবে তাঁদের সঙ্গে আলাপ হয়নি কখনো। অধিকাংশ সদস্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে এখানে আসার পর। আমরা ধরুন পহেলা বৈশাখ করি, দুই ঈদের পুনর্মিলনী করি আর মাঝে-মাঝে সামারে বারবিকিউ কিংবা ক্রিসমাসে একটা গেটটুগেদার। এর বাইরে কখনো সেভাবে যাওয়া হয়নি আমাদের।

শাহরিয়ার ফয়সালের কথা নিঃসন্দেহে যুক্তিসংগত। আমারও থাকে যুক্তি,

: আমরা তো কোনো রাজনৈতিক দলের অনুষ্ঠান করছি না, আমরা এমন একজন মহান ব্যক্তিকে স্মরণ করবো যাঁর জন্যে আমরা আমাদের দেশটা পেয়েছি। যিনি না হলে আমরা এই যারা বিদেশি শিক্ষার্থী হিসেবে দেশ থেকে এসেছি এই প্রথম বিশে^র জ্ঞান-গবেষণায় সমৃদ্ধ হয়ে দেশে ফিরে অর্জিত সেই বিদ্যা দিয়ে স্বদেশের সেবা করার লক্ষ্যে, তারা কি কখনো এই সুযোগটা পেত যদি পাকিস্তান নামক গোলামির জিঞ্জির সারাক্ষণ আঁটা থাকতো আমাদের পায়ে!

শাহরিয়ার ফয়সাল আমার বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন না, আবার খুব একটা উচ্ছ্বাসও ঝলকায় না তাঁর কণ্ঠে। বরং তাঁর মৌন অবস্থিতি থেকে আমার উপলব্ধি হলো, তিনি নিশ্চয়ই আগস্টের মর্মান্তিক ও শোকাবহ ট্র্যাজেডি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। বিকেল খানিকটা হেলে পড়লে আমরা ক্যাম নদীর পাড় ঘেঁষে হাঁটি। পর্যটকদের কোলাহলে অপরাহ্ণের ক্যামব্রিজও বেশ স্পন্দমান। ব্রিজের এক কোণে ভিয়েতনামি লোকটা ভ্যানের ওপর রাখা চুলোর গরম তেলে একমনে ভেজে চলছিল ভেজিটেবল রোল। খেতে দারুণ সুস্বাদ ওর রোলগুলি। পাতলা একটা আস্তর, দেখলে মনে হবে এখনই গুড়িয়ে যাবে, কিন্তু না, ভেতরকার কুঁচিকুঁচি কাটা মাশরুম ক্যাবেজ গাজর এবং আরো নানান সবজিকে সেই পাতলা আস্তরটাই ধরে রাখে প্রবলতার সঙ্গে। আমরা দুজনে দুটো রোল খেলাম। হঠাৎই হইচইয়ের শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি নিচে আরেক ধুন্ধুমার কাণ্ড। এক ইতালীয় দম্পতি পান্টিং করতে করতে যাচ্ছিল প্রশান্ত ঠান্ডা ক্যামের জল কেটে। নদীতে প্রায় সর্বক্ষণই রাজহাঁসেদের চলাচল। কখনো কখনো পর্যটকদের গায়ের ওপরেই এসে পড়ে। সেরকমই একটা ঘটনা ঘটে। ইতালীয় লোকটার হয়তো খেয়াল থাকে না। পান্টিংয়ের বৈঠার একটা আঘাত গিয়ে লাগে পাশ দিয়ে যাওয়া একটা রাজহাঁসের গায়ে। আর যায় কোথায়। অমনি আশপাশ থেকে সাত-আটটা রাজহাঁস একজোট হয়ে এগিয়ে আসে প্রতিরোধে কিংবা প্রতিশোধে অথবা আক্রমণে। ঠোঁটের সজোর কামড় বসিয়ে দেয় বৈঠা বয়ে যাওয়া বেচারা বিদেশির বাহুতে। হেল্প হেল্প বলে তার স্ত্রী জুড়ে দেয় চিৎকার। কিন্তু ততক্ষণে অন্য হাঁসেরা নিতে শুরু করে রণপ্রস্তুতি। ইতালীয় দম্পতি ততক্ষণে লাফ দিয়ে পড়েছে ক্যামের জলে। দ্রুত সাঁতরে তীরে উঠে পড়ে দুজনেই। তাদের আরো আশ্চর্য করে দিয়ে ছুটতে থাকে হাঁসেরাও। শেষে একটা পাবে ঢুকে পড়ে প্রাণে বাঁচে ওরা। হাঁসেরা তখন কেউ ঘাড় নাড়িয়ে, কেউ এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিংবা কেউ আকাশমুখো হয়ে হয়তো নিজেদের কর্মপন্থা নিয়েই ভাবিত হয়। লোকেদের পক্ষে দর্শক হওয়া ছাড়া উপায়ান্তর থাকে না। সকলেরই জানা, ইংল্যান্ডের সমস্ত রাজহাঁস রানীর সম্পত্তি। কাজেই ওদের কোনো ক্ষতির কথা কারো পক্ষেই কল্পনা করা সম্ভব নয়। সেটা সরাসরি অপরাধের পর্যায়ে পড়বে। হাঁসেরাও হয়তোবা জানে তাদের এমন কর্তৃপক্ষীয় নিরাপত্তা ও পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি। নইলে এতটা ঋজুতা ও দৃঢ়তা তাদের স্বভাবে লক্ষযোগ্য হতো না। কিংবা হয়তো রাজহাঁসেদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যই এমন।

কয়েকমাস পর আমরা ক্যামব্রিজ বাংলাদেশ সমিতির সদস্যরা শাহরিয়ার ফয়সালের ডারউইন কলেজের পোর্টার্স-লজসংলগ্ন হলরুমে একত্রিত হলাম। আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু মূলত ১৫ই আগস্ট উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর স্মরণে আলোচনাসভা ও ভাবগম্ভীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তাছাড়া ক্রিসমাসের ছুটিতে সদস্যদের ওয়ারউইক ক্যাসল ভ্রমণ। সমিতির সদস্যসংখ্যা সর্বমোট কুড়ি। প্রেসিডেন্ট মযহারুল ইসলাম ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্সের অধ্যাপক। মুক্তিযুদ্ধের আগে এসেছিলেন পিএইচ.ডি করতে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে – ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটিতে। দেশে ফেরার আগেই যুদ্ধ এবং দেশের স্বাধীনতালাভ। তিয়াত্তরে তিনি ফেরেন দেশে; কিন্তু এরই মধ্যে তিনি পেয়ে যান ব্রিটিশ নাগরিকত্ব এবং বিয়ে করেন কানাডীয় শার্লিকে, যিনি বর্তমানে শার্লি ইসলাম। শার্লিরা থাকেন কানাডার হ্যালিফ্যাক্সে। ওঁর মায়ের শরীরটা হঠাৎই বেশ খারাপ হয়ে গেলে মযহার এবং শার্লি দুজনেই ছুটে গেছেন সেখানে। শার্লি তাঁর স্বামীকে সংক্ষিপ্ত ‘ময’ নামে ডাকেন। মাসখানেক আগে এক সন্ধ্যাবেলা ওঁদের ক্যামব্রিজের বাড়িতে ডিনারের আমন্ত্রণ করেছিলেন ওঁরা। চমৎকার পাস্তা রান্না করতে পারেন শার্লি, আর ছিল বেগুন ও চিজের মুসাকা। ডেজার্ট ছিল ব্ল্যাক ফরেস্ট গ্যাটু এবং গোট চিজ। ক্যামব্রিজের বাড়ি বলছি এজন্যে, তাঁদের আরেকটা বাড়ি আছে লন্ডনের সাউথ উডফোর্ডে। শার্লির হাসপাতালে নার্সের চাকরি। তাছাড়া ফিজিওথেরাপিতে আছে উচ্চতর ডিগ্রি। মযহারুল ইসলামকে বাদ দিলে বাকি উনিশজনের সকলেই উপস্থিত সভাস্থলে।

সদস্যদের প্রায় সকলেই আমার চেনা। দুয়েকজনের সঙ্গে রয়েছে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা। যাঁদের সঙ্গে পরিচয় ঘনিষ্ঠ নয় তাঁদের সঙ্গেও হরহামেশা দেখা হয়ে যায় সিটি সেন্টারে শপিংমলে কিংবা ক্যামব্রিজ সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে। সভার শুরুতে শাহরিয়ার ফয়সাল সবাইকে সম্ভাষণ জানান। উনিশজনের মধ্যে মাত্র দুজনই নারী – একজন এমফিল করছে ক্রিমিনোলজিতে এবং আরেকজন পিএইচ.ডি সমাজবিজ্ঞানে।

সভা-আলোচনার আনুষ্ঠানিকতার প্রাক্কালে খানিকটা ঘরোয়া আড্ডার মতো চলে কিছুক্ষণ। গণিতের নির্মল সাহা গত সপ্তাহে গিয়েছিল লন্ডনে। সেখানকার আলী স্টোর থেকে কিনে এনেছিল চ্যাঁপা শুঁটকি আর ইলিশ মাছ। সেসব গল্প হয়। বাঙালি দোকান থেকে তিনখানা বাংলা পত্রিকাও সে কিনে এনেছিল। সেগুলি সঙ্গে এনেছে নির্মল অন্যদের পড়ানোর জন্যে। দেশের বাংলা পত্রিকা দেখেই কেমন যেন একটা শিহরণ খেলে যায় আমার মধ্যে। যতবার আমি লন্ডন গিয়েছি ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে কিংবা ব্রিটিশ মিউজিয়ামে কাজ করার জন্যে ততবার আমি গিয়েছি ব্রিকলেনে। হয় শাকসব্জি কিনেছি দেশের – করলা, ঝিঙা, পটোল – এইসব, নইলে কিনেছি বাংলাদেশ থেকে আসা দৈনিক কিংবা সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকা-ম্যাগাজিন। চারদিন আগেকার সংবাদ পড়েও মনে হতে থাকে সব খবরই আজকের, একটুক্ষণ আগেকার। কোথাও যেন বেজে ওঠে ঘণ্টা। কিন্তু পত্রিকার সংবাদ দেখেই বিষণ্নতায় মন ছেয়ে যায়। নীলফামারীতে রাতের অন্ধকারে কালীমন্দিরে আগুন দিয়েছে দুষ্কৃতিরা। রামুর একটি কেয়াং থেকে অষ্টধাতুর মূর্তি চুরি হয়ে গেছে রাতের অন্ধকারে। বাগেরহাটে দড়াটানা নদীতীরবর্তী একটি গ্রামে এনজিওর ওপর হামলা করেছে কিছু মানুষ। এনজিওটি নাকি গ্রামের লোকেদের জোর প্রয়োগ করে খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তর করছিল। বান্দরবানে একজোড়া বম প্রেমিক-প্রেমিকাকে আটকে রেখে মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছে স্থানীয় বাঙালি যুবকেরা। দেশ থেকে আসা দেশের সংবাদ পড়ে মনে হতে থাকে যেন সংবাদপত্রের পাতা নয়, উড়ে এসেছে কালো কালো মেঘ, দুঃস্বপ্নের মেঘ। এত কষ্ট করে ক্যামব্রিজ থেকে লন্ডন গিয়ে বেচারা নির্মল গাঁটের পাউন্ড খরচ করে কিনে এনেছে বাংলাদেশের নোংরা-আবর্জনার স্তূপ।

শাহরিয়ার ফয়সাল যখন ১৫ই আগস্ট প্রসঙ্গে সমিতির করণীয় সম্পর্কে পর্যালোচনার জন্য উত্থাপন করেন তখন সদস্যদের মধ্যে প্রথমটায় একটা হালকা গুঞ্জনের ঢেউ উঠলো। ফিজিক্সের কবির কেমিস্ট্রির ইউসুফের কানে-কানে যেন কিছু একটা বললো। কবির একসময়ে সমিতির সেক্রেটারি পদের ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহী ছিল কিন্তু তার সীমাবদ্ধতা একটাই, ভারতীয়দের সে সহ্যই করতে পারে না। গত পহেলা বৈশাখে সবাই যখন বললো, ক্যামব্রিজের সমস্ত বাঙালি একজোটে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করবে তখন কবিরই বলেছিল, ইন্ডিয়ানদের বাদ দেন। অনেকেই তখন প্রতিবাদ করে, এখানে বাংলাদেশ ভারত মরিশাস মালদ্বীপ করা হচ্ছে না। যারা বাঙালি যারা বাংলাভাষী তারা পৃথিবীর যে-প্রান্ত থেকেই আসুক উৎসবে যোগদানের যোগ্য। শেষে কবিরের প্রস্তাবও অসমর্থিত হয়ে যায়। কিন্তু স্বভাবটা তার স্থগিত হয় না। এমন একজন সংকীর্ণ লোককে জ্ঞানসাম্রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র ক্যামব্রিজে একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিনিধিত্বের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত করার প্রশ্নে অধিকাংশ সদস্যের নিকটেই প্রত্যাখ্যাত হয় সে। কবিরই প্রথম ভঙ্গ করে নীরবতা –

: ১৫ই আগস্টে তো মূলত রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি থাকে। আমরা একটা অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, সেটা আমরা কতটা কীভাবে করবো সে-বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দরকার। অনুষ্ঠান করাটা বড় কথা নয়, এর সাফল্য-ব্যর্থতাই আসল কথা।

আইনের খুরশিদ রহমান এক কোণে বসেছিলেন। দুই নারীর একজন রাজনীতিবিজ্ঞানের সুনন্দা ওর ইয়ারমেট। অনুচ্চ স্বরে কথা চলছিল তাদের মধ্যে। কবিরের কথার সূত্রে ফ্লোর নিলেন খুরশিদ –

: আমরা এখানে কোনো দলের প্রতিনিধি নই, দেশের প্রতিনিধি আর যে-শোকাবহ ঘটনাটা ঘটেছে সেটা আমাদের দেশেই ঘটেছে। দলীয়ভাবে না দেখে এটাকে দেশীয়ভাবেই দেখা দরকার। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব নিহত হয়েছিলেন, কাজেই তাঁকে স্মরণ করাটাকে আপনারা চাইলে রাজনীতি বলতে পারেন; কিন্তু আমার ধারণা সমিতি হিসেবে এ-অনুষ্ঠান করলে আমাদের মর্যাদা বাড়বে বই কমবে না। এই ইংল্যান্ডে এসেও দেখতে পাচ্ছি কেনিয়ার লোকেরা কেনিয়াত্তাকে নিয়ে চিনারা মাও জে দংকে নিয়ে কঙ্গোর লোকেরা প্যাট্রিস লুমুম্বাকে নিয়ে অনুষ্ঠান করে। ওরা কি সবাই একই দলের সমর্থক, মনে হয় না। কিন্তু ওরা নিশ্চয়ই একই দেশের সমর্থক।

খুরশিদ রহমানের কথা এবং যুক্তি হয়তো কবির প্রদর্শিত যুক্তির সহি জবাব; কিন্তু সাধারণভাবে বিচার করলে খুরশিদের যুক্তিকে খণ্ডানোর মতো কোনো যুক্তি আমি অন্তত খুঁজে পাই না। উপস্থিত সদস্যদের অধিকাংশের অবয়বে ইতিবাচক তথা প্রসন্ন একটা ছায়ার আভাস মেলে। তারা নীরব থাকলেও তাদের সেই আভাস যেন খুরশিদের কথারই প্রতিধ্বনি। চীনের মাও জে দংয়ের নাম শুনেই আমার মনের মধ্যে সহসা জেগে ওঠে আমাদের হলেরই ফে ইউ এবং হুয়া চুয়ানের মধ্যকার সাম্প্রতিক একটি পটভূমি। ফে ইউ চীনের হলেও থাকে জার্মানিতে এবং সে কমিউনিস্টবিরোধী, গণতন্ত্রী। সকালে ব্রেকফাস্টের টেবিলে কী কথায় তাদের দুজনের মধ্যে প্রবল বচসা। শেষে আমরা জানলাম, কমিউনিস্ট চুয়ান পুঁজিবাদী দেশগুলির সমালোচনা করছিল। তখন ফে ইউ বললো, চীনে তো কোনো স্বাধীনতাই নেই মানুষের। ব্যস, ফে ইউ’র ব্রেন ওয়াশ হয়ে গেছে, সে পুঁজিবাদের চর। স্বার্থপরের মতো বিষয়বুদ্ধির পেছনে ছোটার জন্যে গণতন্ত্রী সেজেছে। ফে ইউ-ও কম না। হুয়া চুয়ানকে সে আখ্যা দেয় চীনের গুপ্তচর হিসেবে, আসলে চুয়ানের কাজ হলো চিনা ছাত্ররা এসব দেশে এসে কী বলে কী করে কী তাদের মনোভাব দাঁড়ায় সেসবের তত্ত্ব ও তথ্য সংগ্রহ করা। এসব  করে সেসব বেইজিংয়ে প্রেরণ করা। পরে আমরা হাউজমেটরা তাদের বিবাদ মিটিয়ে দিই। একটা জিনিস আমার তখন দৃষ্টিতে আটকেছিল। ফে ইউ এবং হুয়া চুয়ানের বিবাদের মধ্যে জার্মান মাইকেল ছিল নিশ্চুপ দর্শকের ভূমিকায়। সে কিন্তু চাইলে নিজ স্ত্রী ফে’কে সমর্থন জোগাতে পারতো। কিন্তু তা না করে সে দুই স্বদেশির মধ্যেই ব্যাপারটা যাতে সীমাবদ্ধ থাকে সেদিকে সজাগ থাকে। তবে ঘটনার সেখানেই শেষ নয়। আরো বিস্ময় অপেক্ষা করে আমাদের জন্যে। মাসখানেক পরে এক সকালে দেখতে পেলাম গণতন্ত্রী ফে ইউ এবং সমাজতন্ত্রী হুয়া চুয়ান একজোটে হামলে পড়েছে এক ভিয়েতনামির ওপর। কী ব্যাপার, কী ব্যাপার! ওদের দুজনেরই দাবি, ভিয়েতনামি এনগুয়েন ল্যু থ্যু চিনের নেতা মাও জে দং’কে সন্ত্রাসী বলেছে। অদ্ভুত এক ঐক্য তখন দুই চিনার মধ্যে। জাতিত্বের বৃহত্তর অনুভবের নিকটে তুচ্ছ হয়ে যায় পুঁজিবাদ সমাজতন্ত্র মুক্তবাজার সবকিছু। দুই মেরুর দুই বৈপরীত্য সমস্ত বৈসাদৃশ্য বিসর্জন দিয়ে সেদিন একটি বিন্দুতে মিলিত হলে আমি মনে মনে ভাবি, এরও নিশ্চয়ই রয়েছে কোনো রাজনৈতিক পরিভাষা। হয়তো আমার মনে পড়ে হেগেলকে কিংবা মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনকে, যিনি জাতীয় প্রতিরোধের ওপর নিক্ষেপ করেছিলেন নতুন আলো। আমি তখন ভাবি, একটা মানুষ যিনি সমগ্র বাঙালি জাতিকে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি স্বাধীন জাতিসত্তা উপহার দিয়েছেন, তাঁর মৃত্যু/ হত্যাদিবসে তাঁকে স্মরণ করবো কি না তা নিয়ে কালক্ষেপণে বসেছি। এমন পরিস্থিতিতে বিশে^র লোকেরা নিশ্চয়ই করুণা বোধ করবে আমাদের জন্যে।

শেষ পর্যন্ত দুয়েকজনের মৃদু আপত্তি তেমন কাজে আসে না। ভোট হলে হয়তো ১৬-৩ ভোটে জিতে যেতাম আমরাই যারা বঙ্গবন্ধুর স্মরণে ১৫ই আগস্ট পালন করতে চেয়েছি। ঠিক হলো, আমাদের ক্লেয়ার হলের সেমিনার লাইব্রেরি-সংলগ্ন অডিটরিয়মে পালিত হবে ১৫ই আগস্ট, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্মরণে আলোচনা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আমার ওপর দায়িত্ব বর্তায় মঞ্চের দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি সংবলিত ব্যানারের ব্যবস্থা করা। সুনন্দাকে দেওয়া হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সঞ্চালনার ভার। কিছুদিন আগে ক্যামব্রিজে এসেছিলেন গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর। তখন সেই অনুষ্ঠানটির চমৎকার সঞ্চালনা সুনন্দা করেছিল। এক ঘণ্টার অনুষ্ঠানে আলোচনা-উত্তর যে-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন তার জন্যে আমরা বেছে নিই নির্মলেন্দু গুণের দুটি কবিতা – ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আামাদের হলো’ এবং ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’। মহাদেব সাহার ‘আমি কি বলতে পেরেছিলাম’ এবং রফিক আজাদের ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’। কবিতাগুলি সুনন্দার সংগ্রহে থাকার কারণে এগুলিই হয়ে উঠলো আমাদের প্রকৃত অবলম্বন। কবিতার বই কিংবা কবিতার সংগ্রহ উচ্চতর ডিগ্রি করতে আসা শিক্ষার্থীদের কাছে থাকার কথাও নয়। তবে চাইলে লন্ডন যাওয়া যায় এবং সেখানকার ব্রিকলেন কি হোয়াইট চ্যাপেল থেকে বাংলা বইপত্র নিয়ে আসা যায়। কিন্তু এক ঘণ্টার অনুষ্ঠানে এটুকুই অনেকখানি বলে সবাই রায় দিলে আমরা প্রত্যেকেই নিজ-নিজ সামর্থ্যকে পুঁজি করে লেগে যাই প্রযোজনার কাজে।

বিশ^কর্মার ছবিসংবলিত পোস্টকার্ড সামনে রেখে শ্রীধর ইধাপালাপ্পাহর পুজোর আনুষ্ঠানিকতার ছবিটি মাথার মধ্যে অনুপ্রেরণার দোলা দিয়ে যেতে থাকলে আমি এদিকে-ওদিকে খোঁজ করতে থাকি। কিন্তু কোথাও কোনো ছবি খুঁজে পেলাম না বঙ্গবন্ধুর। না কোনো পোস্টকার্ড, না কোনো একটা কাগজ যেখানে তাঁর ছবি আছে। চাইলে সেই ছবিটিকে ক্যামেরায় তুলে এবং বিখ্যাত ইডেন লিলি থেকে আকারে খানিকটা বড় করে নিলে অনায়াসে ক্লেয়ার হলের অডিটরিয়ামের দেয়ালে লাগিয়ে দেওয়া যায় একটা বোর্ডের ওপর। লন্ডন গিয়ে নিয়ে আসা যায় বইপত্র ঘেঁটে। মুশকিল হলো, দেশে তখন চলছে বঙ্গবন্ধুবিরোধী এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের মিত্রদের শাসন। এরই মধ্যে তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটাকেও পাল্টে দিয়ে বিকৃত করে নিজেদের সুবিধামতো গড়ে নিতে শুরু করেছিল। সেদিন সন্ধেবেলা সমিতির সভায় আমি বেশ ঝাঁজের সঙ্গে বলতে বাধ্য হয়েছিলাম। কবিরই বলছিল, এখন তো রাজনৈতিক স্রোত সম্পূর্ণ নতুন যুগের দিকে ধাবিত। মানুষ এখন অতীত ভুলে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক ভবিষ্যতের দিকে মুখ বাড়িয়ে দিতে চায়। আমি কবিরকে বলি –

: মানুষ নয় আসলে আপনি বা আপনাদের মতো মানুষেরা অতীত ভুলে যেতে চায় বা ভুলে যাওয়ার কথা বলে। এই যে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো আর এখন এই বিরানব্বইয়ে এসে সতেরো বছর পরে হিসাব করে বলুন, শাসকেরা কি পেরেছে এই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে যে, বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশ স্বাধীন হয়নি। শাসকেরা কি পেরেছে ৭ই মার্চের বিকল্প হিসেবে আরেকটি ঐতিহাসিক তারিখকে গ্রন্থিত করতে যে-তারিখটি তার ঐশ^র্য আর ঔজ্জ্বল্য দিয়ে মøান করে দেবে মার্চের সাত’কে। কিংবা আপনি এমন একটি বাক্যের কথা বলুন যে-বাক্যটি বঙ্গবন্ধুর ‘দাবায়া রাখতে পারবা না’কে প্রতিস্থাপন করে ভিন্ন ও নতুন গৌরবে অভিষিক্ত হতে পারে। এত বিপুল ইতিহাসের বটবৃক্ষের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আপনি কিভাবে অতীতকে ভুলে যাওয়ার কথা বলছেন। যে-বটগাছের ছায়ার নিচে আপনি বর্তমানে দাঁড়িয়ে সেটাই তো অতীত, আর তা এমনই অতীত যে তার শেকড় মাটির ভেতরটা খনন করতে করতে পৌঁছে গেছে অনন্তের দিকে। চাইলেও ভোলা আপনার পক্ষে অসম্ভব। আপনি কেবলই ভান করতে পারেন ভুলে যাওয়ার।

আমার এবং শাহরিয়ার ফয়সালের ডরমিটরিতে আসার রাস্তা একটাই, ওয়েস্ট রোড। ফেরার সময় তিনি আমার বক্তব্যের বেশ প্রশংসা করলেন। বললেন, এঁরা আসলে এমন এক রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী যাঁরা বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস প্রণয়ন করতে চায়। এঁরা কথা বলে ক্যামব্রিজে বসে কিন্তু এঁদের কথায় তাদেরই প্রতিধ্বনি যারা বর্তমানে দেশ চালাচ্ছে পাকিস্তানি কায়দায়। কদিন পর দেখবেন এরা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন তালিকা তৈরি করবে। বলবে – পঁচাত্তরের আগে যেসব তালিকা করা হয়েছিল সেগুলিতে ভুল ছিল। দেখবেন এও তারা বলবে, অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম ভুলবশত রাজাকারদের তালিকার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সেগুলি এখন সংশোধন করে দেওয়া গেল। মুগ্ধতায় আমার মন ভরে যায়। আমি জানতাম না ফয়সালের চিন্তাভাবনার দিকগুলি। কথা বলে জানা গেল তাঁর বাড়ি ফরিদপুর এবং মুন্সি আবদুর রউফ এবং তাঁর বাবা আপন চাচাত ভাই। এখনো তাঁরা প্রতিবছর চট্টগ্রামে আসেন মুন্সি আবদুর রউফের শহিদ হওয়ার জায়গাটা স্বচক্ষে দেখার জন্যে। বঙ্গবন্ধুর কোনো ছবিরই সন্ধান যখন মিলছিল না তখন আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলতে লাগলো। ইতঃপূর্বে ক্যামব্রিজ লাইব্রেরিতে ভারতীয় উপমহাদেশ এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের শেলফটাতে চোখ বুলিয়েছিলাম। একটা বই পড়েওছিলাম, নীরদ সি চৌধুরীর লেখা লর্ড ক্লাইভের জীবনী। একটা কোণে ক্লাইভের ওপর লেখা সাত-আটটা জীবনীগ্রন্থ; কিন্তু নীরদ চৌধুরীর লেখা গ্রন্থটাই সবচাইতে সুলিখিত ও সুগ্রথিত বলে আমার মনে হয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসের ওপরও পেলাম অনেক বই। বই রয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখাও এবং তাঁর স্মরণীয় বক্তৃতাগুলির একটা সংগ্রহ পেলাম রামেন্দু মজুমদারের সম্পাদনায় যেটা প্রকাশিত হয়। সে-বইটা পেলাম না শেলফে। হয়তো কোনো পাঠক সেটি নিয়ে গেছেন পড়ার জন্যে। একটা ভারতীয় বই পেলাম বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা, যেটির শুরুতেই পাওয়া গেল বঙ্গবন্ধুর ছবি। বইটা ইস্যু করে আনলাম চার সপ্তাহের জন্যে। তারপর আমার ক্যানন ক্যামেরায় সেটার একটা চমৎকার  পোর্ট্রেট তুলে চলে গেলাম বিখ্যাত ইডেন লিলি স্টুডিওতে। তিনদিনের মধ্যে চমৎকার একটা ছবি পেয়ে গেলাম বঙ্গবন্ধুর – সুমুদ্রিত সুপরিস্ফুটিত। তাঁর চশমা মুজিব কোট সবই দারুণভাবে প্রতিফলিত। কিন্তু অনুষ্ঠানের মঞ্চে তাঁকে উপস্থাপনা করার একটা উদ্ভাবনীযুক্ত ধারণা এলো মাথায়।

আমাদের হাউজমেট ড্যানিয়েল হোল্টগেন পিএইচ.ডি করছে জিওগ্রাফিতে। সে জার্মান হলেও তার নানাবাড়ি ইংল্যান্ডের নর্দহ্যাম্পটনশায়ারের পলার্সপুরি। ভারতীয় মিশনারি ইংরেজ উইলিয়ম কেরিরা ওর নানাদের পূর্বপুরুষ। তাঁতের ব্যবসা ছিল তাঁদের। ড্যানিয়েল চমৎকার ছবি আঁকে। একবার আমরা ক্লেয়ার হলের কেইন্সসাইড হাউজের সবাই মিলে পিকনিক করতে গিয়েছিলাম নরউইচে। যেখানটায় আমরা পিকনিক বারবিকিউ করি সেখানে একটা অনেক দিনের পুরনো চার্চ ছিল। ড্যানিয়েল সেটার একটা পেনসিল-স্কেচ করলো এবং ও সেটা উপহার দিলো আমাকে। মাসখানেক আগে একবার ওর মা এসেছিল জার্মানি থেকে। দুপুরবেলা কড়া রোদ ছিল। ড্যানিয়েল তখন লাইব্রেরিতে ব্যস্ত কোর্সওয়ার্কের কাজে। বাড়িতে ছিলাম আমি। দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম পাস্তা আর লাজানিয়া। পরিচয় হলো ভদ্রমহিলার সঙ্গে, আমরা সংক্ষেপে বলতাম ড্যান, ওর মা। জার্মানিরই আরেকজন মার্গারেট মেহল ছিল বাড়িতে। কিন্তু মার্গারেট সেদিন ছিল না। সেমিনারে গিয়েছিল ডেনমার্কে। দেখে মনে হলো ড্যানের মা খুব ক্ষুধার্ত। আমাকে বললেন, ড্যানের শেলফ আর ফ্রিজটা আমাকে কি একটু দেখিয়ে দেবে? আমি মৃদু হেসে বলি, ঝামেলায় যাচ্ছেন কেন? কেননা তাঁর দেহে ও মনে ছিল ভ্রমণের ক্লান্তি। বললেন, তাঁর আসার কথা ছিল সন্ধেবেলা কিন্তু লন্ডনে যাঁর বাড়িতে যাবেন তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে। কাজেই পরিকল্পনা খানিকটা বদলে আগেভাগেই চলে এসেছেন। আমার ফ্রিজে ছিল বাংলাদেশের চিকেন কোর্মা আর ভাঁপা ইলিশ। ছিল মোটা নানরুটি, একটুখানি জল ছিটিয়ে গরম করলেই বেশ ফুলেফেঁপে ওঠে। আমার আন্তরিক আমন্ত্রণকে প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব হলো না তাঁর পক্ষে। ছেলেকে দেখে ফিরে যাওয়ার সময় তিনি আমাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যান। সেই থেকে ড্যানিয়েল আমাকে বিশেষভাবে পছন্দ করে। ভাবলাম, পেনসিল-স্কেচ কিংবা পেন-ইঙ্ক পোর্ট্রেট যেটাই সে করে দিক না কেন, ১৫ই আগস্টের বঙ্গবন্ধু-স্মরণানুষ্ঠানে সেটা হবে এক দারুণ সংযুক্তি।

ড্যানিয়েল হোল্টগেন ছিল বেশ ফুরফুরে মেজাজে। অপরাহ্ণের রোদ তখন আমাদের বাগানের গার্ডেন ক্লকটার ওপর ছায়া ফেলে দিগন্তের দিকে চলে যাচ্ছে। অদূরের কয়েকটা এলম গাছের ছায়ায় বসে গল্প করছিল স্কটিশ শিলাঘ স্নেইডন এবং স্পেনের ফিওনা ভেলভেডিয়ার। বাড়ির পরিচারিকা জিলবেঘ তার ফরাসি মিনি-কারটাতে কেবলই স্টার্ট দিয়েছিল। ওপরের জানালা থেকে দেখা যাচ্ছিল তার ধূসর রঙের গাড়িটা। দরজায় টোকা দিয়ে অপেক্ষা করি। ‘এসো’ শুনেই আমি ঢুকে পড়ি দোতলায় ড্যানের ঘরে। কিন্তু ঢুকেই যে-দৃশ্যের মুখোমুখি হই তাতে বিব্রত ও অনুতপ্ত হয়ে পশ্চাদপসরণের উদ্যোগ নিতেই ড্যানিয়েল আমাকে বাধা দেয় –

: চলে যাচ্ছো কেন? তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিই, আমার ইংলিশ বান্ধবী জেইন। উস্টারশায়ার ওর বাড়ি। সাংবাদিকতায় এমফিল করছে এখানে।

ড্যানিয়েলের কথায় আমি নিশ্চয়ই পরিচিত হতে চাই কিন্তু সংকোচ আমাকে শীর্ণ করে দেয়। জেইনের পরনে লিলেনের পাতলা একটা গোলাপি শেমিজ। শেমিজের স্বচ্ছতার ওপারে তার পরনের লাল ব্রা এবং লাল প্যান্টি তাকে অপর কোনো লোকের বাসিন্দায় পরিণত করেছে। মনে মনে আমি ড্যানকে শাপশাপান্ত করতে থাকি। ওর অনুমতি পেয়েই আমি ঢুকেছিলাম ওর কক্ষে। দুজনের কারোর মধ্যেই নেই কোনো জড়তা। নিজের সংকোচের জন্যে মনে মনে নিজেকেই আমার অপরাধী মনে হয়। বললাম, পরে একসময় আসি। ড্যানিয়েল বললো, কোনো সমস্যা নেই। জেইন বিশ্রাম নিক, তুমি আমাকে বলতে পারো। জেইনের কাছ থেকে তখনকার মতো বিদায় নিয়ে হাতের বক্সবোর্ডটা ড্যানিয়েলকে হস্তান্তর করে সংক্ষেপে বিষয়টা ওকে বুঝিয়ে দিলাম, যার সারমর্ম হলো, ১৫ তারিখ সন্ধে ছ’টায় অনুষ্ঠান, কাজেই বিকেল পাঁচটার মধ্যে পেলেই চলে। এনভেলাপে মোড়ানো বঙ্গবন্ধুর ছবিটা টেবিলের ওপর রেখে সে বললো, পেনসিল-স্কেচই করে দেবো, নো টেনশন, ১৫ই আগস্ট বিকেল পাঁচটার মধ্যেই পাবে তুমি। মাথা থেকে যেন একটা বিরাট ভার নেমে গেল এবং ভিন্ন আরেকটি ভারও চেপে বসলো। ফয়সালকে বলেকয়ে সবাই মিলে স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন তো করা গেল। এখন সেটিকে সফল করে তুলতে না পারলে সমালোচকদের কথা সহ্য করতে হবে। এটিও সিদ্ধান্ত হয়েছিল, আমরা চাইলে আমাদের বিদেশি বন্ধুদেরও সঙ্গে নিয়ে আসতে পারি। কানাডা থেকে সোসাইটির প্রেসিডেন্ট মযহারুল ইসলামের বার্তা এসে পৌঁছায়, তিনি ১২ই আগস্ট ক্যামব্রিজে এসে পৌঁছাবেন। তাঁর স্ত্রী শার্লির মা সুস্থ হয়ে উঠেছেন, আপাতত আশঙ্কামুক্ত।

ড্যানিয়েল হোল্টগেন যেহেতু আমারই হাউজমেট ওর গতিবিধিতে লক্ষ রাখার পক্ষে সুবিধে হয় আমার। যদিও সে স্কেচটা করবে জনান্তিকে তার নিজস্ব অবসরে। এদিকে যে জেইনের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটলো দেখলাম সে ওকে নিয়েই ব্যস্ত। একদিন চলে গেল গ্রান্টার দিকে কবি রুপার্ট ব্রুকের স্মৃতিময় পাবটাতে কফি খাওয়ার জন্যে। আরেকদিন দেখি, দুজনে স্কোয়াশ খেলছে ব্যারেলস রোডের কোর্টটাতে। কোর্টটা ম্যাডিংলে থেকে ডানে ঘুরতেই, ফলে লাইব্রেরি যাওয়া-আসার পথে চোখে পড়বে অনিবার্যভাবেই। মনে মনে ভাবি, কাজের ফাঁকে ও নিশ্চয়ই স্কেচটা করছে। কৌতূহল প্রকাশ অসৌজন্য হতে পারে ভেবে আমি নীরব থাকি। কাজের অগ্রগতি জানতে চাইলে সে যদি ভেবে বসে আমি তার ওপর আস্থাশীল নই, তাহলে আমার জন্যে সেটা হবে লজ্জার। তাছাড়া কাজটা সে করে দিচ্ছে স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই। ওর মায়ের আমি আদরযত্ন করেছি বলে নয়, ওর সঙ্গে বাড়তি একটা আন্তরিকতা গড়ে উঠেছিল বাড়িতে ঢোকার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। গুন্টার গ্রাস আমার একজন প্রিয় ঔপন্যাসিক জেনে খুশি হয়েছিল সে। হাইনরিশ ব্যোলের ছোটগল্পের আমি অনুরক্ত। যখন জানলাম, কোলোনে ব্যোলের বাড়ির পাশেই থাকে ড্যানের বড় খালা আমার মনে হলো ব্যোল আমারও যেন পরিচিত। আমি জার্মান চলচ্চিত্র-নির্মাতা ওয়ার্নার হার্জগের ভক্ত জেনে ড্যান আরো খুশি। বললো, হার্জগের ফিল্মের রম্ এনে দেবো তোমাকে। এটা হতে পারে, নিজেকে প্রবোধ দিই, জেইন বেড়াতে এসেছে কদিনের জন্যে। মনোযোগ দিয়ে কাজটা করতে গেলে ড্যানের হয়তো একটা বেলাই লাগবে। এক বিকেলে আড়চোখে দেখলাম, টেবিলে বসে ও চার-পাঁচটা পেনসিল খুব মনোযোগ দিয়ে পরখ করছে। আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয় নিশ্চয়তার বোধ।

আগস্টের প্রথম সপ্তাহে এক সন্ধ্যায় আমরা মিলিত হই শাহরিয়ার ফয়সালের ঘরে। অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি সম্পর্কে চলে কথাবার্তা। অর্থনীতি বিভাগের আজমল জানাল, ওই সময়টাতে অক্সফোর্ড থেকে বাঙালি এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ ড. স্বপন আদনান ক্যামব্রিজে আসতে পারেন। গ্রামীণ অর্থনীতি বিষয়ে অক্সফোর্ডে গবেষণা করছিলেন তিনি। ক্যামব্রিজেও তাঁর ইচ্ছে টক দেবেন। এতকাল আমরা জানতাম, বন্যা খুব খারাপ জিনিস, সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়, সব ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু স্বপন আদনান বলছেন, না, সব বন্যা খারাপ নয়। বন্যাকে বরং কাজে লাগানোর কৌশলটা উদ্ভাবন করতে হবে। আর ইচ্ছে করলে পরিকল্পিতভাবেও বন্যার আয়োজন করা যায়, ইত্যাদি। অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের ছেলেরও নাকি ক্যামব্রিজে আসার কথা রয়েছে। তাহলে অনুষ্ঠানে আমরা আরো দুজন অতিথি পাচ্ছি। সুনন্দা আমাদের আবৃত্তি করে শোনায়, ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’। অন্য যারা কবিতা আবৃত্তি করবে তারাও রিহার্সাল দিয়েছে নিজ-নিজ উদ্যোগে। ব্রিটিশ বাঙালি ফারহানা বাংলায় বললেও শোনায় ইংরেজির মতো, তবু আমরা ঠিক করলাম মহাদেব সাহার ‘আমি কি বলতে পেরেছিলাম’ কবিতাটা ও-ই আবৃত্তি করবে। নির্মলের ধারণা, কবিতাটা বড় তাই ফারহানাকে অন্য কোনো কবিতা দেওয়া হোক। কিন্তু ফারহানার এ-কবিতাটাই পছন্দ। ফয়সাল আমাকে কানে-কানে বলেন, ফারহানার মতো যারা ইংল্যান্ডে থাকে, বাঙালি, তাদের যদি আমরা সুযোগ দিই তাহলে সেটা নতুন প্রজন্মের জন্যে একটা অনুপ্রেরণা হয়ে দেখা দেবে। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর অবদান সম্পর্কে ওদেরই বেশি জানা দরকার, ওরাই তো ভবিষ্যৎ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একটা গান ‘চাঁদ তুমি ফিরে যাও’ গাইবে পরিসংখ্যানের শিক্ষার্থী মুক্তি রহমান। ফয়সাল ফোঁড়ন কাটে, মুক্তির গান আমরা কয়েকবার শুনবো যদি তিনি আমাদের আজ রাতে ম্যাকডোনাল্ডে চিকেন বার্গার আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাওয়ান। আমিও যোগ দিই, ঠিক আছে কফিটা না-হয় আমিই খাওয়াবো। এভাবেই একসময় রাত বাড়ে। আমরা যে যার বাড়ি ফিরে যাই।     

দূরে প্রথমে একটা চার্চে তারপর কাছে দূরের অন্যান্য চার্চেও ঘণ্টা বাজে রাত বারোটার। কিংস, সেন্ট জন্স, ট্রিনিটি এইসব কলেজের চার্চ ছাড়াও সিটি সেন্টারের রাউন্ড চার্চে বাজে ঘণ্টা। সব ঘণ্টা একসঙ্গে না বাজলেও মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে বাজে এবং মনে হয় যেন বেজে ওঠে এক ঘণ্টা-কোরাস। সেই কোরাস কর্কশ নয়, খুব সুরেলা ও সাংগীতিক। ঘণ্টার পর অকস্মাৎ সব এমন চুপচাপ আর ঠান্ডা মেরে যায় যে, একটি পত্রপতনের শব্দও বুঝি শোনা যাবে উৎকর্ণ হলে। দেশের ছবি উঁকি দেয় মনে। এত বড় আকাশটা বিশাল ছাদের মতো আর তার নিচে বয়ে চলেছে কতশত বছরের কথা ও কাহিনি। বাবা নিশ্চয়ই গভীর ঘুমে অচেতন। ভাবছেন, তাঁর সন্তান বিদেশ থেকে ফিরবে আরো বিদ্বান আর আরো জ্ঞানী হয়ে। বাবার স্মৃতি আমাকে নিয়ে যায় ১৯৭৪-এ। জানুয়ারির শেষ দিককার কথা। শীত তখনো বিদায় নেয়নি। অফিস থেকে ফেরেন তিনি সারাদিনের কর্মক্লান্তি নিয়ে; কিন্তু সেদিন তাঁর মন ভরে ছিল অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে। যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো এসেছিলেন বাংলাদেশ সফরে। বঙ্গবন্ধু তাঁকে নিয়ে যাবেন রাঙামাটি লেক সফরে। চট্টগ্রাম শহর থেকে গাড়ি করে তাঁরা যাবেন সেখানে। বাবা ছিলেন গোল্ডেন বেঙ্গল টোব্যাকো কোম্পানির চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। অনেকে মজা করে বলতো, সিগারেট কোম্পানির বড় কর্তা; কিন্তু ধূমপান করেন না। বাবার অনেকগুলি গাড়ি ছিল অফিসের – মার্সিডিজ, টয়োটা, ডাটসান, প্রিন্স, নিশান, মাইক্রো, হুইল জিপ এরকম বেশ কয়েকটা। এগুলির মধ্যে জেলা প্রশাসন তাঁর মার্সিডিজ গাড়িটা ‘রিকুইজিশন’ করেছে বঙ্গবন্ধু এবং মার্শাল টিটোকে চট্টগ্রাম শহর থেকে রাঙামাটি নিয়ে যাওয়ার জন্যে। ক্লাস এইটের ছাত্র আমি সেই প্রথম জানলাম গাড়ি ‘রিকুইজিশন’ কাকে বলে। বাবার খুশির কারণ, তাঁকে যে-গাড়ি অফিসে বয়ে নিয়ে যায় সেটা বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতার স্মৃতিধন্য হয়ে উঠবে অচিরে। 

সেদিন আড়চোখে ড্যানিয়েলের পেন্সিল-পর্যবেক্ষণ আমাকে খানিকটা স্বস্তি দিলেও দুদিন পরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার মধ্যে দারুণ বিপন্নতা ও সংশয় জাগিয়ে তোলে। হাতে সময় ছিল তখন মাত্র তিনদিন। আমাদের সমস্ত আয়োজন ও রিহার্সাল বলতে গেলে চূড়ান্ত। দুপুর বেলাটায় আমি আধঘণ্টা সময়ের জন্যে বাড়ি আসি। হিসাব করে দেখেছি দেড় পাউন্ড খরচ করে চিকেন/ এগ স্যান্ডউইচ খাওয়াই যায়। তাতে বড় জোর ১০ মিনিট সময়ই বাঁচে। তার চেয়ে ঘরে ফিরে নিজের রান্না খেয়ে অন্তত পাঁচ মিনিট গড়িয়ে নিলে বরং একটা নবজাগরণ ঘটে, যার শক্তিতে বাকি সময়টা অর্থাৎ রাত পৌনে ন’টা পর্যন্ত বইয়ের ভুবনে কাটিয়ে ফেরা যায়। আমি ছাড়া আর ছিল মরিশাসের বিজয় বীরস্বামী। একবার নিচে নেমেছিল ব্ল্যাক কফি বানানোর জন্যে। আর দোতলায় আমার একটা কামরা পরে জেসিকা ট্যান্ডি। তিন কাপের সমান এক কাপ গ্রিন টি খাবেই দুপুরে। জেসমিন বানিয়ে ‘সি ইউ’ বলে সে-ও চলে যায় তার কামরায়। হলের বেরিবুশের দেয়ালের ওপার থেকে ভেসে আসে শিশুদের কলকাকলি। অপর  পারেই রবিনসন কলেজের মাঠ। সেটা আবার চেস্টারটন স্কুলের বাচ্চাদের খেলাধুলার জন্যেও ব্যবহার করা হয়। ওপরে নিজের কক্ষ থেকে বেশ দেখা যাবে তাদের ছোটাছুটি হইচই।

টুনা-স্যান্ডউইচ খেয়ে কেবল কফিতে চুমুক দিয়েছি অমনি হেঁকে ওঠে ডোরবেল। ভেবেচিন্তেই খোলা উচিত ছিল কিন্তু নারীমুখ দেখে বলা যায় স্বয়ংচালিতের মতো আমি ভেতর থেকে দরোজার পাল্লা সরিয়ে দিতেই ‘হাই’ বলে অপূর্ব সুন্দরী একটি মেয়ে বলে, ‘মে আই কাম ইন?’ ওকে বসালাম সিটিং রুমে। নিজে থেকেই পরিচয় দেয় সে। ওর নাম এরিকা। এসেছে জার্মানির স্টুটগার্ট থেকে এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে সে জানায়, আমি ড্যানিয়েল হোল্টগেনের বান্ধবী। মাত্র কদিন আগে পরিচয় হয়েছিল ড্যানের ইংলিশ বান্ধবী জেইনের সঙ্গে। তাহলে কি ওর দুজন বান্ধবী! আমি ভাবনাক্রান্ত হই। এই দুজনের দুজনই কি বান্ধবী নাকি প্রেমিকা। নাকি একজন বান্ধবী এবং একজন প্রেমিকা। অথবা দুজনই বান্ধবী কিংবা দুজনেই প্রেমিকা। তাহলে কে বান্ধবী কে প্রেমিকা। পারমুটেশন ও কম্বিনেশনের জট একের পর এক সমীকরণেরই সৃষ্টি করে যায় কিন্তু এক্স-এর মান আর বের হয় না। বরং আমার এক্স-এর মান কোন দিকে চলে যায় সে-ই চিন্তায় আমি খানিকটা দুর্ভাবনায় পড়ি। আমার বঙ্গবন্ধুর স্কেচ বা পোর্ট্রেটের কী হবে। এভাবে একের পর এক ড্যানিয়েলের বান্ধবীরা (কিংবা প্রেমিকারা) আসতে থাকলে কখন সে আমার কাজে ব্যাপৃত হবে। আমার মনে হতে থাকে ওরা আসছে আসলে আমার সময়টাকে ছিনতাই করে নিতে। এরিকার আগমনের আগাম সংবাদ ড্যানের জানার কথা নয়, সে বলে, এটা সম্পূর্ণ একটা সারপ্রাইজ। ড্যানিয়েল তার বাল্যবন্ধু, ওরা লেখাপড়াও করেছে একই স্কুলে। উভয় পরিবার একে অন্যকে চেনে। এরিকা নিশ্চিত ডিপার্টমেন্ট থেকে ফিরে এসে ওকে দেখতে পেলে সে নিশ্চয়ই খুশি হবে। আমি তাকে স্যান্ডউইচের আহ্বান জানালে সে বিনয়ের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করে, বাড়িতে ড্যান থাকবে না ভেবে সে সিটি সেন্টার থেকে খেয়ে এসেছে – হ্যাম স্যান্ডউইচ। তবে এক কাফ ব্ল্যাক কফিতে ওর আপত্তি নেই। ব্রাজিলের কফি ছিল কাপবোর্ডে। বানিয়ে দিলাম এরিকাকে। এরিকাকে সুন্দরী বললে কম বলা হয়। একবার মনে হয় ওর গায়ের রং গোলাপি, আবার মনে হয় দুধে আলতা; কিন্তু খানিকটা কাঁচা হলদেটে ভাবও আভাসিত হয় ওর চেহারায়। যদিও গাত্রবর্ণ সৌন্দর্যের মূল মানদণ্ড নয় তবু বলতে হবে, এরিকার গায়ের রং এবং তার শারীরিক কাঠামো উভয়ের অনুপাত এতটাই সুষমাময় যে, আমার মনে হয়, সুপরিমিতি কথাটা ওর জন্যেই প্রযোজ্য। ওর কফি শেষ হতে না হতেই ড্যানিয়েল হোল্টগেনের আবির্ভাব। সারামুখে উচ্ছ্বাস আর আনন্দ নিয়ে ড্যান এরিকাকে স্বাগত জানায় যেমনটা সে স্বাগত জানিয়েছিল সেদিন তার ইংলিশ বান্ধবী জেইনকে। আমি আরো জটিলতার মুখোমুখি। দুজনের প্রতিই ড্যানের অপরিসীম ভালোবাসার প্রকাশ আমাকে মুগ্ধ করে এবং করে আতঙ্কিতও। অনিবার্য দুটি প্রশ্ন জেগে ওঠে আমার মনের মধ্যে – এক. জেইন এবং এরিকা কি পরস্পর পরস্পরকে চেনে, দুই. ড্যানিয়েল কী আমার বঙ্গবন্ধুর স্কেচ/ পোর্ট্রেটটা করে দিতে পারবে!

১৩ই আগস্ট বৃহস্পতিবার। তার মানে মাঝখানে শুক্রবার একটা দিন এবং তারপরেই উইকএন্ডের প্রথম দিন, শনিবার, ১৫ তারিখ। আমার ভোরে ওঠাই অভ্যাস। কিন্তু আমারও আগে উঠে পড়েছিল ড্যানিয়েল এবং এরিকা। বেড়াতে যাচ্ছে ড্যানের নানাবাড়ি পলার্সপুরি। দুধ-কর্নফ্লেক্স আর ব্ল্যাক কফি সেরে দুজনে পিঠে দুটো ব্যাগ ঝুলিয়ে চলে গেল ওরা ড্রামার স্ট্রিট বাস-স্টেশনের দিকে। আমার কেন জানি মনে হতে থাকে, ড্যান হয়তোবা আমার জন্যে সারপ্রাইজেরই ব্যবস্থা করছে। ও নিশ্চয়ই ছবিটা এরই মধ্যে শেষ করে রেখে দিয়েছে নিজের কাছে, হয়তো ১৫ তারিখ সকালবেলাই হস্তান্তর করবে আমাকে। বস্তুত এ-কদিনে আমি নিজেও বিস্ময়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। বিশেষ করে ড্যান জেইন আর এরিকা বিষয়ক বিস্ময়ের কোনো সমাধান তখনো মেলেনি। যখনই ওদের দেখি আমার চোখের সামনে দুটো প্রশ্নচিহ্ন সমান্তরাল হয়ে দাঁড়ায় আর তার ঠিক পাশেই বিস্ময়চিহ্ন হয়ে আসে জেইন, ড্যানের ইংলিশ বান্ধবী। ধাঁধায় পড়ি আমি। কোথায় ক্যামব্রিজ কোথায় পলার্সপুরি। এখন যদি ড্যান আর এরিকার মনে প্রেমের জোয়ার জেগে ওঠে তাহলে ক্লেয়ার হলের শিক্ষার্থী-কোলাহলের জগৎ ছেড়ে তারা দুটো দিন ওখানেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয় আমার ষোলকলা পূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর পোর্ট্রেট তো হবেই না, উল্টো কবির গংদের ব্যঙ্গ-উপহাস আমাকে বিদ্ধ করবে তীক্ষè। আমি কিংবা ফয়সাল দুজনের কেউই তাকে কোনো জবাব দিতে পারবো না। বসে বসে নিকটের এলম গাছের পাতাঝরা দেখা ছাড়া কিংবা ক্যাম নদীতে ভেসে যাওয়া পর্যটকদের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমরা আর কিছুই করতে পারবো না। বিকেল সিটি সেন্টারে বাজার করতে গিয়ে ফয়সালের সঙ্গে দেখা। হেসে বলেন, কী খবর, সব ঠিকঠাক চলছে তো! পোর্ট্রটেটা অনুষ্ঠানের ঠিক এক ঘণ্টা আগে দেয়ালে লাগিয়ে দিতে হবে। সবাই সময়সচেতন। ৫টায় তো অনুষ্ঠান, দেখবেন ৪.৪৫-এর মধ্যে সবাই এসে হাজির। আমি সাধ্যমতো চেপে যাই বাস্তবের ভারসাম্যহীনতার বিষয়কে। আমার ঘাড় যেন আমার কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই আন্দোলিত হতে থাকে এবং আমার জানাও হয় না সেই আন্দোলন ইতিবাচক না নেতিবাচক। তবে শাহরিয়ার ফয়সাল সম্ভবত সেটিকে ইতিবাচকই ভাবেন। ফলে, ঠিক আছে ঠিক আছে পরশু দেখা হচ্ছে, বলে তিনি চলে যান গ্রনভিল কলেজের সামনে দিয়ে চেস্টারটন রোডের দিকে। এবং কিমাশ্চর্যম! ফয়সালের বিদায়রেখার দিক থেকেই প্রায় অলৌকিকতার মতো হেলেদুলে একজনের ঘাড়ে আরেকজন মাথা ঠেকিয়ে হেঁটে আসতে থাকে – ড্যান এবং এরিকা। আনন্দ ছড়ায় আমার ভেতরে। আমি খানিকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। যাক এই একটা দিন কালকের গোটা দিন এবং পরশু সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত অনেকটা সময়। নিশ্চয়ই এইটুকু সময়ের মধ্যে ড্যান বঙ্গবন্ধুর পোর্ট্রেটটা করে দেবে। আমার উচ্চাশা আমাকে এমনটি পর্যন্ত ভাবতে বাধ্য করে, ড্যান হয়তো আমার পোর্ট্রেটটা এঁকে শেষ করার জন্যেই উইলিয়ম কেরির স্মৃতিখচিত ওর নানাবাড়ি নর্দাম্পটনশায়ারের পলার্সপুরি থেকে চলে এসেছে ক্যামব্রিজে। সারা মুখ আলো করে আমি বলি, নাইস টু সি ইউ বোথ। আশা করি তোমরা চমৎকার সময় কাটিয়ে এসেছো? উত্তরে দুজনের অবয়বে আলোকের উদ্ভাস।

কিন্তু হলে ফিরে আমার উচ্চাশা পরিণত হয় আশঙ্কায়। যদিও ড্যান ছিল ওর কক্ষেই। অপরাহ্ণের ছায়া-ছায়া অন্ধকারে দেখতে পাই ড্যানের দরজাটা আলতো খোলা এবং ভেতরে দুজনের কথকতার শব্দ উপচে আসে বাইরে। কথা ওরা বলে ওদের মাতৃভাষা জার্মানে, কিছু শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। ডাস, ইখ, গেস্তে, ক্রুংক্, জের, মরগেন্, গুটেন্ এরকম ছেঁড়া-ছেঁড়া শব্দ আমার কানে ঢোকে কিন্তু তাদের দ্রুতগতি ঠিক-ঠিক অনুসরণ আমার না কুলোলে আমি বরং একটু অপেক্ষা করি। তারপর যে-ঘটনা ঘটে তার জন্যে আমি, ড্যান কিংবা এরিকা কেউই হয়তো প্রস্তুত ছিলাম না। ঘটনাটি আমার মধ্যে এমন একটা লজ্জা আর বিব্রত হওয়ার অনুভূতি জাগায় যে নিজের অপরিণামদর্শিতার ওপরেই আমার মন ভরে যায় ন্যক্কারে। তখন সন্ধ্যা হয়-হয়। হলে কারো থাকার কথা নয় এ-সময়টাতে। কেউ টেনিস কেউ স্কোয়াশ কিংবা কেউ ক্রিকেট খেলতে চলে গেছে মাঠে। অথবা পড়ুয়ারা হাতে হালকা স্ন্যাক্সের প্যাকেট নিয়ে চলে গেছে ক্যামব্রিজ সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে। আমারও তখন লাইব্রেরিতেই থাকার কথা। কিন্তু আমার করোটিতে তখন অবিরাম জলভ্রমির মতো ১৫ই আগস্টের অনুষ্ঠানের ঘুরপাক চলতে থাকে। বিশেষ করে পোর্ট্রেটটার গতিপরিণতি নিয়ে এক অমীমাংসিত ভাবনা আমার মধ্যে একটা অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্ম দিয়ে যায়। আমার কেবলই মনে হয়, পারবে কী ড্যান। মনে-মনে এরিকার প্রতি একটা রাগ দানা বাঁধে, মেয়েটা না এলেই ভালো ছিল, আমি ভাবি। ও আসার ফলে ড্যানের সময় ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে এবং এতে করে হুমকির মুখে পড়ে গেছি আমি। আমি ঠিক উঁকি দিই না, কিংবা ড্যানই হয়তো বা এরিকাই হয়তো আলিঝালি দেখে শব্দ করে। কী শব্দ কে করে আমি ভালো করে বুঝতেও পারি না। আমার মনে হতে থাকে, কেউ আমাকে ‘হাই’ বলে ওঠে এবং সেটিকে সম্ভাষণ ভেবে অবলীলায় আলতো করে ভেজানো দরজাটা একটুখানি সরিয়ে দিলে পাইন কাঠের হালকা দরজা নিজ থেকেই দ্বিগুণ সরে গিয়ে বেশ খানিকটা জায়গা করে দিলে ভূত দেখার মতো চমকে উঠি আমি। যেন ড্যান এরিকা নয় রদ্যাঁর দুটি মূর্তি অকস্মাৎ চলিষ্ণু হয়ে উঠেছে আলোছায়ার রহস্যময়তার ঘূর্ণির মধ্যে। একটা চেয়ারের ওপর বসে ড্যানিয়েল হোল্টগেন এবং ওর কোলের ওপর এরিকা। দুজনেই বসনহীন এবং তাদের একমাত্র আবরণ সৌরজগতের মুক্ত-স্বাধীন আলোক। একমাত্র আলোর পোশাক পরা দুই দীপ্ত প্রাণ নিজেদের স্বাধীনতার স্বপ্নকে উপভোগ করছে প্রাণভরে আর কোথাকার কোন এক বেরসিক আমি কোত্থেকে এসে পদ্মবনে মত্ত হস্তির মতো অনুপ্রবেশ করেছি তাদের সেই স্বপ্নাচ্ছন্নতার মধ্যে। নিজেকে এতটাই ছোট আর ক্লিষ্ট মনে হতে থাকে যে, আমি খুঁজতে থাকি একটুখানি আড়াল যেখানে নিজেকে দ্রুত সটকে নিয়ে ওদের অভিমুখকে করতে পারি অবাধ। আমাকে দেখে না ড্যান না এরিকা দুজনের কাউকেই বিব্রত বলে মনে হয় না এবং তারা একটুও ভড়কে না গিয়ে মৃদু হেসে আমার বিব্রত ভাবটাকেই সামাল নেওয়ার সুযোগ করে দেয় আমাকে। ড্যানই বলে ওঠে, ভয়ের কিছু নেই তোমার প্রোগ্রাম তো পরশু, হয়ে যাবে। দুঃখ প্রকাশের চিরন্তন সেই শব্দ অস্ফুটে উচ্চারণ করে ড্যানকে ধন্যবাদ দিয়ে দরজাটাকে পুনরায় ভেজিয়ে দিয়ে দ্রুত আমি ফিরে আসি আমার কক্ষে। কিন্তু আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে অল্প কয়েকটি মুহূর্তের চকিত ছবি। টেবিলের ওপর মোটা আর্ট পেপার যেমন ছিল তেমনটাই রয়েছে। স্কেচ-পেনসিলগুলিও নাড়াচাড়া করা হয়েছে বলে মনে হলো না। এবং ড্যানের পুরু জিওগ্রাফি এনসাইক্লোপিডিয়ার ওপর রাখা ওকে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ছবিটাও সেভাবেই রাখা। মনে-মনে বিরক্তি-ক্ষোভের তীর ছুড়তে থাকি এরিকাকে লক্ষ্য করে, যদিও ড্যানের ইংরেজ বান্ধবী জেইনও অনেকটা সময় ছিনতাই করে চলে গিয়েছিল। আমার মাথার ভেতরে ধাঁধা, জেইন এবং এরিকা দুজনেই কী করে সমান পর্যায়ের নৈকট্যের অবস্থানে থাকে। এ কোন ভুবনের বাসিন্দা তারা!

চোদ্দো তারিখটা আমার জন্যে বয়ে আনে ঘোর অমানিশা। আর মাত্র একটা দিন মাঝখানে। সমস্ত প্রস্তুতি চূড়ান্ত। সবগুলি গান-কবিতার রিহার্সাল শেষ। ফয়সাল এবং আমি আমরা দুজনেই অনুষ্ঠানের সাফল্যের ব্যাপারে নিশ্চিত, হ্যাঁ, আমাদের দেশ ও জাতির জনকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের দিনটিকে আমরা দূরের এই দেশে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে স্মরণ করতে পারবো। কিন্তু তখনো আমি জানি না আমারই কামরার একটা কামরা পরে জার্মান ড্যানিয়েল সত্যিই আমার সমস্ত সাফল্যের মুখ্য উপাদান বঙ্গবন্ধুর পোর্ট্রেটটা আসলেই সম্পূর্ণ করতে পারলো, নাকি এক আসন্ন অপ্রস্তুত পরিস্থিতির শিকার আমি অপেক্ষা করছি প্রকাশ্যে অপমানিত হওয়ার ইতিহাস রচনা করার জন্যে। আমার আশঙ্কাকে প্রমাণ করার জন্যেই হয়তো সন্ধ্যাটা রচিত হয় আমারই জন্যে। তখন সন্ধে হয়-হয়। কেইন্সসাইডে সম্ভবত কেউই ছিল না। থাকলেও কোনো সাড়া নেই। একটা কাগজে পরদিনকার অনুষ্ঠানের খসড়াটাকে গেঁথে তুলছিলাম আমি। কার পর কে বলবেন, কোন কবিতার পর কোন গান কি আবৃতি এইসব নিয়ে নিমগ্নপ্রায় আমার কোনো খেয়ালই থাকে না পরিপাশর্^ সম্পর্কে। ওভাল আকৃতির জানালা দিয়ে তাকালে দেখতাম রবিনসন কলেজের মাঠে রাগবি খেলায় উদ্দাম সমর্পণে মেতে উঠেছে ওই কলেজেরই দুটো দল। ক্যালেন্ডারে শীতকাল না এলেও জানালা দিয়ে হুহ করে হাওয়া এসে কাঁপিয়ে দেয় হাড় আর মাংসপেশি। আমি তাই ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিই। তবুও খেলোয়াড়দের শ্রমশীল উৎসারণ আমার বন্ধ জানালায় থেকে থেকে ধাক্কা লাগায়। বলতে গেলে আচমকা সমস্ত নিস্তব্ধতাকে দীর্ণ-বিদীর্ণ করে দিয়ে বিচ্ছুরিত হতে থাকে চিৎকার। ভালো করে কান পাতি। ভেসে আসছিল সেই চিৎকার ড্যানের কামরা থেকে। না একা ড্যান নয়, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চেঁচায় এরিকা, ওর জার্মান বান্ধবী। আমি দরজা খুলি না। দ্রুত চেয়ার ছেড়ে বন্ধ দরজায় কান পাতি। দরজা খোলাটা এবং খুলে ওদের কামরার নিকটে যাওয়াটা হবে অভদ্রতা। হ্যাঁ, কোনো বিপদ হলে ওদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়াটাই কর্তব্যকর্ম কিন্তু ওরা আসলে ঝগড়া করছিল। কী ওদের বিষয় কী ওদের উপলক্ষ সেটা জানার সাধ্য আমার থাকে না যেহেতু ওরা চিৎকার করে ওদের মাতৃভাষায়। ঝগড়া ওরা করে ওদেরই কামরার নির্জনতায়। বন্ধ দরজা ভেদ করে শব্দাবলি  এদিক-ওদিক ছিটকে পড়লেও দূরবর্তী কারোর পক্ষে সেটা শুনতে পারা সম্ভব নয়; কিন্তু আমি ওদের নিকট প্রতিবেশী বলে উচ্চারিত প্রায় সমস্ত শব্দ ধেয়ে আসতে থাকে আমারই দিকে। সবটা কেমন যেন ঘোলাটে আর রহস্যে ভরা মনে হতে থাকে আমার। গতকালই যাদের দেখেছি আনন্দমার্গের শীর্ষবিন্দুতে আজ মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তারা ছিটকে পড়লো নিরানন্দের পাদদেশে! ড্যান আর এরিকা দুজনের উচ্ছল নির্দোষ আনন্দপূর্ণ অভিব্যক্তি ভাসে। হ্যাঁ, আমার মনের চোখে ওরা এমনই এক দৃশ্যের রচয়িতা যে-দৃশ্যাবলি জীবনের উপচানো সুখভাণ্ডের বই আর কিছু নয়। ওরা সেই মুক্ত জীবনানন্দের প্রতীক যে-জীবন সকলেই কামনা করে; কিন্তু সকলেই লাভ করে না, করে কেউ-কেউ।

একবার মনে হলো, এরিকা আবার মনে হলো ড্যানিয়েল, কেউ একজন রায় ঘোষণার মতো করে সর্বশেষ বাক্যটি উচ্চারণরত। জার্মান না বুঝলেও শব্দ ও বাক্যের প্রবাহ এবং প্রবাহজনিত পরিণাম আমি আঁচ করতে পারি। আমি আসলে অপেক্ষা করতে থাকি এক আকস্মিক উপসংহারের জন্যেই যে-উপসংহার যবনিকা টেনে দেবে সমস্ত অস্থিরতার, সমস্ত কলস্বনের। একটু পরেই সব সুনসান নীরবতার সাক্ষী। ড্যান কিংবা এরিকা কারো কণ্ঠ শোনা যায় না।

কোথাও দরজা খোলার এবং দরজা লাগানোর শব্দ কানে আসে। আমি আমার কামরার ভেতর থেকে লাগানো দরজার ডোরভিউতে চোখ রাখলে দেখতে পাই, দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে এরিকা এবং তার পেছন পেছন ড্যানিয়েল হোল্টগেন। যে-ব্যাগ কাঁধে জার্মানি থেকে এসেছিল সেই ব্যাগটাই এরিকার কাঁধে এবং ড্যানের শূন্যহাত। বুঝতে পারি, চলে যাচ্ছে এরিকা জার্মানিতে। কোনো একটা কারণে দুজনের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদ এবং তারই পরিণতি একজনের আকস্মিক অপসৃতি। ঝগড়া তো মানুষের সঙ্গে মানুষেরই হয়। কিন্তু আমার মাথায় তখন প্রবল ভাবনার ঘুরপাক। কী হবে আমার পোর্ট্রেটের! এমনকি ড্যানের কামরায় আটকা পড়েছে স্টুডিও থেকে ব্লো-আপ করা বঙ্গবন্ধুর ছবিটাও। পোর্ট্রেট না পেলে সেটির পরিবর্তে অন্তত ছবিটা কোনোভাবে কাজে লাগানো যেত। কেন যে এমন উদ্যোগ আমার মনে হানা দিয়েছিল ভেবে নিজেকে ধিক্কার দিতে থাকি আমি। এমন সুন্দর একটা অনুষ্ঠান শুধু আমারই কারণে বিপর্যয়ে পড়বে, স্পষ্ট চোখের সামনে ভেসে ওঠে কবিরের মুখ, মনে-মনে সে নিশ্চয়ই খুশি হবে আমার অসম্মানের সাক্ষী হতে পেরে।

আমি তবু প্রতীক্ষা করি। একটুখানি শব্দ হলেই ছুটে যাই দরজার দিকে। একবার মনে হয়, ড্যানের কামরা থেকে আবার মনে হয়, আমার দরজার গায়ে কারো টোকা। বুঝতে পারি আমার সমস্ত সত্তায় অবদমনের হামলা আছড়ে পড়েছে। এদিকে ড্যানিয়েল হোল্টগেন উধাও। ওর দরজা বন্ধ এবং তার কোনো দেখা নেই। কৌতূহল আমাকে অস্থির করে তোলে। একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিত, এরিকার সঙ্গে ওর মনোমালিন্য এবং ঝগড়াই হয়েছিল। আরো খানিকটা ঔৎসুক্য ছড়িয়ে দিলে আমি হয়তোবা তাদের ঝগড়ার কারণ হিসেবে ড্যানের ইংরেজ বান্ধবী জেইনকেই দায়ী করতে পারি যদিও আমি স্থির-নিশ্চিত নই সেটাই মুখ্য উপলক্ষ কি না বাদানুবাদের। এমনও হতে পারে, জেইন এবং এরিকাকে ছাড়িয়ে যুক্ত হয়েছে অন্য কেউ অন্য কোনো মেলোড্রামা। ক্লেয়ার হলের রেস্টুরেন্টের দিকে যাই। কৌতূহলী দৃষ্টি ছুড়ে দিতে থাকি চারপাশে। একবার ভাবলাম, ঝগড়াঝাটি কিংবা দুঃখকর পরিস্থিতিকে সামলাতে ওরা খুব বিয়ার-মদ খায়। ড্যান কি তাহলে ক্লেয়ার হলের পাবের কোনো এক কোণে বসে সমানে মদ বা বিয়ার পান করে চলেছে এবং ঘটে যাওয়া ঘটনাকে অতীতের বিষয়-আশয় বলে নিজেকে নতুন দিনের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নাহ্, নেই, কোথাও সে নেই। পাবের ম্যানেজার জেমসকে আগ বাড়িয়ে জানতে চাই ওর নিয়মিত গ্রাহক ড্যানিয়েল সম্পর্কে; কিন্তু সে জানায়, পূর্বদিন রাতেই তার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল ড্যানিয়েল হোল্টগেনের। সন্ধ্যায় টেলিফোন পেলাম শাহরিয়ার ফয়সালের। অনুষ্ঠান নিয়ে বেশ একটা সন্তোষ আর তৃপ্তির ভাব মনে যে-অনুষ্ঠান তখনো হয়নি। আমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেন না ফয়সাল, অন্তত শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে আমি যেন অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর পোর্ট্রেটটা বোর্ডে লাগিয়ে দিই। স্বয়ংচল আমার ঘাড় নাড়া টেলিফোনে ফয়সালের দেখার কথা নয় কিন্তু সামান্যতম চিড় তাঁর পক্ষে টের পাওয়া সম্ভব ছিল না। এই একটা দিনের মধ্যে ড্যানিয়েলের আকস্মিক অন্তর্ধানের বিপর্যয় কাটিয়ে কী করে আমি সাফল্যের রেখা স্পর্শ করবো সে-সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকলেও আমি আস্থার সঙ্গে বলি, হ্যাঁ, পোর্ট্রেটটা আমি ঠিক সময়ে লাগিয়ে দেবো অনুষ্ঠানের জায়গাটাতে।

দিন পৌঁছে যায় দিনের অন্তে। অন্ধকার গাঢ় গাঢ়তর হয়ে ঘিরে ধরে কেইন্সসাইড হাউজকে। সাউথ আফ্রিকার ক্রিসের সঙ্গে দেখা হয় কিচেনে। কথা হয় জে এম কোয়েৎজি সম্পর্কে। কোয়েৎজি এবং ক্রিসের বাড়ি একই জায়গায়। ইতালির মারিয়া গ্রাৎসিয়া লোলার কণ্ঠে সাফল্যের ঝিলিক। ডেরেক ওয়ালকট বিষয়ে তার পিএইচ.ডি থিসিসের কাজ সে গুছিয়ে এনেছে। গ্রাৎসিয়ার সংগ্রহে থাকা ওয়ালকটের ‘ওমেরস’ বইটা সে আমাকে দেখিয়েছিল কয়েকদিন আগে, যে-বইতে অটোগ্রাফ রয়েছে স্বয়ং ওয়ালকটেরই। মজার কথা, ওয়ালকট তখনো নোবেল পাননি। ডেনমার্কের কামিলা লুন্ড রাতের ডিনার সারে শুধু সালাদ দিয়ে। লাল রঙের মুলা, গাজর আর সালাদপাতার সঙ্গে কুঁচিকুঁচি করে কাটা একটা সবুজ আপেল – এই তার খাবার। আমি জিজ্ঞেস করি, খিদে লাগে না রাতে? মাথা নাড়ায় কামিলা, একটুও না। মনে মনে বলি, সবই অভ্যাসের ফল। এত ঘটনা ঘটে তবু ড্যানিয়েলের দেখা নেই। শেষ পর্যন্ত আমি মনে জমে ওঠা প্রবল হতাশার বোধ নিয়ে কক্ষে ফিরে যাই। তারপরেও কান পেতে থাকি যতক্ষণ জেগে থাকি ঠিক ততক্ষণই। এই বুঝি শব্দ হয় এবং খুলে যায় ড্যানিয়েলের দরজা কিংবা বেজে ওঠে ওর কণ্ঠস্বর। চার্চের ঘণ্টা মধ্যরাতের ঘোষণা দিলে শূন্যতা ও অপ্রাপ্তির এক অজানা অনুভব বুকে নিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। আমার সমস্ত ক্ষোভ ও বিরক্তির লক্ষ্যবস্তুত তখন আর কেউ না, না ড্যান না এরিকা, আমি স্বয়ং। আমারই অপরিপক্ব ভাবনা ও অপরিণামদর্শী আয়োজনের ফলে আমাকে একটা লজ্জাকর পরিস্থিতির শিকার হতে হবে ভেবে নিরানন্দের আচ্ছন্নতা নিয়ে একসময়ে তলিয়ে যাই ঘুমের রাজ্যে।

ক্লান্তি এতটাই আমাকে দখল করে যে অনিশ্চয়তা আর সংশয়ের দ্বিমুখী আক্রমণও আমার নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না। তখন সকাল হয়েছে কি হয়নি। একটা-দুটো পাখির ডাক শোনা যায়। কেইন্সসাইড হাউজের লাগোয়া অর্থনীতিবিদ জন কেইন্সের বাড়ির বাগানের আপেল গাছগুলিতে ঝুলে থাকা পাখিদের জন্য বানানো কাঠের কুঠুরিগুলিতে নিশ্চয়ই ঠোকরাতে শুরু করেছে খাদ্যান্বেষী ক্ষুধার্ত পাখিরা। ছোট ছোট কাঠের বাক্স দূর থেকে একেকটা কুটিরশিল্পের মতো দেখায়। পাখিরা জানে, ওখানে খাবার থাকে তাই তারা নিয়মিত কুঠুরিগুলিতে ভিড় জমায়। হয়তো তারই শব্দ ভেসে আসে। অন্য সময় হলে ম্যাডিংলে রোডের দ্রুত ছুটে যাওয়া গাড়ির শব্দ কানে আসতো না। কিন্তু এই সুনসান ভোরের বেলায় কিছুক্ষণ পরপর দুই দিক থেকে ছুটে যাওয়া গাড়ির সাঁই সাঁই শব্দ পাওয়া যায়। এসব ছাড়িয়ে আচমকা আমার কানে বাজে একটা টোকার মতো শব্দ; মনে হতে থাকে কেউ টোকা দিচ্ছে আমারই কামরার দরজায়। চকিতে আমার মনে ভেসে ওঠে দিনকয়েক আগেকার দৃশ্য। আমাদের হাউজক্যাট স্পটিকে ওর মালিক আমাদেরই হাউজমেড ফরাসি জিলবেখ আমার জিম্মায় রেখে উইকএন্ড কাটাতে গিয়েছিল মার্সেইতে ওর বাড়িতে। দেখি ক্ষুধার্ত স্পটি ভোরবেলা আমার ঘরের দরজায় শব্দ করছিল ওর কোমল লেজের ঘষটানি দিয়ে। ঠিকই আমার ঘুম ভেঙে যায় এবং আমি কাপবোর্ডে রাখা টিনের কৌটো থেকে বের করে দিই ওর খাবার। কিন্তু সেরকম ঘষটানির শব্দ নয়। স্পষ্ট টোকারই শব্দ এবং জোরালো নয়, মৃদু এবং ছন্দময়। তড়াক করে বিছানা ছেড়ে চোখ রাখি ডোরভিউতে। দেখে নিজের চোখকে বিশ^াস করতে কষ্ট হয় আমার। দরজায় টোকা দেয় ড্যানিয়েল হোল্টগেন। ওর হাতে ধরা আর্টপেপার ডোরভিউ থেকে স্পষ্ট চোখে পড়ে।  

কিন্তু ভালো করে না ফোটা ভোরের আলোতেও দেখতে পাই রক্তজবার মতো চোখ করে তাকানো ড্যানকে। মনে হচ্ছিল লাল রঙের দুটো অনামা কোনো ফল তার দুই চোখের জায়গা দখল করে বসেছে। ওর এক হাতে আমার দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ব্লো-আপ ছবিটা যেটি আমি ইডেন লিলি থেকে পরিস্ফুটন করিয়ে এনেছিলাম ওর জন্যে। অন্য হাতে ওর আঁকা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি এবং সেখানে তাঁর উত্তোলিত হাতের তর্জনী যেন স্পষ্ট নিবদ্ধ করে রয়েছে নয়া ঔপনিবেশিক বৈরী প্রতিপক্ষের দিকে। আমার সমস্ত শরীর নিংড়ানো আবেগ বুকের কাছে এসে জমে ফেটে পড়ার অপেক্ষায়। কিন্তু ড্যানিয়েলের রক্তলাল চোখ দেখে আমি আঁচ করি রাতজেগে সে গড়ে তুলেছে পোর্ট্রেটটা। আমার অনুমানই সঠিক। ড্রামার স্ট্রিটে এরিকাকে বিদায় জানিয়ে ড্যান সোজা গিয়ে ঢোকে মডলেন স্ট্রিটের পানশালায়। মাঝরাত অবধি মদ খেয়ে যখন ইউফোরিয়ায় টলটলায়মান তখনই হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় আমাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা। ফিরে এসে এক বসায় চার্চের ঘণ্টায় ভোরের ঘোষণার সমান্তরালে কাজটা শেষ করা সম্ভব হয় তার। কী বলে যে ওকে ধন্যবাদ-কৃতজ্ঞতা জানানো যায় আমি খুঁজে পাই না। শুধু অস্ফুটে বলি, ড্যানিয়েল, ভাই, আজ তুমি আমার জন্যে যে কাজটা করলে তার কোনো প্রতিদান হয় না। সত্যি তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। ড্যান আমাকে পাল্টা কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলে, পরশু তুমি যে চিকেন কোর্মাটা খাইয়েছিলে সেটা খুব পছন্দ হয়েছে এরিকার। বলছিল, তোমার কাছ থেকে লিখে নেবে রেসিপিটা। জার্মানি গিয়ে রান্না করে খাওয়াবে ওর মাকে। ক্লান্ত-বিষণ্ন ড্যানিয়েল হোল্টগেন ওর কামরায় গিয়ে দরজা আটকে দেয়। ভোরের আলো আরো স্বচ্ছতা নিয়ে আসে। সেই স্বচ্ছতার উদ্ভাসে দাঁড়িয়ে আমি আমার ওভাল আকৃতির জানালার সামনে ড্যানের আঁকা জাতির জনকের পোর্ট্রেটটা তুলে ধরি আর আমার পূর্বপঠিত ইতিহাসের পৃষ্ঠায় শুনতে পাই সমুদ্রের গর্জন : সাত কোটি বাঙালিকে তোমরা দাবায়া রাখতে পারবা না!

পুনশ্চ, ড্যানিয়েলের ইংরেজ বান্ধবী জেইনের একটা কানের টব কী করে যেন আটকে গিয়েছিল তার কামরার কার্পেটের মধ্যে। হয়তো সেটি বহু খুঁজেও আর পায়নি সে। কিন্তু পায় এরিকা। ছোট ছোট ডায়মন্ডের ঘেরাটোপে ছোট্ট সবুজ এক টুকরো দ্বীপের মতো এমারেল্ডটা ঘোষণার মতো উন্মোচিত করে ড্যানিয়েলের অপর বান্ধবী জেইনের কাহিনি। সেই কাহিনির অনিবার্য পরিণামের বাকিটুকু আমি কল্পনা করে নিতে পারি।