পথ পসারিণী

আজকের দুপুরটা একটু অন্যরকম লাগছে। যেন ঝিরিঝিরি হাওয়ায় প্রকৃতির সঙ্গে মানুষও দুলছে। সাড়াশব্দহীন, একটুবা প্রগাঢ় রহস্যময়। জলাশয়ের বুকে ছোট ছোট ঢেউয়ের যেমন  কোনো শব্দ থাকে না, ঠিক এমনই একটা ক্ষীণ গতির কাছে বেমালুম বোকা বনে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছি। কী নেই, কিই-বা আছে … আমার কি চোখ টপকাচ্ছে? নাকি প্রকৃতির!

নিজেকে নিজের ভেতর খুঁজে পাওয়ার অনিঃশেষ বোধ নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম। অনেক ভিড়। সিরিয়াল দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। দুপুরের রোদ ঝিমিয়ে আসার পর মলিন একটা চিত্রপটে নামে  থোকা-থোকা বিস্ময়। সে-ও এক অদ্ভুত ধাঁধা। শূন্যতার সঙ্গে শূন্যতার ঘোরপ্যাঁচহীন খেলা, যেন নিজেকে হারিয়ে নিজেকেই খোঁজা, পথভোলা পথিকের আমূলবিদ্ধ উদাসীনতার সঙ্গে কখন যে মিশে যায় নিজের অনুভব, আশ্চর্য!

পাশে কার যেন ক্ষীণ স্বর শুনতে পেলাম। মুখটা বোরখায় ঢাকা, মাঝারি স্বাস্থ্যের এক মহিলা বলছে, ভাই, আমার মা হসপিটালে ভর্তি, অনেক টেকার দরকার। বিপদে পইরা আত পাতছি।

তোমার মা-র নাম কী?

প্রশ্নটা অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও মূর্তমান দৃশ্যপটের শূন্যতায় নিজেকে যথেষ্ট খাপছাড়া লাগছে। মহিলা অবাক না হয়ে গদগদ কণ্ঠে বলে, মৌসুমি।

কেমন যেন ধাক্কা লাগল। শূন্যতার ভেতর কী শুরু হলো বাতাসের ফোঁসফাঁস, বলি, তোমার নাম কী?

আমার নাম আসমা, কিছু দিবেন বাজান।

ভাই থেকে বাজান। কেমন যেন অসময়োচিত হাঁকডাক। পকেট হাতড়ে একশ টাকার নোট হাতে দিতেই অকৃতজ্ঞের মতো হনহন করে হেঁটে জনস্রোতে মিশে গেল। ঊর্ধ্বাকাশে তাকালাম। জাগতিক জীবনের স্বচ্ছ বিশ^াসে মোচড় দিয়ে পৃথিবীর দূরত্বে বর্ধিত হচ্ছে অনাবিল স্বস্তি, কোনো ভণ্ডামি নাই।

পরদিন মন খারাপ করে পড়ে থাকলাম। মায়ের হালকা বকুনিও খেলাম। মা সচরাচর চটে না, কিন্তু কী করবে, সন্তানের কণ্ঠে কোনো নির্ভরতা নেই, কাজে কোনো গতি নাই। আলোক সঞ্চার করা ইচ্ছাশক্তির কাছে এসে যায় আড়ষ্টতা। গলা-ফাটা ডাক দিয়ে কাউকে আপন করতে পারি না। একটা বিকৃত ছন্দ এসে যায়। বাইরে তাকাই, ও-বাড়ির ছাদে কাকটা মৃদু স্বরে কা-কা করলেও ঘিঞ্জিময় ভবন থেকে ভবনের দেয়ালে যেন কানফাটা প্রতিধ্বনি হচ্ছে। মা চা এনে বলল, কাল ভোরে  রেলস্টেশন থেকে চার তারিখের দুটো টিকেট নিয়ে আসবি।

কেন?

তোর বাবা গ্রামের বাড়ি যাবে।

অনলাইনে কেটে দেবো।

অনলাইনে সচরাচর পাওয়া যায় না।

না পেলে স্টেশনে যাব।

তুইও যাবি নাকি আমাদের সঙ্গে?

না।

মা চলে যাওয়ার পর উঠে বসলাম। জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে থাকি। মনে হচ্ছে, লোকে লোকারণ্য একেকটি রাস্তা ক্রমশ নিস্তেজ হচ্ছে, সেখানে সংসার জিনিসটা হয়ে উঠছে কেমন বিলীয়মান বাস্তবতা। কখনো কখনো অতি গুরুত্বের গুরুভার নিয়ে নিকট ও দূরের দৃশ্যপটে চেপে বসে অসাড়তা। কিছুই মেলে না। সামঞ্জস্যহীন অনড় বোধে না-পাই সিদ্ধান্ত, না-পাই গন্তব্য।

পরদিন অনলাইনে টিকিট না পেয়ে চলে যাই স্টেশনে। কাউন্টারে দীর্ঘ লাইন। কী আর করা, ঘাড় ও মাথায় ক্রমশ খিচে আসা ব্যথা নিয়ে সম্ভবত একচল্লিশজনের পেছনে দাঁড়ালাম। রাতে তেমন ঘুম হয়নি, একটু বিবমিষা চাপে। তবু তীর্থের কাকের মতো সামনে তাকাতেই পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে মুখ ঘুরিয়ে তাকাই। ক্লিনিকের বাইরের সেই মহিলাটি। একটু নিকটে এসে লঘু অথচ কনকনে গলায় বলল, বাজান আমি  মোহনগঞ্জ যাইতে আইছিলাম। ব্যাগটা কেডায় জানি চুরি কইরা নিছেগা, বিপদে পইড়া গেছি।

মহিলা আজো বোরখায় ঢাকা। আমাকে চিনতে পারেনি।  চেনার কথাও না। প্রতিটি মুহূর্তই তাদের কাছে কথা ও চাতুর্যের আপেক্ষিক বিচারে তুচ্ছ। গলার স্বর খাদে নিয়ে বললাম,  তোমার স্বামী নাই?

আছে, ল্যাংড়া, ঘরে পইড়া থাহে সারাদিন।

মোহনগঞ্জ কে থাকে তোমার?

মহিলা থতমত খেয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, আমার বাপের বাড়ি।

ওহ্।

পকেট হাতড়ে ফের একশ টাকা দিতেই দ্রুত দিকবদল করে হাঁটা দিলো। কী নির্ভেজাল ভণ্ডামি, বেঁচে থাকার আকুতি প্রকট হলে জগৎসুদ্ধ শুরু হয় মারণাস্ত্রহীন মানসিক কৌশলের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা।

অকস্মাৎ আমার মনে কেমন একটা পরিবর্তন শুরু হলো। কাউন্টার ও টিকিটের কথা ভুলে সোঁদাগন্ধময় স্টেশনের বাইরে এসে আড়াল থেকে মহিলার পিছু নিলাম। প্রাইভেটকার থেকে একজন ভদ্রমহিলা নামতেই তার পায়ে পড়ে মহিলা কু-কু করে কাঁদতে থাকে। এমন অনাকাক্সিক্ষত আচরণে ভদ্রমহিলা কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ভ্রু কুচকে অন্যত্র তাকিয়ে থাকে। মুখঢাকা আত্মপ্রতারণার কপট ও ধূর্ত মহিলাটি অবলম্বনহীনভাবে বলতে থাকে, মা, আমার সোয়ামীটা মইরা গেছে গাড়ির নিচে পইড়া। আমি অসহায় মা।

বাসায় কাজ করতে পারো না?

মাজায় খুব বিষ-বেদনায় কাম করার পারি নাগো মা।

ভদ্রমহিলা পার্স খুলে পাঁচশো টাকার নোট দিয়ে বলল, আমার মার জন্যে একটু দোয়া করো, হসপিটাল আছে।

হাতে টাকা নিয়েই বোরখাওয়ালি দুই হাত তুলে দোয়া করতে করতে দুটো রিকশার ফাঁক দিয়ে আড়াল হয়ে গেল। আমিও আড়াল থেকে পিছু নিলাম। একটু এগিয়ে সরু গলি ধরে হেঁটে হেঁটে ছোট্ট একটা গেটের মতো খুপরি দিয়ে ফের জংশনে ঢুকে গেল। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাশে লম্বা মালগাড়ির আড়ালে ছোট্ট একটা স্ফীত অংশে পরম শান্তিতে বসে পড়ল।  পেছনে একটা জংলা গাছ, সেই গাছে আবার পরগাছা কয়েকটি লতা ঝুলে আছে। সব টাকা বের করে গুনে গুনে একটা পুঁটলিতে রেখে পা দুটো সামনে মেলে পান চিবুতে থাকে। এদিকটায় তেমন কেউ আসে না। মালগাড়িগুলিও বেশ জরাজীর্ণ, নিচে অজস্র আগাছা। অতি প্রাচীন স্তব্ধতার মতো বগি থেকে বগির লাইনচ্যুত দৃশ্যপটের নিরালায় মহিলার পান চিবানোর প্রশান্তিটুকু শান্তি ও স্বস্তির আপেক্ষিক ফ্রেমে মনে হচ্ছে চির আধুনিক।

দৃশ্যটি বেশ ভালো লাগছে। জংলা গাছে যদি বুলবুলি নয়তো একটি ফিঙে এসে বিচরণ করতো –

আড়াল থেকে একদৃষ্টে তাকিয়ে অকস্মাৎ চমকে উঠি, কিসের আগ্রহ কিংবা অতলান্তিক ঘোরে দিকপাশ ভুলে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি? নিজের আশীর্বাদপুষ্ট জীবন কি তবে নির্দিষ্ট ছকের বাইরে অন্যরকম ঘন-ঘোর ধোঁয়াশায় ধুঁকছে?  ভোরের আকাশটায় মেঘেদের প্রান্তে প্রান্তে সূর্যের আলতারঙা রূপটার দিকে তাকাতেই মায়ের কল এলো।

টিকেট পেয়েছিস?

না। দীর্ঘ লাইন।

চেষ্টা কর, জানিস তো তোর বাবা বাসে যাতায়াত করতে পারে না।

আচ্ছা দেখছি।

লাইন কেটে তাকালাম। মহিলা উঠে বোরখা টেনেটুনে স্টেশনের ভেতর চলে গেল। মাথাটা ভীষণ টলছে। কাউন্টারের ভিড় আরো বেড়ে গেছে। কী যে যন্ত্রণাদগ্ধ ট্রেন-টিকেটের অনিয়ম! ততক্ষণে মনে হলো, আমার ভেতর বিষয়ভিত্তিক জীবনের আড়ালে মানুষের সুকৌশল কর্মব্যাখ্যার আত্মানুসন্ধান চলছে। ক্রমশ তেজোদ্দীপ্ত রোদে যেন বর্ধিত হচ্ছে কতগুলি হাত, হাতের ছায়াগুলির ক্রমাগত  সঞ্চালনে, যেনবা চিরচেনা মনুষ্য রাস্তার বিপরীতে প্রসারিত হচ্ছে একটি ইশারা, যা অন্তর খুইয়ে খুইয়ে প্রবল হা-পিত্যেস টেনে খামচে ধরছে আশীর্বাদপুষ্ট পূর্বাপর প্রকৃতির রূপ।

চলে এলাম নিরিবিলি রেস্তোরাঁয়।  পেটে ক্ষিধে থাকলেও মুখটা পানসে। কতগুলি মানুষ দলবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে খোলা বাজারে সস্তায় পণ্য কেনার জন্য। মুখগুলি ভোগ নয়তো ত্যাগের মিশ্র ছায়ায় কি ঝিমুচ্ছে, নাকি টলছে! দৃষ্টিসীমার বিভ্রম কাটিয়ে লাল চা খেয়ে বেরোলাম। বাইরের আকাশটাকে লাগছে কেমন স্বর্ণপ্রভাময়। আর নিজেকে লাগছে  যেন ক্রোধহীন আদর্শের শ্রেষ্ঠ যুবক, যার কাছে বৈসাদৃশ্য জীবনের গতিময় ছন্দটাই স্বস্তি। একেকটি রহস্য কিংবা অর্থময় ঘটনার গুরুভার নিয়ে রাস্তা ভাঙার মজাটাই আলাদা।

টিকিট না পাওয়ায় বাবা সন্তানের প্রতি রাগ ও ক্ষোভে হাঁপাচ্ছে। মুখটা বেশ কঠিন। মা বলল, একটু চেষ্টা করে দেখতি।

দেখেছি।

ভেতরে কেমন ধাক্কা লাগলো, ইদানীং মিথ্যে কথা সহজে হজম হয় না। আগে পটাপট মিথ্যে বলার ভেতর ছিল কেমন নির্ভেজাল কৌতুক। প্রগাঢ় হাস্যরসে ভরা সেইসব মুহূর্তের সঙ্গে আজ নগর জীবনের গাঢ় ও দ্বন্দ্বপ্রসূত রসবোধহীন বাস্তবতা এসে যায়। মা বলল, এখন কী করি বল তো?

কী আর করবে, যেও না।

যেতে তো হবেই, কাল ওখানে সার্ভেয়ার আসবে। তোর বাবার থাকাটা ভীষণ জরুরি।

তাহলে কষ্ট করে বাসেই যাও।

মা এবার কিছুটা রেগে গিয়ে বলল, আচ্ছা তোর কোনো দায়িত্ব নেই? সবসময় তো ঘরে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকিস।

আমি চুপ করে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ি। সেই বোরখাওয়ালির কথা মনে পড়ে। এরকম নিপুণ ধোঁকাবাজির ধাক্কায় ধাক্কায় কতদূর এগোনো যায় জানি না, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, অর্থবিত্তের  যে চলমান সংক্রামক ব্যাধি, সেখানে অনুচ্চস্বরে মহিলার স্বল্প-স্বল্প সিদ্ধিলাভ মারাত্মক কিছু নয়। কিন্তু কেনই-বা এসব ভাবছি, আস্ত আহাম্মকের অহেতুক যোগ-বিয়োগ ধ্যানে সময়কে তুচ্ছ করার কোনো মানে নেই। চিৎকার করে ডাকি, মা মা –

মা দ্রুত ঢুকে, কী রে, কী হলো!

এক কাপ চা দেবে?

মা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, যেন নিজের ছেলেকে চিনতে পারছে না। বেরিয়ে যেতে যেতে ক্ষীণ স্বরে বলে, দিচ্ছি।

শেষ পর্যন্ত বাবাকে বাসেই যেতে হলো। চরম অপরাধবোধ নিয়ে মাথা নিচু করে থাকি। কাল রাতেও অনলাইনে অনেক চেষ্টা করে পাইনি। পরিচিত কেউ থাকলে টিকিট পাওয়া কঠিন ছিল না, তবে পরিচয়ের সূত্র ধরে বেশিদূর এগোতে পারি না বলেই বাবার দৃষ্টিতে আমি আজো অপদার্থ। বাবা কেবল মাথা ঘুরিয়ে বলল, পারলে ব্যবসাটা ঠিকমতো দেখিস।

মা কাছে এসে বলল, অনিয়ম করিস না। সময়মতো খেয়ে নিস।

তাঁরা চলে যাওয়ার পর হুড়মুড় করে পেয়ে বসে এক ধরনের দহন। যা অনুভূতির মর্মমূল ছুঁয়ে অন্তর্ঘাতকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। বস্তুত, কী চাই আমি? কোথাকার কোন পথভাঙা চটুল মহিলা, বৃত্তাবত্ত জীবনের টানাপড়েনে দৈনন্দিন টোকায় টোকায় নিজের প্রাপ্যটা নিচ্ছে অদ্ভুত ছলাকলায়, তাকে কেনই-বা মন  থেকে সরানো যাচ্ছে না। দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে থাকলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, নিজেকে বাস্তবমুখী করতে কর্মমুখী মানুষের উদ্যমকে দেখব এবার আত্মান্বেষী গতির চলমানতায়। এভাবে কেটে গেল বেশ কয়েকদিন।

সেদিন রাতে অদ্ভুত একটি স্বপ্ন  দেখলাম। খোলা মাঠে বাতাসের তীব্র ঘূর্ণিতে ওলট-পালট হচ্ছে মহিলাটি। হালকা অন্ধকারের ভেতর উল্টে-পাল্টে শরীরময় ক্ষতচিহ্ন নিয়েও চাপা স্বরে খিলখিল করে হাসছে। এমন ভুতুড়ে দৃশ্য অসহায়জনিত শুষ্ক খাদের কিনারে আমাকে ঠেলে দিচ্ছে। আগাছাপূর্ণ খাদের রূপটিতে দৈনন্দিন জীবনের কোনো বোঝাপড়া নেই, কখনো ছিল বলে মনেও হয় না। কেবল মানুষের সঙ্গে মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক সময়ের সূক্ষ্ম ফাঁকে, আদিকালের অনন্ত-মরীচিকা ঢেউ দু-চোখে টপকাচ্ছে তো টপকাচ্ছে। খোলা মাঠের চারপাশ জুড়ে ঘূর্ণিবায়ুর শা-শা শব্দ থাকলেও হাসির খিলখিল ভুতুড়ে দৃশ্যপটে নিজেকে মনে হচ্ছে বোধহীন অসাড়। কী যে ভয়ভীতিপূর্ণ মন  থেকে মন ভাঙার কাতরতা! বাতাস যদি অকস্মাৎ থেমে যায়, মেঘমালার আচমকা শঙ্কিত বৃষ্টি কি নির্জন খাদের নীরব ঢেউ-দুলুনিতে আছড়ে পড়বে?

আমি নিজেই কি পড়ে গেলাম খাদে! খিলখিল হাসির আঁধারঘন নতুন জোয়ারজলে গড়াগড়ি খাচ্ছি তো খাচ্ছিই … হাসির বিপরীতে এবার চিৎকার করে বলি, ভয় পাচ্ছি!

বাতাসের দাপটে অস্থির চলাচলের বিমূর্ত প্রতীক হয়ে দ্বিতীয়বার চিৎকার করতে যেতেই দম আটকে প্রবল জলতেষ্টা নিয়ে ঘুম ভাঙে। ঘরের চারপাশ জুড়ে নীরবতা। গা কেমন কাঁটা দিয়ে ওঠে। দ্রুত মাকে কল করে বসি। মা বলল, কী রে, এত রাতে! কী হয়েছে?

তোমরা ভালো আছো মা, বাবা কী করছে?

ঘুমুচ্ছে, কী হয়েছে তোর, গলা এমন শুকনো লাগছে কেন, স্বপ্ন-টপ্ন দেখিসনি  তো?

আমি চুপ করে থাকি। চোখ ফেটে জল গড়াতে থাকে।

কথা বলছিস না কেন!

স্বর কিছুটা নরম করে বলি, ভালো আছি মা।

পরদিন ব্যবসায় গিয়ে সবকিছু বুঝে  নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করি। একা বাসায় সময় কাটে চিরআলস্যে। দৃষ্টিপাতে থাকে সন্দেহ, চলাচলে প্রলম্বিত হয় একেকটি ঘটনাক্রমের ধোঁয়াশা।

হিসাবের খাতা উল্টাতে উল্টাতে অকস্মাৎ সেই পরিচিত স্বর শুনে তাকালাম। সেই মহিলা এবার সমাজসেবীর মতো কমদামি খয়েরি রঙের সিল্ক শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে। এতদিনে ওর মুখটা স্পষ্ট করে দেখলাম। শ্যামলা মেটে রং, একটু মায়াবী। পাশে একজন বয়স্ক বুড়ি। মাথার চুলগুলি সব সাদা। আমি তাকানোমাত্র সিল্কের আঁচলটা ভালোভাবে কোমরে সেঁটে স্বতঃস্ফূর্ত সমাজ সংস্কারকের মতো বলতে থাকে, মাহাজন ব্যাটা, এই বুড়িটার তিন কূলে  কেউ নাই। আফনেরা যদি সবাই ইট্টু …

ইশারায় থামালাম। বুড়ি ঘাড় গুঁজে স্থির। লম্বাটে ফর্সা মুখে ক্রমশ ঘনীভূত অপরাধবোধ, তবু প্রয়োজনের কাছে অথর্ব বুড়ি কালকে ঠকবাজির তীক্ষè হাতে সঁপে একসার বোবা। সমাজসেবী ফের কিছু বলতে যেতেই পরিচিতজনের মতো দরাজ গলায় বললাম, দাঁড়াও!

মহিলা এবার দু-চোখ বড় করে তাকায়। ওকে চিনে ফেলার ভয়তাড়িত বিস্ময়ে কিছুটা নড়েচড়ে পা ফেলতে  যেতেই দ্বিতীয়বার ডাকি, দাঁড়াও!

হাঁটার গতি বেড়ে যায়। একপাশে মাথা ঘুরিয়ে মুখের ঝামটা দিয়ে কেবল বলে, ওই ব্যাটা ডাহ ক্যা, কী করছি আমি তুমার।

বলতে বলতে পাশের সরু গলিতে ঢুকে পড়ে। বুড়ি হতভম্ব, পাশের দেয়ালটা হাত দিয়ে চেপে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে। বলি, কিছু খাবা?

দুপাশে মাথা নাড়ে।

কী করবা এখন তুমি?

আচানক আমূলবোধে তীব্র টোকা লাগে। খিলখিল করে হেসে ফেলে বুড়ি। স্বপ্নের সেই ভুতুড়ে হাসি। গুমোট দৃশ্যপটে দুরারোগ্য ব্যাধির মতো আমার যন্ত্রণাদগ্ধ আত্মদর্শনে দেখা দেয় নতুন ফাটল। পূর্বাপর বোধ হারিয়ে চিৎকার করে বলি, চোপ!

বুড়ি উল্টো পথে হাঁটা দেয়। আমি হ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকি, যেমন তাকিয়ে থাকি প্রতিদিন।