যত দূর চোখ যায়, তত দূর শুধু পানি আর পানি। দিগন্তে আকাশ আর পানির মিতালি, বিশাল জলরাশির আপন খেয়ালে ঢেউ ভাঙে ঢেউ হয়। আকাশে গাঢ় নীল, রোদের ঝিলিক ঢেউয়ের ঠোঁটে – চিকচিক করে ওঠে কখনো কখনো। কখনো বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ে জলডাঙ্গা নদীর তীরে। এই রহস্যময় ঢেউগুলি নদীর তীরে আছড়ে পড়ে নাকি মহবত আলির বুকের ভেতরে আছাড়ি-পিছাড়ি করে তা সে বুঝতে পারে না? নিরুদ্বেগ নিশ্চল দৃষ্টিতে মহবত আলি তাকিয়ে থাকে দূর সীমানায়। ঝড়ের বেগে দীর্ঘশ^াস পড়ে। ভবিষ্যৎ জীবনের চিন্তায় তার স্নায়ুতন্ত্র শিথিল হয়ে আসে, চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে। কীভাবে কী হলো? মাসখানেক আগে তেওয়ারী গ্রামটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল নদীর তলদেশে। ভাঙনের খেলা দেখে মহবত আলি – ক্রমশ নিষ্প্রভ হয় চোখের আলো। শত বছরের বসতি, হাজারো স্মৃতির জাহাজ ডুবে বিলীন হয় জলডাঙ্গার গর্ভে। তখন মøান হয়ে আসে রোদের তীর্যক আলো, তারপর ধূসর।

                গ্রামটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পর দাঁড়ানোর মতোও এতটুকু ডাঙা নেই। একটি ছাপড়া বেঁধে রোদ-বৃষ্টিতে রক্ষা করার জন্য মাথা গুঁজে পড়ে থাকার মতো সামান্য মাটি, খড়বিচালি, গাছের পাতা? নেই। গাছ-লতাপাতা? নেই। শস্যের মাঠ? নেই। শস্য? নেই। শিউলি ফুলের মতো সাদা ভাত? নেই। মহবত আলির শরীর বেয়ে হিমধারা বয়ে যায়। কোথায় যাবে? কীভাবে বাঁচবে?

একদিন মহবত আলি সপরিবারে ছোটে নতুন শরণের সন্ধানে। দূরে – এক অজানা নগরে। নগরের নাম শুনেছে, কোনো দিন দেখা মেলেনি। সঙ্গে আট বছরের ছেলে হাবুল ও বাকপ্রতিবন্ধী স্ত্রী আমেনা। সেই নগরের নাম ঢাকা। বাসে চড়ে যাত্রা শুরু করে। এবড়ো-খেবড়ো সড়কের ওপর দিয়ে কচ্ছপ গতিতে চলছে লক্কড়ঝক্কড় একটি বাস। ভীষণ ঝাঁকুনিতে ঘুম আসে। আমেনা আর হাবুল ঘুমিয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেই মহবত আলিকে কে যেন ডাকে, ‘বাজান আমারে নিবা না?’ চমকে ওঠে মহবত আলি এবং তখন তার বুকের ভেতর থেকে একটি ধ্বনি অনুরণিত হতে থাকে, ‘ফুলজান! আমার ফুলজান!’ মহবত আলির বুকের ভেতরে হু-হু করে ওঠে।

এক বছর আগে জলাতঙ্ক রোগে মারা গেছে দশ বছরের একমাত্র মেয়ে ফুলজান। আহা কী যে কষ্ট ছিল মেয়েটার! জিয়ল মাছের মতো মহবত আলির করোটিতে মৃত্যুর আগেকার ফুলজানের কষ্ট, আর্তি, বাঁচার কি নিদারুণ করুণ আকুতি সবই যেন নড়েচড়ে ওঠে এবং বধির কান্নায় চোখ ভিজে ওঠে তার। ফুলজানকে একটি পাগলা কুকুরে কামড়ে ছিল। পাশের গ্রামের কবিরাজ হেকমত আলি কলাপড়া দিয়ে চিকিৎসা করেছিল। অমাবস্যার রাতে জোনাকি পোকা ধরে সবরি কলার ভেতরে ঢুকিয়ে মন্ত্র পড়ে কলাটি মহবত আলির হাতে দিয়ে হেকমত কবিরাজ বলেছিল, ‘একশ ফাগলা কুত্তায় কামড়াইলেও একটা কলা খাইলেই দূষিত বিছন নষ্ট অইয়া যাইবো, বুঝলা মহবত আলি। নিছিন্তে খাওয়াও, আল্লাহর রহমে কিছুই অইবো না। কামরূপকামাখ্যার বিদ্যা দিয়া কলা ফড়া দেই আমি। বুঝলা? আমার বাপের দাদা এই বিদ্যা শিইখ্যা আইছিল কামরূপকামাখ্যা থাইক্যা। হেইডা অইলো গিয়া জাদুবিদ্যা আর কবিরাজের দ্যাশ। তারফরে আমার দাদা, আমার বাপ আর আমার বাপের হাত দিয়া আমার শিক্ষা। নির্ভুল শিক্ষা। তুমি নিছিন্তায় থাকবা। কিছ্ছু অইবো না।’

কিন্তু সেই বিদ্যার কেরামতি ও জোর কোনোটাই টেকেনি। একসময় ফুলজান পানি দেখলেই চিৎকার করত। মানুষকে কামড়াতে চাইত। পাড়ার দু-তিনজন মুরুব্বি বলেছিল, ‘তোমার মাইয়ারে বাইন্দা না রাখলে গেরামের সব্বোনাশ অইয়া যাইবো। যারে কামড় দিবো হেই ফাগলা অইয়া যাইবো।’

বুকে পাষাণ বেঁধে গ্রামের মানুষের চাপে অবোধ শিশু ফুলজানকে বেঁধে রাখা হয়েছিল। মেয়েটি চিৎকার করত, খেতে পারত না, পানি দেখলেই বিকট চিৎকারে অস্থির হয়ে পড়ত। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যেত কিন্তু পানি খেতে পারত না। চোখের সামনে চঞ্চলা কিশোরী কয়েক দিনেই মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। মহবত আলির স্বগতোক্তি, ‘আহা ফুলজান আমার! তর কব্বরটাও ভাইসা গেল গা জলডাঙ্গায়!’ স্মৃতিকাতরতায় মহবত আলি যেন বেদনায় নীল হয়ে ওঠে। 

ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বাস চলে গড়িয়ে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, ধেয়ে আসে অন্ধকার। গাবতলী বাস টার্মিনালে বাসটি থামলে স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে মহবত আলি নেমে রাস্তার উত্তর পাশে একটু ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়। কোথায় যাবে সে নিজেও জানে না? শুধু জানে মিরপুর যাবে। শহরে চোরবাটপারের খপ্পরে পড়ে কি না ভেবে সাবধানে থাকে সে। এর মধ্যে সাদা লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা একটি লোক গায়ে পড়ে জিজ্ঞেস করে, কই যাইবেন ভাইজান?

মহবত আলি উত্তর দেয়, মিরপুর, যামু।

লোকটি ভ্রুকুটি করে জবাব দেয়, ওহ, ম্যালা দূর।

মহবত আলি হকচকিয়ে যায় এবং বিস্ময়ের সঙ্গে বলে, ম্যালা দূর? কী কন? গেরামের মাইনসে কইয়া দিলো, বুগালেই।

লোকটি মৃদু হেসে বলল, ম্যালা দূর। টেরেইনে যাইতে লাগব।

কী কন? টেরেইনে?

হুম। আমি ব্যবস্থা করতে পারুম।

মহবত আলির কপালে ভাঁজ পড়ে। এমন কথা তো গ্রামের কেউ বলেনি। সবাই বলেছে গাবতলী থেকে সামান্য দূরেই মিরপুর এক নম্বর। হাঁটতে হাঁটতে যাইবি।

চিন্তাচ্ছন্ন মহবত আলির দিকে রহস্যময় লোকটি উত্তর প্রত্যাশা করে চেয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে এবং পুনরায় যখন জিজ্ঞেস করে, ব্যবস্থা করুম মিয়া? তার কণ্ঠে ক্রোধের আভাস।

এই সময় অন্য এক পথচারী এদের পাশে দাঁড়ালে মহবত আলি জিজ্ঞেস করে, মিরপুর এইহানতো কত্ত দূর?

পথচারী উত্তর দেওয়ার আগেই রহস্যময় লোকটি কেটে পড়ে এবং পথচারী বুঝিয়ে বলে হেঁটে গেলে কীভাবে যেতে হবে। মহবত আলি হালে পানি পায়। স্বস্তির নিশ^াস ফেলে বলে, আল্লাহ বাছাইলো। হারামজাদা বাটপার!

রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে মহবত আলি ভাবে, মিরপুর গিয়ে তারপর কোথায় যাবে? ঠিকানাবিহীন মানুষের সব পথই খোলা। সর্বত্রই তার ঠিকানা। এই শহরের সব পথ অচেনা, সব মানুষ অচেনা। তারপর কিছুক্ষণ ভেবে মিরপুরের দিকে এগোতে থাকে। মনে মনে বলে, আল্লাহ একটা ব্যবস্থা করবো।

পথে দু-একজনকে জিজ্ঞেস করে নিশানা ঠিক করে। হাঁটে ধীর পদক্ষেপে। সারাদিনের না-খাওয়া। ক্ষুৎপিপাসা আর ক্লান্তিতে ওরা যেন কাদার তাল। একটি পথের মোড়ে এসে হাবুল বলল, ‘বাজান ভুক নাগছে।’ মহবতের খিদেও চাঙ্গা। আমেনা সহ্য করে চেপে আছে খিদের দানবকে। হাবুলের কথায় মহবতের খিদেটা যেন দানবের রূপ নেয়। তার মনে হয়, এখন যদি এক গামলা ভাত খেতে পারত। তার চোখে ভেসে বেড়ায় সাদা সাদা ভাত আর ভাত। কিছুক্ষণ পরেই সে বুঝতে পারে, এ তার কল্পনাবিভ্রম। কে তার জন্য ভাত বেড়ে রেখেছে এই শহরে? এমন দয়ালু সুহৃদ কে আছে? 

আমেনা কথা বলতে পারে না, কাকে বলবে কষ্ট! কাউকে বোঝাতে পারে না। স্ত্রীর কষ্ট মহবত আলি কখনো বোঝে, কখনো বোঝে না। তিনবেলা ভাত খেয়ে অভ্যস্ত মানুষগুলির সকালের নাশতা খাওয়ার পর সারাদিন ভাতের দেখা মেলেনি। মহবতের প্রাণ ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কোথায় ভাত পাওয়া যায় জানা নেই ওর। সে ভাবে, রাতে কোথাও একটু মাথা গোঁজার আশ্রয় পেলে ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করবে। তারপর মনে মনে সঙ্গে আনা টাকাগুলি হিসাব করে। কষ্ট করে চললে এক সপ্তাহ চলতে পারবে। তবে এই মুহূর্তে খিদের দানবটাকে থামানো দরকার। বাম পাশের গলি দিয়ে ভেতরে সামান্য দূরে একটা রেস্তোরাঁ দেখে পথের মোড়ে আমেনা আর হাবুলকে বসিয়ে রেখে ওই গলির দিকে এগিয়ে যায় সে। বাবা অদৃশ্য হলে হাবুল দেখে একটু দূরে সিটি করপোরেশনের পাইপ থেকে ঝরঝরিয়ে পানি পড়ছে। পানির তৃষ্ণায় যেন ওর বুক ফেটে যাচ্ছে। মায়ের শরীরে ধাক্কা দিয়ে পানির দিকে ইশারা করে দেখায় এবং মাকে বোঝায় সে পানি পান করতে যাবে। মাথা নেড়ে সম্মতি দেয় মা। পানির পাইপ থেকে আঁজলা ভরে পানি পান করলে এক প্রকার প্রশান্তি ওর সারা শরীরে ভর করে। মুখমণ্ডলে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিয়ে আরো প্রশান্তির পরশ অনুভব করে। একবার নয়, কয়েক বার পানির ঝাপটা দেয় মুখমণ্ডলে। আমেনারও অনেক তৃষ্ণা। এদিকে সারাদিন বাস জার্নি করে এখন প্রস্রাবের চাপে তলপেট ফেটে যাওয়ার উপক্রম। পথেঘাটে নারীদের বড় বেহালদশা। শরীর শক্ত না হলে সীমাহীন বিপদ। কাকে বলবে কষ্টের কথা! কাউকে বলা যায় না। আমেনা বাকপ্রতিবন্ধী হওয়াতে অস্বস্তিটা একটু বেশি। হাবুলের দিকে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে মা। ফুলজান মারা যাওয়ার পর হাবুল চোখের আড়াল হলেও আমেনার বুকের ভেতরে হু-হু করে, কান্নায় বুক ভেসে যায়। হাবুলকে বুকে আগলে রাখতে চায়। কুকুর ফোবিয়ায় আক্রান্ত মা। তার মনে হয়, হাবুলকেও কুকুরে কামড়াবে। তখনই সে দেখতে পায় পানির পাইপের পাশে একটি নেড়ি কুকুর শুয়ে আছে। তারপর মনে হয় একটি থেকে দুটি কুকুর, দুটি থেকে চারটি, চারটি থেকে আটটি কুকুর – এভাবে পুরো এলাকা কুকুরে সয়লাব হয়ে গেছে। মায়ের বুকে ধড়ফড় শুরু হয়। হাবুলকে ডাকতে পারছে না, আবার বোঁচকাবুঁচকি রেখে এখান থেকে সরতেও পারছে না। আতঙ্কে ওর শরীরটা আরো অসাড় হয়ে আসছে। 

অকস্মাৎ ঘড়াৎ ঘড়াৎ শব্দ করে একটি ট্রাক থামে আমেনার সামনে এবং পরক্ষণেই ট্রাক থেকে কয়েকজন বলিষ্ঠ লোক ধুমধাম করে নেমেই টেনেহিঁচড়ে তাকে ট্রাকে তুলে নেয়। কোনো কিছু বোঝার আগেই ত্বরিতগতিতে ঘটনাটি ঘটে যায় এবং আমেনাকে তুলে নিয়ে ট্রাকটি যখন ছেড়ে যায় তখন হাবুলের চোখে পড়লে মুহূর্তকাল সে হতভম্ব হয়ে থাকে, বাবার কথা বেমালুম ভুলে যায় এবং বেদিশা হয়ে ট্রাকের পেছনে ‘মা মা’ বলে চিৎকার করতে করতে দৌড়াতে থাকে। প্রাণপণে হাবুল দৌড়াতে থাকে ট্রাকের পেছন পেছন। পথচারীরা, রাস্তার পাশে দোকানিরা হাবুলের দিকে তাকিয়ে থাকলেও কেউ এগিয়ে এসে কিছুই জানতে চায়নি। এই শহরে কে কার দায় নেয়? কিন্তু ট্রাকের গতির কাছে হেরে যায় হাবুল আর মুহূর্তের মধ্যেই ট্রাকটি হারিয়ে যায় অনেক গাড়ির ভিড়ে।

হাবুল দৌড়াতে থাকে, দৌড়াতে থাকে এবং সারাদিনের না-খাওয়া বলহীন ক্ষীণ শরীরে এই কিশোরের শক্তি যখন নিঃশেষ হয়ে অসাড় হয়ে পড়ে তখন পথের পাশে ধপাস করে বসে পড়ে। তার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে, চোখ দুটি ঘোর অন্ধকারে ঢেকে যায়, সে বসে হাঁপাতে থাকে। কিছুক্ষণ পর শরীরে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এলে সে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কিছুক্ষণ চিৎকার করে কাঁদে। দু-একজন পথচারী সহানুভূতি দেখায়, কেউ জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে; কিন্তু কান্নার জন্য হাবুল কারো কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারে না।

সন্ধ্যার পর মহল্লার এই খাবারের ছোট্ট হোটেলে মানুষের ভিড় পড়ে। মহল্লার রেস্তোরাঁয় মোগলাই পরোটা, শিঙাড়া, সমুচা, ডালপুরি, কাবাব, চাসহ বিকেলের নাশতা খেতে মহল্লার মানুষের হুড়াহুড়ি। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মহবত আলি ছয়টি ডালপুরি নেয়। সঙ্গে চিকন করে কাটা পেঁপে ও পেঁয়াজকুচির ওপর সামান্য বিট লবণের ছিটা। ডালপুরির ঠোঙা মহবত আলির হাতে দিয়ে ছেলেটি বলে, ‘ছয় ট্যাহা দেন।’ খাবার নিয়ে ফিরে এসে দেখে আমেনা ও হাবুল নেই। যেখানে ওদের বসিয়ে রেখে গিয়েছিল সেই স্থানটি ফাঁকা এবং সঙ্গে সঙ্গে তার বুকের ভেতরটাও ফাঁকা হতে হতে মনে হলো একটি মহাকাশে পরিণত হয়ে গেছে। চারপাশ খাঁ-খাঁ করছে। আশেপাশেও কেউ নেই। বুকের ভেতরের বিষাদের প্রবাহ যেন নদী হয়ে হিমবাহে পরিণত হয়ে তার শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে। ক্লান্ত-শ্রান্ত-অবসন্ন কাদার তালের মতো শরীরটা ক্রমশ পাথরের মতো স্তব্ধ হতে থাকে। কোনো শব্দ শুনতে পায় না মহবত আলি। হাতে ডালপুরির ঠোঙা নিয়ে নিশ্চল চোখে কালচে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আকাশে ফুটতে থাকে তারা – একটার পর একটা। অসংখ্য তারা। এক সময় সারা আকাশ তারায় ছেয়ে যায়।

সরকারি ‘ভিক্ষুক পুনর্বাসন কেন্দ্রে’র সামনে ট্রাকটি থামে। আমেনাসহ আরো বিশ-পঁচিশজনকে ট্রাক থেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে একটি তেতলা বাড়ির ভেতরে ঢোকানো হয়। ঘড়াং ঘড়াং ঘড়াৎ বিকট শব্দে লোহার গেটটি বন্ধ হয়ে যায়। নামপরিচয়হীন ‘বাকপ্রতিবন্ধী ভিক্ষুক’ হিসেবে আমেনার রেকর্ড করা হয় ‘ভিক্ষুক পুনর্বাসন কেন্দ্রে’র রেজিস্টারে।

মানুষের কান্নারও শেষ আছে। অশ্রুগ্রন্থি শুকিয়ে গেলে হাবুল আবার দৌড়াতে থাকে বাবার খোঁজে। কিন্তু কোন পথে সে এতটা দূর এসেছে তা আর ঠাওর করতে পারে না। সে-পথ আর খুঁজে পায়নি সে যে-পথে এখানে এসেছিল। নিরুপায়, ক্লান্ত, শ্রান্ত ও নির্বাক হাবুলের দৃষ্টি স্থির হয় পথবাতির আলো পেরিয়ে অসংখ্য তারকারাজির কালচে রহস্যময় আকাশে। কতক্ষণ তার এভাবে কেটে যায় সে নিজেও জানে না। পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আবার কান্নার উদ্রেক হলে সে ডুকরে কাঁদে কিছুক্ষণ। সব কান্নাই অরণ্যে রোদন। শহরের অচেনা মানুষেরা অচেনাই থেকে যায়, কেউ এগিয়ে এলো না সাহায্য করতে, সহমর্মিতা দেখাতে। ক্রমান্বয়ে অফিস ফেরতা মানুষের কোলাহলও শান্ত হয়ে আসে। হাবুলের কান্নার শব্দ শহরের কোলাহলে হারিয়ে যায়, না শুনতে পায় বাবা, না পায় মা, না শুনতে পায় শহরের ব্যস্ত মানুষেরা। গভীর রাতে একটি সড়কদ্বীপে ঘুমিয়ে থাকে ক্লান্ত-শ্রান্ত হাবুল। ছিন্নভিন্ন মলিন কাপড়-চোপড় পরা জীর্ণ-শীর্ণ আরো কয়েকজন কিশোর এই সড়কদ্বীপে ঘুমে আচ্ছন্ন। মাঝরাতে হাবুল অনুভব করে ওর পিঠে লাঠির গুঁতো। তড়াক করে জেগে উঠতেই একজন পুলিশ সদস্য তার ডান হাতটি শক্ত করে ধরে টেনে একটি ভ্যানে তোলে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে সড়কদ্বীপে ঘুমিয়ে থাকা কিশোরদের দুজন দৌড়ে পালিয়ে যায়। অন্য চারজনকে ভ্যানে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুর থানায়। হাবুলকে পুলিশের খাতায় ‘ছিনতাইকারী’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং পরদিন সকালে পাঁচজন কিশোরকে টঙ্গীর ‘কিশোর অপরাধী সংশোধন কেন্দ্রে’ পাঠানো হয়।

দুই

আগারগাঁওয়ের এক বস্তির একটি ছাপড়া ভাড়া নিয়ে থিতু হয় মহবত আলি। জীবিকার পথ হিসেবে বেছে নেয় রিকশা। রিকশা চালিয়ে মালিকের জমা আর দিনের খাবারের টাকা হলে সে আর ভাড়ায় যাত্রী না উঠিয়ে একা একা রিকশা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় অলিতে-গলিতে এবং যেখানে কোনো নারীকে পথের পাশে কিংবা পথের মোড়ে দেখতে পায় সে তাকিয়ে দেখে আমেনা কি না; এবং পথের মোড়ে, ফাঁকা জায়গায় কিংবা খেলার মাঠের শিশু-কিশোরদের খেলতে দেখলে সে দাঁড়িয়ে দেখে হাবুল এই শিশুদের মধ্যে আছে কি না। কখনো বিভ্রম হয়ে অন্য শিশুকে হাবুল মনে করে কাছে যায়; কিন্তু বিভ্রম ভাঙলে বাকহীন তাকিয়ে থাকে। তার চোখ থেকে অশ্রু বিগলিত হয়। আমেনাকে কিংবা হাবুলকে কাউকেই সে খুঁজে পায় না।  

এক রাতে স্বপ্ন দেখে হাবুল ছাপড়ার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। তার নাকের নিচে সদ্য গজানো চিকন রেখার মতো গোঁফ, চুলগুলো বড় রুক্ষ ও লালচে, গায়ের গেঞ্জিটা খুব নোংরা, পরনে কালো প্যান্ট। সে বাবার দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত কণ্ঠে বলে, বাবা আমি ছিনতাইকারী হইছি।

না রে ফুত, ছিনতাই ছাইড়্যা দে। ছিনতাইকারী হইস না। আমার লগে রিসকা ছালাইবি।

না বাবা, রিসকা চালানো খুব কষ্ট। আমি ছিনতাইকারী হমু। একদিন কামাই করলে দশদিন বইয়া বইয়া খামু।

না রে ফুত আমার! ছিনতাই করা ভালা না। পুলিশে ধরবো। থানায় নিবো। এই কাম পাপ। তুই ছাইড়্যা দে। তোরে আমি বয়া বয়া খাওয়ামু। আয় আমার ফুত। আমার বুহে আয়।

না, আমি আমু না বাজান। আমি ছিনতাই করুম।

আয় বাজান, আয় বাজান আমার, আমার হাবুল। ফুলজানের মতোই আমারে ছাইড়্যা যাইস না।

মহবত আলির ঘুম ভেঙে যায়। চিড়িক দিয়ে ওঠে বুকের ভেতরে। বিছানায় বসে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে, তার কান্নার মিহিন সুর রাতের জমাট নৈঃশব্দ্যের বুকে চির ধরায়।

সারাদিন রিকশা চালিয়ে রাতে নিজেই রান্না করে খেয়েদেয়ে ঘুমালেও ঘুমাতে পারে না মহবত আলি। প্রতিরাতেই কোনো না কোনো স্বপ্ন দেখে আর ঘুম ভেঙে গেলে বিছানায় বসে কাঁদে। আবার কোনো রাত ছাপড়াটি ছেড়ে রাস্তার কিনারে এসে চুপচাপ বসে থাকে।

এক রাতে স্বপ্নে দেখে ফুলজানকে। ফুলজান ডাকে, বাজান, বাইরে যাইও না। ফাগলা কুত্তায় কামুড় দিবো।

বাইরে না গেলে খামু কী মা? আয় আমার ফুলজান। আমার বুহে আয়।

না, বাজান। আমার ডর লাগে। কুত্তারে ডর লাগে। এই শহরটা দেখো কুত্তায় ভইর‌্যা গেছে। তুমি বাইর অইয়া দ্যাহো।

ফুলজানের কথা বিশ^াস করে মহবত আলি গভীর রাতে ছাপড়া থেকে বের হয়ে যায় এবং রাস্তায় গিয়ে সে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। গলিটি ভরে গেছে কুকুরে। তারপর দূরে তাকিয়ে দেখে সারা শহরেই কুকুর আর কুকুর। এটি যেন শহর নয়, যেন কুকুরের সমুদ্র। মহবত আলি বিড়বিড় করে, এত কুত্তা, মানুষ নাই ক্যারে? কয়েকটি কুকুর তাকে দেখে ঘেউ ঘেউ করতে থাকে এবং তখন ভয়ে মহবত আলির শরীর ঘেমে একসা হয়ে যায়; ছাপড়ায় ফিরে এসে একটি বিড়ি জ¦ালিয়ে ধীরে ধীরে টানে। শুয়ে পড়ে, একটু নির্বিঘ্নে ঘুমাতে চায় মহবত আলি। কিন্তু কোনো রাতেই সে নির্বিঘ্নে ঘুমাতে পারে না। চোখ দুটি লাগতেই আবার স্বপ্নে দেখে আমেনা হাতের ইশারায় তাকে ডাকছে। মহবত আলি বস্তির ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। চারপাশে তাকিয়ে দেখে। গাঢ় অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নেই।

তিন

কিছু কিশোর অপরাধীর বন্ধু হয় হাবুল। কী না শিখে? ওখানে নির্যাতন কি কম? খাওয়া-থাকা, মশার কামড়, মারামারি, হাতাহাতি, গালাগালি – কী নেই? বলে বিদ্যার্জনের কথা। তা কি আর হয়? সময় গড়িয়ে যায়। পাঁচ বছর পর কিশোর অপরাধ সংশোধন কেন্দ্র থেকে হাবুলের মুক্তি মেলে। মুক্তি? প্রাচীরের বাইরে আসা মানেই কি মুক্তি? শিকল থেকে ছাড়া পেলেই কি মুক্ত হওয়া যায়? সমাজের শিকল থেকে কীভাবে মুক্তি পাবে হাবুল?

কিশোর সংশোধন কেন্দ্র থেকে মুক্তি পাওয়ার পর রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে হাবুল চারপাশ তাকিয়ে দেখে। বিস্মৃত হয়ে গেছে মায়ের মুখ। বাবারও। হেঁটে বেড়ায় হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে। মানুষের ভিড়ে ওর হাঁটতে ওর ভালো লাগে। প্রতিটি মানুষকে মনে হয় রহস্যময়। মনে হয় অপরাধী। 

খাবারের খোঁজ করতে করতে ব্যর্থ হয়ে এক কিশোরের ঠিকানা অনুযায়ী মহল্লার গালকাটা মান্নার শিষ্য হয়ে যায়। বেঁচে থাকার জন্য তাকে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। তাকে শেখানো হয় অপরাধ বলতে কিছু নেই। জীবনে বেঁচে থাকার জন্য সব কাজই মহৎ। এই জগতে কে অপরাধ করে না। হাবাগোবা হাবুল এই দীক্ষাকে মগজে ধারণ করে হাঁটে মানুষের ভিড়ে। ভিড় ভালো লাগে ওর। ভয়ানক ভিড়। ভিড়ের ভেতরে সাপের মতো বিলি কেটে চলে সে।

একদিন মোবাইল ছিনতাই করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে সে। ভিড়ের মানুষেরা ইচ্ছেমতো পিটায়। এই ভিড়ের মধ্যে মহবত আলিও ছিল। সেও পিটায়। ঘুষি দেয়। কিল দেয়। লাথি দেয়। নাক দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে হাবুলের।

আধমরা হাবুলকে রাস্তার পাশে ফেলে ভিড়ের মানুষগুলি কেটে পড়ে। ওরা ভেবেছে ছিনতাইকারী মরে গেছে। পথবাতির আলো-আঁধারে ঝাপসা ছায়ার মতো ছেলেটির দিকে তাকিয়ে মহবতের মায়া হয় এবং অন্যরা সটকে পড়লেও সে দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ ছেলেটার মুখের গড়নটা হাবুলের মতো মনে হওয়াতে হাঁটু গেড়ে বসে, খুব ভালো করে দেখে মুখটি, হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সে। ওরে বাজান, আমার হাবুল না তুই? আমার হাবুল! বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে মহবত আলি।

মহবত আলির বুকের ভেতরে নদীর ঢেউয়ের মতো ঢেউ ওঠে। আবেগ ও কান্নার ঢেউ উথলে ওঠে বুকে। হাবুল! আমার হাবুল!

হাবুল চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে এবং সেও বাবাকে চিনতে পারে। তার চোখ থেকেও পানি গড়িয়ে পড়ছে। সে অস্ফুট উচ্চারণে বলল, বাজান, তুমিও আমারে মারছ?

মহবত আলি কোনো জবাব দিতে পারে না; নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে হাবুলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।