গদ্যময়

গাপ্পুর মন ভালো নেই।

এমনিতেই দিন দিন অসাড় হয়ে পড়ছে শরীরের কলকব্জা। তবু এক টুকরো চিনচিনে কষ্ট বুকের ভেতর, কিছুতেই ভেতর থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না সে।

হিল্লিকে মনে পড়ে খুব। মনে হলেই একটা প্রশ্ন প্রায়ই কুরে-কুরে খায় ওকে। কিছু না বলে চলে যেতে পারলো হিল্লি? কেন, একমুখ হেসে কি বিদায় নেওয়া যেত না ওর কাছ থেকে? সে কি এতই মন্দ?

অলস সময় কাটতে চায় না গাপ্পুর। কোনো কিছু আর নড়েচড়ে না আগের মতো। বসে বসে পুরনো

কথাগুলিই বারবার দাগ কাটে মনে।

কদিন আগেও যখন-তখন লোলোর রূপের মোহে কিংবা হয়তো পঙ্গু এ-সময়ের ভার সইতে না পেরে গাপ্পু ছুটে যেত ম্যাডামের বাড়ির সামনে।

এক-দুটো ঘেউ তুলে জানান দিত সে এসেছে। ভাগ্য ভালো থাকলে ওদের একঝলক চোখাচোখি হতো। নইলে গেটের বাইরে থেকেই বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হতো সে। কারণ লোহার গেটের কাছে ওকে ঘুরঘুর করতে দেখলেই লাঠি নিয়ে তেড়ে আসত দারোয়ান; দূর-দূর শুনে কান ঝালাপালা সারাক্ষণ। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে ব্যাটার পা কামড়ে দেওয়ার। যা হবে, পরে দেখা যাবে ভেবে কদিন দাঁত কেলিয়ে এগিয়েও গেছে। পরক্ষণে লোলোর মেমসাহেবের কথা ভেবে সে পিছিয়ে এসেছে। এমন শিক্ষিত পরিশীলিত

রুচিশীল বিদেশিনীর সামনে নিজেকে দাঁতাল নেকড়ের বংশধর হিসেবে কীভাবে মেলে ধরে? অগত্যা মন থেকে উদগ্র ইচ্ছেটা বাদ দিয়ে কুঁই কুঁই শব্দ তুলে গন্ধ শোঁকার ভান করে ফিরে এসেছে নিজের জায়গায়।

দু-দণ্ড শান্তি দেওয়া সেই লোলোও চলে গেছে বহুদূরে। তাই শুয়ে বসে পুরনো কথার শুকনো হাড় চিবোয় গাপ্পু। এছাড়া আর কি-ই বা করার আছে ওর?

আজকাল হিল্লির কথা এর-ওর মারফত ভেসে আসে ওর কানে।

করোনার এমন দুঃসহ সময়েও নাকি ওর জীবনে এখন ফাগুনকাল। ছায়ার মতো, হাওয়ার মতো, যার সঙ্গে হিল্লি এখন লেপ্টে রয়েছে, সে এক মুরগি ব্যাপারীর প্রিয় পোষ্য। শুনেছে, খাওয়ার অভাব নেই সেখানে। প্রতিদিন নাড়িভুঁড়ির পাহাড় জমে থাকে দোকানের সামনে। নিজেরা আর কত খাবে, বন্ধু-পরিজনকে আদর করে ডেকে নিয়ে দেদার খেতে দেয়। এ সময়ে এমন ভূরিভোজ পেয়ে সবাই মহাখুশি। সে-ই শুধু বাদ। ধুঁকে মরছে সামান্য খাবারের অভাবে!

অথচ একদিন হিল্লির বিপদে গাপ্পুই এগিয়ে এসেছিল সবার আগে।

করোনার শুরুতে মানুষ তো একদম পাল্টে ফেলল নিজেদের। কেউ তখন ঘর থেকে বেরুতেই চাইতো না। বাজার-সদাই বলতে গেলে প্রায় বন্ধ; খাবারের দোকানগুলি ভূতের ছায়ার মতো ঘন অন্ধকারে ঢাকা, মাসের পর মাস খুলছেই না। ডাস্টবিনগুলি ফকফকা, এক টুকরো খাবার পড়ে নেই সেখানে। খাবারের অভাবে কত বন্ধুবান্ধব রাস্তায়-রাস্তায় হাহাকার করে মরেছে ওদের। সে-সময় হিল্লিকে বাঁচিয়ে রেখেছিল কে? বয়স্ক ভেবে লোলোর মালকিন-ম্যাডাম খাবারটা তো ওকেই দিতেন। গাপ্পু আর হিল্লি সেই খাবার ভাগ করে খেয়েছে প্রতিদিন। গাপ্পুর পেটে ক্ষুধা মোচড় দিত ঘন ঘন, পেট ভরত না কিছুতেই। তবু ভালোবাসার খাতিরে এটুকু কষ্ট মেনেই নিয়েছিল সে। কোনো অনুযোগ ছিল না মনে।

হয়তো একটুখানি বুড়িয়ে গেছে সে, একথা সত্য। বার্ধক্য ওকে হয়তো আগের মতো সেরকম সবল-সতেজ হতে দেয় না; তাই বলে কি মনের তরুণটিও মরে গেছে ওর?

ভাঙা থালার মতো যেদিন ওকে একা ফেলে রেখে সৌভাগ্যকে আলিঙ্গন করতে হিল্লি চলে গেল আর কারো হাত ধরে, সেদিন একাকী নিঃসঙ্গ গাপ্পু হাউমাউ করে খুব কেঁদেছিল। রাতভর সেই আর্তনাদে কেঁপেছিল পুরো মহল্লা। ওর বুক ফাঁকা হওয়া কান্নার শব্দে কত ফ্ল্যাটের মালিক গভীর রাতে ব্যালকনির গ্রিল ধরে ভেবেছে, কুকরটা কি শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে গেল? দারোয়ান মাঝরাতে ছুটে এসেছে খ্যাঁক খ্যাঁক করে, এই চুপ কর, চুপ কর। মানুষরে ঘুমাইতে দে। শয়তান কুনহানের।

গাপ্পু দৌড়ে চলে যায় নিরাপদ স্থানে; পরক্ষণে ফের কঁকিয়ে উঠেছে, একটা কথা পর্যন্ত হিল্লি বলল না যাওয়ার সময়!

সেই থেকে নিরম্বু উপবাসের মতো একা সে। কেন, সে কি শত্রু ছিল হিল্লির? সততা, নিষ্ঠা, অনুরাগ, দয়া, মমতা – এসবের কোনো মূল্য নেই হিল্লির কাছে? তারুণ্য কি বার্ধক্যকে অজগরের মতো গিলে ফেলে? ফিরেও তাকায় না সেদিকে একবার?

করোনায় ম্যাডাম মারা যাওয়ার পরপরই গাপ্পুর অভাব শুরু হয়ে গেল। আগ বাড়িয়ে কেউ আর খাবার দিতে চায় না এখন। ডাস্টবিন থেকে খাবার সংগ্রহ করতে গেলেও শক্তি প্রয়োজন। কমবয়স্ক দাঁতালগুলি ওকে মুখ ভ্যাংচে নানারকম আকথা-কুকথা বলে তাড়িয়ে দেয় সেখান থেকে। একমাত্র লোলোর ম্যাডামই ওর অসহায়তাটুকু বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর এরকমভাবে আর কেউ এগিয়ে আসেননি। বরং উল্টোটা ঘটেছে; দেখলেই সবাই ওকে দূর-দূর করতে শুরু করে। রিকশাওয়ালা শরীরে রিকশা তুলে দেয়, গাড়ির ড্রাইভার মাড়িয়ে দিতে চায় ওর নিরীহ ঠ্যাংদুটো, চা স্টলের লোকগুলি ছুড়ে দেয় গরম চা আর তিনতলার বারো বছরের অপুষ্ট কাজের মেয়েটা ওর শরীরের ওপর জানালা গলিয়ে গরম ভাতের ফেন ফেলে দিয়ে হেসে ওঠে খিলখিল করে। পিঠের দগদগে ঘায়ের ওপর নজর পড়লে মানুষগুলি থুতু ফেলে মুখ ঘুরিয়ে, নাকে কাপড় গুঁজে এড়িয়ে চলে ওকে। এমন ভাব, যেন এরা কখনো বৃদ্ধ হবে না, তাদের কোনোদিন এরকম রোগ হয়নি, হবে না!

যত দিন গড়াচ্ছে গাপ্পু তত মনমরা হয়ে পড়ছে। সুযোগ পেলেই গাছের নিচে বসে হাঁপাতে থাকে আজকাল। অনেক কিছু ভুলে যাচ্ছে। প্রায়ই নির্ঘুম রাত কাটে ওর, কেন যেন অহেতুক ঘেউ ঘেউ করতে ইচ্ছা করে সারাক্ষণ। গিড়ায়-গিড়ায় ব্যথা, চিবোতে কষ্ট হয়, মুখ বেয়ে লালা গড়ায়। চোখের দ্যুতিও আর আগের মতো নেই। প্রায়ই ঝাপসা দেখতে পায় সব। শরীরের নানা জায়গায় ঘা। চুলকাচ্ছে, কামড়াচ্ছে, কত কিছু।

 সবার ওপর পেটের ভেতরকার অসহ্য ক্ষুধার যন্ত্রণা। সব সওয়া যায়; কিন্তু পেটের ক্ষুধা আগুনের মতো লেলিহান। এক মাস ধরে তা-ই সইতে হচ্ছে ওকে। ধীরে ধীরে জীবনটা সাপের খোলসের মতো ফ্যাকাসে আর অর্থহীন হয়ে পড়ছে নিজের কাছে।

শরীর-মন কিছুই আর চলছে না। নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে সব। কখন নিশ^াস ফেলা বন্ধ হবে সেদিকেই যেন সে এগিয়ে চলছে এক-পা দুই-পা করে!

সেই সকাল থেকে দুটো মাছি বিরক্ত করে মারছে গাপ্পুকে। লেজ নেড়ে তাড়াতে চাইলেই উড়ে যায় অন্যখানে। পরক্ষণে আবার এসে ঘায়ের ওপর বসে। সেখানে ডিম পাড়বে বজ্জাতগুলি। ঘা’টাকে আরো দগদগে করে তুলবে। হয়তো ওরাও ওর শরীর-স্বাস্থ্যের খবরাখবর রাখে। জল-পড়া-ঘোলা চোখ দুটো সামান্য বুঁজলেই ওরা উড়ে এসে সেখানে বসে পড়ে। কত আর তক্কে তক্কে থাকা যায়? গাপ্পুর শরীর তো নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। সবকিছু চলে যাচ্ছে হাতের মুঠোর বাইরে। হয়তো কিছুদিন বাদে এ প্রিয় জীবনটাও – কে জানে!

এসময় দলবল নিয়ে কোত্থেকে এসে বাঘা দাঁড়ায় ওর সামনে। ঠাট্টা-মেশানো গলায় ওকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আংকেল, কার কতা ভাবতাছেন চোখ বুইজা?

হিল্লি? হে তো মা অইবো। সুখ তো তাইর বাইয়া-বাইয়া পড়তাছে।’ বলেই হেসে ওঠে বাঘা। এককালে বাঘারও কণ্ঠলগ্না হয়ে ঘুরে বেড়াতো হিল্লি।

‘তোমার কাছেও তো ছিল সে। ধইরা তো তুমিও রাখতে পারলা না।’ কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে গাপ্পুর। তবু বলেই ফেলল।

‘সবাইরে ধইরা রাখন যায় না আংকেল। সে যা চাইছিল এখন তা পাইছে। ভালো থাকুক। হিল্লির ভালা আপনি চান না?’ তীক্ষè শোনায় ওর গলা।

‘আমার চাওনে কি যায়-আসে?’ একটা দীর্ঘশ^াস বের হয়ে আসে ওর ভেতর থেকে। কল্পনায় হিল্লির ঢলোঢলো চেহারাখানা ভাসে গাপ্পুর চোখে। চোখ বুজে আসে অপার দুঃখে।

‘লোলোর খবর কী অংকেল? আপনে নাকি প্রায়ই যান ওর বাসার সামনে? কী জন্য?’ তরল গলায় একথা বলে খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হাসে বাঘা। দেখাদেখি পেছনে দাঁড়ানো ওর দলবলও হাসির জোয়ারে ভাসে।

দুর্বল শরীর গাপ্পুর। নইলে গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঠিকই একটা কড়া উত্তর শোনাতে পারত ওকে। শরীর পড়ে যাওয়ার কারণে আজকাল মান-অপমান জ্ঞানও নেই বললেই চলে।

গাপ্পু নরম হয়ে বলল, ‘না রে, নিজের শরীরই চলে না। আবার লোলো মেমসাহেবের খবর? বেচারাও তো চলে গেল ম্যাডামের ছোট ছেলের কোলে চড়ে বিদেশে। একবার তাকাইলো না পর্যন্ত। তোমার লগে তো বেশ ভালোই খাতির আছিল। কইয়া গেছে কিছু?’ মুখে-চোখে ছড়ানো অস্ফুট এক চিলতে বাঁকা হাসি।

বাঘা এ-কথায় কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সে যে লোলোর পিছু নেয়নি তা নয়। কিন্তু ওর মাত্রাজ্ঞান খুব প্রখর। হাজার আবেগে ভাসলেও মহিলার ছককষা লক্ষ্মণরেখা সে কিছুতেই ভাঙতে পারেনি। মুরুব্বি গাপ্পুর কথায় সে মুখে বলল, ‘আরে না কাকা। আমি কে যে আমারে কইয়া যাইবো? যত সহজ ভাবেন তত না। বিদেশিগুলান আমরার চাইতে অনেক জটিল। আপনার মতোন সহজ-সরল নয়। বড় অহংকারী, বুঝলেন কাকা? ’

গাপ্পুর চোখের সামনে এ সময় লোলোর বিদায়বেলার ছবিটা ভাসে। লাল একটা গাড়ি। ম্যাডামের ছেলের কোলে চড়ে বেরিয়ে গেল এ-গলি ছেড়ে। গাপ্পু কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল লোলোকে বিদায় জানাবে বলে।

একসময় গাড়িটার টায়ারে হিসি ঝেড়ে দিলো অপেক্ষার দংশন সহ্য করতে না পেরে। গাড়িটা যখন ছেড়ে দিলো তখনো পিছু পিছু ভাঙাচোরা এই দেহখানা নিয়ে ছুটে গিয়েছিল অনেকখানি পথ। তবু লোলো একবারের জন্যেও ফিরে তাকায়নি ওর দিকে। মাচার ঝুলে থাকা শিমের মতো লোলোর মুখ-চোখ জুড়ে ছিল অজস্র সফেদ-সোহাগী সাদা পশম আর নির্দোষ-নিষ্ঠুর অহংকার। মনটা সেদিনও বড় বিষণ্ন হয়ে পড়েছিল গাপ্পুর।

গাপ্পু কথা ঘুরিয়ে বাঘাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘এদিকে কী জন্য? ইলেকশন সামনে, এই জন্য?’

‘হ। যাবো মালিবাগের বি-ব্লকে।

ওখানে দুজন মানুষ আছেন, তারা আমাদের কল্যাণ চায়। রাস্তায় যারা ধুঁকে ধুঁকে মরতেছে তাদের আশ্রয় দেয়, খাওয়া দেয়। এমনকি যারা আমাদের ক্ষতি করবার চায় তাদেরও রুখতে চায়।’

‘তো তুমি কি করবা?’ গাপ্পু মাথা দুলিয়ে প্রশ্ন করে। পেটের ক্ষুধাটা ক্রমেই ভাদ্রমাসের রোদের মতো অসহ্য হয়ে উঠছে। সকালের দিকে কে যেন ডাস্টবিনে কিছু মুরগির পাখনা ফেলে গিয়েছিল। তাই নিয়ে কমবয়েসি শয়তানগুলি নিজেদের ভেতর খুব মারামারি করেছে। সেখানে ওর মতো হাত-রথ বসে যাওয়া বুড়ো-হাবড়া কি কিছু করতে পারে? অগত্যা পেটের জ¦ালা পেটেই থেকে যাচ্ছে। বাঘা আসার আগে এক বুড়ো কাশতে কাশতে একদলা কফ ফেলে গেল ওর সামনে। সেটুকুই চেটেপুটে খেয়ে এখন ঝিমোচ্ছে সে। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ, কতদিন চলবে?

‘আমাদের ভাই-বন্ধুরা যাতে তাদের সহযোগিতা করে, সে-কথা বলতে হবে তো, কাকা। সবার মাথায় তো সব ঢোকে না। উনারা মানবিক মানুষ। আমাদের নিয়ে ভাবেন। আমাদের তো তাদের স্বার্থ সমঝে চলতে হবে, নাকি?’ বাঘা গুরুগম্ভীর মন্তব্য করে। এ সময় ওকে সত্যিকার নেতা লাগে।

‘তা তো বটেই।’ একমত হয় গাপ্পু। মনে পড়ে এ-গলির ম্যাডামের কথা; তিনিও এরকম স্বভাব নিয়ে বেঁচে ছিলেন দীর্ঘদিন। করোনায় তাঁর মৃত্যু হওয়ার পর সবাইকে নিষ্ঠুর আর অবিবেচক বলেই মনে হচ্ছে ওর। গাপ্পুদের আঘাত করেই যেন শান্তি পাচ্ছে সবাই। ধর্ষকামী মানুষ সব!

‘আরেকটা কথা কাকা।’ বাঘা মাথা নুয়ে ওর কানে ফিসফিস করে কিছু একটা জানাতে চায়।

‘কী?’ ওর কথা বলার ভঙ্গি দেখে বুকটা ধক্ করে ওঠে গাপ্পুর। দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। কিসে থেকে কী হয় কে জানে!

‘আংকেল, খুব সতর্ক থাইকেন। আমরা দুষ্টুদের কামড়ে দিই বলে কিছু লোক সুস্বাদু খাবার দিয়ে আমাদের হত্যা করতে চাইছে। বেশ কটা এরকম ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন মহল্লায়। খুব হুঁশিয়ার। গায়ে পড়ে কেউ খাবার দিতে চাইলে বুঝবেন তাতে বিষ আছে। খেয়েই মারা পড়বেন। সাবধান!’ বলেই বাঘা তার দলবল নিয়ে চলে গেল। ওর নেতাসুলভ দায়িত্ববোধটা বেশ প্রখর; এই সততাটুকু গাপ্পুর বড় ভালো লাগে।

কিন্তু কথা শুনে, সত্যি বলতে কী, এবার আর ভয় পেল না গাপ্পু। বরং হাসি পেল। মনে পড়ল পুরনো কথা। একদিন ওরও যৌবন ছিল। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল থেকে সবে পা রেখেছে এ-শহরে। বড়লোকের বাড়িতে কত যে সমাদর ওর। কত রঙের-ঢঙের খাবার-দাবার। সেবাযত্নের জন্যে একজন বাঁধা মানুষ ছিল ওর। গাপ্পুর কথা বলে মালিকের কাছ থেকে নিয়মিত ওই ব্যাটা টাকা মেরে খেত। অথচ কয়েক বছরের মাথায় যখন ওর শরীরে ঘা দেখা দিলো তখন থেকেই শুরু হলো ওর প্রতি চরম অবহেলা। ওর জায়গায় আরেকজন এলো। মতি বাটপার নাদুস-নুদুস নতুনটার দিকে ঝুঁকে পড়ল। কারণ গাপ্পুর কথা বললে মালিকের হাত থেকে আর টাকা খসে না। তাই ওকে দেখেও না দেখার ভান করে। বকাঝকা, মারধর তো চলত নিত্যদিন। একদিন অভিমান করে বেরিয়েই পড়ল। বেশরম বেশ্যার মতো নাম লেখাল রাস্তায়।

আজ কেন সেসব ভুলে যাওয়া অতীত ওর মনে পড়ছে? কেন? গাপ্পু কি তাহলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? শুনেছে, মরণকালে অতীত বড় জ¦ালাতন করে। নিজের সন্তান-সন্ততি আর মা-বাবার কথা মনে পড়ে। সরাইলের কথা এখন আর অত মনে নেই। ঝাপসা হয়ে এসেছে সব স্মৃতি। তবু পিতৃভূমি-মাতৃভূমির কথা মনে পড়লেই সমস্ত ইন্দ্রিয় আলগা হয়ে পড়ে। কেমন অবশ অবশ লাগে সব। চোখে ভাসে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপের মতো কুয়াশাচ্ছন্ন একটা বিশাল উঠোনের ছবি। সেখানেই ভাইবোন আর মা-বাবাকে নিয়ে ওদের সুখের সংসার। কী যে সম্মান তখন সমাজে! যারা ওদের দেখতে আসত সবার চোখে সমীহ মিশে থাকত। ওরা কাউকে পাত্তাই দিত না। আভিজাত্যের গর্ববোধে বুঁদ হয়ে থাকত। মাঝে মাঝে গাড়িওয়ালারা এসে মালিকের টাকা মিটিয়ে পছন্দসই একেকজনকে কোলে করে চলে যেত সুদূরে। তখন মন খারাপ হতো সবার। কিন্তু যে যেত সে রাজার হালে থাকতে পেত, খেত রাজা-মহারাজার স্টাইলে। অন্যসব পশুপাখি চোখভরা ঈর্ষা নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকত। একটা হাঁচি দিলে মালিক হুমড়ি খেয়ে পড়ত ডাক্তার দেখানোর জন্যে। জেল্লামাখা দেহের সঙ্গে সৌভাগ্য যেন রংধনু হয়ে ওদের জীবনে মিশে থাকত।

মনে পড়ছে খুব। গাপ্পুর মাথা যত দুপায়ের ওপর নুয়ে পড়তে থাকে তত পুরনো সুখস্মৃতিগুলি ওকে দগদাতে থাকে।

সহসা খুব কাছেই একটা গাড়ি থামার শব্দ পেল গাপ্পু। চোখ মেলে তাকাল সে। চোখের সামনে রাস্তার মোড়ে একটা পিকআপ ভ্যান এইমাত্র দাঁড়িয়েছে। ভ্যানটার পেছনের খোলে একটা বড় ডেকচি আর সেটি ঘিরে ষণ্ডামতোন কজন লোক।

তাকালেই ভয় করে। লোকগুলির চোখ ওরই দিকে তাক করা। একজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওই যে একটা। কাজ শুরু করে দে।’ সঙ্গে সঙ্গে ওরা লাফ দিয়ে নেমে পড়ে পিকআপ ভ্যান থেকে। ছুটে এসে ওর সামনে একটা বাটির মুখ খুলে দেয়। আহ্! মানুষের হাতের তৈরি সুস্বাদু মাংসের গন্ধ ওকে পাগল করে দেয়। ওর ক্ষুধার্ত পেট নড়াচড়া করে ওঠে। চোখ দুটো চকচক করে লোভে। লোকগুলি সামান্য দূরে চলে যেতেই সে বাটিটার সামনে এসে শুঁকতে থাকে নাক দিয়ে। আহ! সরাইলে থাকতে প্রতিদিন ওদের মালিক এরকম খাবার খেতে দিত ওদের। কী যে স্বাদ! ভোলা যায় না। সেই সুগন্ধ নাকে এখন সুড়সুড়ি দিচ্ছে। এ-গন্ধে ধীরে ধরে আওলা হয়ে পড়ছে গাপ্পুর মাথা। এ-গন্ধের ভেতর ওর অনেক সুখস্মৃতি, সেগুলি মাথাচাড়া দিয়ে জেগে উঠছে ওর ভেতর। সে কি পারে এড়িয়ে চলতে?

সহসা বাঘার কথা মনে হলো। গাপ্পু চোখ তুলে লোকগুলির দিকে তাকাল। সহজেই বুঝতে পারে ওরা কেন ওকে এত খাতির করছে!

কিন্তু মানুষের তৈরি তুলতুলে নরম এই মাংসখণ্ডগুলি যে ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে! ওর ক্ষুধার্ত শরীর ও মন বারবার ওকে উদরপূর্তির তাগাদা দিয়ে মারছে। সে কতক্ষণ ঠেকিয়ে রাখবে এই উদগ্র ইচ্ছাকে? কতক্ষণ?

গাপ্পু সব জানে। তবু সে চুমুক দেয়। আহ! কী শান্তি ও স্বস্তি নেমে আসছে ক্ষুধার রাজ্যে। আগ্রাসী হয়ে সে গিলতে থাকে মাংসের টুকরোগুলি। হাড়গুলি চিবিয়ে, লেহন করে শুষে নিচ্ছে অপূর্ব এক সুখ।

এসময় হিল্লির চেহারাটা চোখের সামনে ভাসে। চলে যাওয়ার পর আর কখনো দেখা হলো না দুজনার। একটা দীর্ঘশ^াস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে গাপ্পুর। একই সঙ্গে তৃপ্তির লম্বা একটা ঢেঁকুর। সম্ভবত ক্ষুধার পেটে সুস্বাদু খাদ্য খাওয়ার মতো অনির্বচনীয় আনন্দ আর কিছুতেই নেই!

খেতে খেতেই গাপ্পুর শরীর ঢলে পড়ে মাটিতে। অবশ হয়ে আসছে সমস্ত শরীর। চোখ বুঁজে আসছে অনন্ত নিদ্রায়। এরই ভেতর কানে ভেসে আসছে অদূরে দাঁড়ানো মানুষগুলির অট্টহাস্য। নিজেদের কাজের সাফল্যে নিজেরাই উল্লসিত।

গাপ্পু বুঝতে পারে না ওদের মতো বোবা নিরীহ নির্ভরশীল অসহায়দের নিশ্চিহ্ন করে মানুষগুলি এত সুখ পায় কেন!

সহসা অবশ হওয়া গায়ের সমস্ত শক্তি কণ্ঠে জড়ো করে প্রচণ্ড শব্দে ডেকে ওঠে গাপ্পু, ‘ঘেউ, ঘেউ, ঘেউ।’

লোকগুলি আচমকা ভয় পেয়ে দু-পা পেছনে চলে যায়। একটু বাদে নিশ্চিন্ত হয়ে ফের হাসতে শুরু করে। মুখে বলে, ‘মরতে মরতেও ভাব যায় না কুত্তার বাইচ্চার!’

লোকগুলি বুঝতেই পারল না ওদের জাগাতে চেয়ে গাপ্পু কী কথা বলতে চেয়েছে ওদের!

প্রচণ্ড দুঃখ ও অভিমানে গাপ্পুর শরীরটা নিথর হতে থাকে; একসময় একটা গভীর দীর্ঘশ^াস বের হয়ে আসে বুকের তলা থেকে। তারপর নেতিয়ে পড়ে মাটিতে।

Published :


Comments

Leave a Reply