ভূমিকা ও অনুবাদ : আন্দালিব রাশদী
সুনাম ও দুর্নাম দুই-ই জুটেছে তাঁর। ব্যক্তিগত জীবনে যা-ই হোক, লেখালেখিতে যৌনতার আসর তাঁকে পরিণত করেছে দিল্লির ডার্টি ওল্ডম্যানে। খুব কাছে থেকে যাঁরা তাঁকে চেনেন, কেউ কেউ লিখেছেন, নারীর উষ্ণতা তাঁর রচনায় ছিল বটে, বিছানায় নয়; বিছানায় ছিল বড়জোর গরম পানির ব্যাগের উষ্ণতা।
আবার তাঁকেই বলা হয়েছে ‘গ্র্যান্ড ওল্ডম্যান অব ইন্ডিয়ান জার্নালিজম’। ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নিউইয়র্ক টাইমসে তিনি লিখেছেন, স্কুল ফাইনাল পাশের সার্টিফিকেট না থাকায় ইন্দিরা কেরানির চাকরিও পেতেন না।
আবার সেই প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সঞ্জয় গান্ধীকে বলেছেন গুন্ডা। অন্যদিকে মা ও ছেলের সঙ্গে গড়ে ওঠা সখ্যের কারণে এবং ইন্দিরার জারি করা জরুরি অবস্থাকে স্বাগত জানানোর কারণে যথেষ্ট নিন্দিত হয়েছেন। তিনি লিখেছেন, গর্দভও প্রধানমন্ত্রী হয়। যেমন দেবগৌড়া।
ভারতীয়দের মধ্যে যাঁরা ইংরেজিকে সাহিত্য ও সাংবাদিকতার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তাঁদের অন্যতম প্রধান খুশবন্ত সিং। কথাসাহিত্য ও সাংবাদিকতা – দুটো একসঙ্গে মেলালে পাঠকভাগ্যে কেউ তাঁকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি।
খুশবন্ত সিংয়ের জন্ম ২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৫, পাঞ্জাবের হাদালিতে। সাতচল্লিশের দেশভাগে জায়গাটি এখন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। ধনাঢ্য ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে খুশবন্ত সিং বেড়ে উঠেছেন। পড়াশোনা করেছেন দিল্লির মডেল স্কুল, লাহোরের গভর্নমেন্ট কলেজ, দিল্লির সেইন্ট স্টিফেন্স কলেজ এবং লন্ডনের কিংস কলেজে। ব্যারিস্টার হওয়ার জন্য লন্ডনের ইনার টেম্পলে পড়াশোনাও করেন।
বিয়ে করেন ১৯৩৯-এ কানওয়াল মালিককে। ১৯৪৭-এর ভাগাভাগির পর স্থায়ীভাবে দিল্লিতে ফিরে আসেন। ওকালতিকে বিদায় জানিয়ে পররাষ্ট্র দফতরের তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনে যোগ দেন। খুব বেশিদিন চাকরিতে ছিলেন না। পদত্যাগ করে লেখালেখিতে মন বসাতে চান। তারপরও একাধিক চাকরি নিয়েছেন এবং ছেড়েছেন। গল্পকার হিসেবে খ্যাত হতে শুরু করেন। প্রথম গল্পগ্রন্থ বিষ্ণুর চিহ্ন এবং অন্যান্য গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালে। দেশভাগ ও দাঙ্গার মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত উপন্যাস ট্রেন টু পাকিস্তান তাঁকে বিশেষভাবে পরিচিত করে তোলে। পরে উপন্যাসটি চলচ্চিত্রায়িত হয়। শিখ ও মুসলমান-অধ্যুষিত সীমান্তবর্তী গ্রাম মানো মাজরা। ১৯৪৭-এর গ্রীষ্মে যখন শিখদের মৃতদেহ নিয়ে ট্রেনটি পাকিস্তানে প্রবেশ করে, গোটা গ্রাম পরিণত হয় ভয়াবহ রণক্ষেত্রে। মুসলমানরা বলছে, হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা ও সূচনা করেছে হিন্দুরা। হিন্দুরা বলছে, দোষ আসলে মুসলমানদের। মোদ্দা কথা, মরেছে দুপক্ষের মানুষ। গুলি খেয়েছে, ছুরিকাহত ও বর্শাবিদ্ধ হয়েছে, এবং মুগুরের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছে। দুপক্ষই নির্যাতিত হয়েছে, ধর্ষিত হয়েছে।
উপন্যাসের স্বজনহারা হাহাকার করা চরিত্রগুলো উপসংহার টানে, স্বাধীনতা তো শিক্ষিত মানুষের জন্য। তারা এর জন্য লড়াই করেছে। আমরা ইংরেজের দাস ছিলাম। এখন আমরা হবো শিক্ষিত ভারতীয় কিংবা পাকিস্তানিদের দাস।
খুশবন্ত সিং দীর্ঘ গবেষণামূলক গ্রন্থে শিখদের ইতিহাস লিখেছেন, অমৃতসর স্বর্ণমন্দির আক্রমণের প্রতিবাদে ১৯৭৪-এ পাওয়া রাষ্ট্রীয় পদক পদ্মভূষণ ফিরিয়ে দিয়েছেন। ২০০৭ সালে ভারত তাঁকে পদ্মবিভূষণ পদক দেয়। তিনি রাজ্যসভার সদস্যও হয়েছেন।
তিনি ইংরেজির পাশাপাশি পাঞ্জাবিতেও লিখেছেন। ইলাসট্রেটেড উইকলির সম্পাদক হিসেবে পত্রিকাটির মৌল চরিত্র বদলে একে ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাপ্তাহিকে পরিণত করেন। রসিকতার ভাষা যে কতটা নির্মমভাবে প্রয়োগ করা যায়, খুশবন্ত তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধ ইত্যাদি মিলিয়ে তাঁর গ্রন্থসংখ্যা অর্ধশতের কাছাকাছি।
শতবর্ষপূর্তির কাছাকাছি এসে ২০১৪-র ২০ মার্চ খুশবন্ত সিং প্রয়াত হলেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২০০৬ সালে আউটলুক ইন্ডিয়া ডটকমে প্রকাশিত খুশবন্ত সিংয়ের দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ এখানে অনূদিত ও প্রকাশিত হলো :
** আপনি যখন ইলাসট্রেটেড উইকলির দায়িত্ব নিলেন ১৯৬৯ সালে, তখন থেকে শুরু করা যাক।
* দুবছর আগেই আমাকে এ-দায়িত্বটি নিতে বলা হয়েছিল, কিন্তু আগেই রকফেলার অনুদান বৃত্তি নেওয়ায় তা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। রমণকে চাকরিচ্যুত করার পর তারা অন্য কোনো সম্পাদক নিয়োগ করেনি। কারণ, আমি বলেছিলাম দুবছর পর কাজে যোগ দেবো; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিন বছর লেগে গেল। যখন এ-প্রস্তাবটি গ্রহণ করি, আমি যুক্তরাষ্ট্রে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ও সমকালীন ভারত পড়াচ্ছি।
** সাহিত্যের আহবান ছাড়া এটা কি আপনার জন্য লোভনীয় কোনো প্রস্তাব ছিল?
* এটা লোভনীয় ছিল, কারণ তখন এ-ধরনের একটাই ম্যাগাজিন ছিল। আমি বাড়ি ফিরে আসতে চেয়েছি এবং সাংবাদিকতায় ফিরতে চেয়েছি। যোগ দেওয়ার আগেই ম্যাগাজিনটিকে নিয়ে আমি কী করতে চাচ্ছি তা আমার কাছে বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। কারণ, যখন আমি সমকালীন ভারতবর্ষ পড়াচ্ছিলাম, তখন বুঝতে পারি, ভারত সম্পর্কে আমি কত কম জানি। ফিরে এসে ১৯৬৯-এর গ্রীষ্মে আমি দায়িত্ব নিই। ব্যানার্জি নামে একজন তখন দুর্গ আঁকড়ে ধরে ছিলেন, কিন্তু যে-ব্যবস্থাপনা ট্রাস্ট ইলাসট্রেটেড উইকলি চালাচ্ছিল, তারা তাঁকে নিয়োগ দিতে আদৌ রাজি ছিল না। স্পষ্টতই ব্যানার্জি উপযুক্ত ছিলেন না।
** কিন্তু তারা আপনাকে বেছে নিল কেমন করে? আপনার তো সাংবাদিক হিসেবে কোনো পূর্বাভিজ্ঞতা ছিল না?
* আমি আগে এআইআর এবং যোজনাতে কাজ করতাম, কিন্তু সেটা অবশ্য মোটেও গণ্য করা হয়নি। নিউইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হচ্ছিল বলে তারা আমাকে চাচ্ছিলেন। আমি তখন বেশ লিখছিলাম এমনকি ভারতীয় পত্রপত্রিকায় মাঝের পাতায় লিখছি; কাজেই আমাকে অস্তিত্বহীন বলা যাবে না। স্টেটসম্যান পত্রিকার জন্য নিয়মিত লিখছি; টাইমস অব ইন্ডিয়ায় উপ-সম্পাদকীয় ছাড়াও মাঝে মাঝে নিবন্ধ লিখছি নিউইয়র্ক টাইমসে, এ-ধরনের আরো কিছু।
** এটা কি আপনার কখনো মনে হয়নি, পত্রিকায় এসব লেখা আপনার মতো সাহিত্যের পন্ডিত এবং লেখকের জন্য মানানসই নয়?
* দেখুন, আমার মাথায় যা এসেছে আমি তা-ই লিখেছি এবং পত্রিকাগুলো তা-ই গ্রহণ করেছে। আমি সেভাবে কখনো চিন্তা করিনি। সকালে যদি আমার কিছু একটা ঘটে, আমি তা-ই কাগজে লিখে ফেলি। লেখাটা ছোট হলে রসালাপ হিসেবে ছাপার জন্য পাঠিয়ে দিই, বড় হলে নিবন্ধ আকারে ছাপা হয়। আমি প্রচুর ঘুরে বেড়িয়েছি, কাজেই লেখার মতো অনেক কিছু ছিল।
** আপনার কি মনে হয়নি আপনার উপন্যাসের জন্য এসব লেখা দূরে সরিয়ে রাখা দরকার?
* না, আমি একেবারে পরিষ্কার স্লেট নিয়ে সাংবাদিকতায় এসেছি। আমি কী করতে চেয়েছি সে-ব্যাপারে আমার স্পষ্ট ধারণা ছিল। আমার কাছে সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের মধ্যে কোনো তফাৎ ছিল না, একটুও না। আমি চাকরিটার ব্যাপারে উদগ্রীব ছিলাম। শুরুতে আমি কিছুটা হতাশ ছিলাম – ম্যাগাজিনটির অনেকের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি ছিল এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসা যাচ্ছিল না। যেমন একটা ছিল নাসার সঙ্গে; সপ্তাহের পর সপ্তাহ মহাশূন্য ভ্রমণের দীর্ঘ প্রবন্ধ ছেপে যেতে হচ্ছে। জ্যোতিষশাস্ত্রের দীর্ঘ কলাম নিয়ে আমি অধৈর্য হয়ে পড়ি। এই লেখাগুলো ইংল্যান্ড থেকে আনা হতো একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় – আর পাতাভরা বিয়ের ছবি – ওদের বিয়ে কিংবা বিয়ের ঘণ্টা নামে পাতার পর পাতা স্বামী-স্ত্রীর ছবি ভয়ংকর দেখাত। আরো ছিল আন্টি ওয়েন্ডির কলাম – প্রিয় শিশুগণ ধরনের লেখা। আগের একজন সম্পাদক আইরিশ ভদ্রলোক সি আর ম্যান্ডি এমন একটি ছকে ম্যাগাজিনটির ধরন ঠিক করে রেখেছেন। সঙ্গে ককটেল পার্টি, পাতা ওলটালেই এসব ছবি দেখতে হবে। আমার মতো করে পদক্ষেপ নিতে এবং ওসব চুক্তি গুটিয়ে ফেলতে আমার দু-তিন মাস লেগে যায়।
** অভিজ্ঞতা নেই এমন একটি কাজের দায়িত্ব নিতে আপনি কি বিচলিত হয়ে পড়েননি?
* না, আমার পুরো আত্মবিশ্বাস ছিল। আমি জানতাম, আমি কী করতে যাচ্ছি আর এটা ছিল ত্রিমুখী ফর্মুলা : অবহিত করা, আমোদিত করা এবং প্ররোচিত করা।
** বিদেশি কাগজ থেকে নেওয়া ফর্মুলা? আপনার কি কোনো রোল-মডেল ছিল?
* না, সবটাই আমার। একটি অনুপম ভারতীয় মডেল। অবহিত করা – আমি পুরোপুরি অবহিত ছিলাম না, আমি ভাবলাম আর সব ভারতীয়র অনুভূতি আমারই মতো। আমোদিত করা – কারণ আমি ছিলাম একজন জোকার। যেমন একটি কাগজ হাতে নিয়ে আমি লিখতে বসে যেতাম। মনে যা আসত তা লিখতাম – যেমন কোনো কোনো বানরের নিতম্ব লাল কেন – এতে অনেকেই বিস্মিত হয়। অবশ্য এ-বিষয়টি যথেষ্ট পড়াশোনা করেই আমি বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দিয়েছিলাম। আর প্ররোচিত করা – ভারতীয়দের মন এতটাই নিষ্ক্রিয় যে, কেবল অদ্ভুত কিছু বললেই তারা ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে। এটা কাজে লেগেছে। ভারত নিয়ে সে-বিষয়ের সত্যিকার কর্তৃত্বসম্পন্ন লেখকদের দিয়ে যখন লেখাতে শুরু করি, সাফল্য আসতে থাকে। যখন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াই, তখনকার একজন শিক্ষার্থীর একটি গবেষণাপত্র নিয়ে কাজে হাত দিই। এটা আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম। আমার ওই ছাত্রী তার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে খুব ভালো গবেষণা করেছে – কেমন করে তারা বিভিন্ন আদালতে পেশোয়াবৃত্তান্ত, সাভারকার থেকে নাথুরাম গডসে পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের মানুষ, ফ্যাসিবাদী, বামপন্থী ও চিন্তাবিদ চিত্তপবন ব্রাহ্মণ, ছোট সম্প্রদায়ের জন্য তাদের অঢেল অবদান সব বিষয়ই। তারপর আমি সম্প্রদায় ধরে ধরে সংখ্যা তৈরি করতে থাকি – প্রতিটি কপি বিক্রি হয়েছে, সেই সম্প্রদায়ের লোকেরা কিনেছে।
মুসলমানদের মধ্যে শিয়া ও সুন্নির বিভাজন ছাড়া আরো যে কত ধরনের সম্প্রদায় আছে অন্যরা তা জানে না। যেমন ইসমাইলিয়া, খোজা, মেমন, সুলাইমানিয়া। পর্যায়ক্রমে আমি সব তুলে আনি। আয়েঙ্গার, আয়ার, বাঙালি ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, জাঠ, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শিখ – একটার পর একটা উঠে আসে ম্যাগাজিনের পাতায়। ৩০ থেকে ৪০টা এ-ধরনের সম্প্রদায় হবে – সব কপি বিক্রি হয়ে গেছে, ম্যাগাজিনের প্রচারসংখ্যা দ্রুত বেড়ে যায়। ‘আমার বিশ্বাস’ নামে একটি সিরিজ চালিয়েছি – এতে বিভিন্ন বিষয়ে সেলিব্রেটিদের বিশ্বাস ও বিশ্বাসের কারণ নিয়ে প্রশ্ন করা হতো – ঈশ্বর, ধর্ম, নিয়তি, পৃষ্ঠপোষকতা, দুর্নীতি এসব নিয়ে। সিরিজটা খুব সফল হয়েছিল। কেউ খোলামেলা কথা বলতেন, কেউ বলতেন না। প্রায়ই তাঁদের লেখাটা আমাকে পুনর্লিখন করতে হতো। নিজেদের লেখা সম্পর্কে সেসব মানুষের অনেক উঁচু ধারণা – যখন তাঁরা অফিসের নোট লিখতেন, কেউ তাঁদের লেখায় কমা পর্যন্ত বসাতে পারতেন না – আমাকে তাঁদের পুরো লেখাই পুনর্লিখন করতে হয়েছে।…
সৌভাগ্যবশত আমার কোনো বস ছিল না। ইলাসট্রেটেড উইকলিসহ পুরো বেনেট অ্যান্ড কোলম্যানের কর্তৃত্ব নিয়ে নিয়েছে সরকার আর জৈনরা কিছু সময়ের জন্য কর্তৃত্ব হারিয়েছে, কাজেই আমাকে নিয়ন্ত্রণ করার কেউই ছিল না। সরকার-নিয়োজিত ট্রাস্টের চেয়ারম্যান জাস্টিস দেশাইয়ের পূর্ণ সমর্থন আমি পেয়েছি। আমাদের দুজনের সমঝোতা ছিল চমৎকার। তিনি কখনো আমার কাজে হস্তক্ষেপ করতেন না, বাড়িতে ডেকে চা খাওয়াতেন। তারপরও কয়েকজন সদস্য বড্ড বেশি স্বাধীনতাভোগের অপরাধে আমার বিরুদ্ধে লেগে গেলেন এবং অন্যায়ভাবে তিরস্কার করলেন। যেমন একটি উদাহরণ দিই : আমরা প্রচ্ছদে সিমি গারওয়ালের স্বল্পবসন একটি ছবি ছাপি। সিদ্ধার্থ চলচ্চিত্রে তিনি এ-পোশাকেই আবির্ভূত হন। তাঁরা খুব মর্মাহত হন। কিন্তু এটি তো ছবির স্টিল থেকে নেওয়া।
** সিমি কী বলেছেন?
* সিমি কিছুই বলেননি। তাছাড়া তিনি বলার কে? যিনি দারুণ অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন তিনি পেরসিস খাম্বাতা। তাঁর নগ্ন ছবি প্লেবয় ম্যাগাজিন এবং একটি জার্মান ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল। তিনি যখন শুনলেন ছবিগুলো আমার হস্তগত হয়েছে এবং আমি তা ইলাসট্রেটেড উইকলিতে ছাপার পরিকল্পনা করছি, তিনি এসে আমাকে রীতিমতো হুমকি দিলেন। যা ইচ্ছে করুন – আপনি এভাবে বিদেশি ম্যাগাজিনের জন্য ছবির পোজ দিতে পারলেন আর নিজের দেশের মানুষের বেলায় আপনার এত অস্বস্তি? তারপর তিনি আমার সঙ্গে তর্ক করলেন, একসময় করুণা ভিক্ষা চাইলেন – যেন না ছাপি। তাঁর মনোভাবের এতটা পরিবর্তনের পর কাজটা কেমন করে করি!
এরকম ছবি শত শত পাওয়া যায়, ছবি পাওয়াটা সমস্যা নয়, সমস্যা উপস্থাপনায়। আমি ঠিক করলাম, আমি যদি উন্মুক্ত বক্ষ কোনো উপজাতি যুবতীর ছবি ছাপি, তাহলে ব্লিৎজ কিংবা অন্য কোনো ম্যাগাজিন যা করে – গায়ের মাপ ছেপে দেওয়া এবং বলে দেওয়া এটি কিন্তু তার টেলিফোন নয় – এ-জাতীয় বোকামি করিনি। আমি তার গোত্রের বিবরণ, তাদের সংখ্যা, জীবনযাপন, স্কুলশিশুর জন্য আগ্রহোদ্দীপক মামুলি ধরনের তথ্য উপস্থাপন করেছি। মানুষ এটা পড়েছে। তারা ছবি দেখেছে, শিরোনাম পড়েছে। আমি একে একটি প্যাটার্নে পরিণত করি। আমি ভেবে দেখি, শিরোনামের উন্নয়ন দরকার। বাচি কাকারিয়াকে এর দায়িত্ব দিই। যখন এ-ধরনের ছবি তার হাতে দিই, এ নিয়ে কোনোরকম কথা না বলে সে কাজে নেমে যায়। ছবি মানুষকে আকৃষ্ট করবে আর আপনি মানুষকে তথ্য সরবরাহ করবেন। আমার এই চাতুরীতে খুব কাজ হলো।
** আপনি বলেছেন ইলাসট্রেটেড উইকলি ম্যাগাজিনের প্রচারসংখ্যা এতটাই বাড়তে থাকে যে, বিজ্ঞাপন থেকে প্রাপ্ত আয় তার সঙ্গে আর কুলিয়ে উঠতে পারছিল না, ফলে আর্থিক ক্ষতিসাধিত হতে থাকে।
* হ্যাঁ, সে-কারণে প্রচারসংখ্যা চার লাখ দশ হাজারের ওপর আর উঠতে দেওয়া হয়নি। আমি যখন দায়িত্ব নিই প্রচারসংখ্যা ছিল ষাট হাজার। বছরখানেকের মধ্যেই প্রচারসংখ্যা চার লাখ ছাড়িয়ে যায়। চার্চগেটে নিউজ স্টলে গিয়ে আমি জিজ্ঞেস করতাম, কত কপি চলেছে? তারা আমাকে চিনতেন এবং খুব সন্তুষ্ট ছিলেন। জবাব দিতেন, এক কপিও নেই, সব বিক্রি হয়ে গেছে। পত্রিকার নিয়মিত গ্রাহকের সংখ্যা বেশি ছিল না, অধিকাংশই বিক্রি হতো নিউজস্ট্যান্ড থেকে।
** নিউজস্ট্যান্ড থেকে বিক্রিতে কোনো সমস্যা হয়নি? যেমন বিক্রেতা ম্যাগাজিনটি নিচ্ছে না?
* মোটেও না। এর সঙ্গে অন্য কোনো ম্যাগাজিনের কোনো প্রতিযোগিতাই ছিল না। আমার সমস্যা শুরু হলো জৈনরা ফেরার পর থেকে। আমার মনে একটি সংখ্যার প্রচ্ছদ-কাহিনি ছিল ‘শূকরের খোঁয়াড় থেকে কত কামাতে হবে?’ প্রচ্ছদে ছিল ঝুলানো শূকরের মাংসের ছবি। আমাকে বললেন, এটাতে সুরুচির পরিচয় মেলেনি। তাছাড়া এতে জৈন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করা হয়েছে। আমি তখন অশোক জৈনকে বললাম, দেখুন আমি এখানে প্রায় নয় বছর ধরে কাজ করছি। এর প্রচারসংখ্যা বাড়িয়েছি। একটি প্রশংসাবাক্যও শুনিনি, আর আপনি খুঁত ধরতে এসেছেন। তার সঙ্গে এরকম চলতে থাকল। সরকার বদল হলো আর মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন। স্পষ্টতই তিনি জৈনদের বললেন যে, আমাকে ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবে দেখতে চান না। কারণ আমি মিসেস গান্ধীকে সমর্থন করেছি। আমি তাঁকে সমর্থন করেছি কারণ তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়েছে বলে আমি মনে করেছি এবং আমি ইন্দিরার জরুরি অবস্থা ঘোষণাকে যুক্তিযুক্ত মনে করেছি। আমি অপর পক্ষের প্রতিও সুবিচার করেছি। যেমন গণতান্ত্রিক পন্থায় প্রতিবাদের সীমা জয়প্রকাশ লঙ্ঘন করছেন বলে আমার লেখার যে-প্রতিবাদ তিনি দেন, আমি তাও ছাপিয়ে দিই। তিনি যখন সংসদ আইনপরিষদ ও সেনা-কার্যক্রম স্থগিত রাখার আহবান জানান, আমি বলেছি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটা অভাবনীয়। তিনি জবাব লিখলে আমি পুরোটাই প্রকাশ করি।
** আপনি কেমন করে মিসেস গান্ধীর ঘনিষ্ঠ হলেন?
* ইলাসট্রেটেড উইকলিতে যোগ দেওয়ার বহু আগেই তাঁর সঙ্গে আমার বহুবার দেখা হয়। প্রথম দেখা ১৯২০ সালে লাহোরে, কাশ্মির যাওয়ার পথে সেখানে এসেছিলেন। তিনি আমার কিছু বন্ধুর সঙ্গে লাহোরে ছিলেন; তারা তাঁকে নিয়ে আমাদের বাসায় এসেছিল। তখন তিনি ছিলেন অবোধ পুতুল। তার সঙ্গে যখন আবার দেখা, তিনি শাস্ত্রী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী। মনে হয়েছে তিনি মন্ত্রিত্বের ভার টানতে পারছেন না, বিষণ্ণ হয়ে পড়েছেন এবং কদাচিৎ অফিসে আসছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নিউইয়র্ক টাইমস যখন তাঁকে নিয়ে লিখতে বলল, আমি তাঁর একটি ঋণাত্মক ছবিই তুলে ধরেছিলাম। আমি লিখেছিলাম, ইন্দিরা প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় ভারত বিস্মিত হয়েছে। তিনি যদি কেরানি পদে চাকরির জন্যও আবেদন করতেন, তা পেতেন না। কারণ তাঁর ম্যাট্রিকুলেশন ডিগ্রি নেই। অবশ্য তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আমি আর তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী হতে চাইনি। কারণ আমার ধারণা, তা চাটুকারিতার গন্ধ বহন করবে। তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর সঙ্গে দু-একবার আমার দেখা হয়ে থাকতে পারে। আমি ইলাসট্রেটেড উইকলির জন্য তাঁর একটি সাক্ষাৎকার চেয়েছিলাম। তবে তিনি যখন ক্ষমতার বাইরে, তখনি পরিবারটিকে চেনার সুযোগ পেয়েছি। জরুরি অবস্থা চলাকালে সঞ্জয় গান্ধীর সঙ্গে দু-একবার সাক্ষাৎ হয়েছে, সবসময়ে আমার বাড়িতেই। আমি তখন তাঁকে বৃক্ষরোপণের বিষয়টিতে জোর দিতে বলি।
তাঁরা যখন ক্ষমতাচ্যুত, আমি সপ্তাহে দু-তিনবার তাঁদের বাড়িতে গিয়েছি। আমি যখন ন্যাশনাল হেরান্ডে যোগ দিই, প্রথমদিকে প্রায় প্রতিদিন তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে। একসময়ে বললাম, প্রতিদিন আপনার সময় নষ্ট করতে চাই না। আপনি বরং আপনার কোনো প্রতিনিধির কথা বলুন, যিনি আমাকে রাজনীতি বিষয়ে বলতে পারবেন বলে আপনি মনে করেন। তিনি প্রণব মুখার্জির কথা বললেন। তাঁর সঙ্গে আমার বেশ কবার মোলাকাত হয়েছে। আমি আবিষ্কার করলাম, এটা অর্থহীন। তাঁদের সঙ্গে কতটা অসদাচরণ করা হয়েছে, এর পুনরাবৃত্তি করা ছাড়া তাঁর আর বলার কিছু নেই। কাজেই আমি যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। তারপর মাঝে মাঝে মিসেস গান্ধীর বাড়িতে যেতাম। তাঁর বাড়ির সামনের বাগানে সবসময়ই মানুষের ভিড়। মূলত তাঁদের বেশিরভাগই তাঁকে দেখতে এসেছেন। যশপাল কাপুরসহ কাউকে কাউকে তিনি আসতে নিষেধ করতেন। কিন্তু যশপাল আশপাশেই থাকতেন। লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন। নিজেকে দেখানোই তাঁর উদ্দেশ্য। তাঁর মতো আরো অনেকেই ছিলেন। অবশ্য তিনি বরাবরই আমার সঙ্গে সৌজন্যমূলক আচরণ করতেন। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর রুমে ডাকতেন। কথা বলে আমি বেরিয়ে আসতাম। কিন্তু এসব লোকজনের কমতি ছিল না। এজন্য যে আমি অস্বস্তিবোধ করতাম তা নয়। তিনি যদিও তখন ক্ষমতায় নেই, এটাও তোষামোদি। কারণ তিনিই তখন দেশের দৃষ্টি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। এতে অবশ্য আমারও মনে হয়েছে, আমি ঠিক পথেই আছি।
আমার জন্য ইন্দিরার মনে একটি কোমল স্থান তৈরি হয়েছিল। কারণ আমি সঞ্জয়কে সমর্থন করেছি। আমি মারুতি প্রকল্প নিয়ে লিখেছি। আমি ফ্যাক্টরি ঘুরে এসেছি। এটার অবস্থা ভয়াবহ। সেখানে কিছুই নেই। পুরোটাই গ্রামের কামারশালার মতো।
আমার আশা ছিল সারি সারি তৈরি গাড়ি দেখব। কিছুই ছিল না। কিন্তু আমি আরো ভেতরের কাহিনি বের করতে গিয়ে দেখলাম, তাঁকে বরং ভুল কারণে আক্রমণ করা হয়েছে। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী বংশীলাল তাঁকে নামমাত্র মূল্যে জমি দিয়েছেন। আর সেই জমি প্রতিরক্ষা স্থাপনার খুব কাছাকাছি – এগুলো আমি একটার পর একটা করে পরীক্ষা করেছি। প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করেছি – জমির জন্য তাঁরা কত পেয়েছেন, তাঁরা আমাকে সে-পরিমাণ জানিয়েছিলেন।
** এটা একজন সম্পাদকের জন্য অস্বাভাবিক নয় কি – সাধারণ রিপোর্টারের মতো মাঠে গিয়ে অনুসন্ধান করা?
* আমি এমন বহুবার করেছি। গল্পটা আমার কাছে কৌতূহলোদ্দীপক মনে হলে আমি বেরিয়ে পড়ি। বাংলাদেশ (স্বাধীনতা) যুদ্ধের প্রতিবেদন আমি নিজেই করেছি। আমি তখন ঢাকায় যাই আর যেহেতু (জেনারেল) অরোরার মতো অনেককেই আমি চিনি, আমি ঢাকায় থাকার সুযোগ পাই। পাকিস্তানি বন্দিদের সাক্ষাৎকার নিই। আমি ছাড়া আর কেউ এ-কাজটি করতে পারেনি। সেসব রচনা পর্যায়ক্রমে নিউইয়র্ক টাইমসে ছাপা হয়েছে। এ-কাজের জন্য আমি নিউইয়র্ক টাইমস থেকে টাকা নিয়েছি। সেখানে প্রকাশিত হওয়ার এক সপ্তাহ পরে ইলাসট্রেটেড উইকলিতে তা ছেপেছি। আমি পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের বিষয়টি তুলে আনি। আমি তাদের পক্ষে দাঁড়াই। তাদের আটকে রাখার কোনো যুক্তি নেই। আমরা যুদ্ধে জিতে গেছি, বন্দিরা এখন তাদের বাড়ি ফিরে যেতে পারে। এতে মিসেস গান্ধী খুব গোসা হলেন। তিনি আমাকে দিল্লিতে ডাকলেন। আমার প্রতি তিনি কোমলই ছিলেন, যতদিন না মানেকা (মানেকা গান্ধী, সঞ্জয়ের স্ত্রী) আমাদের সম্পর্কটি নষ্ট করে দেন।
তিনি বললেন, ‘আপনি রাজনীতির কিছুই বোঝেন না।’ আমি বললাম, ‘মিসেস গান্ধী, আমি রাজনীতির কিছুই জানি না, কিন্তু আমি নৈতিকতা সম্পর্কে জানি। নৈতিকভাবে যা ভুল তা রাজনৈতিকভাবে শুদ্ধ হতে পারে না।’ তিনি আমার দিকে ওপরে-নিচে তাকিয়ে বললেন, ‘আমাকে লেকচার শোনানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।’
যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির ব্যাপারে আমার প্রচেষ্টা পাকিস্তানিরা পছন্দ করল। আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওখান থেকে লেখা অনেক চিঠি আমি পেয়েছি। অফিসার ও সৈনিক যে-যুদ্ধবন্দির সঙ্গে আমি কথা বলেছি, আমি তার ঠিকানাই নিয়েছি। বোম্বেতে ফিরে গিয়ে আমি তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে চিঠি লিখেছি – আপনার ছেলের সঙ্গে আমি দেখা করেছি। তার শরীর ভালো, দুশ্চিন্তা করবেন না। তাদের ছেলের ভাগ্যে কী ঘটেছে এ-সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। আমি আমার নিজের গ্রামেও চিঠি লিখেছি। বলেছি, আমার সঙ্গে ছেলেদের দেখা হয়েছে। তাদের শরীর ও স্বাস্থ্য ভালো। এতে দুদিকেই কাজ হয়েছে।
** ভালো গল্পের জন্য আপনার যে-আগ্রহ, তা সাধারণ সাংবাদিকের চেয়ে অনেক বেশি, তাই না?
* হ্যাঁ, বলতে পারেন, আমি একাই পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের আটকে রাখার বিরুদ্ধে লড়েছি। আসলে মুজিবুর রহমানের চাপে মিসেস গান্ধী তাদের ধরে রেখেছিলেন। তিনি তো অবশ্যই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং মুজিব কী চাচ্ছেন তাও স্পষ্ট। ওরা আগে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিক, তারপর যুদ্ধবন্দিরা মুক্ত হবে। শেষ পর্যন্ত আমরা তাই করেছি।
** ইলাসট্রেটেড উইকলির দশ বছরের সবচেয়ে স্মরণীয় কি? – যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে সেসব মানুষ, আপনি যে-ক্ষমতা খাটিয়েছেন কিংবা জনউদ্বেগে আপনার মতামতের প্রভাব?
* আমার বেলায় সারাদেশে ম্যাগাজিনটির প্রচারসংখ্যার বিস্ময়কর বৃদ্ধি। একটি পৃষ্ঠা আমি অবশ্য নিজের জন্য রেখে দিয়েছিলাম – আমার ‘ম্যালাইস’ কলাম।
** ম্যাগাজিনে কোথাও আপনার ছবি ছাপা হতো না, কেন?
* আমি কখনো তা করতে দিইনি। আমার পূর্বসূরি রমণ ধর্ম পালন করতেন, সত্য-সাঁই বাবা, আরো কী সব বিষয়ে তার আগ্রহ ছিল। একটি সংখ্যায় তাঁর ও তাঁর পরিবারের আটটি ছবি ছাপা হয়েছে। তাঁরা বাবার পা ছুঁয়ে প্রণাম করছেন। সেজন্য আমি আদেশ দিলাম ম্যাগাজিনে কোথাও যেন আমার ছবি ছাপা না হয়। প্রকৃতি নিয়ে তথ্যবহুল বিষয় জানাতে আমি কলামটি লিখতে শুরু করলাম। এখানে-ওখানে শোনা গালগপ্পোও এতে ঢুকিয়ে দিতে শুরু করলাম। অনেক চিত্রতারকার সঙ্গে আমার জানাশোনা ছিল, বিশেষ করে ভয়ংকর গল্পবাজ আই এস জোহরের সঙ্গে। আমি নিয়মিত তাঁর কাছে যেতাম। কেলেঙ্কারিতে-ভরা এমনসব গল্প তিনি আমাকে শোনাতেন, তাতে আমার সন্ধ্যাটা সমৃদ্ধ হতো; কিন্তু এসব ছাপাতে পারতাম না। কেমন করে সিমির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক হলো; তাঁর বোনের সঙ্গে, তাঁর মায়ের সঙ্গে – এসব ছাপার লোভ আমি সংবরণ করতাম।
খোলামেলাভাবেই বলছি, হিন্দি ছায়াছবি দেখার মতো ধৈর্য আমার নেই। এগুলো অবাস্তব আর অভিনয়ে বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি। আমি যে-কটা ছবি দেখতে গেছি, রাজকাপুরের সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্ তার মধ্যে একটি। আমি দশ মিনিট পর বেরিয়ে এসেছি; কিন্তু আমার সঙ্গে যা রয়ে যায় তা হচ্ছে রাজকাপুরের সহাস্য সজোর জিজ্ঞাসা : আমার পছন্দ নায়িকার বক্ষদেশ, তোমার কোনটা?
** অধিকাংশ রাজনীতিবিদ এবং সহকর্মী যে মনে করতেন আপনি রাজনীতির কিছুই বোঝেন না, তাঁদের এ-ধারণা আপনাকে বিচলিত করত না?
* না, বরং আমি নিজেকে আরো বড় অনুভব করতাম। আমি রাজনীতি নিয়ে যা লিখি তা সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত মনে করতাম। অন্যরা যা-ই বলুক, আমার রাজনৈতিক মতামত নিয়ে আমি প্রত্যয়ী ছিলাম। বরং আমি এটাকে অন্যভাবে দেখি; অধিকাংশ রাজনীতিবিদকেই আকৃষ্ট করার মতো বলে আমার মনে হয় না। তাঁরা কেবল নিজের কথা বলেন। এর বাইরে তাঁদের কোনো কথা নেই।
** সম্পাদক হিসেবে ম্যাগাজিনে রাজনীতি বিষয়ে লেখার নির্দেশনা কেমন করে দেন?
* আমি ফরমায়েশ দিয়ে লেখাই। যেমন আমি শুরু থেকেই ইসরায়েলের পক্ষাবলম্বন করে চলেছি। আমার পত্রিকার কুররাতুল আইন হায়দার মুসলমান এবং প্যালেস্টাইনের ব্যাপারে খুব আবেগপ্রবণ। আমি তাঁকে বলি, তাঁদের যুক্তিগুলো লিখে নিন। আমি তা প্রকাশ করেছি – ইসরায়েল কেমন করে আমেরিকায় গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে – এ-ধরনের বিষয় নিয়ে লেখালেখি হয়েছে।
** আপনি মনে করতেন ইলাসট্রেটেড উইকলির চিঠিপত্র বিভাগটি সবচেয়ে বড় আকর্ষণ?
* হ্যাঁ, আমার বিরুদ্ধে যা-ই লেখা হোক, আমি তা ছাপিয়ে দিতাম; এমনকি আমাকে খুশামৎ সিংহ নামে ডাকাও ছেপেছি।
** যে-ম্যাগাজিনটিকে আপনি এত উঁচুতে নিয়ে গেলেন, আপনি চলে আসার পর বদনাম নিয়ে এর পতন ঘটল – এতে আপনার কী মনে হয়েছে?
* আমি ভালো করেছি যে আমি কষ্ট পেয়েছি, আসলে আমি আনন্দিতই হয়েছি। আমি নিজেকে শোনাই : সম্পাদক যেভাবে চান, সেভাবে চলতে না দিলে তাদের (জৈন) উচিত শিক্ষা হবে। কিন্তু তারা এ-নিয়ে বিচলিত হয়নি। পত্রিকাটি বন্ধ করে দিয়েছে।
** আপনার উত্তরসূরিরা কি ভুল করেছে বলে আপনি মনে করেন?
* ম্যাগাজিন কীভাবে চালাতে হয় তাঁরা তা জানতেন না। এই ভুলটি সম্পাদকরা এখনো করে থাকেন। বিশেষ করে ম্যাগাজিন সাংবাদিকতার উত্তরসূরিকে তৈরি করে না। দৈনিক কাগজের বেলায় এতে কিছু এসে-যায় না – টাইমস অব ইন্ডিয়া তা প্রমাণ করেছে।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদক কে আমি জানি না। কিন্তু ম্যাগাজিনে সম্পাদক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাঁর হাতেই এটা গড়ে ওঠে। শুধু ফরমায়েশি রচনা জোগাড় করা নয়, ভাবনা ও পরিকল্পনা করাসহ এতে তাঁকে বিশেষভাবে শ্রম দিতে হয়। যেমন, আমি মনে করি বিনোদ মেহতা আউটলুক পত্রিকাটিকে গড়ে তুলতে পেরেছেন তাঁর লিখতে পারার যোগ্যতার কারণেই। এই সামর্থ্য – বিরুদ্ধবাদী যে-কোনো কিছু ছাপতে পারার সাহস – তিনি আমার কাছ থেকে পেয়েছেন। এমন হলে কেউ পক্ষপাতিত্বের দোষ দিতে পারবে না। অন্যদিকে ইন্ডিয়া টুডে কেবল নিজেদের লেখার প্রশংসাসূচক চিঠিপত্রগুলো ছাপে – এটা ঠিক নয়।
আমার সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে আমি আরজিকের (আর গোপাল কৃষ্ণান) নাম বলেছিলাম। অবসরগ্রহণের আগে পর্যন্ত তিনি ইলাসট্রেটেড উইকলিতেই ছিলেন। লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা অত্যন্ত জ্ঞানবান মানুষ তিনি। তিনি পত্রিকায় জ্যেষ্ঠতায় দুই নম্বরে। কিন্তু তিনি যে সম্পাদক হতে পারেননি এ নিয়ে তাঁর কোনো খেদ নেই। আমি তাঁকে সবচেয়ে বেশি সম্মান করতাম তাঁর যোগ্যতার জন্য। কিন্তু মালিকরা ভাবল, আমার মতো বর্ণাঢ্য একজন সম্পাদকের পর তাঁর মতো একজন অন্তরালবর্তী মানুষকে বেছে নেওয়া ঠিক হবে না। আমার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য আমি তাঁকে তৈরি করতে চেষ্টা করেছি। আমার সন্দেহ নেই, তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজটুকুই ম্যাগাজিনের জন্য দিতেন। কিন্তু তাঁরা ওয়াশিংটন থেকে কামাথকে বেছে নিলেন। তিনি ডুবিয়েছেন। তাঁর নিজের জীবন নিয়ে তিনি লাগাতার নিবন্ধ লিখে যেতে থাকলেন। আমি একবার তাঁকে এভাবে বর্ণনা করলাম : ‘তারা অবয়বহীন একজন সম্পাদক চেয়েছিলেন, তা এখন পেয়ে গেছেন।’ এতে তিনি মনে কষ্ট পেয়েছেন এবং ক’মাস এদিক-সেদিক গিয়ে নিজেকে পরিচিত করিয়েছেন – ‘আমি ইলাসট্রেটেড উইকলির একজন অবয়বহীন সম্পাদক।’ তারপর আমার মনে হয় খান্না দায়িত্ব পান, তিনি এটা চাননি। তিনি ওখানে সহকারী সম্পাদক ছিলেন। শুনেছি তিনি একটি দস্যুতার মামলায় নিহত হন।
তারপর এলেন প্রীতিশ নন্দী। তিনি খুব ঘটা করে আরম্ভ করলেন, খালিস্তানি অনুসন্ধান শুরু করলেন – যুক্তরাষ্ট্রে কোথায় তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অন্য কোনো কাগজ বের করতে পারেনি এমন কিছু তথ্য অনুসন্ধান করে বের করার মতো উজ্জ্বল ঘটনা ঘটেছে – এমনকি প্রশিক্ষণ-শিবির পর্যন্ত গিয়েছেন; কিন্তু তাঁর দূরদৃষ্টি ছিল খুবই সীমাবদ্ধ। সে-সময়ে অন্য পত্রিকার আগেই তিনি একটি-দুটি কাহিনি ছেপে বাহবা পেয়েছেন। এমনকি আমাকেও তাঁর জন্য লিখতে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি আমার বাড়ি এসে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে লেখা চেয়েছেন, আমি রাজি হয়েছি। তাঁর জন্য একটি কি দুটো নিবন্ধ লিখেছি। কিন্তু তিনি বড্ড পিচ্ছিল ধরনের চরিত্র। একবার ব্যাঙ্গালোরে অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়। তিনি তখন তাঁর দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় স্ত্রীর সঙ্গে – তিনি কতবার বিয়ে করেছেন আমার ঠিক জানা নেই। আমরা অনানুষ্ঠানিকভাবে কথা বললাম। পুরোটাকে তিনি ফিরে গিয়ে একটি সাক্ষাৎকারের মতো করে ছেপে দিলেন। আমি খুব বিব্রত হলাম। কারণ আমি অনেক বিষয়ে সরলমনে তাঁকে কিছু কথা বলেছিলাম, তা ছেপে দিয়েছেন। কী নিয়ে বলেছিলাম এখন মনে নেই। তবে আমি মনে করি তিনি বিশ্বাসভঙ্গ করেছেন। প্রীতিশ নন্দী সম্পর্কে আমার অত্যন্ত নিচু ধারণা ছিল, এখনো তাই। তিনি উদ্যোগী নাছোড়বান্দা ধরনের মানুষ, টাকা বানাতে ওস্তাদ। তাঁর নামে বরাদ্দ করা বাড়ির দখল ছাড়তে অস্বীকার করেন। আমার ধারণা, তিনি এখনো আম্বানির ফ্ল্যাটে কিংবা ওরকম কিছু একটাতেই থাকেন – টাকার জন্য তাঁর চূড়ান্ত ক্ষুধা। সম্পাদক হিসেবে যদি নিজের সম্পর্কে আপনার খুব উঁচু ধারণা থাকে, তাহলে বুঝতে হবে আপনি পতনের দিকে এগোচ্ছেন। একইভাবে নিজের সামর্থ্য নিয়ে যদি উঁচু ধারণা থাকে, পরিণতি একই। বরং বলুন, এটা আসলে আমি করিনি, আমার এর বেশি করার ক্ষমতা নেই – এ-ধরনের অভিব্যক্তিই উত্তম।
** ইলাসট্রেটেড উইকলি ছেড়ে যাওয়ার পর আপনি কী করলেন?
* শেষ দু-তিন মাস আমি ঝুলে রইলাম। এক সকালে তারা আমাকে একটি কড়া চিঠি দিলো। আমি আমার ছাতা হাতে তুলে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। বাড়ি ফিরে আমার উপন্যাস দিল্লি লিখতে বসে গেলাম। আমি সারা বিকেল কাজ করতাম। কাউকে পাত্তাই দিইনি। এর মধ্যে কয়েকটি প্রস্তাব এলো, যেমন ফ্রি প্রেস জার্নাল দ্বিগুণ বেতন দিয়ে আমাকে নিতে চাইল; কিন্তু আমি তখন বোম্বে ছেড়ে দিল্লি চলে যেতে যাচ্ছি। সেখানে প্রথম প্রস্তাব দিলেন মিসেস গান্ধী। ন্যাশনাল হেরাল্ড সম্পাদনা করতে হবে। এর কোনো সম্পাদক ছিল না। কদাচিৎ প্রকাশিত হতো। খুবই ঋণগ্রস্ত অবস্থায় ছিল। যশপাল কাপুর এর দেখাশোনা করতেন। তিনি আমার কাছে এসে বড় বেতন প্রস্তাব করলেন। আমি তখনই জানি, এ-টাকা ওরা দিতে পারবে না। কাজেই আমি বললাম, আমার কোনো বেতন লাগবে না। তার বদলে স্টাফদের নিয়মিত বেতন দেবেন। স্টাফরা নিয়মিত বেতন পাচ্ছিল না। আমি যে ছয় মাস ছিলাম, তখনো বেতন পায়নি। কাগজ বের হয়নি। কয়েকদিন পরপরই পুলিশ এসেছে। তারা কখনো আমার রুমে আসেনি। কাজেই অফিস যে অবরোধ করা হয়েছে, অনেক সময় আমি টেরও পেতাম না। শেষ পর্যন্ত আমি বলতে বাধ্য হলাম – যে-পত্রিকা তিন দিনে অন্তত একবার বের হয় না, আমি তা সম্পাদনা করতে পারব না।
মিসেস গান্ধী যখন ক্ষমতায় এলেন আমাকে হিন্দুস্তান টাইমসে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হলো। প্রস্তাব তিনি দেননি। প্রস্তাব নিয়ে এসেছে, তাঁর দূত সঞ্জয় গান্ধী : আপনি যুক্তরাজ্যে হাইকমিশনার কিংবা অন্য কোনো দেশে রাষ্ট্রদূত হতে চান, না রাজ্যসভার সদস্য ও হিন্দুস্তান টাইমসের সম্পাদক হতে চান? আমি পরেরটা পছন্দ করলাম। আমি সাংবাদিকতার সঙ্গে থাকতে চাইলাম। আমার নিয়মিত লেখা কখনো কখনো বাধাগ্রস্ত হলো। অর্মতবর্তীকালে আমি অভীক সরকারের হয়ে নিউ দিল্লি ম্যাগাজিন সম্পাদনা করলাম। তারা সব সময়েই খুব সহায়ক ও উদার ছিলেন; কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। কারণ ম্যাগাজিনটি প্রথম কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় এবং সেখানে লাগাতার ধর্মঘট চলছিল। তারপর প্রকাশিত হয় মাদ্রাজ (চেন্নাই) থেকে – পাক্ষিকের বদলে মাসিক। এটা খুব হতাশাব্যঞ্জক, আমি ছেড়ে দিলাম।
আমার ধারণা হিন্দুস্তান টাইমসে বিড়লা আমাকে নিয়ে সুখেই ছিলেন। দু-একবার মিসেস গান্ধীর অফিস থেকে আমার কাছে বার্তা এসেছে – আমার কী করা উচিত, কী করা অনুচিত। আমি এসব উপেক্ষা করেছি। বলেছি, আপনারা হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। আমার বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিন। একবারও আমার মুখ ফুটে বলতে হয়নি, বিড়লারা আমার বেতন বাড়িয়ে দিলেন। এটা খুব সম্মানজনক চাকরি; কিন্তু দৈনিক পত্রিকায় আমি খুব স্বস্তিবোধ করছিলাম না। নিজের লেখালেখি ছাড়া তেমন কিছুই করার ছিল না – সেসব লেখা পড়ার ঠেকা কার? আমি আমার সাপ্তাহিক কলামেই লেগে রইলাম এবং এই পত্রিকায় স্থানান্তর করলাম। তা লোকজনের কাছে সুখপাঠ্য হয়ে রইল। একসময় শনিবারের হিন্দুস্তান টাইমসের প্রচারসংখ্যা অন্যদিনের চেয়ে কুড়ি হাজার বেড়ে গেল – সেদিন আমার কলাম ছাপা হতো। তাতে আমি বেশ তৃপ্তি পেয়েছি।
কদাচিৎ একটি-দুটি নিবন্ধ ছাপা ছাড়া দৈনিক পত্রিকায় সম্পাদকের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটানোর পরিসর বড় কম। ম্যাগাজিনে কাজ করার সময়কার পুরনো অভ্যাস অনুযায়ী কয়েকটি নিবন্ধ লিখেছি। সম্পাদকীয় পাতায় ছাপা হয়েছে। প্রথম পাতা আমি কখনো দখল করিনি। অনেক সম্পাদক বেহিসেবির মতো তা করে থাকেন – যেন তাঁরা এক ধরনের ত্রাণকর্তা। একটা উদাহরণ দিই, ‘ফুলন দেবী’র ওপর আমি নিজেই লিখেছিলাম, আমি তার গ্রাম বেহমাইয়ে গিয়েছিলাম, দু-তিনদিন থেকে তার পরিবারের সদস্য ও সাবেক প্রেমিকের সঙ্গে কথা বলেছি। পুলিশের রেকর্ড ঘেঁটেছি। এটা এক ধরনের অভিযান। অবিশ্বাস্য প্রাচ্যদেশীয় গল্পের মতো।
** বিবিসি আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে, কাহিনিকে রসালো করতে আপনি এর সঙ্গে যৌনতার মিশেল দেন। আপনার বক্তব্য কী?
* এটা তো খোলামেলাভাবেই করা হয়েছে। যেমন আমার ভালো কাজগুলোর একটি হচ্ছে ফুলন দেবীর প্রোফাইল রচনা। আর এই ফুলন দেবী আট কি নয়জন পুরুষের মিসট্রেস হিসেবে দিন কাটিয়েছে। যতক্ষণ ফুলন এদের মধ্যে একজনকে অন্যজনের চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করেছে, তার কাছে সবারই সমান প্রবেশাধিকার। কুড়ি থেকে তিরিশের প্রথমদিকে যাদের বয়স, সেসব কামুক ছজন-আটজন যদি প্রতিরাতে তাকে ভোগ করতে চায়, লেখায় তা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় কী? অন্য আরেকজন মেয়েমানুষ না পাওয়া পর্যন্ত তাকেই নিত্যকার ভোগের শিকার হতে হয়েছে। তারপর এ দুজন আবার নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে মেতে উঠেছে। আমি তার কথিত স্বামী ও একজন প্রেমিকের সঙ্গে কথা বলেছি। দুজনই গ্রামে থাকত। তাদের একজনকে সে কেমন করে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলল, সে-কাহিনি শুনিয়েছে। গঙ্গায় পুরোপুরি নির্বসন হয়ে নাইতে নেমে নগ্ন অবস্থায় উঠে এসে তাদের একজনের কাছে সাবান চায়। সাবানে নিজেকে ঘষতে থাকে, বেচারা আর কী করবে, সেও জেগে ওঠে। এসব সত্যি কাহিনি আমি নিজ কানে ছেলেদের কাছে শুনে এসেছি। তারপর এই বিবাহিত মানুষটি ফুলনকে নিয়ে লখনউ যায়, উকিলকে বলে তাদের বিয়ের বন্দোবস্ত করতে। উকিল তাদের হাতে একটি চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বলে, যাও তোমাদের বিয়ে হয়ে গেছে। খবর পেয়ে ফুলনের প্রেমিকের স্ত্রী ছুটে এসে গ্রামের সবার সামনে তাকে গালমন্দ করে এবং চপ্পল দিয়ে আঘাত করতে থাকে। গালাগালিতে ফুলন দেবীরও পাকা মুখ। পুলিশের ডিআইজি তাকে গ্রেফতারের হুমকি দিয়েছিল। তাকে হিন্দিতে লেখা ফুলনের ভয়ংকর নোংরা গালাগালে ভরা একটি চিঠি আমি দেখেছি – ফুলনের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। তার প্রেমিকদের কাছ থেকে এসব আমার শোনা। ফুলনের সুশ্রী বোনটি প্রথমে আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়নি, একশ টাকা দেওয়ার পর মুখ খোলে।
** আপনি সবসময় রসিকতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন, তাই নয় কি?
* আমি স্বীকার করছি। রসিকতাকে মারাত্মক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কাউকে হাসির পাত্রে পরিণত করে তাকে একেবারে ধ্বংস করে ফেলা যায়; কিন্তু অধিকাংশ সাংবাদিকই তা করেন না। তারা রেগে যান, তাতে কোনো কিছু অর্জন করা যায় না।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.