বাংলা কাব্য-রূপান্তর : অসীম  সাহা

তৃতীয় পর্ব

পঞ্চম সর্গ

কৃষ্ণ বলে, শোনো দূতি, আমার বচন।

রাধাকে আনিতে আজ করো হে গমন ॥

এই কুঞ্জবনমাঝে আমার যে বাস।

রাধা এনে পূর্ণ করো মোর অভিলাষ ॥

আমার মিনতি গিয়ে বলো রাধিকারে।

পূর্বাবস্থা জানাইও, কানে দিও তারে ॥

রাধার বিরহে মোর প্রাণ নাহি রয়।

রাধা ছাড়া জীবনের হলো যে সংশয় ॥

এই প্রাণ রক্ষা করো, দ্রুত তুমি যাও।

কোনোভাবে তাকে এনে আমাতে মিলাও ॥

এমন কাতর কথা শুনে ফের দূতি।

রাধিকার কাছে গেলো ছুটে দ্রুত অতি ॥

করজোড়ে রাধিকারে বলিলো বচন।

কৃষ্ণের বিরহ-দুঃখ – বলি বিবরণ ॥

গীত

রাগ : দেশবরাড়ী ॥ তাল : রূপক

          রাধা-কৃষ্ণের বিরহে মিলন।

তোমার হাতের মালা        গলাতে পরিলো কালা

          তাতে তার শান্ত হলো মন ॥

হিমেল বাতাস বয় তাহাতেই তৃপ্ত হয়

          মন্মথ করিয়া সংহতি।

মনে অনুমান করে বিরহে সে মারে ওরে

          ফুলশয্যা কুটিল সম্প্রতি ॥

শীতল চাঁদের আলো         সর্বদা পুড়িয়ে কালো

          পড়ে খুবই মূর্ছিত হয়ে।

নিতম্বের কামশরে মন তার দগ্ধ করে

          বিলাপ করে ব্যর্থতা লয়ে ॥

শুনে মৌমাছির গান          ঢেকে রাখে দুই কান

          দুই হাতে করে সে যতন।

বিশেষত খুব রাতে কামরোগ বাড়ে তাতে

          বিরহেতে ব্যাকুল যে মন ॥

তোমার করিয়া নাম         আর্তনাদ অবিরাম 

          গড়াগড়ি যায় পৃথিবীতে।

ত্যাগ করে গৃহ-আশ         অরণ্যে করছে বাস

          একটুও পারে না রহিতে ॥

করে তাকে অনুরাগ         বিষয় করিয়া ভাগ

          ওষ্ঠসুধা শুধু তার চায়।

কবি জয়দেব কয়  দেরি তো উচিত নয়

          ইচ্ছা পূর্ণ করো তুমি তায় ॥

আগে যে নিকুঞ্জবনে তোমার সহিত।

কামের সকল জ্বালা – করে সে বিহিত ॥

সেই কুঞ্জে মন্মথ, মহাতীর্থমাঝে।

পুনরায় সেথা থেকে সেই মহারাজে ॥

নিরন্তর করে কৃষ্ণ তোকে নিয়ে ধ্যান।

তোমার প্রলাপমন্ত্রে দেয় শুধু জ্ঞান ॥

সেই মন্ত্র উচ্চারণ করে পুনর্বার।

ইচ্ছা প্রকাশ করে করো এর বিচার ॥

তার দুই স্তনে তুমি দিয়ে আলিঙ্গন।

পাও তুমি মনে তৃপ্তি শুধু সারাক্ষণ ॥

এরকম ধ্যান করে তুমি দিনরাত।

তপস্যা করো হে হরি রাত ও প্রভাত ॥

গীত

রাগ : গুজ্জরী ॥ তাল : একতাল

                 অরণ্যে রাধিকা সাজে ফুলের সাজ।

যমুনার তীরে ধীরে বয় বায়ু, তাহাতে বসিয়া যুবরাজ ॥

করে অভিসার, করে সম্ভোগ, কামুক অত্যন্ত সুন্দর বেশে।

যেতে আর দেরি করো না রাধিকা, চলো যাই প্রাণনাথে শেষে॥

কৃষ্ণ ইঙ্গিতে বাজায় বাঁশি তোর নাম করে খুব মৃদু সুরে।

তোমার শরীর স্পর্শ করে প্রশংসাবাণীর ধুলো শুধু উড়ে ॥

উড়লে পাখি, বৃক্ষসমূহ বিচলিত হয়ে তার আগমন মানে।

শয্যা থেকে দ্রুত উঠে এসে ফের চেয়ে থাকে তার পথপানে ॥

সুদূরে নূপুরের শব্দ অধীর, সাথে চলে কানুরতিরঙ্গে।

অতীতস্মৃতির কুঞ্জবনে চলো, কেন নীল বাস নেই অঙ্গে ॥

তোর উপহার কৃষ্ণের দেহে যেন মেঘের মতো ওড়ে জানি।

উল্টো রমণে কৃষ্ণ যেন ওড়ে সজ্জিত মেঘে সাজে সৌদামিনী॥

অভিমানে ছেড়ে যাবে বন, রাতের আঁধার হলে প্রকাশ।

কথা শুনে যাও তুমি দ্রুত, পুরাও কানুর সব অভিলাষ ॥

আকাশ ছেড়ে নিজের নূপুর বাজালে, জঘন নাচবে রঙ্গে।

নতুন মুকুলে যেন সুন্দরী ঘটনা ঘটায় কৃষ্ণের অঙ্গে ॥

ত্যাগ করে সব দুঃখ-কষ্ট, হৃদয় বাড়িয়ে করো অভিসার।

জয়দেবের কথা শুনে রাধা গিরিধারী সাথে করো বিহার ॥

               শোনো রাধা, কৃষ্ণে তুমি হয়ো না বিমুখ।

               প্রিয় কৃষ্ণে কেন তুমি দাও তবু দুখ্ ॥

               অনেক বিরহে আকুল রয়েছে হরি।

               ভাবতে ভাবতে হৃদয় গিয়েছে ভরি ॥

               মিলন-আশায় বসে থাকে নিরজনে।

               রাধা-আগমন, কৃষ্ণ ভাবে মনে মনে ॥

               তার আগমন-আশায় আশায় থাকে।

               না আসায় শুধু দীর্ঘশ্বাসে মারে তাকে ॥

               রাধা আসে বলে হয়ে যায় চমকিত।

               বারবার কুঞ্জে খুঁজে হয় সে ব্যথিত ॥

               এমন ভাবিয়া অন্য পথ নিজে বাঁধে।

               তোমাকে না দেখে আকুলতা নিয়ে কাঁদে ॥

               আসা তো হলো না – নাকি গুরুজনে ভয়?

               ‘হা রাধা’ বলিয়া অতি গ্লানি তার হয় ॥

               নতুন ফুলের শয্যা করিয়া আবার।

               আকুল হইয়া সে যে রূপ দেখে তার ॥

               মনে পড়ে, তীব্র প্রেমে আছে তার সাথে।

               ফাঁকি দিয়ে গুরুজনে মিলিবে পশ্চাতে ॥

               চুপে থাকে, যদি তার মন জানা যায়।

              এই ভেবে চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়ায় ॥

              তোমার জন্যে কৃষ্ণ বিষাদ নিয়ে মনে।

              কামের তৃষ্ণায় থাকে বিষণ্ন বদনে ॥

              এতো দুঃখে দয়া নাই তোমার অন্তরে।

              সব ত্যাগ করে তুমি এসো তাঁর ঘরে ॥

              কিসের আনন্দে থাকো, বোঝা নাহি যায়।

              বড়ই নিষ্ঠুর তুমি, দয়াহীন হায় ॥

              লোকে বলে, একা একা সূর্য অস্ত গেলো।

              তোমার কুটিল মন, জানতে সে পেলো ॥

              কৃষ্ণের কাম জাগে তোমাকে পাওয়ার।

              গভীর আঁধার নামে, হায় কী আঁধার ॥

              যেন রাজহংসী তাঁকে করিতেছে দয়া।

              আমি তার বেশি চাই, নাই কী রে মায়া ॥

              কী কাজে ব্যস্ত তুমি, দেরি কেন তোমার।

              সকল ব্যর্থ হবে দেরি করলে আর ॥

              হয় কি এমন করে প্রিয় অভিসার।

              মানুষ জানে না, তার কেমন আকার ॥

              একা একা বসে আছি, মনে আছে ভয়।

              অত্যন্ত নিষ্ঠুর তুমি, তাও জানা হয় ॥

              এই অন্ধকার সখি দেখিনি তো আগে।

              বোঝেনি থাকতে কাছে কেউ আগে-ভাগে ॥

              এমন আঁধারে যদি করো অভিসার।

              মানুষ জানে না তার কেমন আকার ॥

              অদ্ভুত কথা শোনো, তোমার ও-মাথাতে

              শৃঙ্গার করিয়া তুমি লজ্জা পাও তাতে ॥

             ইঙ্গিত করিলো সখি যুবকের মনে।

             সেই কাজ করে ফেলে ওরা দুইজনে ॥

              যার স্ত্রীর প্রতি যার ইঙ্গিত রহিলো।

          তার নারী পতিসঙ্গে তেমন করিলো ॥

         অন্যের কারণে দেখা আর অন্যজনে।

             এই অন্ধকারে ভুল হইলো মিলনে ॥

             ভুলে যেন স্বামীসাথে মেলে অন্য কেউ।

             উপপতি ভেবে কামে মনে ওঠে ঢেউ ॥

             আলিঙ্গনে-চুম্বনে, নখেরও আঘাতে।

             কামের প্রকাশ হলো এরকম তাতে ॥

             রমণ করতে নিজ কথা গেলো ভুলে।

             তখন বুঝতে পারে ভিন্ন স্বামী বলে ॥

             এই দুই দম্পতি থাকেন অন্ধকারে।

             লজ্জায় রসবতি হইলো সে শৃঙ্গারে ॥

             কৃষ্ণের মিলন পাছে হয় কারো সাথে।

             এই ভেবে শৃঙ্গারে সে আরো বেশি মাতে ॥

             এই অন্ধকারে সখি, নেই তো বিশ্বাস।

             দেরি হলে অবশ্যই হইবে হতাশ ॥

             প্রয়াস চালিয়ে তোকে পাঠাইলো নিতে।

             এতোটা নিঠুর কেন, পারি না বুঝিতে ॥

             কেন যে গতকাল করিলে চিৎকার।

             ত্যাগ করো তেজমূর্তি, দেরি নয় আর ॥

             এই অন্ধকারে তুমি, যাও যেইখানে।

             ধীরে ধীরে পা ফেলিয়া যেও সাবধানে ॥

             উল্লসিত দেহে তুমি অন্য স্থানে গেলে।

             বিশ্রাম নিয়ে নিও থাকার স্থান পেলে ॥

             কী কথা বলি রাধা, কোথা’ তোমায় পাবো।

             এই রূপে তোমায় দেখে কৃতার্থ হবো ॥

             অতএব যাও তুমি, ত্যাগ করো রোষ।

             না গিয়ে দুঃখ পেলে নেই আমার দোষ ॥

        ষষ্ঠ সর্গ

             এরই ভেতরে এক চতুর দূতিকা।

             পুনরায় বনে গিয়া দেখিলো রাধিকা ॥

             সেই দূতি বহুদিন কৃষ্ণে অনুরক্ত।

             কৃষ্ণের কাছে গিয়া হইলো সে আসক্ত ॥

             ভাবনা করিলো রাধা, লতাঘেরা ঘরে।

             কী করে মিলন হবে কৃষ্ণসখাতরে ॥

             আমার এ-প্রাণ কেন অন্য নারীর হয়।

             পদ্মচোখ নিয়ে কানু কাড়ে এ-হৃদয় ॥

             মোর প্রতি এ-কেমন নিষ্ঠুরতা তার।

             হৃদয়ে বাড়িয়ে প্রেম হয়ে গেলো কার ॥

             এমন বিলাপ করে রাধিকা নির্জনে।

             দূতিকে সে বলে সব মধুর বচনে ॥

             শোনো শোনো শোনো সখি, রাখো মোর প্রাণ।

             কৃষ্ণকে এনে সখি আমায় করো দান ॥

             এমন করুণ কথা শুনিয়া, রাধার।

             কৃষ্ণের নিকটে দূতি গেলো পুনর্বার ॥

             গোবিন্দ দেখিলো গিয়া অত্যন্ত গহনে।

             উৎসাহ নাই কানুর কামবিহনে ॥

             রাধিকার জন্যে যার ছিলো অনুরাগ।

             রাধা গুণগান গেয়ে মনে দিতো দাগ ॥

             সেই কৃষ্ণে গিয়ে দূতি দেয় বিবরণ।

             রাধার বিলাপগাঁধা করে সে বর্ণন ॥

গীত

রাগ : গোড়াকিরি । তাল : রূপক

             ও হে নাথ, শোনো তুমি রাধিকার দুখ্।

নিজঘরে নতুন পাতার তলে বসে আছে বিষণ্ন সে-মুখ ॥

সেই চন্দ্রমুখ যেন তার মিষ্টি মধু রতিসম করে পান ।

তেমনি তোমার চাই সবকিছু, করিয়া নিভৃতে একা ধ্যান ॥

কাম-বিহ্বল হয়ে তোমার নিকটে যেতে যখনি আমি চাই।

দুই-চার পা-ও হেঁটে গেলে পর আমি আনমনা হয়ে যাই ॥

পদ্মের পাপড়ি কাঁকন করিয়া অঙ্গের তাপ করে সে নাশ।

অন্তরের তাপ বিনাশ করিয়া দ্রুত পূর্ণ করি মোর আশ ॥ 

মনে মনে সে যে তোমার শৃঙ্গার ভালো করে দেখে দূর থেকে।

তোমাকে নিজের মতো করে ভাবে, নিজের ভেতরে ছবি এঁকে॥

অভিসার করিলো না কেন দ্রুত আমার প্রাণের প্রিয় নাথ।

সখিকে বারবার বলে, কানু ছাড়া কিছুতে কাটে না এ – রাত॥

মেঘের মতো নিবিড় আঁধারে, দেখি আমি প্রিয় সে-নিতম্বিনী।

আলিঙ্গনে কৃষ্ণ করিয়া চুম্বন, এসেছে তাহাও আমি জানি ॥ 

তুমি দেরি করে যাচ্ছো দেখে, আমি যত লজ্জা ফেলে দিয়ে সব।

বিলাপ করে কেঁদে কেঁদে আমি ক্রমশ হই একেবারে শব ॥

জয়দেব বলে, শোনো, যদি তুমি রাধার সাথে মিলন চাও।

কৃষ্ণ, রাধার বিরহ-বেদনা যেভাবে পারো দূর করে দাও॥

পঞ্চবাণে দগ্ধ হদয় রাধার, রোমাঞ্চিত হয় সারা দেহ।

তুমিহীন কানাই শীৎকার করে, তাতে নাই কোনো সন্দেহ ॥

            অন্তরের জড়িমাতে হইলো বিকার।

            ব্যাকুল হইয়া বনে করিলো বিহার ॥

            বিষণ্ন হইলো রাধা কামনার জ্বরে।

            নিমগ্ন হইলো সে যে স্পর্শসুধাতরে ॥

            সর্বদা তোমার ধ্যানে সমর্পিত রেখে।

            রাধিকার প্রাণ যায় একেবারে বেঁকে ॥

            তোমার জন্যে রাধার এতো দুঃখ হয়।

            তোমার ধূর্ততা তার প্রাণে নাহি সয় ॥

            তোমার সঙ্গমসুখ কখন সে পাবে।

            তোমার লাগিয়া রাধা সারাক্ষণ ভাবে ॥

            কৃষ্ণ এলে তবে মোর হবে রে মিলন।

            সেই ভেবে দেহে পরে যতো আভরণ ॥

            বৃক্ষের পাতা যদি ঝরে পড়ে তাতে।

            কানাই আসিবে বলে দ্রুত শয্যা পাতে ॥

            এই ক্ষণে কৃষ্ণ এসে করিবে শয়ন।

            সেই জন্যে ফুলশয্যা করবে এখন ॥

            কৃষ্ণ এলে কতোই সে করবে বিলাস।

            ভেবে ভেবে করে রাধা এই অভিলাষ ॥

            এইভাবে কতো কাজে রাধা ব্যস্ত হয়।

            যাও তুমি প্রাণনাথ, করো কৃষ্ণময় ॥

            তুমি যদি নাহি যাও, তাহলে এ-দেহ।

            রাত্রি পার করে কিনা, রয়েছে সন্দেহ ॥ [চলবে]