চারুকলায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হীরকজয়ন্তী : আমার চারুকলা (১৯৬৬-৭২) 

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জিত হয় ১৯৪৭ সালে, তবে ধর্মীয় সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে দেশটি বিভক্ত হয়ে দুটি রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে – ভারত ও পাকিস্তান। এ বিভক্তির ফলে দেশ দুটির হিন্দু ও মুসলমান উভয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার বোধ দেখা দেয়, বিশেষ করে বিভক্ত বঙ্গের দুই অংশেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিপুলসংখ্যক মানুষ দেশত্যাগ করে। জয়নুল আবেদিন জন্মসূত্রে পূর্ববঙ্গের মানুষ হলেও তখন কলকাতায় মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত, সরকারি আর্ট স্কুলে শিক্ষকতার আর্থিক নিরাপত্তা ছাড়াও তেতাল্লিশের মন্বন্তরে অভুক্ত মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের রেখাচিত্র তাঁকে সমগ্র ভারতবর্ষে চিত্রশিল্পী হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছে। কলকাতা তখন পুরো ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র, তাঁর সামনে পড়ে আছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম খ্যাতিমান চিত্রশিল্পীর মর্যাদা অর্জনের হাতছানি। জয়নুলের বয়স তখন মাত্র তেত্রিশ। তবে অন্য অনেক প্রতিষ্ঠিত মুসলিমজনের মতো তিনিও কলকাতার মোহ ত্যাগ করে পশ্চাৎপদ পূর্ববঙ্গে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন, তাঁর সঙ্গে চলে আসেন কলকাতা আর্ট স্কুলে তাঁর সহকর্মী আনোয়ারুল হক, সফিউদ্দীন আহমেদ প্রমুখ মুসলিম শিক্ষক। সাম্প্রদায়িক ভেদচিন্তায় প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্রের বয়স এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন কীভাবে একটি শিল্পবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চিন্তা করেছিলেন, উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন তা ভেবে অবাক হতে হয়। তাঁর সে বৃক্ষশিশু আজ পল্লবিত মহীরুহ। একটি ডিপ্লোমা-প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি হয়ে এটি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষদ।

সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত চারুকলা শিক্ষার প্রতিষ্ঠানটির ক্লাস শুরু হয় ১৯৪৮ সালের ১৫ই নভেম্বর। সে হিসেবে ২০২৩ সালের নভেম্বরে এর পথচলার পঁচাত্তর বছর পূর্ণ হলো, জয়ন্তীর হিসাবে একে হীরকজয়ন্তী হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। এ মাইলফলকের অভিঘাত আমাকেও কিছুটা স্মৃতিকাতর করে তুলেছে, মনে পড়ছে ষাটের দশকের শেষার্ধে এ-প্রতিষ্ঠানে আমার ছাত্রজীবনের বিদ্যুচ্ছটাময় অগ্নিগর্ভ দিনগুলির কথা। আমার ছাত্রত্ব সম্ভবত প্রতিষ্ঠানটির আদি-মধ্য পর্যায়ে, দাবি করতে পারি – এর কৈশোর-যৌবনের সন্ধিক্ষণকালের মধুময় দিনে। আমার কালে এটি আর্ট কলেজ নামে সর্বসাধারণ্যে পরিচিত ছিল, পোশাকি নাম ছিল ইস্ট পাকিস্তান কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফ্টস। এইচএসসির পর ঢাকায় এসে অনিশ্চিত ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে আর্ট কলেজ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম এর স্থাপত্যিক সৌন্দর্য, বাগান-জলাধার আর খোলা প্রকৃতির মাঝে ছাত্রদের আঁকাআঁকির পাঠ নিতে দেখে। আঁকার হাত তো ভালোই ছিল, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম – এখানেই পড়বো। তবে আর্ট কলেজে ভর্তি হতে লাগে এসএসসি পাশ, এর মধ্যে ভর্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে ক্লাস চালু হয়ে গেছে প্রায় দু-মাস। বাবার সঙ্গে অধ্যক্ষ জয়নুল আবেদিনের হৃদ্যতা আছে, সে-পথেই হতে পারে মুশকিল আসান। অতএব, বাবাকে সঙ্গে নিয়ে আর্ট কলেজে গমন, অধ্যক্ষ জয়নুল আবেদিন সাহেবের কক্ষে। বাবার উপস্থিতিতে কাজটি সহজ হলো। আবেদিন সাহেব একজন পিয়নকে ডেকে বললেন, ‘এরে ফার্স্ট ইয়ার ক্লাসে নবীর (শিল্পী রফিকুন নবী) কাছে নিয়া যাও, কইও আমি পাঠাইছি, খাতায় যেন নাম তুইলা নেয়।’ ব্যস, ভর্তি হয়ে গেলাম আর্ট কলেজে। এইভাবে এ প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে এবং তৎকালীন ছাত্র ও জাতীয় রাজনীতির এক বিস্ফোরক পরিস্থিতির সঙ্গে আমার দীর্ঘ এক সম্পর্কের সূচনা ঘটলো।

আমার ভর্তিকালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনই অধ্যক্ষ ছিলেন, তবে তাঁর ক্লাস আমরা পাইনি। পরের বছরই তিনি অধ্যক্ষের পদে ইস্তফা দিয়ে অবসর নিয়ে ফেলেন। উপাধ্যক্ষ শফিকুল আমিনই দাপ্তরিক কাজকর্ম তদারক করতেন। আর আমাদের শিক্ষকমহল বলতে গেলে ছিলেন তারকাখচিত। অন্যদের মধ্যে তখনকার প্রবীণ শিক্ষক কলকাতা আর্ট স্কুল-প্রশিক্ষিত শফিকুল আমিন, আনোয়ারুল হক, সফিউদ্দীন আহমেদ, খাজা শফিক আহমেদ, হবিবুর রহমানকে পেয়েছি। তখন খ্যাতির মধ্যগগনে থাকা মোহাম্মদ কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম, আব্দুর রাজ্জাক, আবদুল বাসেত আর কিছুটা বয়োকনিষ্ঠ হাশেম খান, রফিকুন নবী ও মনিরুল ইসলামকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। মীর মোস্তফা আলী, কাইয়ুম চৌধুরী ও সমরজিৎ রায়চৌধুরী অন্য বিভাগের হওয়ায় তাঁদের ক্লাস পাইনি বটে, তবে স্নেহের কমতি হয়নি। প্রথম বর্ষে আমাদের শিক্ষক ছিলেন রফিকুন নবী ও মনিরুল ইসলাম। সদ্য-পাশ করা মনির স্যারের আবার আমরা প্রথম ছাত্র, সেজন্য তাঁর কাছে উপরি হিসেবে পাওয়া স্নেহ এখনো বজায় আছে। নবী স্যার ও মনির স্যারের কাছেই স্কেচ ও স্টাডির হাতেখড়ি। দ্বিতীয় বর্ষে হাশেম স্যারের কাছে শিখেছি বিশেষভাবে জলরং। শফিকুল আমিন স্যার মাঝেমধ্যে পার্সপেক্টিভের ক্লাস নিতেন। তৃতীয় বর্ষ থেকে চিত্রকলা বিভাগে পড়েছি, প্রথম বছরে বাসেত স্যার, চতুর্থ বর্ষে আমিনুল ইসলাম স্যার ও শেষ বর্ষে আনোয়ার স্যারের মতো শিক্ষকদের পেয়েছি। শিল্পের ইতিহাস ও সমাজতত্ত্ব পড়তে হতো, শিক্ষক ছিলেন আবদুল মতিন সরকার ও বুলবন ওসমান। তাত্ত্বিক বিষয়ে ভালো হওয়াতে তাঁদেরও প্রিয়পাত্র ছিলাম।

শিল্পাচার্যের অবসরের পরে অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন শফিকুল আমিন স্যার। আমরা দ্বিতীয় বর্ষে থাকতে নানা দাবিতে কলেজে ছাত্র-আন্দোলন শুরু হয়, আন্দোলনের মধ্যে শফিকুল আমিনের পদত্যাগও যুক্ত হয়। এর মধ্যে এনএসএফের পাণ্ডারা এসে আন্দোলনের নেতাগোছের কয়েকজনকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। ব্যাপকভাবে ধারণা সৃষ্টি হয় ঘটনার পেছনে শফিকুল আমিনের পুত্র আমাদের সহপাঠী মনজুর হাত রয়েছে। উত্তেজিত ছাত্রদের ধাওয়া খেয়ে মনজু আর কলেজে ফেরেনি, শফিকুল আমিনও চাকরি থেকে অবসর নেন। অস্থায়ী অধ্যক্ষের দায়িত্বে আনোয়ার স্যার বেশ কিছুদিন ছিলেন, আমি শেষ বর্ষে থাকতে সৈয়দ শফিকুল হোসেন টিচার্স-ট্রেনিং কলেজ থেকে এসে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। কামরুল হাসান, রশিদ চৌধুরী ও মোস্তফা মনোয়ার একসময় আর্ট কলেজে শিক্ষকতা করেছেন, কিন্তু আমাদের কালে তাঁদের আমরা পাইনি।

তখনকার দিনে অধিকাংশ শিক্ষক ও ছাত্র উভয়ের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, আর্ট কলেজে পড়তে লেখাপড়ার কোনো প্রয়োজন নেই, ছবি আঁকার কৌশল রপ্ত করাই ছাত্রের কর্তব্য। ফলে লেখাপড়ায় ঠনঠন বাপে-খেদানো মায়ে-তাড়ানো ছেলেরাই মূলত লেখাপড়ার দুরূহ কর্ম থেকে পরিত্রাণের আশায় ভর্তি হতো। আবার কেউ কেউ সিনেমার নায়কের ঢংয়ে শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখে পরিবারের অমতে পালিয়ে আসতো। আর সাধারণভাবে সকল অভিভাবকই একমত ছিলেন যে, শিল্পীর চাকরি বা ভাত জুটবে না, ফলে অধিকাংশ ছাত্রই পরিবার থেকে বিশেষ আর্থিক সাহায্য পেত না। খণ্ডকালীন কাজ বা টিউশনি করে অনেককে অর্থ জোগাড় করতে হতো, আমিও তা করেছি। লেখাপড়ার চর্চা বিশেষ নেই, অতএব সন্ধ্যার পর থেকে হোস্টেল নামক আবাসটিতে নরক গুলজার হয়ে উঠতো। নানা প্রকারের দুষ্টামি ও হইহল্লার ভেতরে আমিও শামিল হতে শুরু করলাম। নানা বিষয়ে বই পড়ার আগ্রহ ছিল আমার তীব্র, এই প্রতিকূল পরিবেশেও অবশ্য আমার পুস্তক পাঠের অভ্যাস কমেনি। চতুর্থ ও শেষ বর্ষে আমি ছিলাম হোস্টেলের মনিটর, সুপার মহোদয়ের কাছে এই বাঁধনহীন তরুণদলের কর্মকাণ্ডের জবাবদিহি করতে করতে জেরবার হতাম।

ওই সময় আর্ট কলেজে ছাত্রদের অধিকাংশ আসত একেবারে অজপাড়াগাঁ থেকে। ঢাকায় বড় হওয়া অল্প কিছু ছিল, তারা বাড়ি থেকে আসত। আমার মতো মফস্বলী শহুরে ছেলে ছিল না বলা চলে, ফলে হোস্টেলে আমি ছিলাম কিছুটা নিঃসঙ্গ-মতন। ছাত্রদের তুলনায় মেয়েরা ছিল একেবারে বিপরীত কিসিমের। এরা আসত ঢাকার বিত্তশালী ও কখনো কখনো খ্যাতিমান পরিবার থেকে, অধিকাংশের যাতায়াত পারিবারিক গাড়িতে। আমাদের এক সহপাঠিনী নিজেই গাড়ি চালিয়ে আসত। আমরা হোস্টেলবাসী ছাত্রদলের ছিল পদযুগলই সম্বল। তখনকার আর্ট কলেজ ছিল সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাধিক মুক্ত ও প্রগতিশীল স্থান। ওই সময়, যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ছাত্রীরা পরস্পরকে আপনি সম্বোধন করত ও দূরত্ব বজায় রেখে চলত, তখন আমাদের কলেজে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তুইতোকারি চালু হয়ে গেছে, পরস্পরের গাত্র স্পর্শ করেও দুষ্টামি চলছে। এর মধ্যে কোনো মালিন্য বা হীন মতলব অন্তত আমার কালে দেখিনি। শহুরে বিত্তশালীর কন্যা ও গ্রামের দরিদ্র কৃষকের পুত্রের মধ্যে যে-বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল তার মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা ছিল না। অবশ্য গ্রামীণ সরলমতি ছেলেদের অনেকে অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে রূপসী শহুরে মেয়েদের প্রেমে পড়ে বিফলকাম হওয়ার ঘটনাও কম নেই। অল্প হলেও সফলকাম হওয়ার ঘটনাও অবশ্য আছে।    

ভেবেছিলাম ছবি আঁকা এমন কী কাজ। সামান্য চিত্রাঙ্কনের শিক্ষা যে এতটা পরিশ্রমসাধ্য তা কদ্যাপি ভাবি নাই। স্কুলজীবনে লেখাপড়ায় বেশ ভালো ছিলাম, কিন্তু এজন্য পরিশ্রম বিশেষ করিনি। এখানে পরিশ্রমই মূলমন্ত্র। আঁকো এবং আঁকতে থাকো, প্রচুর অনুশীলনই সাফল্যের চাবিকাঠি। বিভিন্ন ভঙ্গিমায় মানুষের অবয়ব আঁকা শিক্ষণের জন্য অন্যতম উপযুক্ত স্থান হিসেবে বিবেচিত হতো দিবসকালে কাঁচাবাজার আর রাত্রিকালে রেলস্টেশন। এইসব লোকেশনে হোস্টেলের বড়ভাইয়েরা আমাদের সঙ্গী হয়ে প্রশিক্ষণে সহায়তা করতেন। কোথাও স্কেচ বা জলরংচিত্র আঁকতে বসলে লোকে ঘিরে ধরত। অধিকাংশ সাধারণ কৌতূহলের মধ্যে সীমিত থাকলেও মাঝে মাঝে ভারতীয় গোয়েন্দা পাকিস্তানি স্থাপনার ছবি এঁকে নিচ্ছে এমন সন্দেহের শিকারও হতে হতো। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের জোশ তখনো কমে নাই, আমাদের কোনো কোনো সতীর্থ গুরুতর হেনস্থারও সম্মুখীন হয়েছেন।          

ক্রমে ক্রমে ঢাকার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে পরিচয় ঘটতে লাগল। আমরা ভাইবোনরা ঢাকায় অধ্যয়নকালে বেগম সুফিয়া কামাল আমাদের একজন অভিভাবকের মতো ছিলেন, তাঁর বাসায় ছাত্রজীবনে আমিও নিয়মিত যেতাম। সুফিয়া কামালের বাসায় সেকালের বহু রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে দেখেছি। শিল্পী কামরুল হাসান, লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক অজিত গুহ, গায়ক কলিম শরাফী, বাংলাদেশে স্থাপত্যবিদ্যার অগ্রজন মাজহারুল ইসলাম, লেখক ও রাজনীতিক শহীদুল্লা কায়সার, কবি শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক সাদেক খান ও আলমগীর কবির, সংগীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক প্রমুখের কথা মনে পড়ছে। ১৯৬৭ সালে ছায়ানটের উদ্যোগে রমনা বটমূলে নববর্ষ আবাহনের সূচনালগ্নে আর্ট কলেজের ছাত্ররা অনেকেই জড়িত ছিল। সম্ভবত মঞ্চপরিকল্পনা করেছিলেন নিতুনদা (নিতুন কুন্ডু), তাঁর সহায়তাকারী রূপে সিনিয়র ছাত্রদের অনেকেই ছিলেন। আমি তখনো নিচের শ্রেণির ছাত্র। তবে আমরা ১৯৭০ পর্যন্ত প্রতি বছর হোস্টেল থেকে দলবেঁধে ভোরের সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছি। তখন বড়জোর শ’খানেক মানুষ সে অশ্বত্থ গাছের তলা ঘিরে বসতাম, তার মধ্যে আর্ট কলেজের ছাত্রসংখ্যা উল্লেখযোগ্য ছিল। আজকের মতো এই উৎসব তখন লক্ষ মানুষের সমাবেশে পর্যবসিত হয়নি।

আস্তে আস্তে কাছাকাছি-বয়সী কবি-লেখক, গায়ক-অভিনেতা ও আঁতেল বনতে উৎসুক অনেকের সঙ্গে পরিচয় ও কিছু কিছু বন্ধুত্বও হলো। নিউমার্কেটের কলেজ রেস্টুরেন্ট ছিল সন্ধ্যায় আমাদের আড্ডাস্থল। এছাড়া দিনে শরিফ মিয়ার ক্যান্টিন ও শাহবাগ মোড়ের দু-একটি দোকানেও বসা হতো। গুরু বা মন্ত্রণাদাতা হিসেবে পেয়েছি অগ্রজ আহমদ ছফা, মুহাম্মদ খসরু, কায়েস আহমেদ, রাজিব আহসান চৌধুরী প্রমুখকে। কাছাকাছি বয়সের কারো কারো সঙ্গে সম্পর্ক এখনো রয়েছে। আমার চট্টগ্রামের বন্ধু প্রয়াত অমিত চন্দ তখন ঢাকাবাসী, একটি পুস্তকবিপণিতে কর্মরত। তার  সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেড়ে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠতে লাগল। এর আগেই আঁতেল ও বামরাজনীতির বাহক হয়ে ওঠার প্রতি পড়ুয়াগোছের ছাত্রদের মধ্যে আকর্ষণ ব্যাপক হয়ে উঠেছে। এর প্রধান লক্ষণ ছিল নির্দিষ্ট রেস্তোরাঁয় প্রচুর চা ও সিগারেটের সঙ্গে নানা তত্ত্ব নিয়ে ঘোর তর্কে মেতে ওঠা। মার্কস-অ্যাঙ্গেলস, লেনিন-মাও, স্ট্যালিন-ট্রটস্কি, রোজা লুক্সেমবার্গ বা গ্রামসির কোন তত্ত্ব সঠিক বা সঠিক নয় – সেই ব্যাপারে রায় দেওয়ায় সকলেই মোটামুটি ওস্তাদ হয়ে উঠছিল। আমরা শিল্পের নবিশগণ একদিকে আসন্ন বিপ্লবের স্বপ্নে ও অন্যদিকে শিল্পীর বেপরোয়া জীবনের প্রতি আগ্রহে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছি। তখন তরুণদের মধ্যে একদিকে জার্মান বন্দিশিবিরে নিহত চেক বিপ্লবী জুলিয়াস ফুচিকের নোটস ফ্রম দ্য গ্যালোস আর অন্যদিকে সমাজের কাছে উপেক্ষিত ওলন্দাজ শিল্পী ভ্যান গঘের জীবন নিয়ে লেখা উপন্যাস লাস্ট ফর লাইফ বিশেষ জনপ্রিয় ছিল। দুই বিপরীতধর্মী চরিত্র, তবে উভয়ের ট্র্যাজিক পরিণতিই হয়তো তরুণমনকে আকর্ষণ করেছে।

বিপ্লবের সঙ্গে প্রেমের বোধহয় গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ঊনসত্তর-সত্তরে আমাদের নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল যে, সর্বহারার বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গেছে, এখন শুধু পাকা ঘোড়সওয়ারের মতো যথাযথ পথে পরিচালনা করে একে যথাস্থানে এনে বসাতে হবে। বিপ্লবের গুরু গুরু ধ্বনি শোনা গেলেও তার আসতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হচ্ছিল। প্রেমের অত ধৈর্য নেই, সবেগে এসে একেবারে দু-কূল ভাসিয়ে দিলো। আমাদের আর্ট কলেজে প্রেমের প্লাবন বয়ে গেল। সহপাঠী, সিনিয়র-জুনিয়র জুটি তো হলোই, এমনকি নিরীহ ব্যাচেলর কিবরিয়া স্যারও এক ছাত্রীর সঙ্গে প্রেমের বাঁধনে জড়িয়ে গেলেন। আমারও একজনের সঙ্গে খানিকটা মন দেওয়া-নেওয়ার ঘটনা ঘটল, উপহার-বিনিময়ও হলো। অবশ্য এর বেশি অগ্রসর হওয়ার ফুরসত মিলল না, একাত্তর এসে সমস্ত তছনছ করে দিলো – কে কোথায় ভেসে গেল জানার উপায়ও রইল না।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের আবেগ তখন আস্তে আস্তে দানা বাঁধছে, রাজনীতির অঙ্গন ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ছয় দফার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান ক্রমশ নেতৃত্বের অগ্রভাগে চলে আসছিলেন। এই আলোড়নে ছাত্রসমাজ ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে শুরু করল। ১৯৬৯ সালে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন একতাবদ্ধ হয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন ও ১১ দফা দাবি উপস্থাপন করলে ছাত্রসমাজই আন্দোলনের নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠল। শেখ মুজিব তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি, ছাত্রনেতারাই হয়ে উঠলেন আন্দোলনের মুখপাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে হাজার হাজার উদ্বেলিত ছাত্রজনতার সামনে ছাত্রনেতারাই দিতে শুরু করলেন দিকনির্দেশনা। গণআন্দোলন ক্রমশ গণঅভ্যুত্থানের দিকে অগ্রসরমান হলো। কলাভবন চত্বরে প্রতিদিন বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, পোস্টার-ফেস্টুন-কার্টুন-ব্যানার সজ্জিত মিছিল নিয়ে আমরা সমাবেশস্থলে হাজির হলে সারা কলাভবন প্রাঙ্গণ হাততালিতে ফেটে পড়ত। উদ্দীপ্ত ছাত্রজনতার বিশাল মিছিল উত্তেজনায় টগবগ করতে করতে হাঁটত না, দৌড়াতে থাকত। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ ছিল অবশ্যম্ভাবী, কাঁদানে গ্যাসে আমরা মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কেউ কেউ পুলিশের লাঠি থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে শার্টের নিচে পিঠে মোটা কম্বল বাঁধার প্রস্তাব করল। কাঁদানে গ্যাসের প্রতিকার হিসেবে রুমাল ভিজিয়ে চোখে লাগানোর প্রাচীন ব্যবস্থা তেমন কার্যকর মনে না হওয়াতে সিগারেট প্যাকেটের রাংতা কাগজ পুড়িয়ে চোখে ধোঁয়া লাগানোর বুদ্ধির প্রচলনও হলো। আমাদের মতো কম হিম্মতওয়ালাদের মধ্যে পুলিশের হাত থেকে পালানোর সুবিধার জন্য কেডস জুতা কেনার ধুম পড়ে গেল।

ঊনসত্তর-সত্তর জুড়ে উত্তেজনার পারদ চড় চড় করে বাড়তে লাগল। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে শহিদ মিনারের বিপরীত পাশে দেয়ালের ওপর বিশালাকার ব্যানারে বাঙালির ইতিহাস ও সংগ্রামের নানান ঘটনা আঁকলেন শিল্পীদল যাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন মোস্তফা মনোয়ার। আমাদের তরুণ শিক্ষকদের অনেকে হাত লাগালেন। এই ব্যানার আঁকার বিশাল কর্মযজ্ঞটি চলত আমাদের হোস্টেলে, আমরা ছাত্ররা রং গুলানো, কাঠির মাথায় তুলা জড়িয়ে তুলি বানানো আর রঙের বাটি এগিয়ে দেওয়ার মতো কাজগুলো করতাম। মোস্তফা মনোয়ারের বিরাটাকায় মানব অবয়ব অঙ্কনের দক্ষতা আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। এছাড়া রাতজুড়ে ব্যানার-ফেস্টুন-পোস্টার-কার্টুন আঁকার কাজ চলত। ব্যানার ও পোস্টারের জন্য স্লোগান ছাড়াও কবিতার চরণ চয়ন করার দায়িত্ব অধিকাংশ আমিই পালন করতাম।

রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সুকান্তের পরিচিত চরণ ছাড়াও আমি জীবনানন্দ দাশ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ বা তুর্কি কবি নাজিম হিকমতের কবিতার অংশও ব্যবহার করতাম। একবার সিদ্ধান্ত হলো, আমাদের মিছিলের সম্মুখে থাকবে রাস্তার দুই পাশ জুড়ে বিশাল ব্যানার। এর বাণী চয়নের ভার যথারীতি আমার ওপর পড়ল। আমি রবীন্দ্রনাথের কবিতা ঘেঁটে চয়ন করলাম ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’। এই সময় হোস্টেলবাসী ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নিল হোস্টেলের ছাদ থেকে একতলা পর্যন্ত প্রস্থের বৃহত্তম ব্যানার ঝোলানো হবে, এর কথাও রচনার ভার পড়ল আমার ওপর। আমার রচিত ‘স্বাধীনতা আমার স্বপ্ন, ঐক্য আমার শক্তি, মুক্তি আমার লক্ষ্য’ কথাটি একটি লাল কাপড়ে লিখে ঝোলানো হলো। ব্যানারের প্রতিটি অক্ষর একজন মানুষের থেকেও উঁচু, ব্যানারে হোস্টেলের সম্মুখভাগ পুরোটা ঢাকা পড়ে গেল। এই বাক্যটি বেশ কিছু কাগজ সে-সময় হেডলাইন হিসেবে ব্যবহার করেছে। প্রবল গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের দৃশ্যপট এক যুগ-সন্ধিক্ষণে এসে পড়ল।

পহেলা মার্চ থেকে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে অসহযোগ ঘোষিত হলো, আমাদের শিল্পীদলও বসে নেই। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে সভাপতি করে গঠিত হলো ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’। শিল্পীদের মিছিলে আমাদের শিক্ষকগণ ছাড়াও ছাত্র ও বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত শিল্পীরা যুক্ত হলেন, শিল্পীসমাজের মিলিত মিছিল সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। বিশেষ করে বলতে হয় শিল্পী কামরুল হাসানের কথা। একুশে ফেব্রুয়ারির আয়োজনে অক্ষরবৃক্ষের ও অক্ষর-অঙ্কিত শাড়ি পরিধানের পরিকল্পনা মূলত তাঁরই। তিনি গুরুসদয় দত্ত-পরিচালিত ব্রতচারী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। খালি গা, মাথায় পট্টি, গলায় ঢোলক ও ব্রতচারীর বোলসহ তাঁর অংশগ্রহণ আমাদের উদ্দীপনাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিলো।

এইসব ডামাডোলের মধ্যে আমি কলেজের হোস্টেলেই বাস করছি। পহেলা মার্চ থেকে ক্লাস নেই, অধিকাংশ ছাত্র বাড়ি চলে গেছে, আমরা জনা দশ-বারো আছি। একটি সশস্ত্র নৃশংস আক্রমণের বিপদের সম্মুখীন আছি – এমন কথা স্বপ্নেও আমরা তখনো চিন্তা করতে পারিনি। কেবল টিক্কা খানের নিযুক্তির দিন অলকেশ যখন এসে বললে : ‘টিক্কা খান আইছে, এইবার রক্তারক্তি কাণ্ড হইবো, পালাও সকলে’ তখন আমরা তাকে নিয়ে বরং মশকরা করেছিলাম। সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধু রমনা রেসকোর্সের জনসভায় দিকনির্দেশনামূলক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেবেন। চারদিকে কানাঘুষা – বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন, এজন্য তাঁর ওপর নানাদিক থেকে চাপ রয়েছে। সে-জনসভায় উপস্থিতজনের একজন হিসেবে নিজেকে এখনো সৌভাগ্যবান মনে করি, এর বিবরণ এতই বহুশ্রুত যে তার পুনরুক্তি অপ্রয়োজনীয়।

মার্চের মাঝামাঝি থেকে আমার একটু ঘুসঘুসে জ্বর চলছে, বাড়ি থেকে অল্পদিনের জন্য ঘুরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। ২৪ তারিখে তখনকার সকালের ট্রেন উল্কায় চট্টগ্রামের টিকেট কাটলাম। আমার সহপাঠী ও বিশেষ বন্ধু শাহনেওয়াজের কাছে রুমের চাবি দিয়ে বিদায় নিলাম, আমি অল্পদিনেই ফিরে আসব। সমস্ত ট্রেনে মানুষে আর বাংলাদেশের পতাকায় তিল ধারণের ঠাঁই নাই, প্রতিটি স্টেশনে হাজার হাজার মানুষ, ট্রেনের আর স্টেশনের মানুষের মিলিত গগনবিদারী ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে ট্রেনের শব্দ ঢাকা পড়ে গেছে। সকালের ট্রেন বেশ রাতে চট্টগ্রাম পৌঁছাল। তখনো দুঃস্বপ্নেও জানি না বন্ধু শাহনেওয়াজ ও অন্য কয়েকজনের সঙ্গে আর জীবনে দেখা হবে না, আর মাত্র একদিনের হেরফেরে আমারও একই পরিণতি হতে পারত।

আমার আর্ট কলেজ জীবনের যত সম্পত্তি সবই আমার হোস্টেলকক্ষের দেরাজে, সুটকেসে ও বিছানার তোষকের তলায় রক্ষিত থাকত। ১৯৭১-এ সেনা-অপারেশনের পর অরক্ষিত হোস্টেলটির যাবতীয় মালামাল লুণ্ঠিত হয়। ফলে আজ আমার কাছে ছাত্রজীবনে আঁকা ছবি, রংতুলি, আলোকচিত্র বা স্কেচখাতা – কিছুই নেই। চট্টগ্রামের বাসায় সামান্য যে কয়েকটি বস্তু আছে তারাই আমার আর্ট কলেজজীবনের অকিঞ্চিৎকর সাক্ষী। স্বাধীনতার পরপর আমরা চট্টগ্রামের বাসিন্দা কিছু শিল্পী ও ছাত্র ১৩টি পূর্ণাকৃতির হার্ডবোর্ডে আঁকা ‘আবহমান বাংলা’ নামে একটি প্যানেলসিরিজ নিয়ে কলকাতায় আয়োজিত ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীমেলায় গিয়েছিলাম। এর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন ঘটেছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘অতি সাম্প্রতিক আমরা’র উদ্যোগে। প্যানেলটির প্রদর্শনী ওই মেলার অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হয়েছিল। ফিরে আসার পরই আমাদের একাত্তরে অনুষ্ঠিতব্য সমাপনী পরীক্ষাটি সংক্ষিপ্ত আয়োজনে হয়ে গেল। পরীক্ষা পাশের পর সদ্য-স্বাধীন দেশটিতে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পা বাড়ালাম। শুরু হলো আমার জীবনের নতুন এক অধ্যায়।

আলোকচিত্র : আর্ট কলেজের তৎকালীন ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সিরাজউদ্দিনের সৌজন্যে।