জাহিদুল হকের ‘এইখানে বহু শব, বহু মৃত’ : অস্তিত্বের কাব্যিক কাঠামো

কবি-সম্পাদক আবুল হাসনাত তাঁর সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের কবিতা (ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৪) সংকলনের ‘ভূমিকা’য় বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমাদের দুর্গত দেশের জীবন ও মননে হীরকখণ্ডের মত এখনও দ্যুতিময়। বাঙালির শিল্পসাহিত্যে তো বটেই, সামাজিক ইতিহাসের বর্ণময় উত্থানেও এই যুদ্ধ কত তাৎপর্যময় ও গভীরতাসঞ্চারী তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।’ কেন কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না? – এই প্রশ্নের উত্তরে আবুল হাসনাত জানিয়েছিলেন, ‘বাঙালির রাজনীতি ও সমাজ-ভাবনায় মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞান অতীত ও ভবিষ্যতের জন্যেও অবিচ্ছেদ্য। এ ম্লান হবার মত নয়।’ (হাসনাত, ১৯৮৬ : ১৫)। যুদ্ধের সেই বিজয় থেকে অর্জিত আত্মশক্তিকে আত্মস্থ করার জন্যে, চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে এখন প্রয়োজন বাঙালি সংস্কৃতির ‘ঐশ্বর্যের দিকগুলো তুলে ধরা’ – এমনটাই মনে করেন বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক অনুপম সেন। তাঁর মতে, ‘বাঙালিকে বিশে^র সব সংগ্রামী মানুষের সঙ্গে এক হয়েই এগোতে হবে তার বন্ধন-মুক্তির জন্য, তার আত্মসত্তার, বাঙালি সত্তার পূর্ণবিকাশের জন্য। এর জন্যে তার পাথেয়র অভাব নেই। এই পাথেয় সে অর্জন করেছিল ১৯৭১-এর মুক্তি সংগ্রামে।’ তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে অনুপম সেন আরো যোগ করছেন এই বলে যে, ‘এই সংগ্রাম কেবলমাত্র বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল না, প্রকৃত অর্থেই ছিল মুক্তির সংগ্রাম।’ (সেন, ২০১৪ : ৪০)। সেই মুক্তির সংগ্রামের এক ঐশ্বর্যময় কাব্যিক প্রকাশ আমরা দেখতে পাই কবি জাহিদুল হকের ‘এইখানে বহু শব, বহু মৃত’ শীর্ষক কবিতায়।

২.

কবিতাটি শুরু হয়েছে এক বন্ধনমুক্তি আর সত্তার পূর্ণবিকাশের পটভূমিকায়, যেখানে জীবন-মৃত্যুর যৌথতার এক কাব্যিক উপস্থাপন দেখতে পাওয়া যায়; মৃত্যুর সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের কাছে যে-যৌথতা ম্লান ও বিষণ্ন আর অনেকটাই যেন ম্রিয়মাণ। সেসবের স্বাক্ষরিত কবিতায় দেখি –

এইখানে বহু শব, বহু মৃত, মাটিতে লুকিয়ে

আছে স্থির, উদাসীন; যেন তারা মৃত্যুকেই নিয়ে

কী নিঃশব্দে খেলা করে : স্বাধীনতা যেন প্রিয় খেলা!

এই স্বাধীনতা তো এমনি-এমনি পাওয়া কোনো ব্যাপার নয়, সেটি কখনো সম্ভব হয়েও ওঠে না। তাকে পেতে হয় ঘামে, মেহনতে, যুদ্ধে, রক্তে-মৃত্যুতে। অথচ কবির যেন তীব্র অনীহা এইসব মৃত্যুকে মেনে নিতে। তিনি যেন সব রকমের রক্তপাত থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে চাইছেন –

মৃত্যু এক অদ্ভুত গহ্বর; কিন্তু সেও অবেলায়

বধ্যভূমি ফুঁড়ে উঠে কলজে ছিঁড়ে, অক্ষিগোলক-কে

খুবলে তুলে যখন উন্মত্ত নৃত্যে অন্তরীক্ষে, অক্ষে

বিষণ্নতা ওড়ায়, তখন তাকে তীব্র ঘৃণা লাগে।

জার্মান কবি রিলকের (Rainer Maria Rilke) ডুইনো এলিজিগুচ্ছে (Duino Elegies : 1923) মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়েও মৃত্যুকে এড়িয়ে চলার এক তীব্র আকুতি দেখা যায়। কিন্তু এটিও তো কবির জানা ছিল, মৃত্যুকে এড়িয়ে গিয়ে কিছুতেই জীবনের উত্তাপ সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। তাঁর ‘দশম এলিজি’তে রিলকে লিখেছিলেন –

But the dead youth must go on by himself, and silently the elder Lament

takes him as far as the ravine,

where shimmering in the moonlight

is the fountainhead of joy. With reverence

she names it and says : — Among men

it is a mighty stream.

[Translated by Stephen Mitchell : March, 1989]

অমিতাভ চৌধুরীর বাংলা তর্জমায় (জানুয়ারি : ২০০৮) এভাবে আমরা পাচ্ছি –

কিন্তু সদ্য মৃত তরুণটিকে একাকী এগিয়ে যেতেই হবে, আর

প্রবীণা শোক তাকে নিয়ে এলেন গিরিসংকট পর্যন্ত,      

সেখানে চন্দ্রালোকে উজ্জ্বল হয়ে আছে আনন্দের উৎস।

তিনি অতি শ্রদ্ধায় নামকরণ করলেন তার

আর বললেন, পুরুষের মধ্যে

এটি এক মহান জলাধার।

এখানে রিলকেরও উপলব্ধি এই যে, জীবনের আনন্দকে দুঃখের বিনিময়েই পেতে হয়। এর বিকল্প কোনো পথ আর মানুষের জন্যে খোলা নেই, দ্বিতীয় কোনো রাস্তাও নির্মিত হয়নি এখনো। ওই ‘দশম এলিজি’র সর্বশেষ স্তবকে রিলকে বলেছিলেন –

And we, who have always thought

of happiness as rising, would feel

the emotion that almost overwhelms us

whenver a happy thing falls.

অমিতাভ চৌধুরীর অসাধারণ অনুবাদে যাকে এভাবে পাওয়া যায় –

আর আমরা, যারা সর্বদাই ভেবে এসেছি

সুখ বেড়ে ওঠে আমাদের অনুভবে

সেই আবেগ আচ্ছন্ন করে আমাদের

যখন সুখের কিছু খসে পড়ে।

দীর্ঘ এই কবিতাটিতে আমরা একজন কবির প্রশস্তির ভাবব্যঞ্জক শ্রুতিমাধুর্য উপলব্ধি করতে পারি। কোন সে কবি? আগেই বলে নেওয়া হয়েছে যে, সেই কবির নাম রাইনের মারিয়া রিলকে, যিনি কি না বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় – ‘এমন এক কবি, যিনি সর্বতোভাবে কবি হতে চেয়েছিলেন। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে কবি। দৈনন্দিনতম জীবনের অর্থহীনতম মুহূর্তেও। ভ্রমণে ও মননে, বাক্যে, ব্যবহারে, পত্ররচনায়। যখন তিনি কবিতা লিখছেন না বা লিখতে পারছেন না, তখনও।’ রিলকের প্রতি বুদ্ধদেব বসুর প্রশস্তি যেন শেষ হওয়ার নয়; তিনি পূর্বের বক্তব্যের রেশ টেনে আরো বলেছিলেন, ‘যাঁর বিষয়ে আমাদের প্রায় সন্দেহ হয় যে তিনি সাধারণ অর্থে “বেঁচে থাকতে” কখনো চাননি, চেয়েছিলেন শুধু নিজেকে কবিতার একটি বাহন করে তুলতে – এমন এক ধনুর্গুণ, যা লক্ষ্যভেদের জন্য সর্বদা টান হয়ে আছে, সর্বদা প্রস্তুত।’ সেই কবি রিলকের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু দেখতে পেয়েছিলেন একটি কাব্যিক লক্ষ্য, সেইসঙ্গে এক ‘অবিচল আত্মনিবেদন’ (বুদ্ধদেব, ১৯৯১ : ১১)।  

৩.

এখানে মনে রেখেছি যে, জাহিদুল হক অবশ্যই রিলকে নন, রিলকেও নিশ্চয়ই জাহিদুল হক ছিলেন না। কিন্তু তাঁদের দুজনের মধ্যে, অনেক সময়কালের ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও, এই সাযুজ্যটুকু দেখতে পাই যে, রিলকের মতো তিনিও ‘সর্বতোভাবে কবি হতে’ চেয়েছেন। তাঁর ‘এইখানে বহু শব, বহু  মৃত’ কবিতাটি যেন সেই কবি হওয়ার সাক্ষ্যই আমাদের কাছে দিয়ে গিয়েছে, যেখানে জীবনের বিনিময়ে, মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার আনন্দকে আমরা নিজেদের অঙ্গীভূত করে নিতে পেরেছি।

জাহিদুল হকের কবিতাটি একইসঙ্গে স্বাধীনতার, লক্ষ মানুষের জীবনদানের, স্বদেশপ্রেমের, স্বদেশের প্রশস্তির। কোন স্বদেশ? তিরিশ লক্ষ মানুষের রক্ত-মাংস দিয়ে গড়া কবির যে-স্বদেশ; কৃষক-শ্রমিকের ঘাম দিয়ে গড়া স্বপ্নের স্বদেশ; সবুজ প্রান্তরের আল্পনা দিয়ে আঁকা কবির নিভৃত স্বদেশ। কবি যেন সেই স্বদেশেরই স্তুতিগাথা গাইতে চেয়েছেন। কবিতাটির তৃতীয় স্তবক শুরুই হয়েছে এইভাবে –

তুমি প্রিয় দেশ, তুমি প্রিয় পুষ্ট বধ্যভূমি

যেখানে মানুষ তার আত্মদানে রক্তাক্ত ঊর্মির

দোলে নাচে, মাটিকে উর্বর করে শরীর বিলিয়ে,

এইখানে বহু শব, বহু মৃত, মাটিতে লুকিয়ে

আছে স্থির; সাইপ্রেসে ছাওয়া এই অটমের দিনে

আমাদের উৎসবের হলুদ বিলাপে, গানে, ঋণে

ঋজু করে তোলে এই স্বপ্নের বাড়িকে চিরকাল।

কবিতাটির এই অংশে একদিকে যেমন দেখতে পাই

কবি-ব্যক্তিত্বের এক ধরনের উৎপ্রেক্ষণ, তার সামগ্রিক উৎসারণ, তেমনই অন্যদিকে দেখি এক কবি-হৃদয়ের রোমাঞ্চিত সামগ্র্য। কবি রিলকে যাকে বলেছিলেন, ‘নিজের আত্মস্থালাভ’। কবির স্বদেশ-স্তুতির উৎসমূল ঠিক সেইখানে, যেখানে দেশের মানুষের সম্মিলিত রক্তপ্রবাহ জমাটবদ্ধ হয়ে রয়েছে। মানবজাতির অন্যতম মহান শিক্ষক মাও সে-তুঙ বলেছিলেন, ‘সংগ্রামে বলিদান অনিবার্য। মানুষের মৃত্যু স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা যদি জনগণের স্বার্থ এবং সংখ্যাধিক জনগণের দুঃখ-দুর্দশা মনে রেখে জনগণের জন্যে মৃত্যুবরণ করি, তাহলে আমাদের মৃত্যু সার্থক হবে।’ (মাও সে-তুঙ, ২০০৯ : ৩৩১)। আর কবি জাহিদুল হক অন্যদিকে, মাও সে-তুঙের মতাদর্শের অনুসারী না-হয়েও, বলেছেন :

মানুষকে মান দেয় মৃত্যু;

…       …       …

যারা ছিল নেই তারা; তাদের অস্থিতে

মেদ-মজ্জা-মাংস-রক্তে সৃষ্টি হয় দেশ অস্বস্তিতে।

এ দেশ ফুলের; এর অন্তরাত্মাগুলো কঙ্কালের

গড়া ঘরে ছায়া পায়; ঘরে ফেরে বিধ্বস্ত স্বপ্নের

রঙে রক্তাপ্লুত হয়ে, ঘোরে ফেরে অশরীরী হয়ে

খোঁজে তার হারানো শরীর, মুখ, দীপ্র অভয়ের

দিন, মাস, বছর যুগান্ত।

এইখানে, কবিতার এই দ্বিতীয় স্তবকে এসে, জীবনানন্দ-কথিত প্রেরণা নয়, বরং কবির অন্তর্ভেদী অভিজ্ঞতার এক জাগরণ আমরা লক্ষ করি। যাকে বুদ্ধদেব বসু বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে : ‘কোনো শিল্পী বাইরের জগৎ থেকে শুধু তা-ই আহরণ করেন (বা করতে পারেন) যা তাঁর শিল্পের পক্ষে, আত্মবিকাশের পক্ষে প্রয়োজনীয়।’ (বুদ্ধদেব, ১৯৯১ : ২১)। কবি জাহিদুল হকের সেই আত্মবিকাশের রূপান্তর প্রকাশিত হতে দেখি তাঁর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক আরেকটি কবিতায়, এক অনবদ্য ভঙ্গিমায় –

কী করি তোমাকে? স্তুতি। আজ রাত্রে হলুদের ভিড়ে

গেঁথে রাখি তোমার মুখের টুকরো, ভাঙাচোরা; ছিঁড়ে

আনি স্বনিত গানের কলি দূর বিস্মৃতির থেকে

আমার পংক্তির মধ্যে গেঁথে রাখি শব্দের পেরেকে।

(‘না পতাকা, না স্বদেশ, শুধু তুমি’/ নের্ভাল, কোথায় যাচ্ছো)

উপর্যুক্ত পঙ্ক্তিগুলিতে নর্তনশীল একগুচ্ছ চিত্রময়তাকে যেন দেখতে পাই আমরা। যে-গুচ্ছ কবির আত্মজাগরণের প্রতীক, যাকে সঙ্গে নিয়ে কবির অভিজ্ঞতা ছন্দোময়তার এক অনবদ্য সুন্দর গতি অর্জন করেছে। সেই গতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রহস্যময় কিছু অন্ত্যমিল, যা কবিতাটির নান্দনিক ভিত্তিকে একটি শিল্প-সৌষ্ঠবের সমন্বিত আকৃতি দিয়েছে। যার অভিভাব অভিব্যক্তি আমরা খানিকটা হলেও দেখতে পাই বুদ্ধদেব বসুর ‘মরচে-পড়া পেরেকের গান’-এর (ডিসেম্বর, ১৯৬৬) এই নিম্নোদ্ধৃত কবিতায় –

কেবল তোমাকে নিয়ে বেঁচে আছি। যদিও জানি না

কী তোমার নাম, কিংবা কেমন মুখের ছাঁদ।

নারী না পুরুষ তুমি? বোন … বন্ধু? প্রতিহিংসা … ঘৃণা?

তৃপ্তিহীন কাম? না কি বিতৃষ্ণার বিশাল প্লাবনে

ডুবে-যাওয়া, ভেসে-ওঠা, মৃতপ্রায়, অমর বিষাদ? (‘কেবল তোমাকে নিয়ে’)

এই সময়কালে নিজের মানসিক অভিব্যক্তির কথা বলতে গিয়ে বুদ্ধদেব বসু জানিয়েছিলেন – ‘এমন সময় মাঝে-মাঝে আসেই যখন কবিতা লেখার জন্য আঙুল যেন নিশপিশ করে অথচ নিজের কোনো বলার কথা জমে ওঠেনি। এরকম সময়ে একটি মাত্র সন্নিকট বিকল্প আছে আমাদের : তা হলো অন্যের  কবিতার অনুবাদ রচনা। এই বিকল্পটি আমি অনেকবার ব্যবহার করেছি … আমার সমগ্র কাব্যরচনার মধ্যে অনুবাদগুলিকে আমি নগণ্য বলে ভাবি না; এরাও আমার সচেতন প্রয়াসের ফলাফল এবং কিছুটা দৈবেরও দান।’ (বুদ্ধদেব, ১৯৯৭ : ৩৯-৪০)। বুদ্ধদেব বসুর কথার মধ্যে দিয়ে রিলকের কথার প্রতিধ্বনি যেন শুনতে পাওয়া গেল। তেমনি জাহিদুল হকের কবিতার নান্দনিক আঙ্গিকের মধ্যেও আমরা রিলকের কবিতার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি খানিকটা যেন শুনতে পাই।

৪.

রিলকে গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন যে, কবিতা আর কিছুই নয়, সে হচ্ছে একজন কবির অভিজ্ঞতার ফসল। মাল্টের নোটবুকে (ÔThe Notebooks of Malte Laurids BriggeÕ) রিলকে বলেছিলেন, ÔYou ought to wait and gather sense and sweetness for a whole lifetime, and a long one if possible, and then, at the very end, you might perhaps be able to write ten good lines. For poems are not, as people think, simply emotions (one has emotions early enough)—they are experiences.Õ (Rilke, 1990 : 19)|

এই লাইনকটি বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে এইভাবে আমরা পাচ্ছি : ‘কবির উচিত অপেক্ষা করা, সম্ভব হলে দীর্ঘ জীবন ভরে অপেক্ষা করা, মাধুর্য ও বোধ সঞ্চয়ের জন্য – আর তারপর একেবারে অন্তিম সময়ে, হয়তো এমন দশটি পঙ্ক্তি লেখা যায়, যা সত্যিই ভালো। কেননা লোকেরা যা ভাবে কবিতা তা নয়, অনুভুতি নয়  (সেটা খুব অল্প বয়সেই পাওয়া যায়) – কবিতা হলো অভিজ্ঞতা।’ (বুদ্ধদেব, ১৯১ : ২১৩)।

শুধুই রিলকে একাই নন, বুদ্ধদেব-সমসাময়িক কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন, ‘প্রেরণাতে অলৌকিকের আভাস আছে বলে, সাহিত্যসৃষ্টির উক্ত উপকরণ আমি সাধ্যপক্ষে মানতে চাইনি, তার বদলে আঁকড়ে ধরেছিলাম অভিজ্ঞতাকে।’ সেইসঙ্গে এটিও অকপটে জানিয়েছিলেন যে, ‘বর্তমানে, লেখনীর পক্ষাঘাত সত্ত্বেও, স্বপ্নচারী পথিককে যেমন, অনুপ্রাণিত কবিকে আমি তেমনিই ডরাই; এবং কালের বৈগুণ্যে ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের মূল্য বাড়ছে বই কমছে না।’ (সুধীন্দ্রনাথ, ১৯৮৪ : ২৯)। জাহিদুল হকের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক আরেকটি অনবদ্য কবিতা ‘বসতি’তে আমরা সেই অভিজ্ঞতার শৈল্পিক অনুভব আর উপলব্ধির এক অপরূপ প্রকাশ দেখতে পেয়েছি। যেখানে কবি বলেছেন –

কাল চলে যাবো; …

এই গ্রাম, দক্ষিণ পাড়ার এক ম্লান-মুখ-বউ :

‘ভাই, তুমি এত স্বার্থপর কেন? আমাদের জন্যে

কিছু করো, তোমার বাপের গ্রাম, বাপের কবর

অই নদী ভেঙে দেবে কি করে সইবে তুমি?’ বলে

তিরস্কার করেছিলো যেন। আমি সকলকে ডেকে

হয়তো আশ্বাস কিংবা বিশ্বাসের মৃদু কিছু গান

শুনিয়ে দিয়েছি; কিন্তু জানি, বিশ্বাস তো ভেঙে যাচ্ছে,

ভেঙে যাচ্ছে ভাঙ্গনকে প্রতিরোধ করার প্রয়াস।

আর এর পরপরই কবি মিনতি আর প্রার্থনার যুগ্মতায় নদীর উদ্দেশে বলেছেন :

হে নদী, তবুও তুমি এই গ্রাম কিংবা বাড়িটাকে

ভেঙে আর দিও না দোহাই লাগে, যেখানেই যাই,

যতদূরে পালাই না কেন, আবার ফিরবো আমি

হাজার নদীর ধ্বস খুঁড়ে খুঁড়ে তোমার সম্মুখে।

এতসব হতাশা আর নিরাশার মধ্যেও কবি তাঁর আশাবাদ যেন উজাড় করে দিয়েছেন দেশের প্রতি ভালোবাসায়। আর সেখানেই আমরা দেখতে পাই তাঁর কবিতার শৈল্পিক স্বাতন্ত্র্য। সেই স্বাতন্ত্র্যের সুর দিয়ে কবি আশা-হতাশার যুগল সম্মিলনে উদ্দীপিত হয়ে ‘এইখানে বহু শব, বহু মৃত’ কবিতাটির দ্বিতীয় স্তবকের শেষে এসে বলেছেন :

হায় রে, দুঃখের

রোদে-ওড়া পতাকারা, রক্তে ডোবা যুদ্ধ, স্বাধীনতা,

ভালো থেকো – উজ্জ্বল মুকুট হয়ে মনুষ্য মাথায়

থেকো।

কবি হাসান হাফিজুর রহমান যেমন স্বদেশের উদ্দেশে বলেছিলেন : ‘এবার মোছাব মুখ তোমার আপন পতাকায়।’ সেই একই ধরনের একটি আশাবাদী চেতনা যেন কবিতাটির উপর্যুক্ত লাইনক’টিতে পরিলক্ষিত হতে থাকে। তার সঙ্গে স্বজন হারানোর বেদনার আর্তিটাও অগোপন থাকেনি। শুধু এই পঙ্ক্তি’টিতেই নয়, বলা যায়, গোটা কবিতাটিতেই একইসঙ্গে আশা-হতাশা, আনন্দ-বেদনার যুগ্মতা দেখতে পাওয়া যায়। স্বাধীনতা-প্রাপ্তির আনন্দে কবি উজ্জীবিত, কিন্তু একইসঙ্গে তিনি বেদনার্ত এই কারণে যে, এই প্রাপ্তির জন্যে যে কতটা মূল্য দিতে হয়েছে গোটা জাতিকে, সেইটিও তাঁর অজানা নয়। যে-কারণে নিরঙ্কুশ আনন্দে তিনি নিজেকে ভাসিয়ে দিতে পারছেন না। এটা যেন তাঁর অস্তিত্বের টানাপড়েনেরই আরেকটি অংশ, যাকে কবি কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারছেন না, তিনি অস্বীকার করতে চাইছেনও-না। বক্তব্যের এই অকপটতা তাঁর কবিতাকে আরো শৈল্পিক বিশিষ্টতা প্রদান করেছে।

৫.

মুক্তিযুদ্ধের কবিতা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে শামসুর রাহমান তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেছিলেন, ‘আমরা জানি, নানা দেশের মুক্তিসংগ্রামে কবিতা মানুষকে দীপ্তিমান নক্ষত্রের মতো প্রেরণা জুগিয়েছে, উদ্বুদ্ধ করেছে চরম বিপর্যয়ের মধ্যে দাঁতে দাঁত চেপে থাকতে; ন্যায়, কল্যাণ, প্রগতি ও শান্তির জন্যে লড়াই করতে।’ আর তারই সূত্র ধরে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত কবিতাগুলির বিষয়ে জানিয়েছিলেন – ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেরও কবিতা, আবেগমথিত বাণী, নিগৃহীত, মৃত্যুতাড়িত কিন্তু মুক্তিলিপ্সু ও সংগ্রামশীল জনসাধারণের প্রেরণা হয়ে উঠেছিল।’ সেইসব কবিতার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে শামসুর রাহমানের মতামত হচ্ছে, এই ‘কবিতাবলী আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নান্দনিক দলিল বলে আমি মনে করি। সংকলিত কবিতাগুচ্ছের প্রতিটি পঙ্ক্তিই রসাত্মক বাক্য, এই অসম্ভব দাবি আমি করবো না। তবে এ-কথা নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করবো এইসব কবিতায় বিধৃত হয়েছে অধিকৃত, রক্তাক্ত বাংলার আর্তনাদ, হতাশাপীড়িত মৌন মিছিল, মুক্তিসেনার দৃপ্ত পদধ্বনি, স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা এবং মানবতার জয়গান।’ (হাসনাত, ১৯৮৬ : ১০)

শামসুর রাহমান মুক্তিযুদ্ধের কবিতার যেসব বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছিলেন, সেসবের  সবগুলি না হলেও, কিছু বৈশিষ্ট্য তো জাহিদুল হকের এই কবিতাটিতেও আমরা দেখি, যেখানে আশা-হতাশা-আর্তি-আর্তনাদ-স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা সব একাকার হয়ে একত্রে মিলেমিশে রয়েছে। সেই কারণেই এই কবিতাটি মোটেই একস্তরিক নয়, বরং বহুস্তরিক ও সেইসঙ্গে বহুস্বরের একটা রূপায়ণ যেন এখানে আমরা দেখতে পাই। অনেকটা রিলকের ডুইনো এলিজিগুচ্ছের ধরনে এখানে কবি মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের উদ্দেশে বলেছেন –

তোমাদের জন্য গড়ি সুআশ্রয়, হৃদয়কে খুঁদে

স্মরণ – ভাস্কর্য গড়ি, পতাকাকে সুরবুদ্বুদের

ভেতরে বাক্সময় করি; বারোকের কারুকার্যে ধরি;

তোমাদের রক্তে পলি, তোমাদের স্মৃতি ধন্বন্তরি!

তোমাদের মনে রাখি মৃতগণ, প্রিয় স্বজনেরা।

এইভাবেই কবিতাটির অন্তিম পর্বে এসে আমরা দেখতে পাই যে, কবির কাছে তাঁর স্বদেশ আর স্বদেশের নিহত মানুষগুলি, যাঁরা ছিলেন কবির প্রিয় একান্ত স্বজন – সব একাকার হয়ে একটি বৃত্তে যেন পরিণত হয়েছে। এই কবিতাটির সার্থকতা যদি  কোথাও কিছু থেকে থাকে, সেটি এখানেই। এখানেই কবির কৃতিত্ব নিরতিশয় শৈল্পিক মাধুর্যে প্রকাশিত হয়েছে কবিতাটির প্রতিটি স্তবকে।

৫.২

আরেকটি কথা বলে রাখা দরকার যে, ‘এইখানে বহু শব, বহু মৃত’ কবিতাটি জাহিদুল হকের নের্ভাল, কোথায় যাচ্ছো (র‌্যামন : জানুয়ারি, ২০০৩) কাব্যের অন্তর্ভুক্ত। যে-সময়ে এই কাব্য প্রকাশিত হচ্ছে, সেটি না আমাদের দেশীয়, না আন্তর্জাতিক, কোনো পরিস্থিতিই ঠিক মানবসভ্যতার জন্যে যে কিছুমাত্র অনুকূল  ছিল – সেটি বলা যাবে না। যে-কারণে কবিতাটিতে প্রকাশিত এইসব ‘বিষণ্নতা’, ‘বিপন্নতা’, ‘দুর্ভাগ্য’, ‘হলুদ বিলাপ’, ‘হতাশ্বাস’ – সবকিছুই যেন যাপিত জীবনের একটি স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে হয়। কবিতাটি যেন একজন কবির জীবন-যাপনের স্বাভাবিক অভিজ্ঞতায় বিধৃত। আর স্বাভাবিক বলেই সুন্দর, লাবণ্যময়, শিল্পিত। এখানে আরোপিত কোনো প্রকাশ-ভঙ্গিমা দেখতে পাওয়া যায় না। আর সবকিছুর পরেও কবির নির্ভরতা হচ্ছে – তাঁর নিজস্ব এক স্বদেশভূমি। তাই বারেবারে স্বদেশের প্রতিই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আবেগমথিত স্তুতিগাথা; এটি আবেগমথিত বটে কিন্তু আবেগের আতিশয্য সেখানে নেই, যে-আতিশয্য একটি কবিতার রূপায়ণকে ক্ষুণ্ন করে, ক্লিন্ন করে।

৬.

ইয়েটস (William Butler Yeats) বলেছিলেন, ‘ÔA poet writes always out of his personal life, in his finest work out of its tragedy, whatever it be, remorse, lost love, or mere loneliness.Õ সেইসঙ্গে তিনি এ-ও বলতে ভোলেনি যে, Ôhe never speaks directly as to someone at the breakfast table, there is always a phantasmagoria.Õ (Yeats , 1961 : 509)। এখানে ইয়েটস যে চলমান কল্পচিত্রমালার কথা বলেছেন, সেটিও দেখি জাহিদুল হকের কবিতাটির সমাপ্তিপর্বে এসে। যেখানে তিনি বলেছেন –

চিরকাল সুঘ্রাণের ঘেরা

স্বপ্নের বাড়িতে, প্রান্তরে, দেশে পতাকার রঙে

উৎসবে কি অনুৎসবে, কবিতায়, গানেদের অঙ্গে

তোমাদের পাবো খুবই : তোমাদের স্মৃতিগুলো খুবলে

এনে আলো দেব সূর্যকে, চন্দ্রকে – ভালবাসা উগলে!

এখানে কবির স্বপ্ন-স্বদেশ-আনন্দ-বেদনা-প্রেম-প্রিয়া সবই যেন একাকার হয়ে একসূত্রে গাঁথা রয়েছে। আর তার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই এসে মিলেছে আমাদের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় শব্দের বিবিধ ব্যবহার, নানাবিধ চিত্রকল্পের অবিরল সমারোহ। আঙ্গিকের এইসব কারুকাজ কখনোই এই কবিতাটিকে কর্কশ করে তোলেনি, আবার মোলায়েমও নয়। বরং কবিতাটিকে একটি দৃঢ় মেরুদণ্ড দিয়েছে, এবং সেটি অবশ্যই শৈল্পিক ঋজুতায়।

৭.

কবি শামসুর রাহমান বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের কবিতা আমাদের অস্তিত্বেরই কবিতা।’ (হাসনাত, ১৯৮৬ : ১০)। জাহিদুল হকের কবিতাটি আমাদের সেই অস্তিত্বকেই যেন অন্তর্গূঢ় সূক্ষ্মতায় এক কাব্যিক কাঠামো প্রদান করে। আর সেই কাঠামোর মধ্যে আমরা দেখতে পাই জীবনের বহুস্তরিক অনবদ্য এক বিন্যাস। যে-বিন্যাসের মধ্যে জাহিদুল হকের কবিতাটির শিল্পসুষমা নিহিত।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

১. অনুপম সেন, ২০১৪। বাঙালি-মনন, বাঙালি-সংস্কৃতি : সাতটি বক্তৃতা, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা।

২. আবুল হাসনাত (সম্পাদনা), ১৯৮৬। মুক্তিযুদ্ধের কবিতা [প্রথম প্রকাশ : ১৯৮৪], সন্ধানী প্রকাশনী, ঢাকা।

৩. বুদ্ধদেব বসু (অনুবাদ), ১৯৯১। রাইনের মারিয়া রিলকের কবিতা [প্রথম প্রকাশ : ১৯৭০], এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।

৪. বুদ্ধদেব বসু, ১৯৯৭। কবিতার শত্রু ও মিত্র [প্রথম প্রকাশ : ১৯৭৪], এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড,  কলকাতা।

৫. মাও সে-তুঙ, ২০০৯। রচনাবলীর নির্বাচিত অংশ [প্রথম প্রকাশ : ২০০০], ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।

৬. সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, ১৯৮৪। কাব্যসংগ্রহ (ভূমিকা : বুদ্ধদেব বসু), [প্রথম প্রকাশ : ১৯৬২], দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।

7. Rainer Maria Rilke, 1990. The Notebooks of Malte Laurids Brigge (Translated by Stephen Mitchell), Vintage. International, New York.

8. William Butler Yeats, 1961. Essays and Introducrios, Macmillan and Company Limited, London.