জলের অক্ষরে লেখা

পর্ব : ১৮

দিনগুলো যেন দ্রুত যাচ্ছে এখন। অংশু হঠাৎ করেই কাজের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতি শুক্রবার যাওয়ার কথা থাকলেও দুদিন পরপরই মানিকগঞ্জ যাচ্ছে ও। ঋভুও সুযোগ পেলেই সঙ্গী হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেউথা থেকে টিন-কাঠের তৈরি দুটো রেডিমেড ঘর এনে জমির এক পাশে স্থাপন করা হয়েছে। একটা শ্রমিকদের জন্য, অন্যটা অংশু এবং শুভর জন্য, যখন যে থাকতে চায় থাকতে পারবে। এরকম রেডিমেড ঘর পাওয়া যায়, ঋভুর তা জানাই ছিল না। দেখে ভীষণ চমৎকৃত হয়েছে। শ্রমিকদের ঘরে গোটা কয়েক চৌকি বিছিয়ে বিছানার ব্যবস্থা করা হয়েছে, একপাশে রান্নার ব্যবস্থাও, নিজেদের খাবার ওরা নিজেরাই রান্না করে খায়। অন্য ঘরটিতে দুটো কামরা, খাট পেতে বিছানা তৈরি করা হয়েছে দুটোতেই, চেয়ার-টেবিলসহ অল্প কিছু ফার্নিচারও এসেছে। অস্থায়ী ব্যবস্থা। কাজ শেষ হলে, মানে ভবনগুলো তৈরি হয়ে গেলে, শ্রমিকরা চলে যাবে, হয়তো তখন ঘরগুলো ভেঙে ফেলা হবে কিংবা রেখে দেওয়া হবে অন্য কোনো কারণে। ঋভু আসলে জানে না, অংশুর মনে কী আছে। যতই নকশা দেখাক আর ব্যাখ্যা করুক, কাজ শুরু হলে এ-বিষয়ে আর কথাই বলে না ও। সব শেষ হওয়ার পর সবাইকে ডেকে যখন দেখায়, তখন মনে হয়, নকশায় নয়, এই স্থাপনাগুলো ছিল ওর কল্পনায়। সেটিরই বাস্তব রূপ এখন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। যে গতিতে কাজ চলছে, মাস কয়েকের মধ্যেই ভবনগুলো দাঁড়িয়ে যাবে, সন্দেহ নেই।

আরিয়ানার আসার সময় হয়ে এসেছে। ঋভু অফিস থেকে দু-সপ্তাহের ছুটি নিয়েছে, অংশু-অপলার কাছ থেকেও। নির্দিষ্ট দিনে আরিয়ানাকে নিজেই রিসিভ করতে গেল সে। এয়ারপোর্টের আনুষ্ঠানিকতা সেরে বেরিয়ে এলো ওরা। ঋভুর অনুসন্ধানী চোখ নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিল আগমন পথের দিকে, এতদিন পর ওকে চিনতে পারবে কি না কিংবা সে চিনলেও আরিয়ানা তাকে চিনবে কি না – সেই শঙ্কাও ছিল। একটা প্ল্যাকার্ডে আরিয়ানার নাম লিখে আনা উচিত ছিল। বাসা থেকে বেরোনোর সময় সেটা মনে পড়েনি। এখন মনে পড়লেও লাভ হচ্ছে না কিছু। অবশ্য শঙ্কা কেটে গেল, আরিয়ানা দূর থেকেই তাকে চিনলো, সেও চিনলো ওকে, দুজনেই হাসিমুখে হাত নাড়লো পরস্পরের উদ্দেশে। আরিয়ানার সঙ্গে এক তরুণী, দূর থেকে চেহারা বোঝা যায়নি, কাছে আসতেই বুকে একটা ধাক্কামতন খেলো ঋভু। আরিয়ানার মতো দীর্ঘাঙ্গী, মুখমণ্ডলও হুবহু একইরকম, যেন কুড়ি বছরের আরিয়ানাকেই দেখছে সে। অবশ্য সূক্ষ্ম কিছু পার্থক্যও আছে। আরিয়ানার চুল ছিল সোনালি, এখনো সেরকমই, আর মেয়েটির চুল কালো। মেয়েটির চোখের রং কালো, আরিয়ানার চোখ নীলচে রঙের। গায়ের রংও একটু আলাদা। আরিয়ানা শ্বেতাঙ্গ, তাও ইতালিয়ান শ্বেতাঙ্গ, যাদের গায়ের রঙের খ্যাতি বিশ^জোড়া। মেয়েটি ঠিক সেরকম নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের ফর্সা মেয়েদের রং যেমন হয় তার রং সেরকম। ঋভুর মনে হলো, আরিয়ানা যেভাবে ভারতবর্ষের প্রেমে পড়েছিল, হয়তো কোনো ভারতীয়কেই বিয়ে করেছিল, হয়তো সেই

ভারতীয়-ইতালীয় সংকর এই মেয়েটি। অবশ্য সে এসবের কিছুই বুঝতে দিলো না আরিয়ানাকে। হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালো, হাত মেলালো ওর সঙ্গে। আরিয়ানা মেয়েটিকে দেখিয়ে বললো, দেখো তো ওকে, কিছু আন্দাজ করতে পারো কি না।

– তোমার মেয়ে? জিজ্ঞেস করলো ঋভু।

– হ্যাঁ।

– নাইস টু মিট ইউ। ঋভু বললো মেয়েটির দিকে তাকিয়ে।

– তুমি কেমন আছো? – ঋভুর প্রশ্নের উত্তরে মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে বিশুদ্ধ বাংলায় বলে উঠলো মেয়েটি।

চমকে উঠলো ঋভু। আরিয়ানার দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে বললো, ও দেখি বাংলা জানে!

– সারপ্রাইজড?

– ডেফিনিটলি। কীভাবে শিখলো?

– জানবে। সব জানবে। জানাতেই তো এলাম।

– আচ্ছা। এখন চলো।

গাড়িতে উঠে ঋভু বাংলায় জিজ্ঞেস করলো, তোমার নাম কী মামণি?

– আমার নাম সোফিয়া।

– তুমি মামণি শব্দটি চেনো?

– হ্যাঁ, জানি। তোমরা মাকে মামণি বলে ডাকো।

– আমি তো তোমাকে মামণি বলে ডাকলাম।

– হ্যাঁ, তোমরা কন্যাদেরও মামণি বলে ডাকো।

– বাহ্, অনেক শিখেছ তুমি। বাংলা শিখলে কী মনে  করে?

– ভাষাটা ভালো লাগে, এই দেশ সম্পর্কে জানতে চাই, তাই…

– তুমি তো মেয়েকে পেয়ে আমার কথা ভুলেই গেলে। আমার কোনো খোঁজই নিচ্ছ না। আরিয়ানা অনুযোগের সুরে বললো।

– হা-হা-হা … না, ভুলিনি তোমাকে। নতুন অতিথির সঙ্গে একটু ভাব জমাচ্ছি।

– জমাও জমাও। আমি বাংলা জানি না বলে মনের সুখে দুজন ভাব জমাচ্ছ। মনে থাকবে। – কৃত্রিম অভিমানের সুরে বললো আরিয়ানা।

– হা-হা-হা … এই তো সুযোগ। আমরা দুজনে মিলে তোমার বদনাম করবো, তোমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবো, তাই না মামণি?

– হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব মজা হবে।

এইসব খুনসুটি করতে করতে বাসায় পৌঁছে গেল তারা।

দোতলায় দুজনের জন্য দুটো আলাদা রুম গুছিয়ে রেখেছিল ঋভু। আরিয়ানা সব দেখে বললো, দুই রুমের দরকার নেই তো। আমরা দুজন এক রুমেই থাকতে পারবো।

– রুমগুলো খালিই পড়ে আছে, যেমন তোমাদের ইচ্ছা সেভাবেই থাকো।

আরিয়ানা তাকালো মেয়ের দিকে, মেয়ে ইশারায় জানালো আলাদা রুমেই থাকতে চায়। সেটিই সাব্যস্ত হলো।

ঋভু বললো, তোমরা ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে একটু বিশ্রাম নাও। তারপর তোমাদের নিয়ে বেড়াতে বেরোবো।

আরিয়ানা বললো, পারভেজ, আমার দু-একটা কথা আছে।

– এখনি বলবে?

– হ্যাঁ।

– বলো।

সোফিয়ার দিকে তাকিয়ে আরিয়ানা বললো, তুমি তোমার রুমে যাও। ও চলে গেলে সে ঋভুকে বললো, কোথাও বসে কথা বলা যায় না?

– হ্যাঁ যায়। লিভিংরুমে বসতে পারি বা ব্যালকনিতে যেতে পারি।

– ব্যালকনিতে চলো।

ব্যালকনিতে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দূরে চোখ মেলে দিলো আরিয়ানা। বিকেলের আলো এসে ভাসিয়ে দিচ্ছে সামনের বাগান। হাওয়া কেমন যেন ভেজা ভেজা, বৃষ্টির পর যেমন হয়; কোত্থেকে যেন ভেসে আসছে দারুণ এক সুগন্ধ, সম্ভবত কোনো ফুলের সৌরভ। আরিয়ানা চোখ বন্ধ করে লম্বা করে শ্বাস নিল। সে তো জানে না, এখন এদেশে শরৎকাল, গাছে গাছে শুভ্র রঙের ফুল সৌরভ বিলাচ্ছে। তাই বললো, এত সুন্দর গন্ধ কিসের? কোথাও ফুলগাছ আছে?

– হ্যাঁ, আছে।

– কোথায়?

– বাগানে।

বেশ কিছুক্ষণ চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো আরিয়ানা, যতটুকু দেখা যায়। বললো, বেশ সুন্দর তোমার বাড়িটা।

– হ্যাঁ। তোমরা একটু ফ্রেশ হয়ে নাও। ঘুরিয়ে দেখাবো।

– আমি যেটা জানতে চাই তা হলো, এত বড় বাড়িতে কেউ নেই কেন? তুমি কি একাই থাকো?

– না। কেয়ারটেকার আছে, সিকিউরিটি গার্ড আছে, ড্রাইভার আছে।

– ওদের কথা বলছি না। তোমার আত্মীয়স্বজন কেউ নেই?

– মা-বাবা মারা গেছেন।

– ওহ! স্যরি!

– ইটস ওকে।

– বউ? – আরিয়ানা জিজ্ঞেস করলো আবার।

– বিয়ে করেছিলাম। টেকেনি।

– ও! স্যরি।

– স্যরি বলার কিছু নেই আরিয়ানা। এসব খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।

– কে জানে! হয়তো!

আরিয়ানার দাম্পত্য জীবন নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে ঋভুর খুব ইচ্ছে করছিল। মেয়েকে নিয়ে এসেছে, স্বামী কোথায়? নাকি ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে? কিন্তু এখনই এসব জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না। সময় তো পড়েই আছে। এমনিতেই জানা যাবে।

– তোমার কথা শেষ?

– না, কেবল তো শুরু হলো। কিন্তু এখন আর নয়। সত্যিই ক্লান্ত লাগছে। একটু ফ্রেশ হয়ে নিই।

দুজনেই ফ্রেশ হতে হতে নাশতা তৈরি হয়ে গেল। ঋভু ওদেরকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে এলো, পরিচয় করিয়ে দিলো চাচা-চাচির সঙ্গে। খাওয়া-দাওয়া শেষে ফের দুজন চলে গেল নিজেদের রুমে, বিশ্রাম নেবে বলে। ঋভুও গেল নিজের রুমে। একটু গড়িয়ে নেওয়া যাক।

ওরা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল, সন্ধ্যা পার হওয়ার অনেকক্ষণ পর সাড়াশব্দ পেয়ে ঋভু বেরোলো। আরিয়ানার রুমে নক করে ডাকলো, উঠেছ আরিয়ানা?

– হ্যাঁ। আসছি।

একটু পর বেরোলো আরিয়ানা। পোশাক পাল্টেছে। নীল স্কার্টের সঙ্গে পরেছে সাদা রঙের শার্ট। কী যে সুন্দর লাগছে ওকে! চেহারায় বয়সের সামান্য ছাপ ছাড়া ওর ভেতরে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। অবশ্য একটা ক্লান্ত ভাব আছে মুখমণ্ডলে, হয়তো দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি। নিজের রুম থেকে বেরোলো সোফিয়াও। ফ্রেশ হয়েছে বলে আরো সুন্দর লাগছে ওকে। আরিয়ানার কুড়ি বছর আগের চেহারা।

ঋভু বললো, তাহলে রেডি তোমরা! চলো বেরোই।

ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখানো হলো না। রাতের বেলা এ-বাড়ির সৌন্দর্য ওরা বুঝতে পারবে না। ঋভু বললোও সে-কথা। ড্রাইভারকে বললো, তোমার যেতে হবে না, আমিই যাচ্ছি। তারপর নিজে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলো। আরিয়ানা বসলো তার পাশের সিটে, পেছনে সোফিয়া।

এই রাতের বেলা অবশ্য কোথাও যাওয়ার নেই। তবু ঘণ্টাখানেক এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ালো ওদের নিয়ে, রাতের শহর দেখাবে বলে। ইচ্ছে করেই যানজটের জায়গাগুলো এড়িয়ে গেল ঋভু। প্রথম দিনেই এই শহর সম্বন্ধে খারাপ কোনো ধারণা দিতে চায় না ওদেরকে।

বাসায় ফিরে ডিনার করে নিল তাড়াতাড়িই। বললো, আজকে তোমরা ঘুমিয়ে পড়ো। কাল থেকে আমাদের বেড়ানো শুরু হবে।

আরিয়ানা আবার বললো, সোফি ঘুমাক। আমি তোমার সঙ্গে গল্প করবো।

ঋভু সোফিয়ার দিকে তাকালো, ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল ও।

আরিয়ানা ফিসফিসিয়ে বললো, তোমার রুমে চলো।

– মেয়ে জানে কিছু?

– হ্যাঁ, সব জানে। কিছুই লুকাইনি।

– ভালো করেছ।

– কিন্তু তোমার কাছে একটা ব্যাপার লুকিয়েছি।

– কী সেটা?

– বলবো। রুমে চলো।

রুমে এসে অবশ্য কথা বলার সুযোগ দিলো না আরিয়ানা, তীব্র আলিঙ্গনে ঋভুকে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘ এক চুমু দিলো সে। ঋভুও নিবিড় করে জড়িয়ে রাখলো তাকে। চুম্বন শেষ হলো না, শুরু হলো আবার। তারপর একসময় দুজনেই

স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গেল। বিছানায় গিয়ে ফিরিয়ে আনলো পুরনো দিনের স্মৃতি।

আরিয়ানা বললো, তুমি দেখছি আগের মতোই আছো।

– তুমিও তো আগের মতো আছো।

– সত্যি?

– হ্যাঁ, সত্যি। তেমনই সুন্দর আর আকর্ষণীয়।

– থ্যাংক ইউ।

– ওয়েলকাম। তুমি যেন কী বলতে চেয়েছিলে!

– ও হ্যাঁ। জানি না তুমি কীভাবে নেবে…

– ওসব ভেবো না। বলে ফেলো।

– মেয়েকে দেখে তুমি কিছু বুঝতে পারোনি?

– কী বুঝবো?

– কিছু ভাবোনি?

– তা ভেবেছি।

– কী ভেবেছো শুনি।

– তোমার সঙ্গে অনেক মিল। কুড়ি বছর আগে তুমি যেমন ছিলে, অবিকল তেমনই।

– একেবারে একরকম? কোথাও পার্থক্য নেই?

– হ্যাঁ, তা আছে।

– কী সেটা?

– ওর চুল আর চোখ কালো, গায়ের রংও একটু অন্যরকম।

– কেন এরকম হলো ভাবোনি?

– ওর বাবা কি ভারতীয়?

– কাছাকাছি গেছো। – আরিয়ানা মিটিমিটি হাসছিল।

– আহা, এত রহস্য করছো কেন? বলো না!

– এখনো বোঝোনি?

– কী বোঝার কথা বলছো?

– ওর নামটা শুনেছ?

– হ্যাঁ, শুনলাম তো!

– পুরো নামের কথা বলছি।

– না, ওটা তো শোনা হয়নি।

– ওর পুরো নাম সোফিয়া আরিয়ানা পারভেজ।

হতভম্ব হয়ে গেল ঋভু – মানে?

– ও তোমার মেয়ে।

এবার বিদ্যুতের শক খাওয়ার মতো চমকে উঠলো ঋভু, বললো, আমার মেয়ে? আমার?

– হ্যাঁ।

– কীভাবে বুঝলে?

– কীভাবে আবার, আমি ওর মা তো!

– তা তো বুঝলাম। কিন্তু তুমি নিশ্চিত হলে কীভাবে?

– নিশ্চিত না হয়ে উপায় কী? নেপালে আমরা একসঙ্গে ছিলাম না?

– হ্যাঁ, ছিলাম। তখনই কি …

– হ্যাঁ। তখনই আমি কনসিভ করেছিলাম। তুমি আমার প্রথম পুরুষ। তোমার সঙ্গে মিলনের আগে আর কোনো পুরুষের কাছে যাইনি আমি। এমনকি পরেও বহুদিন পর্যন্ত আর কোনো পুরুষ ছিল না আমার জীবনে।

– হুম।

– তখন এত অল্প বয়স ছিল, কিছুই বুঝতাম না। পাগলের মতো তোমার সঙ্গে ওইসব করলাম। তারপর গেলাম ভারতে। কিছুদিন ঘুরেটুরে ফিরে গেলাম দেশে।

– তারপর?

– তখন তো আমি বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ি। গ্রীষ্মের ছুটি শেষ হয়ে ক্লাস শুরু হলো। কিন্তু আমার কিছুই ভালো লাগতো না। মন তো এলোমেলো ছিলই, কেবলই তোমাকে মনে পড়তো, কিন্তু শরীরও খুব খারাপ লাগতো।

– কনসিভ করেছো বুঝলে কী করে?

– মা-ই আন্দাজ করেছিল। টেস্ট করে দেখা গেল কনসিভ করেছি।

– তারপর?

– তার আর পর কী?

– তোমার মা-বাবা কিছু বললেন না?

– বললেন না আবার! বড় হয়ে গেছি, বেশি কিছু তো করতে পারেন না, কিন্তু খুব চাপ দিতে লাগলেন অ্যাবরশনের জন্য।

– তুমি রাজি হলে না কেন?

– রাজি হবো কেন? আমার প্রথম বাচ্চা …

– কিন্তু তোমার তো তখনো বিয়েই হয়নি।

– তা হয়নি। কিন্তু প্রেম তো হয়েছে। তোমাকে ভালো তো বেসেছি। আর ও তো আমার কাছে তোমার অমূল্য স্মৃতি।

– হুম। তারপর?

– তারপর সময়মতো মেয়ে হলো। বাবা-মা বললেন, তুমি এবার নিজের পথ দেখো। আমিও বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম।

– বলো কী!

– কী করবো বলো? বাঁচতে তো হবে।

– তখনো তো তোমার সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। তুমি আমাকে জানাওনি কেন?

– জানিয়ে কী হবে? আমার যেমন প্রস্তুতি ছিল না, তুমিও নিশ্চয়ই এই ধরনের ঘটনা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলে না?

– তা ছিলাম না।

– তাছাড়া দুজন থাকি দুই দেশে। এটা জানালে একটা  অবলিগেশন তৈরি হয় না? তোমাকে যেতে হতো ওখানে, নইলে আমাকে আসতে হতো এখানে।

– হুম। দুজনের জন্যই সেটা কঠিন ছিল।

– শুধু কঠিন না, অসম্ভব ছিল।

– তারপর?

– তারপর তো দেখতেই পাচ্ছো।

– বিয়ে করলে কবে?

– বিয়ে করিনি তো!

– করোনি! একা আছো?

– মেয়েকে নিয়ে আছি।

– অন্য কোনো সম্পর্কেও জড়াওনি?

– তা জড়িয়েছি। মনের নয়, শরীরের। মন কথা শোনে, শরীর তো সবসময় কথা শোনে না।

– দারুণ বলেছো। মেয়েকে জানিয়েছো কবে?

– বেশিদিন হয়নি। ওর যেদিন আঠারো বছর বয়স হলো, সেদিন ঘটা করে জানিয়েছি।

– ওর প্রতিক্রিয়া কী ছিল?

– স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে।

– না-ও তো নিতে পারতো!

– ছোটবেলা থেকে তো দেখেছে ওর বাবা নেই। জিজ্ঞেস করলে মাও ঠিক করে কিছু বলে না। নিশ্চয়ই কিছু আন্দাজ করেছিল।

– বিভিন্ন সময় ওর নিশ্চয়ই বাবার নাম লিখতে হয়েছে! পারভেজ নাম দেখে কিছু জানতে চায়নি?

– চায়নি আবার!

– কী উত্তর দিয়েছো?

– এড়িয়ে গিয়েছি।

– এত বড় একটা ব্যাপার কীভাবে এড়িয়েছো?

– একেক সময় একেকভাবে।

– খুবই স্ট্রাগল করতে হয়েছে তোমাকে আরিয়ানা। আমি কোনো দায়িত্বই পালন করিনি। স্যরি।

– আরে ধুর। তুমি জানলে তো দায়িত্বের প্রশ্ন আসে।

– ও জানার পর কী করলো?

– বাংলাদেশ সম্পর্কে খুব আগ্রহ তৈরি হলো। বাঙালিদের স্কুলে গিয়ে বাংলা শিখতে শুরু করলো। দু-বছর টানা শিখেছে। কেমন শিখেছে ও?

– খুবই চমৎকার। এত সুন্দর করে বাঙালিরাও কথা বলে না। ও কি পড়তেও পারে?

– পড়তে পারে, লিখতে পারে, বলতে তো পারেই।

– বাহ্! কী দারুণ ব্যাপার।

– বাবার দেশ, বাবার ভাষাকে সে ভালোবেসে ফেলেছে না দেখেই।

ঋভু দুই হাত বাড়িয়ে দিলো আরিয়ানার দিকে, বললো, এসো, আমার কন্যার মা, আমার কাছে এসো।

আরিয়ানা এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো ঋভুর বুকে। তারপর অবিরল কান্নায় ভাসিয়ে দিলো তাকে।

– কাঁদছো কেন, আরিয়ানা?

– আমি ভাবতেও পারিনি, তুমি এত সহজভাবে নেবে ব্যাপারটা।

– কেন ভাবোনি?

– নেপালে ঝোঁকের মাথায় আমরা একসঙ্গে থাকতে শুরু করেছিলাম। ঝুঁকির কথা ভাবিনি। তারপর আমি যখন জানলাম যে কনসিভ করেছি, খুব ভেবেচিন্তে নিজেকে তৈরি করেছি। কিন্তু তুমি তো টেরও পাওনি। হঠাৎ শুনে যদি অবিশ^াস করো, যদি নেগেটিভলি রিঅ্যাক্ট করো, এইসব ভয় ছিল।

ঋভু গভীর চুমুতে সিক্ত করলো আরিয়ানাকে। ফিসফিসিয়ে বললো, আমার কন্যার মা তুমি, আমার বউ…

লাজুক হাসলো আরিয়ানা।

– চলো বউ, তোমাকে একটু আদর করি।

আহ্লাদি ভঙ্গিতে ঋভুর গলা জড়িয়ে ধরলো আরিয়ানা। ফের দুজন গেল বিছানায়। কিন্তু এবার শরীরের ভাষা গেল পাল্টে। দুজনের শরীর কথা বলে উঠলো মায়ার ভাষায়, আবেগের ভাষায়, পরম কিছু পাওয়ার আনন্দে বিভোর এক ভাষায়।

আনন্দ, তৃপ্তি আর আবেগভরা সঙ্গমের পরও দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে রইলো অনেকক্ষণ, পরস্পরের শরীরে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো মায়াভরে। একসময় ঋভু বললো, ওঠো, ফ্রেশ হয়ে নাও। তারপর গিয়ে দেখো তো আমাদের মেয়ে ঘুমিয়েছে কি না।

– কেন?

– না ঘুমালে ডেকে আনো। ওকে বলো, তুমি আমাকে সব জানিয়েছ।

– আচ্ছা, যাচ্ছি।

আরিয়ানা নয়, কিছুক্ষণ পর সোফিয়া এসে দাঁড়ালো দরজায়। ঋভু দু-হাত মেলে ডাকলো, এসো মামণি।

সোফিয়া এলো না, দরজায় দাঁড়িয়ে অপলক তাকিয়ে রইলো ঋভুর দিকে। তারপর একসময় তার দু-চোখ ভরে উঠলো জলে। ঋভু হাত বাড়িয়েই রইলো আর চোখভরা জল নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে মেয়ে। যেন এক স্থিরচিত্র – চিরন্তন, অপরিবর্তনীয়। একটু পরই সচল হলো ছবিটা, দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলো মেয়ে আর ঋভু এগিয়ে গিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে এলো রুমের ভেতরে। মেয়ে মুখ গুঁজে রাখলো বাপের কাঁধে আর ঋভু কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলতে লাগলো, মা, আমার মামণি, আমার সোনামণি, আমার লক্ষ্মী সোনা চাঁদের কণা …

সোফিয়া মুখ তুলে মিষ্টি করে জানতে চাইলো – এই

কথাটার মানে কী? 

ওর চোখে জল আর ঠোঁটে মৃদু হাসি। কী যে মিষ্টি লাগছে ওকে!

– কোনটা মামণি?

– এই যে বললে, লক্ষ্মী সোনা চাঁদের কণা…

– এটা আদরের একটা এক্সপ্রেশন। মা-বাবা ছোট বাচ্চাদের আদর করে বলে। চাঁদের কণা মানে আ টাইনি পিস অফ মুন।

– ইস! কী সুন্দর এই ভাষাটা!

– হুম খুব সুন্দর। দেশটাও সুন্দর। তোমাকে নিয়ে আমি সারাদেশ ঘুরে বেড়াবো।

– আর মা?

– তোমার মাকে কি আর রেখে যাবো? একসঙ্গেই ঘুরে বেড়াবো সবাই।

ঋভু হঠাৎ খেয়াল করলো, আরিয়ানা এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে। তারও চোখভরা জল। বাপ-মেয়ের মিলনদৃশ্য দেখছে অপলকে। ঋভু তার দিকে হাত বাড়ালো। আরিয়ানা দ্বিধা করলো না। এগিয়ে এসে ঋভুর হাতে ধরা দিলো। এক হাতে আরিয়ানাকে, আরেক হাতে মেয়েকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ঋভু।

সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে ঋভুর কাছে। মনে হচ্ছে, তার জীবনে নয়, এসব ঘটে চলেছে কোনো না-দেখা সিনেমার দৃশ্যে। এরকম কখনো ঘটে নাকি কারো জীবনে? কেউ কি দেখেছে কখনো? দেখা তো দূরের কথা, শুনেছে কেউ এরকম ঘটনার কথা?

তিনজন বসে কিছুক্ষণ গল্প করলো, ঠিক হলো কাল থেকেই তাদের ভ্রমণ শুরু হবে। ঢাকা এবং এর আশেপাশে ঘুরে তারপর যাবে ঢাকার বাইরে।

ঋভু বললো, অনেক রাত হয়েছে মামণি, ঘুমিয়ে পড়ো।

মেয়ে মা এবং বাবাকে চুমু দিয়ে চলে গেল।

ঋভু জিজ্ঞেস করলো, তুমি তোমার রুমে ঘুমাবে, নাকি আমার সঙ্গে?

একটু লজ্জামাখা হাসি নিয়ে আরিয়ানা বললো, তোমার কী ইচ্ছে?

– আমার তো ইচ্ছে তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাই। তোমার?

– আমারও তেমনই।

ভোরে ঘুম ভেঙে গেল ঋভুর। দেখলো, আরিয়ানা কাত হয়ে শুয়ে আছে, ওর একটা হাত ঋভুর বুকের ওপর, ঠিক জড়িয়ে ধরা নয়, ফেলে রাখা। হয়তো জড়িয়েই ধরেছিল, ঘুমের ভেতরে হাত আলগা হয়ে গেছে। ওর ভারী স্তন লেগে আছে তার শরীরের সঙ্গে। মুখমণ্ডলে গভীর ক্লান্তি, তবু কী স্নিগ্ধ! গতকাল থেকেই ওকে এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন, বুঝতে পারলো না ঋভু। অবশ্য ওর স্নিগ্ধ সৌন্দর্য এতটাই মনকাড়া যে, ক্লান্তিটা সহজে চোখে পড়ে না। মনে হয়, সব ঠিকই আছে। এই এখন যেমন, পরম নির্ভরতায়-নিশ্চয়তায় সে ঘুমাচ্ছে। কোনো উদ্বেগের চিহ্ন নেই, যন্ত্রণার চিহ্ন নেই, বেদনার চিহ্ন নেই। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। তার পাঁচ বছরের দাম্পত্যজীবনে কখনো কি রিনি তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে? মনে পড়ে না। পাশ ফিরে শুতো সে, মুখ থাকতো বিপরীত দিকে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনে হতো, ওর মুখ বিষণ্নতায়-ক্লান্তিতে ম্লান হয়ে আছে।

আরিয়ানার হাত আলগোছে সরিয়ে উঠলো ঋভু। বাথরুমে গিয়ে আবশ্যিক প্রাতঃকার্যাদি সেরে ব্যালকনিতে এলো। দেখলো, সোফিয়া রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে। সম্ভবত ঋভুর পায়ের শব্দ শুনে থাকবে সে, ফিরে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললো, গুড মর্নিং বাবা।

ঋভুর বুকে ধাক্কা লাগলো। এই প্রথম বাবা ডাক শুনলো সে, গত রাতেও মেয়েটা তাকে ডাকেনি। এর আগে অন্য কেউ তো ডাকার প্রশ্নই ওঠে না। ডাকটা যে এত মধুর, সে কোনোদিন বুঝতেই পারেনি।

– গুড মর্নিং মামণি। ঘুম কেমন হলো?

– খুব একটা ভালো না।

– কেন? কী হয়েছে?

– সারা রাত কী সব স্বপ্ন যেন দেখেছি।

– নতুন জায়গা তো, হয়তো একটু অস্বস্তি লেগেছে তোমার।

– না, তা লাগছে না। তোমার বাড়িটা তো খুব সুন্দর।

– এটা কিন্তু তোমারও বাড়ি মা।

– আমার? আমার কীভাবে?

– তুমি আমার মেয়ে যে! আমার সবকিছুই তো তোমার!

– কিন্তু এই বাড়ি দিয়ে আমি কী করবো? – হাসছে সোফিয়া।

– তোমার যা ইচ্ছা তাই করবে।

– আমি যদি বিক্রি করে দিয়ে ওই দেশে চলে যাই?

– তাও করতে পারো।

– তোমার মন খারাপ হবে না?

– হবে মা। নিশ্চয়ই মন খারাপ হবে।

– স্বাভাবিক, এত বড় এত সুন্দর বাড়ি …

– বাড়ির জন্য না মামণি, অন্য কারণে মন খারাপ হবে।

– কী সেটা?

– নিচে চলো, তোমাকে দেখাচ্ছি।

– মাকে নিয়ে যাবে না?

– ও ঘুমাচ্ছে এখনো। পরে নিয়ে যাবো। চলো।

– আচ্ছা চলো।

মেয়েকে নিয়ে নিচে নামলো ঋভু। প্রথমেই নিয়ে গেল

মা-বাবার রুমে, বললো, এই রুমে তোমার দাদা-দাদু

থাকতেন।

– এখন কোথায় থাকেন?

– তা তো বলতে পারবো না মা।

– কেন? তোমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই?

– না, মা। যোগাযোগের উপায়ই নেই।

– কেন?

মেয়েটা এখনো কত সরল, ভাবলো ঋভু। বুঝতেই পারছে না, ওনারা মারা গেছেন। বললো, যেখানে গেলে আর ফেরা যায় না, ওনারা সেখানে চলে গেছেন।

– ও!

– তুমি বুঝেছো?

– হুম। কিন্তু ঘরটা দেখে মনে হচ্ছে, এখনো আছেন। হয়তো কোথাও বেড়াতে গেছেন।

– হ্যাঁ। ওনারা থাকতে যেমন ছিল, ঘরটা তেমনই রেখে দেওয়া হয়েছে।

– ও!

ঋভু এবার ওকে নিয়ে গেল বাবার পড়ার ঘরে। এখনো প্রচুর বই। কেউ আর ওসব পড়ে না এখন। অবাক হলো সোফিয়া, এত বই! তুমি খুব পড়ো বুঝি?

– আমি না, তোমার দাদা পড়তেন।

– ও আচ্ছা।

নিচতলাটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে বাইরে এলো ঋভু। মেয়েকে নিয়ে বাগানে গেল। এখন শরৎকাল। সাদা রঙের সব ফুল ফুটে আছে। বেলি, টগর, কাঠগোলাপ, শিউলি। মেয়েকে ফুল চেনালো ঋভু, চেনালো নানা জাতের গাছ, তারপর গেল দক্ষিণ দিকের সেই জায়গাটিতে, নীলু যেখানে ঘুমিয়ে আছে চিরদিনের জন্য।

শ্বেতপাথরে বাঁধাই করা কবর না চেনার কিছু নেই, সোফিয়াও চিনলো। বললো, এটা কার সমাধি?

ঋভু বললো, আমার বোনের।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো সোফিয়া। তারপর বললো, তোমার একটা বোন ছিল, মায়ের কাছে সে-কথা কখনো শুনিনি।

– তোমার মা জানতো না। বলার সুযোগই হয়নি।

– মায়ের সঙ্গে যখন তোমার পরিচয় হলো, তখন তোমার বোন কত বড়?

– ওর বয়স সবসময় একই রয়ে গেছে। বাড়েনি।

– মানে?

– ও মারা গেছে ন-বছর বয়সে! আমার বয়স তখন তেরো।

– ও! অনেক বছর হয়ে গেল, না?

– হ্যাঁ, অনেক বছর। কিন্তু আমার মনে হয়, এই তো সেদিনের ঘটনা।

– হুম।

– ও বেঁচে থাকলে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক কী হতো, জানো?

– হ্যাঁ, জানি। কিন্তু বাংলা শব্দটা ভুলে গেছি।

– ও হতো তোমার ফুপু।

– হ্যাঁ, হ্যাঁ, ফুপু! আরেকটা শব্দ আছে না?  

– আছে। পিসি।

– দুটো শব্দ কেন?

– একই ডাকের জন্য একাধিক শব্দ থাকে না? যেমন মাকে আমরা কত নামে ডাকি, বাবাকেও। – ঋভু বুঝতে দিতে চাইলো না, দুটো শব্দ দুই ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষ ব্যবহার করে। একসময় ঠিকই বুঝে যাবে। কিন্তু শুরুতেই এসব ব্যাপার বোঝানোর দরকার নেই – এই জল আর পানি, ফুপু আর পিসি, খালা আর মাসি, শব্দ দিয়ে মানুষকে বিভাজনের এইসব উদ্ভট রীতি এখন না-ই বা জানলো ও। 

– হ্যাঁ। তা অবশ্য ঠিক। সোফিয়া বললো।

– এদেশে ফুপু-খালার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের সম্পর্ক খুব মধুর হয়। নিজের সন্তানের মতোই তারা ভালোবাসে ভাইবোনের ছেলেমেয়েদের।

– হ্যাঁ, শুনেছি। তোমাদের সম্পর্কগুলো খুব চমৎকার।

– তুমি কাছে যাও, ফুপু বলে ডাকো।

– আমি ডাকলে শুনবে?

– নিশ্চয়ই শুনবে। গিয়ে বলো, ফুপু আমি এসেছি। আমাকে আদর করো।

সোফিয়া সত্যিই গিয়ে কবরের পাশে হাঁটু গেড়ে বসলো। কবরের ওপর সবুজ ঘাস, সেখানে হাত বুলাতে বুলাতে ফিসফিস করে কথা বলতে লাগলো অনেকক্ষণ ধরে। তারপর চোখভরা জল নিয়ে ফিরে তাকালো ঋভুর দিকে, ডাকলো হাত ইশারায়।

ঋভু এগিয়ে গেলে বললো, ফুপুকে তুমি একটু আদর করে দাও বাবা।

– তোমাকে বলেছে বুঝি!

– হ্যাঁ।

ঋভুও বসলো মেয়ের পাশে, হাঁটু গেড়ে। হাত বুলিয়ে আদর করলো অনেকক্ষণ ধরে। নিজের ভেজা চোখ আড়াল করতে চাইলো মেয়ের কাছে, পারলো না। সোফিয়া গভীর আবেগে আলিঙ্গন করলো বাবাকে। ফিসফিসিয়ে বললো, আমি বুঝেছি বাবা, আমি বুঝেছি।

– কী বুঝলে মা?

– এই বাড়ি বিক্রি করলে কেন তোমার খারাপ লাগবে, আমি বুঝেছি। শুধু এই জায়গাটুকুর জন্য, ছোট্ট এই জায়গাটুকুর জন্য, তাই না বাবা?

ঋভু চুপ করে তাকিয়ে রইলো মেয়ের দিকে। কী করে বুঝলো এই ছোট্ট মেয়েটা? অনেকেই তো বোঝে না যে, কোনো স্বজন ছাড়াই ঋভু কেন এই বাড়িতে বছরের-পর-বছর ধরে পড়ে আছে, কেন কোথাও গেলে বেশিদিন এই বাড়ি ছেড়ে থাকতে পারে না। বোঝে না, কী নিয়ে থাকে সে, কার জন্য থাকে।

সোফিয়া কত সহজেই বুঝলো! সন্তান কি তাহলে অন্য সবার চেয়ে সহজে বোঝে তার বাবাকে, মাকে? 

আরিয়ানার ঘুম ভাঙলো আরো অনেকক্ষণ পর। দেখলো, ঋভু নেই রুমে। বেরিয়ে নিজের রুমে গিয়ে প্রাতঃকার্যাদি সেরে রাতের পোশাক পাল্টে ব্যালকনিতে এলো। দেখলো, বাপ-মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাগানে, দুজনের মুখেই হাসি। সোফিয়া বোধহয় কিছু জিজ্ঞেস করেছে, ঋভু গাছের পাতা ধরে চেনাচ্ছে, ফুল কাছে এনে দেখাচ্ছে। কী মধুর এক দৃশ্য! আরিয়ানা চোখ ভরে দেখলো অনেকক্ষণ। তারপর গলা উঁচু করে সোফিয়াকে ডাকলো। ফিরে তাকালো দুজনেই। সোফিয়াও গলা উঁচু করে হেসে বললো, গুড মর্নিং মা।

সম্বোধনটা ঋভুর কান এড়ালো না। কাল রাতেও ডেকেছে মাম্মি বলে, মা বললো আজই।

– গুড মর্নিং। – ওপাশ থেকে বললো আরিয়ানা – তোমরা আমাকে না নিয়েই বেড়াতে গেছো যে!

– নিচে নেমে এসো। অত ওপর থেকে কথা বললে কি বেড়াতে যাওয়া যায়?

– দাঁড়াও আসছি!

একটা মোক্ষম খোঁচা দেওয়া গেছে মাকে, এই কথা বলে খুব হাসছিল সোফিয়া, ঋভুও যোগ দিলো হাসিতে। আরিয়ানা এসে চোখ পাকিয়ে বললো, কী নিয়ে এত হাসাহাসি হচ্ছে শুনি?

– বাবা-মেয়ের হাসাহাসিতে এত নাক গলানো ঠিক নয় মা।

– বাপরে! মেয়ে তো একদিনেই কথা শিখে গেছে! নিয়ে এলাম শান্তশিষ্ট একটা মেয়ে, বাপকে পেয়ে এখন মাকেই হুল ফোটায়!

– এত হিংসা করো কেন? – ঋভু বললো – বাপের সামনে কন্যারা একটু আহ্লাদ করেই।

– তাই তো দেখছি!

সোফিয়া বললো, শোনো মা, চলো তোমাকে বাগান দেখাই। আজকে কত গাছ যে চিনলাম! তোমাকেও চেনাবো। দেখি ঠিকঠিক মনে রাখতে পেরেছি কি না। বাবা, তুমি আজকে আমার গাইড। ভুল হলে ঠিক করে দেবে, আচ্ছা?

– আচ্ছা মা, দেবো।

সোফিয়ার একটা ভুলও হলো না। সবগুলো গাছ আর ফুলের নাম ঠিকঠিক বলে গেল। তারপর ঋভুর দিকে তাকিয়ে বললো, ঠিক বলেছি বাবা?

– হ্যাঁ, সবগুলো ঠিক বলেছো।

– তাহলে তুমি এখন গিয়ে দেখো তো, ব্রেকফাস্ট রেডি হয়েছে কি না। খিদে পেয়েছে। আমি ততক্ষণে মাকে আরেকটু ঘুরিয়ে দেখাই।

– আচ্ছা, মা, যাচ্ছি।

ঋভু বুঝলো, মায়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ একান্ত সময় চায় সোফিয়া, বুদ্ধি করে তাই বাবাকে সরিয়ে দিলো। মৃদু হাসলো ঋভু। মেয়েটা যেমন বুদ্ধিমতী, তেমনই মায়ায় ভরা মন। বাবা যেন কষ্ট না পায় সেজন্য নাশতার কথা বলেছে।

ঋভু চলে যেতেই সোফিয়া বললো, তোমাকে একটা বিশেষ ব্যাপার দেখাবো। ওইদিকে চলো।

– কী এমন বিশেষ ব্যাপার?

– আহা চলোই না। দেখলেই বুঝবে।

মাকে নিয়ে নীলুর কবরের কাছে গেল সোফিয়া। চমকে উঠলো আরিয়ানা, কার কবর এটা?

– আমার ফুপুর, মানে বাবার বোনের।

– ওর বোন ছিল, জানতাম না তো!

– হ্যাঁ ছিল। নয় বছর বয়সে মারা গেছে, বাবার বয়স ছিল তখন তেরো।

– ও! আমার সঙ্গে যখন নেপালে দেখা হলো…

– তার আগেই।

– ও কিছুই বলেনি। অবশ্য পারিবারিক বিষয়ে আমাদের ততটা কথা হয়ওনি।

– হুম। বুঝতে পেরেছি।

আরিয়ানা চুপ করে পুরনো দিনের কথা ভাবছিল, ঋভু মাঝেমধ্যে আনমনা হয়ে যেত, বিষণ্ন হয়ে যেত। এটাই কি কারণ ছিল?

সোফিয়া বললো, বাবার ভেতরে খুব বড় একটা দুঃখ আছে, তাই না মা?

– হুম, তাই তো মনে হয়।

– বাবার কেউ নেই। এত বড় বাড়িতে একা থাকে। কী অদ্ভুত না?

– হ্যাঁ, খুবই অদ্ভুত।

– আমার এত মায়া লাগছে … বলতে গিয়ে গলা ধরে এলো সোফিয়ার।

আরিয়ানা ওর হাত ধরে বললো, এখন তো তুমি আছো।

– কীভাবে আছি বলো? আমি কি আর এখানে থাকবো?

– চাইলে থাকতে পারো।

– তোমাকে ছাড়া আমি থাকবো কীভাবে?

– একদিন না একদিন তো পারতেই হবে মা। আমি কি আর সারাজীবন থাকবো?

– এসব বলো না। আমার ভয় লাগে।

– ভয়ের কিছু নেই। যা তুমি জানো সেই সত্যকে সহজভাবে নাও। এমনকি তুমি না জানলেও সত্য যখন সামনে এসে দাঁড়াবে, তা যত কঠিনই হোক, সহজভাবে নিতে চেষ্টা করো।

– থাক। এখন এসব নিয়ে কথা না বললাম।

নাশতা অনেক আগেই তৈরি হয়ে গেছে, ঋভু ইচ্ছে করেই মা-মেয়েকে কিছুটা সময় দিয়েছিল, এবার বারান্দায় এসে ডাকলো – নাশতা তৈরি। তোমরা ভেতরে এসো। (চলবে)