সম্পর্কের অন্তরালের রূপ-অরূপ

বাংলা ঐতিহ্যবাহী নাট্যরীতিতে জীবনকে ব্যাখ্যামূলক দৃষ্টিতে দেখানো হলেও ইউরোপীয় নাট্যরীতিতে জীবনের দ্বন্দ্বই প্রধান। কনস্ট্যানটিন স্তানিসøাভস্কি যখন বলেন, ‘নাটকে বাহ্যিক অ্যাকশন নয়, মানসিক অ্যাকশনই অ্যাকশনের আত্মা।’ কিন্তু ঊনিশ শতকের দার্শনিক-নন্দনতাত্ত্বিক বেনেদোত্তো ক্রোচে যখন প্রশ্ন করেন, ‘সুন্দরী নারীর সৌন্দর্যবর্ধন করে যে অলংকার তার মূলে কী আছে স্বর্ণটুকু?’ তখন শিল্পের অন্তর্গত সৌন্দর্যের দিকেই সাধারণত দর্শকের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। সম্প্রতি দর্শকদের দৃষ্টি তেমনি আকর্ষণ করেছে দৃষ্টিপাত নাট্যদলের সে এক স্বপ্নের রাত নাটকটি। এই নাটকের মূলসুর নারী-পুরুষ সম্পর্কের রহস্যের স্বরূপ উন্মোচন। নাটকটিতে কাহিনির কোনো ঘনঘটা নেই। মধ্যবিত্ত এক দম্পতির সম্পর্কের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা গভীর ক্ষত, প্রেম-ভালোবাসা, অবিশ্বাস-সন্দেহের দোলাচলে মানবীয় অবক্ষয় এ-নাটকের উপজীব্য। নাটকটি রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন খন্দকার তাজমী নূর। দৃষ্টিপাত নাট্যদল তাদের পঁচিশতম প্রযোজনা হিসেবে নাটকটি মঞ্চে এনেছে।

নাটকের প্রধান চরিত্র অর্ণব চৌধুরী একজন লেখক। তার গল্পের অনামিকা কী সত্যি আত্মহত্যা করেছিল? নাকি তাকে মেরে ফেলা হয়েছিল? ঝড়ের রাতে এমনই এক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে উঠে আসতে থাকে রহস্যের অন্তরালকথা। এ-নাটকে অর্ণব-বেলার ভালোবাসা ও সন্দেহ একই রেখায় বাস করে। নাট্যকার প্রশ্ন তোলেন, গভীর ভালোবাসায় সন্দেহ কী অবশ্যম্ভাবী? কিংবা প্রত্যেকে অবচেতন মনে কি বয়ে বেড়ায় আধিপত্যের দণ্ড? দুটি চরিত্রের ঘাত-প্রতিঘাত, টানাপড়েন ও নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে নাটকটি আবর্তিত। লেখক মানেই কী আত্মঘাতী? বাস্তবতাহীন অরূপের মায়া যাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। কিংবা বিরহ বাতাসের মগ্নতা যাকে আনন্দ দেয়? 

প্রসেনিয়াম নাট্যরীতিতে স্তানিস্লাভস্কির বাস্তববাদী অভিনয় ধারায় নাটকটি উপস্থাপিত। নাটকের মূল চরিত্রদ্বয়ের একজন অর্ণব চৌধুরী, যে-চরিত্রে নাট্যকার-নির্দেশক খন্দকার তাজমী নূর নিজেই অভিনয় করেছেন। আর অন্যটি বেলা, যে-চরিত্রে অভিনয় করেছেন অধরা প্রিয়া। অর্ণব চৌধুরীর নিজের লেখার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে নিজ জীবনের গভীর আর্তনাদ।

মঞ্চে দেখা যায়, বৃদ্ধ অর্ণব চৌধুরীকে কী এক কষ্ট তাড়া করে ফিরছে। ঝড়ের রাতে অর্ণব ঘরে একা। মঞ্চের দৃশ্যবিন্যাসে ড্রয়িংরুমের সাজেশন হলেও নানাভাবে তার বিচিত্র ব্যবহার লক্ষ করা যায়। পুরো নাটকটিই দ্বন্দ্বমুখর। আগত

সাংবাদিক-বন্ধু সিদ্ধার্থ রায় চরিত্রে আব্দুল হালিম আজিজের প্রশ্নের ফাঁকে উঠে আসে তার অনামিকা গ্রন্থের নায়িকা কল্পিত অনামিকার কথা, যে কী না আত্মহত্যা করেছিল। এ অনামিকা আসলে কে? সে কী তার প্রেমিকা? কিন্তু অর্ণব চৌধুরী বিশ্বাস করে, সে আত্মহত্যা করেনি, তাকে হত্যা করা হয়েছে। এক রহস্যের আবহ তৈরি হয় নাটকে। মঞ্চে তখন ঝড়ের আবহ। অর্ণব ফিরে যায় অতীতে। ঝড়ো-বাতাসে ঘরের সবকিছু যখন উড়ে যাচ্ছিল তখন এক ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়ায়। এ আর কেউ নয়, এ সেই অনামিকা। অর্ণব চিৎকার করে ওঠে – এ সেই বেলা।

রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি’ গল্পের অনামা-সুরবালার মতো যেন ভেঙে পড়ে অবদমিত সমস্ত চাওয়া-পাওয়া। মঞ্চে দেখা যায় বেলার জন্মদিনের অনুষ্ঠান। সেখানে বেলা ও তার বন্ধু রাসেলের (সাফায়াত) সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার জেরে অর্ণবকে পীড়িত দেখা যায়। বন্ধুর সঙ্গে অতিঘনিষ্ঠতার ধুয়া তুলে শুরু হয় মানসিক টানাপড়েন। মঞ্চে ছোট ছোট অ্যাকশনের মধ্য দিয়ে সম্পর্কের দ্বান্দ্বিক রূপ ফুটে উঠতে থাকে। একসময় অর্ণব অভিযোগ করে –

অর্ণব : তুমি আমার সাথে একটা মিথ্যা বলেছো ..!

বেলা : আমি, তোমাকে মিথ্যা বলেছি?

অর্ণব : Yes, You told a lie to me…!

বেলা : তোমাকে আমি কোনটা মিথ্যা বলেছি মন? …

অর্ণব : হ্যাঁ, ঠকিয়েছো। ঠকিয়েছো, ঠকিয়েছো, ঠকিয়েছো তুমি আমাকে। আমি তখন প্যারিসে, তুমি …, তুমি conceive

করলে, কী করে হলো?

বেলা : তুমি প্যারিসে থাকতে আমি conceive করলাম?

দুজনই যেন স্কিৎসোফ্রেনিয়ার শিকার। অসংখ্য নাট্যক্রিয়া, নানামুখী দ্বন্দ্ব-মনোসংঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে নাটকের কাহিনি। নাটকের প্রতিটি মুহূর্তই যেন এক একটা টুইস্ট। মুহূর্তেই ভালো, মুহূর্তেই মন্দ – সম্পর্কের নানা পর্যায় সংবেদনশীলতায় উপস্থাপিত। কিন্তু বন্ধু সিদ্ধার্থ যে ছাড়ার পাত্র নয়। আবারো এসে প্রশ্ন তোলে –

– আচ্ছা অর্ণব, ‘অনামিকা’ সত্যি কী স্বাধীন? তোর গল্প উপস্থাপনায় সে যতটুকু বাস্তব বলে মনে হয়, আমার কাছে বা আমাদের সমাজে সে Practicaly ততটুকুই অবাস্তব!

অর্ণবের সংলাপে ফুটে ওঠে সমাজের নানা অবস্থা, বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিক পটভূমি, নারীর অবস্থান, বাস্তবতার স্বরূপ,
সমাজ-রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ। নীলপরী-লালপরী অথবা ডালিমকুমারের মধ্যে লেখক অর্ণব খোঁজেন বাস্তবতার পটভূমি। এ এক সম্পর্কের খতিয়ান। একজন লেখক কী শুধুই শিল্পসত্যে নিমগ্ন থাকবেন? জীবনের প্রতি কি তাঁর কোনো দায় নেই? জীবনের সততা, আর শিল্পের সততা কী আলাদা কিছু? ছোট ছোট নানা ঘটনা, ছোট ছোট নানা নাট্যক্রিয়ায় সম্পর্কের অন্তঃসারশূন্যতা ফুটে উঠতে থাকে। এ যেন হেনরিক ইবসেনের অ্যা ডলস হাউস নাটকের মতো যাতে নোরাকে শেষ পর্যন্ত স্বামীর সংসার ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

ঝগড়া-সমঝোতা, ভুল-বোঝাবুঝি, মান-অভিমান, যুক্তি-খণ্ডনের এক পর্যায়ে এ-নাটকের পরিণতিও সেদিকে যেতে থাকে –

বেলা : এই অসভ্যতা করলে কেন অর্ণব!

অর্ণব : কি …! আমি অসভ্য …?

বেলা : অর্ণব আমি কিন্তু তোমাকে অসভ্য বলিনি, বলেছি, অসভ্যতা করলে কেন …!

অর্ণব : আমি অসভ্য না …!

বেলা : আমি তোমাকে অসভ্য বলিনি মন, বলেছি, অসভ্যতা করলে কেন …!

অর্ণব : আমি অসভ্য …!!

বেলা : অর্ণব, আমি কিন্তু তোমাকে সেটা বলিনি!

অর্ণব : আমি …, অসভ্য, না!

একসময় অতীত রোমন্থন শেষ হয়। নানা ঘটনা-উপঘটনা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, রাগ-অভিমান-ক্ষোভ ও নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে সে-স্বপ্নের নাট্যরাতটির সমাপ্তি ঘটতে চলে সেই কবিতার চরণ দিয়ে, যেখানে বলা হয়েছে – ‘কালো ধোঁয়ার ধস ধস আওয়াজের ফাঁকে ফাঁকে/ তোমার ক্লান্ত অপস্রিয়মাণ মুখশ্রী/ সেই কবে থেকে তোমার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছি।’

অ্যাকশননির্ভর এ-নাটকটি  প্রায় দু-ঘণ্টা দর্শকের গভীর মনোযোগ ধরে রাখে। বাস্তববাদী চরিত্রাভিনয় ধারায় নাটকটির উপস্থাপন। ভাব ও অভিনয়ের বাঁক-বদলগুলি দর্শককে মুগ্ধ করে। অভিনয়শিল্পীদের স্বতঃস্ফূর্ত চলন ও প্রাণবন্ত ভাবপ্রকাশে নাটকটি অনবদ্য। আবেগের ওঠানামাও প্রশংসনীয়। স্বর প্রক্ষেপণের মাত্রাগত পরিবর্তনগুলিও ভালো লাগার মতো। দুটি পুলিশের চরিত্র চমৎকার হাস্যরস তৈরি করেছে। বাস্তববাদী রীতিতে নাটকটি উপস্থাপিত। এ নাটকে পুলিশ ইন্সপেক্টর চরিত্রে মো. রফিক এবং পুলিশ কনস্টেবল চরিত্রে মতিউর রহমান বাচ্চু অভিনয় করেছেন।

এক স্বপ্নের রাত গল্পে নাট্যকার তাজমী নূর খুঁজেছেন সম্পর্ক-ঘৃণা ও ভালোবাসার খতিয়ান। নাটকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, লেখক হলেই যে কাউকে জগৎবিমুখ হতে হবে এমনটা কী একটা ফ্যাশন? নাটকটির প্লটটি অত্যন্ত ছোট। নাট্যকার অবশ্য স্থান-কাল সুনির্দিষ্ট না করলেও বস্তুবাদী ধারায় স্থান-কালই প্রাধান্য পেয়েছে। কাহিনিতে লেখক অর্ণব কষ্ট পেলেও বেলাকে ভালোবাসা দিয়ে জীবন ভরে তুলতে চান। কিন্তু মুহূর্তেই যেন পরিবর্তিত হয়ে যান। বেলাও অর্ণবকে বিশ^াসঘাতকতার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করতে শুরু করেন। অভিনয়, আলো, ক্রিয়া ও সংগীতের নিনাদ এবং সংলাপের অন্তর্নিহিত আবেগে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে থাকে তাদের সম্পর্ক ও সম্পর্কের ভেতরের মনস্তত্ত্ব।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই নাটকের ঘটনা কাদের? এদেশের এ-শহরের মধ্যবিত্ত জনগণের! প্রেম-ভালোবাসা কিংবা সন্দেহের দোলাচলে এই শ্রেণির মানুষের জীবনে কী সত্যিই এমন নাভিশ্বাস? নাটকটি আসলে দর্শককে স্মরণ করিয়ে দেয় নিজেদেরকেই, নিজেদের চরিত্র, নিজেদের আচরণকে। 

বারবার নাট্যমুহূর্তের পরিবর্তন ও আবেগগুলি দর্শককে ভাবাবেগে উদ্বেলিত করে। গ্রিক নাটকের মতো যে এক স্বপ্নের রাত স্থান-কাল-ঘটনার ঐক্যে যেন গাঁথা। নাটকে এক ধরনের স্বপ্নচারী রোমান্টিকতা আছে। নাটকে যেমন মনোদ্বন্দ্ব আছে, তেমনি অভিনয় ও দৃশ্যমুহূর্তনির্ভর অবদমন, স্কিৎসোফ্রেনিয়া থেকে উদ্ভূত মনোদ্বন্দ্ব অবচেতনকে তুলে ধরেছে। নাটকটিতে যে ট্র্যাজিক পরিণতি রয়েছে, তা গভীর এক মনস্তাত্ত্বিক ট্র্যাজেডি।

আলো-আঁধারির দৃশ্যমায়ায়, অত্যন্ত বাস্তব পোশাক পরিকল্পনায়, আবেগময়  সংগীতে, দ্বান্দ্বিক অভিনয়-নৈপুণ্যে অনবদ্য এক শৈল্পিক নাটক যে এক স্বপ্নের রাত। এ-নাটকের সৌন্দর্য নাটকের অন্তঃস্রোতে বহমান। মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাতগুলি যে নাট্যদৃশ্যে বাক্সময় হয়ে উঠতে পারে তা নাটক কি প্রমাণ করে দিয়েছে।

দৃষ্টিপাত নাট্যদলটি বরাবরই সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা দেখিয়েছে। এ-প্রযোজনাও তার ব্যতিক্রম নয়। বিশ্বখ্যাত এ-নাটক দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে মনস্তাত্ত্বিক অ্যাকশনের মধ্য দিয়ে। অন্তর্গত ক্রিয়ার ভঙ্গুর এবং অভঙ্গুর লাইনের গতিই এ-নাটকে প্রাণসৌন্দর্য সঞ্চার করেছে।