অমিয় দেবের গদ্যসংকলন ও ‘বই পড়া’

অমিয় দেবের সদ্য প্রকাশিত বই গদ্যসংকলন (দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০২৩) শুরু হয়েছে ‘বই পড়া’ নামের ১৩ পৃষ্ঠার এক বক্তব্যে ঠাসা, দার্শনিকতায় ভরপুর কথাবার্তায়। ‘কথাবার্তা’ শব্দটি গ্রহণীয় এজন্য যে, গ্রন্থকার বইটির পর্ব ৬-এর একটি নিবন্ধের নাম দিয়েছেন ‘কবিতায় ছবি ও গান নিয়ে কিছু আবোলতাবোল’। বইটির বিষয়-বৈচিত্র্য আপাত অন্তহীন, গুরুত্ব ও বুদ্ধিদীপ্তিতে শাণিত। বইটি শেষ হয়েছে এক দীর্ঘ কবিতার গ্রন্থকারকৃত অনুবাদ দিয়ে, ‘লাভশংকর ঠাকর’; যা ওই নামেরই এক গুজরাতি কবির কবিতা। যাতে এক পৃষ্ঠার গদ্যে পরিচিতির পরে পাঁচ পৃষ্ঠাব্যাপী গান্ধীকেন্দ্রিক (‘বাপু’) অনুষঙ্গ।

নয়টি পর্বে ১০২টি প্রবন্ধ ও নিবন্ধের সমাহার এই বিশাল সংগ্রহে। কিছুর নাম অসাধারণ, যথা – ‘এক ব্যাগ শংকর’, ‘আমরা তোমরা তাঁরা’, ‘অথ বিশেষণ’, ‘এক টুকরো প্রুস্ত’, ‘গান্ধী : কয়েক টুকরো আত্মকথা’, ‘কবিতা গণিত ও বিনয় মজুমদার’, ‘গল্পের অতীত আর শ্রোতার বর্তমান’ প্রভৃতি। শুরুতেই বলবো, পর্ব ৪-এর ‘বাংলা সাহিত্য, কিন্তু কোন বাংলা সাহিত্য’ নামের লেখাটির উপসংহার পূর্ববাংলার বাঙালিদের কাছে ভালো লাগবে : ‘অতএব প্রচ্ছন্ন হলেও প্রভুত্ব আমাদের মানায় না। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! প্রভুত্ব যেন আমাদের সহজাত কবচ! বাংলা সাহিত্যকে তাই আমরা আমাদের সাহিত্য করে রেখেছি, যেন বাংলাদেশের সাহিত্য এক সম্পূর্ণ অর্বাচীন সাহিত্য, উত্তরাধিকারহীন, সদ্যোজাত। বাংলা সাহিত্যের কথা উঠলে আমরা আমাদের আপন সাহিত্যের কথাই ভাবি, আর কোনো সাহিত্যের কথা আমাদের মাথায় আসে না। বাংলাদেশের সাহিত্য আমাদের অবচেতনায় অনুপস্থিত, তাই অস্তিত্বহীন। এই প্রভুত্ব ঘুচিয়ে আমরা কবে ইতিহাসকে মাথায় তুলে নেব!’

কিন্তু শুরুর প্রবন্ধটি ‘বই পড়া’, যাকে আমি শিরোনামায় এনেছি, তার শুরুটাকে কি ভেঙে-ভেঙে কবিতার মতো পড়া যায় না? যথা –

বই আমরা পড়ি নানাভাবে,/

বসে শুয়ে দাঁড়িয়ে, ক্কচিৎ-কখনো হাঁটতে হাঁটতেও।/

বই আমরা পড়ি বাড়িতে গ্রন্থাগারে পাঠাগারে,/

হস্টেলে

মেসে হোটেলে হাসপাতালে,/

কফিখানায় চা-চক্রে/

প্রতীক্ষালয়ে সঙ্ঘারামে/

মাঠে ঘাটে পার্কে বৃক্ষতলে,/ 

সমুদ্রসৈকতে নদীতটে হ্রদের তীরে,/

টিলায় পাহাড়ে পাথরে পাথরে সোপানে সোপানে,

ট্রেনে বাসে নৌকোয় ট্যাক্সিতে রিকশোতে জাহাজে উড়োজাহাজে,/

র‌্যাশন-রেলের টিকিট-কেরোসিনের লাইনে-লাইনে।/

বই আমরা পড়ি একক যুগ্ম ত্রয়ী …            ইত্যাদি।

আর এভাবেই প্রথম পৃষ্ঠার পুরোটা বা দেড় পৃষ্ঠাব্যাপী প্রথম অনুচ্ছেদকে ভেঙে-ভেঙে কবিতার আকারে বা কবিতা ভেবেই পড়ে ফেলা সম্ভব। বস্তুত, অমিয় দেব কবিতা খুব কম লিখলেও, বা প্রকাশ না করলেও, গদ্যের যে-নতুন শৈলীর প্রবর্তন করেছেন, তা একই সঙ্গে সুখপাঠ্য এবং তাঁর জীবনব্যাপী অর্জিত অভিজ্ঞতা ও দীক্ষার সমন্বয়ে গড়া। যাদবপুর বিশ^বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষক ছিলেন বাংলা ভাষার দুই মহান গদ্যকার ও বড় কবি – বুদ্ধদেব বসু ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। আমার কখনো কখনো মনে হয়েছে, এই দুই গুরু থেকে দু-হাতে অর্ঘ্য নিয়ে অমিয় দেব এক নতুন বাণীর জন্ম দিয়েছেন। বলা দরকার, এই বইয়ের লেখাগুলি পত্র-পত্রিকায়-সংকলনে বিগত চল্লিশ বছরের ছড়ানো-ছিটানো সামগ্রী; এই সময়ে তাঁর মূল বই বেরিয়েছে গোটা দশেক (এদের মধ্যে তিনটি ইংরেজিতে)।

ওপরে উদ্ধৃত গদ্যের সঙ্গে পদ্যের পার্থক্য কোথায়? রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা বা লিপিকার মতোন ভাষাই কি পড়ছি না আমরা? এখানে সংগত কারণেই মনে আসবে সুধীন দত্তের ‘ছন্দোমুক্তি ও রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধের প্রথম বাক্য – ‘হর্বর্ট স্পেন্সর নাকি
গদ্য-পদ্যের প্রভেদ-নির্দেশ করতে গিয়ে বলেছিলেন যে, ওই দুই রচনারীতির তারতম্য কেবল মুদ্রাকরের মর্জির উপর প্রতিষ্ঠিত : এক পাতা ছাপা গদ্যের চার দিকে যে-পাড় থাকে, তা সমান্তর, আর পদ্যের কিনারা বন্ধুর।’ স্পেন্সারের বক্তব্যে সুধীন দত্তের মন ‘হাস্যমুখর’ হয়ে উঠলেও একই সঙ্গে তিনি জানান, গদ্য-পদ্যের ‘প্রকৃতিগত বিরোধ’ তিনি আসলেই তদাবধি ধরতে পারেননি।

আগেই বলেছি, অমিয় দেবের বইটি বৈচিত্র্যে এবং সম্পদে ভরা। ‘বই পড়া’ এক অনির্বচনীয় ভাবসম্পদের সন্ধান দেয়। বড় আকারের দুই অনুচ্ছেদের পর অমিয় দেব পাঁচটি অণুচিন্তন দাঁড় করিয়েছেন এই প্রবন্ধে। প্রথমটিতে আছে বইয়ের প্রথম অবহিতি সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব বক্তব্য এবং তিনি নির্দ্বিধায় বলেছেন, পুরস্কারপ্রাপ্তির খবর পত্রিকায় বেরিয়ে যতটা করে, অন্য কোনো মাধ্যমে লেখকের বা বইয়ের প্রচার তেমন হয় না। আরো বলেছেন, লেখকের মৃত্যুবার্তাও তাঁর পুরো সৃষ্টির সারসংক্ষেপ নিয়ে আসে, যা এতদিন কারো জানা ছিল না। বইমেলায় একটি বই বিক্রির কথা ‘গির্জাশোভন’ ঘণ্টা বাজিয়ে প্রচারের কথাও আমরা জানলাম, যেমন জানা গেল এক তরুণ কবি লোকাল ট্রেনে তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘ফিরি করে’ বেরিয়েছেন।  অণুচিন্তন ১ শেষ হয়েছে একথাগুলি দিয়ে : ‘আর অবহিতির অগ্র যাদের খুব তীক্ষè ও পশ্চাৎ আপাতত লুপ্ত সেই সব পাঠকের অবশ্যগম্য অণুভুবন খুদে পত্রিকা ও ক্ষুদ্র পুস্তক বিপণকদের তাঁবু। সেখানে বেজায় হইহল্লা কিন্তু হার্দ্য উত্তাপও সেই মাত্রায় অপর্যাপ্ত, আর এক এক টেবিলে যে-ঐকান্তিক বৈপ্লবিকতা আছে তার তুলনা দুর্লভ। জয় খুদের, জয় ক্ষুদ্রের!’

অণুচিন্তন ২-তে প্রথম বাক্যেই আনকোরা নতুন বইয়ের ‘গন্ধ শুঁকে’ নেওয়ার কথাটি প্রত্যেককেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা মনে করিয়ে দেবে। শেষ বাক্যটিও প্রণিধানযোগ্য : ‘অতএব বই হাতে নিলে অভিজ্ঞতাই আমাদের বলে দেয়, কতক্ষণ কীভাবে তা নাড়াচাড়া করব আমরা, পঠনপূর্ব কতক্ষণ ব্যাপৃত থাকব তার রূপ-পরিরূপ নিরীক্ষণে।’ জানা গেল, বই শুধু পড়ার জন্যই নয়, বই নাড়াচাড়া করতেও সুখ। অণুচিন্তন ৩-এ আছে বেশ কিছু চমকপ্রদ বাক্য : ‘…পড়া, বই ও পাঠক – এই তিন শব্দের ক্রিয়া-কর্ম-কর্তা ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক সম্ভবই নয়’ অথবা ‘বই যদি হয় পাঠকের জনকতুল্য এবং সেইসঙ্গে ঘাতকপ্রতিমও, তার অস্তিত্বের প্রকৃত নিয়ন্তা, তাহলে বইয়ের নিশ্চয়ই আছে এক বিধাতৃসুলভ ক্ষমতা যার কাছে পাঠককে মাথা নুইয়ে থাকতে হয় সারাক্ষণ। তার মানে, আমাদের ‘পড়া’ ক্রিয়াপদেও কর্তৃত্বের কোনো প্রশ্নই ওঠে না পাঠকের, তাকে দিয়ে যা হতে পারে তা ঘরজামাইয়ের মতো ওই পড়া ব্যাপারটা পরোক্ষে ঘটিয়ে তোলা মাত্র – যেন এক যন্ত্রীর হাতে সে যন্ত্র, যেন রানী মৌমাছির দুর্বার টানে এক বানভাসী মৌমাছি পুরুষ।’ অণুচিন্তন ৪-এ পাঠকের ‘বই-ব্যতিরেকী’ ‘স্বাধীন অস্তিত্বের’ কথা মনে করিয়ে দিয়ে শেষাবধি বলছেন : ‘বইয়ের উদ্দেশ্য পাঠক, পাঠকের অন্বিষ্ট বই। কিন্তু তাদের সাক্ষাৎ নয় নাটকীয়, তা ইতিহাসসম্মত। এবং ইতিহাসসম্মত বলেই বই-পাঠকের সম্পর্ক দ্বান্দ্বিক।’ এখানেও ডায়ালেক্টিক্স! কী সুন্দর নতুন চিন্তা।

অণুচিন্তন ৫-এর শুরুটাই মনে করিয়ে দেয় পড়া ছাড়া বই আর পাঠকের অন্য কোনো সম্পর্ক নেই। লেখক টেনে এনেছেন ভগবদ গীতাকে। এক অর্থে যুধিষ্ঠিরের সকল ক্রিয়াই অকর্মক; আর অর্জুনের পুরোটাই সকর্মক : ‘উপমান প্রশস্ততর করে বলা যায়, যুধিষ্ঠির স্মরণীয় পাঠক হিসেবে, অর্জুন স্মরণীয় বই হিসেবে।’ যুধিষ্ঠির আর অর্জুনকে এ-জাতীয় অভিধা-প্রয়োগ অভিনব, তথা অভূতপূর্ব; সোজা কথায় এই প্রথম।

একইভাবে ১৯৮৭-এর লেখা ‘এক ব্যাগ শংকর’ও (এই বইয়ের দ্বিতীয় প্রবন্ধ এবং নামটি শংকরের নিজের দেওয়া তাঁর এক গল্পসংগ্রহের) প্রায় সমদৈর্ঘ্যরে। ছয়টি অংশ। তবে আলোচনা শুধু ওই গল্পসংগ্রহ নিয়েই নয়, কেন শংকরের বই এত চলে তার অর্থনৈতিক ব্যাখ্যাও এসে গেছে আলোচনায়, যেমন ‘শংকর শস্তা’। ঘুরিয়ে বাজার অর্থনীতির আরেক ব্যাখ্যাও টেনেছেন অমিয় দেব :

‘যে-বইয়ের বিক্রি যত বেশি সে-বইয়ের চাহিদা তত বেশি; অর্থাৎ বেশি বিক্রি মানেই বিক্রি আরো বেশি। অর্থাৎ বিক্রির একটা নিজস্ব গণিত আছে এবং সকল পণ্যের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য, বইয়েরও।’ অবশ্য ওই আর্থ-ব্যাখ্যা বাদেও কত অজানারে, চৌরঙ্গী, মাথার ওপর ছাদ, স্বর্গ মর্ত পাতাল, তীরন্দাজ, জন-অরণ্য, নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরি, সীমাবদ্ধ প্রভৃতি বই নিয়ে বাংলা ভাষার এই প্রিয় লেখকের ওপর আলোচনা আছে এই প্রবন্ধে।

অমিয় দেব মনে করেন, শংকর অনেকখানিই ‘পূর্ণাঙ্ক’ লেখক, কারণ তিনি পাঠকপ্রবণ। এর বিপরীতে আছেন অভিজ্ঞতানির্ভর লেখক, যাঁরা ‘শূন্যাঙ্ক’-অভিধেয় অমিয় দেবের বিচারে। বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখকদের একজন, হয়তো বই-কাটতির হিসেবে প্রথম, মনি শংকর মুখার্জীর সঙ্গে কি ঢাকার হুমায়ূন আহমেদের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়, বিশেষত শেষোক্তও যেহেতু একই বিবেচনায় পাঠকপ্রবণ, অর্থাৎ ‘পূর্ণাঙ্ক’?

পর্ব ২-তে আটটি লেখার মধ্যে আছে আড়াই পৃষ্ঠার ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’, এটা বারো বছর আগে কালি ও কলমের পাতায় ছাপা হয়েছিল। অমিয় দেবের লেখা থেকে এ-অংশটুকু উদ্ধৃত করতে অনুপ্রাণিত হচ্ছি : ‘এও সকলের জানা যে, বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হবার পরে তার সাধারণ পরিষদে তিনি বাংলায় বক্তৃতা করেন। বাংলা ভাষার মর্যাদা যে তাতে কত বেড়ে গিয়েছিল তা বলবার নয়। (তারিখটা ছিল ১৯৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বর। সেদিন বেঁচে থাকলে ‘ভাষা, কবিতা ও মনুষ্যত্ব’র লেখক বুদ্ধদেব বসু তাঁকে সাধুবাদ জানাতেন।) ১৯৭৫-এর পনেরোই আগস্ট যে-কলঙ্ক লেপন হল এই ইতিহাসে তার কথা তুলছি না, শুধু বলছি তিনি অমর হয়ে রইলেন। বাংলাদেশের জনক।’

পর্ব ৩ বিদেশি সাহিত্য নিয়েই ব্যাপৃত : দান্তে, মারতিন ফিয়েররো, প্রুস্ত, টোমাস মান, এলিয়ট, পামুক প্রমুখকে নিয়ে ছয়টি লেখা। তবে টোমাস মানকে নিয়ে যে-লেখা যাতে অনেকটা আছেন গ্যেটে, তাতে তিনি নিজের দুজন শিক্ষক সুধীন দত্ত ও বুদ্ধদেব বসুকে আলোচনায় এনেছেন যথেষ্ট পরিমাণে।

পর্ব ৪-এর ‘বাংলা সাহিত্য, কিন্তু কোন বাংলা সাহিত্য’ নামের লেখাটির উপসংহার সম্পর্কে শুরুতেই বলেছি। এখানে অন্যান্য ভারতীয় ভাষার সাহিত্যালোচনা বাদে আরো আছে তাঁর নিজের বিষয় ‘তুলনামূলক সাহিত্য’ নিয়ে একটা সুখপাঠ্য লেখা।

জীবনানন্দ নিয়ে সব-দরজা-খুলে-দেওয়া এক প্রবন্ধ আছে পর্ব ৬-এ : ‘জীবনানন্দের দরজায়’। কবি ও কবিতার পাঠকেরা এই মন্তব্যে পাবেন তাঁদের সাধনা ও ব্যাপৃতি সম্পর্কিত অমূল্য শব্দাবলি : ‘সার্থক কবিতামাত্রেই এক অন্তর্লীন সূত্র থাকে, এবং তাঁর শব্দবন্ধে আপাত-দূরান্বয়ের প্রবণতা সত্ত্বেও জীবনানন্দে তা আছে। তাছাড়া তাঁর মননের মধুও তাঁর কবিতাকে ঢের রসপ্রদ করে তুলেছে।’

এই পর্বে অন্য কবিদের মধ্যে আছেন অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অলোক সরকার, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, তাঁর বন্ধু প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, তাঁর আরেক সহপাঠী নবনীতা দেব সেন, অনুরাধা মহাপাত্র ও সুবীর মণ্ডল। এই পর্বের শুরু হয়েছে ‘কবিতায় ছবি ও গান নিয়ে কিছু আবোলতাবোল’ (নিবন্ধের অরক্ষণশীল নামের আরেক উদাহরণ), সুধীন দত্ত ও আবু সয়ীদ আইয়ুব, ‘পরিচয়ের আড্ডা’, আরিস্ততল, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখকে নিয়ে কথাবার্তা এবং ‘বাংলা গদ্যকবিতার শতবর্ষ বিষয়ে একটি প্রস্তাব’। পরের লেখাটিতে অমিয় দেব এ-তত্ত্ব নিয়ে এসেছেন যে, রবীন্দ্রনাথের লিপিকা, যা ১৯১৯ সালে প্রকাশিত হয়, তাকেই বাংলা গদ্যকবিতার শুরুর বছর ধরা উচিত। গ্রহণযোগ্য কথাই বটে। প্রায় তিরানব্বই বছর আগে সুধীন দত্তের লেখা ‘কাব্যের মুক্তি’ প্রবন্ধে লিপিকা থেকে উদ্ধৃতি-অন্তর্ভুক্তি অমিয় দেবের প্রস্তাবকেই সমর্থন করে, কার্যত।

পর্ব ৭ বাংলা কথাসাহিত্য নিয়ে আলোচনায় শরৎচন্দ্রের অনুজা রাধারানী দেবীকে নিয়ে লেখাটি (‘রাধারানী দেবীর শরৎচন্দ্র’) এবং ‘উপন্যাসের আদর্শ ও রবীন্দ্রনাথ’ অবশ্যপাঠ্য। পরেরটি এই বইয়ের আদ্য লেখাগুলির একটি, ১৯৮৬ সালের। গোরাকে তিনি ‘মহত্তম’ বলে আখ্যা দিয়েছেন : ‘কোনো আদর্শ রবীন্দ্ররচনা সংকলনে যদি একটি উপন্যাসেরই মাত্র জায়গা থাকে, সন্দেহ নেই তাতে অধিষ্ঠিত হবে ‘গোরা’ই।’ তবে এই বাক্যটি হয়তো আলোচনার জন্ম দেবে সাহিত্য-সমঝদারদের মধ্যে : ‘রবীন্দ্রনাথ শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক নাও হতে পারেন বাংলায়, তবু ‘গোরা’ প্রায়-শ্রেষ্ঠ বাংলা উপন্যাস।’

পর্ব ৮-এ আছে শতাধিক পৃষ্ঠায় ঊনত্রিশটি লেখা। রাজনৈতিক বিষয়াদি আছে। আছে নিজের প্রথম বয়সের বাম-সংশ্লিষ্টতা এবং পার্টির ‘দাদা’দের আজ্ঞায় নিকৃষ্ট মানের বই পড়া। আছে কোরিয়ায় এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এক নোবেলজয়ীর সঙ্গে (চীনা লেখক গাও) দুজন দোভাষীর মাধ্যমে কথাবার্তার বিবরণ (‘গাও, গণতন্ত্র, আতিথেয়তা’); আছে বক্তৃতার জন্য আহূত হয়ে, সে-অনুষ্ঠানে তাঁর লিখিত

বক্তৃতা কয়েকজনের হাতে যাওয়া ও তাতে আয়োজকদের কাছে অগ্রহণযোগ্য বক্তব্য থাকায় তা বাতিল হয়ে যাওয়া (‘স্বপ্ন ও সত্য’); তথা ‘একটি অভিনব বই’। পরের লেখাটি নোবেল পুরস্কারের জনক আলফ্রেড নোবেলের নেমেৎসা নামের সুইডিশ নাটকের নেমেসিস নামে বাংলা অনুবাদ নিয়ে। অমিয় দেবের মতে, এটাই সম্ভবত ইউরোপীয় ভাষার কোনো বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ হওয়ার আগেই বাংলায় অনুবাদ।

আমাদের ভালো লাগে জানতে ও পড়তে যে, সিলেটে জন্ম-নেওয়া এবং সেখানকার রসময় মেমোরিয়াল হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করা অমিয় দেবের ছেষট্টি বছর বিরতিতে ২০১৭ সালের সিলেট ভ্রমণে তাঁর পুরোটা কৈশোরের অনেক স্মৃতিকে টেনে এনেছেন। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, কালি ও কলম এবং তার সম্পাদক প্রয়াত আবুল হাসনাতের উদ্যোগে আয়োজিত সাহিত্য সমে¥লনে আমন্ত্রিত হওয়া এই সুযোগ করে দিয়েছিল, ধারণা করছি। পড়া যাক : ‘ছেষট্টি বছর পর সিলেটে পা দিয়ে কি ইচ্ছা হয় না একটু ঘুরে দেখি, অন্তত নদীর কাছে গিয়ে একবার দাঁড়াই, সেই উঁচু পোলটাকে একবার সেলাম জানাই – বলি, তুমি আমার বর্তমান পোলের চেয়ে একটুও কম নও। ইস্কুলের চেহারা না জানি কেমন হয়েছে, মলিন না উজ্জ্বল।’

‘আমার তরুণ বন্ধুটি যখন হোটেলের আটতলার ঘরে এসে আমার স্কুলের ছবি দেখালেন, তখন আমার দীর্ঘলালিত নিরাসক্তি ফুঁড়ে এক ইচ্ছার উদ্গম হল। এইই তো আমার জন্মভূমি, এখানেই আমি বড়ো হয়েছি। অন্তত একবার প্রাণ খুলে এর নিশ^াস নিই। এতদিন ভুলে থেকে যে-পাপ করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত কি হবার নয়? বন্ধুটি অকুতোভয়। যেদিন ফিরে আসব সেদিন সকালে সকলের অগোচরে তিনি আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। বেরিয়েই এক রিকশো ধরলেন। তারপর কখন যেন জাদুবলে নিয়ে হাজির করালেন ‘রসময় মেমোরিয়াল হাই স্কুল’-এর গেটে। জ্বলজ্বল করে উঠল এই নাম। কিন্তু অনেক হাঁকাহাঁকিতেও অত সকালে কেউ গেট খুলতে এল না। দূর থেকেই দেখলাম একতলা স্কুলবাড়ি দোতলা হয়েছে। স্কুল কি জানল তার ছেষট্টি বছর আগেকার এক ছাত্র এসেছিল?’

শুধু সিলেট নিয়েই অমিয় দেবের স্মৃতিময়তা পাই না আমরা এই বইতে। তিনি দুটি অধ্যায় লিখেছেন ‘ডায়েরির বদলে’ ও ‘ডায়েরির বদলে ২’ নাম দিয়ে। ও-দুটোই সুখপাঠ্য। স্মৃতিভারাতুর আরো অনেক কথা আছে বইটি জুড়ে। আছে যাদবপুর বিশ^বিদ্যালয়ের শুরুর কথা; তাঁরা সাতজন ছিলেন তুলনামূলক সাহিত্যের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। বিভাগীয় অধ্যক্ষ ছিলেন বুদ্ধদেব বসু; খণ্ডকালীন অধ্যাপক ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। অন্যদের মধ্যে আরো ছিলেন এই বইয়েরই দ্বিতীয় পর্বের ‘শাদা পাজামা ও গেরুয়া পাঞ্জাবি’ শীর্ষক নিবন্ধের অভিনব ব্যক্তিত্ব ফাদার আঁতোয়ান, বেলজিয়ান-ফরাসি, যিনি পড়াতেন ইউরোপীয় প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সাহিত্য। তাঁর কাছেই অমিয় দেবরা পড়েছিলেন হোমার, গ্রিক ট্র্যাজেডি ও দান্তে। ফাদারের চোখে পড়ার মতোন অভ্যাস ছিল ‘পার্ক স্ট্রিটের চৌরঙ্গি-মুখী ফুটপাতে বই পড়তে পড়তে হাঁটা’;  উদ্দেশ্য দক্ষিণ কলকাতার বাস ধরবেন। ১৯৮১-তে তাঁর শবযাত্রায় ছিলেন অমিয় দেব, সেন্ট জেভিয়ার্সে মাস্-এও ছিলেন।

সিলেটে থাকাকালীন বড় দাদার প্রভাবে একসময়ের কমিউনিস্ট-ভাবাপন্ন কিশোর অমিয় দেব সুপরিণত বয়সে এসে বিপুল পরিমাণে গান্ধীভক্ত; এই গ্রন্থের পঞ্চম পর্বের ছয়টি লেখা এবং পর্ব ৯-তে লাভশংকর ঠাকরের গান্ধীবিষয়ক বিরাট কবিতা নিজ অনুবাদে স্থান দেওয়া সেই প্রমাণই দিয়ে রাখে। আগামী বছরে তিনি নব্বই পেরোবেন। শতায়ু হোন অমিয় দেব; আপনার গদ্যসংকলন বাংলা ভাষার অমূল্য সম্পদ হয়ে রইবে।