‘বিদ্রোহী’ কবিতার নতুন ব্যাখ্যা

বিশ্ব-কবিতার ইতিহাসে কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) ‘বিদ্রোহী’ কবিতা এক অনন্যসাধারণ নির্মাণ। শতবর্ষেরও আগে রচিত এ-কবিতা এখনো প্রাসঙ্গিক, এবং অব্যাহতভাবে প্রাসঙ্গিক থাকবে পৃথিবীতে যতকাল মানুষ থাকবে, ততকাল। মাত্র বাইশ বছর বয়সে নজরুল রচনা করেন প্রায় দেড়শো পঙ্ক্তির এই কবিতা। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় দুজন মানুষ আছেন – একজন বক্তা, একজন শ্রোতা। বক্তা বা পুরোহিত তার শ্রোতা কিংবা শিষ্যকে বিদ্রোহব্যঞ্জক কিছু কথা বলতে বলছেন। কিন্তু নজরুলের অসামান্য নির্মাণ-কুশলতায় পরিণতিতে বক্তা বা শ্রোতা নন, কবি নিজেই হয়ে ওঠেন বিদ্রোহী, উপাধি পান ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে। একটি কবিতার শিরোনাম একজন কবির নামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে – এমন ঘটনা বিশ্ব-কবিতায় দ্বিতীয়টি আছে কি না সন্দেহ।

ঔপনিবেশিক শোষণ, সামন্ত মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সচেতন বিদ্রোহী রূপে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় আবির্ভূত হয়েছেন নজরুল। রোমান্টিক অনুভববেদ্যতায় মানবতার সপক্ষে তিনি উচ্চারণ করেছেন বিদ্রোহের বাণী, সত্য সুন্দর মঙ্গল ও শান্তির বাসনায় তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন যাবতীয় অপশক্তির বিরুদ্ধে, ধর্মীয় শোষণ এবং জীর্ণ-সনাতন মূল্যবোধের বিরুদ্ধে। পরাধীনতার গ্লানিতে নজরুলচিত্ত দীর্ণ হয়েছে এবং এই গ্লানি থেকে মুক্তির অভিলাষে তিনি হয়েছেন বিদ্রোহী। তাঁর বিদ্রোহ ছিল পরাধীনতার বিরুদ্ধে উচ্চকিত, সকল আইনকানুনের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ, ইতিহাসনিন্দিত চেঙ্গিসের মতো নিষ্ঠুরের জয়গানে মুখর, ভৃগুর মতো ভগবানের বুকে পদাঘাত – উদ্যত, মানবধর্ম প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়সংকল্প, ধ্বংসের আবাহনে উচ্ছ্বসিত, সুন্দরের প্রতিষ্ঠায় উদ্বেলিত।

সৃষ্টিশীল পুরাণচেতনা ও ঐতিহ্যভাবনা ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রাতিস্বিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নজরুলের ঐতিহ্যসাধনা পুরাণ আর ইতিহাসের অন্ধ অনুকরণ নয়, বরং তা নব-প্রতিনব সৃষ্টির লাবণ্যে উদ্ভাসিত। পুরাণ আর ঐতিহ্যের অবয়বে তিনি স্থাপন করেছেন সমকালের জীবনভাষ্য, পুনর্মূল্যায়নের আলোয় তা বিকিরণ করেছে নতুন ব্যঞ্জনা। এক ঐতিহ্য থেকে আরেক ঐতিহ্যে নজরুলের পদচারণার উদ্দেশ্য ছিল সমাজ বিনির্মাণের জন্য বিদ্রোহের সপক্ষে শক্তির সন্ধান করা। এ-উদ্দেশ্যে ভারতীয় পুরাণের পাশাপাশি নজরুল পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং গ্রিক-পুরাণ ব্যবহার করেছেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়। তিনি পুরাণ ও ঐতিহ্য ব্যবহার করেছেন একদিকে ঔপনিবেশিক সমাজ ভাঙার উদ্দেশ্যে; অন্যদিকে সেই ভাঙনের মধ্য দিয়েই নতুন সৃষ্টির আকাক্সক্ষায়। এক্ষেত্রে ‘বিদ্রোহী’তে নটরাজ শিব নজরুলের দ্বৈত-উদ্দেশ্যের স্মারক হয়ে শিল্পিতা পেয়েছেন। কেননা, শিবই বিশ^-পুরাণের একমাত্র চরিত্র, যাঁর মাঝে আছে ধ্বংস ও সৃষ্টির যুগল-অনুষঙ্গ। শৈব-মিথিক অনুষঙ্গে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নজরুল ছড়িয়ে দিয়েছেন বিদ্রোহের আগুন, সৃষ্টির উল্লাস। তিনি ছিলেন জনজীবনসম্পৃক্ত কবি; তাই তাঁর ঐতিহ্যবোধও ছিল জীবনসম্পৃক্ত। অতীত পুরাণ ও ঐতিহ্যকে তিনি অন্ধভাবে অনুসরণ করেননি, বরং সৃষ্টি করেছেন নতুনভাবে, নতুন জীবনবীক্ষায়। দ্বিমাত্রিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী ছিলেন বলেই ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নজরুল একই সঙ্গে ভারতীয় পুরাণ এবং পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাস-ঐতিহ্য ব্যবহারে অর্জন করেছেন স্মরণীয় সিদ্ধি।

কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিক্ষমপ্রজ্ঞার মূলীভূত প্রেরণাশক্তি রোমান্টিকতা। রোমান্টিকতার আন্তরপ্রেরণায় তিনি কখনো উচ্চারণ করেছেন বিদ্রোহের বাণী, কখনো-বা গেয়েছেন প্রেম-সৌন্দর্যের গান। তাঁর কবি-প্রতিভায় বিদ্রোহ ও প্রেম মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে – সৃষ্টি হয়েছে এই অসামান্য চরণ – ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর-হাতে রণ-তূর্য।’ উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, নজরুলের এই বিদ্রোহ-চেতনা ও প্রেমভাবনার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। রোমান্টিক চেতনারই
এপিঠ-ওপিঠ বিদ্রোহ আর প্রেম। বস্তুত নজরুলের বিদ্রোহ-চেতনা ও প্রেমভাবনা আন্তরসম্পর্কে একে অপরের পরিপূরক – অগ্নি-বীণার উদ্দাম বিদ্রোহই সিন্ধু-হিন্দোল-চক্রবাক কাব্যে রোমান্টিক অনুভববেদ্যতায় রূপান্তরিত হয়েছে উচ্ছ্বাসময় প্রেমে।

‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নজরুল ইসলাম সৃষ্টিকে স্থাপন করেছেন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনবাস্তবতার জটিল আবর্তে। কবিতা তাই হয়ে উঠেছে সামাজিক দায়িত্ব পালনের শানিত আয়ুধ। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নজরুলের বিদ্রোহ-চেতনার মাঝে লক্ষ করা যায় ত্রিমাত্রিক বৈশিষ্ট্য : ক. অসত্য, অকল্যাণ, অশান্তি, অমঙ্গল এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, খ. স্বদেশের মুক্তির জন্য ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং গ. শৃঙ্খল-পরা আমিত্বকে মুক্তি দেওয়ার জন্য বিদ্রোহ। নজরুলের বিদ্রোহ-চেতনাকে নানামাত্রায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে – কখনো তা হয়েছে সদর্থক, কখনো-বা নেতিবাচক। তবে তাঁর বিদ্রোহীসত্তাকে যেভাবেই দেখা হোক না কেন, তা ছিল মূলত সৃষ্টিশীল। নজরুলের বিদ্রোহ সৃষ্টিশীল বলেই ধ্বংসের মাঝে তিনি খুঁজে পেয়েছেন নতুন সৃষ্টির উৎস।

২. ‘বিদ্রোহী’ কবিতার অধিকাংশ ব্যাখ্যাই করা হয়েছে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে – কখনো-বা নন্দনতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় রেখে। এসব ব্যাখ্যার বাইরে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাকে ভিন্ন এক মাত্রায় বিশ্লেষণ করে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বই :

মনোচিকিৎসক-মনোশিক্ষাবিদ-কথাকার মোহিত কামালের বিদ্রোহী কবিতার মনস্তত্ত্ব এ-বইটি নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ইতঃপূর্বের নানামাত্রিক ব্যাখ্যার সঙ্গে যুক্ত করেছে নতুন এক ব্যাখ্যা, যা সবিশেষ কৌতূহলোদ্দীপক এবং চিন্তাসঞ্চারী।

‘বিদ্রোহী’ কবিতার মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মোহিত কামাল যা বলেছেন, সেখান থেকে দুটো উদ্ধৃতি প্রথমেই আমরা অনুধাবন করতে চাই :

ক. আমরা জানি, দ্রোহ যেমন আবেগ, প্রেম-ভালোবাসাও তেমনি আবেগ, দ্রোহ-বিদ্রোহী অনুভবও বটে; আর আবেগ হচ্ছে মনের অঙ্গ, উপাদান। মস্তিষ্কের স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র এবং নিয়ন্ত্রণাধীন স্নায়ুবার্তা বহনকারী জৈব-রাসায়নিক পদার্থ নিউরোট্রান্সমিটার ও হরমোনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে যা নিয়ন্ত্রিত হয়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মূল্যায়ন করতে হলে নজরুলের সৃষ্টিশীল কল্পনাশক্তির পাশাপাশি তাঁর তীব্র আবেগময় সত্তা নিয়েও কথা বলতে হবে। তা না হলে পুরো ‘বিদ্রোহী’ কবিতার অন্তর্নিহিত মনোজাগতিক শিল্পরূপ স্পষ্ট হবে না; আর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মনস্তত্ত্ব বুঝতে হলে নজরুলের ছেলেবেলার বুনিয়াদটাও বুঝতে হবে। জানতে হবে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখার স্বভাবজাত প্রাক-প্রস্তুতি ও আনুষঙ্গিক প্রেক্ষাপটের কথাও।

(পৃ ১১)

খ. দেহের সংবেদনশীল পঞ্চ ইন্দ্রিয় বা মনের পাঁচটি জানালা দিয়ে নানা তথ্য ঢোকে ব্রেনে। তা মানুষের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করে এবং সচেতন ভাবনা – জগৎ বা কগনিটিভ ওয়ার্ল্ড কিংবা ‘কনশাস স্ট্রিম অব থটস’ আলোড়িত করে, আবেগে পরিবর্তন ঘটায়, আচরণেও। আবার ইন্দ্রিয়-অনুভূতির বাইরে থেকেও অনুভব করা যায় ঠিক দেখা-শোনার সরাসরি মনের একই রকম অনুভবের মতো। এটাই সৃষ্টিশীল কল্পনা বা ‘ক্রিয়েটিভ ইমাজিনেশন’। এর ওপর ভর করে সৃষ্ট বিপুল-বিস্তৃত অথচ লক্ষ্যমুখী যাত্রার এক মনস্তাত্ত্বিক ঝোড়ো-অনুভবের শব্দজোয়ার আমরা দেখতে পাই ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়। (পৃ ৯)

দুটো উদ্ধৃতি থেকেই একথা সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায়, মোহিত কামাল ভিন্ন এক পথে এগিয়ে গেছেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতার অন্তর্সত্তা উন্মোচনে – সে-পথ মনস্তত্ত্বের পথ। লেখক তাঁর ব্যাখ্যায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ‘আমি’-সত্তা উন্মোচনের ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। মোহিত কামাল লিখেছেন, ‘… ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের শিল্পপ্রতিনিধি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে নজরুলের ‘আমি’, ‘মম’ ‘আমিত্ব’; আর এ বুনিয়াদের ওপর দাঁড়িয়ে তাঁর পেনসিল প্রকাশ ঘটিয়েছে শৃঙ্খলিত-নিপীড়িত মানুষের আমিত্বের ভেতর লুকিয়ে থাকা মুক্তিকামী চেতনাকেও। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের গভীরে ঢুকতে হলে নজরুলের ওই আমিত্ব-র উৎস খুঁজতে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখার আগে তাঁর ফেলে আসা সময়কালটার (১৮৯৯-১৯২১) দিকেও নজর দিতে হবে’

(পৃ ১৪)। এ-লক্ষ্যেই মোহিত কামাল ছেলেবেলায় নজরুলের লেটো গানের আসরে অংশগ্রহণ, ত্রিশালে দরিরামপুর স্কুল এবং শিয়ারশোল রাজ স্কুলে পড়ালেখার সময়কাল, শৈলজানন্দসহ অন্য বন্ধুদের সঙ্গে নজরুলের সখ্য-খেলাধুলা, আনন্দ-বেদনার অধ্যায় এবং স্কুলের শিক্ষক নিবারণচন্দ্র ঘটকসহ অন্যদের প্রভাবে তাঁর মধ্যে যে ব্যক্তিত্বের বুনিয়াদ তৈরি হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যায় তা-ও পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে লেখক গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেছেন। এই মনোবৈজ্ঞানিক তথ্যসমূহ যথার্থই ব্যাখ্যা করেছেন মোহিত কামাল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ‘মম’, ‘আমি’, ‘উন্নত’, ‘শির’, ‘বীর’ – এই শব্দরাশি নজরুল সকল অচেতন-অর্ধচেতন মানুষের সত্তায় আরোপ করেছেন। তাই ‘বিদ্রোহী’ পাঠ করলে সকলেই একযোগে ‘আমি’ হয়ে যায় – কোটি কোটি ‘আমি’ একাত্ম হয়ে সৃষ্টি করে জোরালো আমিত্ব – সৃষ্টি হয় আমি-সমুদ্র। মোহিত কামাল বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেন এভাবে :

… এই শব্দবিক্ষেপের মধ্যে লুকিয়ে আছে মনস্তত্ত্বের প্রবল আত্মবিশ্বাস (self-confidence), নিজেকে যথাযথ প্রত্যক্ষ করে (perception) চারপাশকে মূল্যায়ন করে (cognitive appraisal) নিজের চিন্তাভাবনার আলোকে জ্বলে-ওঠার আহ্বান, প্রেষণাশক্তিকে নাড়া দেওয়ার আহ্বান। (পৃ ২৩)

নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় মানুষের মনের শক্তি বা মোটিভেশনাল ফোর্সকে চাঙা করতে একের পর এক দ্রোহসম্ভব শব্দ ব্যবহার করেছেন। এ-কবিতার বিদ্রোহব্যঞ্জক শব্দরাশি মনোজগতের বিপুল বিস্ময়কর শক্তি, প্রেষণার প্রাণরসায়ন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মূলস্রোতে প্রেষণাকে উদ্দীপ্ত ও আলোড়িত করার অপরিসীম শক্তি মোটিভেশনাল ফোর্স প্রবহমান থেকেছে মহাসাগরের জলোচ্ছ্বাসের মতো। মোহিত কামালের এই ব্যাখ্যা ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মৌলসত্তা উপলব্ধিতে সঞ্চার করেছে নতুনতর মাত্রা।

নানা দৃষ্টিকোণেই কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ হতে পারে। মোহিত কামাল তাঁর বিদ্রোহী কবিতার মনস্তত্ত্ব শীর্ষক গ্রন্থে মনস্তাত্ত্বিক মাত্রার ভিন্ন এক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন। ভিন্নতর এই ব্যাখ্যা উপস্থাপনের জন্য লেখককে অভিনন্দন।