ভাষার পথ ধরে গভীর অনুসন্ধান

ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে মানুষ সৃষ্টি করেছে ভাষা। সময়ের সঙ্গে চেষ্টা করেছে তাকে নানাভাবে সুশৃঙ্খল করতে।  তৈরি করেছে বিবিধ নিয়মকানুন, সুনির্দিষ্ট রূপরেখা। কিন্তু শৃঙ্খল দিয়ে সবসময় কি বেঁধে রাখা গেছে ভাষাকে? ভাষার চেনারূপের এক ধরনের বিপর্যয় পরিলক্ষিত হয় কবিতায়। চিত্রকলা বা চলচ্চিত্রের মতো শিল্পমাধ্যমগুলিতেও প্রায়শ ভেঙে পড়ে আমাদের চেনা বাস্তবের দৃশ্যমান রূপ। এই ভাঙন বা বিপর্যয়ের কারণ কী? এর মধ্য দিয়ে কোন গন্তব্যে পৌঁছাতে চায় ভাষা? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন সাজ্জাদ শরিফ তাঁর ঈশ্বর দর্শন : অবাক থেকে বাক ছাপিয়ে বইটিতে।

বইয়ের শুরুতে ‘বাকের ভেতরে’ শিরোনামে লেখা ভূমিকায় শিল্প-সাহিত্যে ভাষার বিপর্যয়বিষয়ক ভাবনাটি কীভাবে তাঁর মনে দানা বেঁধেছিল, সে-বিষয়ে লিখেছেন সাজ্জাদ শরিফ। পটভূমি খুঁজতে গিয়ে লেখক লিখেছেন, ‘আমি বহু দিনের কাব্য-ব্যবসায়ী। দীর্ঘ সময়ের বদভ্যাসে সবকিছুকে কবিতার, বিশেষ করে ভাষার ভেতর থেকে দেখার একটা বাতিক গড়ে উঠেছে। চিত্রকলা আর চলচ্চিত্রের সঙ্গে ভাষার দিক থেকে কবিতার একটা সুপ্ত কিন্তু অভিন্ন যোগসূত্রের চিহ্ন আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। আমার মনে এমন একটা ধারণা দানা বাঁধছিল যে, ইতিহাসের পথ ধরে চেতনার গভীরে মানুষের অবিরাম যে নির্মিতি চলছে, তার এক প্রত্যক্ষ রূপ সাহিত্য ও শিল্পকলার অচেনা ভাষার মধ্যে ধরা আছে।’ (পৃ ১০)

বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমে ভাষার যোগসূত্র ও বিপর্যয় বিষয়ক দার্শনিক অনুসন্ধান ঘিরে একটি প্রবন্ধ নিয়েই এ-বই। প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে ‘জাগ্রত অবস্থা’, ‘বিপর্যস্ত ভাষা’, ‘চোখের দেখা, মনের বোঝা’ এবং ‘অব্যক্তের ভার’ শিরোনামে চারটি ভাগে।

আদিম সমাজে ‘প্রাকৃতজন’ থেকে ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার যাত্রায় ভাষা কীভাবে ভূমিকা রেখেছিল, সে-ইতিহাসের পথ ধরে অনুসন্ধান রয়েছে ‘জাগ্রত অবস্থা’ শিরোনামীয় প্রথম অংশে। কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাস অন্তর্জলী যাত্রার উৎসর্গপত্রের সূত্র অনুসরণ করে প্রাকৃতজনের আত্মপরিচয় অর্জনের মাধ্যমে মানুষ হয়ে ওঠার যাত্রাপথ ও উদ্দেশ্য বোঝার প্রয়াস রয়েছে এখানে। প্রকৃতির অংশ থেকে ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার এই বিপুল যাত্রাকে ‘ঈশ্বরযাত্রা’ হিসেবে বুঝতে চেয়েছেন কমলকুমার মজুমদার। রামকৃষ্ণ পরমহংসের মতে, এই ঈশ্বরযাত্রা বা ঈশ্বর দর্শন-ই জীবনের উদ্দেশ্য।

মানুষের সঙ্গে শিল্প-সাহিত্যের সম্পর্ক বোঝার জন্য জার্মান দার্শনিক হেগেলের লেকচার্স অন ইসথেটিকস বই থেকে উদ্ধৃত করে লেখক পাঠককে পরিভ্রমণ করিয়েছেন আলতামিরা গুহায় বাইসন আঁকার অসামান্য মুহূর্তে, যে-মুহূর্তে জীবত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে মানুষ অগ্রসর হয়েছিল মনুষ্যত্বের দিকে। হেগেলকে উদ্ধৃত করে লেখক লিখেছেন, ‘আদিম যুগের কোনো এক প্রাকৃতজন যখন হাতে চকখড়ি নিয়ে গুহার ভেতরে বাইসন আঁকল, তখন ইতিহাসে এক অসামান্য ঘটনার সূত্রপাত ঘটল। এই বাইসন আঁকার মধ্য দিয়েই মানুষ প্রথম জীবত্ব থেকে মুক্তি পেল মনুষ্যত্বে। মানুষ হয়ে সে উঠে দাঁড়াল, তার যাত্রা শুরু করল পরমের দিকে। … এতদিন তার যে ইন্দ্রিয়পর জীবন ছিল, বলা যায় প্রাণীর জীবন – যে কেবলই খায় আর প্রজনন করে – এই জীবসত্তার বাইরে অতিরিক্ত আরেকটি সত্তা জেগে উঠল তার মধ্যে। আগে যে বাইসন সে দেখত, সেটির সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল খাদ্য আর খাদকের। গুহার ভেতরে আঁকা এই প্রথম একটি বাইসন এখন তার সামনে, যেটিকে সে খাবে না। এটি আর কোন শিকারবস্তু নয়, তার ভাববস্তু।’ (পৃ ২০-২১) অর্থাৎ, জীবত্ব থেকে মনুষ্যত্ব বা পরমের দিকে যাত্রায় ভাষা কিভাবে ভূমিকা রেখেছে, তার প্রতি আলোকপাত রয়েছে এ-অংশে।

পরবর্তী ভাগ ‘বিপর্যস্ত ভাষা’য় দেখানো হয়েছে ভাষার বিপর্যয় কীভাবে নিবিড়ভাবে মিশে আছে শিল্প-সাহিত্যের বিচিত্র শাখায়। সঞ্চিত জ্ঞান কীভাবে আমাদের দেখার অভিজ্ঞতাকে প্রভাবিত করে, তা বোঝাতে কিছু ছবির সাহায্য নেওয়া হয়েছে এখানে। আমাদের ভাবনার সীমারেখাকে বা অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রভাবিত দেখার ভঙ্গিগুলিকে ধাক্কা দেয় শিল্প আর সাহিত্য। চেনা জগৎকে তখন নতুন করে দেখার সুযোগ তৈরি হয়। সম্ভব হয় নিজের সঙ্গে নিজের এক নতুনতর বোঝাপড়ার। আমাদের চেনা জগৎ ও চেনা ভাষার যে চিরাচরিত রূপ, তা চুরমার হয়ে যায়। অজ্ঞেয় বা পরমকে ধরার আশায় কবিরা কীভাবে তাঁদের কবিতায় যুক্তি, বুদ্ধি ও চেনা জগতের বাঁধা ছক ভেঙেছেন, তা দেখাতে চেয়েছেন লেখক। উদাহরণ হিসেবে এনেছেন অমিয় চক্রবর্তী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মৃদুল দাশগুপ্ত, জীবনানন্দ দাশ, আল মাহমুদ ও জয় গোস্বামীর কবিতা। যেমন, মৃদুল দাশগুপ্তের কবিতা ‘প্রকৃত পরিচয়’ –

তোমাকে জানাই স্বপ্ন, বসেছি শরীর নিয়ে

হাতেপায়ে – এই অহংকারে।

মাংসের পলাশ জুড়ে প্রতিষ্ঠা বাঁচায় ওরা, চেতনা

হারাও, কিন্তু তাও তো সুশিক্ষা।

এখানে পাশাপাশি থাকা শব্দগুলির অর্থসম্বন্ধ খুঁজে বের করা এক প্রকার অসম্ভব। আমাদের চেনা ভাষা এবং অর্থ খোঁজার অভিজ্ঞতা এ-কবিতায় ভেঙে পড়ছে। সম্ভাব্যতার বাইরে এভাবে তৈরি হয়েছে অসম্ভাব্যতা, চেনার বিপরীতে অচেনা – এক নতুন জগৎ।

বইয়ের তৃতীয় ভাগ ‘চোখের দেখা, মনের বোঝা’য় লেখক ডুব দিয়েছেন চিত্রকলা ও চলচ্চিত্রের জগতে। আগ্রহী পাঠকের চিন্তার জগতে আলাদাভাবে সাড়া জাগায় এ-অংশটি। দৃশ্য অভিজ্ঞতার চেনা জগতে একরকম নাড়া লাগে। মুর্তজা বশীরের আঁকা ‘দুই প্রেমিকার জন্য সংগীত’, পাবলো পিকাসোর আঁকা মারি তেরেসের প্রতিকৃতি, দিয়েগো ভেলাস্কেথের ‘লাস মেনিনাস’ এবং রেনে মাগ্রিতের আঁকা ‘দ্য হিউম্যান কন্ডিশন’ – এই চারটি ছবির সাহায্যে লেখক দেখান চিত্রভাষার বিপর্যয় কীভাবে জন্ম দেয় নতুন অভিজ্ঞতার। সাধারণ দৃষ্টিসীমাকে অতিক্রম করে ছবির শক্তিমত্তা কীভাবে বিস্তৃত হয়ে পড়ে চোখের দেখার বাইরে পর্যন্ত। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করায় ছবিগুলির নন্দনতাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইংগিতগুলি স্পষ্ট হয়ে ওঠে পাঠকের কাছে। কিউবজমের সূত্র ধরে চিত্রকর্মে ইন্দ্রিয়াতীত পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখক লিখেছেন, ‘জীবনের অভিঘাতে শিল্পীর মনে যে তরঙ্গ ওঠে, সেটিকে দৃশ্যমান করার জন্য শিল্পকর্মে তাঁকে চাক্ষুষ অভিজ্ঞতাকে ছাপিয়ে যেতে হয়। চোখের দেখায় যেসব চিহ্নের মধ্যস্থতায় বাস্তবকে তিনি নিজের কাছে বোধগম্য করেন এবং সবার অভিজ্ঞতার সঙ্গে তার শরিক হন, শিল্পকর্ম নিছক সেই অক্ষিপটের অভিজ্ঞতাকে ছাপিয়ে যেতে গিয়ে সেসব চিহ্নের প্রতিসরণ ঘটায়। চেনা ভাষা অচিন দেশে প্রবেশ করে। আমাদের দেখার অভ্যস্ত অভিজ্ঞতা তখন টলে যায়।’ (পৃ ৫১-৫২)

চিত্রকলার বাইরে এ-অংশে আকিরা কুরোসাওয়ার রশোমন (১৯৫০) ও আন্দ্রেই তারকোভস্কির নস্টালজিয়া (১৯৮৩)চলচ্চিত্র দুটোর প্রসঙ্গ টেনেছেন লেখক। এদের মাধ্যমে দেখিয়েছেন সিনেমার ভাষা কীভাবে দর্শককে বিচিত্র কোণ থেকে সত্যের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত করতে পারে। আবার ক্যামেরার শটের বিশেষ প্রয়োগ ও সময়ের স্নায়ুক্ষয়ী চাপ চাইলে কীভাবে দর্শক ও ছবির চরিত্রের মধ্যে ভেদরেখা মুছে দিয়ে তাদের একাত্ম করে তুলতে পারে।

বইয়ের শেষ ভাগ ‘অব্যক্তের ভার’-এ লেখক এই আলোচনার উপসংহারে পৌঁছাতে চেয়েছেন। ভাষা নামক যে সীমানা মানুষ নিজেই সৃষ্টি করেছে, ভাব প্রকাশের প্রয়োজনে সেই সীমানা তারাই আবার কেন ভেঙে ফেলছে, তার উত্তর খুঁজে পেতে চেয়েছেন লেখক এ-অংশে।

অনির্বচনীয় বা সম্পূর্ণ নতুন কোনো ভাবকে ধারণ করার প্রয়োজনে কবিতাকে বেছে নিতে হয়েছে চেনা ভাষার বিলয়ের পথ হিসেবে। একই পথ ধরে বিপর্যয় ঘটেছে চিত্রকলা, চলচ্চিত্র বা সংগীতের গতানুগতিক ভাষায়। আর বিপর্যয়ের পথ ধরে জন্ম নেওয়া এই ভাবগত রূপই মানুষকে ধাবিত করে পরমের দিকে বা ‘ঈশ্বর দর্শনে’র দিকে। এর মাঝেই জীবনের উদ্দেশ্য নিহিত আছে বলে মনে করেছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংস। অন্তর্জলী যাত্রার উৎসর্গপত্রে তাঁর এ-উক্তিটি তলিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন কমলকুমার মজুমদার। ঠিক যেখান থেকে শুরু করেছিলেন লেখক, শিল্পকলার বিচিত্র পথে ঘুরিয়ে প্রবন্ধের শেষে আবার সেখানেই ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন পাঠককে। লেখকের ভাষায়, ‘নতুন ভাবের অঙ্কুর স্বাধীনভাবে ভাষার মধ্যে আত্মপ্রকাশ করার সময় সেটিকে ভেঙেচুরে নিজের স্বভাবে আত্মস্থ করে নেয় – যেন কোনো মৃৎশিল্পে রূপান্তরের আগে শক্ত মাটিকে শিল্পীর হাতে কাদার মতো নরম করে তোলে – আর সেটিকে গড়ে নেয় একেবারে নিজের মতো করে – ভাষার চেনা শৃঙ্খলা তাই তখন লোপ পায়, অন্বয় ছিটকে পড়ে, অভিধান থেকে শব্দ উৎসাদিত হয়। ভাষার এই দশাকেই আমরা কবিতা বলে চিনি; কিংবা অন্যতর ভাষার ক্ষেত্রে গান, চিত্রকলা বা চলচ্চিত্র বলে।’ (পৃ ৭০-৭১)

আলোচনার প্রয়োজনে এ-বইয়ের মাঝে বারবার এসেছে ফ্রিডরিখ নিৎসে, মার্টিন হাইডেগার কিংবা হেগেলের মতো দার্শনিকদের ভাবনা। তাঁদের তাত্ত্বিক আলোচনার সঙ্গে নিজের ভাবনার যোগ ঘটিয়ে লেখক একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চেষ্টা করেছেন অনেক ক্ষেত্রে। চিত্রের ব্যবহার এবং সেগুলিকে ধরে আলোচনা করার ফলে লেখকের ভাবনার সঙ্গে পাঠকের এক ধরনের সহজ যোগসূত্র স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সবমিলিয়ে ভাষার সৌকর্য এবং চিন্তার উৎকর্ষের জন্য এ-বইটি যে-কোনো মগ্ন পাঠককে ভাবনার যথেষ্ট খোরাক জোগাবে বলে আশা করা যেতে পারে।