চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্ব

মুর্শিদা জামানের আগ্রহের বিষয় অনেক। তিনি

সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা শাখায় কাজ করে চলেছেন। লেখালেখি, বিশেষ করে কথাসাহিত্যে তাঁর ঝোঁক বেশি। সম্প্রতি বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে বেরিয়েছে মুর্শিদা জামানের তেরোটি গল্পের সংকলন অপ্রতিরোধ্য বসন্ত। সমসাময়িক জীবনের জটিল প্রসঙ্গকে এসব গল্পে নানা আঙ্গিকে তুলে আনতে প্রয়াসী হয়েছেন মুর্শিদা জামান। নিম্নে বর্ণিত গল্পগুলো ছাড়াও  এ বইয়ের অন্য গল্পগুলো হলো – কৈলাস, থাই গ্লাস, দুটি পাখির পালক, ফণীমনসা, মৃত্যু গন্ধহীন, কলুষ্কাল ও বরাভয় ও অন্তরঙ্গ কোলাহল। 

বইয়ের শিরোনামীয় ও প্রথম গল্প ‘অপ্রতিরোধ্য বসন্ত’ এক কল্পভবিষ্যতের কথা বলে, যা হয়তো বাস্তবে রূপ নেবে এই পৃথিবীতে অচিরেই। যেখানে মানুষ আর আগের মতো সৌন্দর্যের অধিকারী নয়। নানা প্রতিকূলতা আর নিজেকে নিয়েই সবাই ব্যতিব্যস্ত। সবাই চায় অমরত্ব, সুশ্রী হতে। কিন্তু মেলে না।  এদিকে মানবসৃষ্ট জলবায়ু বিপর্যয়ের অভিঘাতে পৃথিবীতে বেড়েছে জলের পরিধি, ডুবে গেছে নিম্নভূমি। এতে বাসস্থান নিয়েও উদ্বেগ বেড়েছে।

সেই সময়ে জন্ম হয় তোতাইয়ের। দিন দিন অনিন্দ্যসুন্দর এক যুবক হয়ে ওঠে সে। যার দিকে তাকালে যে-কারো চোখ আটকে যায়। শারীরিক সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গে মেধা-প্রজ্ঞায় সে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। জামি ও মেঘলা দম্পতির সংসারে তার প্রবেশ চিকিৎসা-সংক্রান্ত বিষয়ে। কিন্তু দিন দিন তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে মেঘলা, যেখানে সন্তানবাৎসল্য ছাপিয়ে ওঠে অন্য কোনো তীব্র আকর্ষণ। শুধু মেঘলাই নয়, পুরো শহর যখন জানতে পারে তোতাইয়ের কথা, তখন সবার লক্ষ্য থাকে তাকে নিজের করে পাওয়ার। সেই শীতসময়ে তোতাই যেন দুর্দমনীয় বসন্তের প্রতীক। সে যেন সকল জরা, দুঃখ, হতাশা মুছে দিয়ে অনন্ত যৌবনের, সুখের প্রতীক। একসময় সবার চাওয়ার মিলিত রূপ ভয়ংকর হয়ে উঠলে তোতাইয়ের আশ্রয় হয় পানিতে। কিন্তু সে হারিয়ে যায় না হয়তো, মানুষের মনে তাকে পাওয়ার আকাক্সক্ষা, বসন্ত ফেরার প্রত্যাশা জ্বলজ্বল করে।

‘বহিরাগত’ গল্পের প্রধান চরিত্র শিলু ও আরিফ। এ-গল্পে জৈবিক চাহিদা মেটাতে না পেরে মানুষের ভেতরকার অন্তর্দহন পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

শিলু-আরিফ দম্পতি। দুজন যেন দুই মেরুর। শিলুকে বহু রাত বারান্দায় রেলিং ধরে কাঁদতে হয় একটু আবেগঘন যৌনতার জন্য; কিন্তু আরিফের ভেতর তেমন কোনো বোধ কাজ করে না হয়তো। দিন দিন দূরত্ব বাড়ে দুজনের। একসময় কর্মব্যস্ত-সফল শিলু আলাদা থাকার কথা জানায় আরিফকে এবং সংসারের বেড়াজাল ভেঙে সে বেরিয়ে পড়ে ছুটি কাটাতে।

রিসোর্টে এসে নিজেকে স্বাধীন মনে হয় শিলুর; যার সঙ্গে খুশি প্রেমে পড়বে ধরনের আবেগে মথিত হয় তার হৃদয়। এ সময় তার রিসোর্টে আসা এক ব্যক্তির সঙ্গে বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় কাছাকাছি আসার প্রবল আগ্রহে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে, সমর্পণ করতে চায় নিজেকে তার কাছে। কিন্তু পরক্ষণেই তার ভুল ভাঙে আগন্তুকের কথায়। তিনি জানান, ‘… আই হ্যাভ অ্যা বয়ফ্রেন্ড।’ অর্থাৎ তিনি সমকামী। শিলুর মনের আশা মুহূর্তে মিইয়ে যায়। ঘরের বাইরে যে ‘বহিরাগত’ সুখের সে সন্ধান করছিল, তা অধরাই থেকে যায়।

‘আঁধার খণ্ডন’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের স্বাধীনতা দিলেও সবাই কি সেই স্বাধীনতার সুখ উপভোগ করতে পেরেছে? সেই প্রশ্নই যেন এই গল্পে বড় হয়ে ওঠে। গল্পে আমরা পাই ধনীগৃহের বিশ^স্ত ভৃত্য আজগরকে। তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর সাহসিকতা ও আত্মবলিদানের জন্য বেঁচে যায় সেই ধনী পরিবার। মারা যান আজগর ও তাঁর স্ত্রী। তাঁদের সন্তান সবুর থেকে যান সেই পরিবারের সঙ্গে – ভৃত্য হিসেবেই। কিন্তু তাঁর বাবা-মায়ের আত্মবলিদান তাঁকে কোনো বাড়তি সুবিধা এনে দেয় না। তিনি গৃহভৃত্য হিসেবেই এই পরিবারের সঙ্গে জীবন কাটিয়ে দেন। গল্পকথক জীবনসায়াহ্নে এসে যখন তাঁর বাবার পুরনো ডায়েরি ঘেঁটে সেই তথ্য জানতে পারেন, তখন তিনিও আত্মদহনে ভোগেন। কিন্তু তাঁর সময় যে শেষ, একইভাবে তাঁর বড় ভাইয়ের সমবয়সী বিশ্বস্ত সবুরও আজ জীবনের শেষপ্রান্তে। তাই প্রশ্ন থেকেই যায়, স্বাধীনতা কি সবার জন্য সমান আনন্দ, সুযোগ বয়ে এনেছিল?

‘ওয়েডিং রিং সোসাইটি’ গল্পের মূল চরিত্র মিস্টার অ্যান্ড মিসেস অ্যান্ড্রু। মিসেস অ্যান্ড্রু ওয়েডিং রিং সোসাইটির কর্ণধার। মিস্টার অ্যান্ড্রু একসময় সেনাবাহিনীতে ছিলেন। ইরাকের নির্মম যুদ্ধ তাঁকে ঠেলে দিয়েছিল মানসিক রোগের দিকে। সেনাবাহিনী থেকে রিটায়ার করে হয়েছেন একজন ট্রাভেল ব্লগার। অন্যদিকে মিসেস অ্যান্ড্রু হচ্ছেন নারীবাদী সংগঠক। নারীদের কল্যাণে তিনি সদাব্যস্ত। গল্পটি এগিয়ে যায় রেবুতি, বাশার, এনাম ইত্যাদি চরিত্রের সংযুক্ততায়।

‘কাচভাঙা আয়না’ একটি ভাঙা পরিবারের কাহিনি। কবির ও তারেক দুই ভাই। কবির বড়, চাকরিজীবী। ছোট ভাই তারেক বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। তাদের বাবা নতুন সংসার করে তাদের ছেড়ে গেছেন। এ অবস্থায় কবিরের উপার্জনে কোনোমতে চলছিল সংসার। কিন্তু তারেক স্বপ্ন দেখে একটি সচ্ছল সংসারের। আর্থিক সচ্ছলতার জন্য সে বেছে নেয় রাজনীতির পথ। এদিকে অফিসের সহকর্মীরা কবিরকে নিয়ে ঠাট্টা করে, বিশেষত তার বিয়ে নিয়ে। কিন্তু কবির ভুলতে পারে না তার অতীত। তার মনে বাবার স্মৃতি, তার ছোটবেলার স্মৃতি ঘুরেফিরে আসে। চাইলেও সে ভুলতে পারে না, কিন্তু যে সম্পর্ক ভেঙে যায় তা যে আর জোড়া লাগে না সেটা তো অমোঘ সত্য।

ব্যক্তি, সমাজ এবং সময়ের নানামুখী ঘটনা ও জটিলতার কথা মুর্শিদা জামান তাঁর গল্পগুলোয় তুলে আনেন। তিনি দেখাতে চেষ্টা করেন, জীবনের নানা বাঁকে দেখা পরিচিত-অপরিচিত মানুষগুলিকে। লেখকের ভাষায়, ‘কতজনের শূন্য চোখ অথবা ব্যথাভরা হাসি আমাকে দিয়েছে হয়তো ছোট্ট একটি শব্দ অথবা বাক্য।’ বলা যায় সেই চেষ্টায় সফলও মুর্শিদা জামান। এই গ্রন্থভুক্ত অন্যান্য গল্পও আমাদের চিন্তালোকে নিত্যদিনের হতাশা-বঞ্চনা, সুখ-স্বপ্নের পাশাপাশি দূর-ভবিষ্যতের কল্পনাকে মূর্ত করে তোলে।

অপ্রতিরোধ্য বসন্ত বইটির গল্পগুলো জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার খণ্ডাংশ মাত্র।  বইটি পাঠের মধ্যে দিয়ে পাঠকও জীবনাভিজ্ঞতার আস্বাদ পাবেন। এর বহুল প্রচার কামনা করছি।