জলের অক্ষরে লেখা

পর্ব : ৬

অবন্তিকে পৌঁছে দিয়ে ফেরার সময় অংশুর ইচ্ছে করছিল আরো কিছুক্ষণ পথে পথে ঘুরে বেড়াতে। শহরের নানা প্রান্তে তার নকশায় নানা স্থাপনা তৈরি হয়েছে। মাঝে মাঝে সে একাই বেরোয় সেসব দেখতে, সাধারণত মাঝরাতে, যখন কেউ থাকে না আশেপাশে। কখনো-বা অপলাও সঙ্গে থাকে। একেকটা ভবন বা স্থাপনা সে অনেকক্ষণ ধরে দেখে। ভাবে, যা সে কল্পনা করেছিল, তার কতটুকু এখানে আছে! অনেক সময় সন্তুষ্ট হয় সে, অনেক সময় মন খারাপ লাগে। মনে হয়, আরো ভালো কিছু করার সুযোগ ছিল। অবশ্য সে যতই অতৃপ্তিতে ভুগুক, তার স্বকীয়তার চিহ্ন সব কাজেই থাকে। এরকম এক মেগাসিটিতে, যেখানে নিত্যনতুন উঠছে দারুণ সব অট্টালিকা সেখানে আলাদাভাবে নিজেকে চেনানোর কাজটি কঠিনই ছিল। এমন তো নয় যে সে প্রচুর কাজ করতে পেরেছে, অন্যান্য আর্কিটেক্ট ফার্মের তুলনায় তার কাজের পরিমাণ অল্পই। কিন্তু যেগুলো করেছে, দীর্ঘ সময় নিয়ে করেছে, প্রচুর চিন্তা আর কল্পনা মিশিয়ে করেছে। নিজের সৃজনশীলতার সবটুকু সে ঢেলে দিয়েছে তার স্থাপত্যকর্মে।  

এ আসলে নিজেকেই ফিরে দেখা। না, কেবল নিজের কাজকে নয়, নিজের সময়কেও। বড় হয়ে উঠতে উঠতে সে দেখেছে, কী অবিশ^াস্য দ্রুত গতিতে বদলে যাচ্ছে এই শহরের চেহারা। ছিমছাম-প্রাণবন্ত-অলস-আরামপ্রিয়-আড্ডাবাজ চরিত্রের চিরচেনা শহর হয়ে উঠছে অচেনা, হারিয়ে ফেলছে নিজস্ব চরিত্র। সে তার স্থাপনায় সেই হারানো দিনের স্মৃতি ধরে রাখতে চেয়েছে। তার কল্পনাশক্তি ভালো, অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল, এই শহর হয়ে উঠবে অশান্তির, অস্বস্তির, অবিশ^াসের, অসততার, বিচ্ছিন্নতার, একাকিত্বের। সে চেয়েছে, তার কাজগুলো যখন দেখবে মানুষ যেন শান্তি পায় মনে, যেন ফিরে আসে পুরনো স্মৃতি। কেবল নকশা করেই সে দায়িত্ব শেষ করেনি, কোন ভবনের রং কেমন হবে, অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা কেমন হবে তারও দিকনির্দেশনা দিয়েছে। তার এতসব শর্ত সবাই মানতে চায় না, কেবল রুচিশীল মানুষের পক্ষেই এর মর্ম বোঝা সম্ভব। ফলে হঠাৎ-গজিয়ে-ওঠা ধনীদের শহরে তার কাজ পাওয়ার পরিমাণও অল্প। তাতে কিছু যায়-আসে না। সে তো কেবল টাকা কামাতে এই পেশায় আসেনি, এসেছে নিজের চিন্তার ছাপ রেখে যেতে। এবং সম্ভবত কিছুটা পেরেছেও। তবু তার সংশয় যায় না। বারবার ঘুরে-ফিরে দেখে নিজের কাজগুলো। ভাবে, সত্যিই কি এগুলো আলাদা? সে যখন থাকবে না, তখনো কি রয়ে যাবে এগুলো, তার চিন্তা-স্বপ্ন-কল্পনার সাক্ষী হয়ে? মানুষ কি মনে রাখবে তাকে? নাকি আর সব মানুষের মতোই মুছে যাবে সেও, চিরতরে? 

আজো নিজের কাজগুলো দেখতে ইচ্ছে করছিল জহির আমিন ওরফে অংশুর। বাসার পথ ধরেনি সে এখনো। বৃষ্টিভেজা শহর কী সজীব হয়ে উঠেছে! নির্জন রাস্তা, ভিড় নেই, কোলাহল নেই; দিনের বেলায় যে-শহর আর্তনাদ করে বেড়ায়, সে-ই এখন কেমন মিউজিকের মতো মোহনীয় হয়ে উঠেছে! এই রাত বাসায় ফেরার মতো নয়। সে স্টেরিওতে সত্যিই মিউজিক চালিয়ে দিলো। ভেসে এলো হৃদয়স্পর্শী সুর। কখনো কারুনেশ, কখনো ইয়ানি, কখনো আরমন্ড আমর বাজিয়ে চলেছেন তাঁদের অপূর্ব সব কম্পোজিশন। হৃদয় আর্দ্র হয়ে উঠেছে, মনে হচ্ছে জীবনের কোথাও কোনো গ্লানি নেই, বেদনা নেই, হৃদয়ের কোনো কোণে ঘৃণা লুকিয়ে নেই, নেই লোভ, বিদ্বেষ, অহম, হিংসা, ক্রোধ। সব শান্ত, সমাহিত, মোহনীয়।

প্রায় ঘণ্টাখানেক সে ঘুরে বেড়ালো পথে পথে। তারপর মনে হলো, রাত বেশি হয়ে গেছে। বাসায় ফেরা দরকার। অপলা জেগে থাকবে। এই আরেক সমস্যা, সে যত রাত করেই ঘরে ফিরুক, অপলা ঘুমাবে না। সে অনেকবার বলেছে, ঘুমিয়ে পড়ো, আমার ফিরতে দেরি হবে। লাভ হয়নি। তার কাছে চাবি আছে, অনায়াসে নিজেই দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে পারে, কিন্তু অপলাই খুলে দেয় সবসময়। আজো ব্যতিক্রম হলো না।

আড়াইটা বাজে, এখনো জেগে আছো?  –  বললো সে।

এ আর নতুন কী? জানোই তো জেগে থাকবো।

কেন থাকো বলো তো?

এতদিন পর হঠাৎ এই প্রশ্ন?   

আগেও জিজ্ঞেস করেছি। উত্তর পাইনি।

পেতে হবে না। তুমি কাপড়চোপড় ছেড়ে ফ্রেশ হও।

না। তোমার সঙ্গে কথা আছে।

ঠিক আছে বলবে। আগে ফ্রেশ হয়ে নাও।

না এখনই বলবো।

আজকে বেশি খেয়েছ!

তা একটু খেয়েছি। কিন্তু এ-কথা কেন বললে?

একটু পাগলামির আভাস দেখতে পাচ্ছি।

পাগলামি না। সত্যি করে বলো তো, এই যে এত রাত করে বাড়ি ফিরি, তোমর রাগ হয় না?

কেন এসব প্রশ্ন করছো?

আহা বলোই না। রাগ হয় না তোমার?

না হয় না। জানোই তো।

কেন হয় না?

আজব তো! রাগ হবে কেন?

কেন হবে না? সব স্ত্রীই তো রাগ করে, তুমি করো না কেন?

 কী হয়েছে তোমার বলো তো?

না, তুমি আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।

অপলা হেসে ফেললো  –  তুমি তো আর রোজ দেরি করে ফেরো না, রোজ ড্রিংক করেও ফেরো না।

যদি ফিরতাম?

তাহলে রাগ করতাম। খুবই রাগ করতাম। একদম এসপার-ওসপার করে ফেলতাম।

অংশুও হেসে ফেললো এবার।

হাসছো কেন?

তোমার মুখে এসপার  –  ওসপার শব্দটা শুনে হাসলাম।

এখন বলো, এসব প্রশ্ন কেন?

ওরা এগুলো জিজ্ঞেস করছিল।

ওরা মানে ঋভু ভাই? অবন্তি আপা?

হ্যাঁ।

আচ্ছা! তুমি কী বললে?

যা বলার তা তো বললামই।

বলো না!

তোমার শুনে কাজ নেই। অহংকার বেড়ে যাবে।

আমার এমনিতেই যথেষ্ট অহংকার। বাড়ার আর জায়গা নেই।

হা  –  হা  –  হা। শোনো, আমাদের দাম্পত্যজীবন নিয়ে ওদের খুব কৌতূহল।

খুব স্বাভাবিক।

কেন? স্বাভাবিক কেন?

যাদের দাম্পত্য জীবনে সমস্যা থাকে, অন্যদের জীবন নিয়ে তাদের খুব কৌতূহল থাকে।

ও! কারণ তাহলে এটা?

হ্যাঁ। তা, তোমার প্রজেক্টের কতদূর কী হলো?

কোন প্রজেক্ট?

এই যে দুজনকে মিলিয়ে দেওয়া!

খুব একটা অগ্রগতি নেই।

কেন?

কেউ ধরা দিচ্ছে না। অবন্তিকে আজকে সরাসরিই বললাম।

তাই নাকি? কী বললো?

অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব, অনেক ইগো।

আর ঋভু ভাই?

সে তো তোমার প্রেমেই হাবুডুবু খাচ্ছে।

এ্যাই খবরদার। ফাজলামি করবে না।

সত্যি বলছি। ওর মুখে কেবল অপলা অপলা!

আবার! যা জানতে চাইছি সেটা বলো না!

ওকে বোঝা যাচ্ছে না। অবন্তিকে এখনো পছন্দ করে, সেটা বোঝা যায়, কিন্তু বিয়ের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বোধহয় এখনো নিজেকে তৈরি করতে পারছে না।

হুম। এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়া তো কঠিনই। কিন্তু তুমিই বা কেন চাইছো যে, ওদের বিয়ে হোক?

তোমাকে সত্যি করে বলি, আমার চিন্তাটা আসলে অবন্তিকে নিয়ে নয়, ঋভুকে নিয়ে। ওর এই একা থাকা আমার ভালো লাগে না।

কিন্তু উনি যদি একা থাকতে পছন্দ করেন …

পছন্দ করতো। কিন্তু এখন হাঁপিয়ে উঠেছে।

কীভাবে বুঝলে?

এটুকু না বুঝলে আর বন্ধু কিসের? আসলে ঋভু তো আমার বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু।

হ্যাঁ, জানি।

ও আমার পাশে না দাঁড়ালে এই ফার্মটা আমি দাঁড় করাতে পারতাম না।

পারতে, তবে কষ্ট হতো।

হ্যাঁ, খুবই কষ্ট হতো। ব্যাংক লোন পাচ্ছিলাম না কোনোভাবেই। অথচ তখন টাকার খুব দরকার ছিল। কী যে কঠিন এক সময় যাচ্ছিল! আমি তো সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাইনি। বাবা কিছুই রেখে যাননি। বড় ছেলে বলে সংসারের দায়দায়িত্ব কাঁধে। মায়ের যত্ন, ভাইবোনদের পড়াশোনা, ওদের প্রতিষ্ঠা আর নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটানো। হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলাম। অথচ চোখে এবং মনে অনেক স্বপ্ন, অনেক কিছু করার সাধ। চাকরি করে এইসব সাধ পূরণ হবে না, বুঝে গিয়েছিলাম। কিন্তু কী করবো? নিজের ফার্ম তো দাঁড়ই করাতে পারছি না! একদিন ঋভুকে সমস্যার কথা বললাম। ওর কাছ থেকে কোনো সহায়তা আশা করিনি, কেবল একটু হালকা হতে চেয়েছিলাম। ও সব শুনেটুনে বললো, টাকা পেলে ফার্ম দাঁড় করাতে পারবি?

পারবো।

নিশ্চিত?

একশ ভাগ নিশ্চিত।

ঠিক আছে, আমার কাছ থেকে নিয়ে নিস।

মানে?

মানে, এত দৌড়াদৌড়ি না করে আমার কাছ থেকে নে।

তোর কাছ থেকে? কত টাকার কথা বলেছি মনে আছে?

হ্যাঁ। পঞ্চাশ লাখ।

এত টাকা তোর কাছে আছে?

আমার কত টাকা আছে সে ব্যাপারে তোর কোনো ধারণাই নেই অংশু।

আর তুই এই টাকা নিয়ে বসে আছিস?

তো কী করবো?

ব্যবসা কর।

ব্যবসা করে কী হবে?

এটা কোনো কথা বললি?

ব্যবসা তো টাকার জন্যই করবো। কিন্তু এত টাকার তো আমার দরকার নাই।

এখন না থাকলেও পরে দরকার হবে।

হবে না। কখনোই এত টাকার দরকার হবে না। আমার কথা বাদ দে। তুই টাকাটা নিয়ে নে।

তুই সিরিয়াস?

অবশ্যই সিরিয়াস। এটা তো কোনো ইয়ার্কির বিষয় না, তোর জীবনের ব্যাপার।

পরদিনই ও চেক দিলো। পঞ্চাশ লাখ টাকা! তখনকার দিনে পঞ্চাশ লাখ মানে এখনকার সময়ে পাঁচ কোটি! একেবারে মুখের কথায় দিয়ে দিলো। কোনো প্রমাণও রাখলো না। আমি যদি টাকাটা মেরে দিতাম ওর কিছুই করার ছিল না। অদ্ভুত না?

হ্যাঁ, অদ্ভুত।

তারপর কী হলো শোনো। আমি তো ফার্মটা দাঁড় করালাম। কিন্তু বেশিরভাগ টাকাই তো ওর। আমি কি অকৃতজ্ঞ হতে পারি? মেমোরেন্ডাম রেডি করে, ওকে চেয়ারম্যান হিসেবে রেখে, দলিল  –  দস্তাবেজ নিয়ে একদিন গেলাম ওর কাছে। আগে থেকে কিছু বলিনি ওকে সারপ্রাইজ দেবো বলে। বললাম, পড়ে দ্যাখ সব ঠিক আছে কি না। ও বললো, কী এগুলো?

পড়েই দেখ।

দলিলটলিল পড়তে পারবো না।

আহা একটু চোখ বুলিয়ে দে না।

ও একবার পাতা উল্টিয়ে গেল। তারপর বললো  –  এসবের দরকার নাই। তোর যখন টাকা হবে, ফেরত দিয়ে দিস।

তা চলবে না ঋভু। শেয়ার তোকে নিতেই হবে।

আমি কেন নেবো? ফার্ম তো তোর।

কিন্তু ইনভেস্টমেন্ট তো তোর।

আমার আবার কিসের ইনভেস্টমেন্ট? তুই ব্যাংক থেকে লোন নিতে চেয়েছিলি, লোনটা আমি দিয়েছি, এটুকুই।

বাজে কথা বলিস না। সাইন কর।

না। করবো না।

জেদ করিস না তো! সাইন কর।

আচ্ছা। শেয়ার দিতে চাইছিস তো? ওই চেয়ারম্যান ব্যাপারটা বাদ দে। আমি কোনো দায়িত্ব নিতে পারবো না। আর শেয়ার দে ফিফটি ফিফটি। তুই আমাকে সেভেনটি ফাইভ পার্সেন্ট দিয়েছিস কেন?

কারণ সেটা তোর প্রাপ্য।

তাহলে আমি সাইন করবো না।

আচ্ছা। ফিফটি ফিফটি করে দিচ্ছি। কিন্তু চেয়ারম্যান হিসেবে তুই থাকছিস।

না, থাকছি না। বললাম না কোনো দায়িত্ব নিতে পারবো না?

তোর দায়িত্ব নিতে হবে না। তবু তোর নাম থাকতে হবে।

ও একটা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে বললো, আচ্ছা কলম দে। তারপর শেয়ারের জায়গায় কেটে ফিফটি ফিফটি করলো, দুজনই সেখানে সাইন করলাম। কিন্তু জানো, এত বছরেও ও কখনো ফার্মের ব্যাপারে কিছুই জানতে চায়নি। ওর প্রাপ্য অংশ আমি ওর অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিই, কিন্তু কখনো জানতেও চায় না, কীভাবে কী হচ্ছে।

অপলা হঠাৎ করেই অংশুর দুটো হাত ধরে বললো, তোমার কি আজকে খুব মন খারাপ?

কেন বলো তো? তোমার এ-কথা মনে হলো কেন?

এসব ঘটনা তো আমি জানিই। কতবার শুনেছি! তবু তুমি আগাগোড়া আবার বললে। কী হয়েছে, বলবে আমাকে?

অংশু বললো, তুমি যে সত্যিই আমাকে বোঝো তার প্রমাণ আমি অনেকবার পেয়েছি। হ্যাঁ আমার মন খারাপ। তোমাকে যে বারবার আমার স্ট্রাগলের গল্প বলি, তুমি কি বিরক্ত হও?

বিরক্ত হবো কেন? আশ্চর্য!

না, মানে বারবার একই গল্প …

না গো, বিরক্ত হই না। তোমার গল্প তো আমারও গল্প।

তুমি যে কী ভালো একটা মেয়ে!

নাও হয়েছে। অত প্রশংসা করতে হবে না। এবার বলো তোমার মন খারাপ কেন?

আজকে আমরা বসেছিলাম ঋভুর বাসায়। আমারই ডিজাইন করা। সবকিছু নিখুঁতভাবে সাজানো। তবু আমার মনটা এত খারাপ হলো!

কেন খারাপ হলো?

ওর বাসায় সব আছে কিন্তু প্রাণ নেই। কোনো মানুষ বাস করে না ওখানে। ওই যে চাচা-চাচি, এমনকি দারোয়ান করিম, সবাই যেন মৃত মানুষ। কারো মুখে হাসি নেই। সবাই যেন যন্ত্রের মতো কাজ করে চলেছে। ঋভু তো অনেক আগেই মরে গেছে। কিন্তু ওর বাসায় গিয়ে আজকে মনে হলো, এর আগে কখনো এত তীব্র বিষাদ দেখিনি ও-বাড়িতে।  

হুম। এতক্ষণে বুঝলাম।

তুমি জানতে চাইছিলে না, কেন ওর বিয়ের জন্য এত ভাবছি? আমি আসলে ভেবেছি অনেক আগেই, বলেওছি ওকে অনেকবার। কারণ ওর এই ডিপ্রেশন ওকে কোনদিকে নিয়ে যায়, আমি তা নিয়ে শঙ্কিত। সুইসাইডও করে ফেলতে পারে।

ধুর! কী বলছো এসব!

আমার সত্যিই ওরকম মনে হয়।

খোদা না করুন। ওরকম কিছু হবে না।

না হলেই ভালো। ও তো বিয়ের কথা কানেই নেয়নি। অবন্তির আসার খবর পেয়ে মনে হলো, এবার কিছু হতে পারে। আফটার অল, ওদের প্রথম যৌবনের প্রেম তো!

তোমার আশা পূরণ হোক।

হ্যাঁ। হওয়া দরকার। ওদের বিয়ে হোক, বাচ্চা হোক, ওরা কিছু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ুক।

এই বয়সে কি আর বাচ্চা হবে?

কেন হবে না? আমি তো এখনো বাচ্চা নিতে চাই।

দুটোতে মন ভরেনি?

উঁহু। আমি তো গণ্ডায় গণ্ডায় বাচ্চা চেয়েছিলাম।

গণ্ডায় গণ্ডায়! ওরে বাবা, মরে যাবো।

মরবে না, মরবে না। আগেকার মায়েরা নিতো না?

তুমি সত্যিই এখনো বাচ্চা চাও?

হ্যাঁ চাই।

কিন্তু এই বয়সে …

এমন কি বয়স হয়েছে তোমার? চল্লিশও তো হয়নি।

তবু, রিস্কি।

রিস্কি ভাবলেই রিস্কি।

তুমি সত্যিই চাও?

হ্যাঁ চাই।

ঠিক আছে, আমি রাজি।

সত্যি?

হ্যাঁ গো প্রাণনাথ, রাজি।

তাহলে হয়ে যাক একবার।

আজকেই?

হ্যাঁ। আজকেই। এখনই।

ঠিক আছে, ফ্রেশ হয়ে এসো।

ফ্রেশট্রেশ হতে পারবো না। এসো।

লাইটটা অফ করে দাও।

আচ্ছা।

সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরে এসে … কথা শেষ করতে পারলো না অপলা, অংশুর ঠোঁট নেমে এলো ওর ঠোঁটের ওপর। কিছুক্ষণ পর বললো, এসো আজকের সঙ্গমটা আমরা ঋভু আর অবন্তিকে উৎসর্গ করি। ওদেরও যেন এমন আনন্দময় মুহূর্ত আসে।

দেখো। দুজনের কথা বলে কেবল বান্ধবীকেই ভেবো না কিন্তু … অপলার গলায় দুষ্টুমির আভাস।

সে নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।  –  অংশুও কম যায় না।

খবরদার।

খবরদার কেন? আমি বান্ধবীর কথা ভাবি, তুমি আমার বন্ধুর কথা ভাবো।

ঋভু ভাই? এই না না, ছি! আমি ভাবতে পারবো না।

এইসব খুনসুটি করতে করতেই অংশু ঢুকে গেল অপলার ভেতরে। এত চেনা এই শরীর, তবু এখনো ওকে নতুনের মতো লাগে অংশুর। এত আকর্ষণীয় আর আবেদনময়ী সঙ্গী খুব কম  মানুষই পায়। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হলো তার।

দারুণ তৃপ্তিকর এক সফল সঙ্গম শেষে দুজনেই দুজনকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলো অনেকক্ষণ, আলতো করে আদর করে দিতে লাগলো পরস্পরকে। একসময় অপলা বললো  –  ওঠো, ফ্রেশ হয়ে নাও। রাত তো প্রায় শেষ হয়ে এলো। ঘুমাবে কখন?

হুঁ। উঠছি। সব দিন কি আর একরকম হয় বলো? অফিসে না-হয় একটু দেরি করে যাবো।

আচ্ছা যেও। এখন ওঠো।

দুজনেই উঠলো, ফ্রেশ হলো, শুয়ে পড়লো। অংশু তখন ফের বললো  –  তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো। সত্যি করে উত্তর দেবে।

আবার কিসের কথা? এখন ঘুমাও।

না, কথাটা শুনতে হবে।

আচ্ছা বলো।

আজকে অবন্তিকে রেখে ফিরে আসার সময় ভাবছিলাম, নিজের কাজগুলো দেখে আসি। আমি তো এরকম কতবারই করেছি। কিন্তু আজকে বেশি রাত হয়ে গেল বলে বাসায় চলে এলাম। সেই থেকে প্রশ্নটা মাথায় ঘুরছে।

কী প্রশ্ন?

আমি কি সত্যিই আলাদা কিছু করতে পেরেছি? আমি যখন থাকবো না কাজগুলো কি থাকবে? কেউ কি আমার সৃষ্টির মধ্যে আমাকে খুঁজে পাবে?

কেন এসব প্রশ্ন করছো? কী হয়েছে তোমার?

একটা কবিতা পড়েছিলাম। বলা ভালো ঋভু আমাকে পড়িয়েছিল। তারপর থেকেই …

 কোন কবিতা?

পুরোটা মনে নেই। দুটো লাইন এরকম : ‘একটি গাছের নামে তুমি তাকে এড়িয়ে গিয়েছ পৃথিবীর নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়/প্রত্যেকেই মুছে যেতে আসে কোনো একদিন সকলের মুছে যেতে হয়।’

অপলা একটু গম্ভীর হয়ে গেল। বললো, তারপর?

পুরোটা মনে নেই তো!

না, সেটা বলছি না। পড়ার পর এমন কী হলো?

ব্যাপারটা নিয়ে আমি ভাবিনি কখনো। কিন্তু ঋভু ব্যাপারটাকে একেবারে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেল।

কী রকম?

ওটা না হয় ঋভুর কাছেই শুনো। আমি অত গুছিয়ে বলতে পারবো না।

গুছিয়ে বলার দরকার নেই। একটা আলাপের মাঝখানে যতি টেনে দিও না তো। বলো।

আচ্ছা বলছি। মানুষ যেহেতু মৃত্যুকে সঙ্গে নিয়েই জন্মায়, আজীবন সঙ্গী হিসেবে মৃত্যুকে বয়ে বেড়ায়, তারপর একদিন তার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়, সেজন্য মুছে যাওয়াই মানুষের নিয়তি।

কারো মৃত্যু হলেই সে মুছে যায় নাকি?

সমস্যাটা ওখানেই। ঋভু মনে করে, মৃত্যু মানেই মুছে যাওয়া। ধরো, কেউ একজন মারা গেল, তার যদি সন্তান থাকে তাহলে তারা তাকে মনে রাখবে, কিন্তু তার পরের প্রজন্ম? কিন্তু একশ বছর পরের প্রজন্ম? তাদের কাছে তো নামটাও থাকবে না।

হুম।

ও বলে, কেবল শিল্পীদের কথা আলাদা। অল্প কয়েকজন ভাগ্যবান শিল্পীকে মানুষ মনে রাখে, রেখেছে শত শত বছর ধরে। তাঁরা মুছে যাননি। বেঁচে আছেন তাঁদের কাজের ভেতর দিয়ে।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ।

আমি বলিনি, ঋভু বলেছে।

ওই হলো।

আমি নিজেকে শিল্পী হিসেবে দাবি করি না। কিন্তু আমার কাজগুলোতে আমার চিন্তা  –  স্বপ্ন  –  কল্পনা মিশে আছে, শিল্পীদের যেমন থাকে। সেজন্যই জানতে ইচ্ছে করে, ওগুলো কি থাকবে? মানুষ কি মনে রাখবে আমার কথা, আমার কাজগুলোর কথা? 

আমি উত্তর দিলে চলবে?

খুব চলবে। তুমিই তো আমার শিল্পযাত্রার প্রথম সঙ্গী।

হ্যাঁ, তুমি সত্যিই আলাদা কিছু করেছ। তোমার কাজগুলোও থাকবে, ওরা তোমার হয়ে কথা বলবে।

সত্যি বলছো?

হ্যাঁ, সত্যি বলছি। তোমাকে স্বামী হিসেবে বিশেষ ছাড় দিচ্ছি না, আমার বোঝাপড়া থেকে বলছি।

কোন বিশেষ কারণে এরকম ভাবছো?

দ্যাখো, শুধু তোমার কাজ নয়, যে-কোনো কাজেই, বিশেষ করে আর্টিস্টিক কাজগুলোতে, যেমন গান-কবিতা-গল্প-উপন্যাস-নাটক-সিনেমা-পেইন্টিংস যাই বলো না কেন, আসল ব্যাপার হলো ওই শিল্পী তার নিজের কোনো সিগনেচার তৈরি করতে পেরেছেন কি না! তুমি নিজের সিগনেচার তৈরি করতে পেরেছ। এটা এক বিশাল অর্জন।

থ্যাংক ইউ। কিন্তু সিগনেচার তৈরি হওয়ার ব্যাপারটা কীভাবে ডিফাইন করবে?

তোমার কাজ দেখলেই চেনা যায়, এটা জহির আমিনের নকশা।

আর কিছু?

যারা নিজস্ব সিগনেচার তৈরি করতে পারে তাদের ক্ষেত্রে দুটো এক্সট্রিম ঘটনা ঘটে।

কী রকম?

পরবর্তী প্রজন্ম ওই শিল্পীকে হয় অনুকরণ করার চেষ্টা করে অথবা অনুকরণ করতে পারবে না জেনে চেষ্টাই করে না। দুটোই ওই সিগনেচারের ফসল।

উদাহরণ দিতে পারবে?

আমি সাহিত্যের উদাহরণ দিতে পারি।

তাই দাও।

যেমন ধরো নতুন প্রজন্মের লেখকদের কেউ কেউ হুমায়ূন আহমেদকে অনুকরণ করার চেষ্টা করে, কারণ তাঁর একটা নিজস্ব সিগনেচার আছে। আবার কেউ শহিদুল জহির বা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে অনুকরণের চেষ্টাই করে না, যদিও তাঁদেরকে অস্বীকার করার উপায়ই নেই, কারণ ওঁদেরও নিজস্ব সিগনেচার আছে।

আমার ক্ষেত্রে কোনটা ঘটেছে?

তোমাকে অনুকরণ করার চেষ্টা করছে অনেকে, পারছে না।

তুমি শুধু সাহিত্যের ছাত্রীই ছিলে না, একজন বোদ্ধাও। তোমার উচিত ছিল শিক্ষকতা করা। খামোখা জীবনটাকে ঘরে বসে নষ্ট করলে।

মোটেই নষ্ট করিনি। এ-ধরনের কথা আর কখনো বলবে না। আমি যা করেছি ভেবেচিন্ত করেছি এবং খুব ঠিক কাজটি করেছি।

আচ্ছা যাও, তাই।

এখন ঘুমাও। অংশু অপলাকে জড়িয়ে ধরে গভীরভাবে চুমু দিলো, বললো   –  থ্যাংক ইউ। আমার অনেক দ্বিধা ছিল নিজেকে নিয়ে, নিজের কাজ নিয়ে। তুমি দূর করে দিলে। (চলবে)