জলের অক্ষরে লেখা

পর্ব : ৯

বাড়ির সামনে নেমে অবাক হয়ে গেল অবন্তি। এখানে সে অনেকবার এসেছে, কিন্তু এই বাড়িতে নয়। অনেক বছর আগে যখন এখানে আসতো সে, অংশু কিংবা ঋভুর সঙ্গে, তখন এটা ছিল একটা পুরনো দোতলা বাড়ি। দোতলায় বাড়িওয়ালা থাকতেন, নিচতলায় অংশুরা। একটা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ ছিল ওদের বাসাটায়, ততটা খোলামেলাও ছিল না। ছোট সেই বাসায় অনেক মানুষ, অংশুরা পাঁচ ভাই-বোন, বাবা-মা, দাদা-দাদি, একটা দারিদ্র্য আর মলিনতার ছাপ ছিল সর্বত্র। ওই স্যাঁতসেঁতে গন্ধটাকেই তার মনে হতো দারিদ্র্যের গন্ধ। আর এখন কি না সেখানে সাততলা সুরম্য অট্টালিকা! এই কুড়ি বছরে কী এমন ঘটে গেল, কী করে সম্ভব হলো এই অসম্ভব ঘটনা?

এটা অংশুদের বাড়ি? – অবন্তি জানতে চাইলো।

হ্যাঁ।

আগে না এখানে দোতলা একটা বাড়ি ছিল? বেশ পুরনো!

সে তো অনেকদিন আগের কথা।

হ্যাঁ, অনেকদিন আগের কথা। অংশুরা ভাড়া থাকতো সেই বাসায়।

সেই জায়গাটাই ওরা কিনে নিয়েছে। নতুন করে এই বাড়ি বানিয়েছে।

আচ্ছা, অংশুর কি অনেক টাকা হয়েছে?

হাসলো ঋভু, কিছু বললো না।

কী সুন্দর বাড়িটা! কী নজরকাড়া ডিজাইন, কী অদ্ভুত সুন্দর রং!

ভেতরে চলো, আরো ভালো লাগবে তোমার।

চলো।

দরজা খুলে ভীষণ অবাক হলো অপলা।

আরে ঋভু ভাই, আপনি! হঠাৎ করে!

তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হলো, তাই চলে এলাম।

খুব ভালো করেছেন।

তারপরই অপলার চোখ পড়লো অবন্তির দিকে, ঋভুর পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল বলে খেয়াল করেনি। হেসে বললো, আপনি নিশ্চয়ই অবন্তি আপা?

হ্যাঁ। চিনলে কী করে? কখনো দেখোনি তো!

ছবি দেখেছি। বাকিটা আন্দাজ। আসেন, ভেতরে আসেন।

ভেতরে গিয়ে বসলে অপলা আবার বললো, এরকম সারপ্রাইজ দেবেন ভাবিনি। আমি ভেবে রেখেছিলাম, আপনাদেরকে একদিন দাওয়াত করবো।

আমাদেরও সারপ্রাইজ দেওয়ার কোনো প্ল্যান ছিল না। হঠাৎ করেই চলে এলাম। – অবন্তি বললো।

খুব ভালো লাগছে আমার। অংশু নিশ্চয়ই জানে না?

না, জানে না। এটা বুঝলে কী করে?

ও জানলে তো আমাকে জানাতই।

অংশু তোমাকে সবকিছু জানায়?

সব নিশ্চয়ই জানায় না। অনেক কিছু জানায়। দাঁড়ান, ওকে আসতে বলি।

আসতে বলার দরকার নেই। তোমার সঙ্গে গল্প করতেই এসেছি।

ও এলেও আমার সঙ্গে গল্প করতে পারবেন। এসেই যেহেতু পড়েছেন, এত সহজে আপনাদের ছাড়ছি না।

ঠিক আছে ছেড়ো না।

অপলা ফোন করলো অংশুকে। তাদের কথোপকথন হলো এইরকম : তুমি এখন কোথায়?

তোমাকে বলা যাবে না।

মানে? কেন বলা যাবে না?

কারণ, ব্যাপারটা গোপন।

ঝামেলা করবে না। বলো তুমি কোথায়?

এই তো … মানে … বেশি দূর না …

পরিষ্কার করে বলছো না কেন?

কী করে বলি! আচ্ছা ঠিক আছে বলছি … অবন্তির সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি।

ও আচ্ছা! তাই নাকি?

হ্যাঁ। কাজকর্ম কম, ভাবলাম ওকে নিয়ে একটু …

আজকে তোমার খবর আছে …

কেন কেন? আমি কী করলাম?

এক্ষুনি বাসায় আসো।

বাসায় যাবো কেন?

জরুরি দরকার। এক্ষুনি আসো।

কী হয়েছে অপলা? কোনো সমস্যা? মায়ের শরীর ঠিক আছে তো?

না, সমস্যা না। কিন্তু জরুরি। এক্ষুনি আসো। এক মুহূর্ত দেরি করা যাবে না।

আহা বলো না! টেনশন হচ্ছে তো।

না, বলা যাবে না। এলেই দেখতে পাবে।

আচ্ছা আসছি।

যদিও অংশুর কথা কিছুই শুনতে পায়নি, তবু ঋভু আর অবন্তি হাসছিল। বোঝাই যাচ্ছিল, অংশু কোনো গুলতাপ্পি মেরেছে এবং ধরা খেয়েছে। অবন্তি জিজ্ঞেস করলো, কোথায় অংশু?

ও নাকি আপনার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে!

অট্টহাসিতে ভেঙে পড়লো সবাই।

এইসব উল্টাপাল্টা বলে জ¦ালায় নাকি তোমাকে?

সুবিধা করতে পারে না। ধরা পড়ে যায়।

তারপর?

তারপর আর কী!

বকাটকা দাও না?

নাহ্। দুষ্টুমিই তো করে, বকা দেবো কেন?

যদি সত্যিই ওরকম কিছু করতো?

তাহলে ঝগড়া-টগড়া করতাম হয়তো।

হয়তো!

আর কী বলবো বলেন? ওরকম কখনো হয়নি তো!

হুম। আচ্ছা শোনো অপলা, অংশু আসার আগে তোমার বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাও না!

চলেন। দেখাই।

তুমি কি এখানেই বসবে ঋভু, নাকি আসবে আমাদের সঙ্গে?

বসি একটু। তোমরা যাও।

ঋভু এই বাড়ির প্রতিটি বিন্দুবিসর্গ চেনে, জানে। পুরনো বাড়িটা কিনে নেওয়া থেকে শুরু করে নতুন করে নির্মাণের প্রতিটি পর্বে সে অংশুর সঙ্গেই ছিল। তার কিছু দেখার নেই, অবন্তির শখ হয়েছে, ও দেখুক।

ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে লম্বা করিডোর ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল অপলা। তাকে অনুসরণ করতে করতে অবন্তি তীক্ষè চোখে সব দেখছিল। খুব সুন্দর করে সাজানো-গোছানো সবকিছু। শৈল্পিক এবং রুচিশীল। কোনো ঘরবাড়িই এরকম নিখুঁতভাবে গোছানো থাকে না। একটু এলোমেলো থাকেই। সম্ভবত অপলার স্বভাবটাই গোছানো।

করিডোরের শেষ প্রান্তের একটা রুমে ঢুকলো অপলা, অবন্তিও অনুসরণ করলো তাকে। দেখলো জানালার কাছে চেয়ারে বসে  বাইরে তাকিয়ে আছেন অংশুর মা। অবন্তি গিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করলে বৃদ্ধা কতক্ষণ তাকিয়ে রইলেন এক দৃষ্টিতে, তারপর বললেন – অবন্তি! কতদিন পরে এলে মা!

আমাকে আপনার মনে আছে খালাম্মা?

হ্যাঁ। মনে থাকবে না কেন? কত এসেছ একসময়!

সে তো অনেকদিন আগের কথা!

তাতে কী! অংশু, তুমি, ঋভু আর জামিল – কত ভালো বন্ধু ছিলে তোমরা! কত দুষ্টুমি, কত আবদার, কত কাণ্ড তোমাদের – সেসব কি ভোলা যায়?

এখনো মনে রেখেছেন সব?

সব মনে নেই। বয়স তো কম হলো না। তোমার মা-বাবা চলে গেলেন, ঋভুর মা-বাবা চলে গেলেন, অংশুর বাবাও চলে গেলেন, কেবল আমিই পড়ে রইলাম। আচ্ছা, জামিলের মা-বাবা আছেন এখনো?

না, খালাম্মা, ওনারাও …

এই যে দেখ! আমার সমবয়সীরা সব পাড়ি জমিয়েছেন, কেবল আমি …

আপনারও কি যেতে ইচ্ছে করে খালাম্মা? – মুখ ফসকে বলে ফেললো অবন্তি।

মাঝে মাঝে করে, কোনো কাজ নেই তো, থেকে আর কী করবো বলো! আবার মাঝে মাঝে মনে হয় – থেকেই যাই, যতদিন পারি …

একা লাগে না আপনার? ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে, যার যার মতো জীবন …

না, তা লাগে না। ছেলেমেয়েরা ওদের জীবন নিয়ে আছে, থাকুক না। আমার নাতি-নাতনিরা আছে না! এখনো স্কুল-কলেজ থেকে ফেরেনি বলে তোমার মনে হচ্ছে, বাসাটা শান্ত। ফিরে এলেই দেখবে সব বদলে গেছে। ওরা তো সারাক্ষণই আমার কাছে থাকে। – বলতে বলতে অনাবিল হাসিতে ভরে উঠলো বৃদ্ধার মুখ।

এই এক ধরনের মানুষ, যারা খুশি হতে জানে, যাদের অভিযোগ কম। ভাবলো অবন্তি। এঁরা, এই প্রজন্মের মানুষগুলি, এক ভিন্নরকম জীবন যাপন করে গেছেন। কেবল নিজেকে নিয়েই ভাবেননি। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব আর তাদের ছেলেপুলে – সবাই এঁদের আপন ছিল। একে অপরের খোঁজখবর রাখতেন, সুখ-দুঃখে পাশে থাকতেন, স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা বিলিয়ে দিয়ে নিজেদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে নিতেন। যখন-তখন আত্মীয়স্বজন বাসায় আসতো, শুধু আত্মীয়স্বজন কেন, আসতো চেনা-অচেনা নানা মানুষও, ঘরে যা থাকতো তা-ই দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো, রাত্রিযাপন করতে চাইলে ছোট বাসাতেও কোনো না কোনোভাবে ব্যবস্থা হয়ে যেত। কেউ প্রাইভেসি নিয়ে মাথা ঘামাতো না, অতিথি-আপ্যায়ন নিয়ে অস্থির হয়ে যেত না, যেন যে এসেছে সে ঘরেরই মানুষ! এইভাবে, প্রতিটি পরিবারই হয়ে উঠতো একেকটা যৌথ পরিবার। সেই দিনগুলিই কি ভালো ছিল? খালাম্মার কথা শুনতে শুনতে ভাবছিল অবন্তি। ভাবছিল, আমাদের প্রজন্মে এসে একটা রূপান্তর ঘটে গেছে। আমরা প্রাইভেসিকে গুরুত্ব দিতে শুরু করলাম, যখন-তখন বাসায় আত্মীয়-স্বজন বা প্রতিবেশীদের আসা-যাওয়াকে অপছন্দ করতে শিখলাম, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে বড় করে দেখতে শিখলাম, আর নিঃসঙ্গ হতে লাগলাম। তখন মনে হতো, আমরাই ঠিক, মা-বাবারা ব্যাকডেটেড। আসলেই কি তাই ছিল? মনে তো হয় না। তারা যেমন একটা সহজ জীবনের মধ্যে সুখ খুঁজে পেয়েছিলেন, আমরা তো তা পেলাম না। 

অবন্তির ভালো লাগছিল, বেশ কিছুক্ষণ বসে গল্প করলো সে, ভাবলো – একদিন সকালে এসে সারাদিন ধরে গল্প করতে হবে। পুরনো দিনের গল্প। হারানো স্মৃতির গল্প।

মায়ের কাছ থেকে উঠে ঘুরে ঘুরে সব দেখতে লাগলো অবন্তি। দোতলা থেকে তিনতলা, চারতলা, পাঁচতলা, ছয়তলা, সাততলা পার হয়ে একেবারে ছাদ পর্যন্ত। মুগ্ধ হয়ে গেল অবন্তি। এত সুন্দর ডিজাইনের বাড়ি সে কমই দেখেছে এ-জীবনে। প্রতিটি তলায় প্রচুর খালি জায়গা, আড্ডার ব্যবস্থা, প্রশস্ত ব্যালকনি, বড় বড় কামরা। একেকটা ফ্লোর যতখানি জায়গা নিয়ে করা হয়েছে সেখানে অনায়াসে দুটো করে অ্যাপার্টমেন্ট হতে পারতো। অপলা বর্ণনা দিচ্ছিল। নিচতলার একটা অংশে পার্কিং, অন্য অংশে সিকিউরিটি গার্ডদের থাকার রুম, ড্রাইভারদের বিশ্রামের রুম। দোতলায় ঋভু, অপলা, ওদের দুই বাচ্চা আর মা। তিনতলায় থাকে মেজ দেবর আর জা, ওদের দুটো বাচ্চা; চারতলায় থাকে ছোট দেবর আর জা, ওদেরও দুটো বাচ্চা; এখন কেউ বাসায় নেই; দেবর আর জায়েরা অফিসে, বাচ্চারা স্কুলে বা কলেজে। তবে একটু পরেই চলে আসবে সবাই। পাঁচতলা বড় ননদের জন্য, ছয়তলা ছোট ননদের। তারা এখানে থাকে না। তবু তাদের জন্য আলাদা করে রাখা হয়েছে। বেড়াতে এলে নিজেদের ফ্লোরেই থাকে ওরা। সাততলায় কমন স্পেস, গেস্টরুম ইত্যাদি। মাসে অন্তত একবার, দুদিনের জন্য হলেও সব ভাইবোন এই বাসায় জড়ো হয়, বাচ্চাকাচ্চা মিলিয়ে সংখ্যাটা বেশ বড়োই। হই-হল্লা, দুষ্টুমি, খুনসুটি, আড্ডা আর গল্পসল্প করে সময়টা বেশ কেটে যায়।

ঝগড়া হয় না? – মুখ ফসকে বলে ফেললো অবন্তি।

হেসে ফেললো অপলা, বললো – নাহ। ঝগড়া হওয়ার মতো বিষয় তো নেই।

বিষয় লাগে নাকি, ঝগড়া করতে চাইলে এমনিতেই করা যায়।

তা ঠিক। বিনা কারণে ঝগড়া করার জন্য বিশেষ ধরনের বৈশিষ্ট্য লাগে। এই পরিবারের সদস্যদের সেটা নেই বোধহয়। এরা মোটামুটি শান্তিপ্রিয়।

এরা না হয় শান্তিপ্রিয়, কিন্তু তোমরা মানে বউরা বা তোমার ননদদের জামাইরা তো বাইরের লোক …

বাইরের লোক ছিলাম। এখন আমরাও তো এই পরিবারেরই।

অপলা কত সহজে বলে ফেললো কথাটা। যেসব মেয়ে শ^শুরবাড়িকে নিজের বাড়ি বলে মনে করে, শ^শুরের পরিবারকে নিজের পরিবার মনে করে, বা নিজেকেও ওই পরিবারেরই একজন মনে করে, যেমন তার ভাবি আফসানা বা এই অপলা, তাদেরকে অবন্তি বুঝতেই পারে না। দুই পরিবারের সংস্কৃতি ভিন্ন, আচার-আচরণ ভিন্ন, হয়তো বিশ^াসও ভিন্ন, তবু নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্য একটা বাড়িতে এসে নিজেকে সেই পরিবারের সদস্য বলে ভাবতে হলে তো নিজের অনেক কিছুই বিসর্জন দিতে হয়। এরা তা দেয় কীভাবে? কেনই-বা দেয়? সে নিজে শ^শুরবাড়িতে থাকেনি কখনো। জামিলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বিদেশেই, যে ক-বছর সংসার টিকেছিল ততদিন একবারও আসেনি বাংলাদেশে, সে ভাবতেও পারতো না শ^শুরবাড়িতে গিয়ে থাকার কথা। অথচ এরা কী সুন্দর মানিয়ে নিয়েছে! খুব যে খারাপ লাগছে ব্যাপারটা, তাও না। বরং ভালোই লাগছে। যেমন, ভাবি না থাকলে তাদের বাসাটা হয়তো এতদিন মৃতদের ঘরদোর হয়ে যেত। কিংবা, এই অপলা কী সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখেছে, ওর জায়েরাও নিশ্চয়ই একইরকম, নইলে এত গোছানো থাকতে পারতো না। এই মিলেমিশে থাকা, এই যৌথতা, এই বন্ধনের এক আলাদা সৌন্দর্য আছে।

অবন্তি ভাবছিল অনেক কথাই। কীভাবে সেই বাড়িটা অংশুদের হলো আর কীভাবেই বা এরকম দৃষ্টিনন্দন সুইট হোমে পরিণত হলো, সেই গল্প সে ইতোমধ্যে শুনে নিয়েছে অপলার কাছ থেকে। বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক মারা যাওয়ার পর তাঁর একমাত্র ছেলে চলে গেল বিদেশে। দোতলাটাও ভাড়া নিল অংশুরা। ততদিনে ওরা তিন ভাই-ই চাকরিতে ঢুকে পড়েছে। অংশু আর অপলার সংসারজীবনও শুরু হয়েছে। বছর কয়েক পরে বাড়ির মালিক জানালো, বাড়িটা সে বিক্রি করতে চায়। এই সুযোগ ছাড়লো না অংশু। তিন ভাই ধার-কর্জ, ব্যাংক লোন ইত্যাদি নিয়ে, বাবার সামান্য সঞ্চয় আর মায়ের গয়নাগাটি বিক্রি করে বাড়িটা কিনে নিল। তারও কয়েক বছর পর, অংশু ততদিনে ওর ফার্মটা দাঁড় করিয়ে ফেলেছে, অন্য দুই ভাইও যার যার মতো প্রতিষ্ঠিত, এই বাড়ির নকশা করলো অংশু নিজে। মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই পছন্দ করলো। সেই নকশারই বাস্তব রূপ এই বাড়ি। অংশুর রুচির প্রশংসা না করে পারা যায় না। কী যেন একটা ব্যাপার আছে বাড়িটার ডিজাইনে, এমনকি বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রং নির্বাচনের ভেতরেও, একটা শান্তি আর স্বস্তির আবহ অনুভব করা যায়। বাণিজ্যিক দিকটা ও ভাবেইনি। ভাবলে, এটা পনেরো-বিশতলা ভবন হতে পারতো, একেক ফ্লোরে অন্তত দুটো করে ফ্ল্যাট থাকতে পারতো, তাতে ভাড়া দিয়েও অনেক আয় হতো। ওরা হয়তো সেটা চায়নি। টাকার বদলে ওরা শান্তি, স্বস্তি আর তৃপ্তিকে বেছে নিয়েছে।

আচ্ছা, অংশুর কি এখন অনেক টাকা? প্রশ্নটা আবার মনে এলো অবন্তির। কত টাকা হলে ঢাকা শহরে এরকম একটা বাড়ি তৈরি করা যায়, তাও জমি কিনে? প্রশ্ন জাগলেও সৌজন্যবশত কিছু জিজ্ঞেস করলো না সে। তবে দিন যে বদলেছে, দেশের কিছু মানুষের হাতে যে টাকা এসেছে সেটা শহরের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। সবার হাতে যে সৎ পথে টাকা আসেনি, তা সে জানে। এদেশের দুর্নীতিবাজদের কথা সারা দুনিয়ার লোক জানে। অংশু নিশ্চয়ই সেই পথে হাঁটেনি। সে কেবল সময়ের চাহিদাকে কাজে লাগাতে পেরেছে। মানুষের হাতে স্রোতের মতো টাকা এসেছে, তারা পাগলের মতো বাড়িঘর-শপিংমল-রেস্টুরেন্ট বানাচ্ছে, অংশুর আর্কিটেক্ট ফার্ম সেই সময়টিতে অনেক কাজ পেয়েছে। প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত বেড়ে উঠেছে ওর ফার্ম এবং সম্পদ। অবন্তি বিস্তারিতভাবে না জানলেও এটুকু আন্দাজ করতে পারে।

ছাদে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল অবন্তি আর অপলা। নিচে তাকিয়ে অংশুর গাড়ি দেখতে পেল অপলা, বললো, অংশু এসেছে । ঋভু ভাইও অনেকক্ষণ একা বসে আছে। চলেন নিচে যাই।

হ্যাঁ চলো। কিন্তু …

কী?

তোমার সঙ্গে আমার কথা তো শেষ হলো না।

এত তাড়াতাড়ি শেষ হবেই বা কেন?

আমি একদিন সকালে তোমার বাসায় চলে আসবো। সারাদিন গল্প করবো। অথবা তুমি বললে বাইরে কোথাও ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে গল্প করবো।

অপলা হেসে বললো, আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি তো বেশিদিন থাকবেন না। কবে আসবেন জানাবেন। অথবা বাইরেও ঘুরতে যেতে পারি। কোনো সমস্যা নেই।

আমি তোমার কাছ থেকে একটা ব্যাপার জানতে চাই …

কী ব্যাপার, বলেন না!

এই যে তুমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে সংসার করছো, নিজের ক্যারিয়ারটা করলে না, তোমার দুই জা কিন্তু সংসারের জন্য এই স্যাক্রিফাইসটা করেনি, হয়তো তোমার বান্ধবীরাও করেনি, তুমি পুরোপুরিভাবে অংশুর ওপর নির্ভরশীল, এ নিয়ে তোমার আফসোস নেই? মাঝে মাঝে খারাপ লাগে না? এখনই উত্তর চাইছি না, আরেকদিন দিলেও চলবে।

আমি কিন্তু উত্তরটা এখনই দিতে পারি।

ঠিক আছে দাও।

না, আমার কোনো আফসোস নেই, খারাপও লাগে না।

কেন লাগে না?

আমি তো নিজেই এই জীবন বেছে নিয়েছি, কেউ তো চাপিয়ে দেয়নি।

এখন মনে হয় না, ওটা ঝোঁকের মাথায় করেছিলে?

কোনটা? চাকরি ছেড়ে দেওয়া?

হ্যাঁ।

না, ঝোঁকের মাথায় করিনি। খুব ভেবেচিন্তে করেছি।

আমি এই ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। সংসার করার জন্য ক্যারিয়ার ছাড়তে হবে কেন?

ছাড়তেই হবে এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু দুটো ব্যাপার আমি একসঙ্গে করতে পারতাম না। দুটোতেই ঘাটতি রয়ে যেত।

তুমি সংসারটাই বেছে নিলে কেন? ক্যারিয়ারও তো নিতে পারতে!

পারতাম, কিন্তু আমার কাছে সংসারটাই বেটার চয়েস মনে হয়েছে।

এখনো মনে হয়?

হ্যাঁ। সবসময়ই মনে হয়।

এভাবে ঘরের মধ্যে নিজেকে বন্দি করে …

অবন্তি আপা, আপনি একটা ব্যাপার বুঝতে চাইছেন না।

সেটা কী?

আপনি ক্যারিয়ারকেই কেবল কাজ বলে ভাবছেন। সংসার করাও কিন্তু একটা কাজ, অনেক বড় কাজ, আপনি সেটা বুঝতে চাইছেন না।

হুম। এই আলাপ একদিনে শেষ হওয়ার মতো নয়। ঠিক আছে, আরেকদিন তোমার কথা শুনবো। এখন চলো, নিচে যাই।

চলেন।

নিচে গিয়ে দেখলো, অংশু আর ঋভু তুমুল হাসাহাসি করছে।

কীরে, এত হাসির কী হলো? আনন্দের ঝরনাধারা বইছে মনে হচ্ছে! – অবন্তি বললো।

তা বইছে। – অংশু বললো।

কারণটা জানতে পারি?

এই যে তোরা জোড় বেঁধে এলি, কারণ সেটাই।

‘জোড় বাঁধা’ শব্দ দুটো শুনে অবন্তির বুকে ধাক্কা লাগলো। আজকে সকালে ভাবিও বলছিল এই কথা। কী কাকতালীয় ব্যাপার! তখনো সে জানতো না, ওদের সঙ্গে আজ দেখা হবে, আর এখন কি না সবাই মিলে আড্ডা হচ্ছে!

তখনই ভাবির ফোন এলো, অবন্তি অন্য রুমে যেতে যেতে বললো, ভাবির ফোন, কথা বলে আসি। তারপর ফোন রিসিভ করে বললো – হ্যাঁ, বলো ভাবি।

তুমি কোথায় সুসান? সন্ধ্যা হয়ে এলো …

এই ঘুরে বেড়াচ্ছি।

কোথায় ঘুরছো? দুপুরে খেয়েছ?

হ্যাঁ, খেয়েছি। দারুণ মজা করে খেয়েছি।

কোথায় কী খেলে শুনি?

এসে বলবো ভাবি।

আচ্ছা। এখন তুমি কোথায়?

জোড় বাঁধার চেষ্টা করছি।

মানে?

মানে আবার কী? সকালে বললে না জোড় বাঁধার কথা!

তা তো বললাম। তা কোন লাফাঙ্গার সঙ্গে জোড় বাঁধছো আবার?

হেসে লুটিয়ে পড়লো অবন্তি, হাসতে হাসতে বললো – লাফাঙ্গা নয়, লাফাঙ্গা নয়, তোমার পছন্দের পাত্রের সঙ্গেই …

ঋভু! ওকে পেলে কোথায়?

পেয়েছি কুড়িয়ে। বাসায় এসে সব বলবো তোমাকে।

সত্যিই তুমি ঋভুর সঙ্গে তো!

হ্যাঁ, সত্যিই।

যাক নিশ্চিত হলাম।

এত নিশ্চিত হয়ো না ভাবি। পুরুষ মানুষের মতিগতির ঠিক নেই …

এতকাল পর ওকে অবিশ^াস করবো? মতিগতি ঠিক না থাকলে কি আর এতদিনে কিছু হতো না?

হুম, তোমার অনেক আস্থা ওর ওপর, বুঝেছি।

অবশ্যই। আস্থা না থাকার কোনো কারণ ঘটেনি। আচ্ছা, থাকো তাহলে। একটু চিন্তা হচ্ছিল বলে ফোন করেছি।

ঠিক আছে ভাবি। রাখলাম।

ড্রয়িংরুমে ফিরে এসে অবন্তি দেখলো, অংশু একা বসে আছে। – ঋভু আবার কোথায় গেল? – জানতে চাইলো সে।

বিড়ি ফুঁকতে গেছে।

এতক্ষণে ওর বিড়ি ফোঁকার সময় হলো?

কেন, সমস্যা কী? ওকে ছাড়া তোর ভালো লাগছে না?

তা আর বলতে!

আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ থাক। সারাদিন তো ঋভুর সঙ্গে …

হিংসা হচ্ছে তোর?

তা তো হচ্ছেই। এরকম টসটসে আঙুরের মতো ভরা যুবতী কন্যা …

এসব কী শব্দ অংশু? তুই কি কোনোদিনও ভালো হবি না?

খারাপ কী বললাম?

টসটসে, আঙুরের মতো, ভরা যুবতী – এগুলো ভালো শব্দ?

আহা, তুই তো ওরকমই।

তোর ইচ্ছে হয়?

ইচ্ছে? কিসের ইচ্ছে?

আমার সঙ্গে শুতে ইচ্ছে হয়?

খেপে আছিস কেন? কী হয়েছে তোর?

খেপিনি তো! তুই বললি তাই আমিও জানতে চাইলাম।

খেপেছিস, খেপেছিস। দুষ্টুমি তো আর নতুন করে করি না, কখনো এরকম রিঅ্যাক্ট করতে দেখিনি তোকে।

না, সত্যিই খেপিনি। সত্যিই জানতে চেয়েছিলাম।

তাহলে বলি। না, ইচ্ছে হয় না। তুই সুন্দরী, তোকে ভালো লাগে, কিন্তু শুতে ইচ্ছে করে না।

কেন করে না? আমি কি যথেষ্ট আকর্ষণীয় নই?

আকর্ষণীয়। কিন্তু ইচ্ছে যে করে না, তার কারণ ভিন্ন।

সেই কারণটা কী?

তোর প্রতি আমি কখনো প্রেম অনুভব করিনি। আর প্রেম ছাড়া শরীর? আমার পোষাবে না।

প্রেম অনুভব করিসনি কেন?

এর তো কোনো উত্তর নেই। সবার সঙ্গে সবার হয় না।

উত্তর নিশ্চয়ই আছে। তুই বলতে চাইছিস না।

একটা উত্তর হতে পারে। আমি সবসময় ভেবে এসেছি, তুই ঋভুর। বন্ধুর প্রেমিকার সঙ্গে তো আর প্রেম করা চলে না। আমার নীতিবোধে বাধে।

তুই খুব নীতিবান মানুষ?

অন্যের চোখে কী তা জানি না। তবে আমার নিজের কিছু নৈতিকতা আছে, আমিই তৈরি করে নিয়েছি। সেগুলো মেনে চলি।

তার মধ্যে একটা হলো, বন্ধুর প্রেমিকার সঙ্গে প্রেম চলে না! আচ্ছা আমি যদি তোর বন্ধুর বউ হতাম তাহলে চলতো?

মনে হয় না।

ধর, যদি ঋভু অপলার প্রেমে পড়ে, কিংবা অপলা ঋভুর, কিংবা দুজনেই দুজনের প্রেমে পড়ে, তাহলে?

সেটা তো ওদের ব্যাপার।

মানে? সেটা তোর অনৈতিক মনে হবে না?

আমি তো আমার নীতিবোধ অন্য কারো ওপরে চাপিয়ে দিতে পারি না।

হুম, বুঝলাম। কিন্তু আমি যে তোর প্রেমে পড়ে যাচ্ছি, তার কী হবে?

তুই? আমার? এতদিন পর? হা হা হা …

হাসছিস কেন?

হাসবো না? এটা তুই কী বললি? হা হা হা …

হাসি থামা গাধা। একটা সিরিয়াস কথা বললাম, সে হেসেই উড়িয়ে দিচ্ছে। উল্লুক!

আচ্ছা, ঠিক আছে, সিরিয়াস হলাম। বল।

কী বলবো?

এতদিন পর আমার প্রেমে পড়ছিস কেন সেটা বল।

তোর কাজকর্ম দেখে।

আমার কাজকর্ম? কোনটার কথা বলছিস?

এই বাড়িটা। এত সুন্দর বাড়ি আমি আমার জীবনে দেখিনি। এত স্নিগ্ধ, এত মায়াময়, এত দৃষ্টিনন্দন। ঋভুর বাড়ির ডিজাইনটাও অনেক সুন্দর।

ওহ! বাঁচলাম। বাড়ি পছন্দ হয়েছে, আমাকে না!

তোর ডিজাইনের কথা বলছি, গর্দভ!

ওই হলো। আমার প্রেমে তো পড়িসনি। দুঃখ পেলাম।

আহারে, চুক চুক চুক …

আমার দুঃখ দেখে আবার মজাও নেওয়া হচ্ছে!

ফাজলামি করিস না। শোন, একদিন আমাকে নিয়ে তোর কাজগুলি একটু ঘুরিয়ে দেখা না! শুধু শুনেই গেলাম, দেখা আর হলো না।

আচ্ছা, নিয়ে যাবো। কবে যাবি?

তুই যেদিন পারবি। তোর তো ছুটির দিন ছাড়া সময় হবে না।

আরে না। যে-কোনো দিনই পারবো।

ঠিক আছে। একদিন ঘুরবো তোর সঙ্গে, আরেকদিন ঋভুর সঙ্গে, আরেকদিন অপলার সঙ্গে।

আলাদা আলাদা?

হ্যাঁ।

একসঙ্গে সবাই ঘোরা যায় না?

তাও যায়। কিন্তু আমি আলাদাভাবে যেতে চাই।

কেন?

একদিন তোর চোখে বদলে যাওয়া ঢাকাকে দেখবো, একদিন ঋভুর চোখে, একদিন অপলার চোখে। একেকজনের দেখা একেকরকম হবে, আমি নিশ্চিত।

তা হবে। ঠিকই বলেছিস তুই। কিন্তু নিজের চোখে একদিন দেখিস না কেন?

আজকে সেজন্যই বেরিয়েছিলাম। দেখেছিও অনেকটা। পরে ঋভুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। অবশ্য সবাই মিলে একসঙ্গেও একদিন ঘুরতে যেতে পারি। আজকেই প্ল্যানটা করে ফেলতে হবে। সবাই আছি যেহেতু। কিন্তু ঋভু গেল কোথায়? অপলাই বা কোথায়?

অপলা বোধহয় কিচেনে। ঋভুর কথা তো বললামই। ছাদে গেছে।

বিড়ি ফুঁকতে কতক্ষণ লাগে? ওকে ডাক।

আচ্ছা যাই, ডেকে নিয়ে আসি।

হুম। আমি দেখি অপলা কী করছে।

ছাদে গিয়ে অংশু দেখলো, ঋভু দাঁড়িয়ে আছে দূরে তাকিয়ে। উদাসীন, বিষণ্ন। আঙুলের ফাঁকে সিগারেট পুড়ছে একা একাই, সেদিকে ওর খেয়ালই নেই। দৃশ্যটার মধ্যে অদ্ভুত একটা মন খারাপ করা ব্যাপার আছে। ঋভুর এই হঠাৎ বিষণ্ন হয়ে যাওয়ার সঙ্গে অংশু পরিচিত। অনেকের ভেতরে থাকলেও সে অনেকসময় এরকম একা হয়ে যায়, যেন থাকেই না সেখানে। কী যে ভাবে, তল পাওয়া যায় না। এত চাপা ও, নিজের সম্বন্ধে এত নীরব যে বোঝার উপায়ও নেই, কী ভাবছে ও, কী আছে ওর মনের ভেতর। একটু দূরে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখতে লাগলো অংশু। 

ঋভুর আসলে ভালো লাগছিল না অনেকক্ষণ থেকেই। ঝোঁকের মাথায় অসময়ে এ-বাসায় এসে হাজির হয়েছে। তারপর সুসান যে অপলার সঙ্গে গেল, গেল তো গেলই, আর ফেরার নাম নেই। একা একা কী করবে সে? অলস ভঙ্গিতে সোফায় গা এলিয়ে টেলিভিশনে অ্যানিম্যাল প্ল্যানেটে চোখ ফেলে রাখলো। ওইটুকুই। কিছুই দেখছিল না সে, সম্ভবত কিছু ভাবছিলও না, কিংবা ভাবলেও কোনো চিন্তাই দানা বাঁধছিল না। বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনি এসে গিয়েছিল একসময়। যখন প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন অংশু এলো, একটু পর সুসান আর অপলাও এলো। কিন্তু ঝিমুনিটা যাচ্ছিল না বলে ছাদে উঠে এসেছে সিগারেট খাওয়ার নাম করে। এই বাড়ির ছাদ থেকে রমনা পার্কের পুরোটাই দেখা যায়। গভীর সবুজ বৃক্ষের সমাহার চোখকে আরাম দেয়। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটাই দেখছিল।

সন্ধ্যা নেমে আসছে। মন্থর, গম্ভীর, বিষণ্ন সন্ধ্যা। এই সময়টিকে ঋভু এড়িয়ে চলতে চায়। এড়াতে না পারলেও অন্তত গভীরভাবে দেখতে চায় না, দেখতে গেলেই মন কেমন করে ওঠে। সন্ধ্যাগুলি একইরকম, সময় যেন থেমে যায়, যেন একটু জিরিয়ে নিচ্ছে, দিনভর রাতভর সে কেবল দৌড়ে বেড়ায়, তারও তো কখনো ইচ্ছে করে থামতে! থমকে দাঁড়িয়ে সে নিজেই কেবল জিরিয়ে নেয় না, অন্যদেরও সুযোগ করে দেয় নিজের দিকে ফিরে তাকাবার। ঋভু সেজন্যই এড়িয়ে চলতে চায় সন্ধ্যাকে, নইলে খামোখা মনে হতে থাকে, কী যেন করার কথা ছিল তার, কী যেন করা হয়নি। কিন্তু সেটা যে কী তা আর বুঝতে পারে না। কী করার কথা ছিল তার? নাকি এ তার বিভ্রম? আসলে কিছুই করার কথা ছিল না, করেওনি সে। তখন মনে হয়, বড় দীর্ঘকাল ধরে বেঁচে আছি, অহেতুক। ক্লান্ত লাগে, লজ্জা হয় তার, মনে হয়, এত দীর্ঘ জীবনের কোনো মানেই হয় না। কৈশোরেই যদি সে চলে যেতে পারতো, নীলুর মতো, বেশ হতো। এখন, এই এতদিন বেঁচে থেকে সে কেবল শিখেছে নিজেকে আড়াল করার কৌশল। কিছু করে না সে, কিছু বলেও না, বলার মতো কিছু নেইও। যে স্মৃতিগুলি একসময় পোড়াতো খুব তাও ধূসর হতে শুরু করেছে, অথচ পুরোপুরি ছেড়েও যাচ্ছে না। বাবা, মা, নীলু … কেবল একেকটি নাম যেন, যেন তার জীবনে এরা ছিল না কখনো, কিংবা থাকলেও অতটা তীব্রভাবে নয়। কে-ই বা ছিল? সে তো জড়ায়নি কোথাও, কারো সঙ্গে। আরিয়ানা নয়, সুসানা নয়, রিনিও নয়। সে কেবল ছিল, বৃত্তের সঙ্গে স্পর্শক যেভাবে থাকে, একটুখানি ছুঁয়ে, সেও সেভাবেই ছিল। কারো সঙ্গে তার কোনো সংযোগ নেই, সম্পর্ক নেই। মানুষ নেই, গ্রাম নেই, এই শহরটিও এত অচেনা হয়ে গেল যেন এটি তার শহরই নয়, নেই দেশও, দেশ নিয়ে এখন আর কিছু ভাবে না সে, যা হচ্ছে হোক, তার কিছু করার নেই। কোনোকিছুর সঙ্গে সম্পর্ক নেই আর তার। এইসব মনে হয় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে। নিজের খুব গভীরে তাকালে সে শূন্যতা ছাড়া কিছুই দেখতে পায় না, ধু ধু শূন্যতা।

অনেকক্ষণ পর অংশু এসে হাত রাখে ঋভুর কাঁধে। ঋভু ফিরে তাকিয়ে একটু হাসে। মøান, বিষণ্ন হাসি। কিছুই জিজ্ঞেস করে না অংশু। বলে – চল, ওরা অপেক্ষা করছে। (চলবে)