লাফিয়ে চলা প্রহর’ : আলেহান্দ্রা পিসারনিকের কবিতা

বিংশ শতাব্দীতে অন্তত তিনজন কবির নব-নব রূপে পুনর্জন্ম ঘটেছে মৃত্যুর পরে। তিনজনেই অকালমৃত। জীবিতকালে তাঁরা ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ কবি, কিন্তু মৃত্যুর পর অনেক দশক পেরিয়েও তাঁদের আমরা নতুন পরিচয়ে খুঁজে পাচ্ছি, আবিষ্কার করছি নতুন তথ্যরাশি, অজানা লেখার ট্রাঙ্ক, অভিলেখাগার ভরে উঠছে নতুন নতুন অভিজ্ঞানে, চলছে নতুন গবেষণা, নতুন অনুবাদ, নতুন প্রকাশনা। সমৃদ্ধ হচ্ছে বিশ্বসাহিত্য, পুলকিত হচ্ছেন পাঠকরা।

প্রথমজন জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪); গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের একজন প্রধান কবি : ধূসর পাণ্ডুলিপির কুহক, বনলতা সেনের রোমান্স, রুক্ষ বাস্তব : দাঙ্গা, দেশভাগ, পছন্দসই চাকরির অভাব, কলকাতার ইট-কাঠ-পাথর-ট্রামগাড়ি : সবমিলিয়ে কবিতার সংখ্যা ছিল মোাটামুটি ৩৮০টির মতো। কিন্তু মৃত্যুর পরে ছয় দশক পেরিয়ে ১৯টি উপন্যাস, ১২৭টি গল্প, ৭৯টি প্রবন্ধ, ৪০০০ পৃষ্ঠা দিনলিপি এবং ২২০০টির বেশি কবিতা এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে! কবি ও কথাসাহিত্যিক  হিসেবে তাঁর নাটকীয় অথচ করুণ পুনরাবিষ্কার।

দ্বিতীয়জন পর্তুগালের কবি ফার্নান্দো আন্তোনিও নোগুইএরা পেসোয়া (১৮৮৮-১৯৩৫)। তাঁর লেখার প্রকৃত সংখ্যা কত, মৃত্যুর আট দশক পরেও তা কেউ সঠিকভাবে বলতে পারবেন না। শুধু তাই নয়, পেসোয়া লিখতেন বিভিন্ন নামে;  সেগুলি ছদ্মনাম নয়, নামগুলির পেছনে রয়েছে ইতিহাস, তাদের রয়েছে নিজস্ব ব্যক্তিত্ব, পেশা, চেহারা, পোশাক, সাহিত্যরীতি এবং রাজনৈতিক মতামত, যেগুলি অনেকের কাছেই উগ্র এবং আপত্তিকর। লিসবনের জাতীয় গ্রন্থাগারের ফাঁকফোকর থেকে এখনো মাঝে মধ্যেই আবিষ্কৃত হয় তাঁর নতুন কবিতা অথবা প্রবন্ধ। এই কল্পিত চরিত্রগুলি তাঁর ‘কল্পনাম’ অথবা ‘হেটেরোনিম’ (Heteronym)। দার্শনিক সোরেন কিয়ের্কেগার্দ (১৮১৩-৫৫) এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন তাঁর দার্শনিক সন্দর্ভে, পেসোয়া তার নতুন রূপ দেন সাহিত্যের অভিব্যক্তি হিসেবে।

তৃতীয়জন আমাদের আলোচ্য কবি আলেহান্দ্রা পিসারনিক (১৯৩৬-৭২)। জেনেশুনে ‘সেকোনাল’ বিষপান করে ১৯৭২ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর তাঁর আত্মহত্যার পরে বুয়েনোস আইরেস শহরের মন্টিভিদিও স্ট্রিটে তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে পাওয়া যায় রাশি রাশি সমাপ্ত আর অসমাপ্ত লেখালেখি, যা লাতিন আমেরিকার সাহিত্যজগতে অভূতপূর্ব। তার মধ্যে ছিল হাতে লেখা আর টাইপ করা পাণ্ডুলিপিতে কবিতা, গদ্য, চিন্তাভাবনা; অনেকগুলি নোটবুক : যাতে ছিল সম্পূর্ণ ও ছিন্নবিচ্ছিন্ন, গদ্যকবিতা, কথাসাহিত্য, দিনলিপি, স্মৃতিচারণ, স্কেচ, পাঠ-প্রতিক্রিয়া, কার্টুন, চিঠিপত্র, ফরাসি ও ইংরেজি লেখকের এস্পানিওল ভাষায় অনুবাদ। আর্হেন্তিনা থেকে তাঁর রচনার আর্কাইভ এসে পৌঁছায় আমেরিকার নিউজার্সি রাজ্যের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিলেখাগারে।

২০০০ সাল নাগাদ তার সঙ্গে যুক্ত হয় প্যারিসে হুলিও কোর্তাসার (১৯১৪-৮৪) এবং আউরোরা বের্নার্ডেস (১৯২০-২০১৪) দম্পতির অ্যাপার্টমেন্ট থেকে প্রাপ্ত মণি-মাণিক্যের বিশাল সম্ভার। গত চার দশক ধরে চলেছে তাঁর অপ্রকাশিত রচনাসম্ভারের পাঠ, বিশ্লেষণ, অনুবাদ, প্রকাশ ও প্রচার। কয়েকটি শীর্ণ কবিতার বই প্রকাশের পর যে-কবির তিরোধান, সাড়ে চার দশক পেরিয়ে এখনো চলেছে তাঁর অপ্রকাশিত রচনার বিশাল সমারোহ আবিষ্কার।

দুই

পূর্ব ইউরোপ থেকে আর্হেন্তিনায় অভিবাসী হয়ে আসা এক ইহুদি পরিবারে ফ্লোরা আলেহান্দ্রা পিসারনিকের জন্ম এপ্রিল ২৯, ১৯৩৬ সালে। তাঁর মা এলা পিসারনিক এবং বাবা রেজ্লা ব্রোমিকার দে পিসারনিক পোল্যান্ডের রোভনে শহর ছেড়ে চলে এসেছিলেন সেখানকার সমাজে ক্রমবর্ধমান ইহুদি-বিদ্বেষ এবং রাজনীতিতে নাৎসিবাদের প্রবল প্রভাব দেখে ভয় পেয়ে। বাড়িতে তাঁরা মাতৃভাষা ইদ্দিশ এবং স্থানীয় ভাষা স্প্যানিশে কথাবার্তা বলতেন। এই দুই ভাষার পরিবেশে দুই বোন মিরিয়াম এবং আলেহান্দ্রার বেড়ে ওঠা। বুয়েনোস আইরেস শহরের অভিজাত সমাজের আত্মপ্রকাশের ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি-সংগীতের ভাষা ফরাসি। খুব কম বয়েসেই আলিয়োন্স ফ্রন্সেতে ফরাসি শিক্ষার ক্লাসে নাম লেখান দুই বোন।

তখন ১৯৫৯ সালের মে মাস; সদ্য তেইশ-পেরোনো কবি আলেহান্দ্রার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ হারানো অ্যাডভেঞ্চারগুলি (লাস আবেনতুরাস পেরদিদাস) প্রকাশিত হয়েছে কয়েক মাস আগে; তিনি তখনো মা-বাবার সঙ্গেই থাকেন তাঁদের বুয়েনোস আইরেস শহরের অ্যাপার্টমেন্টে। একদিন তিনি তাঁর ডায়েরিতে লিখলেন : ‘ভালো লিখতে হলে আগে আমাকে বাঁচতে হবে। কেবল লেখা, অন্য কিছু বিষয় নিয়ে চিন্তা করাও অসমীচীন। অর্থও চাই না, প্রেমও না। আমি জীবন নিয়ে ভাবতেও চাই না, জীবনকে ভালোভাবে গড়ে তোলার আগ্রহও নেই আমার। আমার চাই শান্তি : লেখাপড়ার জন্যে, গবেষণার জন্যে, কিন্তু আগে কিছু টাকা রোজগার করতে হবে, যাতে আমি মা-বাবার সাহায্য না নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারি; আর পারি লিখতে।’

কথাগুলি কি স্বীকারোক্তি? নাকি প্রবল আত্মবিশ্বাস? সাহিত্যবিষয়ে পরিকল্পনা? ঘটনাক্রমে, নাকি অনেক চিন্তাভাবনার পরে লেখা? এতো বছর পরে তা বলা মুশকিল। তিনি ফরাসি ভাষা জানেন, ফরাসি সাহিত্য তাঁর বেঁচে থাকার অবলম্বন, কিন্তু পরপর তিনটি কবিতার বই প্রকাশ করেছেন স্প্যানিশ ভাষায়। ওই একই নোটবুকের ধূসর পৃষ্ঠায় তিনি লিখে রেখেছেন তাঁর সাহিত্যিক পরিকল্পনা : ‘আমাকে ফ্রান্স যেতে হবে! মনে রেখো কথাটা। মনে  রেখো, আমি যেন এই আকাক্সক্ষা করি মনপ্রাণ দিয়ে। মনে  রেখো এই বিশাল আর গভীর পৃথিবীতে এই একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা বাকি রয়েছে।’

এখন আর একথা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তাঁর এই আকাক্সক্ষার পেছনে রয়েছে এক অনস্বীকার্য ইতিহাস : বিংশ শতাব্দীতে ইউরোপের এবং উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার যে-কোনো মহান লেখক-লেখিকার জীবনী নেড়েচেড়ে দেখলেই চোখের সামনে ভেসে উঠবে এক আলোকিত উদ্ভাসন, এক অপরিহার্য গন্তব্য, এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী শহর ও তার বোহেমিয়ান জীবনযাত্রা। ১৯২০-এর দশাব্দ থেকে শুরু করে পশ্চিমের শিল্প ও সাহিত্য যখন আধুনিকতার তুঙ্গে, তখন প্যারিস ছিল তার প্রতিভাময় প্রাণকেন্দ্র। এজরা পাউন্ড, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, জেমস জয়েস এবং সেজার ভায়েহোর মতো বিখ্যাত বিদেশি লেখকেরা তখন সেই শহরের বাসিন্দা। অনেক লেখক আবার নিজেদের মাতৃভাষা ত্যাগ করে ফরাসি ভাষাকেই করে নিলেন তাঁদের লেখার বাহন : পেরুর কবি ও চিত্রশিল্পী সেসার  মোরো (১৯০৩-৫৬) এবং পরের দশকে রোমানিয়ার মরমি দার্শনিক এমিল সিওরান (১৯১১-৯৫), খুব সম্ভবত বিংশ শতাব্দীতে ফরাসি ভাষার শ্রেষ্ঠ গদ্যশিল্পীদের অন্যতম।

এইভাবে কয়েক দশকের মধ্যেই ‘আলোকময় শহর’-এর বাসিন্দা হলেন অভিবাসী শিল্পী-সাহিত্যিকরা; ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতিতে এক নতুন জোয়ার আনলেন তাঁরা – দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বছরগুলি বাদ দিলে সেই স্রোত চললো অব্যাহত। ১৯৫০-এর দশাব্দে প্যারিস শহরের হৃদয় জুড়ে রইলেন লাতিন আমেরিকার ‘বুম’ এবং ‘বুম-পরবর্তী’ লেখকেরা : আর্হেন্তিনার হুলিও কোর্তাসা (১৯১৪-৮৪), পেরুর মারিও বার্গাস য়োসা (১৯৩৬-), কুবার সেভেরো সারদুই (১৯৩৭-৯৩); আরো এলেন ভবঘুরে ডিপ্লোম্যাট-সাহিত্যিকেরা : মিগেল আনহেল আস্তুরিয়াস, ওক্তাবিও পাস, আলেহো কার্পেন্তিয়ের। ওদিকে পরাবাস্তবতার ঢেউগুলি অতলান্তিক মহাসাগর পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দুই আমেরিকার শিল্পে-সাহিত্যে আর সেই ঢেউয়ে স্নান সেরে নিয়েছেন তরুণ আভাঁ-গার্দ, ফ্রানকোফাইল কবি -শিল্পীরা : তাঁদের মধ্যে কবি-চিত্রশিল্পী এনরিকে মলিনা (১৯১০-৯৭), কবি ওলগা অরোস্কো (১৯২০-৯৯) – দুজনেই ১৯৫০-এর দশকের অন্তিমে এসে পিসারনিকের ঘনিষ্ঠ বান্ধব; এবং চিত্রশিল্পী হুয়ান বাতিয়ে প্লানাস (১৯১১-৬৬), যাঁর স্টুডিওতে কিছুদিন ছবি আঁকা শিখেছিলেন তরুণী আলেহান্দ্রা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া অসমাপ্ত রেখে।

কবিতার কামড়ে অস্থির এই তরুণী, তাঁর শৈলী ও তাঁর সাহিত্যপ্রতিমা সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেন সেই ছবির আর কবিতার শহরে, সেখানে তাঁর দু-একজন দূরসম্পর্কের আত্মীয়ও বাস করতেন। ১১ মার্চ ১৯৬০ তারিখে ‘লায়েনেক’ জাহাজে চড়ে রওনা দিলেন অতলান্তিক মহাসাগর। কোনো পেশাদারি বা অপেশাদারি কর্ম নয়, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নাম লেখানোও নয়, কোনো আন্দোলনের অংশ হয়েও নয়, কেবল কবিতার জন্যে এই সুদূর যাত্রা। প্রথম কয়েক মাস কাটলো সাহিত্যজগতের প্রান্তসীমায়, প্রথমে এক লতায়-পাতায় মামার বাড়িতে, তারপর বাবার এক জ্ঞাতি ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে – উভয়েই পোল্যান্ড থেকে আসা ইহুদি অভিবাসী। বুয়েনোস আইরেসের সাংসারিক গ্লানি কিন্তু প্যারিসে তিনি বহন করতে অনাগ্রহী।

সহজে ভেঙে পড়ার মানুষ তিনি নন, তাঁকে চালিত করে কবির অন্তর্দৃষ্টি; তাঁর প্রাত্যহিক জীবন হয়ে উঠলো সাহিত্যের প্রসঙ্গে সম্পৃক্ত। তাঁর চারপাশে তখন শিল্প-সাহিত্যের দিকচিহ্ন। এর এক দশক আগে হুলিও কোর্তাসার কালজয়ী উপন্যাস এক্কা দোক্কা-এর প্রেরণাদাত্রী লা মাগার সঙ্গে লেখকের বারবার দেখা হয়ে যেত লোহার যে পায়ে চলা সেতুর নিচে, সেখানে কবি কাটাতে লাগলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা; সাঁৎ-মিশেল এবং সাঁৎ-জেরমেন-দে-প্রেস বুলেভার্ডের ক্যাফেগুলিতে এবং সেইন নদীর তীরে অবস্থিত পুরনো বইয়ের দোকানেও।

তিনি হেঁটে বেড়ালেন প্যারিসের পথে পথে, আত্মস্থ করে নিলেন তার নির্যাস, আপন করলেন তার মানুষজনকে। পরিচয় হলো বিভিন্ন পরাবাস্তববাদী ব্যক্তিত্বের সঙ্গে : জর্জ বাতাই (১৮৯৭-১৯৬২), জাঁ আর্প (১৮৮৬-১৯৬৬), ম্যাক্স আর্নস্ট (১৮৯১-১৯৭৬) প্রমুখ। বন্ধুত্ব স্থাপন করলেন এবং ফরাসি ভাষার লেখা স্প্যানিশে অনুবাদ করলেন উল্লেখযোগ্য সমসাময়িক কবিদের : আঁরি মিশো, ইভ বনেফয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ : কবিতা লেখার ফাঁকে ফাঁকে বিস্তৃত করলেন তাঁর পাঠপরিধি, স্প্যানিশ আর ফরাসি ভাষায়, বিভিন্ন গোষ্ঠীর, বিভিন্ন ঐতিহ্যের, বিভিন্ন শৈলীর লেখকদের নিবিড় পাঠ ও পুনর্পাঠ। তাঁর নোটবুকে রয়েছে অজস্র উদ্ধৃতির সংকলন, যেগুলি থেকে তিনি শুষে নেবেন কবিতার অনুপ্রেরণা – কবি-লেখকের তালিকাটি দীর্ঘ।

প্রথম দু-বছরে তাঁর ভবঘুরের জীবন – ঠিকানা পাল্টাতে হয়েছে পাঁচবার এবং কবি হিসেবে তিনি অজ্ঞাত। শেষ পর্যন্ত ১৯৬২ সালে একটা চলনসই আস্তানা জুটলো – ৩০ রু সাঁ সুলপিসের চারতলা বাড়ির চিলেকোঠায় – উল্টোদিকে সপ্তদশ শতকের রোমান ক্যাথলিক গির্জার পেছনের দরজা, সেখানকার দেয়ালে অজেন দেলাক্রোয়ার বিখ্যাত ম্যুরাল – ‘দেবদূতের সঙ্গে কুস্তি লড়ছেন জেকব’। ইভন বরদেলৈ (১৯৩৪-) ওইসময় সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী এবং প্যারিসে কবির প্রিয়তমা সখী সেই প্রকোষ্ঠের বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে :

Rimbaud’s Drunken Boat, a zone of intense tobacco, and the prodigious disorder of books and papers, a nomad’s shop where a samovar dominated, and that special atmosphere that grows in places where silence also grows, like an invading honeysuckle, nocturnal, permanent; the silence and a static, vibrant concentration, where the voice of Alejandra was queen.

এই পুণ্য আবাসে কবি হিসেবে তাঁর পুনর্জন্ম।

বেদনা, দারিদ্র্য, মধ্য ও শেষ রাত্রির অন্তহীন পদচারণা শহরজুড়ে – পিসারনিক বিশ্বাস করতেন, এইগুলি হলো চিরস্থায়ী শিল্পের অনুপ্রেরণা। ভেঙে পড়ুক স্বাস্থ্য, নেমে আসুক অর্থনৈতিক সংকট, তাঁর অবলম্বন কবিতা এবং কবিতার ভাষা, তার অন্তহীন রহস্য ও হাতছানি। মন কাঁদে আর্হেন্তিনায় পরিবার, স্বজন ও বান্ধবদের জন্যে, কিন্তু তাঁর আনুগত্য কবিতার প্রতি। ধেয়ে আসে মানসিক অসুস্থতা, ভয় পান – হয়তো পাগল হয়ে যাবেন তিনি, ডায়েরিতে লিখে রাখেন সেসব কথা। সঙ্গে সেসার ভায়েহোর ‘উত্তম বোধ’ কবিতা থেকে একটি উদ্ধৃতি :

জানো মা, পৃথিবীতে প্যারিস নামে

এক মহানগর রয়েছে।

বিশাল, বহুদূর এবং বিশাল,

আবারো বিশাল।

এবং মার্সেল প্রুস্তের আলবের্তিন অদৃশ্য উপন্যাস থেকে আরেকটি : ‘আমার আনন্দ পার্থিব বিষয়ে নয়, আমার সুখ  কেবল সাহিত্যে।’

‘পাইথিয়া’ – গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর মন্দিরের প্রধান পূজারিণী – কবি নিজেকে ভাবতে শুরু করলেন লাতিন আমেরিকার কবিতার ‘পাইথিয়া’ হিসেবে – প্যারিসে বসবাসের সময়টুকু তাঁর কবিজীবনের সবচেয়ে ফলপ্রসূ সময় – চতুর্থ কবিতার বই দিয়ানার বৃক্ষ (আর্বল দে দিয়ানা)-এর কবিতাগুলি সমসময়ে রচিত। ১৯৬২ সালের ডিসেম্বরে বইটি প্রকাশিত হলো বুয়েনোস আইরেস থেকে, উৎসবময় ভূমিকা লিখে দিলেন তাঁর বন্ধু ও পরবর্তীকালের নোবেলজয়ী দিকপাল কবি ওক্তাবিও পাস : ‘দিয়ানার বৃক্ষটি সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, কোনো ছায়া পড়ে না তার; রয়েছে এক নিজস্ব আলো, যা ঝকমকে ও ক্ষণস্থায়ী। আমেরিকা মহাদেশের শুষ্কতম জমিতে তার জন্ম।’

মুক্তছন্দের কবিতা আর গদ্যকবিতা মিলে ৩৮টি ছোট লেখার কোনোটিতে ‘খুঁটিনাটির একটিও অপ্রকৃত বর্ণনা নেই।’ বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে লাতিন আমেরিকার কবিতার উচ্চ শিখরে স্থান হলো তাঁর – পরবর্তী এক দশকে তিনি জয় করবেন নতুন নতুন জগৎ, কবিতার জন্যে তাঁর আত্মবিসর্জন। দিয়ানার বৃক্ষ-এর কবিতাগুলির বীজ ছড়িয়ে রয়েছে সমসাময়িক এই ফরাসি কবিতাগুলির মধ্যেও।

তিন

১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ – এই চার বছর কেটেছিল তাঁর প্যারিস শহরে – এই সময়ে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন কবিতা ও যৌনতার জগতের নতুন দিগন্ত। সে-সময়কার ফরাসি ভাষায় লেখা কবিতাগুলি এর আগে প্রকাশিত হয়নি, মূল ভাষাতেও নয়। ২০১৮ সালে নিউ ডাইরেকশন্স প্রকাশনা সংস্থা কবিতাগুলি প্রকাশ করলো ইংরেজি অনুবাদে – প্রথম পর্বে ১৩টি কবিতা এই গ্রন্থের কেন্দ্রবিন্দু, ‘ফরাসি কবিতা’ নাম দিয়ে গুচ্ছটি রচিত; দ্বিতীয় পর্বে ছয়টি কবিতা অভিলেখাগারে বিভিন্ন কাগজপত্রের ভেতর ছড়ানো-ছিটানো; তৃতীয় পর্বে কবির রচিত আটটি শব্দচিত্র – সবুজ মার্কারে আঁকা ছবির স্কেচের সঙ্গে কবিতার পঙ্ক্তি এবং একটি এচিং, দু-পঙ্ক্তির কবিতাসমেত :

মনে পড়ে ঝড়, লাইলাক ফুলগুলো, ধূসরতা, আতরের সুরভি, সেই গান,

এবং পাগল হাওয়া, কিন্তু দেবদূত কি বললেন, একটা কথাও মনে নেই।

আমি এই গ্রন্থের ১৯টি কবিতার থেকে নয়টি নির্বাচিত কবিতার বাংলা অনুবাদ করেছি। পাঁচ নম্বর কবিতাটির নাম ‘নিশীথ, যৌনতা’, বাকি কবিতাগুলি নামহীন। কবিতাগুলিতে পিসারনিকের গভীরতম অবসেশনসমূহের প্রকাশ : ভাষার সীমাবদ্ধতা, নীরবতা, নিজেকে মেলে ধরতে দ্বিধা, শরীর, নিশীথ, যৌনতা এবং অবশ্যই শরীর, গোপন ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের গভীর অভিঘাত। নিজের অভিজ্ঞতায় দুর্লভ প্রেমের নির্বাধ বহিঃপ্রকাশ, তার সঙ্গে ফরাসি কবিতা পাঠের অন্তরঙ্গ অভিজ্ঞতা। এছাড়াও তাঁর বেশকিছু ফরাসি কবিতা রয়েছে, যেগুলি পরে তিনি স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করে অন্য গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। গ্রন্থের নামটিও কবির দেওয়া নয় : ৬ নম্বর কবিতার একটি অংশ থেকে গ্রন্থের নামকরণ করেছেন অনুবাদক।

কবিতাগুলি এলোমেলোভাবে লেখা, যখন যা ভাবনা এসে হাজির হয়েছে লিখে রেখেছেন প্রিয় নতুন ভাষায়।

পত্র-পত্রিকায় বা বই হিসেবে প্রকাশের কথা ভেবে তা রচিত হয়নি। চিলির কবি রাউল সুরিতা (১৯৫০- লিখেছেন : ‘ÔHer poetry Ñ with a clarity that becomes piercing Ñ illuminates the abyss of emotional sensitivity, desire and absence. It presses against our lives and touches the most exposed, fragile and numb parts of humanity.Õ যা কিছু ভেঙে যায়, অথচ ভাঙে না, সেই বাঁধভাঙা প্রেমের খোঁজে আরশির উভয় দিকেই তার বিচরণ। দুই ভাষার, দুই সংস্কৃতির মাঝামাঝি নো-উইমেন্স-ল্যান্ডই হয়ে উঠবে তাঁর কাব্যময় অস্তিত্ব, এবং আচ্ছন্ন করে রাখবে তাঁর সংবেদন সেপ্টেম্বর ২৫, ১৯৭২ সালের সেই শোচনীয় দিনটি পর্যন্ত। মৃত্যুর আগে তিনি অ্যাপার্টমেন্টের ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে লিখে রেখেছিলেন এই কয়েকটি পঙ্ক্তি :

শিশুর প্রার্থনা

কুয়াশার বিরুদ্ধে গর্জন

গোধূলিতে রচিত

অন্ধকারের বিরুদ্ধে

আমি যেতে চাই

কোথাও না অথবা

গভীরতম গভীরে

হে জীবন

হে ভাষা

হে ইসিডোর

জীবনের শেষ আট বছরে কবি কি আবার ফিরে গিয়েছিলেন ফরাসি ভাষার আশ্রয়ে? সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে ভবিষ্যতের গবেষকদের কাছে  – তাঁর কবিতার অনেক ভূমিই এখন পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত।

লাফিয়ে চলা প্রহর

১.

নীরবতা নিয়ে কত আর ভাবতে পারি? হ্যাঁ, ঘুমিয়ে পড়া সম্ভব, কিংবা স্বপ্ন নিয়ে লড়ে যাওয়া কয়েকদিন, নীরবতাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে। হাতে সময় অল্প, তার ভেতরই দিক পরিবর্তন চাই, সে এক অনেক দূরের যাত্রা খুব স্বল্প সময়ে। তারা বলে : বেছে নিও তুমি, নীরবতা অথবা স্বপ্ন। কিন্তু আমি খুলে রাখি চোখ দুটো, এগিয়ে চলি – এগিয়ে চলি , এক বিন্দু নড়ি না পথ ছেড়ে, সেই সর্বগ্রাসী, আলোকিত অঞ্চলের দিকে, যে আলো গিলবে তোমার চোখজোড়াকে।  যেতে চাও তুমি, যেতেই হবে তোমাকে। ছোট্ট কাল্পনিক ভ্রমণ। কয়েকদিনের জন্যে সীমাবদ্ধ টান তোমার দৃষ্টির ওপরে। ঠিক আগের মতোই। একই বেদনা, এই অসন্তোষ, এই অপ্রেম। আমরা ক্লান্তিতে মরি এখানে। নিজেদের উজাড় করে দিতে চাই আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কুটিল ফাঁদ পেতেছে একজন :  প্রাগৈতিহাসিক দৃষ্টির পানে ফেরত যাওয়া, কালো ধুলোয় মেশা নীল চোখদুটোর গভীর প্রত্যাশার দিকে। লোভ এবং প্রতিশ্রুতি, দুটি রয়েছে নীরবতার অন্তরে। আমার দীক্ষার এখানেই সমাপ্তি। প্রতিটি সমাপ্তির সূচনা এখানে। কেবল নিজের কথাই বলে যাই আমি। একবার মাত্র গিয়ে দেখে আসাই যথেষ্ট, যদি আর একবার তুমি ফিরে পাও তোমার অন্তর্দৃষ্টি। ক্লান্তিতে মরে যাই আমরা এখানে। এক বিন্দু নড়তে চাই না আমরা। ভীষণ ক্লান্ত।

প্রতিটি অস্থির আর প্রতিটি অঙ্গের মনে পড়ে আদিম মর্মপীড়ার কথা। যন্ত্রণা সয়ে বুকে হেঁটে এগোই, নাচতে নাচতে সামনে টেনে নিই নিজেকে। একজন কথা দিয়েছিল। আমি কেবল আমার কথাই বলি। একজন আর সইতে পারে না।

২.

যদি আরো একবার এই থলে ভরা ধুলোর ভেতর নীল দৃষ্টি বেয়ে –  আমি কেবল নিজের কথা বলতে পারি – আমার সে অধিকার রয়েছে – এই প্রত্যাশা, এই অধ্যবসায় – যদি কেবল একবার – কে অনুধাবন করতে পারে আমার বিষাদ? – আমি ভাঙা খেলনার কথা বলি, কালো পুঁটলির কথা, এক প্রত্যাশার কথা, আমি কেবল নিজের কথা বলি, আমি কাজটা করতে সক্ষম, কাজটা করাও উচিত। যত কিছুকে আমি কাছে ডাকি, তারা যদি অন্তত একবারও নিকটে না আসে, কেউ অবশ্যই হেসে ফেলবে, কেউ হয়তো অকথ্য একটা রসিকতা করবে তাকে সমাদর জানাতে – গোমড়ামুখো আলোতে স্তরে স্তরে ধুলো ভাসছে, সেকথা আমি বলি, কিন্তু সেই নীল চোখ সুসময়ের জন্যে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে চলে। কে অনুমান করতে পারে আমার বিষাদ? আবারো ভাঙা খেলনাপাতি নিয়ে খেলা করে যায় খুদে খুদে হাত, কে তাকে বুঝবে, শুনবে তার কথা, অপেক্ষা করবে তার জন্যে? মৃত্যুর বিপ্রতীপে সেই নীল চোখদুটো আমার সহায়, তারা আমার সঙ্গে কথা বলে, শেষে আমি হয়ে দাঁড়ায়। যদি আবার নতুন করে আমার চোখদুটো নির্মাণ করি মাটি দিয়ে, কালো থলির ভেতর ভরে দিই মাথাটা, আমার নীল চোখ পড়তে পারে ধূলির লিখন, বাঁকাতেড়া হাতের লেখনীতে। যদি আবার, প্রতিবার।

৩.

সারাবেলা আমি জলস্রোতের সকরুণ বিলাপ শুনি। আমার মানস, সেই রক্তাক্ত অঞ্চল, ঝড়ের কামড় খাওয়া সেকেলে স্বর্গদূত। সারাদিন আমি শুয়ে শুয়ে গুঙিয়ে যাই, শব্দেরা কুঁচি কুঁচি জলস্রোত হয়ে ছড়ায়, জলে ঝাঁপায় আমার বিলাপ। আমার স্বপ্নে আসো তুমি আর তার মধ্যে মনে রয়ে যায় জলপ্রপাতের আওয়াজ। সারারাত্তির আমি উৎকর্ণ হয়ে শুনি, আমার সন্ধানে কোনো বস্তুর অগ্রসরমান পদধ্বনি। সারা রাত্তির আমার চোখ দিয়ে চিত্রিত করতে চাই তোমার চোখের আকৃতি। সারা রাত্তির তোমার সরোবরে সাঁতার কেটে যাই, আমার চোখের গভীরতায় ডুব দিতে দিতে মিশে যাই তোমার চোখে। সারা রাত্তির আমি তোমার কণ্ঠস্বরে কথা বলি আর নিজেকে শোনাই তোমার নীরবতা। আমার নগ্ন শরীরে বৃষ্টি হয়ে ঝরো তুমি সারা রাত্তির, বৃষ্টির জলসিঞ্চিত হাতে নিমজ্জিত করো আমায়। সারা রাত্তির আর সারা দিন আমি দেয়ালের একটা নীল ছোপের দিকে চেয়ে চেয়ে মনশ্চক্ষে তোমায় প্রত্যক্ষ করি, কোন শৃঙ্গার রসাত্মক শব্দ দিয়ে গড়ে তুলবো তোমার মুখমণ্ডল, সেই কথা ভাবি। আমি এই শনাক্তকরণের অবস্থান কিছুতেই ছাড়বো না, যতক্ষণ না তুমি এসে হাজির হও আমার চোখের সামনে।

সারা দিন ধরে আমি ঘুমের ঘোরে কাঁদি। মনে পড়ে বাতাসের কথা, সারা রাত্তির আমি বাতাসের কথা ভাবি, যে বাতাস বহুদূর থেকে এসে বসবে আমার পাশে। আমার স্মৃতি, ধূসর সমুদ্রসৈকতে শীতল ঝড়ের হাওয়ায় উড়ে আসা খ্যাপা পাখি, বারবার আসে আর ফিরে যেতে চায় না। এই হাওয়া আমার অন্তরে, আর তোমার অন্তরে, পতনশীল জলধারা এবং ধূসর ঝড়ের শীতল সৈকতের আমি কেঁদে যাই সারা রাত্তির।  কোথায় গেল তোমার সব সেকেলে অধীত জ্ঞান? – তারা প্রশ্ন করে। সারা রাত্তির আমি নিজের ক্রন্দনরত মুখমণ্ডলের আওয়াজ শুনি।

এই পথ ধরে তুমি ফিরে যেতে পারো তোমার জন্মগত উৎসে, তোমার বিশুদ্ধ যন্ত্রণায়। সারা রাত্তির আমি এই অচেনা বৃষ্টির কবলে। তুমি বলবে, তারা আমায় দিয়েছে অন্তহীন অবয়বে ভরা এই নীরবতা। আর ঝোড়ো হাওয়ায় একাকী পাখির মতন তুমি এগিয়ে যাও নির্জনতার পানে।

৪.

রাতভরে আমি কেবল জলধারার ক্রন্দন শুনি। রাতভরে আমি এক নিশীথের জন্ম দিই আমার অভ্যন্তরে, তারপর দিনের সূচনা করি আমার নিজের জন্যে, সে কেঁদে যায় কারণ নিশীথের ভেতর দিয়ে দিবস বয়ে যায় জলপ্রপাতের মতন।

কেউ আমায় ব্যাকুল হয়ে খুঁজছে, আমি তার কণ্ঠস্বর শুনি সারা রাত্তির। তুমি আমার আলিঙ্গন ছেড়ে একটু একটু করে দূরে সরে যাও, ধীরপ্রবাহিনী অশ্রুধারার মতন। রাতভরে আমি তোমায় আলোকসমুজ্জ্বল বার্তা পাঠাই, বৃষ্টির জলের লেখা চিঠি, সারা রাত্তির আমি একজনকে খুঁজি পাগলের মতন, আর সেও খোঁজে আমাকে।

আমার অনিদ্রা থেকে জন্ম নেওয়া রিপুদগ্ধ আলোর বৃত্তে কার যেন পায়ের শব্দ শুনি। যার পায়ের আওয়াজ, সে আর যন্ত্রণায় কাতরায় না, কোনোদিন সে আর চিঠিপত্রও লিখবে না। সারা রাত্তির সে বারবার থমকে দাঁড়ায়, আবার পেরোয় তিক্ত আলোর বৃত্ত।

সারা রাত্তির আমি ডুব দিই তোমার চোখের নদীতে, তোমার চোখ হয়ে যায় আমার নিজের। আমার নীরবতার বৃত্ত জুড়ে যে ভবঘুরেটা আসনপিঁড়ি হয়ে বসে, তাকে আমি সারা রাত্তির খোঁচাই। রাত ভোরে আমি চেয়ে চেয়ে দেখি, আমার দিকে এগিয়ে আসে কিছু একটা – শীতল, আর্দ্র, নীরবতার রহস্য থেকে কান্নার শব্দকে জন্ম দেওয়ার ফন্দি আঁটতে।

আগত নীরবতার ধূসর ঝড়ে গভীর হয় ঘননিশীথ। রাত, মৃত মানুষদের আঁখিপল্লবের ছায়াতে, থকথকে রাত, তার তৈলাক্ত, কালোশ্বাসবায়ু ধেয়ে আসে আমার দিকে, তার ধাক্কায় আমি একটা শূন্যস্থান খুঁজতে থাকি আশ্রয়ের জন্যে, যেখানে না আছে উষ্ণতা, না শীতলতা। সারা রাত্তির আমি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই একজনের নাগাল থেকে। মৃগয়ার সামনের সারিতে আমি, আবার প্রভাতফেরিতেও। আমি শোকগাথা গেয়ে চলি। কালো কাফনের ওপর দিয়ে কালো পাখিরা ওড়ে। কাঁদে আমার মন। সব হারানোর হাওয়া বয়। আমি তার উৎকণ্ঠিত আর প্রসারিত হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে এগিয়ে যাই, কিন্তু জানি না এই অন্তহীন বুকফাটা কান্নার, নিশীথের এই ধাতব কোলাহলের, এই বিলম্বের, এই কলঙ্কের, যে সন্ধানের, এই অনস্তিত্বের শেষে কী রয়েছে।

সারা রাত্তির আমি নিজের মধ্যে এই আত্মসমর্পণের পথ খুঁজি, এই ক্রন্দনরত কণ্ঠস্বরটি একান্তভাবে আমারই।

লণ্ঠনহাতে খুঁজতে বেরিয়ে পার হই ছায়াদের অনৃতভাষণ। হৃদয়ের আঘাত অনুভব করি শ্রোণিতে আর হৃদয়ের সেকেলে শূন্যস্থানে জলের মাত্রা কমে।

রাতভরে আমি তোমায় প্রশ্ন করি , ‘কেন?’ রাতভরে তুমি আমায় উত্তর দাও, ‘না।’

৫.

যৌনতা, নিশীথ

আবার একবার, কেউ পড়ে যায় তার প্রথম পতনে – দুই নগ্ন শরীরের পতন, দুটো চোখের, অথবা চারটে সবুজ চোখের অথবা আটটা সবুজ চোখের, যদি আমি আয়নার ভেতরে জন্মানো চোখগুলোকেও ধরি

(মধ্যরাতে, বিশুদ্ধতম ভয়ে, সব হারাবার বিষাদে), তুমি চিনতে পারোনি তোমার নিজের অনুভূতিহীন নীরবতার কণ্ঠস্বর, চোখের সামনে ধরে তোমার নিজের পাগলামির অবকাশে লেখা পার্থিব বার্তাসমূহ, তোমার দেহ যেন একটা গেলাস, এবং নিজেদের আর অন্যদের গেলাস থেকে আমরা পান করি এক অসম্ভব পানীয়।

অভিশপ্ত আসবের মতন অভিলাষ ছলকে পড়ে আমার দেহে। আমার এই তৃষ্ণার্ত তৃষ্ণায়, তোমার চোখের প্রতিশ্রুতি ছাড়া বাঁচবো কী করে আমি? আমি যা কিছুর কথা বলি, তারা কোনোমতেই এই পৃথিবীর নয়। আমি এমন কিছুর কথা বলি, যার অভিপ্রায় রয়েছে অন্য কোনোখানে।

অন্তহীন শুভ্র নিশীথের স্মৃতিতে নগ্ন হয়েছি আমি। আত্মহারা, বিভোর, আর আমি রাতভরে মেতে থাকি নিবিড় সঙ্গমে, কামুক কুকুরের মতন।

কখনো কখনো একই রাতের অবকাশে, বাস্তবের আতিশয্য আঘাত করে আমাদের। পোশাক ছেড়ে ফেলে, আতংকিত আমরা। আরশির কঠোর পর্যবেক্ষণে কুণ্ঠিত আমরা, বুঝতে পারি আমাদের ক্রন্দন, আমাদের গভীর ক্ষত জন্ম নেবে আরশির থেকে।

নিশীথ নিজেকে মেলে ধরে কেবল একবারই। তাই সই। তুমিও দেখো। তুমি তো দেখেছই। দুজনে একান্তে থাকার যে ভীতি, আরশির ভেতর হঠাৎ আমরা চারজন। আমরা কাঁদি, আমরা চোখের জল ফেলি, আমাদের ভীতি, আমাদের আনন্দ যা আমাদের ভীতির চেয়েও ভয়ঙ্কর, আমার অশ্লীল চিৎকার, আমার মুখের অপশব্দেরা আমাদের যুগলকে চাবিবন্ধ করে দেয় আরশির ভেতর, কিন্তু কখনো আমাকে একা নয়। আমি জানি এই নিশীথের প্রকৃতি। আমরা পুরোপুরি তার চোয়ালের ভেতর বন্দি, এতটা গভীরে যে তারা অনুধাবন করে না এই ত্যাগ স্বীকার, আমার সব দেখা চোখদুটোর এই অপবাদ। একটা আবিষ্কারের কথা না বলে পারি না : বুঝতে পেরেছি, সঙ্গমের ভেতর আমি আর আমার ভেতরে সঙ্গম। এক মুহূর্তের ভয়ের হাত থেকে বাঁচতে আমি জীবনভর ভয়ের কথা বলে যাই। অনুপস্থিতির গহ্বর। কিন্তু কে বলবে : সারা রাত কেঁদো না? সব পাগলামি আসলে মিথ্যে। যেমন নিশীথ। যেমন মরণ।

৬.

বাতাসের কথোপকথন, প্রাচীন বিলাপের ধ্বনিতে ভরা নিশীথের স্মৃতির পথ ধরে লাল ঘোড়ার টগবগ। আমার স্মৃতিসমৃদ্ধ চোখ থেকে নির্গত হয় দুর্বৃত্ত। পৃথিবী অবয়ব দেয় তাকে রুদ্ধ চিৎকারে। যদি আমি আরশির দুপাশের এই পাগলামির জগৎ  পেরিয়ে কোনো এক নিশীথে দেখতে পাই নিজেকে, কী ভালোই যে না লাগবে। দেখার উপায় হলো, দু-চোখ খুলে নিজের অস্তিত্বের চিহ্নগুলিকে মিলিয়ে যাওয়ার দর্শন। লাল ঘোড়াটা আসন্ন বদরাগী ঋতুর আগমনবার্তা। নিজের নামের শেষ অংশটা চিবিয়ে খেয়ে আমরা হারিয়ে যাই বুকফাটা আর্তনাদের স্মৃতিতে।

চারপাশের বস্তুসমূহের যদি এই অবস্থা, তবে এই অজ্ঞানতার রাজ্যের অধীশ্বর হে হবে? আমি এঁকেবেঁকে নিজেকে জড়িয়ে নিই লাফিয়ে চলা প্রহরের পরিধিতে, আমাকে তার পেছন পেছন টানতে টানতে নিয়ে যায় প্রহরজোড়া ক্রন্দন, একে একটিমাত্র চিহ্নের হাতে বন্দি, আমি বাতাসের আছড়ে পড়ার আওয়াজ শুনি। বদমেজাজের সেই অশ্ব, আমাকে নিয়ে যাও আমার থেকে দূরে। নিশীথের স্থান নেবে যে ক্রন্দন, তার থেকে অনেক অনেক দূরে।

৭.

হাওয়ার মাতনে আমি তোমায় খুঁজি। তুমি হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ক্রন্দন নও। হাওয়ার মাতনে আমি তোমাকেই খুঁজি।

নিশীথ উন্মুক্ত করে আমায় আর সেই নিশীথ তুমি।

ফিরে এসো আবার। ভেতরে ভেতরে ছিঁড়ে খুঁড়ে যেতে যেতে তোমার ভাবলেশহীন মুখ সামনে ভেসে ওঠে।

তোমার চোখদুটো অন্ধ করে দেয় সবকিছু, এমনকী নিশীথকেও, তোমার নাম লেখা আমার গভীরে।

ফিরে এসো আবার। মৃত্যুর ফেরানো মুখ দেখার জন্যে যে অভিযাত্রা, তাতে তুমি আমার একমাত্র বাহন।

প্রতিটি শব্দের মধ্যে তুমি, উচ্চারণের ভিক্ষা চাও। প্রতিটি শব্দ স্মৃতির প্রতি দীর্ঘ আমন্ত্রণ।

ফিরে এসো যতক্ষণ ঝনঝন করে রাত আর খুলে যায় আরশিগুলি আর আমার ভুবন ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায় তোমার অনুপস্থিতিতে। বাতাসের সঙ্গে সব কিছু ডানা  মেলে উড়ে যেতে চায় আকাশে। চিনতে পারো এক ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত, জীবন কাটানো তোমার সঙ্গ ছাড়া, সে অসম্ভব।

তোমার দৃষ্টির সূচনা আমার চোখে, তোমাকে আর দেখি না আমি। যে-কোনো কণ্ঠেই ডেকে ডেকে যাও তুমি, সাড়া মিলবে না। নিঃশেষ হও তুমি আমার দু-হাতের বন্ধনে, তারা আর স্পর্শ করবে না তোমার শরীর। তোমার চোখদুটো খোদিত আমার অস্থিমজ্জায়। আমায় এই অবস্থায় দেখা অসহ্য হয়ে উঠবে সবার। বীভৎস সব উল্কি।

বৃষ্টি ঝরাই আর সূর্যকে জাগিয়ে তুলি আমি। তোমার চোখকে কামনা করি আমার দু-চোখে।

৮.

স্মৃতি এখন বিস্মরণের নিকটে। দূর থেকে মৃত্যুর

কণ্ঠস্বরে দাঁতের ঘর্ষণ এবং স্পন্দন এবং কাঁপুনি

হাওয়া বঞ্চনা করে

হাওয়া মিথ্যে বলে

উদ্ধত হাওয়া

লুকোয় হাত

পুণ্য দু-হাত

প্রেরিত সন্ত

সন্তের প্রজনন

মিথ্যুক হাওয়ার প্রকোপে

আমি মিথ্যে বলি

আমি বঞ্চনা করি

শুয়ে পড়ি আমি

স্বর্ণ আর দিনগত পাপক্ষয় থেকে

এই উন্মাদ হাত দুটো আমার

আমার পুণ্য হাত দুটোর

প্রজনন তোমার ছায়ায়

লুটিয়ে

আমার আত্মমেহন

এক পুষ্পের ইশারা

শীর্ণ

শীতল

অবহেলায় বিলিয়ে দিই নিজেকে

পাতালময় তুষার

নিজেকে বিলিয়ে দিই

ভয় দেখাও তুমি

নিজেকে বিলিয়ে দিই

কারুর পরোয়া করি না

৯.

প্রহর ডুবে যায় আমার

বন্ধ দু-চোখের শূন্যতায়

ওই আসে খিটখিটে দেবদূত

ওই সবুজ পালক

ওই খোলা জানালা

[রচনাকাল ১৯৬০-১৯৬৪। মূল ফরাসি থেকে প্যাট্রিসিও ফেরারি এবং ফরেস্ট গ্যান্ডারের ইংরেজি ভাষান্তর অবলম্বনে বাংলা অনুবাদ]

* কৃতজ্ঞতা স্বীকার : গৌতম মিত্র