জলের অক্ষরে লেখা

পর্ব : ১১

অবন্তিকে বিদায় দিয়ে ফের বেডরুমে এলো ঋভু। বিছানাটা এলোমেলো হয়ে আছে। মুচকি একটু হাসলো সে, অনেক ঝড় বয়ে গেছে বেচারা বিছানার ওপর দিয়ে, বহুদিন পর। থাকুক, ওভাবেই থাকুক আজকে। ঘর জুড়ে একটা সুগন্ধ, অবন্তির শরীরের গন্ধ, থাকুক ওটাও। সে এলোমেলো বিছানাতেই সুগন্ধির ভেতরে ঘুমাবে আজ। কিন্তু এখন তো ঘুম আসবে না, কী করা যায় তাহলে? বই পড়বে? কোনো এক পুরনো প্রিয় বই, ফিরে পড়বে আবার? নাহ্, ইচ্ছে করছে না। সিনেমা দেখবে? আগে দেখা প্রিয় কোনো সিনেমা? কিংবা না-দেখা নতুন কোনোটা? নাহ্, নতুন কোনো কিছুর ঝুঁকি এই মুহূর্তে নেওয়া যাবে না। ভালো না লাগলে মেজাজ খিঁচড়ে যাবে, সুন্দর অনুভূতিটা যাবে নষ্ট হয়ে। কিন্তু পুরনো সিনেমাও দেখতে ইচ্ছে করছে না। অনেকখানি সময় বসে থাকতে হবে স্ক্রিনের সামনে, ভাবতেই ইয়ে লাগছে।

কেমন যেন একা একা লাগছে তার। মনে হচ্ছে, অবন্তি আজ এখানে রয়ে গেলে বেশ হতো। কী করবে বুঝতে না পেরে ব্যালকনিতে গেল ঋভু। কিন্তু সেখানেও সেই হা-করা নিঃসঙ্গতা। কোনো মানে হয় না এমন অনুভূতির। একাকিত্বকে সে বরণ করেছে, ভালোবেসেছে, উপভোগও করেছে এতদিন ধরে। হঠাৎ করে একে খারাপ লাগার যুক্তি নেই। বরং আজ তার প্রফুল্ল থাকার কথা। অনেকদিন পর আজ সে তৃপ্ত, আনন্দিত। কাক্সিক্ষত কারো শরীরের সঙ্গে নিজের শরীর মিশে যাওয়ার তৃপ্তি, সুসানকে সুখী আর তৃপ্ত করার আনন্দ। রিনি কখনো তৃপ্ত হতো না, কিংবা হলেও বোঝা যেত না। সঙ্গম শেষে কোনো কথাও বলতো না, ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে পাশ ফিরে শুয়ে পড়তো, ঘুমিয়েও যেত অল্পক্ষণের মধ্যে। কিছুক্ষণ পর ঋভুর হয়তো আবার ইচ্ছে করতো কিন্তু রিনি তখন গভীর ঘুমে, ওকে ফের জাগাতে মন চাইতো না। শরীর ভরা অতৃপ্তি নিয়ে ছটফট করতো সে। না, আজ আর রিনির কথা ভাবতে চায় না ঋভু। কিন্তু কী কারণে যেন ওকেই মনে পড়ছে। একটা দাম্পত্য সম্পর্ক, সারাক্ষণই কাছাকাছি থাকার সম্পর্ক, অথচ শীতল এবং আবেগহীন, কতদিনই বা বয়ে বেড়ানো যায়? সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, সম্ভবত রিনিও ছিল ক্লান্ত এবং অবসাদগ্রস্ত। বিচ্ছেদটা তাই অনিবার্যই ছিল।

রিনি আসার আগেই দুজন নারীর সঙ্গে ঋভুর শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল। প্রতিশ্রুতিহীন, দায়হীন সম্পর্ক। বিশুদ্ধ শারীরিক আকর্ষণ ছাড়া আর কিছু ছিল না সেখানে। সম্ভবত সেজন্যই সেই সম্পর্কগুলো ছিল উষ্ণ, উদ্দাম আর আনন্দমুখর। প্রথম সম্পর্কটা হয়েছিল তার বাইশ বছর বয়সে। অপ্রত্যাশিতভাবে। মফস্বল থেকে তাদের এক আত্মীয় এসেছিল বাসায়। নাঈমভাই আর তার বউ পারুল ভাবি। এরা যে কেমন ধরনের আত্মীয় ঋভুর ঠিক মনে নেই। প্যাঁচওয়ালা সম্পর্ক সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। মায়ের চাচাতো না ফুপাতো না খালাতো না মামাতো বোনের, অর্থাৎ কোনো এক ধরনের কাজিনের ছেলে এই নাঈমভাই, তাও ফার্স্ট কাজিন নয়, কেমন করে যেন প্যাঁচ খাওয়ানো। যা হোক, সে অত মাথা ঘামায়নি এই সম্পর্ক নিয়ে। তারা এসেছিল চিকিৎসা করাতে। বিয়ের পর সাত বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও বাচ্চাকাচ্চা হচ্ছে না, সেজন্যই দুশ্চিন্তা। মা এবং বাবাও সাদরে গ্রহণ করলেন তাদেরকে, যেভাবে সব আত্মীয়কেই গ্রহণ করতেন। তাঁদের সময়টিই ছিল ওরকম, স্বভাবটিও। আত্মীয় মানে আত্মীয়ই, তা সে যত দূরেরই হোক না কেন, যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হতো তাদের। বাবা নিজেই তাদের দুজনকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চললো। কিছু ওষুধ দেওয়া হলো দুজনকেই, বলা হলো, একমাস পর ফের তিনি দেখবেন। নাঈমভাই চাকরি-বাকরি করেন, এত লম্বা সময় থাকতে পারবেন না, তাই একমাস পর আবার আসার কথা জানালেন মাকে। মা বললেন, ‘তুই গেলে যা। বউমা থাকুক।’ নাঈমভাই বুঝতে পারছিলেন না, বউকে রেখে যেতে হবে কেন? মা বোঝালেন, এই ধরনের চিকিৎসার জন্য ধৈর্য ধরতে হয়, বারবার ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। তুই তো একবার বউকে নিয়ে গেলে আর আসবি না।

গাঁইগুঁই করলেও শেষ পর্যন্ত বউকে রেখেই যেতে হলো তাকে। এই সামান্য পারিবারিক ঘটনা যে ঋভুর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে, সে তখন তা কল্পনাও করেনি।

ঋভু আর পারুল, সম্পর্কটা যেহেতু দেবর-ভাবির, যত প্যাঁচালো আর দূরেরই হোক না কেন, একটু দুষ্টুমির আমেজ থাকেই। ঋভু তখন টগবগে তরুণ, উচ্ছল-প্রাণবন্ত, সুদর্শন-স্বাস্থ্যবান, দিনমান বন্ধুদের সঙ্গে শহর দাপিয়ে বেড়ায়। বাসায়  ফেরার টান নেই ততটা, তাড়াও নেই। বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে গেছে বাবা-মায়ের কাছ থেকে, সে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে চলেছে। তাছাড়া, বাসায় ফিরবেই বা কেন? কথা বলার মানুষ নেই তো! মা-বাবার সঙ্গে আর কতক্ষণই বা গল্প চালানো যায়? নীলু যদি থাকতো … না, নীলুর কথা সে কিছুতেই ভাবতে চায় না। তো, পারুল ভাবি আসার পর তার একজন গল্প করার সঙ্গী হলো। দুজনের গল্পের বিষয় যদিও পুরোপুরি আলাদা, একেবারেই মেলে না, তবু বেশ জমজমাট আড্ডা হতো তাদের। দুজনই দুজনের গল্প দারুণ উপভোগ করতো। পারুল গল্প করতো তার মফস্বলের জীবন নিয়ে – তার বেড়ে ওঠা, স্কুল-কলেজ, তাকে পটানোর জন্য ছেলেদের ফন্দিফিকির, প্রেম, বিয়ে, সংসার ইত্যাদি নিয়ে। আর ঋভুর গল্প তার প্রতিদিনের মজার মজার অভিজ্ঞতা নিয়ে। নাঈমভাই চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সম্পর্ক ওটুকুই ছিল। ভিন্ন দিকে মোড় নিলো চলে যাওয়ার পর। সেদিন রাতে, খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রুমে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ফের ঋভু ফিরে গিয়েছিল রান্নাঘরে, চা বানাবে বলে। এটা তার প্রতিদিনের রুটিন। ডিনারের পর এক কাপ চা লাগবেই। সে নিজেই

বানায়, কাউকে জ¦ালায় না। সেদিন গিয়ে দেখলো, পারুল ভাবি কী যেন করছে সেখানে। ঋভুকে দেখে বললো, কিছু লাগবে?

হ্যাঁ ভাবি, এক কাপ চা বানাবো।

শুধু চা লাগবে?

হ্যাঁ।

আর কিছু না?

না। এত রাতে আর কী খাবো?

কত কিছু খাওয়ার আছে!

ঋভু তখনো কিছু বোঝেনি। বললো – না, শুধু চা হলেই চলবে।

এক কাপ?

হ্যাঁ।

দু-কাপ বানালে কেমন হয়?

তুমি খাবে?

এমনিতে খাই না, আজকে না হয় খেলাম।

তাহলে দু-কাপই বানাই।

তোমাকে বানাতে হবে না। তুমি রুমে যাও, আমি নিয়ে আসছি।

সুবোধ বালকের মতো নিজের রুমে ফিরে গেল ঋভু। কিছুক্ষণ পর চা নিয়ে এলো পারুল ভাবি। একটা কাপ নিজের জন্য রেখে অন্য কাপটা দিলো ঋভুর হাতে, তারপর বসলো মুখোমুখি। বললো, শুধু চায়ের জন্যই গিয়েছিলে?

তার ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি।

বিভ্রান্ত হয়ে গেল ঋভু। এই হাসির মানে কী? বললো, হ্যাঁ চা-ই তো! আর কী?

রাতের বেলা পুরুষ মানুষের কত কিছু দরকার হয়! – হেসে বললো পারুল।

‘পুরুষ মানুষ’ শব্দটি ঋভুকে হঠাৎ করেই যেন জাগিয়ে দিলো। হ্যাঁ, তাই তো! সে তো এখন পুরুষ মানুষ। পারুল যদি বলতো, ‘রাতের বেলা ছেলেদের কত কিছু দরকার হয়’, তাহলে হয়তো এরকম মনে হতো না। পারুলের দুষ্টুমিভরা ইঙ্গিতটা ধরতে পেরে খুশি হয়ে উঠলো সে। গভীর রাত, সামনে অতীব সুন্দরী আকর্ষণীয় যৌবনবতী রমণী, কিছুটা অশ্লীল হতে দোষ কী?

বললো, তা হয়। কিন্তু সেসব আর পাচ্ছি কোথায়?

পেতে চাও?

চাইলেই পাওয়া যাবে?

চেয়েই দেখো।

কার কাছে চাইবো?

কেন, পছন্দ হয় না আমাকে?

তোমাকে? পছন্দ না হয়ে উপায় আছে?

তাহলে?

কী বলবে ঋভু? পারুল দারুণ আকর্ষণীয় এক নারী। বয়স সম্ভবত তিরিশ হয়নি বা হয়েছে, ঋভুর চেয়ে বড়জোর সাত-আট বছরের বড়। দীর্ঘাঙ্গী, পূর্ণ যৌবনবতী, দারুণ যৌন-আবেদনময়ী রমণী। ঋভুর কি আর লোভ হয়নি? অবশ্য ‘লোভ’ শব্দটা একটু ইয়ে, কিন্তু নিজের কাছে সে অস্বীকার করে কীভাবে? কতবার ভেবেছে, এরকম একজনকে বিছানায় পেলে …। অবশ্য সত্যি পেলে কী করবে সে, ভেবে উঠতে পারেনি কখনো। কোনো অভিজ্ঞতা নেই যে! আজকে সত্যিই তাকে পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, কী বলা যায় এখন? কী করা যায়?

কী হলো? কিছু বলছো না যে!

ঋভু আনমনে ভাবছিল, এবার চোখ খুলে দেখলো,

পারুলের বুকের ওপর থেকে আঁচল পড়ে গেছে। ব্লাউজ উপচে বেরিয়ে আসতে চাইছে দুটো অবাধ্য স্বাস্থ্যবান কবুতর। নিজেকে সামলাতে কষ্ট হলো ঋভুর, ফিসফিসিয়ে বললো, চাই। তোমাকে আমি চাই।

হাসলো পারুল। আলগোছে আঁচল তুলে নিল বুকের ওপর, বললো – সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আসবো। জেগে থেকো।

অনেক পরে, ঋভুকে যখন পেয়ে বসেছে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াবার নেশা, আর চোখ মেলে মনভরে দেখে যাওয়ার ধ্যানমগ্নতা Ñ মানুষ এবং নিসর্গ উভয়কেই, তার মনে হয়েছে পারুলের ওই আঁচল পড়ে যাওয়ার মুহূর্তটি ছিল তার দেখা শ্রেষ্ঠতম দৃশ্যের একটি। এও মনে হয়েছে, বাঙালি নারীদের বুক থেকে আঁচল খসে পড়ার মতো ইঙ্গিতময়, রহস্যময়, আবেদনময় ব্যাপার আর নেই। কখনোই আঁচল সরবে না তার, কেবল খসে পড়বে সেই পুরুষের সামনে, যাকে সে চায়। অদ্ভুত না?

ঋভু অপেক্ষা করছিল। এমনিতেই জেগে থাকে সে। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস তার নেই। আর আজকে তো বিশেষ ব্যাপার, উত্তেজনায় ছটফট করছে। মনে হচ্ছে, কখন ঘুমাবে সবাই, কখন পারুল আসবে? পারুলের সঙ্গে সে প্রতিদিনই গল্প করতো, এই রুমে যখন-তখন আসতো সে, এমনকি নাঈমভাই থাকতেও আসতো, বসতো, আড্ডা দিতো। তখন কিছু মনে হয়নি, অথচ আজকে বুক দুরুদুরু করছে। মনে হচ্ছে, এই বুঝি কেউ জেগে উঠবে, কেউ দেখে ফেলবে, বুঝে ফেলবে ইত্যাদি। যদিও বাসায় বাবা-মা ছাড়া কেউ নেই, তাদের রুমও বাসার অন্য প্রান্তে, চাচা-চাচি তো বাইরের ঘরে, রাতের বেলায় তার রুমে কারো আসার সম্ভাবনাও নেই, তবু কেমন যেন লাগছে। বাতি নিভিয়ে দরজা ভেজিয়ে রেখেছিল সে। ঘণ্টাখানেক পর এলো পারুল। ভেতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করলো। যদিও বাতি জ¦লছে না, তবু ব্যালকনির আবছা আলোতে তাকে দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। পারুল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো দরজার কাছে, সম্ভবত অন্ধকারটা সইয়ে নিল চোখে। ঋভু নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে হাত ধরলো তার, ফিসফিসিয়ে বললো, এসো।

ঘরের মাঝামাঝি এসে পারুলকে জড়িয়ে ধরলো ঋভু। তারপর আঁচল সরিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিলো ব্লাউজের ভেতরে। সেই তখন থেকে তার হাত অধীর হয়ে ছিল, কিন্তু পারুল বাধা দিলো। বললো, উঁহু, ওভাবে নয়। প্রথমেই বুকে হাত দিতে হয় না।

তাহলে?

চুমু দাও।

ঋভু পাগলের মতো চুমু দিতে লাগলো পারুলের গালে, চিবুকে, গলায় এবং দীর্ঘক্ষণ ধরে ঠোঁটে চেপে রাখলো ঠোঁট। এবার পারুল নিজেই ঋভুর হাত ধরে রাখলো তার বুকের ওপর। কানে কানে বললো, বোতামটা খুলে নাও।

এইভাবে এক এক করে প্রতিটি পর্ব শেখাতে লাগলো পারুল। এমনকি যখন সম্পূর্ণ নিরাভরণ দুজনই, তখনো পারুল তাল হারালো না। যতটুকু না হলে নিজে তৃপ্ত হবে না, ততটুকু করিয়ে নিল। কিন্তু এতকিছু করতে গিয়ে ঋভুর কী যেন হলো, হঠাৎ করেই তার উত্থিত অঙ্গ নুইয়ে পড়লো।

পারুল বললো, ভয় পেয়ো না। ভয়ের কিছু নেই। এরকম সবার হয়। একটু পরই আবার দাঁড়াবে। দেখো।

দাঁড়াচ্ছে না তো!

দাঁড়াবে। সাহস রাখো। নারী-পুরুষের এই সম্পর্ক খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা। দুনিয়ায় সাতশো কোটি মানুষ দেখেও বোঝো না?

পারুলই সাহায্য করলো তাকে। কিছুক্ষণ পর সত্যিই উত্থান ঘটলো তার, সাহস ফিরে এলো। পারুল বললো, দেখেছো, হয়েছে না?

হুম, হয়েছে।

এবার এসো।

প্রথমদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি মিলনটি। দ্বিধা, সংকোচ, ভয়, শরীরের অচেনা-অদ্ভুত সব অনুভূতি মিলিয়ে ঋভু খুব বিহ্বল ছিল। কিন্তু পারুল ছিল তৃপ্ত, আনন্দিত। বলেছিল, তোমার প্রথমদিন তো, তাই একটু নার্ভাস ছিলে। কালকে থেকে সব অন্যরকম হয়ে যাবে, দেখো।

কালকেও হবে?

হবে না কেন? তুমি আনন্দ পাওনি?

এত আনন্দ আমি জীবনে কখনো পাইনি।

তাহলে যতদিন পারি, আমরা পরস্পরকে আনন্দ দেবো। ঠিক আছে?

পারুলের নগ্ন শরীর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঋভু বলেছিল, থ্যাংক ইউ। তুমি সাহস না দিলে আমি পারতামই না।

হেসেছিল পারুল।

পরের এক মাস প্রায় বিরতি ছাড়াই প্রতি রাতে মিলিত হতে লাগলো তারা। ঋভুকে আর নতুন করে শিখিয়ে দিতে হলো না কিছু। নিত্যনতুন কলাকৌশল সে নিজেই আবিষ্কার করতে লাগলো। তীব্র, আবেগমুখর, উচ্ছ্বাসময়, সম্মোহনী এক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে পেরিয়ে গেল সময়। এর অনেক দিন পর মার্কেজের এক সাক্ষাৎকারে ঋভু পড়েছিল, তিনি বলছেন, ‘পৃথিবীতে নপুংসক পুরুষ বলে কিছু নেই, যা আছে তা হলো হৃদয়হীন নারী।’ মানে নারীর সহযোগিতা ছাড়া পুরুষের পক্ষে ‘পুরুষ’ হয়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব, বিশেষ করে যৌনতার ক্ষেত্রে। অন্যদিকে সহযোগিতা পেলে আপাত অপারগ একজন পুরুষও হয়ে উঠতে পারে পৌরুষদীপ্ত।

ঋভুর প্রথম মিলনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল এক অসাধারণ নারীর সহযোগিতা এবং মমতায়। সে ছিল সক্রিয়, উদ্দাম; আনন্দ দিতে এবং পেতে পারঙ্গম। সেই অভিজ্ঞতাই ঋভুর পরবর্তীকালের যৌনজীবন নিয়ন্ত্রণ করেছে। এর দু-বছর পর আরিয়ানার সঙ্গে সেই সপ্তাহখানেকের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাও তারই ফসল। এমনকি, এতকাল পরে আজকে সুসানের সঙ্গে যা হলো তাও ওই পারুলের কাছ থেকেই শেখা। কিন্তু দুঃখ এই যে, রিনির সঙ্গে ওরকম কিছু হলো না। 

ঋভু আর পারুলের এই বিশেষ সম্পর্কটির ব্যাপারটা বাসার কেউ বুঝে ফেলবে কি না, এ নিয়ে ঋভু শঙ্কিত ছিল। কিন্তু পারুল ছিল ভ্রুক্ষেপহীন এবং একরোখা। যেন কিছুই যায়-আসে না তার। সম্ভবত মা কিছু একটা আন্দাজ করেছিলেন। ঋভু একদিন আড়াল থেকে শুনে ফেলেছিল, মা পারুলকে বলছেন, ছেলেটার মাথা একেবারে খেয়ে ফেলো না, বউমা। একটু রয়েসয়ে চলো।

পারুলের উত্তর সে শোনেনি, সম্ভবত কোনো উত্তর দেয়ওনি। তাছাড়া, মায়ের ওই কথাটার মানে কী, তাও বোঝা মুশকিল। তারা তো কাউকে দেখিয়ে কিছু করছে না! মায়ের চোখ, দৃশ্যমান যা কিছু আছে তার চেয়ে বেশি কিছু দেখতে পারে, তবে সেটা আন্দাজই, সত্যি সত্যি কিছু দেখে ফেলার সুযোগ তার ছিল না।

যা হোক, মাসখানেক পর ফের নাঈমভাই এলেন।

যথারীতি ডাক্তারের কাছে গেলেন দুজনেই। ফিরে এসে হাসিমুখে

জানালেন, তিন মাস পর আবার আসতে বলেছেন ডাক্তার। বলেছেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।

যাওয়ার সময় হয়ে এলো তাদের। ঋভুর ভেতরে যেন শোকের ঝড় বইয়ে যেতে লাগলো। কী অপরূপ আনন্দেই না কাটলো পারুলের সঙ্গে এই একটা মাস! এরকম দিন কি আর কখনো আসবে?

যাওয়ার আগের রাতে পারুল এলো ঋভুর রুমে।

ফিসফিসিয়ে বললো, তোমাকে একটা গোপন কথা বলি। এই যে চিকিৎসা করিয়ে গেলাম, এটা একেবারে অহেতুক। আমি অনেক আগে থেকেই জানি, আমার কোনো সমস্যা নেই।

সমস্যা তোমার ভাইয়ের। সে ভালো মানুষ, আমি তাকে ভালোবাসি, সেও আমাকে ভালোবাসে; কিন্তু সে সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম। এটা জেনেও আমি সবরকম চিকিৎসায় রাজি হয়েছি কেবল তার সান্ত্বনার জন্য। কিন্তু এবার আমার অন্য একটা লাভ হয়েছে।

ঋভু দারুণ অবাক হয়ে গিয়েছিল কথাগুলো শুনে। বিস্ময় নিয়েই জিজ্ঞেস করলো, কী লাভ হলো তোমার?

এবার আমি সন্তান গর্ভে ধারণ করেই গেলাম। আমি মা হবো।

মানে? মাথামুণ্ডু কিছু না বুঝে ঋভু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস  করলো।

মানে বোঝো না? লাজুক স্বরে বললো পারুল।

উঁহু, বুঝতে পারছি না।

তোমার সন্তান আমার গর্ভে নিয়ে যাচ্ছি!

বলো কী!

হ্যাঁ, সত্যি।

বুঝলে কী করে?

মেয়েরা অনেক কিছু বোঝে।

কীভাবে বোঝে শুনি?

এ মাসে আমার পিরিয়ড হয়নি।

তাতে কী?

ও তুমি বুঝবে না। এটা একটা লক্ষণ।

তুমি সত্যি তাই মনে করো? গর্ভ ধারণ করেছ?

হ্যাঁ।

দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইলো ঋভু। এরকম একটা বিষয় সামনে চলে আসবে সে ভাবতেই পারেনি। কী করবে সে? কী বলবে? এইরকম মুহূর্তে কী করতে হয়?

ভয় পেয়েছ? রহস্যময় হেসে জিজ্ঞেস করলো পারুল।

না, ভয় নয়; কিন্তু কেমন যেন লাগছে।

ভয়ই, কিংবা দুশ্চিন্তা। শোনো, ভয়ের কিছু নেই। আমি কখনো সন্তানের পিতৃত্বের দাবি নিয়ে তোমার কাছে আসবো না।

ঋভু সে-কথা ভাবেইনি। কিন্তু কথাটা শুনে মনে হলো, পিতৃত্বের দাবিও একটা ব্যাপার। বললো, কিন্তু আমি যদি আমার সন্তানের পিতৃত্বের দাবি নিয়ে তোমার কাছে যাই?

যেয়ো না। হেসে বললো পারুল। যেন খুব মজা পাচ্ছে।

কেন যাবো না?

তোমার সামনে লম্বা জীবন পড়ে আছে। বউ আসবে, বাচ্চাকাচ্চা হবে। তোমার তো এই বাচ্চাটার দরকার হবে না। এটা আমারই থাকুক।

একসঙ্গে তোমার-আমার কাছে নয় কেন?

তাহলে যে আমাকে সব ছেড়ে আসতে হবে।

আসতে আপত্তি আছে?

তা আছে।

কেন?

তোমার ভাইয়ের সংসার ভাঙবে, শ^শুরবাড়ির লোকেরা কষ্ট পাবে, আমার নিজের মা-বাবা-ভাই-বোনেরা অপমানিত হবে, এখানে খালা-খালু আমাকে মেনে নেবেন না, তোমার আত্মীয়-স্বজনরা মানবে না, এমনকি তোমার বন্ধুরাও ছি ছি করবে। দুজনের জীবনই বিষাক্ত হয়ে যাবে। জীবন এমনিতেই জটিল, আরো বেশি জটিলতা ডেকে আনতে চাই না।

পারুলের কথা শুনে ঋভু বুঝে নিল, সে অনেক কিছু ভেবে ফেলেছে ইতোমধ্যে, ঋভু এর বিন্দুবিসর্গও বোঝেনি, ভাবেওনি কিছু। বিমূঢ় লাগছিল তার। পারুলের কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে সে এই বয়সেই বাবা হতে চলেছে। এও সম্ভব? অবশ্য সম্ভব নয়ই বা কেন? গ্রামে তো অল্প বয়সেই বিয়ে করে ছেলেরা, বাবাও হয় অল্প বয়সেই। কিন্তু তার শহুরে মন কিছুতেই হজম করতে পারছিল না ব্যাপারটা। তার বিমূঢ়দশা সম্ভবত বুঝতে পারছিল পারুল, হয়তো সেটি কাটিয়ে দিতেই বললো, কাল তো চলে যাবো। আজকে শেষবারের মতো আদর করবে না?

আজকে? নাঈমভাই বুঝে ফেলবে না?

আরে না। সে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গেছে।

যদি জেগে যায়? যদি মাঝরাতে তোমাকে আদর করতে চায়?

করবে!

তখন বুঝবে না?

আরে না। কোথাও দাগ লেগে থাকে নাকি?

থাকে না?

মনে থাকে, শরীরে থাকে না। আমি একটা বিবাহিতা মেয়ে। সাত বছর ধরে এসব করছি। তুমি কোনো দাগ পেয়েছ? এমন কিছু পেয়েছ যা দেখে বোঝা যায়, কতবার আমি সঙ্গম করেছি?

না, বুঝিনি।

বোঝা যায় না। এসব নিয়ে মানুষ অহেতুক চিন্তা করে মরে। এসো তো তুমি।

ঋভু এবার আর দ্বিধা করলো না। এই শেষ দিনের মিলনটা হলো গভীর আবেশ আর আবেগভরা। আনন্দ ছিল, উচ্ছ্বাস ছিল, উত্তেজনাও ছিল কিন্তু তারচেয়ে বেশি ছিল প্রেম। এই প্রথম তারা অনুভব করে উঠেছিল, কেবল শরীরের জন্য শরীর নয়, তারা পরস্পরকে ভালোবাসে। নিবিড় আলিঙ্গনে সেই ভালোবাসার প্রকাশ ছিল; আর ছিল অশ্রু, পারুলের চোখে।

পরদিন পারুলরা বিদায় নিল। যাওয়ার আগে বারবার ঋভুকে বেড়াতে যাওয়ার কথা বললো দুজনই। ঋভুও কথা দিলো। যদিও আর যাওয়া হয়নি কোনোদিন। তারাও আর আসেনি। তবে নাঈমভাই খবর পাঠিয়েছিলেন, তাঁর একটা ছেলে হয়েছে। শুনে চমকে উঠেছিল ঋভু। এই ছেলে কি সত্যিই তার? তবে এ নিয়ে আর বেশি কিছু ভাবেনি সে। আসলে সন্তান জন্ম দেওয়া, বাবা হওয়া ইত্যাদির মতো জটিল বিষয়-আশয় বোঝার মতো বয়সই ছিল না সেটি। অবশ্য এখনো সে বোঝে না ব্যাপারগুলো। সে তো আর বাবা হতে পারেনি তার পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে। কেন পারেনি, কে জানে! রিনির সঙ্গে তার প্রেম ছিল না। শিশুর জন্মের জন্য নারী-পুরুষের প্রেমের দরকার হয় না, মিলনে তৃপ্তিরও প্রয়োজন পড়ে না, পুরুষের শুক্রাণু নারীর ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করতে পারলেই চলে। তা যেহেতু হয়নি, হয়তো রিনি কোনো জন্ম-নিরোধক ওষুধ-টষুধ খেতো তাকে না জানিয়েই, নইলে তো হয়েই যেত। 

আচ্ছা, আরিয়ানার সঙ্গেও তো বেহিসেবি সঙ্গমে মিলিত হয়েছিল সে, অনেকবার। পারুল যদি গর্ভবতী হতে পারে তাহলে আরিয়ানা হলো না কেন? নাকি, ওটা ওর জন্য নিরাপদ সময় ছিল? প্রকৃতি এক আশ্চর্য খেলা খেলে। সঙ্গম হলেই সন্তান হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। দুজনেই সক্ষম হলেও হবে না। নারীরা মাসের একটা নির্দিষ্ট সময়েই কেবল গর্ভধারণের মতো উর্বরতা পেয়ে যায় প্রকৃতির কাছ থেকে। এই প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা না থাকলে পৃথিবীর জনসংখ্যা আরো কয়েকগুণ বেড়ে যেত হয়তো। কৃত্রিম জন্ম-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তো আবিষ্কারই হলো এই কিছুদিন আগে। তার আগে হাজার হাজার বছর ধরে নারী-পুরুষ মিলিত হয়েছে, অবাধে, হিসাব-নিকাশ ছাড়াই, তবু সবসময় গর্ভবতী হয়নি নারীরা। 

পারুলের কথা ভাবছিল ঋভু অনেকক্ষণ ধরে, তারপর আরিয়ানার কথা। ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠলো সে। নাহ্, আজকে সুসানকে ছেড়ে দেওয়া উচিত হয়নি। কায়দাকানুন করে রেখে দেওয়ার দরকার ছিল। অবশ্য ওর বাসায় এর প্রতিক্রিয়া হতো মারাত্মক। সামাল দেওয়া যেত না।

এখন আর ভালো লাগছে না তার। ঘুমিয়ে পড়তে পারলে বেশ হতো। কিন্তু ঘুমের লেশমাত্র নেই চোখে। কী করা যায়, কী করা যায় ভাবতে ভাবতে ভেতর থেকে শিবাস-রিগ্যালের বোতলটা নিয়ে এলো ঋভু। কালকে তিনজন মিলেও শেষ করতে পারেনি, বেশ অনেকটা রয়ে গেছে। ডিনারের পর ড্রিংক করার মতো বর্বর সে নয়, কখনো করে না, কিন্তু আজকের ব্যাপারটা আলাদা। একা একা খেলো সে অনেকক্ষণ ধরে। একসময় টের পেলো, বেশি হয়ে গেছে, মাথা ঝিমঝিম করছে। উঠে হাঁটতে গিয়ে দেখলো, পা টলছে। নাহ্, আর খাওয়া ঠিক হবে না। এইসময় মোবাইলে মেসেজ নোটিফিকেশন এলো। সুসান। লিখেছে, ঘুমিয়ে পড়েছ?

উঁহু।

আমারও ঘুম আসছে না। কী করছো তুমি?

কিছু না। ব্যালকনিতে বসে আছি।

একটু কথা বলি?

বলো।

ফোন বেজে উঠলো।

হ্যাঁ, বলো। – বললো ঋভু।

ব্যালকনিতে বসে আছো কেন?

রুমে যেতে ভালো লাগছে না। – জড়ানো গলায় বললো সে।

ড্রিংক করছো?

হুঁ। এই একটু।

এত রাতে!

তুমি যাওয়ার পর এত একা লাগছিল! কখনো এরকম হয় না। আজকে সব যেন কেমন কেমন …

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো অবন্তি। তারপর যখন কথা বললো, তার কণ্ঠ শোনালো ভেজা ভেজা। বললো, আমারও একা একা লাগছে। তোমার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে।

হুম।

শোনো, আর খেয়ো না। এখন গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।

আচ্ছা।

তাহলে এখন রুমে যাও।

আমার ঘুম আসে না সুসান।

অমন করে বলো না। ঘুম আসবে। আমি বলছি।

আমার চুলগুলো একটু টেনে দেবে?

আচ্ছা, তুমি শুয়ে পড়ো, মনে করো আমি তোমার পাশে বসে তোমার চুল টেনে দিচ্ছি।

ঋভু ভেতরে গেল না, ব্যালকনির ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। ওপাশ থেকে গুনগুন করে ভেসে এলো সুসানের গান : তন্দ্রাহারা নয়নও আমার এই মাধবী রাতে …

একটু চমকে উঠলো ঋভু। মায়ের খুব পছন্দের গান ছিল এটি, সুসানের তা জানার কথা নয়। নিতান্তই দৈবচয়ন বলাই বাহুল্য, চট করে মনে এসেছে বলে গাইছে। তবু তার মনে হলো, কাছে-পিঠে কোথাও মা দাঁড়িয়ে আছেন, মন দিয়ে শুনছেন সুসানের গান। কত দিনের পুরনো এই গান, তবু পুরনো হয় না কেন? কেন এখনো এমন গভীরভাবে স্নায়ুকে স্পর্শ করে যায়? চোখ বুজে শুনতে শুনতে ঋভুর মনে হচ্ছিল, সুসানের কণ্ঠ যেন পাহাড়ের ওপার থেকে ভেসে আসা ঝরনার ছন্দময় ধ্বনি, কিংবা কোনো প্রান্তরে বসে বাজানো রাখালের বাঁশির মতো দূরাগত এক বিষণ্ন সুর, বিষণ্ন অথচ মায়াবী …

ঘুমিয়ে পড়লো ঋভু।

ঘুম যখন ভাঙলো তখনো বেলা ওঠেনি, তবে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। আকাশে মেঘের আনাগোনা, আলোটা তাই একটু ছায়াছন্ন, তবু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সব। ভোরবেলায়, পৃথিবীর এই জেগে ওঠা দেখতে ভালো লাগে ঋভুর, যদিও সচরাচর দেখার সুযোগ হয় না। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে বেলা উঠে যায়। আজকে একটু অন্যরকম হলো। ঘুম ভেঙেছে সেই স্বপ্নটা দেখে। ছোট্ট একটা মেয়ে, পানিতে ডুবে যাচ্ছে, আবার ভেসে উঠছে, তার হাত দুটো ওপরে তোলা, যখন ভেসে উঠছে তখন সেই হাত নেড়ে চিৎকার করে ডাকছে Ñ ভাইয়া, ভাইয়া, ভাইয়া …। নিয়মিত স্বপ্ন। কেন যে দেখে, আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলো না ঋভু। মন খারাপ হয়ে যায় বলে সে স্বপ্নটা দেখতে চায় না; কিন্তু স্বপ্নের ওপরে তো কারো হাত নেই, নিয়ন্ত্রণ করারও উপায় নেই, বাধ্য হয়ে তাই দেখতেই হয়। কাকে দেখে সে? মেয়েটা কে? নীলু? সাড়ে নয় বছর বয়সে যে পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিল, কেন সে বারবার ফিরে আসে? থাকুক না নিজের মতো। পার্থিব জীবনের ওপারে কিছু আছে কি না ঋভু জানে না। পাপ-পুণ্য, মৃত্যু-পরবর্তী জীবন বা স্বর্গ-নরক নিয়ে সে কখনো কিছু ভাবেনি। তার কাছে পৃথিবীর এই জীবনই সব। এবং এই জীবন খুবই নশ^র, অনিশ্চিত, মৃত্যুতাড়িত। এখানে যেমন মানুষ একশ বছর পর্যন্ত বাঁচে, তেমনি সাড়ে নয় বছর বয়সেও চলে যায়। কোনো নিয়মকানুনের বালাই নেই, কোনো হিসাব-নিকাশ নেই, কোনো ধারাবাহিকতা নেই। সকলেই মুছে যেতে আসে, মুছে যায়, কেউ আগে, কেউ পরে। সকলের নামই জলের অক্ষরে লেখা। মুছে যাবেই। এসব ঋভুর জানা হয়ে গেছে। ‘জীবিতের শোক মৃতরা গ্রহণ করে না, এই দিক থেকে বড় পরাধীনভাবে বেঁচে আছি আমরা’, একজন লেখক বলেছিলেন, মনে পড়লো তার। গ্রহণ করবেই বা কেন? সে তো যাওয়ার আগে জেনেই যায়, তাকে মনে রাখা হবে না, ভুলে যাবে সবাই কারণ বিস্মৃতিই মৌলিক, ভুলে না গেলে স্মৃতির ভারে অচল হয়ে যেত মানুষের জীবন; জেনে যায়, তাকে ছাড়াই পৃথিবীর সবকিছু ঠিকঠাক চলবে।

আসলেই কি চলে? নীলু চলে যাওয়ার পর তাদের জীবন থেমে যায়নি বটে; কিন্তু জীবনের ছন্দটা কি আগের মতো ছিল? বাবা ব্যবসা গুটিয়ে ফেললেন ধীরে ধীরে, হয়ে পড়লেন গৃহবন্দি, সুস্থ-সবল মানুষটা অতিদ্রুত বুড়িয়ে গেলেন, অসুস্থ হতে লাগলেন, আজ এই অসুখ তো কাল ওই অসুখ, তারপর যেন সময় হওয়ার আগেই চলে গেলেন। যাওয়ার জন্য একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন তিনি। নীলুর কথা বলতেন না বটে, কিন্তু ঋভু বুঝতে পারতো, মেয়ের কাছে যাওয়ার জন্যই অত তাড়া তাঁর। গেলেন তো গেলেন, যাওয়ার আগে কী কী করলেন কেউ জানলো না, যাওয়ার পর দেখা গেল টাকাপয়সা ভাগাভাগি করে রেখে গেছেন। কী যে হয়েছিল তার, কোন চিন্তা থেকে এমনটি করেছিলেন, ঋভু আজো জানে না। আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো, মারা যাওয়ার আগে তিনি বলে গিয়েছিলেন, তাঁকে যেন কবর দেওয়া হয় আজিমপুর গোরস্তানে, সাধারণ অস্থায়ী কবরে। অথচ নীলুর কবর তিনি দিয়েছিলেন এই বাড়ির আঙিনায়, দক্ষিণপাশের দেয়াল ঘেঁষে বকুলগাছতলায়। মেয়ের পাশে থাকতে চাইতে পারতেন তিনি, কিংবা গ্রামে নিজেদের পারিবারিক কবরস্থানে, যেখানে তাঁর বাবা-মা আর অন্য আত্মীয়স্বজন ঘুমিয়ে আছেন। চাচারাও চেয়েছিলেন বাবাকে সেখানে নিয়ে যেতে, ঋভু রাজি হয়নি। বাবার নির্দেশ মেনে আজিমপুরেই রেখে এসেছে। অস্থায়ী কবরগুলো থেকে মৃতের দেহাবশেষ তুলে ফেলা হয় কয়েক মাস পরেই, সেখানে কবর দেওয়া হয় সদ্যমৃত অন্য কাউকে। সেও থাকতে পারে না বেশিদিন, নতুন কেউ এসে তাকে সরিয়ে নিজের জায়গা করে নেয় কিছুদিনের জন্য। এইভাবে চলতেই থাকে। কারো কোনো চিহ্ন থাকে না। বাবা যে এটা জানতেন না তা নয়, জেনেশুনেই তিনি সেখানে থাকতে চেয়েছেন। হয়তো নিজেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার একটা ইচ্ছে জেগেছিল তাঁর মধ্যে। অথচ দেখ, নীলু কী সুন্দর ঘুমিয়ে আছে নিজেদের বাড়ির বকুলতলায়, তেত্রিশ বছর ধরে!

অনেকদিন ওর কবরের কাছে যাওয়া হয় না, ইচ্ছে করেই যায় না ঋভু। আজ মনে হলো, যাই একটু দেখে আসি। নিচে নামলো সে। চাচা-চাচি উঠে পড়েছেন। ফজরের নামাজ শেষ করে চাচা হাঁটছেন বাইরে, চাচি কিচেনে। কাউকে কিছু বললো না সে। চাচার সঙ্গে দেখা হলো বাগানে, তিনিও কিছু বললেন না। ধীরপায়ে নীলুর কবরের দিকে এগিয়ে গেল ঋভু। শে^তপাথরে বাঁধানো সুন্দর এক সমাধিসৌধ। মাথার কাছে উৎকীর্ণ সমাধিলিপি, এপিটাফ : ‘অপার নীলিমা, তোমার নাম লেখা হয়েছিল জলের অক্ষরে।’

কী সুন্দর একটা নাম রেখেছিলেন বাবা – অপার নীলিমা! নীলিমা থেকে নীলু। যিনি ছেলের নাম রাখেন পারভেজ মাহমুদ ওরফে ঋভু, তিনি কীভাবে যে মেয়ের ওরকম একটা নামের কথা ভাবেন, কে জানে! সম্ভবত কন্যার জন্য তাঁর একটা বাড়তি আদর ছিল অথচ সেই কন্যাই তাঁকে ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েছিল অতি অল্প বয়সে।

কবরের ওপর আর চারপাশে বকুল ফুল ঝরে পড়ছে। মিষ্টি এক গন্ধে ছেয়ে আছে চারপাশ। যতবার ঋভু এসেছে এখানে, দেখেছে, সবসময়ই পরিছন্ন থাকে জায়গাটা। চাচার কাজ এটা। তেত্রিশ বছর ধরে তিনি আগলে রেখেছেন নীলুর কবর, পরম মমতায় আর যত্নে। কৃতজ্ঞতায় হৃদয় আর্দ্র হয়ে উঠলো ঋভুর। হাঁটু গেড়ে বসলো কবরের পাশে। হাত বাড়িয়ে আদর করে দিতে লাগলো, ঠিক যেন শৈশবের সেই খুকি মেয়েটি। ফিসফিসিয়ে বললো, কেমন আছিস তুই নীলু? মৃত্যুর ওপারে কি কিছু আছে রে? থাকলে সেটা কেমন? বাবা আছে সেখানে? মা? দেখা হয় তোদের? আমাকে রেখে সবাই চলে গেলি। একা একা কেমন আছি আমি, তোদের জানতে ইচ্ছে করে না? আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না? সেই কবে থেকে তোর ছোট্ট শরীরটা কাঁধে নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছি, কিছুতেই নামাতে পারছি না, মনে হচ্ছে, নামিয়ে দিলেই ব্যথা পাবি তুই, কেঁদে উঠবি। আমাকে দিয়ে আর কতকাল এই ভার বইয়ে নিবি? এবার আমাকেও নিয়ে যা তোর কাছে। এখানে থাকতে আমার ভালো লাগে নারে নীলু, একটুও ভালো লাগে না। আমাকে নিয়ে যা তুই, নিয়ে যা…  (চলবে)