জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে

শেষ পর্যন্ত ভাগ্য যেন সহায় হলো অনিমেষের। আগে থেকেই কিছু লোক দাঁড়িয়ে ছিল। অনিমেষ এসেছিল ঘণ্টাখানেক পরে। তার পরও আর কেউ কেউ এসেছে। ভিড়ের মধ্যে কয়েকজন মহিলাও আছে। সবাই লম্বা বোরখায় আবৃত। লঞ্চঘাটে এতগুলো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে সেই কখন থেকে। সবার মুখে চোখে উৎকণ্ঠা, আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। গলায় তেমন জোর নেই। কথাবার্তা হচ্ছে খুবই কম। একটু পরেই ঘাটে একটা একতলা লঞ্চ এসে থামল। নামার যাত্রী নেই বললেই চলে।

শহরে মানুষ আসতেই চায় না। ভয়ে শহর থেকে বরং গ্রামের দিকে পালাচ্ছে।

দক্ষিণাঞ্চলের নদীপথ। মিলিটারিরা নদীপথ ভয় পায়। সড়কপথগুলো খুব ভালো নয়। তাই দেরি হচ্ছে আসতে। নাহলে আরো আগেই এসে যেত।

এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ শুরু হয়েছে। ২৫শে মার্চের ঢাকা ম্যাসাকারের অনেক খবর ইতোমধ্যে সবাই জেনে গেছে।

ঢাকা থেকে সড়কপথে বিভিন্ন স্থানে ছুটছে মিলিটারি কনভয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত অনেক ঘটনা ঘটে গেছে এই শহরে। একটা মানুষকে স্পাই সন্দেহে শত শত মানুষের চোখের সামনে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে।

কদিন আগে ধূসর একটা স্যাবার জেটকে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরতে দেখেছে এই শহরের মানুষ মাথার ওপরের আকাশে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে সেই জেট প্লেন থেকেই হামলা চালানো হয়েছে শহরের ওপরে। সেই থেকে শহরের মানুষ অজানা আতঙ্কে শহর থেকে পালাতে শুরু করেছে। বারবার এদিক-ওদিক থেকে মিলিটারি আসার খবর আসছে।

সবার ধারণা, গুপ্তচর সন্দেহে এই মানুষটাকে গুলি করে মারার জন্যই  মিলিটারি আসছে এত তাড়াতাড়ি। এই ঘটনা না ঘটলে মিলিটারির এখানে আসতে আরো হয়তো দেরি হতো।

দু-তিন দিনের মধ্যে শহর যেন একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল। রাতের বেলা কালো অন্ধকারের চাদর যেন পুরো শহরটাকে ঢেকে দেয়। চারিদিক সুনসান, কোথাও কিছু দেখা যায় না। সব দোকানপাট বন্ধ। বাড়িঘরে মানুষ নেই। রাস্তাঘাট ফাঁকা। দিনের বেলা অতি সামান্য কিছু লোক চলাফেরা করে। সন্ধ্যার পরে আলো থাকে না বলে মানুষ তো দূরের কথা,
কুকুর-বিড়ালও দেখা যায় না কোনো রাস্তায়। চারিদিকে ভুতুড়ে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করে। 

একটা চামড়ার সুটকেস গোছানোই ছিল জামা-কাপড় আর সব মিলিয়ে হাজারখানেক টাকাসহ। সব ঘর দরজা বন্ধ করে
যে-কোনো সময় স্যুটকেসটা নিয়েই যাতে দৌড়ানো যায়, তেমনিভাবে গোছানো ছিল সবকিছু।

২৩ এপ্রিল। অনিমেষ ধরেই নিল, আরো দু-একদিনের মধ্যেই এ-শহর চলে যাবে পাকিস্তানি মিলিটারির দখলে। যদিও শহরতলির এখানে-সেখানে কিছু বয়স্ক মানুষ আর যুবক ট্রেনিং নিচ্ছে। কিন্তু অনিমেষ জানে, এসব কিছুই নয় আধুনিক মারণাস্ত্র হাতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মিলিটারির কাছে। তবু এই চেষ্টাটা ভালো। মনের জোর বাড়ে।

রাতে চারিদিক একেবারে নিস্তব্ধ। যেন কোনো শ্মশানের নৈঃশব্দ্য চারিদিক ছেয়ে আছে আলোহীন এই ভুতুড়ে শহরটাকে। আসলে এইভাবে থাকা যায় না। খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত প্রায় বন্ধ।

অনিমেষ সিদ্ধান্ত নিল, আর দেরি করার কোনো অর্থ হয় না। বাবা, মা, ভাইবোনদের অনেক আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিল বরগুনার প্রত্যন্ত এক গ্রামে। একা থেকে গিয়েছিল শহরে। এবার তারও যাওয়ার পালা, সময় হয়ে গেছে।

বেলা দশটার দিকে লঞ্চঘাটে এসে দেখে সব ফাঁকা। দু-একজন মানুষ এদিক-ওদিক ইতস্তত ঘোরাফেরা করছে তাদের হাতে ঝুলানো লটবহর নিয়ে। ছোট টার্মিনালটা একেবারে ফাঁকা। একটাও লঞ্চ নেই।

সবার মুখে হতাশার ছায়া। কোনো লঞ্চ আসছে না কোনো দিক দিয়ে। নানা ধরনের গুজব শোনা যাচ্ছে বিভিন্নজনের মুখ থেকে। তাতে আতঙ্ক বাড়ছে।

দাঁড়ানো একজন বললেন, সব লঞ্চ নাকি মিলিটারিরা নিয়ে গেছে রিকুইজিশন করে। তবে সারেং-সুকানিরা লঞ্চ ফেলে যে যেমন করে পারে পালিয়ে গেছে নিজেদের ঘরবাড়িতে। এরকম কত কথা। দিনে দিনে গুজবের ডালপালা ছড়াচ্ছে দেশজুড়ে।

দাঁড়ানো মানুষগুলির মনে আশার বাতি জ্বালিয়ে দূরে দেখা গেল ছোট একটা একতলা লঞ্চ ধীরে ধীরে টার্মিনালের দিকে এগিয়ে আসছে। কিছু পরে সাড়ে দশটার দিকে সেটাই এসে টার্মিনালে ভিড়তেই উপস্থিত সবার মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা গেল। সামান্য কয়েকজন পাঞ্জাবি-পায়জামা-টুপি পরা যাত্রী নামলো লঞ্চ থেকে। মাঝখানে দুজন মহিলা নামলো একেবারে আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা। চোখদুটোও যেন ঠিকমতো দেখা যায় না।

টার্মিনালের পর দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর ভাগ্য সহায় হয়েছে বলে মনে হলেও হঠাৎ যেন আবার ঝামেলা বেধে গেল সারেং-সুকানিদের নিয়ে।  তাদের দুজন হঠাৎ বলে উঠলো এখন তারা আর কোথাও যাবে না। হাঁটাপথে পটুয়াখালী আর পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় নিজেদের বাড়িতে যাবে। পথে চলাফেরায় অসুবিধা। যাত্রীবাহী লঞ্চ দেখলে প্লেন থেকে গুলি করতে পারে, এরকম আশঙ্কায় তারাও ভীত। পরিবারের অন্যদের জন্যও তাদের দুশ্চিন্তা আছে।

সবই  সত্যি কথা, তাদেরকে বোঝানো হলো, এই দুশ্চিন্তা তাদের  মতো এখানে যে কজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, তাদের সবার আছে। এছাড়াও তাদেরকে বিভিন্ন ঘটনার কথা বলে আরো বোঝানো হলো যে, শহরের চাইতে ভাটির দিকে এখনো ভয় অনেক কম, কারণ মিলিটারিরা জল-জঙ্গলের মধ্যে আসতে ভয় পায়।

মিলিটারি সাধারণত যেদিকে সড়কপথ বেশি, জলপথে না গিয়ে সেদিকেই যাওয়া-আসা করতে চাইবে।

এইসব বুঝিয়ে-সুজিয়ে, বেশকিছু বেশি টাকা-পয়সা কবুল করে, তাদেরকে শেষ পর্যন্ত লঞ্চ নিয়ে যেতে রাজি করানো হলো। সবাই লঞ্চে ওঠার পর বলা হলো, যাবার সময় যার যেখানে সুবিধা হবে সে সেখানে নেমে যাবে। লঞ্চ থামবে ঝালকাঠি, বেতাগী, আমুয়া, ফুলঝুরিসহ আরো কিছু ঘাটে। আমরা চাইছিলাম, এসব ঘাট থেকে কেউ যদি লঞ্চে উঠে কোথাও যেতে চায়, তাহলে আমরা তাদেরকে সেই সাহায্যটুকু করব, কারণ আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, এরপরে সম্ভবত এইদিকে আর যাত্রীবাহী কোনো লঞ্চ চলাচল করবে না। লঞ্চ চলা শুরু হতেই সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

অনিমেষ যখন নিজেদের স্টেশনে এসে নামলো, তখন একেবারে শেষ বিকেল। বাড়িতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেল। অনেকদিন পরে বাড়িতে আসায় অন্ধকারে দু-দুবার ভুল পথে গিয়ে আবার ফিরে আসার জন্য আধঘণ্টাখানেক সময় বেশি লেগে গেল।

অনিমেষকে হঠাৎ বাড়িতে আসতে দেখে প্রথমে তো সবাই অবাক। তারপর বাবা-মা, ভাইবোনরা সবাই কেঁদে ফেলল। প্রচণ্ড ভয় আর আতঙ্কে ছিল সবাই, অনিমেষ শেষ পর্যন্ত আর ফিরতে পারে কিনা! কেননা, ইতোমধ্যে সত্য-মিথ্যা জড়িয়ে নানা ধরনের গুজবের ডালপালা অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে।

উৎকণ্ঠিত বাবা শহরের সামগ্রিক অবস্থা এখন কেমন জানতে চাইলেন। মিলিটারি কবে আসবে, তাদেরকে প্রতিরোধ করার তেমন কোনো প্রস্তুতি আছে কিনা আর থাকলেও কেমন সে-প্রস্তুতি, সেসব বিষয়েও জানতে চাইলেন। তবে এতদিনেও এই শহরে মিলিটারি আসেনি শুনে কিছুটা অবাক হলেন। অথচ এদিকে ইতোমধ্যে বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে, শহরে মিলিটারি আসার খবর রটে গেছে। বোঝা গেল, সবটাই ছিল গুজব।

অনিমেষ বলল, মিলিটারি এখনো আসেনি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, দু-চার দিনের মধ্যেই আসবে। তবে কীভাবে তারা শহরে উঠবে আর সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণ চালাবে, সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কারণ তাদের বিরুদ্ধে যতটা প্রতিরোধ করা গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে, তা দিয়ে কতক্ষণ তাদেরকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে, সে-সম্পর্কে কেউ কিছু আন্দাজও করতে পারছে না।

খবর ঠিকই এলো পাঁচদিন পরে। অনিমেষ চলে আসার পরে তিন দিনের দিন মিলিটারি ঢুকেছে শহরে। ঢুকেছে তারা জলপথ-স্থলপথ দুদিক দিয়েই। ঢোকার সময় চোখের সামনে যাকে যেখানে পেয়েছে বা দেখেছে গুলি করে মেরে ফেলেছে। যেমন করে মানুষ পাখি শিকার করে, তেমনি করে তারা মানুষ মেরেছে। আসা-যাওয়ার পথের পাশে বেশ কিছু বাড়িতেও গান পাউডার দিয়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য।

দু-তিন দিনের মধ্যেই কাছাকাছি সব শহর আর বন্দরগুলিতে ঢুকে গেল মিলিটারি সড়কপথ ধরে ধরে। জলপথ ব্যবহার করলই না। সব জায়গাতেই চলতে থাকলো নারকীয় তাণ্ডব আর মৃত্যুর উৎসব – খুন, লুটতরাজ আর ধর্ষণ চলতে থাকলো বিরামহীনভাবে। দিগি¦দিক ছুটল মানুষ শুধু জীবন বাঁচাতে।

একাত্তরের এইসব দিন কেমন যেন ঝড়ের মতো চলে যেতে লাগলো মানুষের জীবনকে তছনছ করে দিয়ে। মানুষের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেল। দিনও কাটতে লাগলো আতঙ্কে। ত্রাস আর আহাজারিতে চারিদিকের বাতাস ভারী হয়ে উঠল।

এইরকম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মাঝেও যখন-তখন রাজাকারদের হানা চলতেই থাকলো। কখনো কখনো ডাকাতির নামেও চলতে থাকলো একই ধরনের ঘটনা। ঘরের মেয়ে, বউ-ঝিদের কেউ কেউ আগেভাগে পালাতে না পেরে শিকার হলো ধর্ষণের।

এর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই এলোমেলো হয়ে গেছে সবকিছু। যে-কোনো সময় হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে সব পরিবারের। কারো যেন করার কিছু নেই, অবস্থাটা শেষ পর্যন্ত দাঁড়ালো এরকমই।

 চারিদিকের অবস্থা দেখে অনিমেষ যেন কিছুটা নার্ভাস হয়ে গেল। এখন সে কী করবে, কী করা উচিত, ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। মানুষ যেন আর মানুষ নেই। রূপান্তরিত হয়েছে অন্য কিছুতে। আসলে এখন এমন একটা সময় কাটছে, যখন সমস্ত মানুষ জীবনের ভয় বা আতঙ্কে ভেতরে ভেতরে একা হয়ে যাচ্ছে। কাউকে কেউ বিশ্বাস করছে না। কারো ওপর কেউ আস্থা বা ভরসা রাখতে পারছে না।

বাবা-মা, ভাইবোন বা আত্মীয়স্বজন কারো মুখের দিকে কেউ যেন আর তাকাতে পারছে না। সবার চোখমুখে উৎকণ্ঠা। প্রয়োজন ছাড়া কেউ এখন আর কথাও বলে না।

অনিমেষের এখন নানা চিন্তা। বিশেষ করে কমবয়সী ভাইবোনগুলোর চিন্তাই এখন বেশি ভাবাচ্ছে অনিমেষকে। নানারকম দুশ্চিন্তা পাথর হয়ে চেপে বসে আছে বুকের ভিতরে। যেন শেষ হচ্ছে না দুঃসময়ের কাল। দিনে দিনে আরো বরং প্রলম্বিত হচ্ছে।

ওই রাতে ঘুম হয় না। শেষরাতে ঘুমের বদলে ঝিমুনি আসে। আবার তা ভেঙে যায় দুঃস্বপ্নের  মধ্যে। এভাবেই সবার দিন আর রাতগুলি পার হয়ে যাচ্ছে একটা ঘোরের ভেতর দিয়ে।

বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে অনিমেষের টেনশন অন্য সবার চাইতে বেশি। সে শহুরে ছেলে বলে অনেক জানে, খোঁজ খবর রাখে, সেহেতু সিদ্ধান্ত সে-ই দিতে পারবে, এই ধারণা নিয়ে পাশের বাড়ির অনিমেষের কাকারা আসে তার কাছে।

– এখন কী করবা বলো দেখি, এই দেশে থাকবা, নাকি ভারতে যাবা?

অনিমেষ এ-প্রশ্নের উত্তর চট করে দিতে পারে না। সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেলে এখানে খালি বাড়িতে কিছুই থাকবে না। দুদিনের মধ্যেই টিনের চালসহ কড়ি-বর্গাসহ সব খুলে নিয়ে যাবে রাজাকার আর সুযোগসন্ধানী দুর্বৃত্তের দল। সারা দিনমান তারা ছোট ছোট দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে হিন্দু অধ্যুষিত পাড়াগুলিতে। কারণ তাদের ভয় বেশি।

– কিন্তু কিছু তো একটা করতে হয়। দিন দিন অবস্থা খারাপ হচ্ছে, বিনোদ কাকার গলায় উৎকণ্ঠা ফুটে ওঠে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যা কিছু করা হোক তা তাড়াতাড়ি করতে হবে। যখন-তখন ঘটতে পারে অঘটন।

অনিমেষও বোঝে, এভাবে চলতে পারে না। যখন-তখন অঘটন ঘটাও বিচিত্র কিছু নয়। তাই যা কিছু করার, করতে হবে তাড়াতাড়ি সময় নষ্ট না করে।

এরপরে আরো কয়েকটা দিন চলে যায় সিদ্ধান্তহীনতার কারণে। আসলে এতগুলি মানুষের জীবন নিয়ে নতুন করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যে অতি কঠিন কাজ, সেটা কারো না বোঝার  কথা নয়।

এদিকে কয়েকদিনের মধ্যে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে গেল। এতদিন এ পাড়ায় রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়নি। অন্য  গ্রামের রাজাকাররা দল বেঁধে এই গ্রামে এসে যখন-তখন উৎপাত করত। এখন এখানেই গঠিত হবে রাজাকার বাহিনী। খবরটা পেয়েই অনিমেষ বুঝতে পারল, আর সময় নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সবকিছু গুছিয়ে এখান থেকে পালানোর ব্যবস্থা করতে হবে সবাইকে নিয়ে। কারণ এদের উৎপাত শুরু হলে আর রক্ষা নেই। যেভাবেই হোক ভিটেছাড়া করে ছাড়বে। তাই দু-চার দিনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যা করার করতে হবে। যদিও  ইতোমধ্যে রাতে পাহারা দেওয়ার জন্য পাড়ায় পাড়ায় যুবকরা মিলে দল গঠন করেছে। কিন্তু তাতে কতটা নিরাপত্তা পাওয়া যাবে, সেটা ভাবার বিষয় বইকি।

 ঠিক এই সময় একদিন শেষ রাতের দিকে এলো সালাউদ্দিন আর তৈমুর। সিরাজ শিকদারের সর্বহারা দলের দুই সক্রিয় সদস্য। সালাউদ্দিনকে আগে থেকেই চিনত, তৈমুরকে চিনত না অনিমেষ।

শেষরাতের দিকে একজন এসে খবর দিলো, দুজন মানুষ তাকে খুঁজছে।

– নাম কী?

– জানি না। পরেশ বলল, শহর থিকা আইছে।

– নিয়ে আয়।

এখন আর অত ভয়ডর নেই অনিমেষের। স্নায়ু সব সময়ই টানটান হয়ে আছে। মৃত্যুভয়ও যেন কমে গেছে।

একটু পরেই পরেশের পেছন পেছন চলে এলো সালাহউদ্দিন আর তৈমুর।

– কী খবর সালাহউদ্দিন? অনিমেষ জানতে চাইলে।

– খবর ভালো না। অনিমেষের সামনে বেঞ্চটায় বসতে বসতে বলল সালাহউদ্দিন নামের যুবকটি। পরনে কালো জামা আর হাফ প্যান্ট। সেই জামা-কাপড় থেকে কেমন একট ঘাস, লতাপাতা মেশানো বুনো গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে দূর থেকেও। দুজনার একই পোশাক। তৈমুরকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল মনে হলো।

– আপনার একটা চিঠি আছে।

– চিঠি! অনিমেষ অবাক হয়ে যায়। কে দিয়েছে? কার চিঠি?

হকভাই দিয়েছেন। চিঠিটা অনিমেষের হাতে দিলো সালাহউদ্দিন।

ভেজা ভেজা চার-পাঁচটা ভাজ করা মোচড়ানো চিঠি খুলে অনিমেষ দেখলো  তিন-চার লাইনে হকভাই লিখেছেন, সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হচ্ছে। তুমি কোনো কারণেই শহরে আসবে না। মিলিটারি এখন পাখি শিকার করে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে। এখানে এলে তুমিও পাখি হবে – হকভাই।

– আর কী? অনিমেষ তাকালো সালাহউদ্দিনের দিকে।

– আমাদের অবস্থা খুব খারাপ। ঝালকাঠির ভেতরে কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগানে আমরা অনেকে ছিলাম। কমরেডও ছিলেন। প্রথমদিকে দুই-তিন দিন ঠেকিয়ে দিয়েছিলাম। পরে আর পারিনি। খালের দুই পাশ দিয়ে পেয়ারা গাছগুলি গ্রামের লোক ধরে এনে কেটে সাফ করে ফেলে ভোর থেকে তিন দিক দিয়ে আক্রমণ চালিয়েছে রাজাকারসহ মিলিটারিরা। আমাদের অনেকে মারা গেছে স্পটেই, পালাতেও পারেনি।

– তোমাদের আর্মস কেমন ছিল?

– ভালোই ছিল। পরে গুলি ফুরিয়ে গেছে।

– তারপর?

তারপর আর কী, পালানো ছাড়া পথ ছিল না। যারা বেঁচে ছিল, তারা যে যেদিকে পেরেছে পালিয়েছে।

অনিমেষ অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে  সালাহউদ্দীনের মুখের দিকে।

– রবিউল, মতিন, জাকির, যতীন, রহমান প্রথম আক্রমণের মুখেই শেষ। আর কারো খবর জানি না। আমরা একসঙ্গে ছিলাম সাতজন। একটু পেছনে থাকায় বেঁচে গেছি। তাদের লাশগুলো গাছে ঝুলিয়ে রেখেছে হারামজাদারা।

– কী যে অবস্থা, ভাবা যায় না – অনিমেষ স্বগতোক্তি করে।

– আমরা এর পরের খবর ঠিক জানি না। তারা পশুর চেয়েও অধম কোনো জন্তুর মতো ব্যবহার করেছিল। সেইভাবে আমাদের ছেলেদেরকে দূর থেকে গুলি করে মেরেছে। যাদেরকে নাগালে পেয়েছে তাদেরকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে। সালাহউদ্দিন বলতে থাকে, আমরা কয়েকজন কোনোরকমে জীবন বাঁচিয়ে নাচনাপারার খাল সাঁতরে চলে এলাম এদিকে। এখানে থাকার কোনো উপায় ছিল না। এখন আমাদের সঙ্গে একটা পিস্তলসহ সামান্য কিছু গুলি আর অস্ত্র ছাড়া আর কিছু নেই।

– তারা মানে তোমাদের সঙ্গের আর  যারা আছে তারা এখন কোথায়?

– কাছাকাছি আছে। সবাই একসঙ্গে চলি না, সমস্যা আছে। রাজাকার আছে। নানা ধান্দায় দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়। ধরতে পারলে ছাড়বে না। জেলা পিস কমিটি হয়ে গেছে। সেখান থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রতি গ্রামে রাজাকার বাহিনী গঠনের জন্য। এই গ্রামেও হয়েছে নাকি?

– এখনো হয়নি, বললো অনিমেষ, শুনেছি হবে।

– সাবধানে থাকবেন। আপনি কিন্তু টার্গেটে আছেন।

– জানি। একটু থেমে অন্যমনস্ক কণ্ঠে বলল অনিমেষ, কী করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।

– একটু পানি খাব। সালাহউদ্দিনের গলা শুকনো। দু-মাইলের মতো হেঁটে এসেছি।

অনিমেষ উঠে পানি আনতে ঘরের ভেতরে গেল। এটা অন্য একটা বাড়ি।

 অনিমেষ রাতে নিজেদের বাড়িতে থাকে না। প্রতি রাতে বাড়ি পাল্টায়। কোন দিক দিয়ে কখন কী হয়ে যাবে বলা যায় না।

কিছু পরে ঘরের ভেতর থেকে একবাটি মুড়ি আর এক জগ জল নিয়ে এলো তাদের জন্য। বলল, এখন এখানে এর বেশি কিছু নেই। এ দিয়েই পেট ভরে নাও। আবার কখন খেতে পাবে, কে জানে!

– ঠিক আছে। সালাহউদ্দিন  জলটল খেয়ে একটু সুস্থ হলো যেন। তৈমুর খেলো না কিছুই।

– তোমরা আছো কোথায়? আবার কি দেখা হবে, আসবে এদিকে?

– না, জানি না, ভাগ্যে কী আছে, কে জানে! সালাহউদ্দিন মাথা নিচু করে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বলে, আমাদের বাড়িঘর নেই, সব জ্বালিয়ে দিয়েছে। তার আগে ঘরবাড়ি সব লুটপাট হয়ে গেছে। বাড়িতে যারা ছিল, তারা কে কোথায় কীভাবে আছে, বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে জানি না। খবর পেয়েছি এটুকুই। ওদিকে যেতেও পারছি না।

বলতে বলতে দুচোখ জলে ভরে আসে সালাহউদ্দিনের। একটা উদগত দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখে বুকের ভিতরে।

একটু পরে আবার অনেকটা ফিসফিস করে বলে, তৈমুরের তো কেউ নেই। বড় রাস্তার পাশে বাড়ি ছিল। মিলিটারিরা একবার পথ দিয়ে যাওয়ার সময় থেমে গান পাউডার ছড়িয়ে পুরো বাড়িটা একেবারে ভস্ম করে দিয়েছে। জ্বলন্ত বাড়ির কাছে পিঠে কাউকে যেতে দেয়নি। এর আগে বাড়ির ভেতরে-বাইরে যাদেরকে পেয়েছে সবাইকে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছে। এই খবর পাওয়ার পর তৈমুর অজ্ঞান হয়ে ছিল প্রায় একদিন। সেই ধাক্কা এখনো ঠিক সামলাতে পারেনি। এখনো কেউ কোনো প্রশ্ন করলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, ঠিকভাবে কোনো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারে না।

আধো অন্ধকারের মধ্যে তৈমুরের দিকে অনিমেষ তাকায় এবার ভালো করে। সে যেন অবাক হয়ে দেখছে অনিমেষকে। নিথর নিস্পন্দ বসে আছে তৈমুর যেন মরা মানুষ, ধাক্কা দিলেই পড়ে যাবে। জীবনের অস্তিত্বটুকু ঝুলছে সুতোয়, জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে। অনিমেষের চোখের পলক পড়ে না।