তালজ্ঞান না থাকলে সংগীতজগতে জায়গা পাওয়া মুশকিল। সুর-লয়-তাল সংগীতের কাঠামো। গান-বাজনা পরে। অনেকে জন্মলগ্ন থেকে এগুলো পেয়ে থাকে। এমন ভাগ্যবান না হলে শিখতে হয়। গুরু ধরে। হতে পারে মা-বাবা বা পরিবারের কেউ। তাছাড়া গুরুমশাই। সংগীতেরও আছে হাতেখড়ি। এখানে হাতেখড়ি কণ্ঠ ও যন্ত্রসহযোগে। আর পেছনে থাকে তাল-যন্ত্রটি। যাকে আমরা বাঁয়া-তবলা, মৃদঙ্গ, খঞ্জনি, করতাল, ঢোল ইত্যাদি বলে থাকি। এরা বোল তোলে। যেমন ধা ধিন ধা … না তিন না … বা তেরে কেটে তেকে ধিন … এসব মাত্রার হেরফের।

প্রতি স্বর ক্ষেপণ বা বাজনার টোকা মাত্রানির্ভর। এক মাত্রা, আধামাত্রা ইত্যাদি। এর মধ্যে গাওয়ার সময় আছে ফাঁক। অর্থাৎ মাত্রা হজম করে যাওয়া। পরবর্তী সুরে যাবার ফাঁকে।

 যাক, সংগীতের ব্যাকরণ আমার জ্ঞাতব্য বিষয় নয়। আমার কথা আক্ষরিক অর্থেই তালগাছ নিয়ে। সেটা আমার মামাবাড়ি  ঝামাটিয়াকে কেন্দ্র করে। পশ্চিম, দক্ষিণ, পুব যেদিকে চাই তালগাছ উঁকি মারছে। পশ্চিম আর দক্ষিণ সরাসরি। পুবদিকে একটি পুকুর পার হয়ে। বাড়ির পুবদিকে নানার বড়ভাই, যিনি নানার বাবা শেখ আবদুল জব্বার সাহেবের পালক পুত্র, বাস করতেন। মামাবাড়ির তিনতলা বাড়ির পুবদিকের অংশীদার তিনি। বাড়ির পাশেই এই নানা বেশ কয়েকটা নারকেল গাছ লাগিয়েছিলেন লাইন ধরে Ñ সেই গাছ যৌবন লাভ করে তিনতলার ছাদ ছুঁইছুঁই করছিল। তাই ওদিকটা বেচারী চাল তাল ঠুকে দাঁড়াতে পারেনি। তবে নারকেলের মধ্যে একটা গাছ সদর্পে প্রহরীর মতো দণ্ডায়মান। এই পুকুরের নাম বড়পুকুর। অন্যান্য পুকুরের চেয়ে বড় আর জল স্বচ্ছ। পুকুরের পুবপাড়ে তালের সার Ñ সকালবেলা ছায়া পড়ে, কী অপূর্ব শ্রী ধরে স্থির। এদিকে কোনো ঘাট নেই। পুবের সকাল বাধাহীন। এর দক্ষিণে একটা ছোট বাঁশঝাড়। বেশ হালকা। নিচে অন্ধকার বাসা বাঁধেনি। শুকনো পাতা তলায় পড়ে থাকে। কদিন পর বুধি বা হামিদা ঝাঁট দিয়ে নিয়ে যাবে জানুন হিসেবে। জানুন মানে জ্বালানি Ñ এটি ঝামটের গ্রামীণ উচ্চারণ। ঝামটিয়া গ্রাম সংক্ষেপে হয়ে গেছে ঝামটে বা অনেকে আরো বেঁকিয়ে বলে ঝেমটে।

এই ঝামটিয়া নামের উৎপত্তির সূত্র জানার অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু সত্যিটা অজানা থেকে গেছে। আমার এক মামা নাম আবদুল দেইয়ান, তিনি আল-বারাকা ব্যাংকের ঢাকা কলেজের উল্টোদিকের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এম.এ., সুতরাং তাঁর কাছে ইতিহাস জানতে চাই। তিনি কয়েকটি যুক্তি দাঁড় করিয়েও স্থির হতে পারেননি। মামা লম্বা, পাতলা, ফর্সা চেহারার, খুব মিষ্টভাষী আর আমাকে ও বাবাকে (সাহিত্যিক শওকত ওসমান) অনেক ভালোবাসতেন। বাবার অনেক অজানা কাহিনি তাঁর কাছ থেকে জানতে পারি। যদিও তিনি বাবার চেয়ে অনেক ছোট, কিন্তু শালা-দুলাভাই, তাই খুব মধুর ছিল তাঁদের সম্পর্ক। আমাকে দেইয়ান মামা খুব স্নেহ করতেন। দেখা হলেই, মামু, আছো কেমন? ছোটবেলায় মামার সঙ্গে কড়ে ডাং খেলেছি (ডাংগুলি) Ñ বলতে গেলে খেলার সাথি, তাই খুব আদর করতেন। অফিসে গেলেই প্রথম কথা, মামু, কী খাবে বলো? তাঁর ঢাকার ইস্পাহানি কলোনির ফ্ল্যাটে গেলে মামিও ব্যস্ত হয়ে পড়তেন ভাগনের খাতিরদারিতে। মামির বাবার বাড়ি বি.এন.আর-এর বাগনান স্টেশন। মামি জমিদারবাড়ির মেয়ে। তাঁরা দুটি খুব ভালো জুটি। মামি ফর্সা, লম্বা … এককথায় সুন্দরী। মামার চয়েস ভালো। সম্প্রতি মামা আমাদের ছেড়ে গেছেন। তাঁর দু-মেয়ে খুব উচ্চশিক্ষিত। প্রায়ই বিদেশে থাকে।

আমার মামাবাড়ির সদর দরজা পশ্চিমদিকে। পাকা বাঁধানো সিঁড়ি ভিটে পর্যন্ত। আর একটা দরজা দক্ষিণে। পুরো বাকুল বা উঠোন ঘর দিয়ে ঘেরা। বারান্দা লাগোয়া পশ্চিমে একটা চালা। টালির ছাউনি। পশ্চিমে পাকা দেয়াল, সুতরাং ওদিক বন্ধ। এই চালায় থাকত সংসারের পরিত্যক্ত জিনিসপত্র ও জ্বালানি। কাঠ চেরাই লাকড়ি থেকে শুরু করে তালের পাতা কেটে রাখা। অনেক থাকত ঘুঁটে। আর ভাঙা সব জিনিস। এখানে বাইরে যাওয়ার একটা দরজা ছিল। এরপর ছিল ধান রাখার পাকা গোলাঘর। তার সঙ্গে লাগানো দক্ষিণে রান্নাঘর। রান্নাঘরের পাশে আর একটা দরজা। এটা দক্ষিণ দরজা। উঠোন বা বাকুলটা বেশ সুরক্ষিত। রাতে দুটি দরজা খিল দিয়ে রাখা হতো। বাড়িতে প্রবেশ করা কষ্টকর। যদিও এ-গ্রামে চুরি-চামারি বলতে কিছুই ছিল না। তবু ধনীদের সাবধানতা তো থাকবেই। পৃথিবীতে ধনী-গরিব যত দিন থাকবে তার জীবনধারা হবে এমনই। গরিব নিশ্চিন্তে ঘুমোয়। দরিদ্রের শেকল ছাড়া হারানোর আর কিছু নেই। মহাজন-বাক্য। বিশ্বজুড়ে। আজও এ-তথ্যের তারতম্য ঘটেনি। মানুষ প্রযুক্তিগত দিক থেকে অগ্রসর হলেও তার অন্তর্লীন লোভ-লালসা মানুষকে আদিম মনোবৃত্তিতেই রেখে দিয়েছে। এটা শুধু আমার চিন্তা নয়, প্রতিধ্বনি পাই সমবয়সী এক জাপানি সেনসের চিন্তায়। এই অধ্যাপকের উক্তি : পৃথিবীর অনেক কিছু বদলেছে, কিন্তু মানুষ বদলায়নি।

জাপানি অধ্যাপকের কথা মনে পড়লে মনে হয়, তাঁদের রাষ্ট্রের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যোগ দেওয়ার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু রাজা হিরোহিতের মনে হয়তো ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারত অধিকারের চিন্তার উদ্গম ঘটে। নেতাজিকে তাঁরা হয়তো এজেন্ট হিসেবে গণ্য করেছিলেন। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে চাওয়া। ইংরেজ চলে গেলে তারা শাসনভার গ্রহণ করতে পারত। রাজনীতি বড় জটিল জাল। জাপানিরা ভারত দখল করতে পারলে নেতাজি সুভাষকে হয়তো বলতো : তালগাছটা আমার।

ভাদ্র মাস তালের মাস। ভাদুরে গরম। গ্রামের লোকে বলে : তালপাকা গরম পড়েছে। এই সময় তালের পাতার পাখাও ভালো বিক্রি হয়। সব মেলাতেই তালপাতার পাখা বেচাকেনা স্বাভাবিক ঘটনা।

মামাবাড়ির পশ্চিমের সিঁড়ি ধরে নামলেই ডানে পড়ত লুৎফর নানার ভিটেয় ওঠার রাস্তা। আর এর পাড়ে ছিল লাইন ধরে চার-চারটে তালগাছ। সবই এক উচ্চতার। মনে হয় লাগানো হয়েছিল একসঙ্গে। এই তালের সারির পাশে ছোট একটা ডোবা। ভিটের ঢাল ডোবায় গিয়ে মিশেছে। এখানে দুটো কুলগাছ ছিল। একটা বেশ বড়। মোটা ও ঝাঁকড়া। আর একটা নতুন এবং অল্পবয়সী। আর কুলটাও উত্তম। নারকোলি। খেতে খুব ভালো। নারকোলের গন্ধ পাওয়া যেত। রসাল এবং মিষ্টি। গাছটা পূর্ণবয়স্ক নয় বলে সরু। ধরে ঝাঁকানি দেওয়া যায়। আমরা দু-ভাই … আমি আর আমার পিঠেপিঠি ছোট মুজিবরের সঙ্গে দুজন মিলে ঝাঁকানি দিতাম। তাতেই পাকা কুলগুলো টুপটাপ করতে থাকত। কিন্তু ল্যাঠা হলো, এ-ব্যাটাদের ধরা যায় না। গড়িয়ে গিয়ে পড়ত ডোবার জলে। খুব তাড়াতাড়ি জলের কিনারে হাতড়ে হাতড়ে কুল সংগ্রহ করতে হতো। ওদিকে গাছের ঝাঁকানির শব্দ নানা বা নানির কানে চলে গেছে। তারা কে রে কে রে … করে … তেড়ে আসার আগেই আমাদের যা পাওয়া তাই সংগ্রহ করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিঠটান দিতে হতো। আধেকের বেশি কুল জলে পড়ে থাকত। পরে ধাক্কা সামাল নিয়ে আবার যেতাম। শুধু ডোবায় ডুবে যাওয়া কুলের কূল-কিনারা করতে। বেশি পাকাগুলো আবার নিজে নিজে ভেসে উঠত। প্রথমে নিঃশব্দে সেগুলি সংগ্রহ। পরে জলের তলায় হাতড়ানো। খুব দ্রুত হাত চালাতে হতো। দেখে ফেললে যাবে নালিশ। আর তখন মা করবেন পালিশ। বাবা ঝামটিয়ায় কালেভদ্রে আসতেন। থাকতেন খুব জোর সপ্তাহখানেক। তাই মা একাই দশভুজা। তিনি বাবার জায়গাও দখল করে রেখেছেন। একাই দুর্গা – একাই শিব। বাবা থাকলে বরং সুবিধে হতো। তিনি শিক্ষক এবং লেখক মানুষ। কবিও। প্রথমে কবিতা দিয়ে সাহিত্য শুরু করেন বলে গ্রামের লোক তাঁকে কবি সাহেব বলে ডাকত। বাবা আমাদের অন্যায়কে বয়সের ধর্ম বলে হেসে উড়িয়ে দিতেন। তাতে আরো বাড়ত মায়ের রাগ। আর বাবার অনুপস্থিতিতে সুদে-আসলে উসুল করতেন। তখন আমাদের ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচির পালা। বাড়িতে কেনা তালপাখাগুলি তাড়াতাড়ি নষ্ট হওয়ার কারণ আমাদের পিঠ আর মায়ের হস্তচালনা। পুরনো পাখা ফেলে দেওয়া হতো না। ওটা যত্ন করে মা রেখে দিতেন। নতুন পাখা যাতে নষ্ট না হয়।

নানিদের পুকুর তিনটে। একটা ভিটের পশ্চিমে। অন্যটা দক্ষিণ দিকে সামান্য কয়েকশো হাত দূরে। এটার চারদিক বাঁধ দিয়ে বাঁধানো। আর মোটা তারের জাল-ঘেরা। কোনো গরু-ছাগল ঢুকলে তার আর রক্ষে নেই। আমরা দু-ভাই Ñ মুজিবর তখন বেশ বেড়ে উঠেছে। হাতে তালের ডাঁটা নিয়ে পিছু ছুট। আর  নাগালে পেলে ফটাস … ফটাস … আগল বা দরজা বা টাঁটি বন্ধ। বাছাধনদের পালানোর সব রাস্তা বন্ধ। আমরা পিটতে পিটতে হালকা হয়ে গেলে টাঁটি খুলে বের করে দিতাম। ততক্ষণে ওরা বাহ্য করে ফেলেছে। আর আমাদের মুখের হাসি দেখে কে।

বাগানে ঢোকার প্রধান কারণ চারদিকে কলাগাছ লাগানো। কলাগাছ গরু-ছাগলের খুব প্রিয় খাদ্য। সুতরাং দরজা খোলা পেলেই ওরা ঢুকে পড়ত। আর আমাদের হাতে পড়ে মালির সেই পিটনিগুলা তারা কখনো ভুলতে পারত না। আমার ছোট নানি আম্পা বেগম প্রায় নানিকে বলতেন, তুমি বড়বু ভালো দুজন পাহারাদার পেয়েছ। তোমার বড় আর মেজ নাতির জন্যে গরু-ছাগলে আর ওদিকে মাড়ায় না।

দুই জা হাসি-ঠাট্টা করত।

নানি বলত, দোয়া করো বোন, ওরা যেন সহি-সালামতে থাকে।

নানিদের বাড়িতে দশ বছর বয়সটা একটা অভিশাপের মতো। আমার বড়খালা আমেনা খাতুনের প্রথম সন্তান শেখ জাহিদুল হোসেন দশ বছর বয়সে টিটেনাসে মারা যায়। আমার একমাত্র মামা শেখ আবদুল করিমের বড় ছেলে শেখ বজলুল করিমও দশ বছরে মৃত্যুবরণ করে। টাইফয়েডে। তখন টাইফয়েডের কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। আমি আমার মা-বাবার প্রথম সন্তান। ছ-সাত বছর পার করেছি। দশ বছর এগিয়ে আসছে। তাই এখন থেকেই আমার জন্যে সবার একটা চিন্তা। অলীক হলেও চিন্তাটা অভিভাবকদের মনে ছায়া ফেলত। বিশেষ করে মা-খালা-নানিদের মহলে। এরা নামাজ পড়ে সবার জন্যে দোয়া চাইত। বিশেষ করে আমার দশ বছর যেন ভালোয় ভালোয় পার হয়ে যায়।

নানিদের ছোট পুকুরটা কলাগাছ আর কিছু বাবলাগাছ ঘেরা। আর একটা ছিল খেজুরগাছ, এটা নুয়ে পুকুরের ওপর ঝুলেছিল। পাকা খেজুর পড়লে স্নানের সময় আমরা হাতড়ে হাতড়ে খেজুর বের করতাম। একে পাকা, তার ওপর জলে ডুবে খেজুরগুলি খুব ফুলে যেত। কোনো কোনোটা বেশিক্ষণ থাকায় একটু গন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু আমাদের কাছে তা-ই ছিল অমৃত।

এই পুকুরটার জল তেমন স্বচ্ছ ছিল না। অথচ পাশেই নানার বোন নজিমন নানির পুকুরটার জল ছিল কাকচক্ষুর মতো। টলটলে। বাঁধানো ঘাট। রেড-অক্সাইডে পালিশ করা। দু-পাশে বাঁকান হেলান দেওয়া বসার আসন। সিঁড়ির দু-পাশ বাঁধানো। জলের নিচে চাতাল পাকা। জলের নিচে ছিল চাতাল Ñ সবুজ শ্যাওলা ভরা। আমরা বিকেলের ছায়ায় সিঁড়িতে কুচোচিংড়ি দেখতে পেতাম। এই ছোট চিংড়িকে হাওড়া-হুগলিতে বলত ঘুঁসোমাছ। যেমন বাংলাদেশের টাকি মাছ, পশ্চিমবঙ্গে গোড়ুই মাছ। এরকম নামের অনেক হেরফের আছে দু-বাংলায়। তাই ঘটি-বাঙাল দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো। সেটা আরো বাড়ে কলকাতা মহানগর সৃষ্টির পর। কলকাতার আঞ্চলিক বাংলা যদিও প্রমিত বাংলা নয় Ñ তবু অনেক কাব্য-ভাষা সাহিত্যে স্থানপ্রাপ্ত। যেমন গড়ের মাঠ। আসল প্রমিত বাংলা হলো নদিয়া-কৃষ্ণনগর। যার একটি অংশ বাংলাদেশের : যা কুষ্টিয়া মহকুমা থেকে জেলা। ১৯৮৩ সালে এই জেলা ভেঙে আরো জেলা বর্তমানে যেমন : কুষ্টিয়া সদর, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর।

নৃতাত্ত্বিকদের মতে, প্রায় প্রতি দশ-বারো মাইল পার হলেই আঞ্চলিক কথার বদল ঘটে। এটা অবশ্য একটা গড় হিসাব। হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। উদাহরণত   দিনাজপুর সর্ব উত্তরের জেলা অথচ ওখানকার কথ্যভাষা বেশ সুন্দর। এদিকে নোয়াখালির ভাষা দারুণ রকম পৃথক। সিলেট-চট্টগ্রামকে বাদ দিচ্ছি। কারণ এই বৃহত্তর দুই জেলা একেবারেই ভিন্নধর্মী। সিলেট ছিল আসামের অংশ। ১৯৪৭ সালে তারা গণভোট গ্রহণ করে বাংলায় যোগ দেয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। বাংলার পুরনো মানচিত্রে সিলেটের কোনো অবস্থান ছিল না। সিলেটের লোকেরা অ-সিলেটিদের আঞ্চলিক কথায় বলে ‘বেঙ্গলি’। উনি একজন বেঙ্গলি … এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।

বড়পুকুর আর ছোটপুকুরের মাঝে বেশ কয়েকটা তালগাছ ছিল। ছিল দুটো ছোটখাটো বাঁশঝাড়। পাশে অনেকটা ফাঁকা জায়গা বলে দক্ষিণপাড়ার পেছনের বাগদি ছেলেদের এখানে খেলার জায়গা ছিল। এটাই ঝামটিয়ার স্টেডিয়াম। পাশে একটা ঢিবি। এর তিন পাশে তিনটে তালগাছ দাদরা তালে বিন্যস্ত। ঢিবি শেষ হলো তো পুবদিকে আরো একজোড়া তালগাছ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। অবশ্য শোয়া তালগাছ বেশির ভাগ ঘাটের সিঁড়িতে ব্যবহৃত। আর মৃত অথচ চলন্ত তালগাছ হলো ডোঙা বা ডিঙ্গি। পানসি নৌকার পরই এর অবস্থান। মানুষের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। কত কিছু না উদ্ভাবন করেছে। স্রষ্টা বা   প্রকৃতি এভাবে তাকে অন্যান্য প্রাণিকুল থেকে করেছে পৃথক। যাকে আমরা নাম দিয়েছি হোমো-স্যাপিয়েন্স। নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এই উদ্ভাবন ও শক্তির উদ্ভব। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক আরনল্ড টয়েনবি তাই মানুষ সম্বন্ধে বলেছেন : চ্যালেঞ্জ অ্যান্ড রেসপন্স। সামনের বাধা মানুষ গ্রহণ করেছে এবং সাড়া দিয়ে সেই বাধা অতিক্রম করেছে। না দমে। হাল না ছেড়ে। গীতার কর্মবাদ মানুষের সারা জীবন জুড়ে বিদ্যমান। এমন মহৎ বাণী বিশ্বে দুটি আর নেই। ফলের চিন্তা করো না, কাজ করে যাও।

তালগাছের কথা বলতে গিয়ে যতেমামার কথা মনে পড়ল। মামাবাড়িতে সব সময়ের জন্যে হাজিরা দিত মানিকমামা। মানিকচন্দ্র ধাড়া। আর মামি সুধামুখীও ছিল বাঁধা। তাদের মেজ ছেলে হারণচন্দ্র ধাড়াও ছিল কিশোর শ্রমিক। আমার চেয়ে তিন-চার বছরের বড়। বেশ সপ্রতিভ। তবে পাঠশালার দিকে পা বাড়ায়নি। অবশ্য মানিকমামাও ছিলেন সেই দলে।

মানিকমামার পর যিনি নিয়মিত বেড়ার কাজে নিয়োজিত হতেন তিনি ছিলেন যতীন্দ্রচন্দ্র বাগ। সংক্ষেপে যতেবাগ। মাঝবয়সী এই মামা ঘর-ছাউনি ও বেড়ার কাজ খুব ভালো করতেন। আর চাষবাস তো ছিলই। রান্নাঘরের পাশে ছিল গোয়ালঘর। রান্নাঘরের দক্ষিণের জানালা ছেড়ে তার পাশে। গোয়ালঘরের বেড়া ঠিক করতে যতেমামাকে একদিন সকালে ডাকা হয়।

যতেমামা ছোটখাটো গোলগাল ফর্সা চেহারার মানুষ। সদা হাসিখুশি। আর আসর জমিয়ে রাখার মানুষ। আমরা কেন গ্রামের সবাই তাঁকে খুব পছন্দ করত। যতেমামা নন্দদুলালের মতো নাচেও পারদর্শী। কথায় কথায় হাসুগানের ঢঙে নাচ জুড়ে দিতেন।

একদিন বাঁশ ফেঁড়ে বাখারি তৈরি করতে লাগলেন। সঙ্গে একটা হুঁকো আছে। মাঝে মাঝে কলকে ধরনের ফাঁক। দু-চার টান দিয়ে আবার কাজে। একাই কাজ করছেন, কোনো সাহায্যকারী নেই। কাজটা আসলে খুব সহজ-সরল। একাই চলবে। তো একদিন সকালে আমি আর আমার মেজভাই মুজিবর মামার সঙ্গে খুনসুটি করছি।

মামা হুঁকোয় কয়েকটা রামটান দিয়ে হাসতে হাসতে এলেন। তারপর নাচ শুরু। আর মুখে হাসি। তিনি বলতে শুরু করেন :

আল্লা, আল্লা, করি রে ভাই

আল্লা নেইকো ঘরে,

তারপর হঠাৎ জিভ কেটে নাচ থামিয়ে দিলেন। বললেন, মামারা বাকিটা ভুলে গেছি।

আমরা মহাফাঁপরে পড়লাম। কি ভুলে গেছেন!

বলি, মনে করার চেষ্টা করুন।

নাহ! কিছুতে মনে আসছে না। ঠিক আছে পরে মনে পড়লে বলব। বলে কাজে লেগে গেলেন।

আমরা দু-ভাই ‘আল্লা আল্লা করি রে ভাই, আল্লা নেইকো ঘরে …’ বলতে বলতে ঘরে ঢুকি।

নানি বললেন, কি আল্লা আল্লা করছ তোমরা?

আমরা যতেমামার পুরো কাহিনি বললাম। নানি হাসতে হাসতে বললেন, ওই ফোক্কড়টা না! ওর কথা শুনতে হবে না, তোমরা যাও।

আমাদের মনে হলো, ছড়ার বাকি অংশ নানি জানেন, কিন্তু আমাদের বললেন না।

আমরা চলে গেলাম। কিন্তু সারাদিন মাথায় ‘আল্লা আল্লা করি রে ভাই, আল্লা নেইকো ঘরে …’ ঘুরপাক খেতে থাকে।

এর দিন পনেরো পর।

একদিন সকালে উঠে শুনি গতরাতে যতেমামা তালগাছ থেকে পড়ে পা ভেঙে ফেলেছেন।

কথাটা শুনে আমাদের খুব খারাপ লাগল। হাসিখুশি যতেমামা আমাদের খুব প্রিয় … তার পা ভেঙে গেল! কী করে কাজ করবে! মনটা খারাপ হয়ে যায়।

নানিকে বলি, নানি, কোন তালগাছে উঠেছিল? আর পড়লই বা কি করে?

নানি বেশ রাগতস্বরে বলেন, আমাদের দক্ষিণের জমিতে আলে যেসব তালগাছ আছে তার বেশ কটাতে তাল ধরেছে। এখন কাঁচা তাল খাবার উপযুক্ত হয়েছে। আঁধার রাতে যোতে তালগাছে উঠে কাঁদিতে কোপ দিয়েছে আর তালের কাঁদি পড়েছে জাঙ্গের ওপর। ব্যাস, তাল আর যোতে দুজনই মাটিতে। আল্লা আল্লা করছিল না, আল্লা ঠিকই শাস্তি দিয়েছেন। চুরি করতে যাওয়া! আরে বাবা আমাকে বললেই তো পারতিস! দাঁড়িয়ে থেকে তাল পাড়তোম Ñ ওকেও এককাঁদি দিতাম। এখন আল্লার বিচার হয়েছে। নানির স্বর বেশ রাগত। সাধারণত নানিকে রাগতে দেখি না। বরং মা-র কথা শুনে চুপ করে থাকে। কোনো জবাব দেন না।

পরে যতেমামার পা সেরে যায়। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতেন। আমাদের সঙ্গে দেখা হলে সেই আগের যতেমামার অমলিন হাসি দেখতে পেতাম।

কী ভাগ্নে, কেমন আছো?

ভালো মামা। তোমার পা ঠিক হয়েছে!

হ্যাঁ। ভগবানের আশীর্বাদে সেরে উঠেছি।

যতেমামার এই কাহিনি আমার মনে এখনো লেপ্টে আছে। ভুলতে পারি না। তাঁরা ভিটেতে গাদাগাদি করে থাকেন। কোনো ফাঁক নেই যে দুটো গাছ লাগাবেন। মাঠে চাষ করার সময় চোখের ওপর ড্যাবড্যাব করে তালগুলি রোজ চেয়ে থাকে। লোভ সামলাতে পারেননি। তাই এ-বিপর্যয়। এদেশে চেয়ে কারো কাছ থেকে কিছু পাওয়া যায় না। যার যত বেশি সে ততো আঁটোসাঁটো। বরং যাদের কম আছে তারা কিছু দেয়।

এই পুবদিকে বড়খাল থেকে একটা সরু সোঁতা বেরিয়ে এসেছে। জোয়ার বড় হলে জল ওঠে। এই সোঁতার এপারে ঝামটিয়া, ওপাশে গ্রাম খাজুরদহ। সোঁতার দুপারে তালগাছের সার। এরা যেন সীমান্ত-প্রহরী। এই সোঁতাটা একেবারে কোম্পানি পুকুরের কাছ পর্যন্ত গেছে। বাঁশের দুটো ছোটখাটো সাঁকো আছে পারাপারের জন্যে।

এদিকে বড়খালের কাছাকাছি একটা ঢিবি আছে। নাম করিমুল্লাহর ঢিবি। এ-পাড়ার কোনো এক আত্মীয় মাটি ফেলেছিলেন ঘর তৈরি করবেন বলে। সম্ভবত তিনি গত হন তাই আর বাড়ি তৈরি হয়নি। কিন্তু কচ্ছপের পিঠের মতো খালধারে ভিটেটা তাঁর স্মৃতি বহন করে চলেছে। মূককীটের মতো মহাকাল সবকিছুকে উদরপূর্তি করে চলেছে, যা আর কখনো উগরে দেবে না।

দক্ষিণপাড়ায় তালগাছ বেড়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছে – কারণ এখানে বসতি কম। উত্তরে ঘনবসতি, ফলে তালগাছ ঠাঁই পায়নি।

তাল নিয়ে একটি ঘটনা আমার খুব মনে পড়ে। মামাবাড়ির  পশ্চিমের সদর সিঁড়ি বেয়ে নামলেই লুৎফর নানার চার-পাঁচটা গাছ ছিল। আগেই বলেছি।

একবার তখন আশ্বিন মাস। দ্বিতীয়বার বান এসেছে। প্রায় দুদিন কেটে গেছে। পাকা তাল পড়লেই টুব করে জোরে আওয়াজ হয়। লুথু নানার দুটো গাছ তালে ভরা। বানের জল হাঁটু পর্যন্ত ডোবে। সুতরাং বাঁধ ধরে হাঁটতে কষ্ট হয় না। তবে পা টেনে টেনে চলতে হয়। ছপাং ছপাং করে যাওয়া যায় না।

বিকেলে বানের জলে পা ডুবিয়ে বানের স্রোত দেখছি। আর মাপ করছি বাড়ছে না কমছে। এটা করি কাঠি পুঁতে। ওটা ডুবে যায়, না আরো জেগে ওঠে তা ধরেই হিসাব করি কতটুকু বাড়ল-কমল।

এই সময় টুব করে একটা জোর আওয়াজ। এ-আওয়াজ সবার চেনা। পাকা তাল পড়েছে। এটা পড়েছে লুথু নানার একটা গাছ থেকে। সঙ্গে সঙ্গে আমার পা ওদিকে বাড়িয়ে দিয়েছি। জল-কাদা ভেঙে তালটা কুড়োতে যাচ্ছি Ñ এমন সময় ঘটল এক অবাক করা ঘটনা। কে রে … কে রে … চিৎকার করতে করতে নানি শাড়ি ডুবিয়েই ভিটে থেকে তেড়ে আসছেন। এদিকে সিঁড়িতে আমার নানি দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি ডাক দিলেন, তাল ফেলে চট করে চলে এসো।

লুথু-নানি এমনটা করতে পারেন তা আমার কল্পনাতেই কখনো ঠাঁই পায়নি। অথচ ব্যাপারটা ঘটল।

আমি দ্রুত পা চালিয়ে সিঁড়িতে উঠি। নানি হাসতে হাসতে বললেন, ওদিকে কখনো কিছু আনতে যেও না। তোমার নানির মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কখন কী করে বসে কেউ বলতে পারে না।

আমি ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝলাম। নানি যে মানসিকভাবে অসুস্থ তা আমার জানা ছিল না। দেখি শাড়ি ডুবিয়ে ভেসে থাকা তালটা কুড়িয়ে নিয়ে ভিটেয় উঠে যাচ্ছেন।

লিচুচোর মালির অনেক কিলঘুসি খেয়েছিল। আমার কপালেও তা বরাদ্দ ছিল। শুধু সময়মতো দে হাওয়া চাগিয়ে কাপড় করতে পারায় বেঁচে গেছি।

খাজুরদহে আমার বড় খালার শ্বশুরবাড়িতেও তালগাছ ভরা। তাদের বড়পুকুর পাড়ে ঢ্যাঙা ঢ্যাঙা সব অনেকদিনের পুরনো তালগাছ শোভা পাচ্ছে। খালার বাড়ি গেলেই এই পুকুরপাড়ে তালগাছগুলো আমাকে খুব টানত।

তালগাছ শুকনো জায়গা পছন্দ করে। তাই পশ্চিমবঙ্গ-উত্তরবঙ্গ জুড়ে এর রাজত্ব। দক্ষিণ বাংলায় তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তবে বানে ডুবে মরে না, তালগাছের এই একটা সুবিধে। নিচু জায়গাতে হলেও ভয় নেই।

বড় উঁচু তালগাছ মানুষের বড় উপকার করে। ঝড়-বাদলের সময় তালগাছ বিদ্যুৎ পরিবাহক, তালগাছ মানুষের জানমাল রক্ষা করে। বর্তমান বিশ্বে বজ্রপাতে প্রচুর মানুষ মারা যায় তালগাছের অভাবে বা গাছ কমে যাওয়ায়। নতুন করে বাংলায় তালগাছ লাগানোর সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা একটা আনন্দের সংবাদ।

একটা বড় খবর দেওয়া হয়নি। বড়পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটা দীর্ঘদেহী তালগাছ ছিল। নাম হাঁড়িতাল। আসলেও হাঁড়িতাল। এক একটা তাল প্রায় হাঁড়ির মতো বড়। একটার ওজন তিন-চার সের হবে। এই গাছের তালের প্রতি পুরো ঝামটে গ্রামের অধিবাসীদের নজর ছিল।

তো একবার হলো কী, গাছটায় বাজ পড়ল। অনেক দিন গাছটা ঝিমিয়ে ছিল। বড় গাছ তো! আঘাতটা ধীরে ধীরে কাটিয়ে আবার সতেজ। তালের আকারও কমেনি। যেমনটা ছিল তাই। গ্রামের সবাই খুশি Ñ এই একটা তালগাছের নিরাময় হওয়ায়, বিশেষ করে আমরা, যারা গাছের নিকট প্রতিবেশী। এই গাছের একটা তাল পাওয়া মানে সারা বছরের তাল কুড়োনো। কোয়ালিটি বিকামস কোয়ান্টিটি।

এই হাঁড়িতালের অদূরে মাঠের মাঝখানে ছিল আর একটা তালগাছ। মাঝারি সাইজ। আকার অনুযায়ী তালের প্রকার। এটা ফাউ। তবে হাঁড়িতাল না পেলে এটাই একশ। অদূরে একটা ছোট বাঁশঝাড়। আর একেবারে পুকুরের পাড় ঘেঁষে একটা নবীন তেঁতুলগাছ। এই গাছটা আমার খুব প্রিয় ছিল। কারণ খুব সহজে উঠতে পারতাম। তেঁতুলের সময় পার হয়ে গেলে কচি তেঁতুলপাতাও মুখে পুরতাম। নর-বানর পার্থক্য ঘুঁচে যেত।

এই জায়গাটা আর ছোটবাগান ছিল আমার ভাই-ব্রাদারদের আস্তানা। কালেভদ্রে যেতাম বড়বাগানের দিকে। অনেকটা দূর তো! মা চোখে হারাতে চাইতেন না তাঁর সন্তানদের। আর ঝামটেয় ছেলে ধরার ভয় দেখানো ঘুম পাড়ানোর মায়েদের একটা কৌশল ছিল। আর রাতে জুজুবুড়ি তো ছিলই। তবে ছেলেধরাটা শুধু কথার কথা নয়, সত্যি ছেলে ধরে বিক্রি করে দেওয়াও একদল লোকের ব্যবসা ছিল। যেমন এখনো আছে ছোট-বড় যে-কোনো কাউকে অপহরণ করে মুক্তিপণ চাওয়া। ভুক্তভোগী ছাড়া এ-যন্ত্রণা আর কেউ বুঝবে না। সুতরাং ছেলেধরা একটা বড় ট্যাবু বা বাধা বা ভীতি ছিল সমাজে এবং বলতে গেলে এখনো আছে।

সব তাল পাকলে মিষ্টি হয় না। অনেক তাল তিতে। তাই তিতে তাল শাঁস হিসেবে খেয়ে ফেললে ভালো কাজে লাগে। শাঁস তিতে হয় না। আর তা করতে না পারলে পেড়ে গাদা করে রাখলে গজা হয়। গজা তিতে নয়। সুতরাং তিতে তালেরও কদর আছে। কাঁচা শাঁস খেতে খুব স্বাদু। আর গজাও কম যায় না। ভেতরের গজা বা গাছের কুঁড়িটি ছাড়াও শাঁস থাকে। নরম মোমের মতো। ওটাও খেতে মজা। আবার এই মজার আঁটি শুকিয়ে জানুন হয়। তালের কোনো কিছুই ফেলা যায় না। অনেকটা নারকেল গাছের মতো। কোনো কারণে তালগাছ কাটা গেলে তার ভেতরের নরম থোড়টাও খেতে সুস্বাদু। আর তালপাতার পাখার কত কদর। বাংলার লোকশিল্পের একটা বড় উপাদান তালপাতার পাখা।

গ্রামবাংলায় তালগাছ নিয়ে অনেক সময় খুনোখুনি পর্যন্ত হয়ে যায়। কথায় বলে, তালগাছটা আমার। তালগাছের জন্যে লোকে তাল ঠুকে মামলা করে।

গ্রামবাংলায় তালগাছের হাজার ব্যবহার। ডিঙি বা ডোঙা ছাড়া তালপাতার ছাউনিও বেশ দীর্ঘজীবী।

তালপাতায় লেখাপড়াও হয়। মধ্যযুগে তালপাতায় অনেক চিত্রিত পুঁথি তৈরি হতো। এই পাতাকে আবার নানা প্রক্রিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী করার প্রচেষ্টা নেওয়া হতো। অনেক পুঁথি ছিল চিত্রিত। এসব এখন গবেষণার বস্তু। কাব্য ও চিত্র দু-ক্ষেত্রেই।

আজকে বাংলায় তালগাছ দেখে মনেই হয় না এ-গাছ আমার দেশের গাছ নয়। এই গাছের আদিবাস আফ্রিকা মহাদেশ। ওর কৃষ্ণগড়নটি একটি ভালো সাক্ষী। আফ্রিকার জনগোষ্ঠীর মতো খুব শক্তপোক্ত। যেমন ম্যারাথন দৌড়ে অলিম্পিকে আফ্রিকানদের কেউ হারাতে পারে না। তেমনি বাংলার প্রাকৃতিক দুর্যোগে তালগাছ উপড়ে পড়তে খুব কমই দেখা যায়। অথচ আম-কাঁঠাল ঝড়ে পড়ে যায়। এমনকি বিশাল বৃক্ষ শিরীষও মুখ থুবড়ে পড়ে। বটগাছ বাংলার নিজস্ব বৃক্ষ। হাট-বাজার, বিদ্যালয় ইত্যাদি জনসমাগমের এলাকায় এর অবস্থান। বড় একটা নির্ভরশীল আশ্রয়। শুধু মানুষের নয়, কীটপতঙ্গ ও পক্ষীকুলের আশ্রয়স্থল। উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম বেনিয়ান বেঙ্গলিস্কি। গাছের সঙ্গে বেঙ্গল নামটাও জুড়ে গেছে। কী ক্ষুদ্র একটা বীজ থেকে কী বিশাল একটা বৃক্ষ তৈরি হয়। একেবারে ন্যানো-প্রযুক্তি। বটগাছ পূজামণ্ডপে বড় মানায়। তেমনি অশ্বত্থগাছ। গাছের গোড়ায় মনসাঘট বা রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি একটা সহগ দৃশ্য। ঈদগাহ ও মাজারেও এদের দেখা মেলে। লাল রঙের দানবাক্স চোখে পড়ে। বাংলায় দরগাকেন্দ্রিক সুফিবাদী একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। শাহ মখদুম, শাহ জালাল, বদর শাহ, ফুরফুরা শরিফ, বায়েজিদ বোস্তামি, শাহ ফরিদ, শাহ পরান Ñ এমনি প্রচুর দরগার নাম করা যায়। বদর শাহ তো মাঝিদের ত্রাণকর্তা। আমরা বানের সময় মাঠ দিয়ে নৌকো যেতে দেখলে বলতাম :

নৌকো চলে বদর বদর

হাল ধরেছে বুড়ো বাঁদর …

বদর যে বদর শাহ তখন তা জানতাম না।

তালগাছ দেখার জন্যে উত্তর বাংলায় রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে যাওয়ার পথটি আদর্শ। বরেন্দ্রভূমির সৌন্দর্য এই তালগাছ। ভূমির ঢাল আরো সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। এটি বাংলার প্রাচীন অঞ্চলের মধ্যে একটি। সেই ভূতাত্ত্বিক যুগ কোয়ার্টারনারি যুগের ভূমি।

পশ্চিমবঙ্গে হাওড়া স্টেশন থেকে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস ধরে বর্ধমান অতিক্রম করে বীরভূমের বোলপুর পৌঁছতে বিশাল দিগন্ত ও তালগাছের শ্রী দেখার মতো। মনে হয় যেন নন্দলাল বসুর স্কেচে।

আমাদের নিজ গ্রাম সবলসিংহপুরও তালগাছসমৃদ্ধ। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মুণ্ডেশ^রী নদীর তীরে বাবলা আর তাল সোনায় সোহাগা। সবলসিংহপুরের ওপারে গ্রাম হারিশচক আর লতিফপুর (এখন লোকে বলে নতিফপুর) তালগাছসমৃদ্ধ। ছোট নদীটি দেখে মনে হবে রবীন্দ্রনাথ বুঝি এই নদীটি দেখেই তাঁর কবিতা লিখেছেন : ‘আমাদের ছোট নদী, চলে বাঁকে বাঁকে’।

রবীন্দ্রনাথ বাংলার প্রকৃতিকে এমন নিবিড়ভাবে দেখেছেন ভাবলে অবাক হতে হয়। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতটি তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

তালগাছ আফ্রিকা মহাদেশে জন্মালেও সিল্ক রুট ধরে

মধ্য-এশিয়া ও আরব বণিকদের সঙ্গে ভারতবর্ষ ও বাংলায় হাজির হয়েছে। আর এখন তো মৌরসিপাট্টা নিয়ে স্থিতি লাভ করেছে। কে বলবে, তালগাছ বাংলার গাছ নয়?

আর সব গাছকে হারিয়ে তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে।

রবীন্দ্রনাথ তালগাছকে বাংলার শিশুদের মুখে মুখে বসিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য বেশির ভাগ গাছই একপায়ে দাঁড়িয়ে … তবে তাঁর কাব্যের মিল স্থাপনের জন্যে এই তথ্যটুকু যোগ করেছেন।

শান্তিনিকেতনের ভেতরে-বাহিরে অন্তরে অন্তরে তালগাছ বিরাজিত। বিশেষ করে ক্যানালপাড়ের যার সোজা পাকা পিচঢালা রাস্তা গড়ানে নেমে গাছে গোয়ালপাড়া পর্যন্ত। আর দুপাশে বা চারদিকে তালগাছের বাহার।

আবার এখান থেকে প্রান্তিকের দিকে যেতে বাঁয়ে পড়ে তালতোড়। এখানে বিশাল পুকুর ছিল অনেকটা দিঘির মতো। একসময় এটি বাণিজ্যিকভাবে ঘেরান্ডার মধ্যে ছিল না। যখন খোলা ছিল চারপাশে ছিল তালের সার। পুকুরে প্রতিবিম্ব। সে এক দেখার জিনিস। বিশেষ করে শরৎকালে। আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, আর নিচে মেঘ-রৌদ্রের খেলা … আর জলে প্রতিবিম্বের নিরন্তর নিঃসরণ যেন ইউটিউব চলছে। ইউটিউবের কথা যখন উঠল বলে রাখি : এখান থেকে জানতে পারি যে তালগাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম হলো বোরাসাস ফ্ল্যাবেলিয়ার (Borassus Flabelliar)।

ছেলেবেলায় বৈশাখি মেলায় তালপাতার সেপাই ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলনা। এটা একটা চাই-ই চাই। খুবই সস্তা। এক আনা বা দু-আনা।

তালগাছ অবশ্য ভয়েরও আকর। তালগাছে মামদো ভূতের বাসা।  অনেক  সময়  রাতে  একা  বেরোলে  ভূত  তালগাছের   মাথায় উঠিয়ে নিয়ে যায়।

তালগাছে সবচেয়ে সুন্দর জিনিস হলো বাবুই পাখির আবাস। কী নিখুঁতভাবে তৈরি। সূক্ষ্ম কারিগরি। ইঞ্জিনিয়ারিংটাও দেখার মতো। একপাশে পেটমোটা বাঁকানো। যেখানে ডিম ফুটবে। বাচ্চা বাস করবে। বাসায় ঢোকার ফুটো বা দরজাও মজবুত করে তৈরি। সবই খড়কুটো আর পাতার শিরা দিয়ে নির্মিত।

ময়ূর যেমন সৌন্দর্যে Ñ তেমনি বাবুই কারিগরিতে সেরা।  আর গানে : ‘ও কালো কোকিল তুমি, আর ডেকো না।’ দৌড়ে? উটপাখি। ডুবুরি, পানকৌড়ি। মাছ ধরায় তীক্ষè নিশানা মাছরাঙা। মানুষের তৈরি ময়লা সাফে কাকের জুড়ি নেই। আর মৃত প্রাণীর পচাগলা দেহটি সাফ করছে শকুন। কাকে ফেলে কাকে রাখি। তবে বাঙালিদের প্রিয় পাখি দোয়েল, শালিক, বুলবুলি আর টিয়া। মুনিয়াও কম যায় না। ছাতারে বা সাতভাই পাখির ছাইরঙা পাখিগুলির বাগড়া উপভোগ্য। দাঁড়কাক বড় চেহারার হলে কী হবে ডাকের মধ্যে কেমন একটা বিরহবোধ আছে। হাঁড়িচাঁচা চ্যাঁ-চ্যাঁ করে বাড়ির গাছে ফল পাকার খবর দেয়। আর হলুদবউ, হলদেগুড়গুড়ি বা কনেবউ লাজে রাঙা হয়ে আছে সব-সময়। এছাড়া ময়না? বড় বেশি আদরের। ‘ও আমার ময়না গো …’ সলিল চৌধুরীকাকা তাঁর সুরে ময়নাকে কি আদরেই না ডেকেছেন। কাকাতুয়া দাঁড়ে বসে ঘাড় ফুলিয়ে বলবে, ওই চোর, ওই চোর … ধর ধর … ওই চোর।

টেলিগ্রাফের তারে ঝুঁটিঅলা ফিঙের লেজ দুলছে। দুপুরের করুণ সুরের সঙ্গে ঘুঘুর ডাক বাঙালির মনকে উদাস করে দেয়। সবার তখন মন কেমন করে। কেমন যে করে তা সে নিজেও জানে না। বাউল বনে যায়।

সবচেয়ে সুখের আর আদরের পাখি হলো পায়রা বা কবুতর বা কইতর।

তালগাছে পাখির বাসা খুব সুরক্ষিত। কিন্তু পাখির ডিম বা বাচ্চা খাবার লোভে সাপের আনাগোনাও বাদ যায় না।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলো। মানে ভারতবর্ষ ভাগ হলো। তিন ভাগে। ১৯০৫-এর পর এই সময় বাংলা ভাগ হলো দ্বিতীয়বার।

১৯৫০ সালে আমাকে ঝামটিয়া, সবলসিংহপুর ও কলকাতা ছাড়তে হলো। বদলি নেওয়ায় বাবার কর্মক্ষেত্র কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম শহরে যেতে হলো।

তারপর দুটি রাষ্ট্রে পাসপোর্ট-ভিসার প্রবর্তন। আমার জন্মভূমিতে আসি এখন বিদেশি।

২০০০ সালে যাই ঝামটিয়া ও সবলসিংহপুর। মাঝে কেটে গেছে পঞ্চাশটি বছর। আমি তখন প্রৌঢ়। মামাবাড়ি ও নিজ বাড়ির অনেক কিছুই বদলে গেছে। তবে সবচেয়ে অবাক হলাম, শৈশবে আমার দেখা সেইসব তালগাছের একটাও নজরে পড়ল না।